নয়
ভোর চারটা। কম্পটন রোডের আটষট্টি নম্বর বাড়ির কিচেনে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিস সুপার স্যাম রসটন। পিছন দরজা দিয়ে ঢুকেছেন ভদ্রলোক। ‘কি বললে?’ চোখ বড় করে সুপারের দিকে চেয়ে আছেন বাড়ির মালিক ব্যারি ব্যাংকস্। ‘ডাকাত?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলালেন রসটন।
‘মাই গড!’ পাশে দাঁড়ানো হতভম্ব স্ত্রীর দিকে তাকালেন একবার ভদ্রলোক। ‘তা এখন কি করতে চাইছ?’
‘খানিক কষ্ট দেব তোমাদের। ওপরতলার রাস্তার দিকের একটা রুম ছেড়ে দাও। আমার লোক ওখান থেকে নজর রাখবে বাড়িটার ওপর।
‘তা না হয় দিলাম,’ চিন্তিত ব্যাংকস্। ‘কিন্তু এখনই কেন অ্যারেস্ট করছ না ওদের?’
‘ধারণা করছি দলে আরও লোক আছে ওদের। টাকার বখ্া নিতে আসতে পারে। তখন একসঙ্গে ধরতে চাই সব ক’টাকে।’
‘তাহলে দেরি করে কাজ নেই। যাও, ডেকে নিয়ে এসো সবাইকে। রূম একটা খালিই আছে ওপরে।’
ওদিকে পুলিস স্টেশনে এক ডেস্ক সার্জেন্টের সামনে বসে আছে মাসুদ রানা। ইচ্ছে করেই সুপারের সঙ্গে যায়নি ও। উনষাট কম্পটন স্ট্রীটে কে বা কারা থাকে, জানার জন্যে রয়ে গেছে। রেকর্ড রূম থেকে একটা ফাইল নিয়ে এসে ভেতরে নজর বোলাচ্ছে সার্জেন্ট।
‘দু’জন থাকে ও বাড়িতে। ওরা গ্রীক সাইপ্রিয়ট, স্যার,’ বলল সার্জেন্ট। ‘দুই ভাই, যমজ। দুজনেই অবিবাহিত। অ্যানড্রিয়াস এবং স্পিরিডন স্টেফানিডেস। চার বছর ধরে আছে এখানে। হলিওয়েল ডোনার কাবাবের ব্যবসা আছে।
স্লীপার ট্র্যান্সমিটার, ভাবতে লাগল মাসুদ রানা, এবং লো-লেভেল দুই স্লীপার—ডীপ কভার এজেন্ট! ওই ঘরেই কি আছে সেই ট্র্যান্সমিটারটি, যেখান থেকে স্কোয়ার্ট দুটো ট্র্যান্সমিট করা হয়েছে? ডার্বিশায়ার পিক ডিস্ট্রিক্ট এবং শেফিল্ডের উত্তরের পাহাড়ি এলাকা, দুটোই খুব কাছাকাছি এখান থেকে। ট্র্যান্সমীটিং সেরে চট্ করে এখানে এসে গা ঢাকা দেয়া খুব সম্ভব। বোমার অংশগুলোও কি এখানে এনে জড়ো করা হয়েছে? উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল মাসুদ রানা।
টেলিফোন তুলল ও। ঘুম ভাঙাল স্যার লংফেলোর। ‘কি ব্যাপার, রানা? খবর ভাল?’
‘মোটামুটি, স্যার। জরুরী একটা প্রয়োজনে ডিসটার্ব করছি আপনাকে।’
‘দ্যাট’স অল রাইট, সান। বলো।’
‘যাকে ফলো করছি, সে হয়তো আজ কোনও এক সময় ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করবে। যদি করে, আমি চাই কেউ যেন বাধা না দেয় তাকে। আমার সন্দেহ তাকে ভিয়েনায় আশা করবে কেউ নির্ধারিত সময়ে। ও পৌঁছতে ব্যর্থ হলে অন্যরকম হয়ে যেতে পারে পরিস্থিতি।’
‘বুঝেছি। সকালে তোমার হয়ে অর্ডারটা ইস্যু করে দেব আমি।’
‘ওর পাসপোর্ট নাম্বার হিথ্রোর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানতে পারবেন আপনি।’
‘ওকে।’
একটু পর ফিরে এলেন পুলিস সুপার রসটন। একান্তে আধ ঘণ্টা আলাপ করল রানা তাঁর সঙ্গে।
সকাল সাড়ে ন’টায় ফিফটি নাইন, কম্পটন রোড ত্যাগ করল ফ্রানজ ওসনিয়াক। হ্যারি নিগেল এবং আরেকজন অ্যাশগেট রোড থেকে পিছু নিল তার। ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশনে গেল লোকটা, উঠে পড়ল লণ্ডনগামী ট্রেনে। সেন্ট প্যানক্রাসে অন্য একদল ওয়াচারের ওপর লোকটার ভার ছেড়ে দিয়ে চেস্টারফিল্ডে ফিরে এল প্রথম দু’জন।
বোর্ডিং হাউসে আর গেল না ফ্রানজ ওসনিয়াক। যদি কিছু রেখে এসে থাকে সে ওখানে, এক সেট পায়জামা-শার্টসহ হ্যাণ্ড গ্রিপ ট্রেনে ফেলে যাওয়ার মতই একেবারে ফেলে এসেছে। সোজা হিথ্রো এল সে। দুটোর ফ্লাইটে রওনা হয়ে গেল ভিয়েনা। সোভিয়েত এমব্যাসির দু’জন রিসিভ করল তাকে ওখানে।
ঠিক এগারোটায় বাসা থেকে বেরোল দুই গ্রীক সাইপ্রিয়ট। এরাও পায় মধ্যবয়সী। পুলিস সুপারের সরবরাহ করা শক্তিশালী লেন্সওয়ালা ক্যামেরার সাহায্যে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো ওদের। ছবি নিয়ে ব্রায়ান স্মিথ রওনা হয়ে গেল লণ্ডন। ম্যানচেস্টার থেকে একদল এক্সপার্ট এসে গ্রীকদের বাসা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন ট্যাপ করার ব্যবস্থা করল। একটা ডিরেকশন ফাইণ্ডার ব্লীপারও জুড়ে দেয়া হলো ওদের গাড়িতে।
·
শেষ বিকেলে উত্তর এল লণ্ডনের। জানা গেল, ওরা সাইপ্রিয়ট, কথাটা ঠিক নয়। এক সময় গ্রীক মেইনল্যাণ্ডের অধিবাসী ছিল। গোড়া কমিউনিস্ট। হেলাস ‘মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত ছিল দুই ভাই। প্রায় বিশ বছর আগে সাইপ্রাসের উদ্দেশে গ্রীস ত্যাগ করে ওরা পুলিসের তাড়া খেয়ে। লণ্ডনের প্রশ্নের উত্তরে এথেন্স জানিয়েছে, ওদের আসল নাম কোস্টাপোপোলাস। নিকোশিয়ার মতে আট বছর আগে ওখান থেকে উধাও হয়ে গেছে দু’জনে।
এদিকে ক্রয়ডন ইমিগ্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী সাইপ্রিয়ট নাগরিক পরিচয়ে লণ্ডন আসে ওরা দুই ভাই। ব্রিটেন সরকার তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এদেশে থাকার অনুমতি দেন স্টেফানিডেস ভ্রাতৃদ্বয়কে। সবশেষে চেস্টারফিল্ড রেকর্ড। এদের মতে সাড়ে তিন বছর আগে লণ্ডন থেকে এখানে আসে তারা। বাসা ভাড়া নেয় ফিফটি নাইন কম্পটন রোডে। হলিওয়েল ক্রসে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কাবাব-ব্যবসা আরম্ভ করে। অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির অমায়িক মানুষ দুই ভাই। আইন মেনে চলে কঠোরভাবে।
হুঁম!’ রিপোর্টগুলো রেখে দিল মাসুদ রানা। বাইরে ঘনিয়ে এসেছে রাত।
একটি ছাড়া আজকাল আর কোন ইউরোপিয়ান গাড়ি নির্মাতা অতীতের মত বড়, গোল হেড লাইট তৈরি করে না। এখন বেশিরভাগই চৌকো হয়ে গেছে। একমাত্র অস্টিন এখনও তৈরি করে। অস্টিন মিনির জন্যে কেবল। মাসুদ রানা যখন গ্রীক যমজদের ব্যাপারে লণ্ডনের রিপোর্ট পড়ছে, ঠিক সেই সময় সাউদাম্পটনের চেরবার্গ জেটিতে এই ধরনের একটি মিনি অস্টিন অবতরণ করল ফেরি থেকে। ওটা এসেছে অস্ট্রিয়ার সালজবার্গ থেকে।
অস্টিন এবং তার চালক-কাম-মালিক, কারও কাগজপত্রে কোন খুঁত নেই। অকৃত্রিম অস্ট্রিয়ান কাগজপত্র। আসলে লোকটি চেক এসটিবির এজেন্ট, ফ্রানজ ওসনিয়াকের মত।গাড়িটা সার্চ করল কাস্টমস। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। ছেড়ে দিল তারা ওটা। লণ্ডনের পথে রওনা হয়ে গেল মিনি অস্টিন। এক নাগাড়ে দুই ঘণ্টা চলার পর সাউদাম্পটনের উত্তর প্রান্তে পৌঁছল গাড়িটা।হেড লাইট নিভিয়ে পথের পাশের প্রকাণ্ড এক ঝোপের আড়ালে এসে গাড়ি দাঁড় করাল চালক। হাইওয়ে থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে চলে এসেছে সে। কেউ দেখতে পাবে না। একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে নেমে এল লোকটা, অন্ধকারেই শুরু করে দিল কাজ। প্রথমে বডি এবং হেডলাইট ইউনিটের মাঝের ফাঁক আড়াল করে রাখা চকচকে ক্রোম রিঙটা খুলে ফেলল সে।
এবার বড়ির ভেতরের উইঙের সঙ্গে জোড়া পুরো হেডলাইট ইউনিট খুলে বের করে আনল সকেট থেকে। ওর পিছনে, এঞ্জিন কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে যুক্ত হওয়া তারগুলোও খুলে ফেলল সে। এরপর বালবের পিছনের অর্ধ গোলক আকৃতির রিফ্লেকটিং বাউল দুটো আলাদা করে একটা হেসিয়ান ব্যাগে পুরল লোকটা। অস্বাভাবিক ওজন ও দুটোর।
এক ঘণ্টারও বেশি ব্যয় হলো কাজটা সারতে। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল চেক। চোখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত নিয়ে অন্ধের মত চেয়ে আছে মিনি অস্টিন। কাল কোন এক সময়, ভাবল লোকটা, ওরকম আরেক সেট হেডল্যাম্প কিনে আনবে সে সাউদাম্পটন থেকে। ওগুলো ফিট করে কাল রাতেই ফিরে যাবে সালজবার্গ।
সে তো পরের কথা, আগের কাজ আগে। সিগারেটটা মাড়িয়ে দিল চেক। ব্যাগ ঝোলাতে ঝোলাতে বড় রাস্তায় উঠে হেঁটে এগোতে লাগল ফেলে আসা বন্দরনগরীর দিকে। পাঁচশো গজমত এগোতে বাস স্টপটা আবার দেখতে পেল লোকটা। এটার সামনে দিয়েই গেছে সে তখন। ঘড়ি দেখল। বেশ সময় আছে হাতে এখনও। প্রায় পনেরো মিনিট।
আর কোন যাত্রী নেই বাস স্টপে। সে একাই। অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল লোকটা। আরও পাঁচ মিনিট বাকি সময় হতে। হঠাৎ মোটর সাইকেলের ভারি আওয়াজে ঘাড় ফেরাল লোকটা। আগাগোড়া কালো পোশাক পরে রয়েছে বাইক চালক। থেমে দাঁড়িয়েছে বাইকটা তার চার হাতের মধ্যে।
‘রাতের শেষ বাসে বাড়ি ফেরা খুব বিরক্তিকর,’ বলে উঠল লোকটা। ফোঁস করে দম ছাড়ল চেক। ‘তাও ভাল, যত দেরিই হোক, অন্তত পৌঁছানো যায়।’
ব্যাগটা আগন্তুকের হাতে তুলে দিল চেক। পিছনের ফাইবার গ্লাস বক্সে সঙ্গে সঙ্গে চালান হয়ে গেল তা। এই সময় স্টপেজে এসে থামল সাউদাম্পটনের শেষ বাস। উঠে পড়ল লোকটা। ছেড়ে দিল বাস। কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকল তাতায়েভ। তারপর বিএমডব্লিউ ঘুরিয়ে রওনা হলো লণ্ডনের দিকে।
পরদিন সূর্যোদয়ের একটু আগে ইপসউইচ পৌঁছল সে থেটফোর্ড হয়ে। মনটা দারুণ খুশি। নবম চালান পৌঁছে গেছে হাতে। চালান।
পরদিন সকালে ইপসউইচ শহরের এ-দোকান ও দোকানে কেনাকাটা করতে দেখা গেল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভকে। হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে প্রথমেই কিনল সে একটা হালকা, খাটো হাতলওয়ালা দুই চাকার পুশ ট্রলি। সাধারণত ভারি কোন বোঝা, বস্তা, ডাস্টবিন বা স্যুটকেস স্থানান্তরে ব্যবহার করা হয় এগুলো। নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি করে এমন একটি দোকান থেকে কিনল দুটো দশ ফুটি তক্তা।
এরপর অফিস ইকুইপমেন্টের বড় এক দোকানে দেখা গেল তাতায়েভকে। এখান থেকে ছোট একটা স্টীলের ফাইলিং কেবিনেট কিনল সে। ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা, আঠারো ইঞ্চি পাশে, বারো ইঞ্চি গভীর। একটা টিম্বার স্টোর থেকে সংগ্রহ করল কয়েকটি কাঠের হুড়কো, গোল ব্যাটন এবং কড়িকাঠ জাতীয় এক খণ্ড কাঠ। ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ডু-ইট- ইওর-সেলফ দোকানে ঢুকল তাতায়েভ। .কিন্ল কমপ্লিট এক সেট টুল বক্স। নানান মাপের বিটসহ একটি হাই-স্পীড ড্রিল মেশিন। পেরেক, নাট-বল্টু, স্ক্রু এবং এক জোড়া হেভি ডিউটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল গ্লাভস্।
এখানকার কাজ সেরে এক প্যাকেজিঙ ওয়্যারহাউসে ঢুকল মেজর ভ্যালেরি। কিনল কিছু ফোম ইনসুলেশন। সবশেষে ইলেক্ট্রিক এমপোরিয়াম থেকে চারটা নয় ভোল্টের ব্যাটারি এবং কয়েক গজ মাল্টিকালারড সিঙ্গল ফ্লেক্স তার কিনল সে।
এত জিনিস সেলুনে করে চেরিহে’জ ক্লোজে নিয়ে আসতে দুটো ট্রিপ দিতে হলো ভ্যালেরিকে। সমস্ত কিছু গ্যারেজেই ফেলে রাখল সে। আবার রাত নামতেই ওর বেশিরভাগ স্থান পেল কিচেনে।
সে রাতেই তাতায়েভের জন্যে নির্ধারিত মস্কো রেডিওর কমার্শিয়াল ব্যাণ্ড জানাল তার ‘অ্যাসেম্বলার’ আসার সংবাদ। দু’দিন পর লণ্ডন সে।
রুমটা বেশ বড়। রাস্তার দিকে তিনটে জানালা। মাঝেরটার সামনে বসে আছে মাসুদ রানা। আরও একটা রাত কেটে গেছে উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ছাড়াই। কোন অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখা যায়নি গ্রীক যমজের। আজও ঠিক সময়ই কাজে বেরিয়েছে তারা। ফিরেও এসেছে যথানিয়মে। বেতাল কিছু করার চেষ্টাও করেনি। এমন কি বাসা বা দোকানের টেলিফোনও তোলেনি ওরা নিজে থেকে। যে ক’টা ফোন এসেছে, দোকানের নাম্বারে এসেছে। সবগুলোই কাবাবের অর্ডার বা টেবিল রিজার্ভেশন সম্পর্কিত।
একবার ভেবেছে রানা ওদের অনুপস্থিতিতে বাসার ভেতরে ঢোকার একটা চান্স নেবে কি না স্লীপার ট্র্যান্সমিটারের খোঁজে। কিন্তু পরে বাতিল করে দিয়েছে সে ইচ্ছে। মারাত্মক ঝুঁকি আছে তাতে। ও বাড়িটা নিঃসন্দেহে সিকিউরিটি অ্যালার্মের কারখানা। হেজিপেজি নয় ওরা দু’ভাই, টপ ক্লাস সীপার এজেন্ট। নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপার ভালই বোঝে। তিল পরিমাণ এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই বরবাদ হয়ে যাবে সমস্ত কিছু।
ঘড়ি দেখল মাসুদ রানা। এগারোটা। চোখ তুলতেই গ্রীক যমজের ওপর চোখ পড়ল। বেরিয়ে আসছে বাসা থেকে। কাজে যাওয়ার সময় হয়েছে। কি কারণে কে জানে, হাসছে খুব দু’ভাই। গাড়ি বের করে রওনা হয়ে গেল অ্যানড্রিয়াস ও স্পিরিডন স্টেফানিডেস ওরফে কোস্টাপোপোলাস যমজ। বলতে হলো না, অপেক্ষমাণ পুলিসের দুই ওয়াচার এবং বিএসএসের হ্যারি নিগেল বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
সবার ডিউটি ভাগ-ভাগ করে দিয়েছে মাসুদ রানা। কাউকে যদি দেখে ফেলে ওরা দেখুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু একবারের বেশি দু’বার যাতে চোখে না পড়ে সে, ফেউ বলে তাকে সন্দেহ করতে না পারে ওরা দু’ভাই, সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ রয়েছে সবার ওপরে।
পরদিন ফিনএয়ারের একটি জেট অবতরণ করল হিথ্রো। সরাসরি হেলসিঙ্কি থেকে এসেছে। যাত্রীরা সব ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস্ পেরিয়ে এল। কারও কাগজপত্রে কোনরকম গণ্ডগোল নেই। ওর মধ্যে একজন; লম্বা, গাল ভর্তি চাপ দাড়ি, মাঝবয়সী লোক রয়েছে। ফিনিশ পাসপোর্টের অধিকারী। পাসপোর্ট অনুযায়ী উরহো নুটিলা তার নাম।
ফিন ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে লোকটা, বাধে না একটুও। কারণ তার মা ক্যারেলিয়ান। বাৰা ৰুশ। জন্মগতভাবে লোকটা রুশ। সেমিয়ানভ নাম। পেশাঃ সোভিয়েত অর্ডন্যান্স ডিরেক্টরেটের আর্মি আর্টিলারি কোরের কর্ণেল। আসলে লোকটা যতটা না সৈনিক, তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞানী নিউক্লিয়ার এঞ্জিনিয়ার। ফিনদের মত চলনসই ইংরেজি বলতে পারে লোকটা।
কাস্টমসের ঝামেলা চুকিয়ে এয়ারপোর্টের কার্টসি কোচে এসে উঠল সেমিয়ানভ অন্য যাত্রীদের সঙ্গে। হিথ্রোর পেন্টা হোটেলে এসে থামল বার্স। ভেতরে ঢুকল সে। কিন্তু রিসেপশন ডেস্কে গেল না। সামনে দিয়ে ‘কাট্টি’ মেরে সোজা রিয়ার এক্সিটে চলে এল। দরজা দিয়ে বেরোলেই সামনে হোটেলের কার পার্ক। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতে হলো সেমিয়াভকে। কেউ নেই ধারে কাছে।
ধীরগতিতে কাছে এসে দাঁড়াল একটা ফ্যামিলি সেলুন। জানালার কাঁচ নামিয়ে প্রশ্ন করল ওটার চালক, ‘এয়ারপোর্টের বাস কি এখানেই যাত্রী নামায়?’
‘না। সামনেই নামিয়েছে,’ বলল কর্ণেল।
কোত্থেকে এসেছেন আপনি?’
‘ফিনল্যাণ্ড।’
‘আই সী! ওখানে নিশ্চয়ই খুব ঠাণ্ডা এখন?’
‘নাহ্! খুব গরম। ওটা আসলে সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে মশা।’
মাথা ঝাঁকাল তাতায়েভ। সামনে দিয়ে ঘুরে ওপাশের প্যাসেঞ্জার সীটে উঠে বসল এঞ্জিনিয়ার। গাড়ি ছাড়ল মেজর। বিনা বাক্য ব্যয়ে বড় রাস্তায় উঠে এল। মাইলখানেক এগিয়ে প্রশ্ন করল তাতায়েভ, ‘আপনার নাম?’
‘সেমিয়ানভ।’
‘ওতেই চলবে, আর কিছু দরকার নেই। আমি ফ্ল্যানারি। মার্টিন ফ্ল্যানারি।’
‘বেশি দূরে যেতে হবে আমাদের?’
‘দুই ঘণ্টার পথ।’
বাকি পথ দু’জনের কোন কথা হলো না। তিন জায়গায় তিনটে বেসিক ট্রিক খাটাল তাতায়েভ পিছনে কেউ লেগেছে কি না বোঝার জন্যে। কিন্তু না, লাগেনি। চেরিহে’জ ক্লোজে যখন পৌঁছল ওরা, দিনের আলো তখন সামান্যই বাকি। সামনের বাসার ভাড়াটে ডানকান রস তার বাগানের পরিচর্যা করছিল, ফ্ল্যানারির সঙ্গে নতুন একজনকে দেখে এগিয়ে এল সে।
‘হেড অফিস,’ তার উদ্দেশে চোখ টিপল তাতায়েভ। ‘মনে হচ্ছে প্রমোশনের ব্যাপার-স্যাপার।’
হেসে শুভেচ্ছা জানাবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল সে।
বাতি জ্বালার আগে ঘরের কার্টেন ভাল করে টেনে দিল ভ্যালেরি তাতায়েভ। কার্টেন না টেনে কখনোই বাতি জ্বালে না সে।
‘আগে কাজের কথা হোক,’ বলল কর্ণেল।
মাথা দোলাল মেজর, ‘হোক।’
‘চালান সবগুলো হাতে পেয়েছেন আপনি?’
‘পেয়েছি।’
‘নয়টা?’
‘নয়টা।’
‘লেট’স কনফার্ম। বাচ্চাদের খেলার বল একটা। ওজন কিলোগ্রাম।’
‘চেক।’
‘এক জোড়া জুতো, এক বাক্স চুরুট, একটা প্লাস্টার কাস্ট।’
‘চেক্।’
‘একটা পোর্টেবল্ ট্র্যানজিস্টর সেট, একটা ইলেক্ট্রিক শেভার। ‘চেক।’
‘একটা দেড় ফুট লম্বা স্টীল টিউব, একটা ছোট ফায়ার এক্সটিঙগুইশার। দুটোই অস্বাভাবিক ভারি।’
‘চেক।’
‘এক জোড়া হেড ল্যাম্প বাউল, খুব ভারি।’
‘চেক্।’
‘ঠিকই আছে তাহলে। অন্য সব টুকটাক কেনাকাটা যদি সারা হয়ে থাকে, তাহলে কাল সকালে হাত দেব কাজে।’
‘এখনই নয় কেন?’
‘ইয়ংম্যান, কাঠ কাটা, ড্রিল করা, এসবে শব্দ হয়। আরও এখন রাত। তাছাড়া আমি ক্লান্ত। যে কাজ করতে যাচ্ছি তাতে সামান্যতম ভুল হলেই সর্বনাশ। তাই এখন নয়। কাল সন্ধে নাগাদ সেরে ফেলতে পারব কাজটা, আশা করি।’
মাথা দোলাল মেজর।