সাত
অন্ধ গলিতে ঘুরে মরছে মাসুদ রানা। বেরিয়ে আসার পথ পাচ্ছে না’। আটদিন হয়ে গেল. কোন অগ্রগতি হয়নি কাজের। এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। নির্বাচনী প্রচারণায় মুখর সারা ব্রিটেন। বক্তৃতা-বিবৃতি আর শোভাযাত্রায় উৎসবের রূপ পেয়েছে ছোটবড় প্রতিটি শহর। সবাই ব্যস্ত। কেউ জানে না ওরা কী ভয়ানক বিপদ ঘনিয়ে আসছে মাথার ওপর।
প্রতিদিন অজস্র ভ্রমণার্থী আসে এ দেশে, তাদের প্রত্যেকের আগাপাশতলা সার্চ করে দেখা অসম্ভব একটা কাজ। সে-জন্যে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং ডক পুলিসের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে মাসুদ রানা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের জন্যে। বিশেষ করে ইস্ট ব্লকভুক্ত দেশের নাগরিকদের ব্যাপারে। ঠিক কি খুঁজতে হবে, সে সম্পর্কে খানিকটা ধারণাও দেয়া হয়েছে তাদের।
নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে কি কি মৌলিক পদার্থের প্রয়োজন, প্রফেসর ডেভিড ওয়েনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে মাসুদ রানা। ওর একটা হবে খাঁটি ইউরেনিয়াম ব্লক, টু থার্টি ফাইভ। একটা ট্যামপার, আকার সিলিণ্ডার অথবা বলের মত, যে-কোনটা হতে পারে। এক ইঞ্চি গুরু, হাই টেনসিল হার্ডেনড্ স্টীলের। তৃতীয়টা একটা স্টীল টিউব। এটাও হাই টেনসিল হার্ডেনড্ স্টীলের, এক ইঞ্চি পুরু। টিউবের দৈর্ঘ্য হতে হবে আঠারো ইঞ্চি, ওজন ত্রিশ পাউণ্ড।
রানা নিশ্চিত, এই তিনটে জিনিস অন্তত গাড়ির চেসিসে জুড়ে ব্রিটেনে ঢোকাবার চেষ্টা করা হবে। এ ব্যাপারেও কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ রয়েছে ওর। তাই সবগুলো বর্ডার ও ফেরিঘাটে হন্যে হয়ে জিনিসগুলো খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। গাড়ির অংশ নয়, এমন কোন ব্লক, বল বা গ্লোব এবং সিলিণ্ডার। প্রতিটির ওজন হতে হবে অস্বাভাবিক ভারী। মানুষের ব্যাপারে শ্রেণী বিভেদ থাকলেও গাড়ির ব্যাপারে তা নেই। সে পুব ইউরোপীয়ই হোক, পশ্চিম ইউরোপীয়ই হোক, প্রতিটি গাড়িই সার্চ করা হচ্ছে। কোনও দিক থেকেই কোন খবর নেই এখনও।
বুকে জোর পাচ্ছে না রানা। স্রোতের মত প্রতিদিন আসছে-যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি। মোটর সাইকেল, কার, ভ্যান, ট্রাক, জাগারনাট, আর ও কত কি! শুধু তৎপরতায় কাজ হবে না, মন বলছে ওর। সঙ্গে ভাগ্যের সহায়তাও চাই খানিকটা। দুটোর মিলন না হলে কোন আশা নেই।
পরদিন শনিবার, বিকেল চারটের দিকে ফেরিবোটে করে ডোভার পৌঁছল এক ক্যাম্পার ভ্যান। জার্মান রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ওটার। ভ্যানের মালিক সপরিবারে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে এসেছে ক্যালাইস থেকে। ওটার মালিক-কাম-চালক, উলফ কিগলারের সঙ্গে আছে তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে। ওদের কাগজপত্রে কোন খুঁত চোখে পড়ল না ইমিগ্রেশনের। সব ঠিকঠাক। কাজেই ছেড়ে দিল ওরা কিগলারকে।
ধীরগতিতে কাস্টমসের নাথিং-টু-ডিক্লেয়ার গ্রীন জোনের দিকে এগোল এবার ক্যাম্পার ভ্যান। প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ কি মনে করে হাত তুলল এক কাস্টমস অফিসার। পাশ থেকে রানা এজেন্সির এক ওয়াচার খুঁচিয়ে দিয়েছে তাকে, কারও নজরে পড়েনি ব্যাপারটা। দাঁড়িয়ে পড়ল ভ্যান। আরেকবার পরীক্ষা করে দেখা হলো কিগলারের কাগজপত্র। তারপর ওগুলো ফেরত দিয়ে পিছনের কম্পার্টমেন্টে তল্লাশি চালানো হবে বলে জানাল অফিসার।
হাসিমুখে পাশে বসা সুন্দরী স্ত্রীর দিকে তাকাল উলফ কিগলার। কিছু বলল। অভয় দিল সম্ভবত, কিন্তু বুঝল না অফিসার। বেরিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে দিল সে। ভেতরের লিভিং এরিয়ায় খেলা করছিল তাদের দুই ছেলেমেয়ে, ইউনিফর্ম পরা অফিসারকে দেখে ঘুরে তাকাল। ছেলেটি ছোট, বছর চারেক হবে বয়স। মেয়েটির বয়স ছয় বছর। ‘হাই!’ মিষ্টি করে হাসল অফিসার শিশু দুটির উদ্দেশে।
মেয়েটি বেশ চটপটে। উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। ‘গুটেন ট্যাগ!’
তার সোনালি চুল নেড়ে দিল অফিসার। থুতনি স্পর্শ করে আদর করল ছেলেটিকে। তারপর কাজে লেগে পড়ল। নিচে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছে উলফ কিগলার ও রানা এজেন্সির ওয়াচার। প্রথমে নিজের চারদিকে নজর বোলাল অফিসার, তারপর ডানদিকের দেয়ালে ঝোলানো কাবার্ডগুলোর ভেতরটা পরখ করতে লাগল। কাপড়-চোপড় ও রান্নার ইউটেনসিল ছাড়া কিছু নেই ওখানে।
এবার ওর ঠিক নিচের লকারগুলো চেক করা হলো। একটিতে বাচ্চাদের কিছু খেলনা রয়েছে। দুটো পুতুল, একটা টেডি বেয়ার, চার- পাঁচটা রঙচঙে নরম রাবারের বল ইত্যাদি। ছুটে এসে ভেতর থেকে একটি পুতুল বের করে নিল মেয়েটি, ওটা নাচিয়ে উত্তেজিত স্বরে কিছু বলতে লাগল অফিসারকে।
‘ওহ্, বিউটিফুল!’ আবার তার চুল নেড়ে দিল লোকটা। লাফিয়ে নেমে পড়ল ভ্যান থেকে। ‘অল রাইট, স্যার,’ মাথা ঝাঁকাল অফিসার জার্মানের উদ্দেশে। ‘এনজয় ইওর হলিডে।’
‘ড্যাঙ্কি!’
গড়িয়ে গড়িয়ে শেড থেকে বেরিয়ে এল ক্যাম্পার ভ্যান। এগিয়ে চলল ডোভার শহরের দিকে। শহর হয়ে লণ্ডন যাওয়ার ইচ্ছে কিগলারের। তার স্ত্রী ম্যাপ দেখে দেখে নির্দেশ দিচ্ছে, সেই মত গাড়ি চালাচ্ছে সে। এর মধ্যে কয়েকবার হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়েছে কিগলার। দেরি করে ফেলেছে সে। কিন্তু কিছু করার নেই। তার ওপর নির্দেশ ছিল কোনমতেই স্পীড লিমিট অতিক্রম করা যাবে না।
আধঘণ্টা চলার পর চ্যারিঙ গ্রামে পৌঁছল ভ্যান। মেইন রোডের ডানদিকে। গ্রামের শেষ মাথায় দেখা গেল বড় একটি সাইনবোর্ড—হ্যাপি ঈটার ক্যাফেটেরিয়া। স্টিয়ারিঙ ঘোরাল কিগলার, প্রায় শূন্য কার পার্কে দাঁড় করাল ভ্যান। বাচ্চাদের নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে ঢুকল মিসেস কিগলার। এদিকে মিস্টার নির্দেশমত এঞ্জিন কভার তুলে লেগে পড়ল ‘কাজে’। মিনিটখানেক পর অপরিচিত এক কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাল সে। রাইডার’স লেদার ড্রেস পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে।
‘এঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে?’ প্রশ্ন করল আগন্তুক।
‘হ্যাঁ। মনে হয় কারবুরেটরে কিছু একটা হয়েছে।’
‘না,’ মাথা দোলাল মোটর সাইক্লিস্ট। ‘গোলমালটা ডিস্ট্রিবিউটরে। দেরি করে ফেলেছেন আপনি।’
‘দুঃখিত। ফেরি, কাস্টমস সবাই মিলে দেরি করিয়ে দিল। আসুন।’ ভ্যানে এসে উঠল সে তাতায়েভকে নিয়ে। খেলনার লকার থেকে একটা বল বের করে তুলে দিল তার হাতে। ‘এই যে।’
পাঁচ ইঞ্চি ডায়া বলটার, কিন্তু তার ওজন অবিশ্বাস্য। প্রায় বিশ কিলোগ্রাম বা চুয়াল্লিশ পাউণ্ড। হতেই হবে, কারণ ওটার রাবারের আবরণের ভেতর লুকিয়ে আছে আসল জিনিস। খাঁটি ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ। যার ওজন সীসার দ্বিগুণ। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ বের করে বলটা ভরল তাতায়েভ। ভ্যান থেকে নেমে পার্কের ও প্রান্তে রেখে আসা বিএমডব্লিউর দিকে চলল। প্রচণ্ড শক্তি খাটাতে হচ্ছে তাতায়েভকে ওটা হাতের তালুতে করে বয়ে নিয়ে যেতে, মুখের ভাব স্বাভাবিক রাখতে। সবাইকে সে বোঝাতে চাইছে যে জিনিসটা তেমন কিছু নয়। যদিও বোঝার জন্যে কেউ তাকিয়ে নেই তাতায়েভের দিকে।
কভার নামিয়ে দ্রুত ক্যাফেতে ঢুকে পড়ল উলফ কিগলার। ওদিকে পিছনের ফাইবার গ্লাস বক্সে জিনিসটা রেখে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিল মেজর ভ্যালেরি। মেইন রোডে উঠে তুমুল গতিতে ডার্টফোর্ড টানেলের দিকে ছুটল। টানেল অতিক্রম করে সাফোক। সেখান থেকে লণ্ডন হয়ে ইপসউইচ। সুদীর্ঘ সফর।রাস্তা ছেড়ে শূন্যে ভাসছে প্রায় বিএমডব্লিউর দুই প্রশস্ত চাকা, উড়িয়ে নিয়ে চলেছে প্রভুকে।
ভাইজরের ভেতর দিয়ে স্থির চোখে সামনে তাকিয়ে আছে মেজর তাতায়েভ। নিরুদ্বিগ্ন, প্রশান্ত চেহারা। শিস দিয়ে গান গাইছে।
নিজেকে পরাজিত সেনাপতির মত নিঃস্ব, অসহায় মনে হচ্ছে মাসুদ রানার। এত বড় একটা বাহিনী, এত ব্যাপক আয়োজন সব বেকার হতে বসেছে। সব ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢোকা অব্যাহত রয়েছে শত্রুর। জানে, অথচ কিছুই করতে পারছে না ও। অন্ধের মত শিকার করতে নেমেছে রানা। দেখতে না পেলেও ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে শিকারের উপস্থিতি।
কিন্তু এর বেশি কি-ই বা করতে পারে রানা? কি করার আছে? কম্পিউটর প্রিন্টআউটের পাহাড় কোন আশার আলো দেখাতে পারেনি এখন পর্যন্ত। কোন প্যাটার্নের সন্ধান পায়নি রানা ওর মধ্যে। কোন ইস্ট ব্লক নাগরিক একবারের বেশি প্রবেশ করেনি ব্রিটেনে, কোন পাসপোর্ট একবারের বেশি ব্যবহৃত হয়নি।
কিছু কিছু অনিয়ম যে ঘটেনি, তা নয়। ঘটেছে। কিন্তু তার সঙ্গে রানার কাঙ্ক্ষিত অনিয়মের কোন সংযোগ নেই। কয়েকবার করে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে সেগুলো, রূমে নিয়ে আলাদাভাবে লাগেজ তো বটেই, প্রায় উলঙ্গ করে সার্চ করা হয়েছে ওর বাহকদের। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এসব হিথ্রোর ঘটনা। লণ্ডনের বাইরেও এ ধরনের তিনটে ঘটনা ঘটেছে গত দু’দিনে।
এমআই ফাইভের মতে তিনজনই আমেরিকান আণ্ডারওয়ার্ল্ড ফিগার। জুয়া এবং মাদক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ওদেশের পুলিসের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে আশ্রয় পাওয়ার আশায়। ঘাড় ধরে পরবর্তী বিমানে তুলে দেয়ার আগে তাদেরও একই কায়দায় সার্চ করেছে ইমিগ্রেশন-কাস্টমস। বিএসএসের অনুরোধে সিআইএ ওদের পরিচয় ও কীর্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে। এমআই ফাইভের রেকর্ডের সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই তাতে।
কোন কিছু কি নজর এড়িয়ে যাচ্ছে ওর? ভাবল মাসুদ রানা। বিশেষ কিছু? নতুন করে ভাবতে বসল ও, আর কি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া যায় এর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে চেষ্টা বাদ দিল রানা। ঠিক পথেই এগোচ্ছে ও. কোন সন্দেহ নেই তাতে।
মন বলে, একটা না একটা সুযোগ শেষ পর্যন্ত পাবেই ও। কোথাও না কোথাও ছোট্ট একটা ভুল করবেই চতুর ব্রেনটি। করবেই।
চেরিহে’জ ক্লোজ। ইপসউইচ। একটা শক্তিশালী পোর্টেবল রেডিওর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। তার জন্যে নির্ধারিত ব্যাণ্ডে মস্কো রেডিওর কমার্শিয়াল শুনছে সে গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে। বড়সড় একটা ব্রাউন সেট, ক’দিন আগে স্টোমার্কেট থেকে কিনেছে তাতায়েভ। পৃথিবীর প্রায় সব চ্যানেলই ধরে এটায়।
তাতায়েভ বেশ চিন্তিত। দু’নম্বর চালান পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ার সংবাদ সময় মতই মস্কোকে জানিয়েছে সে। কথা ছিল, সেরকম কিছু ঘটলে মস্কোকে কেবল অবহিত করতে হবে তা। এরপর প্রতিদিন রাত বারোটা থেকে পরবর্তী পনেরো মিনিট অথবা প্রতিদিন দুপুর একটা থেকে সোয়া একটা পর্যন্ত এই বিশেষ ব্যাণ্ড শুনতে হবে তাকে। নিজের কাজে গাফিলতি নেই তাতায়েভের।
রাতে সম্ভব না হলে দিনের নির্ধারিত সময় রেডিওর সামনে কাগজ কলম নিয়ে বসে থাকে সে। এক দিনও বাদ দেয়নি ; কিন্তু উত্তর এল না আজও। বিকল্প চালান হাতে না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না সে।
চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার হঠাৎ। আসছে! উত্তর আসছে, কল সাইন শুনতে পেয়েছে সে। ঘড়ি দেখল তাতায়েভ—বারোটা দশ। কলম তুলে নিল তাতায়েড। প্রস্তুত। পর পর দু’বার কল সাইন, তারপর সামান্য বিরতি দিয়ে শুরু হলো সঙ্কেত বার্তা। মোর্স সঙ্কেত। ঝটপট লিখে ফেলল সে ওটা, সরাসরি ইংরেজিতে।
তাতায়েভ নিশ্চিত, ব্রিটিশ, মার্কিন এবং জার্মান লিসনিং পোস্টগুলোও এতক্ষণে লিখে নিয়েছে বার্তাটা। কিন্তু তাতে চিন্তার কিছু নেই। কোড জানা না থাকলে এ আর কারও পক্ষে ডিসাইফার করা কোনমতেই সম্ভব নয়। সেট অফ করে ওয়ান টাইম প্যাড নিয়ে লেগে পড়ল ভ্যালেরি তাতায়েভ। পনেরো মিনিট ব্যয় হলো তার বার্তার অর্থ উদ্ধার করতে। যা এরকম : ফায়ারবার্ড টেন রিপ্লেসিঙ টু আর ভিটি।
আর ভি অর্থ রঁদেভু। টি বিশেষ একটি স্থানের নাম। একটা এয়ারপোর্ট হোটেল। হোটেল পোস্ট হাউস, হিথ্রো। ঝামেলা! ভাবল তাতায়েভ। কুরিয়ার দশ এবং সাতের সঙ্গে খুব কম সময়ের ব্যবধানে সাক্ষাৎ করতে হবে ওকে। প্রথমটির সঙ্গে সকাল সাতটায়, হিথ্রোয়, এবং সাতের সঙ্গে সকাল এগারোটায়। কলচেস্টারে। এর মধ্যে এত পথ অতিক্রম করা কঠিন হবে। তবে পঙ্খিরাজটির ওপর বেশ আস্থা আছে ভ্যালেরি তাতায়েভের। ঠিক সময় জায়গামত গিয়ে হাজির হতে পারবে সে, নিজেকে আশ্বস্ত করল মেজর। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ঠিক চারটের সময় ঘুম ভাঙা চাই। কথাগুলো তিনবার উচ্চারণ করল তাতায়েভ, কানের ভেতর দিয়ে অবচেতন মনে পৌঁছে দিল বার্তাটা। মুহূর্তে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমের কোলে। ডান হাত বালিশের নিচে, আলতো করে ধরে রেখেছে সাকো অটোমেটিক।
কাঁটায় কাঁটায় চারটেয় ঘুম ভাঙল তার। হালকা নাশতা এবং এক কাপ চা খেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল তাতায়েভ। পোস্ট হাউস হোটেলে পৌঁছল সে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। মোটর সাইকেল পার্ক করে লেদার জ্যাকেট ও জিপ সাইডেড ট্রাউজার খুলে ফেলল ভ্যালেরি। নিচে সাধারণ ফ্ল্যানেলের স্যুট পরেই এসেছে। এক পেনিয়ারে ওগুলো ভরল সে! ওটা বন্ধ করে দ্বিতীয়টা খুলে বের করল একজোড়া জুতো। জ্যাকবুট খুলে ওটায় ভরে রাখল, পায়ে দিল জুতো।.
পা বাড়াল হোটেল রিসেপশনের দিকে।
রাতে ভাল ঘুম হয়নি লুইস্ ইয়ারজেলস্কির। কারণ দীর্ঘ চাকরি জীবনে গতকাল সন্ধেয় প্রথম বড় ধরনের একটা ঝাঁকি খেতে হয়েছে তাকে। এমনটি ঘটতে পারে কখনও চিন্তাই করেনি সে। পোলিশ বিমান সংস্থা ‘লট’-এর সিনিয়র স্টুয়ার্ড ইয়ারজেলস্কি। হিথ্রোর ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসে সবার খুবই পরিচিত সে। আগে কখনও তার ব্যাগেজ খুলেও দেখেনি ওরা।
কিন্তু কাল দেখেছে। শুধু তার নয়, প্রত্যেকের। তাও আবার যেমন- তেমন দেখা নয়। ব্যাগের সবকিছু বের করে, ফেলে-ছড়িয়ে বিচ্ছিরি এক কাণ্ড করেছে ওরা। পরিচিত বলে খাতির করেনি বিন্দুমাত্র। তারওপর একেকজনের সে কী চাউনি! সে সময়ে ইয়ারজেলস্কির বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল যে লোকগুলো ওর অনেকদিনের চেনা, এবং তাকেও খুব ভাল করে চেনা আছে ওদের।
কাস্টমসের একজন যখন হাত ঢুকিয়ে দিল তার ব্যাগে, ইয়ারজেলস্কির মনে হলো যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। মুহূর্তে মুখ ভরে উঠেছিল টক টক পানিতে। খানিক পর যখন আসল জিনিস বের করল লোকটা, মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল সে আরেকটু হলে। ওটা ছিল একটা ইলেক্ট্রিক রেজর। ওয়ারশ ত্যাগ করার ঘণ্টাখানেক আগে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা ভরে দিয়েছিল তার ব্যাগে। ওটা নিয়ে কি করতে হবে লণ্ডন পৌঁছে, তাও তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল।
ভাগ্য ভাল যে জিনিসটা ব্যাটারি চালিত বা রিচার্জেবল মডেলের নয়। এবং ধারেকাছে কোন প্লাগ পয়েন্টও ছিল না যে চালু করে ওটার কার্যকরিতা পরীক্ষা করে দেখবে লোকটা। ওই জন্যেই বেঁচে গেছে লুইস ইয়ারজেলস্কি। নইলে হয়ে গিয়েছিল। তার ধারণা, দেখতে রেজরের মত হলেও ওটা আদৌ তা নয়। অন্ করা হলে ঠিকই ধরে ফেলত কাস্টমস যে একটা কিছু গণ্ডগোল আছে ওটায়।
ঠিক সাতটায় রিসেপশনে ঢোকার আগে, হাতের বাঁ দিকে, হোটেলের পাবলিক বাথরূমে ঢুকল এসে সিনিয়র স্টুয়ার্ড। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যানেলের স্যুট পরা এক ইংলিশম্যানকে হাত ধুতে দেখে কপাল কোঁচাকাল সে। ড্যাম! কন্ট্যাক্ট যদি এসে পড়ে এখন, ও ব্যাটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাকে। কি করবে ভাবছে ইয়ারজেলস্কি, এই সময় কথা বলে উঠল ইংলিশম্যান।
মর্নিং। আপনার ইউনিফর্মটা কি ইয়োগোস্লাভ এয়ারলাইনের?’
চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিল স্টুয়ার্ড দ্রুত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না। এটা পোলিশ ন্যাশনাল এয়ারলাইনের।’
‘দারুণ এক দেশ পোল্যাণ্ড,’ হাত মুছতে মুছতে বলল যুবক। কোনরকম টেনশনের বালাই নেই তার মধ্যে। হাসি হাসি, অত্যন্ত সপ্রতিভ চেহারা। ‘কিছুদিন ছিলাম আমি আপনাদের দেশে। বড় সুখের ছিল দিনগুলো।’
বড় সুখের ছিল দিনগুলো, আপনমনে মাথা দোলাল ইয়ারজেলস্কি। ঠিক এই কয়টা শব্দই শুনতে চাইছিল সে। রেজরটা বের করে এগিয়ে দিল যুবকের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই থতমত খেয়ে গেল তাকে কটমট করে তাকাতে দেখে। চট্ করে ফিরিয়ে নিল হাত। মাথা দুলিয়ে তাকে একটা দরজা বন্ধ বুদ দেখাল যুবক। বুঝে ফেলল স্টুয়ার্ড। ওর ভেতরে কেউ আছে, তাই সতর্ক হতে বলছে।
মুখ ঘুরিয়ে যে ওয়াশবেসিনের সামনে সে দাঁড়িয়ে, সেটার কাঁচের শেলফটা দেখাল ইংলিশম্যান। ওর ওপর রাখতে বলছে সে জিনিসটা। তাই করল স্টুয়ার্ড। এবং যুবকের আরেক চোখে শাসানি ও ইঙ্গিত দেখে তাড়াতাড়ি প্যান্টের জিপ্ খুলে দাঁড়িয়ে গেল ইউরিনালের সামনে। পাঁচ আঙুল তুলে দেখাল যুবক। অর্থাৎ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলছে তাকে এখানে।
মাথা নেড়ে সায় দিল ইয়ারজেলস্কি। বলল, ‘ধন্যবাদ। পোল্যাণ্ড সত্যিই খুব সুন্দর দেশ।’
কথাটা শোনেনি বোধহয় যুবক, ভাবল স্টুয়ার্ড। তার আগেই রেজর নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে এম টুয়েলভ মোটরওয়েতে পৌঁছে গেল তাতায়েভ। উড়ে চলেছে উত্তর-পূব লণ্ডনের এসেক্স কাউন্টি বর্ডারের দিকে। আটটা বেজে কয়েক মিনিট তখন।
হারউইচের পার্কস্টোন কী-র জেটিতে এসে ভিড়ল ‘টর ব্রিটানিয়া’ ফেরি। ওটা গোথেনবার্গ থেকে এসেছে। এ ফেরির যাত্রী সাধারণত ট্যুরিস্ট, ছাত্র, কমার্শিয়াল ভিজিটর। ওটা ভিড়তে দল বেঁধে নেমে এল সবাই। ওর মধ্যে স্টিগ লাণ্ডভিস্ট নামে এক কমার্শিয়াল ভিজিটর রয়েছে। নিজের স্যাব সেলুন কার নিয়ে এসেছে লোকটি।
তার কাগজপত্র বলছে সে একজন সুইডিশ ব্যবসায়ী। কথাটা মিথ্যে নয়। একদম সত্যি। আরও সত্যি যে সে একজন গোঁড়া কমিউনিস্ট এজেন্ট। কথাটা অবশ্য কাগজপত্রে উল্লেখ করতে ভুলে গেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। আসলে জানার কোন উপায় নেই যে স্টিগকে কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে সুইডিশ সরকার অনেক আগেই। এবং পুলিসের তাড়া খেয়ে পুব জার্মানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে এইচভিএ-র এজেন্ট সে।
গাড়ি থেকে নামার অনুরোধ করা হলো তাকে। বলা হলো সঙ্গের লাগেজ নিয়ে এক্সামিনেশন বেঞ্চে আসতে। তাই করল স্টিগ লাগুভিস্ট। মুখে অমায়িক হাসি। এদিকে তার লাগেজ চেকিঙ চলছে, ওদিকে আরেক কাস্টমস অফিসার গিয়ে তার সেলুনের এঞ্জিন কভার তুলে ঝুঁকে পড়ে ভেতরটা দেখতে লাগল। একটা চকচকে স্টীলের বল বা রডের মত দেড় ফুট দীর্ঘ পাইপ ধরনের কিছু একটা খুঁজছে সে। এঞ্জিন কম্পার্টমেন্টের ভেতর কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়ে থাকতে পারে জিনিসগুলো। কিন্তু নেই।
এবার গাড়ির তলা দেখল লোকটা। তারপর পিছনের বুট। সাধারণ টুল কিট্ এবং একটা ছোট ফায়ার এক্সটিঙগুইশার ছাড়া ওখানেও কিছু নেই। ব্যাগেজ তল্লাশি শেষ সুইডিশের। স্যুটকেস দুলিয়ে হৃষ্টচিত্তে গাড়ির কাছে ফিরে এল সে।
‘সব ঠিক আছে, অফিসার?’ বিনয়ী কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে।
‘হ্যাঁ। ধন্যবাদ, স্যার। এনজয় ইওর স্টে।’
এক ঘণ্টা পর কলচেস্টারের দক্ষিণে লেয়ের-ডি-লা-হে নামে খুদে এক গ্রামে কিংস ফোর্ড পার্ক হোটেলের কার পার্কে এসে থামল স্টিগ লাগুভিস্টের স্যাব সেলুন। মিড মর্নিং কফি পানের সময় এটা। পার্কে বেশ কিছু গাড়ি রয়েছে। তবে মানুষ নেই কোনটিতে। সবাই ভেতরে পানাহারে ব্যস্ত!
ঘড়ি দেখল লাণ্ডভিস্ট। সময় হয়নি এখনও। আরও পাঁচ মিনিট বাকি। তবে ওই সময়েই যে মুক্তি পাবে সে এমন কোন কথা নেই। ওর পরেও পাক্কা এক ঘণ্টা সময় থাকবে চূড়ান্ত সময়সীমায় পৌঁছতে। যদি লোকটা তার মধ্যে আসে, ভাল। নইলে নতুন স্থান, নতুন সময় নির্ধারণ করে দেবে হউপট ভেরওয়ালটাঙ অউফক্লারাঙ।
লোকটা কি আসবে? আপনমনে ভাবছে লাওভিস্ট, কখন আসবে? চারদিকে ভাল করে তাকাল সে আবার। পিছনদিকে, পার্কের একেবারে ও প্রান্তে এক মোটর সাইক্লিস্টকে দেখতে পেল সুইডিশ, স্ট্যাণ্ডে দাঁড় করাচ্ছে নিজের বিশাল বিএমডব্লিউ। মুখ ঘুরিয়ে সিগারেট ধরাল লাণ্ডভিস্ট। যার আসার কথা, সে দেখতে কেমন জানা নেই তার।
কেমন লোকটা? কোন দেশী? ঠিক এগারোটায় কাঁচের জানালায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ শুনে চমকে ঘুরে তাকাল ব্যবসায়ী। মোটর সাইক্লিস্ট! বোতাম চেপে কাঁচ নামিয়ে দিল সে।
‘আপনার নাম্বার প্লেটের ‘এস’ কি সুইডেন মীন করে? না, সুইটজারল্যাণ্ড?’ প্রশ্ন করল আগন্তুক!
চওড়া হাসি ফুটল লাণ্ডভিস্টের মুখে। বাঁচলাম! ‘সুইডেন। গোথেনবার্গ থেকে আসছি আমি।’
‘যাইনি কখনও ওদেশে।’
আসন ছাড়ার প্রয়োজন হলো না ব্যবসায়ীর। আসল জিনিস, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রটা এখানে পৌছার আগে পথে গাড়ি থামিয়ে পাশের সীটে এনে রেখেছিল সে একটা হেসিয়ান ব্যাগে পুরে। ব্যাগটা চালান করে দিল সে ঝটপট। পেনিয়ারে ভরল তাতায়েভ ওটা। এক ঘণ্টা পর থেটফোর্ডে নিজের লক্ আপ গ্যারাজে পৌঁছল সে। চালান দুটো ফ্যামিলি সেলুনের বুটে ভরে ওটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল ইপসউইচের পথে।
বিকেল তিনটের দিকে আগেরগুলোর সঙ্গে ক্লোদস চেস্টে স্থান পেল দুইয়ের বিকল্প দশম ও সপ্তম চালান।
অসটেণ্ড থেকে দীর্ঘ যাত্রা সেরে ফকস্টোন জেটিতে ভিড়তে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন বোঝার ভারে ডুবু ডুবু ‘কুইন এলিজাবেথ’। পায়ে হাঁটা ট্যুরিস্টের দঙ্গল ও হালকা গাড়ির ভারমুক্ত হতে সময় লাগল এক ঘণ্টারও বেশি। এরপর রয়েছে অসংখ্য দৈত্যাকার টিআইআর জাগারনাট। ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত, ইইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কার্গো বহন করে এগুলো।
ওর মধ্যে সাতটা জার্মানিতে রেজিস্টার্ড। প্রচণ্ড শক্তিধর হ্যানোমাগ রিগ, পিছনে বিশ ফুট দীর্ঘ কন্টেইনারবাহী আঠারো চাকার ট্রেইলার। প্রতিটির ক্যাবের পিছনে, দু পাশে দুটো করে ভার্টিক্যাল এগজস্ট পাইপ রয়েছে আকাশমুখি। এঞ্জিনের গর্জনের সঙ্গে তাল রেখে ধোঁয়া ছুঁড়ছে ওপরে। একেকটা ছাড় করাতে পনেরো বিশ মিনিট করে ব্যয় হলো। ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট টেবিলের জন্যে তৈরি জার্মান কফি মেশিন নিয়ে এসেছে ওগুলো।
হুঙ্কার ছেড়ে কাস্টমস শেড থেকে এক এক করে বেরিয়ে এল জাগারনাটগুলো। রওনা দিল অ্যাশফোর্ড হয়ে লণ্ডনের পথে। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, ওরই একটার এগজস্ট পাইপের ভেতরে, তলার দিকে অবিশ্বাস্য ওজন।
রাত ন’টার দিকে কেন্টের লেনহ্যাম পৌছল রিগটা। রাস্তার পাশে ওটা দাঁড় করিয়ে ক্যাবের ছাদে উঠে এল ড্রাইভার। এগজস্ট পাইপ ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল সে, তারপর ভেতরে হাত চালিয়ে বের করে আনল প্যাড মোড়া পাইপটা। একটু পরই এল সে আঁধার ফুঁড়ে। কালো পোশাক পরা এক মোটর সাইক্লিস্ট। দু’চারটা বাক্য বিনিময় হলো দুজনের। তারপর পাইপটা তার হাতে তুলে দিল জাগারনাট চালক।
আট নম্বর চালান ছিল ওটা।
দু’হাতে রুক্ষ চুল মুঠো করে ধরে বসে আছে মাসুদ রানা। মুখ নিচু করে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে। গর্তে বসে যাওয়া লাল চোখের দৃষ্টি খ্যাপাটে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সব মিলিয়ে উদভ্রান্ত চেহারা। মেজর ন্যাশনাল অ্যালার্ট ঘোষণা ছাড়া ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস যতদূর সম্ভব করছে, তাতে কোন সন্দেই নেই ওর।
ওদেরও এরচেয়ে বেশি কিছু করার নেই। ট্যুরিস্ট ও যানবাহনের নিত্য স্রোত ঠেকিয়ে দিয়ে যদি থরো সার্চের নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন হয় কখনও, সেক্ষেত্রে মেজর ন্যাশনাল অ্যালার্ট ঘোষণা করার নিয়ম আছে, যা জরুরী অবস্থার পর্যায় পড়ে। তেমন কিছু করতে গেলে প্রাণস্পন্দন থেমে যেত দেশের। কারণ রোজ যে পরিমাণ ট্যুরিস্ট চারদিক থেকে ব্রিটেনে প্রবেশ করে থাকে, তা রীতিমত বিস্ময়কর।
ওই জাতীয় কিছু করতে গেলে সামরিক বাহিনীকেও পথে নামাতে হত। কিন্তু মাসুদ রানা তা চায়নি। গোপন সূত্রে পাওয়া হুমকির মোকাবেলা করতে চেয়েছিল ও গোপনেই। কিন্তু ব্যর্থ হতে বসেছে ওর পরিকল্পনা। নাকি হয়েই গেছে? সবগুলো চালান ঢুকে পড়েছে এরই মধ্যে? অনুশোচনা হচ্ছে এখন ওর। কেন এত বড় একটা ঝুঁকি নিতে গেল?
আশঙ্কা হচ্ছে, সর্বনাশটা বুঝি শেষ পর্যন্ত ঠেকাতে পারবে না রানা। ওর অনুরোধে মিডল্যাণ্ডের সবগুলো ইঙ্গ-মার্কিন বিমানঘাঁটির তালিকা ম্যাপ ইত্যাদি সেদিনই যোগাড় করে দিয়ে গেছেন স্যার লংফেলো। তিনটে ঘাঁটি আছে। রেনডেলহ্যাম ফরেস্ট, ওয়াঙফোর্ড ও সেইন্ট এডমাণ্ডস্-এ। এর যে কোন একটিই মস্কোর নিশানা। কিন্তু কোনটি? ধরা যাক, রেনডেলহ্যাম ঘাঁটি। কিন্তু যে ঘটাবে কাজটা, সে কোথায় লুকিয়ে আছে কি করে বুঝবে মাসুদ রানা? লোকটি যে কে, তাও তো হবে।
এতদিন এসব নিয়ে ভাবেনি ও। মনে করেছিল কয়েকটা চালান আটকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে কেজিবির স্পাইটিকে। ব্যর্থ হয়ে এক সময় বাধ্য হয়েই দেশে ফিরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু তা বোধহয় আর হলো না। যতই নিজেকে আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করুক, মন মানছে না। ভার হয়ে আছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রথমে রাহাত খান ও পরে মাসুদ রানাকে কথা দিয়েছিলেন এ নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করবে না ব্রিটেন।সে যে ভেতরের ব্যাপার টের পেয়ে গেছে, বুঝতেই দেবে না মস্কোকে। তারপর নির্বাচন শেষ করেই টপাটপ্ জেলে পোরা হবে লেবার পার্টির লেফুটিস্ট উইঙের মাথাগুলোকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হঠাৎ করেই বেজে উঠল টেলিফোন। মুখ তুলল মাসুদ রানা। রিসিভার কানে লাগাল। ‘ইয়েস?’
‘রানা!’
দূরাগত ভরাট কণ্ঠের ডাকটা দেহের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গের সৃষ্টি করল ওর। ঝট করে সিধে হয়ে বসল রানা। ‘স্যার!’
‘রানা! কেমন আছ তুমি?’ অদ্ভুতরকম নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ। ‘না, স্যার। ভাল না।’
‘আমি বুঝি। ভাল কোন খবর হলে তুমি নিশ্চয়ই জানাতে আমাকে।’
‘এখনও কিছুই করতে পারলাম না, স্যার,’ কণ্ঠে হতাশা চাপা না রানার।
‘রানা, তুমি কি হাল ছেড়ে দিয়েছ?’ প্রশ্নটা তীক্ষ্ণ চাবুকের মত সপাং করে আছড়ে পড়ল যেন কানের পর্দায়। টের পেল রানা, বৃদ্ধের কাঁচাপাকা ভুরু কুঁচকে উঠেছে।
‘জি না, স্যার। কিন্তু…’
‘হাল ছেড়ো না, রানা। হতাশ হয়ো না। তোমার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমার। আমি জানি তুমি পারবে। তুমি ন্যায়ের পক্ষে আছ, ওরা অন্যায়ের পক্ষে। কথাটা মনে রাখবে প্রতি মুহূর্তে। বুকে বল পাবে তাহলে। মনের জোর বেড়ে যাবে, ঠিক যেন কোন বাচ্চা ছেলেকে পরীক্ষার আগে আদর করে মন দিয়ে লেখাপড়া করার ব্যাপারে বোঝানো হচ্ছে, এমনভাবে বললেন তিনি কথাগুলো।
‘জি, স্যার।’
‘ঘাবড়াবার কিছু নেই, বুঝলে? সমস্যার বিরুদ্ধে আঁটশাট বেঁধে লাগতে পারলে ভয় পেয়ে সমস্যাই পিছিয়ে যায়। লেগে থাকো। কাজ হবে। হতেই হবে কাজ!’
আশ্চর্য! ভেতরের সমস্ত হতাশা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। মনের জোর হাজার গুণ বেড়ে গেল রানার। ‘জ্বি, স্যার। লেগে আছি আমি। সুযোগের অপেক্ষায় আছি।’
‘গুড! এখন রাখি তাহলে। দোয়া করি. সফল হও।’