প্রথম খণ্ড - মানুষের ঘরবাড়ি
দ্বিতীয় খণ্ড - মৃন্ময়ী
তৃতীয় খণ্ড - অন্নভোগ

অন্নভোগ – ৪

চার 

পরীদি এল। শাড়ি সায়া পাল্টে পরীদি এল। সাদা সিল্ক, লাল ব্লাউজ, মুখে স্যান্য প্রসাধন। সামনে এসে পরীদি পিলুর জামাটা দেখে বলল, ছিঁড়ে গেছে। দেখেছিস। 

পিলু নিজের ছেঁড়া জামা আগেই দেখেছে। সে পরীদির কথায় আশ্চর্য হল না। 

—কোথাও লাগেনি তো! 

সে বলতে পারত, জ্বলছে। জামা তুলে দেখাতে পারত। সে জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে শুনলে পরীদিও 

কষ্ট পাবে। কিন্তু পরীদিকে এখন চিঠিটা দেখানো দরকার। 

সে বলল, দাদা কাল রাতে কোথায় আবার চলে গেছে। 

পরীদি খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, কখন গেল। দেখি চিঠিটা। 

পিলু চিঠি এগিয়ে দিল, পরীদি পড়তে পড়তে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। পরীদি দাঁড়িয়েই আছে। এ-ঘরে সে বসে আছে পরীদির যেন খেয়াল নেই। চিঠিটা পরীদি উল্টে দেখল। কোথাও কী খুঁজল। তারপর বলল, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি কে বলল! 

—বাবা যে বললেন! তুমি বোসো পরীদি, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। 

— বসছি। তুই খেয়ে নে। আমরা এক জায়গায় যাব। তুই সঙ্গে থাকবি। 

পরীদির সঙ্গে যাবার তো কারো দরকার হয় না। সে দেখল, যারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদেরই একজন সাদা পাথরের রেকাবিতে মিষ্টি ফল সাজিয়ে এনেছে। পিলু যে কিছুটা পেটুক পরীদি জানে। কিন্তু এমন অসময়ে এত খাবার দেখে তার নিজেরই সংকোচ হচ্ছিল। বলল, পরীদি, আমার খিদে নেই। 

—খাতো! লজ্জা হচ্ছে! দাদা তো লিখেছেন আবার তিনি ফিরে আসবেন। আমাকে শহর ছেড়ে যেতে বারণ করে গেছেন। এত সাহস হয় কী করে তোর দাদার! আমি শহরে থাকব কী থাকব না আমার মর্জি। তোর দাদার কথায় থাকব। 

পরীদিকে পিলু ঠিক বুঝতে পারে না। কেন এই ক্ষোভ— দাদা তো খারাপ কিছু লেখেনি। পরীদিকে দাদার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে শুনে তারই খারাপ লেগেছিল। দাদার তো মন খারাপ হতেই পারে। 

পরীদি চিঠিটা নিজের ব্যাগে তুলে রেখে দিতে গেলে পিলু বলল, চিঠিটা বাবাকে ফেরত দিতে হবে। 

—চিঠিটা থাক আমার কাছে। তোর দাদার খুব আস্পর্ধা দেখছি। তিনি আমার জন্য সন্ন্যাস নিতে গেছেন। নিখোঁজ। নিখোঁজ হওয়া বের করব। 

এই রে! পিলু ঘাবড়ে গেল পরীদির কথায়। ভেবেছিল, চিঠিটা পেলে পরীদি জলে পড়ে যাবে। ছটফট করবে, কোথায় গেল, কখন গেল, থানায় ডাইরি করা হয়েছে কি না, নিখোঁজ হলে নাকি থানায় যেতে হয়—কিন্তু এটা তো আর নিখোঁজ হওয়া নয়—লিখেই তো গেছে, আমার জন্য স্টেশনে গিয়ে বসে থাকিস না। আমি ফিরব। 

পরীদির শরীরে মৃদু সৌরভ। আর পাটভাঙা সিল্ক পরায় একটু নড়লেই খস খস শব্দ উঠছে। দু-একজন উঁকি দিয়ে তামাসা দেখার মতো তাকে দেখে গেল। পরীদি বোধহয় সহ্য করতে পারছে না। ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, এত লজ্জা তোদের কবে থেকে হল। এখনও কিছু মুখে দিলি না। 

আসলে পরীদি যেন এবার তাদের সবার মর্যাদাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলছে। ‘এত লজ্জা তোদের’ কথাটা তার ভাল লাগল না। পরীদি কী সব র‍্যাক থেকে টেনে নামাচ্ছে, কী যেন খুঁজছে। পরীদি যে ভাল নেই সে বোঝে। তবু এর মধ্যে পরীদি বাবাকেও যেন টেনে এনেছে। 

পরীদি বইটই যা তক্তপোষে নামিয়ে রেখেছিল, তা আবার ভাঁজ করে র‍্যাকে সাজিয়ে রাখছে। দেয়ালে সেই ছবি—সে জানত পরীদির ঠাকুরদার বাবা কী তস্য পিতা কেউ হবে। সে কোনোদিন ছবিটা সম্পর্কে প্রশ্ন করেনি। আজ হঠাৎ কেন যে তার মনে হল, এমন সুন্দর মুখে পাগলের মতো দাড়ি কেন বুঝছে না। পরীদি যদি খুশি হয়, এইভাবেই যেন বলা, তোমার কে হয় ছবিটা। দাড়ি রেখেছে কেন। একটুখানি দাড়ি। 

পরী কিছু একটা খুঁজে পাচ্ছে না। তা যে কী পরী নিজেও জানে না। অথচ খুঁজছে। সে পিলুর কথায় মুখ ফেরাল, কার কথা বলছিস? 

পিলু আঙুল তুলে দেখালে বলল, আমার কেউ হয় না। চেষ্টা করছি আমি তার কেউ হতে পারি কি না। তোর দাদা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করিস, পরীদির ঘরের ছবিটা কার! নে দয়া করে খেয়ে উপার কর। 

—আমার খেতে ইচ্ছে করছে না বলছি। 

—পিলু, আর কত জ্বালাবি। তোকে আমি জানি না মনে করিস। কালীবাড়িতে তোর দাদার কাছে গিয়ে বসে থাকতিস। 

দাদা তাকে দেখলেই ক্ষেপে যেত।—আবার! যেন সে গেলে দাদার এবং বাবার অপমান। একটু সুস্বাদু খাবার পাতে পড়বে এই ভেবে সে পালিয়ে এক ক্রোশ পথ হেঁটে দাদার কাছে চলে যেত। দাদার কাছে চলে যেত ঠিক—তবে আমবাগানে কিংবা বটতলায় লুকিয়ে থাকত। কিংবা দাদার দুই- ছাত্র প্রায় তার সমবয়সী, তারা খোঁজখবর দিত মাস্টারমশাই কোথায়। পিলুকে ঠোঙা ভর্তি সন্দেশ এনে দিত। মাঝে মাঝে দেখতে পেত লক্ষ্মীদিকে। সে এখনও জানে না, আসলে, বাবাঠাকুর না লক্ষ্মীদি সে গেলেই মিষ্টির ঠোঙা পাঠিয়ে দিত তাকে। জঙ্গলে বসে কিছুটা খেত। বাকিটা বাবাঠাকুর প্রসাদ পাঠিয়েছে বলে, বাবার হাতে এনে দিত। দাদা কখনও জানতে পারত না। 

একবার টের পেয়ে দাদা তাকে রেল-লাইন পর্যন্ত তাড়া করেছিল—আবার যদি আসিস, আমি এখানে থাকব না বলে দিলাম। তুই কিরে, মান অপমানবোধ পর্যন্ত নেই। সবাই কী ভাবে! দাদার সেই তিরস্কার তাকে এতই পীড়নে ফেলে দিয়েছিল, যে আর কখনও যায়নি। কেবল মনে হত, তাকে দেখলেই দাদা কষ্ট পাবে। যেন সে গেলেই বদ্রিদার বাড়ির সবাই টের পেয়ে যায় তারা কত গরীব। লক্ষ্মীদি হয়তো সব বলে দিয়েছে পরীদিকে। 

তারপর না খেলে পরীদি বুঝবে, তারও কম রাগ না। তাকে অপমান করেছে বলেই খাচ্ছে না। না খেলে কষ্ট পাবে। কেউ কষ্ট পেলে তার কেন যে এত খারাপ লাগে! তার খিদেও পেয়েছে। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। একটা সন্দেশ তুলে মুখে আস্ত ঠেসে দিতেই প্রচণ্ড বিষম খেল। কাশছে। 

—তুই কিরে, ইস, কী কাশছে! তাড়াতাড়ি মিমি জলের গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়ে বলল, শিগগির জল খা। মাথায় চাপড় মারছে, ফুঁ দিচ্ছে। পিলুর চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। সে প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। আর পরীদি পাগলের মতো কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। কেবল বলছে, এত বড় সন্দেশ এক সঙ্গে মুখে পুরে দিতে আছে। কড়াপাকের সন্দেশ। রাক্ষসের মতো গিলছিস! কাল বাড়িতেও একবার তার একই দশা হয়েছিল। 

পিলু দেখছে সারা ঘরে সন্দেশের অংশ-বিশেষ ছড়িয়ে পড়েছে। ইস কী বিষম খেল! দাদা হয়তো তার কথা ভাবছে। বিষম খেলে বাবা বলবেন, কে আবার তোমার কথা ভাবতে শুরু করল। জল খাও। কেউ কারো কথা ভাবলেই কিছু খেতে গেলে বিষম খেতে হয়। এটা সে বিশ্বাস করে। বিশেষ করে বাবার এমন সব আপ্তবাক্য শুনে শুনে তারা বড় হয়েছে যে, বিশ্বের সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এই যে দাদা বের হয়ে গেল এটাও তাঁরই ইচ্ছে। কোনো শুভবোধ এর অন্তরালে কাজ করছে। এমন কী সে যে বিষম খেল, প্রায় চোখ উল্টে দিয়েছিল, এও তাঁর কোনো গূঢ় ইচ্ছে থেকে। 

এবং অবাক হয়ে দেখল, পরীদি কেমন স্বাভাবিক গলায় বলছে, মেসোমশাইকে দাদু ডেকে পাঠিয়ে কী বলেছে, জানিস! 

যাক পরীদির মধ্যে সেই রণংদেহী ভাবটা আর নেই। শান্ত স্বভাবের পরীদিকেই সে বেশি চেনে! তবে পরীদির রণংদেহী স্বরূপও তার চেনা। দাদার সঙ্গে কী নিয়ে যে খটাখটি লেগে থাকত বুঝতে পারত না। 

পরীদি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কথা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। খেয়ে নে। না হলে আবার বিষম খাবি। আসলে সে পরীদির কথার জবাব দেবার জন্যই জল খেয়ে আর একটা সন্দেশ হজম করতে গেলে, পরীদির এই সতর্কতা। 

তার প্লেট খালি হলে পরীদি ওটা হাত থেকে নিয়ে নিল। বলল, মুখ ধুবি আয়। বলে পরীদির বাথরুমে নিয়ে যেতেই সে বিস্ময়ে হতবাক। সুন্দর কারুকাজ করা পাথরে তৈরি কোনো মন্দিরের অভ্যন্তর যেন। বিশাল আয়না ফিট করা। সব কিছু এত ঝকঝকে যে সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বালতি থেকে পরী জল নিয়ে বলল, বেসিনে মুখ ধুয়ে নে। হাত পাত। আরে কী করছিস, জল নিচে পড়ছে দেখছিস না। বেসিনে জল ঢালার সময় বলল, জান বাবা না কী ক্ষেপে গেছে! বাবাকে তোমার দাদু বলেছে, শেষ বয়সে বাড়ি বয়ে অপমান। দাদার জন্য তোমাকে বিলাসপুরে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। জান দাদা গুম মেরেছিল শুনে। বাবার হম্বিতম্বি দাদা জানত না। রাতে ফিরে এলে বললাম দাদাকে। সব শুনে দাদা কেমন গুম মেরে গেল। 

—বাবার গোঁ জান তো। 

—বাবা দাদাকে কুপুত্র বলেছেন। 

—বাবা বলেছেন, এ যে মহাপাপ ধনবৌ। দেবীর গায়ে হাত! এ-পাপের যে ক্ষমা হয় না। আমাদের কী হবে! জান পরীদি, বাবাকে এমন জলে পড়ে যেতে দেখিনি। বাবা রাতে কিছু খানওনি। বলেছেন, দু-দিন নিরম্বু উপবাস। দু-দিন অহোরাত্র চণ্ডীপাঠ, যদি দেবী এতে শান্ত হন। দাদাও রাতে খেল না। 

—মা এসে ডাকল। কত বোঝাল। বলল, তোর বাবাকে তো জানিস, গোঁ উঠলে তেনার বুদ্ধিভ্রংশ হয়। তুই খেয়ে নে। 

—দাদা কেমন ভেঙ্গে পড়েছিল। সত্যি বলছি দাদাকে এ-ভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি, বলল, বিশ্বাস কর মা, আমি পরীকে মারিনি। পরীকে মারতে পারি না। আর কেউ বিশ্বাস না করুক তুমি অন্তত বিশ্বাস কর, পরীকে আমি কখনই মারতে পারি না। 

—তোর দাদা খেল! 

—না খায়নি। 

—মেসোমশাইও উপবাসে আছেন! 

—তাই। সকালে দাদা নেই। এখন তো সবাই উদ্ভ্রান্ত! কী যে হবে!

—সবাই তোরা কাল থেকে না খেয়ে আছিস! 

পিলু চুপ করে থাকল। 

পরীদি হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিল। জানালার পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। 

সে বুঝতে পারছে না, পরীদি জানালায় তার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে কেন! তারপর পরীদি হঠাৎ ছুটে গেল বারান্দার দিকে। সে দাদাকে নিয়ে যেমন ত্রাসের মধ্যে আছে পরীদিকে নিয়েও কম ত্রাসের মধ্যে নেই। সেও উঠে বারান্দায় চলে গেল। পরীদি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সে এখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কী যে করবে! আর তারপরই দেখল পরীদি চোখে মুখে জল দিয়ে বের হয়ে এসেছে। সাদা তোয়ালে কাঁধে ফেলা। মুখে সামান্য হাসি। 

পিলুর গলা বুক শুকিয়ে গেছিল। পরীদিকে হাসতে দেখে সে যেন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। পরী বলল, চল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

আশ্চর্য পরীদির সামান্য যে প্রসাধন ছিল মুখে এখন তাও নেই। তর তর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে থাকল। পেছন থেকে কে যেন বলল, কোথায় বের হচ্ছ! 

পরীদি তাকাল সিঁড়ির উপরের দিকে। পরীদির বাবা দাঁড়িয়ে সিঁড়ির মুখে। সামনে থেকে চাকর বাকরেরা সরে দাঁড়িয়েছে। 

পরীদি খানিকক্ষণ কিছু ভাবল। পিতা পুত্রীর এমন মুখোমুখী হওয়ার দৃশ্য সে জীবনেও দেখেনি।

পরীদি শুধু বলল, তীর্থ করতে যাচ্ছি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *