অন্ধ শিকারী – ২.৮

আট

ওইদিনই অন্তরের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো মাসুদ রানার। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে উপস্থিত হলো সুযোগ।

ভিয়েনা থেকে ছেড়ে আসা অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান হিথ্রো অবতরণ করল বিকেল চারটে দশে। নিয়ম অনুযায়ী ইমিগ্রেশন ডেস্ক অতিক্রম করতে লাগল যাত্রীরা। তিনটে ইমিগ্রেশন ডেস্ক। একটা ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্যে, একটা ইইসি দেশসমূহের নাগরিকদের জন্যে এবং শেষেরটা নন্-ইউকে, নন্-ইইসি ডেস্ক।

শেষ ডেস্কটির সামনে এসে দাঁড়াল এক মাঝবয়সী লোক। আটত্রিশ- চল্লিশ বছর হবে বয়স। লম্বা পাঁচ ফুট আট। নীল চোখ। খাঁজ কাটা থুতনি। চেহারা সুরত সব মিলিয়ে মন্দ নয়। কিন্তু ঝামেলা বাধিয়েছে চুল। ভীষণ পাতলা মাথার চুল। খুলির প্রায় পুরোটাই দেখা যায় ওর ভেতর দিয়ে। একটা গ্রিপ ছাড়া আর কোন লাগেজ নেই তার সঙ্গে।

তার পাসপোর্টের ওপর শকুন দৃষ্টি বোলাতে আরম্ভ করল ইমিগ্রেশন অফিসার। লোকটাকে কেন যেন পছন্দ হয়নি তার। পরিচিত নীল প্লাস্টিক মোড়া পাসপোর্ট। ওপরে এমব্লেম করা সোনালি ঈগল। বেশিদিন হয়নি ইস্যু করা হয়েছে। কভার ওল্টাল অফিসার। ফ্রানজ ওসনিয়াক লোকটার নাম। পেশা ব্যবসা। পাসপোর্টের নাম্বারটা সামনের কম্পিউটরে ফিড করল অফিসার।

কিছু একটা ঘটে গেল ডিসপ্লে স্ক্রীনে। শক্ত হয়ে গেল অফিসার। যদিও ওসনিয়াককে টের পেতে দিল না সে কিছু। বরং সন্তুষ্ট হওয়ার ভান করে মাথা দোলাল। ‘ধন্যবাদ, স্যার। আনন্দের হোক আপনার ব্রিটেন সফর। নেক্সট, প্লীজ!’

ওসনিয়াক সামনে থেকে সরে যেতেই মুখ তুলল অফিসার। সরাসরি সামনের দিকে তাকাল। দশ-বারো গজ তফাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের দুই পোর্টার দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হলো। একটা চোখ টিপল অফিসার, মুখ ঘুরিয়ে আবছাভাবে ইঙ্গিত করল অস্ট্রিয়ানের উদ্দেশে। অলস ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল দুই পোর্টার। তারপর পা বাড়াল লোকটার পিছন পিছন। ওদের একজন রানা এজেন্সির ব্রায়ান হারকোর্ট স্মিথ, অন্যজন বিএসএসের হ্যারি নিগেল।

কয়েক পা এগোতেই ডানে ল্যাভেটরি। চট্ করে ভেতরে ঢুকে পড়ল স্মিথ। কেউ নেই ভেতরে। নিশ্চিত হয়ে পকেট থেকে ছোট, শক্তিশালী একটা কমিউনিকেটর বের করে খুব দ্রুত কিছু নির্দেশ দিল সে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, বেরিয়ে এসে যোগ দিল স্মিথ হ্যারির সঙ্গে। ফ্রানজ ওসনিয়াক তখন কনকোর্সের শেষ মাথায় মিডল্যাণ্ড ব্যাঙ্কের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাচ্ছে। টেরও পেল না ওপরের ব্যালকনি থেকে টপাটপ চার পাঁচটা ছবি তুলে নেয়া হলো তার এই আচমকা যেন ঢিল পড়েছে মৌচাকে। স্মিথের নির্দেশে এয়ারপোর্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও চারজন সহকারী যোগ দিল ওদের সঙ্গে। ফ্রানজ ওসনিয়াককে চারদিক থেকে ঘেরাও করে এগোতে থাকল দলটা। দু’নম্বর টার্মিন্যাল ভবনের সামনের র‍্যাঙ্ক থেকে ট্যাক্সি চাপল অস্ট্রিয়ান। তিনটে গাড়িতে ভাগ ভাগ হয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে লোকটাকে অনুসরণ করতে লাগল ওরা ছয়জন। বেজওয়াটারের সাসেক্স গার্ডেন ও এজওয়্যার রোডের সংযোগস্থল প্যাডিংটনে ট্যাক্সি ত্যাগ করল ওসনিয়াক। বি অ্যাণ্ড বি, বেড অ্যাণ্ড ব্রেকফাস্ট বোর্ডিং হাউস আছে এখানে অনেকগুলো। এ বোর্ডিং ও বোর্ডিং ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল অস্ট্রিয়ানকে, তার মানে রিজার্ভেশন নেই লোকটার। অবশেষে একটার জানালায় ‘রূম খালি’ নোটিশ ঝুলতে দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।

আশ্রয় জুটেছে ব্যাটার, ভাবল স্মিথ। পাশে বসা নিগেল হ্যারিকে বলল, তুমি ওটার ব্যাক ডোরের ওপর নজর রাখো। আমি কথা বলছি চীফের সাথে।’ বিনা বাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। ঘড়ি দেখল স্মিথ। এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেছে ওরা এক ঘণ্টা আগে। আর দেরি না যোগাযোগ করল সে মাসুদ রানার সঙ্গে।

‘একটার খোঁজ বোধহয় পাওয়া গেছে, চীফ।’

‘হোয়াট!’ লাফিয়ে উঠল রানা। ‘কোথায়?’

‘প্যাডিংটনের এক বোর্ডিং হাউসে ঢুকেছে এসে। আমরা পাহারায়।’

‘কোন্ দেশী?

‘অস্ট্রিয়ান। নাম ফ্রানজ ওসনিয়াক।’

‘ওকে সন্দেহ করার কারণ?’

‘পাসপোর্টে গোলমাল আছে। রেড লাইট শো করেছে কম্পিউটর।’

‘ছবি তোলা হয়েছে?’ উত্তেজনায় ফ্যাসফেঁসে শোনাচ্ছে রানার কণ্ঠ। ‘হ্যাঁ। এতক্ষণে মামির হাতে পৌঁছেও গেছে হয়তো।’

‘অল রাইট। আমি যাচ্ছি মামির ওখানে। ক’জন আছ তোমরা?’

‘ছয়জন।’

‘গুড। আর, স্মিথ! ওয়েলডান। রাখছি। যোগাযোগ রেখো।’

‘রাইট, চীফ।’ কমিউনিকেটর রেখে বোর্ডিঙ হাউসের দিকে নজর দিল ব্রায়ান হারকোর্ট স্মিথ। সন্ধে হয়ে এসেছে। কোন ঘটনা ছাড়াই মিনিটের পর মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে। দশ মিনিট পর পর অন্যদের সঙ্গে কথা বলছে স্মিথ। তার নির্দেশে অন্য চারজন আরও আগেই বেরিয়ে পড়েছে গাড়ি ছেড়ে।

বোর্ডিঙ হাউসের সামনের রাস্তার ওপারে দু’জন আর এপারে দু’জন রয়েছে তারা। সবার সঙ্গেই রয়েছে একটি করে কমিউনিকেটর। আশায় আশায় রয়েছে, কিছু একটা করবে ফ্রানজ ওসনিয়াক। কিন্তু করছে না। কিছুই করছে না লোকটা। একসময় প্রতীক্ষার অবসান ঘটল ওদের। ঠিক সাড়ে আটটায় বেরিয়ে এল অস্ট্রিয়ান। গা ছাড়া ভঙ্গিতে এজওয়্যার রোডের সাধারণ মানের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। সাপার সারল ধীরেসুস্থে। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার বোর্ডিঙ হাউস।

পথে কারও সঙ্গে কথা হয়নি ওসনিয়াকের। তুলে দেয়নি কিছু কারও হাতে, নেয়ওনি কিছু কারও কাছ থেকে। তবে দুটো কাজ করেছে সে যা তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত করে তুলেছে ওদেরকে। রেস্টুরেন্ট যাওয়ার পথে একটা দোকানের শো-কেসের কাঁচে চোখ রেখে পিছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা কয়েক সেকেণ্ড। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে এসেছে বোর্ডিঙ হাউস পর্যন্ত। যখন নিশ্চিত বুঝেছে ওসনিয়াক যে কেউ তাকে অনুসরণ করছে না, সোজা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকেছে। খাওয়ার সময় পাশের টেবিলে কফি পানরত ব্রায়ান স্মিথের দিকে একবার ভুলেও তাকায়নি লোকটা।

খাওয়া সেরে বেরিয়ে এসে আরেক খেল্ দেখিয়েছে লোকটা। রেস্টুরেন্ট আর বোর্ডিঙ হাউসের মাঝামাঝি পৌছে হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্ট দেয়ার মত আচমকা এক দৌড়ে রাস্তা অতিক্রম করে ওপারের ফুটপাথে গিয়ে উঠেই কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকেছে পিছনে, আর কেউ স্প্রিন্ট দেয় না বোঝার জন্যে। কিন্তু তেমন কেউ ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। ওসনিয়াক যখন সম্ভাব্য অনুসরণকারীকে পিছনে খুঁজছে, তারা তখন ওপারেই, তার দশ হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি খোঁজার ভান করছে।

‘শালারা আধুনিক কায়দা আর কবে শিখবে!’ আপনমনে হেসেছে স্মিথ।

ওদিকে বিএসএস রেকর্ড অফিসে বসে ছটফট করছে মাসুদ রানা। আসার সময় গিলটি মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে কাজে লাগতে পারে ভেবে। খবর পেয়ে স্যার লংফেলোও এসেছেন একটু আগে। এনসাইক্লোপেডিক মেমোরির অধিকারী পঁয়ষট্টি বছরের মিস ডরোথির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে ওরা। বৃদ্ধা সবার কমন মামি।

অন্য সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির তুলনায় বিএসএসের রেকর্ডরূমই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। এর সবচেয়ে বড় অংশটির নাম অ্যালবাম সেকশন। এমন কোন ব্যক্তি; যাকে বিদেশী এজেন্ট বা স্পাই হতে পারে বলে সন্দেহ হবে, পৃথিবীর সব গোয়েন্দা সংস্থাই ছবি তুলে রাখে তার সুযোগমত। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তোলা হয় ছবিগুলো। সন্দেহ সত্য হোক, না হোক, প্রতি বছর অমন হাজার হাজার ছবি তুলে থাকে তারা। সব সময় সন্দেহভাজনদের ছবিই তোলা হয়, ব্যাপারটা তাও নয়। যার খুশি তারই ছবি তোলে ওরা।

এর কোনটিই ফেলে দেয়া হয় না। সযত্নে তুলে রাখা হয় অ্যালবাম সেকশনে। কে জানে কখন কোনটির প্রয়োজন দেখা দেবে। বিদেশী ডিপ্লোম্যাট, ট্রেড ডেলিগেটের সদস্য, সাইন্টিফিক অথবা কালচারাল ডেলিগেটের সদস্য, এদের ছবি তোলা হয় বেশি। কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা মহিলার সর্বোচ্চ ষাটটি পর্যন্ত ছবিও রয়েছে ব্রিটিশ অ্যালবাম সেকশনে। বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন পরিবেশে—সময়ে তোলা।

এছাড়া সংস্থাগুলোর আন্তঃদেশীয় পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিনিময় চুক্তির ফলেও এক সংস্থা অন্য সংস্থার কাছ থেকে প্রচুর ছবি পেয়ে থাকে প্রতি বছর। কখনও হয়তো কোন সোভিয়েত ট্রেড ডেলিগেশন গেল কানাডা সফরে। তাতে রয়েছে হয়তো ইভানভ। সন্দেহভাজন। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিস অবিলম্বে তার ছবি পাঠিয়ে দেবে ওয়াশিংটন, লণ্ডন ও অন্যান্য ন্যাটো মিত্রদের কাছে। সযত্নে ছবিটা সংরক্ষণ করা হবে।

হয়তো পাঁচ বছর পর কোন এক এশিয়ান অথবা আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে সাংবাদিক হিসেবে দেখা যাবে তাকেই। কিন্তু তখন তার নাম কজলভ। এসব ক্ষেত্রে ইভানভ বা কজলভ বা আর যা-ই হোক লোকটির নাম, তার ছবির নিচে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্যাপশন হয় ‘ফুল টাইম কেজিবি হুড’। সোভিয়েত এবং তার মিত্রদের বেলায় বিএসএস অত্যন্ত হুঁশিয়ার। এদের রুশ বা ইস্ট ব্লক স্পাই অথবা সম্ভাব্য স্পাইয়ের ছবির আর্কাইভ দেখলে মাথা ঘুরে যাবে যে কারও। এভারেস্ট সমান তার অ্যালবামের পাহাড়।

এর অর্ধেক সংগ্রহও যাদের নেই, তারা পর্যন্ত যেখানে সদ্য তোলা কারও ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্যে তার অতীতে তোলা কোন ছবি আছে কি না খুঁজে বের করতে কম্পিউটরের শরণাপন্ন হয়, সেখানে বিএসএস শরণাপন্ন হয় মিস্ ডরোথির। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধার। অদ্ভুত তার স্মরণশক্তি।

নাকের আকার, চোয়ালের গঠন, থুতনির কাটা দাগ, গালের তিল কি আঁচিল, ঠোঁটের বাঁক, চোখের আকার, গ্লাস অথবা সিগারেট ধরার ভঙ্গি, বা অস্ট্রেলিয়ার কোন পাবে হাসতে গিয়ে বেরিয়ে পড়া বাঁধানো দাঁত, একবার দেখলেই মুখস্থ হয়ে যায় বৃদ্ধার। জীবনেও ভোলে না।

ফ্রানজ ওসনিয়াকের ছবিগুলো পাশাপাশি বিছিয়ে চেয়ে আছে মামি।কপালের কোঁচকানো চামড়া আরও কুঁচকে আছে। ভেতরে অস্থিরতা থাকলেও তা চেপে রেখেছে সামনে বসা তিনজন। ঝাড়া এক ঘণ্টা পর দুটো মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল বৃদ্ধা, ‘ফার ইস্ট!’ উঠে গিয়ে একটা র‍্যাকের সামনে দাঁড়াল। মিনিট পাঁচেক খোঁজাখুঁজি করে বের করে আনল প্রয়োজনীয় অ্যালবাম।

ফ্রানজ ওসনিয়াকের একটা ছবি বের করল মামি ভেতর থেকে। পাঁচ বছর আগে তোলা। তখন তার চুল অনেক ঘন ছিল। কোমর ছিল সরু। টোকিওর ভারতীয় দূতাবাসের এক পার্টিতে হাসিমুখে আলাপ আরেকজনের সঙ্গে।

‘চেক,’ ঘোষণা করল মিস ডরোথি। ‘পাঁচ বছর আগে টোকিওর চেক দূতাবাসের লো-লেভেল এজেন্ট ছিল। নাম জিরি হেইক।’

দাঁত বেরিয়ে পড়ল মাসুদ রানার। খুশিতে না কিসে ঠিক বোঝা গেল না।

পরদিন সকাল এগারোটায় আবার বোর্ডিঙ হাউস ত্যাগ করল ফ্রানজ ওসনিয়াক। তার ওপর নজর রাখার জন্যে গিলটি মিয়াসহ রানা এজেন্সির সাতজন ওয়াচার রয়েছে এ মুহূর্তে। রাতে লোকটার আসল পরিচয় জানার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিল মাসুদ রানা। কিন্তু বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন ওসনিয়াককে আর বেরোতে দেখা গেল না, তখন ফিরে গিয়েছিল ও সকালে আসার কথা বলে। যদি না এর মাঝে আসার পড়ে।

স্মিথ-হ্যারি ও অন্যদের বদলে রাতের পাহারাদারীর জন্যে এসেছিল আরেক দল। সে সময়ও থেকে গিয়েছিল গিলটি মিয়া রানার নিষেধ অমান্য করে। রাতে বিশ্রাম নিয়ে সকালে আসার কথা বলেছিল ওকে রানা।

‘কাজের সোমায় আবার কিসের বিশ্রাম?’ উত্তর দিয়েছিল গিলটি মিয়া। ‘চিন্তায় আমার ঘুম হবে ভেবেচেন? মাজরাতে উটে যদি ব্যাটা ন্যাজ তুলে পালায়, তকন?’

গাড়িতে বসেই রাত কাটিয়েছে গিলটি মিয়া। চোখ ছিল বোর্ডিঙ হাউসের দরজায়, ব্যাটা ন্যাজ তুলে পালায় কি না দেখার জন্যে। সকালে রাতের দল বিদেয় নিয়েছে, এসেছে কালকের দল। কিন্তু তাকে নড়ানো যায়নি। অনেকদিন পর মনের মত একটা কাজ পেয়েছে সে। মিস্ করতে রাজি নয় কারও কথায়।

এজওয়্যার রোডে এসে ট্যাক্সি নিল অস্ট্রিয়ান। রওনা হলো পার্ক লেন। পিছনে ব্রায়ান স্মিথের নেতৃত্বে তিনটে গাড়িতে তাকে অনুসরণ করছে দলটা। পিকাডিলিতে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ওসনিয়াক। তারপর পিছনের কাল্পনিক ফেউ খসাবার জন্যে কয়েকটা বেসিক ট্রিক্ খাটাল। ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়েছে গিলটি মিয়া ও অন্য তিনজন ওয়াচার। একটু পর হঠাৎ ঝেড়ে দৌড় দিল লোকটা কাছের বড়সড় এক অফিস বিল্ডিং লক্ষ্য করে।

এ মাথা দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে এল রিয়ার এক্সিট দিয়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকাল আর কেউ দৌড়ে আসছে কি না দেখার জন্যে। কিন্তু না, ছুটে আসছে না কেউ। দরকারও ছিল না। কারণ সংক্ষিপ্ত পথে আগেই ওখানে পৌঁছে গেছে এক ওয়াচার। কাল রাতের কথা মনে রেখেছে ওরা। তাই লোকটাকে ট্যাক্সি বিদেয় করতে দেখেই সতর্ক হয়ে গেছে। দ্রুত ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নিয়েছে।

চারদিক দেখে শুনে সন্তুষ্ট মনে লোয়ার রিজেন্ট স্ট্রীটের ব্রিটিশ রেল ট্রাভেল সেন্টারে এসে ঢুকল সে। কাউন্টারে শেফিল্ডের ট্রেন ক’টায় ক’টায় ছাড়ে জেনে নিল। তারপর রাত নয়টা পঁচিশের গাড়ির একটা রিটার্ন টিকেট কিনল। দ্বিতীয় শ্রেণীর। তার পাশের কাউন্টারে মাদারওয়েলের টিকেট কেনার জন্যে খুচরো শিলিং গুণছিল এক যুবক, ওসনিয়াক কাউন্টার ত্যাগ করতেই তারও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। ক্লার্কের উদ্দেশে ‘জাস্ট আ মিনিট’ বলে পিছিয়ে এল সে।

খবরটা মাসুদ রানাকে জানানো হলো। ‘লেগে থাকো ‘ নির্দেশ দিল ও। ‘মিস লীড করার জন্যেও করে থাকতে পারে টিকেটটা।’

‘আমার মনে হয় না, চীফ। অত বুদ্ধি নেই শালার। ওর টেকনিক মান্ধাতা আমলের।’

‘হতে পারে। তবে সন্দেহ নেই একেই খুঁজছি আমরা। ভিয়েনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওরা কনফার্ম করেছে জিরি হেইক এসটিবির হলেও ভেতরে ভেতরে কেজিবির।’

‘অল রাইট, চীফ। ভাৱনার কিছু নেই। কথায় বলে চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। ছুটতে পারবে না ও কিছুতেই।’

ওদিকে চার্লস স্ট্রীটের এক হোটেল কক্ষে জানালার পাশে বসে আছে মাসুদ রানা। বাঁ হাতে শক্তিশালী বিনকিউলার, ডান হাতে খুদে কমিউনিকেটর। ব্রায়ান স্মিথের সঙ্গে আলাপ সেরে বিনকিউলার চোখে লাগাল ও। কয়েকশো গজ দূরের সাউথ আফ্রিকান এমব্যাসি ওর লক্ষ্য। ডি অ্যাঙ্গাসের ওপর নজর রাখছে।

লোকটার • সার্ভিস রেকর্ড জানা আছে মাসুদ রানার। দুই দফায় ভিয়েনার সাউথ আফ্রিকান এমব্যাসিতে সাত বছর চাকরি করেছে। ফ্রানজ ওসনিয়াক ওরফে জিরি হেইকের আগমনে তার মধ্যে বাড়তি কোন তৎপরতা দেখা যায় কি না আবিষ্কার করার আশায় বসে আছে রানা। কিন্তু দিনভর বসে থাকাই সার হলো। তেমন কিছু ঘটল না। যদিও তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। বলা যায় না, হয়তো শেফিল্ডেই মোলাকাত হবে দু’জনের। রাত সাড়ে আটটায় শেষবারের মত বোর্ডিঙ হাউস ত্যাগ করল ফ্রানজ ওসনিয়াক। ট্যাক্সি চেপে রওনা হলো গন্তব্যে। দশ মিনিট চলার পর লোকটার গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হলো ব্রায়ান স্মিথ, জানিয়ে দিল খরটা মাসুদ রানাকে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পথে ছুটল ও লোয়ার রিজেন্ট স্ট্রীটের দিকে।

স্টেশনের সামনে ট্যাক্সি বিদেয় করল অস্ট্রিয়ান। বেশ ধীরস্থির সে এবার। কোনদিক দেখাদেখি নেই, কোন ট্রিক খাটাবার চেষ্টাও নেই। নিশ্চিন্ত। ডিপারচার বোর্ডে চোখ বোলাচ্ছে। তার চারপাশে ভিড়ের মধ্যে মিশে রয়েছে মাসুদ রানা ও অন্যরা। নয়টা পঁচিশের লেস্টার-ডার্বি- চেস্টারফিল্ড-শেফিল্ড ইন্টারসিটি দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। একটু পর সেদিকে এগোল ওসনিয়াক।

প্রথমে বাইরে থেকে গাড়ির এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঘুরে এল লোকটা। এঞ্জিনের সঙ্গেই রয়েছে তিনটে ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিজ, বুফে কার। এরপর নীল কভার মোড়া ক্লাব সীটের তিনটে সেকেণ্ড ক্লাস ক্যারিজ। ওর মাঝেরটায় উঠে পড়ল অস্ট্রিয়ান। মাথার ওপরের র‍্যাকে গ্রিপটা রাখল। আরাম করে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকল।

যাত্রী একেবারেই অল্প। কাজেই কাছাকাছি যাওয়ার ঝুঁকি নিল না রানা। ওসনিয়াকের সামনে-পিছনের ক্যারিজে ভাগ ভাগ হয়ে বসল। গিলটি মিয়া ও অন্য দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে রানা থাকল পিছনে। স্মিথসহ অন্যরা সামনে। ইন্টার ক্যারিজ কাঁচের দরজা দিয়ে ওসনিয়াককে দেখতে পাচ্ছে সবাই। গাড়ি ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে এক নিগ্রো যুবক উঠল মাঝেরটিতে। কানে ওয়াকম্যান। আধবোজা চোখ।

মিউজিকের তালে তালে তুড়ি বাজাতে বাজাতে ওসনিয়াকের তিন সারি সামনে বসে পড়ল সে। তারপর চোখ পুরো বুজে ফেলল। তুড়ি বাজাচ্ছে। পুরু সোলের কেডস্ পরা পা দোলাচ্ছে। তবে এতে রানা বা স্মিথের কোন অসুবিধে হলো না। দু’জনের ওপরই সমান নজর রাখতে পারছে ওরা।

ঠিক সময় মতই সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশন ত্যাগ করল আন্তঃনগর। সোজা ছুটল উত্তরে। ঝাড়া এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট নিজের আসনে বসে থাকল অস্ট্রিয়ান। করার মত ছিলও না কিছু। সঙ্গে পত্রিকা-বই কিছুই আনেনি ব্যাটা। ধূমপানের অভ্যেসও নেই বোঝা গেল। জানালা দিয়ে স্রেফ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাল।

দশটা পঁয়তাল্লিশে গতি কমে এল আন্তঃনগরের। সামনেই লেস্টার। উঠে গ্রিপটা পাড়ল ওসনিয়াক। গ্রাহ্য করল না মাসুদ রানা ও তার সঙ্গীদের ভ্রূকুটি। টয়লেট এরিয়া পার হয়ে এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। কাঁচ নামিয়ে পেট পর্যন্ত বাইরে বের করে দিয়ে ডানে তাকিয়ে থাকল ফ্রেমে দুই কনুইয়ে দেহের ভর চাপিয়ে।

গাড়ি থেমে দাঁড়াতে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো স্থানীয় রেলওয়ের এক পোর্টারের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল অস্ট্রিয়ান। ‘এক্সকিউজ মি, ইজ দিস শেফিল্ড?’

‘নো, স্যার। ইট ইজ লেস্টার।’

‘আহ্, সো। থ্যাঙ্ক ইউ।’ গাড়ি ছাড়া পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল সে। তারপর কাঁচ তুলে দিয়ে নিজের আসনে ফিরে এল। এগারোটা বারো মিনিটে দ্বিতীয়বারের ট্রেনের গতি কমে আসতে দেখে আবারও একই কাজ করল লোকটা। ডার্বি ইন করেছে গাড়ি। উঠে দরজায় এসে দাঁড়াল সে। একই প্রশ্ন করল একজন যাত্রীকে।

‘ডার্বি,’ উত্তর দিল যাত্রী।

গাড়ি যাত্রা শুরু করতে ফিরে এল আসনে। গ্রিপ্‌টা র‍্যাকে তুলে রেখে বসে পড়ল।এগারোটা তেতাল্লিশে চেস্টারফিল্ড স্টেশনে ইন করল গাড়ি। ভিক্টোরিয়ান মডেলের বিশাল, ঝকঝক্ েভবন। মাথার ওপর রূপালি চেইনের সাহায্যে ঝোলানো অসংখ্য ফুলের উঠে দরজার দিকে পা বাড়াল ফ্রানজ ওসনিয়াক। এবার আর গ্রিপ্‌টা নিল না, র‍্যাকেই পড়ে থাকল ওটা। মুখ বের করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। ডান পায়ে তাল ঠুকছে ফ্লোরে। চার-পাঁচজন যাত্রী নামল এখানে। গাড়ি ছাড়ার আগেই ফাঁকা হয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম। লম্বা হুইসল বাজাল এঞ্জিন, পরমুহূর্তে বিশাল এক পাইথনের মত হেলেদুলে রওনা হলো ইন্টার সিটি।

হঠাৎ ঝট করে সিধে হলো অস্ট্রিয়ান, কেউ কিছু ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই এক হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে ফেলল। প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে পড়ল। ছুটে এল সবাই। এমনটা কেউ-ই আশা করেনি। গতি এখনও তেমন তুলতে পারেনি গাড়ি, ইচ্ছে করলেই নেমে যেতে পারে সবাই। কিন্তু তাতে ফাঁস হয়ে যাবে ওদের উপস্থিতি। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে নিজেদের রাখা যাবে না।

চট্ করে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিল মাসুদ রানা। শিকার হাতছাড়া হওয়া বাঘের মত হিংস্র হয়ে উঠেছে চেহারা। এদিকেই তাকিয়ে ছিল ওসনিয়াক, যখন নিশ্চিত হলো আর কেউ নামেনি গাড়ি থেকে, নিশ্চিন্তমনে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল রানার দেহে। ঝট্‌কা মেরে দরজা খুলে ফেলল ও।

শেফিল্ড চলে যাও তোমরা,’ চেঁচিয়ে বলল রানা। ‘গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে যত তাড়াতাড়ি পারো। দরজা বন্ধ করে দাও।

রানিং বোর্ডে নেমে পড়ল মাসুদ রানা। বাইরে অন্ধকার। বেশ বেড়ে গেছে ট্রেনের গতি। ত্রিশ মাইলে উঠে গেছে কম করেও। মনে খানিকটা দ্বিধা থাকলেও সাহস হারাল না ও। ঝাঁপ দিল সামনে প্যারাট্রুপারদের মত। মনে মনে আল্লাকে স্মরণ করল যেন কোন লোহার খুঁটি বা বোল্ডারের ওপর আছড়ে না পড়ে। বাতাসের গতি অনুযায়ী প্যারাট্রুপাররা এগারো থেকে পনেরো মাইল গতিতে মাটি স্পর্শ করে।

মাসুদ রানা করল বিশ মাইল গতিতে। তবে ওর ভাগ্য ভাল, কার্পেটেরমত মোলায়েম, ঘন মে-ঘাস মৃদু অভ্যর্থনা জানাল। পরমুহূর্তেই বল হয়ে গেল রানা। পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত দু’হাঁটু বুকের কাছে, কনুই দুই পায়ের ফাঁকে, মাথা ও দুই হাঁটু দুই কনুইয়ের মাঝখানে—টেনিস বলের মত ড্রপ্ খেতে খেতে পনেরো-বিশ গজ় গিয়ে থামল মাসুদ রানা। আন্তঃনগর ততক্ষণে সরে গেছে অনেক দূরে।

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ও। ছুটল আলোকিত স্টেশনের দিকে। টিকেট ব্যারিয়ারের সামনে যখন পৌঁছল রানা, গার্ড তখন রাতের মত কাজ সেরে স্টেশন সংলগ্ন নিজের কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়িয়েছে। ওর দিকে তাকাল লোকটা অবাক হয়ে।

‘শেষ যে যাত্রীটি বেরিয়ে গেল, গ্রে স্যুট পরা, খালি হাত, গেছে লোকটা?’

হাত তুলে স্টেশনের সামনের কার পার্ক দেখাল গার্ড; ‘ওদিকে।’ তীরবেগে ছুটল মাসুদ রানা। পিছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকছে ওকে গার্ড, ‘হেই, ম্যান! হেই, কাম ব্যাক!’ টিকেটের কথা মনে পড়ে গেছে বোধহয় তার। পাত্তা দিল না রানা কার পার্কে পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকাল। একটা ট্যাক্সিও নেই। শেষ গাড়িটাই নিয়ে ভেগেছে হারামজাদা। হঠাৎ ওপাশের আড়াল থেকে এক পোর্টারকে বেরিয়ে আসতে দেখল রানা। সঙ্গে মোটর সাইকেল রয়েছে লোকটার, ঠেলে নিয়ে আসছে। বাড়ি ফেরার ধান্ধায় আছে হয়তো।

সেদিকে ছুটল রানা। দৌড়ের ফাঁকে পকেট থেকে একশো পাউণ্ডের দুটো নোট বের করে ফেলেছে। ও দুটো পোর্টারের হাতে গুঁজে দিল রানা। ‘দু’ঘণ্টার জন্যে তোমার বাইকটা ধার দাও।’

‘হবে না,’ সোজা সাপ্টা জবাব লোকটার। চেহারা দেখে চোর-ছ্যাচড় ভেবেছে হয়তো রানাকে।

ওজন মেপে মারল রানা। কথা বাড়াবার সময় নেই, অনেক দূরে চলে গেছে তখন ফ্রানজ ওসনিয়াক। তার চোয়ালের ওপর মাঝারি শক্তির এক ঘুসি বসিয়ে দিল মাসুদ রানা। জায়গাটা চেপে ধরে বসে পড়ল পোর্টার বাইক ছেড়ে। এক লাফে এগিয়ে এসে পড়ন্ত বাইক ধরল রানা, নোট দুটো লোকটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কিক্ করল স্টার্টারে। ‘সরি,’ দুঃখ প্রকাশ করল ও। ‘সকালে ফেরত পাবে গাড়ি।’

পরমুহূর্তেই লাফিয়ে ছুটল মোটর সাইকেল। রাস্তার দু’পাশের সবগুলো পোস্টেই আলো আছে, কাজেই হেড লাইট জ্বালল না রানা। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে একজোড়া টেইল লাইট, গতি যথাসম্ভব বাড়িয়ে ধেয়ে চলল সেদিকে। পর পর দু’তিনটে ট্রাফিক পয়েন্টে লাল সিগন্যালের কারণে দাঁড়াতে হলো ট্যাক্সিটিকে, ফলে ব্যবধান দ্রুত কমিয়ে আনতে সক্ষম হলো রানা। হলিওয়েল রোড ছেড়ে ওটা যখন সল্টারগেটে পৌঁছল, ও তখন ওসনিয়াকের মাত্র একশো গজ পিছনে।

হঠাৎ ট্যাক্সির ব্রেক লাইট জ্বলে উঠতে দেখল মাসুদ রানা। জায়গায় দাঁড় করিয়ে ফেলল ও বাইক। বন্ধ করে দিল এঞ্জিন। ওসনিয়াক বেরিয়ে পড়েছে গাড়ি ছেড়ে, তাকাচ্ছে না সে কোনদিকে। কেউ যে ওকে অনুসরণ করেনি সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। মোটর সাইকেলটা পথের পাশে কাৎ করে শুইয়ে রাখল মাসুদ রানা! নিজেও বসে পড়ল ওটার পাশে।

চলে গেল ট্যাক্সি। জন-যানহীন পথের এ-মাথা ও-মাথা নজর বোলাল একবার অস্ট্রিয়ান, তারপর রাস্তা পেরিয়ে ওপারের উঁচু দেয়াল ঘেরা চেস্টারফিল্ড ফুটবল মাঠের দিকে চলল। ছায়ায় ছায়ায় সন্তর্পণে এগোল মাসুদ রানা। মাঠ অর্ধেকটা চক্কর দিতেই কম্পটন স্ট্রীট। মাঠের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো এ রোডের বাড়িগুলো। বেশিরভাগই অন্ধকার। ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষ। সোজা হেঁটে গিয়ে ওর একটার সামনে থামল ওসনিয়াক। নক করল দরজায়।

কয়েক সেকেণ্ড পর আলো জ্বলে উঠল অন্ধকার ঘরটির ভেতরে। দরজা খুলে গেল, ভেতরে সেঁধিয়ে গেল ফ্রানজ ওসনিয়াক। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল রানা, বসে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে। ঘড়ি দেখল, সবে বারোটা পাঁচ। আশ্চর্য হলো ও, মাত্র বিশ মিনিট হয়েছে চেস্টারফিল্ড পৌঁছেছে ট্রেন? অথচ মনে হচ্ছিল না জানি কয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে ধারেকাছেই কোথাও গাড়ির আওয়াজ উঠল। মনে হলো দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়িটা। খুব সম্ভব ফুটবল মাঠের ওপাশে কোথাও হবে। রানা যেখানে মোটর সাইকেল রেখে এসেছে, সেখানে। এক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই আবার চলতে শুরু করল ওটা। আওয়াজ ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।

পরক্ষণেই চমকে উঠল রানা কমিউনিকেটরে গিলটি মিয়ার ক্ষীণ কণ্ঠ শুনে। ‘স্যার, আপনি কি ধারেকাচে কোতাউ রয়েচেন।’

ব্যাপারটা বিশ্বাসই হতে চাইল না ওর। ‘গিলটি মিয়া!’

‘আপনি কোতায়, ‘স্যার?’

‘তুমি কোথায়!’

‘মটোর সাইকেলটার কাচে।’

‘কোন দিক থেকে এখানে আসতে হবে জানাল তাকে রানা। দুই মিনিট পর ভূতের মত নিঃশব্দে হাজির হলো মানুষটা। নির্দেশ অমান্য করেছে গিলটি মিয়া, কাজেই ওর ওপর রাগ হওয়ার কথা। অথচ উল্টে কৃতজ্ঞ বোধ করল রানা।

‘কি করে এলে তুমি?’

একটু ইতস্তত করল গিলটি মিয়া। ‘আপনার পেচন পেচন আমিও লাপিয়ে পড়েচিলুম টেরেন থেকে।

‘ওরা বাধা দেয়নি তোমাকে?’

অন্ধকারে সাদা দাঁত দেখা গেল তার। ‘সুযোগ পেলে তো!’

*খুব খারাপ কাজ করেছ। হাত-পা ভাঙত যদি?’

‘আপনার হাত-পা ভাঙত যদি?’

এরপর কথা বাড়ানো নিরর্থক। ‘বুঝলাম। কিন্তু এতদূর এলে কি করে?’

‘গাড়িতে করে।’

‘কোথায় পেলে গাড়ি!’

‘আপনি স্যার দেকেননি। ইস্টিশানের বাইরে বাঁ দিকে একটা পেট্টল পাম্প ছিল। আপনি তো কুলি ব্যাটাকে ঢিসুম দিয়ে লম্বা দিলেন। আমি কি করি? খুঁজতে খুঁজতে গেলাম পেট্রল…’

‘কথা কম। সংক্ষেপে বলো।’

মুখ ব্যাজার হয়ে গেল গিলটি মিয়ার। ভেবেছিল গাড়ি সংগ্রহের কাহিনী শেষ করে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ার লোমহর্ষক একটা বর্ণনা দেবে। কিন্তু হলো না। ‘ওকেনে তেল নিচ্চিল একটা ট্যাক্সি। ওটা লিয়ে এয়েচি।’

‘ভাল করেছ।’ রানা জানে আরও কথা বাকি আছে গিলটি মিয়ার। চান্স পেলে রাত কাবার করে দিতে পারবে। কাজেই চুপ করিয়ে দিল ওকে। ‘বসে পড়ো চুপ করে।’

দুটোর দিকে ব্রায়ান স্মিথের সাড়া পাওয়া গেল। রেঞ্জের ভেতর এসে পড়েছে ওরা। আরও আধঘণ্টা পর একত্র হলো সবাই। রানার সঙ্গে গিলটি মিয়াকে দেখে আশ্চর্য হলো দলের অন্যরা। ‘গড!’ অস্ফুটে বলল ব্রায়ান। আমি ধরে নিয়েছিলাম…।’

আরেকবার দত্ত প্রদর্শন করল গিলটি মিয়া।

বিটওয়েল স্ট্রীট। চেস্টারফিল্ড পুলিস স্টেশনে পুলিস সুপার স্যাম রসটনের মুখোমুখি বসে আছে মাসুদ রানা। এত রাতে গভীর ঘুম থেকে উঠে আসতে হয়েছে বলে মনে মনে বিরক্ত হয়েছেন ভদ্রলোক। তবে মাসুদ রানা কেন কি কাজে এসেছে, খানিকটা আভাস পাওয়ার পর মেজাজ মোটামুটি নিউট্রাল হয়েছে।

সুপারের আগ্রহ মেটাবার জন্যে আসল ঘটনা যতদূর সম্ভব রেখে-ঢেকে জানাল মাসুদ রানা। ‘বলেন কি!’ লাফিয়ে উঠলেন সুপার। ‘তাহলে তো এখনই অ্যারেস্ট করতে হয় ব্যাটাকে।’

‘উঁহুঁ, তাতে কোন লাভ হবে না। অ্যারেস্ট করলে তো লণ্ডনেই করা যেত।’

‘তাহলে?’

‘আগে জানতে হবে ওই বাড়িতে কে থাকে।

‘কোন সমস্যা নয়। নম্বর কত বাড়িটার?’

‘অন্ধকারে দেখতে পাইনি। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সে জন্যে।’

‘আই সী দ্য পয়েন্ট। তাহলে আর কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

‘সকালে চার-পাঁচজন ওয়াচার দরকার হবে আমার। আমার সঙ্গে যারা আছে, তাদের কাউকে না কাউকে ট্রেনে হয়তো দেখেছে লোকটা। এখানে যদি আবার দেখে নিশ্চয়ই সন্দেহ করে বসবে।’

‘দেয়া যাবে। আর কিছু?

‘যে বাড়িতে ঢুকেছে আমার সাসপেক্ট, তার মুখোমুখি কোন একটা বাড়ি প্রয়োজনে খালি করে দিতে হবে। অথবা যদি রাস্তার দিকের একটা রূমও পাওয়া যায়, তাতেও চলবে। আড়াল থেকে লোকটার এবং ও বাড়িতে আর যারা থাকে তাদের ওপর চোখ রাখার জন্যে দরকার হবে। আমার লোক থাকবে ওখানে।’

কি যেন ভাবলেন সুপার। কম্পটন রোড বললেন না? আমার এক বন্ধু -থাকে ওখানে, আটষট্টি নম্বর বাড়ি ও…’

রানার কমিউনিকেটর খড়মড় করে উঠতে থেমে পড়লেন ভদ্রলোক। ওটা মুখের কাছে তুলল রানা। ‘ইয়েস! হ্যাঁ, কত? ফিফটি নাইন? শিওর? ঠিক আছে।’ যন্ত্রটা টেবিলে রাখল রানা। ‘আমার লোক বলছে ওই বাড়ির নম্বর ঊনষাট।’

‘দারুণ!’ বললেন সুপার। ‘মনে পড়েছে, আমার বন্ধুর মুখোমুখি বাড়িটির নম্বর ষাট।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *