প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৫

পাঁচ 

পিলু মিমির গা ঘেঁসে রয়েছে। সিঁড়ি ধরে নামার সময়ও সে মিমির আড়ালে থাকছে। যেন একটু আলগা পেলেই খপ করে তাকে কেউ ধরে ফেলবে। আবার টেনে হিঁচড়ে উপরে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনো পরিত্যক্ত ঘরে আটকে রাখবে। তেমন সুযোগ দিতে সে আর রাজি না। শত হলেও পরীদি তার একা। এত লোকজনের সঙ্গে পেরে উঠবে কেন 

পরীদি সোজা নেমে হলঘরের কোণায় ফোনের কাছে চলে গেল। তাকে ইশারায় বসতে বলে, কাকে যেন চাইল। 

—হ্যালো, হ্যাঁ আমি মিমি। সুহাসদা নেই? 

ও-প্রান্ত থেকে কেউ কিছু বলছে। পিলুর খুব আগ্রহ ফোনে কান পাতার। সে শুনতে চায় দুর থেকে কীভাবে কথা ভেসে আসে। তার এই ফোনের খেলাটা একসময় মারাত্মক ছিল। দেশলাইয়ের বাকসে সুতো বেঁধে অপর প্রান্তে কাউকে কথা বলত। এ-জন্য একবার যা পিঠে পড়েছিল! এমনই নেশা যে নতুন দেশলাইয়ের খোল চুরি করে ধরা পড়ে যায়। সব কাঠি আছে। খোল নেই। মা পই পই করে বলেছে, পিলু তোর জন্য ঘরে দেখছি কিছু রাখার উপায় নেই! তোর কাজে লাগে না কী আছে বলত। দেশলাইয়ের একটা খোল রাখা যায় না। কিন্তু সেবারে আস্ত নতুন দেশলাইয়ের খোল নিয়ে হ্যালো হ্যালো বানাতেই মা বাড়ি এলে বিরাশি সিক্কার ওজনের কিছু কিল, এবং সে পিঠ বাঁকিয়ে দিয়েছিল, শ্বাস নিতে পারছিল না—আর পরীদি সত্যিকারের ফোনে কথা বলছে! 

—সুহাসদা পার্টি অফিসে! ঠিক আছে। 

মিমি আবার ফোন কেটে দাঁড়িয়ে থাকল। পার্টি অফিসে ফোন করতে হবে। সে ঘড়ি দেখল। আধ ঘণ্টা আগে বের হয়েছে। গোরাবাজার থেকে রাধারঘাট আসতে কতটা সময় লাগতে পারে আন্দাজ করল মনে মনে। আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। সোজা এলে আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে যাবার কথা। আবার নাও আসতে পারে। পার্টির ক্যাডারদের সামনে যদি পড়ে যায়— তবে এক টানা লেকচার শুরু করবে। তার তো কাজের শেষ নেই—কার হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না, কার রেশন কার্ড হয়নি, কার স্কলারশিপের টাকা আসেনি, কে অকারণে বরখাস্ত হয়েছে, মিটিং মিছিল নিয়ে ব্যস্ত মানুষটা আধ ঘণ্টায় পার্টি অফিসে পৌঁছাতে নাও পারেন। 

পিলু ঠিক বুঝতে পারছে না পরীদি কেন চুপচাপ ফোনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার যন্ত্রটাও নামানো। আর দোতলায় সিঁড়ির মুখে সবাই দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কী গভীর নৈঃশব্দ। 

যেন পরীদির আচরণে গোটা বাড়িটা স্তম্ভিত। কুকুরটা পর্যন্ত রা করছে না। পরীদিকে শুঁকছে। আসলে বাড়ির আগেকার সেই মেয়েটার সঙ্গে এ-মেয়েটার ঘ্রাণ এক আছে কি নেই শুঁকে হয়তো পরীক্ষা করছে। 

পিলু এ-হেন দৃশ্যে খুবই বিচলিত। বাবার মুখের উপর কথা তারাও এক আধ সময়ে বলে ফেলে- কিন্তু এটা যে পরিবারের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি, পিলুর মতো ছেলেও তা টের পায়। অথচ পরীদির কোনো ভাবান্তর নেই। এ-সময় সুহাসদাকেই আবার কেন ফোন। সেও চেনে, এক ডাকে সবাই চেনে মানুষটাকে। রোগা দুবলা, বেঁটে এবং ভারি কাচের চশমা চোখে। একা, সাইকেল তার নিত্য সঙ্গী। সাইকেলে চেপে বসলেই মানুষটার মধ্যে বোধহয় কোনো আগ্রহ সঞ্চার হয়। সে তাদের কলোনিতেও দেখেছে সুহাসদাকে। বাজারের দিকটায় একবার দেখেছিল। মিলের ইউনিয়ন নিয়ে কী সব কথাবার্তা বলছিল। সুহাসদার সঙ্গে সে দেখেছে সব সময় পাঁচ দশটা ছেলে থাকে। হাঁটলে তারা হাঁটে। থামলে তারা থামে। 

—হ্যাঁ আমি। ভাবলাম পাব না। যাক শোনো, আমি কাটোয়া যাচ্ছি। 

অপর প্রান্ত থেকে কথা ভেসে আসছে পিলু বুঝতে পারছে। 

—আরে না। ও-সব কিছু না। 

মিমি আবার থেমে বলল, না আমিই করব। কবে ঠিক হল। 

—মিমি, তোমার যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। এই যে সেদিন বললে, বাড়িতে তোমাকে নিয়ে অশান্তি চলছে। বের হওয়া বারণ। মুখার্জী সাবের সঙ্গে পাকা কথা বলার জন্য তোমার দাদু ওর বাবা মাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। 

—তোমার সঙ্গে এত কথা বলার সময় নেই। আমিনার পার্ট আমিই করব। আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আর শোনো আমার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। ছাড়ছি। 

—কী বলছ! শোনো। আর একবার ভেবে দ্যাখ। ওখানে গিয়ে থাকা খাওয়ার অসুবিধা হবে। তা ছাড়া…. 

—না না। আমি যাব। 

—শোনো তুমি আমিনার পার্ট করতে পারছ না শুনে আমরাতো জলে পড়ে গেছিলাম। পরে ভাবলাম, লীনাকে দিয়েই ঠেকা কাজ চালিয়ে দেব। আমাদের জন্য অকারণ তুমি বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি কর না। মুখার্জী সাব তো দারুণ লোক 

—আচ্ছা আমি ছাড়ছি। 

—তুমি কী বাড়ি থেকে করছ। 

—হ্যাঁ। 

—আমি যাচ্ছি। 

—না। আমি এক্ষুনি বের হয়ে যাব। 

—কাগজ। কাগজ চলছে। 

—ছাড়ছি। 

বলেই মিমি ফোন ছেড়ে বলল, এই পিলু, কী হাবার মতো তাকিয়ে আছিস। চল! 

—আমি কথা বলব। 

–কার সঙ্গে কথা বলবি। 

পিলু এমন মুগ্ধ হয়ে গেছিল, যে সে নিজে কথা বলতে না পারলে, ফোনের রহস্যটা ঠিক জানতে পারবে না! তারপরই মনে হল, সত্যি সে কার সঙ্গে কথা বলবে! সে তো কাউকেই চেনে না। কিংবা অকারণ তো ফোনও করা যায় না। তার হ্যালো হ্যালো খেলাটা এখানে এসে এত বড় বিস্ময় হয়ে গেছিল, যে সে কেমন ঘোরে পড়ে গিয়েই কথাটা বলেছে। 

মিমি কী ভাবল কে জানে। সে ফোন তুলে কাকে কী বলল, তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলল, কর। সুহাসদার সঙ্গে কথা বল। তারপর নিজেই বলল, সুহাসদা, পিলু তোমার সঙ্গে কথা বলবে। পিলুকে চেন না! বিশ্বর ছোট ভাই। যার কবিতার তারিফ করে বলেছিলে— ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে। 

পিলু শিশুর মতো আব্দার করে ফেলেছে টের পেতেই সে লজ্জায় পড়ে গেল। কিছুতেই ফোন ধরছে না। আর এত বড় প্রাসাদের মতো বাড়িতে এত উত্তেজনার মধ্যে মুহূর্তে সে যেন তার এবং পরীদির আগেকার জীবনের সন্ধান পেয়ে গেছিল। কিছুক্ষণ আগে তাকে টেনে হিঁচড়ে উপরে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল—জামা ছিঁড়ে গেছে, হাফ প্যান্টও খুলে গেছিল, এবং ধস্তাধস্তিতে তার পিঠের ছাল চামড়া উঠে গেছে—পিলুকে দেখলে এখন আর বিশ্বাসই করা যাবে না। সে কিছুতেই কথা বলবে না। পরীদির গা ঘেঁসে বলছে, না। তুমি ছেড়ে দাও। 

মিমি হেসে ফোনে বলল, কথা বলবে না। লজ্জা করছে বাবুর 

—দাওনা ওকে। 

—এই পিলু। ধর। 

পিলু এবার বোধহয় সাহস পেয়ে গেছে। 

মিমি বলল, সুহাসদা কথা বলবে। ধর বলছি। আরে উল্টো করে ধরলি কেন। না না, এদিকটা কানে রাখ। তুই আচ্ছা বুদ্ধু। 

পিলু বোকার মতো ধরে আছে। 

—বল হ্যালো। 

পিলু ফোন ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালাল। মরে গেলেও বলতে পারবে না। কেমন কৃত্রিম কথাবার্তা। হ্যালো বললেই সে যেন আর পিলু থাকবে না। সে তার বাবার দ্বিতীয় পুত্র—মাটির ঘরে বাস, ভাঙ্গা সাইকেলটা ধরলে পর্যন্ত দাদার তিরস্কার—আবার স্পোক ভেঙ্গে আনলি, তুই কী রে—তোর হাতে কিচ্ছু ঠিক থাকে না, আমার সাইকেল নিলি কেন—বলেই যে দাদার কানমলা খায়, তার পক্ষে হ্যালো বলা কত কঠিন, পিলুর ছুটে পালানো না দেখলে বোঝার উপায় নেই। 

মিমি ফোন তুলে হেসে দিল। বলল, পালিয়েছে। লজ্জা পেয়েছে। তুমি বিকালে থাকছ তো। যদি পারি যাব। দিনক্ষণ ঠিক হলে জানিও। আমি মুক্ত। জান, আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। 

এবার পরী সিঁড়ির দিকে তাকাল। অবাক দাদু সোজা নেমে আসছে। সে জানে এ-বাড়িতে এই একটিমাত্র মানুষ তাকে যে কোনো কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারে। দাদুকে নেমে আসতে দেখে অবাক শুধু না, কোথাও যেন এক সুপ্ত ছলনা সে টের পেল। দাদুর অসুস্থতা কী তবে ভান! কে জানে, যিনি গোপনে বিশ্বর সঙ্গে মেসোমশাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে রেলের চাকরির নামে একটা গোটা পরিবারকে ঠকাবার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সেই তিনি যে ভান করবেন না কে জানে। তবু দাদুর প্রতি তার টান আছে। সে দাদুকে নেমে আসতে দেখে বলল, আমি বের হচ্ছি। ভেব না। রোজই তো বের হই। এত উতলা হয়ে পড়ছ কেন। চল। ওঠো। অসুস্থ শরীরে কে তোমাকে নামতে বলেছে। ওঠো বলছি। বলে সিঁড়ি ধরে দাদুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তর তর করে নেমে এল। সবাই তার আচরণে স্তম্ভিত। সে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। সোজা নেমে সাইকেল বের করে রাস্তায় নামতেই যেন সেই আগেকার মিমি। তার হাতে এখন কত কাজ। 

পিলু তার পাশে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। টাউন হলের সামনে এসে মিমি বলল, সুধীনদাকে একটা ফোন করলে হত। ঠিক আছে চল। পরে ফোন করা যাবে। 

আজ ছুটির দিন। রাস্তায় রিকশা, সাইকেলের ভিড় কম। তারা পুলিশ ব্যারাক পার হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় রাস্তায় খানা খন্দ। দু’জনই খানা খন্দ বাঁচিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। 

একটা সুন্দর মতো বাংলো বাড়ির সামনে তারা থামল। আসলে পিলু জানে না, তাকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। সামনে বিশাল স্কোয়ার মাঠ। বাঁদিকে অফিস আদালত। আজ ছুটির দিন বলে সব ফাঁকা। এমন কী গাছতলাতেও প্রচন্ড ভিড় দেখেছে পিলু—অফিস টাইমে রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়াই কঠিন। গাছতলায় স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের আখড়া। তাদের ঘিরে কত লোকজন। কোর্ট কাছারি না থাকলে যা হয়—কেমন জনবিরল হয়ে আছে জায়গাটা। 

তার মাথায় দাদার চিঠিটা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। বাবা চান না, চিঠিটা আর কেউ দেখুক। পরীদি কেন যে চিঠিটা ব্যাগে রাখল! 

সে সুযোগ বুঝে বলল, চিঠিটা সঙ্গে নিয়েছ তো। বাবা কিন্তু ফিরে গেলেই চিঠির কথা বলবে। 

–মেসোমশাই দেখেছে! 

—দেখবে না। বাবাই যে চিঠিটা দিল। বলল, অযথা আর চিন্তা করবে না। তোমার খারাপ অভ্যাস–তোমাকে এজন্য বাবু চিঠি দিয়ে গেছেন। 

—মোসোমশাই তোর দাদার চিঠি দিয়ে কী করবেন! 

আর এ-সময় উর্দিপরা একটা লোক ছুটে আসছে। তারা যে গেটে দাঁড়িয়ে আছে কেউ নিশ্চয় ভিতর থেকে টের পেয়েছে। পাঁচিল এবং বাগান পার হয়ে বিশাল বারান্দা। বারান্দায় নীল রঙের বেতের চেয়ার টেবিল সাজানো। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। দূর থেকে সব কিছু এত পরিপাটি দেখেই পিলু বলল, কার বাসা এটা পরীদি। আর তখনই দেখল, আরে সেই লোকটা। তাদের বাড়ি একবার গেছিল—পরীদি পাঠিয়েছিল। বেঁটে মতো। সুন্দর ছিমছাম-লতাপাতা আঁকা আলখাল্লার মতো কী গায়ে। ডোর দিয়ে কোমরের কাছে বাঁধা। এটা খুবই বিচিত্র পোষাক — পরীদিকে দেখে উর্দি পরা লোকটার পেছনে ছুটে আসছে। 

গেটের তালা তিনি নিজেই খুলে দিলেন। গেটের দরজা টেনে ধরলেন। পরীদি তার দিকে তাকিয়ে বলল, আয়। 

আসলে মিমি বুঝিয়ে দিল ছেলেটি তার সঙ্গেই এসেছে। পরেশ চিনতেও পারে। কিন্তু না চেনার ভান করাতেই যেন বলা, আমার সঙ্গে এসেছে। বিশ্বর ভাই। 

—আই সি। তোমাদের বাড়ি আমি গেছি। 

মিমি এটাই চেয়েছিল। বিলুকে পরেশ আদৌ পাত্তা দিত না। কেবল কবিতা পাঠের আসরে বিলুবাবু বিলুবাবু করত। পরেশ এক দিন অবশ্য অভিযোগ করেছিল-বিলু শিষ্টাচার জানে না। হতে পারে। বিলু নাকি তার হাত থেকে পান্ডুলিপির বান্ডিল নিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে। আমি পরীর সঙ্গে কথা বলে নেব। তাকে বাড়িতে নিয়ে বসায়নি—রাস্তা থেকেই বিদায় করেছে। পরেশ হাসতে হাসতে বলেছিল, দেখছি খুবই রাগী ছোকরা। আমার হাত দিয়ে পাঠানো উচিত হয়নি তোমার। 

—তুমি গাড়িতে ওদিকে যাচ্ছিলে বলে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, আমি নিজেই দিয়ে আসব। তোমাকে যেমন পছন্দ করে না, আমাকেও না। দেখলেই ক্ষেপে যায়। 

—খুবই দাম্ভিক। 

—তা ঠিক।

আসলে পরেশের সঙ্গে বিলুর বয়সের তফাৎ অন্তত সাত আট বছরের। বিলু তার সঙ্গে পড়ে, আর পরেশ এখানে বছর দুই হল আই এ এস ক্যাডার থেকে এসেছে। পরেশের চালচলনে কিছুটা তেজি ভাব থাকলেও কবিতা পাগল। নিজে ছাইপাঁশ যাই লেখে, মনে করে তুখোড় কবি। কলকাতার বড় বড় কাগজে তার দু-একটা কবিতা এক সময় ছাপা হয়েছে—তখন বোধ হয় পরেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খুবই দুর্বল—অন্তত সুধীনদা মুকুলের মতে। বিলু ওর দু-একটা কবিতা পড়ার পরই কেন যে আর তার লেখা কবিতা ভুলেও দেখে না।-–ও সাহেবের কবিতা। মুকুলকে দিও। আমার কাছে দেওয়া ঠিক হবে না। হারিয়ে ফেলতে পারি। 

মিমি টের পেল পিলু খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। তাঁর পায়ে জুতো নেই। ইজের পরনে। সার্টও ময়লা। চুল কিছুটা ধূসর। সে কী ভেবে যে বলল, পরীদি আমি যাই। 

মিমি বলল, যাবি। একসঙ্গে যাব। 

মিমি যাওয়ায় সাহেব বেশ বিহ্বল হয়ে উঠেছেন। হাতে তাঁর একটা ভারি বই। যেন তিনি বইটা পড়ছিলেন, পড়তে পড়তে টের পেয়েছেন, তার প্রিয়জন গেটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অসময়ে গেটে তালা দেওয়া থাকে। অসময়ে পরী আসেও না। একা তো নয়ই। সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। 

ঘরে ঢুকেই বলল, পরেশবাবু, তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। হাতে ওটা কী বই। এত ভারি বই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ কেন! কষ্ট হচ্ছে না! 

পরেশ বলল, জেমস ফ্রজারের ‘গোল্ডেন বাউ’। দারুণ। দারুণ। তুমি তো পার্টি কর, তোমার অবশ্যই পড়া দরকার। দেখবে নাকি। বলে পরেশ বই-এর পাতা ওল্টাতে থাকল। 

মিমি বসে পড়েছে। দেখলে মনে হবে খুবই যেন ক্লান্ত। চুল অবিন্যস্ত হাওয়ায়। কপাল থেকে চুল সরিয়ে নিজেই উঠে গিয়ে পাখার স্পিড বাড়িয়ে দিল। আর তখনই দেখল পিলু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে ইতস্তত করছে। মিমি জানে, পিলু ধুলো পায়ে এমন সুন্দর কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় কি না জানে না। সে হাত তুলে বলল, আরে তুই বাইরে কেন। ভিতরে আয়। কিচ্ছু হবে না। আয়। 

পিলু সাহস পেয়ে সে তার পরীদির চেয়ারের পাশে ছুটে গিয়ে বসে পড়ল। 

মিমি বলল, পরেশ, তোমাকে এক্ষুনি কয়েক জায়গায় ফোন করতে হবে। খবর নিতে হবে। ভেবে দেখলাম তুমি পার। থানা হাসপাতাল সব জায়গায় ফোন করে দেখবে। কোনো দুর্ঘটনার খবর আছে কিনা! 

পরেশ কপাল কুঁচকে বলল, হোয়াট হ্যাপ্‌ডে! 

—আরে বল না, বিশ্ব কাউকে না বলে না কয়ে কোথায় চলে গেছে। 

—ডিডন্‌ট হি টক টু এনিওয়ান বিফোর হি লেফট দ্য হাউস? 

—না না, তাহলে তোমার কাছে আসব কেন। কাউকে কিছু বলে যায়নি।

পিলু তাড়াতাড়ি সংশোধন করে দিতে গিয়ে ধমক খেল মিমির। 

পিলু বলতে চেয়েছিল, সে বলে যায়নি, তবে 

—তবে কী হতভাগা! আসলে মিমি জানে পিলু ভারি সরল স্বভাবের ছেলে। সে চিঠির কথা বলে দিতে পারে। দাদা তার জন্য চিঠি রেখে গেছে। হাবাটা বোঝেও না, চিঠিতে যা তার দাদা লিখে গেছে তাতে কোনো মেয়ের কপাল পুড়তে পারে। সে পরী মিমি কিংবা মৃন্ময়ী বলেই হয়তো কোনো আঁচ লাগবে না। কিন্তু এ নিয়ে ঢাক পেটানো ঠিক নয়, পিলুর বোধহয় তা জানা নেই। 

পিলু থতমত খেয়ে থেমে গেল। 

পরেশ বলল, তবে কী…! 

—আরে ওর কথা কেন শুনছ! 

পরেশ আর কোনো কথা বলতেই যেন সাহস পেল না। মিমি জানে তার আগুনে পুড়ছে লোকটা। নিজেই আগ বাড়িয়ে তার বাবাকে দিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। এটা ঠিক সব দিক থেকেই পরেশ তার যোগ্য মানুষ—তবু কোথায় যে থেকে যায় নদীর পাড়ে মানুষের হেঁটে যাওয়ার ছবি। সেই ছবির কথা ভাবলেই জীবনের সব মূল্য কোনো শিউলিতলায় ঝরা ফুলের মতো বাসি হয়ে যায়। 

পরেশ কাকে যেন ফোনে কী বলল। কোণায় গোল মতো ছোট্ট টেবিলের উপর বাহারি ফোন। ঝালরের ঢাকনা টেবিলে। এবং ঘরের মধ্যে বিলাসের উপকরণ। একজন বাঙালী সাহেব হতে গেলে যা যা দরকার কোনো কিছুর খামতি নেই। বিশাল কাচের আলমারি। থরে থরে কাচের দামি রকমারি গ্লাস সাজানো। পাশে পরেশের নিজস্ব ছোট্ট সেলার। পিলু হাঁ হয়ে দেখছে। 

পরেশ ফোন করে দিয়ে এসে মিমির সামনে বসল। অসময়ে পরী কেন এসেছে বুঝতে পেরে সেই প্রসন্নতা আর নেই। কলোনির এক উদ্ভ্রান্ত রাগী ছোকরার জন্য তাকে ফোন করতে হচ্ছে ভেবে কিঞ্চিত বিরস মুখ। বলল, এক্ষুনি খবর পাবে। কী খাবে বল। 

—কিছু না। এক গ্লাস জল দাও। ঠান্ডা না। তুমি তো জান ঠান্ডা জল আমি খাই না। গলা ধরে যায়। 

মিমি বুঝতে পারছে, পরেশ কোনো অধস্তন কর্মচারিকে দায় সঁপে দিয়েছে। 

এখন শুধু ফোনের অপেক্ষা। 

কখন কে রিঙ করবে। 

পরেশ কী বলছে, কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছে না। 

যেমন বলছে, গ্রান্ড ওল্ড ম্যান শুনলাম অসুস্থ। 

যেমন বলছে, আজই যেতাম। কাজে আটকে গেলাম। 

মিমি হুঁ হাঁ কিছু বলছে না। শাড়ির আঁচল টেনে দিচ্ছে। পরেশ তাকে দেখলে, আসলে কী দেখে জানে। পুরুষ মানুষের এই ব্যাধিগ্রস্ত চোখকে সে সহ্য করতে পারে না। সে জানে না, এটা কেন হয়। নানা জায়গায় সে ঘোরে। কম পুরুষই আছে তাকে দেখলে স্বাভাবিক থাকতে পারে। বিলুর সঙ্গে এত মিশেও, কেন যে তাকে সে বোঝে না। বিলুর মধ্যে সম্ভ্রমবোধ গভীর এটা সে টের পায়। যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করুক— সে জানে, বিলুর কাছে সে সর্বনাশ ছাড়া কিছু নয়। 

বিলু তাকে নিয়ে গোপনে একটা কবিতাও লিখেছিল। এবং সেটা চুরি করেছে। তখন কবিতাটা এতখানি গুরুত্ব পায়নি। সেটাই সে আজ র‍্যাক থেকে বই নামিয়ে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছে। বিলুর কবিতায় ছিল, তার প্রতি বিদ্বেষ। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছে। আজ কেন যে মনে হল, না সে কবিতার ঠিক যেন অর্থ ধরতে পারেনি। নিরিবিলি কোনো জায়গায়, অথবা বিলুদের বাড়ি যাবার পথে কবিতাটা আর একবার দেখবে। 

বিলু খাতার পাতা ছেঁড়া দেখে বাড়িতে প্রচন্ড নাকি অশান্তি করেছিল। কে ঢোকে আমার ঘরে। কার এত সাহস। সে মায়াকে ডেকে বলেছিল, খাতার পাতাটা কে ছিঁড়ে নিয়েছে জানিস? 

মায়া বলেছে, না। 

পিলুকে বলেছে। একই জবাব। 

সে যে বিলুর অনুপস্থিতিতে তার বাড়িতে এত আপন—পিলু, মায়া, মেসোমশাই, মাসিমা ছাড়া কেউ জানে না। বিলুর ঘরে কিংবা যে কোনো ঘরে সে শুয়ে বসে থাকতে পারে। ঘুমিয়ে থাকতে পারে। বিলুর কবিতার খাতা হাতড়াতে পারে। নতুন কবিতা যা লিখল বিলু, এটা জানার তার এক অপরিসীম আগ্রহ। সে তা জানতে গিয়েই কবিতাটা আবিষ্কার করে ফেলেছিল। আর পড়ে সে বেশ মজা পেয়েছিল। জ্বালা ধরিয়ে দিতে পেরেছে—সে তো এটাই চায়। জ্বলুক। জ্বলে জ্বলে খাক হয়ে যাক। সে গোপনে খাতা থেকে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়েছিল। 

সে যে পরেশের সঙ্গে সেজেগুজে সিঁড়ি ধরে নামছিল, তাও সেই এক জ্বালা থেকে। বোঝো জ্বালা কত গভীর। কেন এত লাগল! আমাকে দেখলে ক্ষেপে যাও আর পরেশের সঙ্গে দেখলে হৃৎপিন্ড জ্বলে যায়! কেন! কেন এটা হয়। তুমি বিলু কী মনে কর! রেলের চাকরি, বিলাসপুরে নির্বাসন- এত সোজা! কত সহজে শিস দিতে জানি, কত সহজে একজন পুরুষকে দিয়ে অভিনয়ে মেতে যেতে পারি, দাদু পর্যন্ত মজে গেল দেখে। সিঁড়ি ধরে নামছি। আগুনের মতো জ্বলছি। প্রসাধন কতটা করতে পারি ইচ্ছে করলে, টের পেলে তো। তুমি কে, তোমাকে চিনিই না—অ বিলু-দাদুর সঙ্গে দেখা করবে। বোঝো। আমি তো জানতাম তুমি আসবে। সার্টিফিকেটের নকল সঙ্গে, দাদু নিজে সব করে দিচ্ছেন, রেলের চাকরি পেয়ে উদ্ধার হয়ে যাবে—বোঝো, এক পলকে সব ভন্ডুল। তুমি সহ্য করতে পারলে না। আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। পাগল হয়ে গেলে—তোমার পরীর পাখা গজিয়েছে। নেচে নেচে নামছে। উড়ছে। পতঙ্গ হয়ে তুমিও পুড়ে মরলে। তোমার মাথা কত সহজে বিগড়ে দিলাম- আমার কী ভয় বিলু জান না, যদি তুমি হেসে কথা বল, যদি আমার উগ্র প্রসাধন জ্বালা ধরাতে না পরত, পরেশের হাত ধরে নামতে নামতে দেখতাম — তুমি সরে দাঁড়িয়েছ, আমাদের পথ করে দিয়েছ, তবে হয়তো আমি নিজেই তোমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দিতাম। রামবিলাসকে বলতাম— একটা রাস্তার কুকুর বাড়িতে ঢুকল কী করে। তাড়াও। তাড়াও! 

কিন্তু না, তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলে। নিজেকে সামলাতে পারলে না। চোখে আগুন জ্বলে উঠল। যা-হোক মাথাটা যে গোবর পোরা নয়, সেই আমার সান্ত্বনা। পরেশকে নিয়ে রঙ্গ করছি, তোমাকে বিদ্রুপ-টের পেলে। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লে। পারলে না। নিজেকে সামলে রাখতে পারলে না। নকল মিষ্টি হাসিতে তোমাকে কী বলতে গেলাম, আর ঠাস করে গালে চড় মারলে—অঃ বিলু এ যে আমার… 

রিঙ বাজছে। 

পরেশ ছুটে গিয়ে ফোন ধরল। 

পিলু মিমি তাকিয়ে আছে। 

মিমি অপেক্ষা করতে পারছে না। সেও ফোনের কাছে চলে গেল। 

পরেশ ফোন নামিয়ে বলল, না কোনো দুর্ঘটনার খবর নেই। কুমারপুরে একজন খুন হয়েছে। আলম নাম। পারিবারিক কলহ। 

মিমির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। 

সে বলল, আমরা যাচ্ছি। পরে আসব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *