অন্ধ শিকারী – ২.৬

ছয়

তুফানের গতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে থেটফোর্ড ফিরে এল মেজর তাতায়েভ। মোটর সাইকেল গ্যারেজে রেখে পোশাক পাল্টাল সে দ্রুত। একটা হালকা রঙের স্যুট পরে রেইনকোট চাপাল তার ওপর। এরপর গ্যারেজে তালা মেরে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলো চেরিহে’জ ক্লোজ।

যখন বাসায় পৌঁছল সে, ‘তখন ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। ভেতরে ঢুকে দরজায় তালা লাগাল তাতায়েভ। ওপরতলায় এসে ক্লোদস্ চেস্টের নিচের ড্রয়ার খুলে হাঁটু মুড়ে বসল সামনে। সনি পোর্টেবলটা আছে ভেতরে। রেইনকোটের পকেট থেকে প্লাস্টার কাস্টের ব্যাগটা বের করে ওর পাশে রাখল সে। ব্যাগে কি আছে জানে না ভ্যালেরি। জানতে চায়ও না সে।

তাতায়েভের কাজ ওগুলো সংগ্রহ করে অ্যাসেম্বলারের হাতে তুলে দেয়া। চালান সবগুলো পৌঁছলে আসবে সে। বিছানায় যাওয়ার আগে এক কাপ চা তৈরি করল মেজর ভ্যালেরি। দুটো চালান পৌঁছেছে, আরও সাতটা পৌঁছতে হবে। মোট নয়টা। নয়টা অ্যাপয়েন্টমেন্ট, নয়টা ব্যাক- আপ অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং আরও ছয়টা অতিরিক্ত অ্যাপয়েন্টমেন্টের রয়েছে।

প্রথম চালান খোয়া গেলে ব্যাক আপ কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হবে ওগুলো আবার। বাই চান্স, তাদের ভেতর থেকেও যদি এক-আধজন ব্যর্থ হয় কোন কারণে, তা সামাল দেয়ার জন্যেই রয়েছে শেষের এই অতিরিক্ত ছয়জন। প্রতিটি অ্যাপয়েন্টমেন্টের স্থান-কাল মুখস্থ তাতায়েভের। ব্যাক আপ কুরিয়ারদের একজনের সঙ্গে মিলিত হতে হবে তাকে খুব শিগগির দু’ নম্বর বিকল্প চালান নিয়ে আসবে সে। চালানটা কেন যে পৌঁছল, না, তাতায়েভের কোন ধারণা নেই সে ব্যাপারে।

তবে মস্কো ব্যাপারটা জানে। তার গ্লাসগো কনসাল সে ব্যাপারে রিপোর্ট করেছে, জানিয়েছে বিস্তারিত। ওতে ডেকহ্যাণ্ড আঁদ্রেই পাভলভের ‘জিনিসপত্র’ যে প্যাট্রিক পুলিস স্টেশনের লক আপে রয়েছে, সে বিষয়ে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছে কনসাল মস্কোকে।

ঘুমিয়ে পড়ল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে তখন।

টাইয়ের ঢিলে নট্ বুকের কাছে ঝুলছে। চুল এলোমেলো। ঘুমের অভাবে দু’চোখ জবা ফুলের রঙ পেয়েছে। সামনের অ্যাশট্রেতে উপচান সিগারেটের গোড়া। কার্পেট ঢাকা পড়ে গেছে কম্পিউটর পেপারে। ওর মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে মাসুদ রানা। অসহায়ের মত চেয়ে আছে কাগজের স্তূপের দিকে। চেহারায় রাজ্যের শঙ্কা আর হতাশা।

মূল্যবান চার চারটে দিন পেরিয়ে গেছে হাতের ফাঁক গলে, আর এক চুলও এগোতে পারেনি রানা। যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। অন্য তালিকার সঙ্গে গত এক সপ্তাহে সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনে আসা কয়েক শো ইমিগ্রান্টের এনট্রি তালিকাও রয়েছে রানার সামনে। ওর মধ্যে রয়েছে ডেলিগেট, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল বায়ার, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন ভাঁড়, জর্জিয়ার একদল গায়ক-গায়িকা, কোসাকের একদল নর্তক, দশজন অ্যাথলেট এবং তাদের সফরসঙ্গীরা এবং ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিতব্য একটি মেডিকেল কনফারেন্সে যোগ দিতে আসা ডাক্তার।

এছাড়াও আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ট্যুর সেরে ফিরে আসা অসংখ্য ইংরেজ অ-ইংরেজ ট্যুরিস্ট! নেই কেবল অ্যারোফ্লোট ক্রু-অফিসারদের তালিকা, যারা নিত্য আসা-যাওয়া করে মস্কো-লণ্ডন-মস্কো। নেই ডেনিশ যুবকের তথ্যও, যে প্যারিস থেকে এসে বার্মিংহাম দিয়ে এদেশে ঢুকে বেরিয়ে গেছে ম্যানচেস্টার হয়ে।

এ কাজে যথেষ্ট সহায়তা করছে ওকে এয়ারপোর্ট, সী-পোর্ট ও বর্ডার পোস্ট কাস্টমস। এমনিতে ব্রিটিশ কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সব সময়ই কড়া। দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত সচেতন। রানা এজেন্সির অনুরোধে আরও কড়াকড়ি আরোপ করেছে তারা এ ক্ষেত্রে। ওদের সঙ্গে প্রতিটি এন্ট্রি পয়েন্টে কম করেও দু’জন করে বিএসএস ও রানা এজেন্সির এজেন্ট রয়েছে। রানার বিশ্বাস, কোথাও বেলাইনের কিছু ঘটলে সময় মত সামাল দিতে পারবে ওরা।

এর মধ্যে রুশ ব্লকভুক্ত দেশের কয়েকজন ইমিগ্রান্টকে আটক করার মত ঘটনাও ঘটেছে। তবে তা অতিরিক্ত ডিউটি-ফ্রি কারেন্সি সঙ্গে আনার জন্যে, অন্য কোন কারণে নয়। ওদিকে ইমিগ্রেশনের হাতে কোন জাল বা ভুয়া পাসপোর্ট এর মধ্যে পড়েনি। পড়বে বলে আশাও করেনি মাসুদ রানা। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এ ব্যাপারে যতটা ঢিলে, কমিউনিস্ট দেশগুলো ঠিক ততটাই সচেতন। দেশত্যাগ করার আগে নিজ নাগরিকদের পাসপোর্ট অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করে দেখে ওরা। বিশেষ করে দেশটি যদি হয় ব্রিটেন।

রানার মূল দুশ্চিন্তা বিশটিরও বেশি কমার্শিয়াল সমুদ্র বন্দর, যার ওপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বলতে গেলে কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। যেমন গ্লাসগো। বিদেশী নাবিকরা ইচ্ছেমত বন্দর ত্যাগ করতে পারে, যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করতে পারে। ভাগ্যিস ওখানে সেদিন একদল নেড ছিল, নইলে পোলোনিয়াম ডিস্কের টিকির সন্ধানও পেত না কেউ।

রূমের ভেতর পা রেখে থমকে গেলেন স্যার লংফেলো। ওর সঙ্গে আলোচনা করে কিছু অগ্রগতি হলো কি না জানতে এসেছিলেন। কিন্তু চেহারা দেখে সাহস হলো না মুখ খুলতে।

‘আসুন, আসুন,’ বৃদ্ধকে আহ্বান জানাল রানা।

‘না, রানা। থাক বরং। তোমার যা অবস্থা!’

‘ও কিছু নয়,’ সামনের কাগজগুলো ঠেলে পাশে সরিয়ে দিল ও। ‘বসুন।’

বসলেন বৃদ্ধ। এটা-ওটা নিয়ে খানিক আলোচনা হলো দু’জনে। ‘কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে না তো, রানা?’ একসময় প্রশ্ন করলেন স্যার লংফেলো। করেই বুঝলেন, বোকার মত হয়ে গেল প্রশ্নটা। কাজটা পুরোটাই আপাদমস্তক এক মহা সমস্যা। ‘মানে, ঠিক আর কি কি খুঁজতে হবে সে ব্যাপারে কোন ধারণা পেয়েছ? বলেছেন প্রফেসর ওয়েন?’

‘হ্যাঁ।’ ড্রয়ার থেকে একটা তালিকা বের করে এগিয়ে দিল রানা বিএসএস চীফের দিকে। ‘এগুলো। অন্তত এরকমই হওয়ার কথা।

কাগজটায় চোখ বোলালেন তিনি। ‘ব্যাস?’ বিস্মিত হলেন বৃদ্ধ। ‘এসব দিয়েই তৈরি হবে বোমা?

মাথা দোলাল মাসুদ রানা। ‘কিন্তু মুশকিল যে এসব চেনা খুব মুশকিল। গ্লাসগোর মত যদি ভাগ্য সহায়তা না করে তাহলে…।’ ইচ্ছে করেই থেমে গেল ও! ‘ওহ্, আরেকটা কথা।’

‘বলো!’’পুরো মিডল্যাণ্ডে কতগুলো ব্রিটিশ-আমেরিকান বিমান ঘাঁটি আছে, ওর কোন্ কোন্টায় নিউক্লিয়ার ডিভাইস আছে জানা প্রয়োজন।’

‘আজই জেনে যাবে। আর কিছু?’

‘এ মুহূর্তে নেই, স্যার। তবে পরে প্রয়োজন হতে পারে। আমি আসলে একটা প্যাটার্ন খুঁজছি।’

‘কিসের প্যাটার্ন?’

‘একই নাম্বারের পাসপোর্ট নিয়ে একাধিকবার আসা-যাওয়ার ঘটনা ঘটে কি না। অথবা এক পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে আরেক পয়েন্ট দিয়ে কেউ বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কি না। চান্স নেই, আমিও বুঝি। তবুও আশায় আছি।’

নতুন এক ব্যবস্থা নিয়েছে রানা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বন্ধু দেশগুলো থেকে আগতরা যে পয়েন্ট দিয়েই এ দেশে প্রবেশ করুক, তাদের নাম ও পাসপোর্ট নাম্বার কম্পিউটরের মাধ্যমে সারাদেশের প্রতিটি এনট্রি ও এক্সিট পয়েন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে সহজেই তা ঠেকিয়ে দেয়া যাবে।’

‘প্রার্থনা করি সফল হও,’ বিড় বিড় করে বললেন লংফেলো। ‘প্ৰাৰ্থনা করি ওরা যেন অন্তত আর একটা সুযোগ দেয়।

কিন্তু মাসুদ রানাকে কোন সুযোগ দিতে রাজি নয় মেজর ক্রিপচেঙ্কো। কোন প্যাটার্নের সন্ধান দিতে চায় না সে। ক্রিপচেঙ্কোর কোন ধারণাই নেই কি পাচার করছে সে ব্রিটেনে, কি কাজে লাগবে ওগুলো। কেবল জানে, জিনিসগুলো পাঠাবার নির্দেশ আছে তার ওপর। পাঠাতেই হবে। বিফল হলে চলবে না। মোট বারোজন কুরিয়ার বাছাই করেছে সে। প্ৰথম নয়জনের দুটো করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, প্রাইমারি ও অলটারনেটিভ।

প্রথমবার কেউ ব্যর্থ হলে ফিরে আসবে সে, অবশ্য যদি ধরা না পড়ে। আবার ঢুকবে অন্যদিক থেকে। বাকি তিনজন স্ট্যাণ্ড বাই কুরিয়ার। প্রথম দলের কেউ কোন দুর্ঘটনায় পড়লে, ওদের পাঠানো হবে বদলি হিসেবে তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে মেজরকে, এ কাজে কোন কেজিবি রেসিডেন্টুরাকে ব্যবহার করা চলবে না। কোনমতেই না’ এবং ডিরেকটরেট ‘এস’ যাতে ভেতরের কিছু টের না পায়, সে জন্যে তার বিভাগ থেকেও আর কোন ইলিগ্যালকে নেয়া যাবে না।

যে কারণে বাধ্য হয়েই প্রতিবেশীদের সাহায্য চাইতে হয়েছে ক্রিপচেঙ্কোকে। যাদের মধ্যে রয়েছে চেকস্লোভাকিয়ার এসটিবি, পোল্যাণ্ডের এসবি এবং পুব জার্মানির হপট্ ভেরওয়ালটাঙ অউফ-ক্লারাঙ বা এইচভিএ। এরমধ্যে শেষেরটিই সেরা। তাছাড়া ওদের ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদও। কারণ লাখ লাখ পুব জার্মান পালিয়ে গেছে পশ্চিম জার্মানিতে, বসবাস করছে স্থায়ীভাবে। ওর মধ্যে এইচডিএ-র শ’ শ’ ইন প্লেস ইল্লিগ্যালসও রয়েছে। মাঝে প্রাচীর থাকলেও এথনিক জার্মানে পরিচিতি আছে ওদের। বড় একটা প্লাস পয়েন্ট ওটা।

মাত্র দু’জন রুশ নিয়েছে মেজর, বাকিদের ধার করেছে। তার জানার কোন উপায় নেই যে প্রথম দুজনের একজন, ভুয়া ডেকহ্যাণ্ড পাভলভ গ্লাসগোয় ঝাপটা পার্টির হাতে পড়ে শেষ পর্যন্ত মরে বেঁচেছে। এবং তার জিনিসপত্র প্যাট্রিক পুলিস স্টেশনে থাকলেও ওর মধ্যে আসল জিনিসটি নেই। মস্কো তাকে জানিয়েছে যে জাহাজে অতিরিক্ত মদ পানের কারণে পথেই মারা গেছে পাভলভ।

খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থার আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে মেজর ক্রিপচেঙ্কো। তার পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সুবিধে, মাত্র তিন কুরিয়ারকে ইস্ট ব্লক ডিপারচার পয়েন্ট দিয়ে ব্রিটেনে পাঠানোর আয়োজন করেছে সে। অন্যরা যাবে যে পথে গেলে কারও কোন সন্দেহের উদ্রেক হবে না, সে পথে।

ব্রিটিশ কাস্টমস বা ইমিগ্রেশন যাতে কোন প্যাটার্নের সন্ধান না পায়, সে-জন্যেই তার এ আয়োজন।

পরদিন। প্রাগ থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বৃদ্ধ পিয়ানো বাদক অবতরণ করলেন হিথ্রো। আলইটালিয়া ফ্লাইটে। পরদিন উইগমোর হল কনসার্টে পিয়ানো বাজানোর প্রোগ্রাম আছে তাঁর। এমন একজন খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, কাস্টমস চটপট রেহাই দিল তাঁকে এবং তাঁর তিন সফরসঙ্গীকে।

একজন ড্রেসার; যে বাদকের পোশাক এবং সাজগোজের ব্যাপার দেখাশোনা করে। এক মহিলা সেক্রেটারি; ভক্তদের চিঠিপত্রের ঘোঝা সামলানো এবং তার উত্তর দেয়াসহ যাবতীয় পত্র যোগাযোগের কাজ করে সে। অন্যজন ব্যক্তিগত সহকারী। লোকটি তালগাছের মত লম্বা, লিকলিকে স্বাস্থ্য। লোকটা হোস্টদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন ও ঝামেলা সামাল দেয় বাদকের।

তাঁর হোস্ট, ভিকটর হস্সার অর্গানাইজেশনের একদল গুণমুগ্ধ ভক্ত যুবক-যুবতি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল বৃদ্ধকে। কাম্বারল্যাণ্ড হোটেলের নির্ধারিত সুইটে পৌঁছে দিল তাঁকে দলবলসহ। অন্যদের জন্যে সুইটের সঙ্গেই আলাদা আলাদা রূমের ব্যবস্থা আছে।

খানিক বাদে এক এক করে বিদেয় নিল গুণমুগ্ধ ভক্তরা। খানিক জিরিয়ে নেয়ার সুযোগ পেল দলের সবাই। কিন্তু রূমে আশ্রয় নিয়েও সে সুযোগ হলো না ব্যক্তিগত সহকারীর। দুশ্চিন্তায় গত কয়েকদিন থেকেই বিশ্রাম-ঘুম কোনটিই হচ্ছে না তার। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে লোকটির দুশ্চিন্তা! যে কাজের নির্দেশ আছে তার ওপর, তা করার আগ্রহ একেবারেই ছিল না সহকারীর। কিন্তু চেকস্লোভাকিয়ান সিক্রেট পুলিস ও ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এসটিবি-র বিরুদ্ধাচরণ করার কথা ওদেশে কেউ কল্পনাও করে না।

ওদের দাবি না মেনে উপায় ছিল না সহকারীর। রাজি না হলে একমাত্র নাতনীটিকে প্রাগ ভার্সিটিতে ভর্তি করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে তার। সফল হবে না কোনদিনও। ওরা আশ্বাস দিয়েছে যদি সে কাজটা করে দেয়, তাহলে ওরা মেয়েটির ভর্তির ব্যাপার সামাল দেবে। বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হবে না তাকে।

কি চাই? না, তোমার জুতোজোড়া। অবাক হলেও মনের ভাব চেপে রেখে নির্দেশ পালন করেছে সহকারী। দু’দিন পর যখন ফেরত দেয়া হলো, ও দুটো, খুব ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে দেখেছে সে। কিন্তু আবিষ্কার করতে পারেনি কিছুই। মনে হয়েছে যেমন ছিল, তেমনই আছে তার জুতো। ওদের নির্দেশে ওই জুতো পায়ে দিয়েই লণ্ডন এসেছে সহকারী।

সন্ধের পর হোটেলের রিসেপশনে এল সুবেশি এক যুবক। মোলায়েম কণ্ঠে সহকারীর রুম নাম্বার জানতে চাইল সে। একই রকম মোলায়েম কণ্ঠে নাম্বারটা জানানো হলো তাকে কোন প্রশ্ন না করেই। ধারণা করা হলো এ নিশ্চয়ই পিয়ানো বাদকের ভক্ত, সহকারীর মাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করতে এসেছে।

পাঁচ মিনিট পর, নির্ধারিত সময়ে দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে চমকে উঠল ব্যক্তিগত সহকারী। এ সেই সঙ্কেত। প্রথমে তিনটে, তারপর খানিক বিরতি দিয়ে আবার দুটো। লাফিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। দরজার নিচ দিয়ে কেউ এক টুকরো কাগজ ভরে দিল ভেতরে। তুলল ওটা লিকলিকে। ওতে বড় করে লেখা আছে আইডেন্টিফিকেশন কোড।

দরজা পাঁচ ইঞ্চি পরিমাণ উন্মুক্ত করল সে। একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরাজুতো জোড়া বের করে দিল। অদৃশ্য হাত প্রায় কেড়ে নিল ব্যাগ। দরজা বন্ধ করে বাথরূমে এসে ঢুকল সহকারী। কাগজটা কুচি কুচি করে কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিল। বুকের ভার নেমে গেছে। যতটা কঠিন হবে বলে ভেবেছিল সে, ঠিক ততটাই সহজে বিদেয় হয়েছে ঝামেলা। যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ভাবল সহকারী, এবার হয়তো নাতনীটার একটা হবে।

মাঝরাতের দিকে ইপসউইচের বারো নাম্বার চেরিহে’জ-এ পোর্টেবল সনি ও প্লাস্টার কাস্টের পাশে স্থান পেল জুতো জোড়া। চতুর্থ চালান তার গন্তব্যে পৌঁছেছে নিরাপদেই।

কেজিবিকে কেন এত ব্যাপক এক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ রাখলেন রুশ প্রেসিডেন্ট? ভাবছে মাসুদ রানা, কেন? এত ঝুঁকি না নিয়ে সেক্ষেত্রে সহজেই তো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পুরে পাঠানো যেত চালানগুলো! সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা থাকতেও কেন তাকে পাশ কাটালেন প্রেসিডেন্ট? লণ্ডনের রুশ দূতাবাসের উঁচু পর্যায়ে বিএসএসের সোর্স রোমানভ আছে বলে? রোমানভের ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ দেখা দিয়েছে তাঁর মনে? ওর মাধ্যমে বিএসএস খবর পেয়ে যাবে বলে?

না, তা হতে পারে না। রোমানভের ব্যাপারে এখনও কারও মনে সন্দেহ জাগেনি। জাগলে এখনও চাকরিতে বহাল থাকা সম্ভব হত না তার পক্ষে। তেমন কিছু ঘটে থাকলে হয় কৌশলে মস্কো ডেকে নিয়ে যাওয়া হত রোমানভকে, নয় কোন গুরুত্বহীন পদে বদলি করা হত, নয়ত তৃতীয় বিশ্বের কোন অখ্যাত দেশে পাঠিয়ে দেয়া হত।

মাসুদ রানা জানে, মস্কোর এলিট মহলে গত কিছুদিন ধরে ঘন ঘন পরিবর্তন চলছে। বড় বড় কর্তাদের কাউকেই এক পদে ছয় মাসের বেশি রাখা হচ্ছে না। বিশেষ করে কেজিবির বেলায় সেন্ট্রাল কমিটির মনোভাব ভীষণ কঠোর।হাতে গোণা দু’চারজন ছাড়া প্রায় সবাইকেই গণবদলির শিকার হতে হচ্ছে। ইচ্ছেমত যখন-তখন বিদেশে অবস্থানরত কেজিবি রেসিডেন্টুরাদের ডেকে নেয়া হচ্ছে দেশে।

এর কারণ একটাই হতে পারে, ভাবছে রানা। কেজিবির বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী পক্ষ বদল করেছে গত কয়েক বছরে। সংখ্যাটা আশঙ্কাজনক। সেই জন্যেই কি খেপে গেছেন প্রেসিডেন্ট ওদের ওপর? কেজিবি ছাড়াই কাজ চলবে প্রমাণ করতে চাইছেন? কিন্তু রানা যেমন জানে,

তেমনি তিনিও নিশ্চয়ই অবহিত আছেন, এই দ্বীপ দেশটির ব্যাপারে যে অগাধ জ্ঞান রাখে কেজিবি, পৃথিবীর আর কোন গোয়েন্দা সংস্থা তার সিকিভাগও রাখে না।

জানালা দিয়ে দূরের অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চেয়ে আছে অন্যমনস্ক মাসুদ রানা। এ দেশের ভৌগলিক সীমারেখার বাইরে কোথাও কাজ করছে একটি চতুর মস্তিষ্ক। অসম্ভব চতুর মস্তিষ্ক। রানার মন বলছে, ট্রেস করা যাচ্ছে না বলে লোকটা কাজ বন্ধ রেখেছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সে। ধরতে পারছে না কেউ। ধরার উপায় সে রাখেনি বলে। একের পর এক চালান পাঠাচ্ছে সে ব্রিটেনে, অত্যন্ত বিপজ্জনক চালান। ক’টা পাঠাতে পেরেছে সে এ পর্যন্ত? চারটা? পাঁচটা? নাকি ছ’টা? শেষ পর্যন্ত কি ব্যর্থই হতে হবে রানাকে?

তুমি হতে পারো ভাল, মনে মনে নিজেকে বলল রানা; কিন্তু ওই লোক আরও ভাল। সেরা। তোমার কোন চান্স নেই এ যাত্রা, মাসুদ রানা। খুব সম্ভব ব্যর্থ হতে চলেছ তুমি।

টেমসের দিকে তাকাল রানা। বাতাসে মৃদু ঢেউ উঠেছে ঘোলা পানিতে। একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকল ও।

আরও একজন চেয়ে আছে ঢেউয়ে দিকে। তবে টেমসের’ নয়, ইংলি- চ্যানেলের। সাসেক্সের নিউহ্যাভেন পোর্টে কারও জন্যে অপেক্ষা করছে সে। কালো লেদার জ্যাকেট—ট্রাউজার পরনে। পাশেই ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে আছে তার বিএমডব্লিউ। হেলমেটটা সীটের ওপর রাখা। প্রায় দিগন্তরেখার কাছাকাছি একটা ফেরিবোট দেখা যাচ্ছে, চ্যানেলের বিশাল একেকটা ঢেউ ঠেলে এদিকেই আসছে। সেদিকেই চেয়ে আছে মেজর।

ডিয়েপপি থেকে আসছে ফেরিবোট কর্নোওয়ালিস। আর এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে ঘাটে। ওটার ফোরডেকে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ উপকূলের দিকে চেয়ে আছে আন্তন যেলেস্কি। সঙ্গে নিভের্জাল পশ্চিম জার্মান পাসপোর্ট রয়েছে তার। নামটার ভেতরে পোলিশ-পোলিশ গন্ধ। কিন্তু ও কিছু নয়, অনেক জার্মানের পোলিশ নাম আছে, জানে ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন।

প্রথম বাধা পেরিয়ে কাস্টমসের সামনে উপস্থিত হলো আন্তন যেলেস্কি। ওরা খুলে দেখল তার সুটকেস। এক বোতল জিন আর পঁচিশটি চুরুটের আনকোরা একটা বাক্স আছে ওতে। কর্নোওয়ালিসের ডিউটি-ফ্রি শপ থেকে কেনা। কাস্টমসের আপত্তি জানানোর কিছু নেই, কারণ অনুমতির বাইরে কিছু করেনি যেলেস্কি। তাকে মুক্তি দিয়ে পরেরজনকে নিয়ে পড়ল কাস্টমস।

এক প্যাকেট চুরুট ঠিকই কিনেছিল যেলেস্কি, সঙ্গে সঙ্গে তা আবার ফেলেও দিয়েছে সাগরে। ওই প্যাকেটের মত অবিকল দেখতে আরেকটা প্যাকেট সঙ্গে নিয়েই ডিয়েপপি থেকে কর্নোওয়ালিসে ওঠে সে। মাঝপথে এসে ফেরির ডিউটি ফ্রি শপ থেকে চুরুট কিনে বাথরূমে গিয়ে ঢোকে। তারপর সদ্য কেনা প্যাকেটের রঙচঙে লেবেলটি যত্নের সঙ্গে খুলে তা দিয়ে মুড়ে নেয় আগের প্যাকেটটি। সাগরে আশ্রয় পায় আসল চুরুটের প্যাকেট।

স্টেশনে এসে টাইম টেবল চেক করল আন্তন যেলেস্কি। আর আধঘণ্টা পর ছাড়বে লণ্ডন এক্সপ্রেস। টিকেট কেটে এঞ্জিনের কাছাকাছি একটা ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিজে উঠে পড়ল সে। জানালার পাশে বসল আয়েশ করে। যাত্রী ‘নেই তেমন একটা। কম্পার্টমেন্টে যেলেস্কি ছাড়া আর দু’তিনজন আছে কেবল। সময়মত ছাড়ল ট্রেন।

লুইস পৌঁছার সামান্য আগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পোশাক পরা এক দীর্ঘ দেহ এসে দাঁড়াল তার পাশে। হাসি মুখে প্রশ্ন করল, ‘গাড়িটা সোজা লণ্ডন যাবে, তাই না?’

‘না,’ হাসল জার্মান। ‘লুইসে দাঁড়াবে শুনেছি।’

হাত বাড়াল ভ্যালেরি তাতায়েভ। সিগারের চ্যাপ্টা প্যাকেটটা তুলে দিল জার্মান। জ্যাকেটের জিপ খানিকটা নামিয়ে ওটা ভেতরে পাঠিয়ে দিল মেজর, গলা পর্যন্ত টেনে তুলল জিপ। মাথা দুলিয়ে বিদেয় জানাল, বেরিয়ে গেল কম্পার্টমেন্ট থেকে। লুইসে পলকের জন্যে আরেকবার তাকে দেখতে পেল আন্তন যেলেস্কি। রেল লাইনের সমান্তরাল রাস্তা ধরে মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে উল্টোদিকে চলেছে মানুষটা। ফিরে যাচ্ছে নিউহ্যাভেন।

ইপসউইচে আগের চালানগুলোর সঙ্গে যোগ হলো চুরুটের প্যাকেট। অবলীলায় যথাস্থানে পৌঁছে গেছে পঞ্চম চালান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *