অন্নপূর্ণা – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

অন্নপূর্ণা – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

কার্তিকের বউভাতে সকালবেলা এই পথ দিয়েই মাছ গেছে। কলকাতার ঠাকুররা হাতা-খুন্তি হাতে কাঠের বারকোস মাথায় দিয়ে বিশ্বাসদের সানের পুকুর পাড় ধরে এই পথেই বিয়ে বাড়ি গেল। এখন সন্ধেবেলা। গাঁয়ের পথ আলো করে দুটো হ্যাজাক যাচ্ছে। কিছুই চোখ এড়ায়নি হাজরার। গালে কালো দাড়ি। মনের ভাব মুখে ধরা পড়ে না। চোখ দুটো মোটা ভুরুর ছায়ায় থাকে। কখন জ্বলে, কখন নেভে— কেউ তা জানে না।

সন্ধ্যের মুখে-মুখে একবার বাজারে যাবে ঠিক করে ফেলেছিল। একটা মিথ্যে আশা আজ ক’দিনই হাজরার মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল। দুপুরেও একবার মনে হয়েছে, হয়তো বিকেলে ঘরে ফিরে শুনবে—কার্তিকের বউভাতে বাড়িসুদ্ধ লোককে খেতে বলেছে। কাজকম্মের বাড়ি, আত্মীয়-কুটুম্বে বোঝাই—তাই বলার সময় পায়নি।

এবার বর্ষা এসেছে দেরিতে। সামনে পুরো ভাদ্র মাসটা পড়ে আছে। অথচ আকাশ যেন শরৎকালের। নির্মেঘ। নীল। তবে মাঝে মাঝে কালো মেঘে ঝুলে পড়ে। তখন গত বছরকার মোটা আল দিয়ে পিপড়ের সারি ডিম মুখে করে ডাঙা জায়গার খোঁজে ছোটে। চারদিক গুমোট। তবু বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। এখনও অর্ধেক মাঠ জলের অভাবে পড়ে আছে। আর কবে জল হবে। আর কবে লোকে রোয়া ধরবে!

হাজরার সামনে স্টেশন। বাজারে যাওয়ার রাস্তা। পেছনে গাঁ ঘেঁষে দু’তিনশো বিঘের এক বন্দে জায়গা—তার ওপরেই কোম্পানি বাঁধের গায়ে তার নিজের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। পুকুর পাড়ের সজনে গাছটা পর্যন্ত এখান থেকে চেনা যায়। সামনে কোনও বাধা নেই। স্রেফ দু’একটা বাবলা গাছ আর ন্যাড়া মাঠ।

সামান্য যেটুকু যা চাষ হয়েছে—তার ভেতর দিয়ে হাজরা বড় রাস্তার দিকে এগোতে লাগল। সকাল থেকেই ছাঁকা তেলে নেমন্তন্ন বাড়ির পটল ভাজা, মুড়িঘন্টের ডালের গন্ধ পাচ্ছিল মাঠ দিয়ে। কার্তিকের বউভাতের হ্যাজাক এখন গাছপালার আড়ালে চলে গেছে।

চোখের নজর কেমন মোলায়েম হয়ে এসেছে। সকাল থেকে সন্ধেতক একপো জায়গা নিড়িয়ে ধান চারার গোড়াগুলো ঘেঁটে দিয়েছে। নগদ তিন টাকা—পান্তা আর গরম জুটেছে আজ হাজরার। ঠায় মাথা নিচু করে সারাদিন জমি আঁচড়ে এগোতে হয়েছে। মুখে রক্ত এসে থানা দিয়ে গাল ভারী করে তুলেছে তাই।

খেয়ে পেট ভরেনি। বনঝাল গাছের জঙ্গলে, বাঙালদের মাঠকোঠার ঢোলকলমির বেড়া দিয়ে শুধু ভাতের গন্ধ উঠে আসছিল। ভুর ভুর করে। তাতে নানান জিনিস মেখে মনে-মনে এক-এক গ্রাস দলা পাকাতে পাকাতে হাজরা বড় রাস্তায় উঠে এল।

এখানে একটি মন্দা তাল গাছের নীচে পা কাটা এক খোঁড়া থাকে। তালপাতার ছাউনি দিয়ে দোকান করেছে। সকাল সন্ধে বিড়ি বাঁধে। দেড় টাকা ভরি গাঁজা বিকোয়। পুরিয়া পাঁচ পয়সা।…সরকারি গ্লাস আছে। এক ভাঁড় রস নিয়ে গোল হয়ে বসলে হাতে হাতে গ্লাস ফেরে। বাসি তাড়ি গুলঞ্চের রস দিয়ে তারানো—পেটে পড়লেই মাথাটা দাউ দাউ করে ধরে ওঠে। আবার ভোরবেলা পাইকারি ব্যাপারিরা ওই তালতলাতেই অমড়া থেকে লাউ, মুলো—সব ঢেলে বেচাকেনা করে। পাশেই খাল। সোজা গিয়ে মাতলায় পড়েছে।

খোঁড়ার দোকানে ঢুকে হাজরার কাছে দুনিয়াটা সরল হালকা হয়ে গেল। খাঁটি রস বিশেষ ছিল না। সকালের ট্রেনে স্যাকারিন আর মিল্ক পাউডারে মিশেল তাড়ি, বারো আনা ভেজালের সঙ্গে কলকাতায় চালান হয়ে গেছে। বাকি যা ঝড়তি-পড়তি ছিল—তাতে আবার ফুট কাটছিল। গ্লাস দশ পয়সা। তিন গ্লাস তাড়ি—সঙ্গে এক পুরিয়া গাঁজা—হাজরা কয়েক লহমায় রাজা হয়ে গেল।

দাম মিটিয়ে দেওয়ার পর কোমরে নগদ দু’টাকা পঁয়ষট্টি পয়সা গজগজ করছিল। এখন তার ভাবনা কীসের। জ্বর-জারি, মন খারাপ, অভাব, কাপড়ের খুঁটের পয়সা দিয়ে খানিকক্ষণ তো ঠেকানো যাবে।

সারাদিন খাটাখাটনির পরে বাসি তাড়ির সঙ্গে গাঁজার ধোঁয়া হাজরার বুকের ভেতর বাড়তি জোর এনে দিচ্ছিল। পা দু’খানা এলোমলো পড়লেও বেশ জোরে এগোচ্ছিল। পথে একটাও কুকুর পড়ল না। সব গিয়ে এখন কার্তিকদের কাজের বাড়ি হাজিরা দিচ্ছে।

বাড়ির পুকুর পাড়ে সজনেতলায় এসে মনে পড়ল। ওই যাঃ! সব তো গোলমাল হয়ে গেছে। খুকির মা বলে দিয়েছিল খাটুনির পয়সা দিয়ে এক কিলো আটা নয়তো ভুট্টা নিয়ে যেতে। তা তো আনা হয়নি।

জ্যোৎস্নায় উঠোন বড় আনন্দের দেখাচ্ছিল। ভাঙা গোলঘরের মাটিতে মানকচুর নধর ডগা ঘরের ছই বরাবর সিধে উঠে গেছে।

এই সময়ে তেজ দিয়ে কথা বলে থাকে হাজরা। দু-দু’বার জোর গলায় ডাকল। আসলে তার ভয় করছিল। বারো চোদ্দো বছরের বিয়ে-করা বউটা গেল কোথায়। সাড় নেই কোনও। ছেলেটা, বড় খুকিটা—তারাই বা কোথায়?

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না।

প্রমীলা বেরিয়ে এসে বলল, ‘আস্তে চেঁচাও। জেগে উঠবে।’

তেলাকুচো লতার ওপর থোকা থোকা জোনাকি লেজে আগুন জ্বেলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল।

কই! তোমার নেমন্তন্ন এল!

হাজরা বেরোবার সময়ও আজ ভোরে বলে গেছে, বিকেলের ভেতর কার্তিকদের বাড়ি থেকে লোকজন এসে ডেকে নিয়ে যাবে ঠিক। সেরকম একটা ক্ষীণ আশা ছিল। কেউ ডাকতে আসেনি।

মণ্ডলগিন্নির ধান ভেনে দিয়ে আধ পালি মতো খুদ হয়েছিল। সঙ্গে পুকুর পাড়ের সাচি শাক ভাজা। খুঁটিনাটি জানিয়ে শেষকালে প্রমীলা বলল, ‘ওদের মুখেও স্বাদ হয়েছে। আজকাল আর খেতে চায় না। বড়খুকি তো নিজেই এদানী গেঁড়ি-গুগলি তুলে আনে। বলে, ঝোল রেঁধে দে—’

‘একগাছি জাল থাকলে না-হয় পুকুরে কিংবা খালে ফেলে দেখতাম—’ বলেও হাজরার মনে পড়ল, তার এই চল্লিশ বছরের জীবনে জ্ঞাতিদের সঙ্গে শরিকানি পুকুরে কোনও দিন মাছ ফেলা হয়নি। মাছ ফেলা মানে ঝগড়া ডেকে আনা। বর্ষায় খাল-বিলের যা-কিছু ভেসে-আসা বিলসে মাছ পড়ে—তাই ধরে খাওয়া হয়। তবে বেওয়ারিশ খালে দু-একবার বড়সড় মাছ পেয়েছে হাজরা।

সারা পাড়া এই সন্ধ্যেবেলাই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি। না সবাই বুঝি কার্তিকদের বাড়ি গেল। বৃষ্টির অভাবে উঠোনে যা-কিছু সবজি দিয়েছিল—সব পুড়ে খাক। সামনে কেষ্টবাবুর আবাদে জ্যোৎস্না পড়ে ঠনঠন করছে। একগোছ ধানও লাগানো যায়নি। জল নেই।

‘আশা ছিল, কার্তিক নিজে এসে ডেকে নে যাবে। বারো বছর বয়সে প্রথম রাখালিতে ঢুকি। কার্তিককে তখন কাঁধে নিয়ে বেড়াতাম। আমার খুব ন্যাওটো ছিল—’। প্রমীলা কোনও জবাব করল না। কয়েক বছর আগেও হাজরাদের হেলেগরু ছিল। তাদের জাবনা দেওয়ার শুকনো মেছলা আজও ঘরের গায়ে উলটে রাখা আছে। তার একটাতেই চুল খুলে দিয়ে প্রমীলা চুপ করে বসেছিল।

হাজরার বুকের ভেতর স্যাকারিন আর মিল্ক পাউডারে ঘোলানো একটা স্রোত ওপরে উঠে আসার জন্য চাপ দিচ্ছিল। একে তার বুকের বেগ বলে বোধ হয়। কিংবা অম্বল। কার্তিকদের আবাদ বাড়ি রাখালি করতে ঢুকে সারাদিন গরু চরাত মাঠে মাঠে। শেয়ালের গর্তে আগুন দিয়ে বড় বাঁশ হাতে নিয়ে বসে থাকত। একবার শেয়ালের হাতেই যাওয়ার দশা হয়েছিল তার। ফাঁকা মাঠের মধ্যে বিশ-বাইশটা গরু নিয়ে আবাদ বাড়িতে থাকত হাজরা। কার্তিকের বাবা কাজে ভুল হলে নিজে এসে কত লাথি মেরেছে হাজরাকে। তবু স্বীকার করবে, পালান বিশ্বাসের দয়া-মায়া ছিল। বিপদে আপদে হাজরাদের দেখত। আশ্বিন মাসে এক মণ ধান দিয়ে চাষের শেষে দেড় মণ ফেরত নিত অবশ্য। তবু দিত। এখন তো কেউ দেয় না।

প্রমীলাও তাই বলল, ‘এখন আর কেউ দিতে চায় না আমাদের—’ তারপর আপনাআপনিই… বলল, সে তোমার কার্তিকীর জন্যি—।

ছানাকাটা দুধের ধারা জ্যোৎস্না। তার ওপর এমন এমন কথায় কার বা নেশা থাকে।

‘তবু, কার্তিক ছেলেটা ভাল ছিল কিন্তু—’

‘ছাই—’

হাজরাও আর তেমন জোর দিয়ে আপত্তি করতে পারল না।

‘ও-ই তো তোমাদের পথে বসাল—’

কী বলবে হাজরা। কলকাতায় কলেজে পাশ দিয়ে এসে কর্তিক এখানকার ইস্কুলে মাস্টার হয়েই গত দেড়-দু’বছরে পার্টির বাবু হয়েছিল। কার্তিকের কথায় হাজরা, প্রফুল্ল প্রামাণিক—ওরা সবাই ট্রেনে চড়ে শেয়ালদা গেছে—ময়দানে মিছিল করে গেছে কতবার। বড় বড় সভায় সন্ধে হলে মশাল জ্বালাত।

লাস্ট ট্রেনে গাঁয়ে ফিরে কাউকে আর ভয়ডর লাগত না। পুলিসরা কেমন কেঁচো হয়ে গিয়েছিল। সে তো কার্তিকদের ভয়েই। চরের ধান কাটা হল। এক জায়গায় জমা হল। তারপর সে সব যে কোথায় গেল। কেউ আজ আর হদিস দিতে পারে না। ভোর থাকতে জমি-জায়গা বিল্লি হত। সে এক মোচ্ছব গেছে। ঘরে পাঁচ সের, দশ সের ধান আসত ঠিকই। কিন্তু যারা এতকাল ধান বাড়ি দিত—তারা সেই যে গুটিয়ে গেল— চাইলে বলে, পাব কোথায়?

হাজরা আর দাঁড়াতে পারছিল না। দুটি ভাতের নেশা, দুটি ভাতের আশা তাকে আস্তে আস্তে ভীষণ কাবু করে ফেলছিল। চুপচাপ বসে থাকা বউটার কাছাকাছি গিয়েও তার ঘাড় গলা দিয়ে সেই একই ভাতের গন্ধ পেতে লাগল। আজ তার হয়েছে কী?

প্রমীলা মাথা সরিয়ে নিল না। খুব আস্তে বলল, ‘খেয়েছ কিছু?’

খোঁড়ার দোকানে তিন গ্লাস—

‘তা বলছি নে। শক্ত কিছু পড়েছে পেটে?’

‘তুমি খেয়েছ’, বলে হাজরা লক্ষ করল, তার বিয়ে করা বউটার কণ্ঠমণিতে জ্যোৎস্না পড়ে মুখের ভারী ছায়ার নীচে এক চিলতে নরম হাড় শুধু জেগে আছে। তদ্দণ্ডে তার মনের মধ্যে খুব মায়া হল। এরই নাম বউ। এরই নাম মেয়েমানুষ। কিন্তু কাছে গেলেই এত ভাতের গন্ধ পায় কেন? মহা জ্বালাতন।

প্রমীলা কোনও কথাবার্তা না বলে ঘরে ঢুকে হাঁড়ির ভেতরেই বাকি ভাতের সঙ্গে যা কিছু ছিল তা-ই দিয়ে বেড়ে দিল। হাজরা অন্ধকারেই ডাবা হাঁড়িটায় হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে খেতে লাগল। মাটির দেওয়াল কেটে সেখানটায় হাওয়া, আলোর জন্যে জানালা—সেখানে বাঁশের মাচায় হাজরা নিজে শোয়। তারপর প্রমীলা। তারপর খোকাখুকু। শুতে এসে হাজরা দেখল, প্রমীলা জেগে। দেখে তার খুব আহ্লাদ হল। সারাদিন সে যতবার কার্তিকের কথা ভেবে রাগ করবার, অভিমান করবার বা ঘেন্না করবার চেষ্টা করেছে—ততবারই মনে পড়েছে, এই কার্তিক ছোটবেলায় তার কোলে কাঁখে ঘুরত। তাই কার্তিককে দুষতে তার মন সরেনি। অথচ প্রমীলা আগাগোড়া কাতুকে ভাল নজরে দেখে না। এই কার্তিকের জন্যে নাকি তাদের যত কষ্ট।

হাজরা কোনও আপত্তি করেনি। বাঁশের মাচায় এখানটায় শুয়ে শুয়ে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখা যায়। মেঘ দেখা যায়—ভোর বেলা সূর্য ওঠা নজরে আসে। এখানটায় শুয়ে এসব দেখতে দেখতে হাজরার মন থেকে সবার ওপর রাগ দ্বেষ উবে যায়। সবাইকে সে ক্ষমা করতে পারে। বৃষ্টির আগে ফড়িংয়ের দল মাঠে দল পাকিয়ে ওড়ে। তাদেরও এখান থেকে শুয়ে শুয়ে দেখা যায়। তখন কারও ওপরে রাগ থাকে না। এই বুঝি পৃথিবীর নিয়ম।

পঞ্চাশ সালে সে নিজের চোখে দেখেছে, কোলের খুকিকে সন্ধের ঝোঁকে পথে নামিয়ে দিয়ে অল্পবয়সী মা পালিয়ে যাচ্ছে। দেশগাঁয়ের মেটে রাস্তায় মানুষের মাংসখোর সেয়ানা শেয়ালের পাল পথ হারানো সেই খুকির পাশ দিয়ে অল্প দূরে দূরে হেঁটে চলেছে। শুধু সন্ধের অপেক্ষা। হাটুরে লোকজন ঢিল ছুঁড়লেও সরে না।

এসব দেখা শোনার পর শরীরে কারও কি আর রাগ থাকে। এই মেয়েমানুষটাকে সে কথা বোঝাবে কে!

এই যে নদী, খাল, বিল—এ তল্লাটের জলকর—সবই গত বিশ বছর কেবলই শুকিয়ে আসছে—এসব দেখার পর কারও কি আর রাগ থাকে।

প্রমীলার বুকের ওপর একখানা হাত ফেলে দিল হাজরা। বউ কোনও বাধা দিল না। সাহায্যও করল না। শুধু বলল, ‘চল আমরা এখান থেকে চলে যাই—’

হাজরার বুকের ভেতরটা খচ করে উঠল, ‘এতকালের ভিটে ছেড়ে কোথায় যাব। বাইরে আমাদের কে চেনে—’

‘এখানে তো চিনে উদ্ধার করে দিচ্ছে—’

‘তা হোক। তবু তো আমি খগেন গুণীনের বেটা। বাপের নামে এখনও আমাদের প্রতাপনগর, বেগমপুর অব্দি লোকে চেনে—’

‘তাও যদি তুমি ওষুধ দিতে জানতে!’

‘ভুলে গেছি সব। বাবা একটা শেকড় চিনিয়েছিল। কেউ যদি কুকুর, ছাগল—ঘরে পোষানি জন্তু-জানোয়ার বাণ মেরে বোবা করে দিত—মুখুণ্ডি করে ফেলত—ওই শেকড় খেলে আবার বাক্‌ ফুটত।’

নতুন বিয়ে করে এসে গোড়ায় গোড়ায় প্রমীলাও এসব দেখেছে।

হাজরা আর কিছু বলল না। আসলে এই এতকালের এই জানাশুনো ঘরদোরে রোজ সন্ধেরাতে ফিরেও হাজরার বিশেষ ফুর্তি হয় না। এখানে ঘুমোবার সময় মাথার ওপর হেলে পড়া একটা খড়ের চাল আছে ঠিক—কিন্তু ওই অব্দি—তার চেয়ে বিশেষ কিছু বেশি নয়।

‘আমাদের এখানে কেউ নেই। মরে গেলেও কেউ দেখতে আসবে না। তোমার জ্ঞানো খুড়ো একটা টাকা ধার দিলে দিন ঘুরোলে দশ পয়সা সুদ চায়। তার চেয়ে চল আমরা চলে যাই। সীতাকুণ্ডু—’

‘তোমার বাপের বাড়ির দেশে? না, সেখানে যাব না। তোমার ভাই থাকে সেখানে।’

‘তুমি সেখানে মাঝ ধরবে কোম্পানির খালে—অনেক মাছ আছে। তোমার সম্বন্ধীর সঙ্গে না হয় না মিশলে।’

‘কাছাকাছি থাকলেও চোর হয়ে যাব।’

প্রমীলা চুপ করে গেল। তার বড় ভাই সীতাকুণ্ডর সবচেয়ে বড় চোর। তবে সিঁদলে নয়। নারকেল সুপুরি, পুকুরের মাছ চিংড়ি, শুকোতে দেওয়া কাপড়, হাঁস মুরগি, চরে বেড়ানো পাঁঠাছাগল—সব কিছু নিমেষে উধাও করে দেয়। কিন্তু বললে কী হবে—ওই করে তো দিব্যি সংসার চালিয়ে দিচ্ছে। একবার অবিশ্যি ঘোষেদের পুকুরে জাল সুদ্ধ ধরা পড়ে মারের চোটে মরে যাচ্ছিল। তবু তাকে বোঝে প্রমীলা। কিন্তু এই মানুষটা কেমন ধারা। কাজ জুটলে কাজে যায়। না জুটলে চুপ করে কোম্পানির বাঁধে বসে কেষ্টবাবুর আবাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সারাটা বেলা কাবার করে ফেলে। এসব মানুষ নিয়ে সংসার হয়। মুখে বলল, ‘কত গুমোর!’

হাজরা কোনও জবাব দিল না। অন্ধকারেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসল। তখন বেশি রাতের জ্যোৎস্না একটু একটু করে নিভে আসছিল। এই সময়টায় কোম্পানি বাঁধে দাঁড়ালে চোখের সামনে সারাটা কেষ্টবাবুর আবাদ আস্তে আস্তে মুছে যায়। দুনিয়ার সব মেয়েছেলে এই এক ধারা। মাথার ওপর তার বাপ আজ বেঁচে নেই। মা-ও নেই। বেঁচে থাকতে মা কম জ্বালিয়েছে খগেনকে। তবু যেন সে সব সময় ভাল ছিল। বউকে নেড়ে চেড়ে নিজের দিকে কাত করতেই সেই গন্ধটা আবার পেল হাজরা। কে যেন গরম ভাত হাঁড়ি থেকে কলাপাতায় ঢেলে দিয়েছে। গরম ধোঁয়া উড়িয়ে সেই গন্ধটা চারদিকে চারিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে করলে একজন মানুষের আর একজন মানুষের ওপর কেমন দখল হয়।

ঠিক তখনই হাজরার বুকের কাছাকাছি মুখ নিয়ে প্রমীলা বলল, ‘তবে আমায় হাটবারে হাটবারে ঘর ভাড়া করে রেখে আসবে বল।’

‘কোথায়—’

‘কেন? ঘুটিয়ারিতে নেমে হিড়গড়ির বাজারে। তুমিই তো বলেছিলে ব্যাপারিরা সেদিন জোর পয়সা খরচা করে। একটা তো রাত মোটে। পরদিন ভোর ভোর ফিরে আসব।’ হাজরার শরীরে বাসি তাড়ির ঝিমুনিটা খোঁচা খেয়ে জেগে গেল, খুব আস্তে বলল, ‘কোন মুখে ফিরবি?’

‘খুব পারব। তোমরা দুটি পেট ভরে খাবে। ছেলেমেয়ে দুটোও আশ মিটিয়ে যা ইচ্ছে খাবে—’

‘মুখে রুচবে?’

‘হাতে পয়সা পড়লে সব সয়ে যাবে দেখো। তখন ওই বড় হাঁড়িটায় ভাত চাপাব দোবেলা। ওথলানো ফেনে সরা ভেসে উঠবে। বেশি যা হবে পান্তা করে রেখে দেব।’ তারপর আচমকা প্রায় ভাসানের বাজনার জলে-ডোবা গম্ভীর সুর এসে গেল প্রমীলার গলায়, ‘এভাবে আর হয় না।’

বিয়ের বাসন বলতে ওই একটা হাঁড়ি পেয়েছিল হাজরা। মোটা চাদরের। কাঁসা কি পেতল জানে না। নিশুতি রাতে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিল। ঘরের বাইরে বড় বড় ব্যাঙ বৃষ্টির আশায় গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ওদের গলায় খুব ফুর্তি। লতাপাতার মাঝখান দিয়ে থপ থপ করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ বৃষ্টির দেখা নেই।

বুকের মধ্যে বউকে এনে ফেলে সরে শুতেও পারছিল না। এই কথার পর আবার কাছে টেনেও নেওয়া যায় না। অন্তত হাজরা পারছিল না। তার অস্বস্তি কাটিয়ে দেবার জন্যেই যেন প্রমীলা নিজে উঠে বসল।

‘কোথায়?’

‘ঘুম আসছে না—’ বলে প্রমীলা বাইরে উঠোনের ধারে গিয়ে শুকনো ছেচতলায় পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসল। চাঁদ নেই। তবে ফিকে আলোয় কেষ্টবাবুর আবাদ অস্পষ্ট পড়ে আছে। খানিক দূর অবধি দেখাও যায়। হাজরাও বাইরে উঠে এল।

‘এই হাটবারেই আমায় ঘর ভাড়া করে দাও। কালই তো হাট—’ তল্লাটের মুড়ি, চিড়ে, খই, গুড়ে বাজারের বটতলা ভরে যায়। কলকাতা থেকে মলম, মেয়েছেলে, বাঁশি আসে।

তেলাকুচো লতায় তখন গুচ্ছের জোনাকি। হাজরা উঠোনে নেমে গিয়ে, সারা গাছটার গা থেকে কাচিয়ে কাচিয়ে আঁজলা ভরে সেই আলো হাতে নিল। তারপর জোনাকিতে জোড়া হাতের একটা খুচরো ধাক্কায় এলো খোঁপাটা ভেঙে দিয়েই আঁজলা ভরতি জোনাকি-গুলো একেবারে জলের ধারা সেই ভাঙা খোঁপায় ঢেলে দিল। দিয়েই অনেককালের হাজরা নসকর এই এখনকার হাজরার ভেতর থেকে এক ঝটকায় উঠোনে লাফিয়ে পড়েই হাততালি দিয়ে উঠল। এই সময়টায় বউটাকে বড় ভাল দেখাচ্ছে। কোনও লাজলজ্জার পরোয়া করার দরকার নেই হাজরার এখন। সারা দেশটা ঘুমোচ্ছে। মেয়েমানুষটার মাথায়, চুলে আগুন ধরে যাচ্ছে।

প্রমীলাও সপাং করে উঠোনে সিধে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিশুতি রাত ফুটো করে দিয়ে চেঁচাতে লাগল। মাথার চুলের ভেতর দু’হাতের দশটা আঙুল চিরুনি করে চালাচ্ছিল। সঙ্গে চেঁচাচ্ছিল। ‘খাওয়ানোর মুরোদ নেই—আবার গুচ্ছের পোকা গুঁজে দিয়ে জ্বালানো—’

হাজরার হাতের তালি থেমে গেল। ঠিক সেই সময়েই মেঘ সরিয়ে দিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এমন বোকা সে শিগগিরি হয়নি। প্রমীলা তখনও উঠোনময় লাফাচ্ছিল। আর চেঁচাচ্ছিল।

বাদার মধ্যে কেউ যদি একটেরে কুঁড়ে বাধে—পাড়াপড়শি না থাকলে—আগুন লাগলে, এমনি একঠায় বসে বসে নিজের ঘরপোড়া দেখতে হয়। কাছে পিঠের ডোবার জলেও কুলোয় না। মিঠে কথা দিয়ে বউটাকে শান্ত করার ইচ্ছেও ছিল না হাজরার মনে তখন।

লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এক সময় থামল প্রমীলা। বেআক্কেলে জ্যোৎস্না সেই সময় ফক্‌ ফক্‌ করে দেখা দিল। কচু গাছের গোড়ায় দুটি ব্যাঙ। দূরে গাছপালার আড়ালে কার্তিকের বৌভাতের এঁটোপাতা নিয়ে কুকুরদের ঘেউ ঘেউ।

‘নে সেজে নে এইবেলা—’

‘এখন? কোথায়!’

‘হিড়গড়ির হাটে যাবিনে—’

প্রমীলা একেবারে গা ঘেষে দাঁড়াল হাজরার।

‘বাদা দিয়ে খরো খরো চলে যাব।’

‘বড় খুকি কিন্তু আমায় না দেখে কাঁদবে—’

‘সে আমি সামলাব। ভোর ভোর ফিরে এসে ঘরে বসে থাকব—’

অন্য বছর এই সময় বাদায় এক হাঁটু জল থাকে। এখন প্রায় শুকনো। পৃথিবী তার নিজের সুখে মাঠঘাট ছড়িয়ে রেখে ঠাণ্ডা খাচ্ছিল। চাঁদ তার পছন্দমত জায়গা থেকে জ্যোৎস্না ঢালছিল। হাজরার পেছন পেছন প্রমীলা। সামনেই নবীনবাবুদের আবাদ। দু’ধারে শুটকো শুটকো ধান চারা। চরাচর জুড়ে ধামাওলটানো কুয়াশায় ওরা মুছে গেল।

১৪.০১.১৯৭৩

লেখক পরিচিতি

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়: ২৫ মার্চ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে খুলনায় জন্ম। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান। ১৯৭৭-এ অমৃত পত্রিকার সংযুক্ত সম্পাদকের পদে। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ ব্যাপক স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯৩-এ অকাদেমি পুরস্কার। মৃত্যু ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *