প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৬

ছয়

পিলুটা যে কোথায় গেল! মায়া দেখল, বাবা বিড় বিড় করে বকছেন। এই অসময়ে কেউ বাড়ি ছাড়া হলেই যেন দুশ্চিন্তা। মায়া রাস্তায় দৌড়ে গেল। 

বাড়িটাতে লোকজন আসছে যাচ্ছে। দুঃসংবাদ পেয়ে সবাই আসছে। বাবা এতক্ষণ মাকে বোঝ প্রবোধ দিচ্ছিলেন। কিছু ধর্মগ্রন্থ সম্বল। বারান্দায় বসে বাবা মাকে বলছিলেন, ধনবৌ, আমরা সবাই নিমিত্ত মাত্র। দুশ্চিন্তা কর না। তাঁর স্মরণ নাও। তিনিই গতি, তিনিই কর্তা। তিনিই প্রভু তিনিই সব কিছুর সাথী। আশ্রয় বলতেও তিনি। তিনি আমাদের শরণ সুহৃৎ। আবার তিনিই প্রলয়, তোমার আমার উৎপত্তির আধার। লয় কিংবা অবিনাশী বীজ স্বরূপ সেই অনন্ত জিজ্ঞাসার কাছে আমাদের মাথা নোয়ানো ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই। বিচলিত হলে চলবে কেন! সবাই সকাল থেকে উপবাসে আছি। রান্নার আয়োজন কর। 

যেন বাবা মাকে সবার উপবাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংসারে তাঁর দায় সম্পর্কে সচেতন করে দিতে চাইলেন। পিলু কোথায় গেল আবার। আসব বলে বের হয়ে গেল, ফেরার নাম নেই। তারপরই বিড় বিড় করে কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন। বাবা নিজেকে অসহায় ভেবে ফেললে, কোন কবচ পাঠ করে থাকেন। এতে তাঁর মধ্যে সাহস সঞ্চয় হয়। সব দুগর্তির প্রতি কিঞ্চিত তিনি অবহেলা দেখাতে পারেন। 

মায়া টের পেয়েছিল, ছোড়দা ফিরে না আসায় বাবার এই দুশ্চিন্তা। এখন যেন বাড়ি থেকে কারো বের হয়ে যাওয়া ঠিক না। ছোড়দাটাও বড় অবুঝ। দেখছিস বাড়িতে কী বিপত্তি—তার মধ্যে না বলে না কয়ে কোথায় চলে গেলি। আসছি বলে গেছিস, এখনও ফেরার নাম নেই। মায়া রাস্তায় ছুটে গিয়ে দেখল, যদি দাদা ফিরে আসে। বড় সড়ক থেকে মাঠ ভাঙতে হয়। কিংবা নিমতলার দিকে যদি যায়। সে চারপাশে দাদাকে খোঁজার সময়ই দেখল—পরীদি আসছে। আর পরীদির পেছনে ছোড়দা সাইকেল চালিয়ে আসছে। ছোড়দা তবে পরীদিকেই খবর দিতে গেছিল। 

সে দৌড়ে এসে বলল, বাবা, পরীদি আসছে। 

খবরটাতে বাবা ভারি বিব্রতবোধ করলেন। 

বাবা বললেন, পিলু ওর চিঠিটা যে কোথায় রেখে গেল। যেন তিনি ভাবলেন, পরী যদি এসে টের পেয়ে যায় তারই জন্য বিলু চলে গেছে, তবে আর এক কেলেঙ্কারি। মেয়েটাই বা কী ভাববে। এমন অপরিণামদর্শী পুত্র যে চিঠি পর্যন্ত রেখে গেছে। এত কথা লেখার কী দরকার ছিল। পরী তো এসেই বিলুর ঘরে ঢুকে যাবে। নিজের মধ্যে তিনি পুত্রের দায় নিয়ে কিছুটা বিচলিতই হয়ে পড়েছেন। 

তাড়াতাড়ি বিলুর ঘরে ঢুকে গেলেন। চিঠিটা যদি এখানে সেখানে পিলু গুঁজে রাখে। আর পরী তো এসে সব খোঁজাখুঁজি করতেই পারে। কারণ বিলু কখন বাড়ি থাকবে না, কোথায় যাবে আগে থেকেই পরী জানতে পারে। সেই বিলু নিখোঁজ। কোনো চিঠিপত্র যদি রেখে যায়। 

পরীদি আসছে শুনলে বাবা রাস্তা পর্যন্ত ছুটে যেতেন। 

—পরী আসছে। কোথায় রাস্তায় গিয়ে বলতেন, মা অন্নপূর্ণা আবার আজ গরীবের ঘরে এলেন।

বাবার এমন উক্তি একবার পিলু প্রকাশ করতেই বিলু চটে লাল। মা অন্নপূর্ণা! তা হলেই হয়েছে।

সেই বাবা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মায়া উঁকি দিয়ে দেখল, বাবা দাদার বই হাঁটকাচ্ছেন, ছোড়দার খাতা বই খুঁজছেন। এবং প্রচন্ড ঘামছেন। দাদার তোষক তুলে দেখছেন। তক্তপোষের ধারে উঁকি দিয়ে খুঁজছেন। জানালার জাফরি আরও তুলে দিয়ে ঘরের অবস্থা লন্ডভন্ড করে ফেলছেন। একপ্রস্থ ছোড়দা করে গেছে, শেষ প্রস্থ বাবা করছেন। মায়া ভাবছে সব তাকে গোছগাছ করতে হবে—রেগে কাঁই। পরীদি উঠোনে ঢুকেই বলল, এই মায়া, মাসিমা কোথায় 

—মা ঘরে শুয়ে আছে। 

—মেসোমশাই। 

–দাদার ঘরে। 

মিমি পিলুকে বলল, সাইকেলটা রাখ ঘরে। সে শাড়ি গাছ কোমর করে বাঁধল –-তারপর ছুটে দাদার ঘরে ঢুকে অবাক—মেসোমশাই ঘরের সব কিছু টেনে নামিয়েছেন। মুখে ঝুলকালি। ফতুয়ায় ঝুলকালি। ঘেমে নেয়ে গেছেন। বিধ্বস্ত সব কিছুর মধ্যে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। 

ঘরে ঢুকেই পরীর মনে হল পুত্রশোকে যেন পাগল মানুষটা। অন্তত দেখলে তাই মনে হয়। পরীর কথায় হুঁস ফিরতেই তিনি ফের তক্তপোষের নিচে ঢুকে কী সব টেনে আনতে থাকলেন। 

—কী খুঁজছেন। আমাকে বলুন। কী অবস্থা করেছেন। 

পরী দেখছে মেসোমশায়ের মাথাটাও ঝুলকালিতে লেপ্টে আছে। মাথায় ঘাস পাতার মতো কী সব জড়িয়ে আছে। আসলে আগে এই ঘরে পরী দেখেছে গরুর ঘাস কেটে রাখা হত। বিলুদের তখন দু’টো ঘর সম্বল। একটা মাটির দেয়ালের, আর বিলুর ঘরটায় পাটকাঠির বেড়া। চারপাশে আম, জাম, গাছ, লিচু গাছের কলম, পেঁপে গাছ কলা গাছ, যেমন প্রথম দিকে কলোনির ঘর বাড়ি হয়ে থাকে—সেই মেসোমশাই ধীরে ধীরে কীভাবে নিজের শেকড় বাকড় চালিয়ে দিলেন, বিলুটা বুঝল না। এত অবুঝ কখনও হলে চলে। 

কিন্তু তিনি পরীকে দেখে আদৌ খুশি হননি। 

—এই বুঝলে, পিলু এসেছে! কখন বের হয়ে গেল! ফেরার নাম নেই। 

পরী মেসোমশাইয়ের কাঁচা পাকা চুল থেকে আম পাতা তুলে বলছিল, পিলু ফিরেছে। কী খুঁজছেন বলুন না। আমি দেখছি। তারপরই ডাকল, এই পিলু, পিলু। শোনতো, মেসোমশাই কী খুঁজছেন দ্যাখতো। খুঁজে পাস কিনা দ্যাখতো। 

পিলু ঘরে ঢুকে বাবার অবস্থা দেখে হতভম্ভ। সে জানে বাবা কী খুঁজছেন! পরীদিকে বলল, দাদার চিঠিটা খুঁজছেন। 

বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, দাদার চিঠি দিয়ে কী তোমরা আমার আদ্যশ্রাদ্ধ করবে, যে সেটা ঠিক ঠাক আমাকে রেখে যেতে হবে! 

পরী কখনও মানুষটিকে এত উতলা হতে দেখেনি। এমন কী রাগতেও দেখেনি। চিঠিটা তবে তাঁর খুবই জরুরী। শত হলেও পুত্রের চিঠি। তাঁর অধিকার বেশি, পরী যেন ভাবতে পারছিল না। সে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে বলল, এটা খুঁজছেন। আমার কাছে ছিল। 

—তোমার কাছে! 

পিলু পড়ে গেছে বিপদে। সেই চিঠিটা দাদার, নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে। এখনও বাবা ঠিক বুঝতে পারছেন না—পরীদির হাতে চিঠিটা গেল কী করে! 

কেমন অবুঝ শিশুর মতো পরীর দিকে তাকিয়ে থাকল মানুষটা—ছি! ছি! মিমি কী না জানি ভাবল তাঁর পুত্রের সম্পর্কে। কত বড় আশা ছিল বড় পুত্রকে নিয়ে। সেই পুত্র, পিন্ডদানের অধিকারী যিনি, যিনি তাঁর পারলৌকিক কাজের প্রথম অধিকারের দায় বহন করছেন—তিনি কিনা একটি নিষ্পাপ মেয়ের উপর কলঙ্ক চাপিয়ে উধাও। –এত অমানুষ তুমি! মাথায় তোমার পোকা ঢুকে গেছে। পোকার কামড়ে যা খুশি আচরণ করতে পার—তা তোমার ব্যক্তিগত অভিরুচি, তাই বলে একটি নির্দোষ মেয়েকে তোমার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জড়াতে গেলে! তুমি তোমার মা বাবার মর্যাদার কথা ভাবলে না, মেয়েটির পারিবারিক মর্যাদার কথা তোমার মাথায় এল না। গায়ে হাত তুলেই ক্ষান্ত হলে না, তার মাথায় কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেলে। তুমি মানুষ! তুমি আমার পুত্র। কেন তুমি চলে গেছ, তার ব্যাখ্যা—পরীর জন্য চলে গেছ! 

পরী বললে, বসে থাকলেন কেন। উঠুন। 

পিলু উঠোন থেকেই সব লক্ষ্য করছে। কাছে যাওয়া ঠিক না। কারণ হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেছে বাবা, তারই জন্য। চিঠিটা আসলে বাবা গায়েব করে দিতে চেয়েছিলেন—সেটা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাবার মাথা ঠিক থাকতে নাই পারে। বাবাকে তো জানে, বড় অপকর্ম করেও দেখেছে, বাবার হাসি মুখ। যা হবার হয়ে গেছে—তাঁরই ইচ্ছে। হাত পা ধুয়ে পড়তে বসগে। আবার সামান্য খুঁত টের পেয়ে বাবা অগ্নিশর্মা। চিঠিটা নিয়ে বাবার এই এত জলে পড়ে যাওয়া কেন সে বোঝে না। 

পরী হাত টেনে বলল, ইস কী করেছেন—এই মায়া, একটা গামছা নিয়ে আয়। চিঠিটা নিয়ে বসে থাকলেন কেন, দিন আমি রেখে দিচ্ছি। কোথায় রাখব বলুন। 

পিলু দেখছে বাবা কেমন নিথর হয়ে গেছেন। বাবা তো এত ভেঙ্গে পড়েন না। দাদার কষ্টে, না চিঠিটা জানাজানি হয়ে গেল সেই কছে। পরীর মাথায় কলঙ্ক চাপিয়ে গেছে তাঁর সু-পুত্র। 

পরী আবার বলল, উঠুন মেসোমশাই। সকাল থেকে আপনারা কেউ কিছু খাননি। বিলু ভালই আছে। আমি সব খবর নিয়েছি। ওর জন্য ভাববেন না। কলকাতায় ওর চেনা জানা বন্ধু আছে। আমাদের অপরূপা কাগজে তাঁরা লিখতেন। এখানকার কবিতা পাঠের আসরে তাঁরা এসেছেন। সঙ্গে তো টাকা পয়সা নিয়েছে। কলকাতায় একটা পেট যে কোনো লোক চালিয়ে নিতে পারে। ও তো লেখাপড়া জানা ছেলে। আপনি এত ভেঙ্গে পড়ছেন কেন। উঠুন। 

পিলু দেখল, বাবা বের হয়ে গেলেন ঠিক, তবে তাঁর ভেতর আগের মানুষটা যেন নেই। মহা অপরাধ করেছেন এমন ভাব চোখে মুখে। এসে তিনি বারান্দায় বসলেন। 

পরীদি জানে বাবাকে কী করে তুষ্ট করতে হয়। সেও জানে, মায়াও জানে। পরীদি নিজেই নারকেলের ছোবড়া ছিঁড়ে হাতে দ্রুত ঘষে একটি পিন্ড বানিয়ে ফেলল। আগুন দিল সেই পিন্ডস্থানে। তা কলকেয় রেখে ফুঁ দিতে দিতে বাবার দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বলল, মেসোমশাই, তামাক 

বাবা কেবল দেখছেন পরীদিকে। 

পরীদি খুবই দ্রুত কাজ করছে। মা’র কাছে গিয়ে বলল, মাসিমা উঠুন। বিলু ভালই থাকবে। বাবাকে যা যা বলেছে, মাকেও তাই বলল। তারপর পরেশবাবুর কাছে গিয়ে যে খোঁজখবর নিয়েছে তাও জানাল। 

মায়া আর পরীদি যেন এখন বাড়িটায় সব। তারাই কোথায় কী আছে টেনে বের করছে। নবমী বুড়ি বলছে, আমায় দিনগো কাটাকুটির কাজটা সেরে ফেলি। 

পরীদি ডাকছে, এই পিলু, রান্নাঘরে দু-বালতি জল দে। তারপর যা গরুগুলি মাঠে দিয়ে আয়।

বাবা বসে বসে তামাক টানছেন। কোনো বিষয়ে যেন তাঁর আর আগ্রহ নেই। চাকরি ছেড়ে গেল, কোথায় গিয়ে উঠবে জানিয়ে গেল না, একটি নিষ্পাপ মেয়েকে জড়িয়ে দিয়ে গেল। এত সব অপকর্ম বাবার মতো মানুষের পক্ষে যে খুবই দুঃসহ পিলু বোঝে। পরীও মানুষটাকে দেখে দেখে ধাত বুঝে গেছে। 

এখন যে কোনো প্রকারে মানুষটাকে ঠেলেঠুলে ঠাকুর ঘরে পাঠাতে হবে। আর মাসিমাকে তুলে চানটান করিয়ে কিছু মুখে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। 

পরী বলল, এই মায়া, রান্নাঘরে কাঠগুলো রেখে আয়। পরী এ-সব পারে। কারণ পরী ক্যাম্প করতে গিয়ে নানাভাবে নিজের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার এবং পার্টি করতে গিয়ে নানা জায়গায় যথেষ্ট অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও বেশ আনন্দের সঙ্গেই রাত্রি দিন উজাড় করে দিতে পারার স্বভাব কবে থেকে যেন গড়ে তুলেছিল। সুহাসদা মহেশ নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারে তাকে হঠাৎ কেন যে বলল, তোমার অসুবিধা হবে। আসলে মনে হয় দাদুই তাকে ফোনে সব জানিয়ে দিয়েছিল। সুহাসদা সেই ছোটবেলা থেকে তাকে জানে। সুধীনদা জানে, শহরের এই মেয়েটি কিছুটা পাগলা আছে। এটা যদি পাগলামি হয় হবে। তার কিছু করার নেই। তার হাতে এখন কত কাজ। 

পরীদি এক ফাঁকে এসে বলল, মেসোমশাই, চিঠিটা কোথায় রাখব। 

বাবা বললেন, রেখে দাও, তোমার কাছেই রেখে দাও। পিলুকে দিতে যেও না। ওর তো কত বান্ধব! সে কী বোঝে কিসে কী হয়! 

পিলুর মনে হল, যাক তবু যে বাবা কথা বলেছেন। বাবাকে সে জীবনেও অমন চুপচাপ হয়ে যেতে দেখেনি। একটা চিঠি সামান্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বাবা এ-ভাবে আতান্তরে পড়ে যেতে পারেন এই প্রথম টের পেল। তার খুবই আতঙ্ক – যে বাবাকে সে দেখে গেছিল, ফিরে এসে যেন অন্য বাবাকে দেখছে। বাবা কথা বলায় কেমন কিছুটা হালকা হতে পেরেছে। চিঠিটা পরীদিই রেখে দিল। আসলে বাবা বোধহয় বুঝেছে, চিঠিটা দাদা বাবাকে লিখে যায়নি, তাকেও না—লিখে গেছে পরীদির কথা ভেবেই। পরীদি না থাকলে হয়তো দাদা চিঠিটা লিখে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করত না। 

এতে তার দাদার উপর ফের কেন যে অভিমান হল সে বুঝতে পারছে না। 

মায়া কাঠ কুটো রান্নাঘরে নিয়ে রাখছে। পরীদি টিন থেকে মুড়ি বাতাসা বের করল। দুধ গরম করে থালায় ঠান্ডা হতে দিল। বাবাকে, মাকে, মায়াকে খেয়ে নিতে বলল, কিন্তু বাবা ঠাকুর-সেবা না করে জল গ্রহণ করেন না। পরীদি যে জানে না তা নয়। তবে আজ হয়তো পরীদির মধ্যেও কিছু গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে। 

বাবা বললেন, আমার তো পূজা আছে মা। তুমি নিয়ে যাও। 

—একটু খেলে কিছু হবে না। 

—না না। 

—তবে তাড়াতাড়ি যান। 

কারণ শুধু তারা কেন, পরীদিও জানে বাবা আজ ঠাকুর ঘরে ঢুকলে কখন বের হবেন কেউ বলতে পারবে না। যদি একশ একটা তুলসীপাতা নারায়ণ শিলার মাথায় চাপান — তবে দুপুর পার করে দেবেন। আর যদি মনে মনে সহস্র তুলসী স্থির করে থাকেন তবে তো হয়েই গেল। বেলা পড়ে যাবে—বাবা পদ্মাসনে বসে থাকবেন। আর উৎসর্গ করবেন সহস্র তুলসীপাতা। জীবনের অজস্র বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার এই উপায় বাবার জানা আছে বলেই তিনি এই বনজঙ্গলের মধ্যে ঘরবাড়ি বানিয়ে নিরুপদ্রবে বসবাস করতে পেরেছেন। 

পিলু লাফিয়ে লাফিয়ে কাজ করছে। দু-বালতি জল রান্নাঘরে রেখে দিল। সে গোয়াল থেকে গরু বের করে মাঠে দিয়ে এল। বাবা কিছুদিন থেকে বাড়ির কাজের লোক খুঁজছিলেন। নিরাপদদাকে রাখার কথা হয়েছিল। কিন্তু মা’র পছন্দ না। মাথায় গোলমাল আছে। কিন্তু তার খুবই পছন্দ নিরাপদদাকে। বাবারও। 

বাবার এক কথা, কার মাথায় গন্ডগোল নেই ধনবৌ। সবাই গোলমালে ভুগছে। গোলমালেই সংসার। গোলমালেই জন্ম মৃত্যু। গোলমালে পড়ে গিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড ঘুরছে বোঁ বোঁ করে। কে কার মাথার দিব্যি দিয়েছিল বল, বোঁ বোঁ করে ঘুরতে। এমন ঘোরা শুরু হয়েছে তেনার কবে থামতে পারবেন জানেন না। থামলেই প্রলয়। 

মা-র এক কথা, এই শুরু হল। 

বাবা খুবই কাতর গলায় বলেছিলেন, নারে, নিরাপদ, বাড়ির দেবী তোর প্রতি তুষ্ট হতে পারছেন না।

নিরাপদদাও ছাড়বার পাত্র না। 

তারও এক কথা। 

—কর্তা রাখেন, রেখে দেখেন। আমি বলরামবাবুর বাগানে ছিলাম। মাঠে পড়ে থাকতাম। কর্তা একটাই মহা-অপরাধ। ভাত বেশি খাই বলে ছাড়িয়ে দিল। 

—তুমি ভাত বেশি খাও বলে ছাড়িয়ে দিয়েছে, না রাতে এর ওর বাড়ি ঢিল মেরে বেড়াও বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। 

ধরা পড়ে নিরাপদদা মা’র দিকে আর তাকাতে পারল না। তার এই একটা ব্যামো আছে। রাত হলেই, তার মাথায় পোকা ঢুকে যায়। কে কখন অপমান করে মনে রাখে। একবার বাবুদের কাঁসার থালা হারাল বলে গাছপেটা করল। বগি থালাটা সে নিয়েছিল ঠিক তবে তাকে ধরতে পারেনি। বাজারের মুকন্দ হালদার মশাই ওজনে মেরেছে—তাতেও কষ্ট ছিল না। পয়সা কম দিয়েছে তাতেও কষ্ট ছিল না। কিন্তু সে পাউরুটি চা খেয়ে দোকানে সব টাকা ফুটিয়ে দিতেই মনে হল—আরে আরও ক’দিন পাউরুটি চা খেতে পারত। সে বিড়ি খায় না, ভাত খায় না, নেশা নেই—একটাই নেশা, সকাল হলে বাদশাহী সড়কে বসে সকালের দিকে এক কাপ চা আর কোয়াটার পাউন্ড পাউরুটি। চা-এ পাউরুটি ভিজিয়ে খাবার নেশাটাই যত নষ্টের গোড়া। সে তখনই টের পেল মুকুন্দ হালদার তাকে ঠকিয়েছে। ঠকিয়েছে বলে, এমন প্রিয় খাওয়া থেকে নিরস্ত হতে হল আচমকা। চোর ছ্যাঁচোড় মুকুন্দ হালদারের কাছে গিয়ে চোটপাট।

—মাপেন থালাখানি আবার মাপেন! 

—কিসের থালা? 

—ক্যান যে বগি থালাখান দেলাম। 

—দেলাম। শুয়ার তুই আমারে থালা দিয়েছিস! 

—দেলাম না। ওজনে মারলেন। 

—পেলি কোথায় থালা। বল কোথায় পেলি। 

—সে দিয়া কাম কি। 

মুকুন্দ আর নিরাপদ লড়ালড়ি। 

মুকুন্দ তাকে বলে, চোর। 

সে মুকুন্দকে বলে, চোর। 

বাবুমশাই জানতে পেরে বলেন, এই মুকুন্দ, দেখি থালাখানা। 

মুকুন্দ বাবুমশাইকে ভয় পায়। সে নিয়ে দেখাল। 

আরে এটাতো সেই থালা। 

ধর ধর। 

নিরাপদ দৌড়ায়, বাবুমশাইয়ের চাকর-বাকর দৌড়ায় এবং তাকে ধরে ফেলে গাছপেটা করলে, এক কথা তার, মারেন, যত খুশি মারেন। আমার দোষ নাই। ভূত ছাইড়া দিলে মজা বোজবেন! খুদা পাইলে কার দোষ। আমার। কার খিদা পায় না কন। 

সেই ভূত নিরাপদ নিজে। গভীর রাতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। আর ইট পাথর কুড়িয়ে বাবুমশাইয়ের বাড়ির ছাদে ঢিল। টিনের ঘরে ঢিল—বন বন। ঝন ঝন। ধবাস। সে চরকি বাজির মতো দু-হাতে এত দ্রুত ঢিল ছোঁড়ে যে বাড়ির মানুষজন ভাবে, ভূতের কাণ্ড—নিরাপদ ভূত ছেড়ে দিয়েছে— হলে কী হবে, একবার ধরা পড়ে যেতেই তার এই যাদুবিদ্যাটা অকাজের হয়ে গেল। জানাজানি হয়ে গেল, নিরাপদের কাজ। 

নিরাপদদা ওঠার সময় বলে গেছে, ঠাইনদি কথা দিতে পারি, কর্তার হুকুম ছাড়া নড়ানড়ি করমু না। জান দিয়া কাজ করমু। দুই বেলা দুইডা বেশি ভাত দিয়েন, দু’মাসে ন’মাসে একখানা গামছা। বছরে একখানা কাপড়। টাকা পয়সা মনে যা লয় দিবেন। সক্কাল বেলায় ছাইড়া দিবেন, চা-পাউরুটি খাইলে সারাদিন আপনার বান্দা হইয়া থাকুম। 

মা কিছুতেই রাজি হয়নি। 

নিরাপদদা, দাদা নেই খবর পেয়ে এসে গেছিল। গরুগুলি মাঠে দিতে গেলে বলল, যান পিলুদা বাড়ি যান। বাড়িতে কর্তার কত বড় বিপদ। কানে গেল আর ছুইটা আইলাম। ঘাস কাইটা নিয়া যামুনে। কর্তার বাড়িতে দুইডা যেন অন্ন পাই। বিলুদার নাকি মস্তিষ্ক বিকৃতি হইছে। পালাইছে। 

—কে বলেছে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। নিরাপদদা, যা জান না বলবে না। 

—না হলে পালায়! কেউ পালায় কখন। আমি পালাই সক্কালবেলায়, এই গাছপালা বন জঙ্গল, বাদশাহী সড়কে হাঁটা, বেড়ান, বুঝবেন মজাটা! জোৎস্না রাতে বালির ঘাটে গেলে ফিরতে ইসছা হয় না। মারুক ধরুক, আমাকে লোকজনে চেনে। এডা কম কথা—আমি নিরাপদ, যে যার মতো মনে লইয়ে ভাবে—চোর—পাগল, ছাগল কী না কয় আমারে কন। আমি পালাই পালাইতে পারি! নিজের রাজত্বি ছাইড়া কেউ পালায়। 

সেই নিরাপদদা এসে হাজির। এক বোঝা ঘাস মাথায়। বাবা বারান্দায় বসেছিলেন। উঠোনে এসে ঘাসের বোঝাটা ফেলে সটান মাটিতে সোজা হয়ে গেল। 

পরী মায়ার দিকে তাকালে, মায়া মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে দেখাল। মাথার গোলমাল আছে।

বাবা বললেন, ঘাস নিয়ে এলি নিরাপদ। 

—হ কর্তা। ঘাস। বিলুদা চইলা গ্যাছে বইলা মনে কষ্ট। আপনের মনে কষ্ট। পিলুদা একলা পারব ক্যান। এক বোঝা ঘাস নিয়া আইলাম, দ্বিপ্রহরের অন্নভোজন—যদি কৃপা করেন। 

পরী দেখল, লোকটা পরেছে খোট। খালি গা। মাথা ন্যাড়া। মাথায় খুসকি। থুতনিতে দাড়ি। চোখ কোটরাগত। 

মাথার দিকে তাকাতেই পরীকেও প্রণিপাত করে ফেলল। নিরাপদ পরীকে ভাল চেনে। একবার সে পরীদিকেও গাছের আড়াল থেকে ঢিল মেরেছিল—পরীদি বলল, তুমি পঞ্চাননতলায় থাক না। 

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে দু-দন্তপাটি বিকশিত হাসি।—আপনে আমারে মনে রেখেছেন দ্যাখছি।

পরীর কেমন মায়া ধরে যায়। 

পরী বলল, থাক। খাবে। গোয়াল পরিষ্কার করতে পারবে? 

—হ্যাঁ 

—যাও। দেখে শুনে হাত লাগাও। 

পিলু দেখল, একবার কাউকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করল না পরীদি। পরীদির কথায় বাবা খুবই তুষ্ট হয়েছেন। মেয়েটার মধ্যে মানুষের জন্য মায়া মমতা আছে। তার দ্বিতীয় পুত্রটির মতোই। 

নবমী নিজেই বঁটি নিয়ে এল। লাউ-এর মাচান থেকে নরম ডগা কেটে আনল। মাচানের নিচে বসে কচি লাউ হাত দিয়ে দেখল। ভারি মজা লাগে দেখতে। কিন্তু লাউ কেটে হাতে নিয়ে যাবার তাগদ নেই। দা-ঠাকুর এসে হাজির। তুমি পারবে! বলতে পার না। পিলু লাউ কেটে নিয়ে এল। জমি থেকে বেগুন তুলে এনে পরীদিকে দিল। 

এবং পরীদি তখন বলল, মায়া, মাসিমার একটা শাড়ি বের করে দেতো। 

মায়া মাকে কিছু বলল না। কারণ সে জানে সামান্য দামের শাড়ি-ব্লাউজ পরীদি পরলে মা খুশি হবে। 

আসলে কে জানে কোথায় থাকে মানুষের অবলম্বন। পরী এসে বাড়িটার হাল ধরায় সবার মধ্যেই আবার স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। বাবা বললেন, মায়া, তেল দে। চানে যাই। ভেবে আর কী করব! 

মা-ও বলল, তুমি পারবে না পরী। তোমার অভ্যাস নেই। আমি যাচ্ছি। 

ক্রমে সব কেমন সচল হয়ে উঠছে সংসারে ফের। পরীদি তবু পুকুর থেকে চান করে এল। আসার সময় হাতে করে এক বালতি জলও নিয়ে এসেছে। 

নবমী লাউ কেটে দিল ডুমো ডুমো করে। মুগের ডালে লাউ, বেগুন ভাজা, পিলু গিমাশাক তুলে এনেছে। নিমাশাক ভাজা। তেঁতুল দিয়ে লাউ-এর চাটনি। কচু, ডাটা আলু আর লাউ-এর ডগা দিয়ে তরকারি। 

বাবা ঠাকুরঘরে ঢুকে গেছেন। আর আশ্চর্য বাবা নিত্য পূজার মতোই সময় নিলেন। একশ একটা তুলসী দিলে ঠাকুরকে এত তাড়াতাড়ি কখনও বের হতে পারতেন না। তিনি বের হয়ে এসে হাতে প্রসাদ দেবার সময় দেখলেন, পরী বারান্দায় আসন পেতে দিচ্ছে। জলের গ্লাস সাজিয়ে দিচ্ছে। থালায় ভাত বেড়ে দিচ্ছে। এমন কি মাসিমাকেও বলছে, আপনি বসে পড়ুন। আমি দিচ্ছি। নবমীকে বলছে, তোমার পাথরের থালা বের করে বসে পড়। নিরাপদকে ডেকে আনার জন্য পিলকে পাঠাল। কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে। 

পিলু ডাকছে, ও নিরাপদদা, কোথায় গিয়ে বসে থাকলে! 

নিরাপদ অন্ন ফেলে বসে থাকার লোক না! কোথায় গেল! কেউ তাকে যদি আটকে রাখে। রাখতেই পারে। কোথায় কী অপকৰ্ম্ম করে বেড়ায়, নিরাপদকে দেখলে, লোকজন অনেক সময় দূর দিয়ে হাঁটে। কারণ—পাগল, ছাগল মানুষ, বেধড়ক মার খেলেও মাথা গরম করে না। উ আ করে না। কেবল হাসে। ঘটি বাটি বাইরে রাখা দায়। গাছের ফল রাতে চুরি করার অভ্যাস। কোন টানে পড়ে গেছে কে জানে! 

পরী বলল, পিলুকেও ডাক। বসে যেতে বল। নিরাপদ এলে, ওকে দিয়ে আমি বসে পড়ব।

পিলু এসে বলল, আসছেন। 

আসলে নিরাপদর এত দেরি হবার কারণ এতক্ষণে টের পেল পরী। একটাই খোট। চান করেছে, খোটের একটা দিক ধরে বাতাসে শুকিয়েছে। শুকনো দিকটা পরে ভিজা দিকটা শুকিয়েছে। সে দেখেছিল, পুকুরের অন্য ঘাটে সে স্নান করছে। পুকুর না বলে দীঘিই বলা ভাল। সে মায়া পিলু একসঙ্গে সাঁতার কেটেছে। ডুব দিয়েছে। বাড়ি থেকে নেমে একটা জমি পার হয়ে দীঘিটা। এখনও এদিকটায় বাড়িঘর হয়নি। জঙ্গল আছে। পায়ে হাঁটা সরু পথ। শুধু এ-পাড়ার মানুষজনই পুকুরটা ব্যবহার করে। বেশ গভীর এবং কালো জল, এর পাড় দিয়ে পরী পিলুর সঙ্গে একবার বড় সড়কে উঠে গেছিল—কেন যে মনে হয়েছিল, কোনো দিন সুযোগ পেলে দু’জনে এই ঠাণ্ডা জলে অবগাহন করবে। 

আজ করেছে ঠিক, তবে বিলু ছিল না। পিলু ছিল আর মায়া ছিল। তখন কিন্তু ও-পাড়ের ঘাটে কাউকে প্রথমে দেখেনি। পরে দেখতে পেয়েছে। তেল মাখার জন্য নিরাপদ হাতে তেল নিয়েছে। হাতে পায়ে চপ চপ করছে তেলে। যখন নিরাপদ ফিরে এল, হাতে একটা লাঠি। এক হাতে দা, যেন স্নান টান সেরে পবিত্র হয়ে সে বান্দর লড়ির মূল তুলে এনেছে। কেন এনেছে জানে না। এ জন্যও দেরি হতে পারে। 

নিরাপদ লাঠিটা ঠাকুরঘরের বারান্দার চালে গুঁজে রেখে খেতে বসল। পরী আর মায়া পরিবেশন করছে। দুটো বড় কলাপাতা কেটে নিরাপদ অন্ন রাখার জায়গা বড় করে নিয়েছে। ওর পাতা বিছানো দেখেই পরী বুঝেছে, প্রথমেই অনেকটা ভাত দিতে হবে। না হলে ত্রাসে পড়ে যাবে। কতটা খেলে পেট ভরে সে বোধ হয় ভাল জানে না। নিরাপদ ভাত সাজিয়ে বলল, কাচা লংকা নাই ঠাইরেন? 

তারপর নিরাপদ কী ভেবে নিজেই উঠে গেল। গেরস্থরা কোন জমিতে কী লাগিয়েছে, চোখে চোখে রাখার স্বভাব। রান্নাঘরের পেছনে দুটো বারোমেসে লঙ্কা গাছ আছে এ-বাড়িতে সে তারও খবর রাখে। গোটা ছয়েক কালো ধানি লঙ্কা পাতের কিনারে বোঁটা সহ সাজিয়ে রাখল। পাশে নুন দিল মায়া। তার খাওয়ার প্রতি যত্নআত্তি দেখে পরী কেমন মুহ্যমান হয়ে যাচ্ছে। এত যত্ন করে কেউ খায়! খাবার আগে কিছু অন্ন হাতে নিয়ে কপালে ঠেকাল। কিছুটা খেল। উঠোনে সে খেতে বসেছে। কাক শালিক উড়ছে, ঘুরছে। সে কিছুটা অন্ন কাক শালিখের নামে পাতের কিনারে বোধ হয় রেখে দিচ্ছে। 

বাবা বলছেন, পরী, তোমরাও এবার বসে পড়। নিরাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, পেট ভরে খাস। পরী না এলে দুপুরের খাওয়া আজ জুটত না। আমরাও তোর মতো নিরাপদ হয়ে থাকতাম। নবমী বসেছে, তার চালা ঘরটায়। দাঁত নেই। মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে খায়। খুবই সময় লাগে। তার পাথরের থালার পাশে পরী সব সাজিয়ে দিয়েছে। খুবই স্বপ্নাহারী নবমী সে জানে। 

পিলু দেখল, বাবা যেন কী খুঁজছেন। 

আসলে বাড়িতে আজ বাবার প্রায় ছোটখাটো ভোজ। গরুর দুধের সামান্য পায়েসও করেছে পরীদি। পরীদি কত দ্রুত কাজ করতে পারে। কে বলবে, পরীদি তাদের কেউ হয় না। 

বাবা পিলুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার পাশে সামান্য ফাঁকা জায়গা রয়েছে। বাবার কাছে এই ফাঁকা জায়গাটা কেন এত আগ্রহ তৈরী করছে সে বুঝতে পারছে না। তার দিকে তাকিয়েই বাবা চোখ নামিয়ে আনছেন ফাঁকা জায়গাটায়। যেন এখানে বসে আজ কারো অন্নগ্রহণ করার কথা ছিল। সে অন্নগ্রহণ করেনি। কোথাও সে চলে গেছে। আর পাশে রান্নাঘরের দরজায় পরীদি। পরীদিও বাবার এই অন্যমনস্ক চোখ দেখে কিছু টের পেয়েছে। একজন মানুষের মধ্যে কোথাও যে হাহাকার রয়েছে— পরী টের পেতেই রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। আর দেখল বাবা মাথা নীচু করে খাচ্ছেন। বাবা তো সোজা হয়ে খান। কখনও মুখ আড়াল করে খান না। বাবা কী দাদা এই ভোজে নেই বলে, ভেঙ্গে পড়েছেন। কাঁদছেন! 

নিরাপদদা হঠাৎ বাবার দিকে পলকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। কারণ সে উঠোনে খেতে বসেছে। উঁচু বারান্দায় বাবা। উঠোন থেকে তাদের চেয়ে বাবার মুখ নিরাপদর কাছে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। সে বলল, কর্তা নিজে পেট ভইরা খান। শোকতাপ কইরা কী করবেন। কপাল। আপনের মনোকষ্টের কথা জাইনা নিরাপদ আইজ যা করল! বলেই সে বারান্দার চালা থেকে বাঁ- হাতে লাঠি বের করে দেখাল।—এই যে লাঠিখান দ্যাখছেন, এটার গুণ অনেক। লাঠি চালান দিলাম। মাথার উপরে আকাশ, নিচে ধরণীতল, আর আপনের মতো সৎ মানুষের কাছে মিছা কথা কইলে জিভ খইসা পড়ব। ভাইবা দ্যাখেন লাঠিটারে চালান দিলাম ক্যান। ছয় মাসের মধ্যে বিলুবাবুরে দুরমুজ কইরা বাড়িতে ফিরাইয়া যদি না আনে আমার নামে কুত্তা পুইষেন। 

পরী বলল, ঠিক আছে, লাঠিটা রেখে দয়া করে খাও। 

পরীর দিকে তাকিয়ে নিরাপদদা বলল, খাওয়ন ত ফুরাইয়া যাইব না। কিন্তু কথা থাকব। যা কথা তা কাজ। অন্ন মুখে দিয়া কথা কইছি। আকাম, কুকাম করতে পারি, কিন্তু মানুষের অনিষ্ট করি নাই। বেদ বাক্য, ব্রহ্ম বাক্য দুইখান কথা আছে। লাঠিখান গুইজা রাইখা দিলাম। ছয় মাস পরে দেখতে পাইবেন লাঠির গুণ। 

পিলু জানে, নিরাপদদা তুকতাক জানে। তার কেন জানি অবিশ্বাস হল না। দাদা ফিরে আসবে— এমনিতেই আসার কথা, দাদাই লিখে গেছে—নিরাপদদা কেন যে বলল, দুরমুজ কইরা নিয়া আইব। বাবা এতক্ষণে নিজেকে বোধহয় সামলে নিয়েছেন। তিনি মুখ তুলে বললেন, নিরাপদ, পাগলামি করিস না। খা। মা অন্নপূর্ণা তোদের খাওয়া হলে খাবেন। 

কেউ আর এখন পরীকে দেখতে পাচ্ছে না। আসলে তাকে নিয়েই এ-পরিবারে এত বড় অশান্তি। . সেই কারণ। তার বোধহয় খারাপ লাগতে পারে। কে জানে কোথায় সে! আড়ালে লুকিয়ে থাকাই স্বাভাবিক। 

বাবা তখন ডাকলেন, একটু পায়েস আর হবে মা। বড় সুস্বাদু হয়েছে। মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বল, দেবীভোগ মনে হচ্ছে না? মা কথা বলতে পারছিল না। তারও গলা ধরে গেছে। 

পরীদি এক বাটি পায়েস পাতে দিতে গেলে, বাবা হা হা করে উঠলেন।—আরে করছ কী। তোমার জন্য রাখলে না। মায়া তুমি-না না আর দেবে না! 

—খান না মেসোমশাই। 

–একলা খেলে চলে! 

তবু পরী জোরজার করে আরও এক হাতা দিতে গেলে বাবা বললেন, মৃন্ময়ী, আমরা এ-দেশে এসে অগাধ জলে পড়ে গেছিলাম। ভাল মন্দ খাওয়ার কথা ভুলেই গেছিলাম। ভোজ হলে মাথা ঠিক রাখতে পারি না। কিন্তু তোমার জন্য না রাখলে যে খেয়ে শান্তি পাব না। আর দেবে না।

মৃন্ময়ী দেখল, মেসোমশাই বড় তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে পায়েসটুকু খেলেন। দিলে আরও খেতে পারেন। কিন্তু সে না খেলে তিনি কষ্ট পাবেন। 

পিলু পায়েসের বাটিটা দেখছে। 

মৃন্ময়ী বলল, তুই আর এক হাতা নে! 

মা তখন না বলে পারল না।—তুমি কাকে দিচ্ছ। সে দিলে না করে কখনও! পেটুক। না না ওকে দেবে না! তুই কিরে পিলু, মেয়েটা একটু খাবে না। 

পিলু বলল, থাক মিমিদি। দেখ না মা রাগ করছে। 

বাবা তখন হাত চাখছেন। বললেন, অনেকদিন পর বড় তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। অন্নপূর্ণার রান্না। স্বাদই আলাদা। আর দেরি কর না মৃন্ময়ী। এবারে তোমরা বসে পড়। 

পরী হঠাৎ ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সে তার উদগত অশ্রু রোধ করতে পারছে না। মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় তীর্থ আর কী আছে সে জানে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *