পাঁচ
জানালার কাছ থেকে পিছিয়ে এল মাসুদ রানা। চিন্তিত মনে এসে বসল টেবিলে।.ওর সামনেই চেলটেনহ্যাম জিসিএইচকিউর পাঠানো রিপোর্টের একটা কপি রয়েছে। অসংখ্যবার পড়েছে ওটা রানা, প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। আরও একবার পড়ল। তারপর বিরক্ত হয়ে ঝপ করে বন্ধ করল ফাইল কভারটা।
ওটা সরিয়ে আরেকটা পেটমোটা ফাইল টেনে আনল মাসুদ রানা। গত এক সপ্তাহে আকাশ-সড়ক-সমুদ্রপথে যত বহিরাগত ঢুকেছে এ দেশে, তাদের নাম এবং পাসপোর্ট নাম্বারের পূর্ণ তালিকা আছে এতে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় দেশের প্রত্যেকটি এনট্রি পয়েন্ট থেকে কম্পিউটরের মাধ্যমে এগুলো পৌঁছেছে রানার টেবিলে। ওর মধ্যে রুশ ব্লকভুক্ত দেশগুলো থেকে যারা এসেছে, তাদের তালিকা আলাদা।
এরকম জটিল, সময়সাপেক্ষ একটা কাজ এত দ্রুত সম্পন্ন হওয়া এক কথায় অসম্ভব। কিন্তু রানা এজেন্সির বিশেষ নির্দেশে সেটাই সম্ভব করে তুলেছে এদের নিষ্ঠাবান, কর্তব্যপরায়ণ প্রশাসনযন্ত্রের একটি অংশ। যদিও এর ভেতর থেকে অলৌকিক কোন ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করে না মাসুদ রানা। সব জটিলতারই সীমা আছে। কিন্তু এটা এমনই জটিল, যার কোন সীমা নেই।
তবুও ভরসা করে আছে মাসুদ রানা। ওর বিশ্বাস, সমস্যা যত জটিল আর কুটিলই হোক, ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে পারলে সমাধানের একটা না একটা পথ পাওয়া যাবেই। তাছাড়া সমগ্র ব্রিটিশ প্রশাসন ওকে সহায়তা করার জন্যে দাঁড়িয়ে গেছে পিছনে। ভরসা করার ওটাও একটা বড় কারণ। এই ব্যাপক অভিযানের নাম রাখা হয়েছে ‘অপারেশন ব্লাইণ্ড হান্ট’। এর সর্বময় ক্ষমতা মাসুদ রানার হাতে। ওর মুখের নির্দেশই এখন আইন।
এরই মধ্যে কাজে নেমে পড়েছে কয়েক হাজার অপারেটর-ওয়াচার। রানা এজেন্সির প্রায় সবাই তো রয়েইছে, সঙ্গে বিএসএস, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড, এমআইফাইভ, এমআই সিক্স, আর্মড ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স এবং পুলিস সবাই রয়েছে এর মধ্যে। ব্রিটেনের প্রত্যেকটি বিমান বন্দর, নৌ- বন্দর, ফেরিঘাট এবং বর্ডার পোস্ট, মোট কথা প্রতিটি এনট্রি পয়েন্টে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে তারা।
ব্রিটেনে যারা ঢুকতে চাইবে, বিশেষ করে রুশ ব্লকের বা খোদ রুশ নাগরিক, ঢুকতে পারে স্বচ্ছন্দে। বাধা দেয়া হবে না। তবে তাদের পাসপোর্ট, ব্যাগেজ, গাড়ি ইত্যাদি চেক করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। কারও ব্যাপারে যদি সন্দেহ হয়, সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে আশেপাশে উপস্থিত’মেট’-কে, বা রানা এজেন্সি নয়ত বিএসএস স্টেশন চীফকে। তবে সন্দেহ হলেই গ্রেফতার করা যাবে না কাউকেই। আড়াল থেকে ছবি তুলতে হবে তার এবং মাসুদ রানার পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বা তাদেরকে অনুসরণ করে যেতে হবে।
বিএসএস চীফের পাশের রুমটিকে করা হয়েছে ‘অপারেশন ব্লাইও হান্টের’ কন্ট্রোল রূম। তার পাশেরটা কমিউনিকেশনস রূম। ডজনখানেক লাল টেলিফোন, ফ্যাক্স, কম্পিউটর সব মিলিয়ে এলাহি কারবার। কিন্তু এত আয়োজন, এত কিছু তবু কেমন যেন খুঁত খুঁত করছে মন। পারবে তো ও?
দুপুরে সোহেল ও মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান লণ্ডন ত্যাগ করেছেন। তখন থেকেই বিষণ্ণতা পেয়ে বসেছে রানাকে। দুনিয়াতে নিজেকে একদম একা, নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ওর।
জোর করে কাজে মন দিল মাসুদ রানা। সভঙ্গকের ইমিগ্রান্টদের ফাইল খুলে নজর বোলাতে লাগল। কিন্তু মিছেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করল খানিকক্ষণ, দাঁত ফোটাতে পারল না। কোন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ কাজ করতে যাচ্ছে, পরে শুনেছে ও রাহাত খানের মুখে। বুঝতে দেরি হয়নি লেবার পার্টির ভেতরের কারা এ কাজে ইন্ধন জুগিয়েছে মস্কোকে। ওদের সঙ্গে এদের গোপন আঁতাতের কথা আরও আগে থেকেই জানে রানা। কিছু কিছু ঝামেলার জন্যে দেরি হয়ে গিয়েছিল, নইলে এই আঁতাতে লেবার পার্টির কে কে জড়িত, তাদের নাম এবং অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য-প্রমাণ আরও আগেই বিএসএসের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল রানা। কিন্তু হলো না।
সময়ের সামান্য হেরফেরের কারণে রানাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ওরা এবার। যত তথ্য-প্রমাণই থাকুক, কিছু যায় আসে না এখন। ওদের বিরুদ্ধে এ মুহূর্তে কিছু করতে গেলে বিপদে পড়ে যাবে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা। দ্রুত জনসমর্থন হারাবে। যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনে। কাজেই ওই পর্যন্ত আঙুল কামড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনিতে ক্ষমতাসীনদের হেরে যাওয়ার কোন কারণ নেই। সর্বশেষ বিবিসি জনমত জরিপের ফলাফলে লেবারদের চাইতে প্রায় পনেরো শতাংশ এগিয়ে আছে ওরা।
মস্কোপন্থীদের জুজুর ভয়ে যদি ব্যবধান আরও খানিকটা কমেও যায়, খুব বেশি হলে পাঁচ ভাগ কমবে। অতএব দুশ্চিন্তার কিছু নেই, নিজেকে প্রবোধ দিল মাসুদ রানা। ভালয় ভালয় শেষ হোক নির্বাচন, তারপর দেখা যাবে।
রাত ন’টায় উঠল ও। কমিউনিকেশনস্-এর সহকারীদের নির্দেশ দিল জরুরি কোন খবর এলে যেন সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয় ওকে। বেরিয়ে এসে গাড়ি ছোটাল রানা। মাথাটা পরিষ্কার রাখা চাই। তাই আজ আর কাজ নয়। লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে সকালে শুরু করা যাবে নতুন উদ্যমে।
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙানো হলো মাসুদ রানার। জানানো হলো চেলটেনহ্যাম জিসিএইচকিউ আরও একটি স্কোয়ার্ট মেসেজ ট্রেস করেছে খানিক আগে। তড়াক করে বিছানা ছাড়ল ও। দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল কন্ট্রোল রূমের উদ্দেশে। সংস্থা প্রধানের ফ্যাক্স করে পাঠানো সংক্ষিপ্ত রিপোর্টের ওপর কয়েকবার চোখ বোলাল ও। সেই একই ব্যাপার। তিন সেকেণ্ড স্থায়ী ক্যানডেন্টাইন মেসেজ। ট্র্যান্সমিট করা হয়েছে শেফিল্ডের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে।
প্রথমবার ডার্বিশায়ার পিক ডিস্ট্রিক্ট, ভাবছে রানা, তারপর শেফিল্ডের উত্তরে…রুশ স্পাইটি কি নর্থ মিডল্যাণ্ডের কোথাও আস্তানা গেড়েছে? নাকি প্রমাণ করতে চাইছে সে ওখানেই আছে? আসলে ওর ধারেকাছেও নেই, আছে দূরে কোথাও? তাই হবে হয়তো। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে লোকটা কার বোর্ন। ভাবছে মাসুদ রানা। পাশের রূম থেকে একটু পর পরই টেলেক্স-ফ্যাক্স মেশিনের-মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে। নতুন নতুন নামের তালিকা আসছে তো আসছেই।
পুব ইউরোপীয় দেশগুলোর ইমিগ্রান্টদের নামের পাশে স্টার মার্ক করা আছে। সহকারীরা ওগুলোর আলাদা তালিকা তৈরি করে ফাইলবন্দী করছে। বাঁধা নিয়মে এগোচ্ছে সব কাজ। শুধু একটা ফাঁক চাই, মনে বলল মাসুদ রানা। কেবল একটা সুযোগ। টেলিফোনের আওয়াজেঁ চমকে উঠল অন্যমনস্ক রানা। দ্রুত রিসিভার তুলল। ‘ইয়েস!’
*আপনার কল, স্যার। গ্লাসগো বিএসএস স্টেশন চীফ।’
‘পুট মি থু, প্লীজ। থ্যাঙ্ক ইউ। …মাসুদ রানা। ইয়েস, গুড মর্নিং।’ ও প্রান্তের বক্তব্য শুনল ও দীর্ঘ সময় ধরে। টের পেল গরম রক্তের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে শিরায় উপ-শিরায়। বেড়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি। ‘ধন্যবাদ, মিস্টার ফরবস,’ বলল রানা। ‘নেক্সট অ্যাভেইলেবল্ শাটলে গ্লাসগো আসছি আমি। নিজে চেক করতে চাই।’
‘আমি থাকব এয়ারপোর্টে,’ বলল ফরবস। ‘দ্যাটস ভেরি কাইণ্ড অভ ইউ।’
গ্লাসগো বিমানবন্দর শহর থেকে আট মাইল দূরে। আকাশ পথে লণ্ডনের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার দূরত্ব। বিকেল সাড়ে তিনটেয় অবতরণ করল মাসুদ রানার বিমান। হ্যারি ফরবস রানার প্রায় সমবয়সী। সামান্য খাটো। থ্যাবড়া নাক। পরিচয় পর্ব সেরে এয়ারপোর্ট ভবন থেকে বেরিয়ে এল দু’জনে। ফরবসের অপেক্ষমাণ গাড়ি নিয়ে রওনা হলো শহরের দিকে।
পাঁচ মিনিটেই ঘটনা বিস্তারিত শোনা হয়ে গেল মাসুদ রানার! ‘আমার ধারণা সঠিক, এমন দাবি করছি না,’ সবশেষে যোগ করল স্টেশন চীফ। ‘তবে লাশটা দেখে মনে হয়েছে কস্মিনকালেও পাভলভ মার্চেন্ট নেভি ছিল না।’
‘আপনি খবর পান কি ভাবে?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘পুলিস সুপারের নির্দেশে এক ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ফোন করে জানায় আমাকে।’ লাল ট্রাফিক সিগন্যাল দেখে গাড়ি দাঁড় করাল ফরবস। ‘যে দুই পুলিস সার্জেন্ট উদ্ধার করেছিল পাভলভকে, তাদের রিপোর্টে লেখা দেখলাম লোকটা উপুড় অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল পথে। যেটা এ ক্ষেত্রে অসম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। এ ধরনের গণপিটুনির শিকার উপুড় হয়ে থাকতে পারে না, মারের চোটে দেহ তার আপনাআপনিই কুণ্ডলি পাকিয়ে যাবে। এবং জ্ঞান হারালে ওই অবস্থায়ই হারাবে।’
সবুজ আলো জ্বলে উঠল। গীয়ার দিল হ্যারি ফরস। ‘আরও আছে। কাঁধের গানি স্যাকটা দু’হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে দেখেছে তাকে দুই সার্জেন্ট। এ-ও নিঃসন্দেহে আরেক অসম্ভব। আঘাত থেকে মাথা বাঁচাবার চেষ্টা না করে কেউ অমন কাজ করে?’
প্রশ্নটা মনে ধরল মাসুদ রানার। ক্রমাগত বুটের লাথির হাত থেকে মাথা না রক্ষা করে সামান্য…। ‘তারপর ধরুন,’ আবার শুরু করল ফরবস। ‘ঘটনার সময় আর স্থানের বিষয়টাও ভেবে দেখেছি আমি। রাতে কোন সীম্যান ঘাটে বাঁধা জাহাজ ত্যাগ করে বারে যাওয়ার জন্যে। অথবা ব্রোথেলে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু এই লোক? রাত দুটোয় পোর্টের চার মাইল দূরের এক ডুয়াল ক্যারিজওয়েতে শিকার হলো নেডদের। কিন্তু কেন গেল সে ওখানে? বার নেই, রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় বার। ব্রোথেলও ওদিকে নয়। তাহলে কোথায় যাচ্ছিল পাভলভ?’
‘ভাল একটা পয়েন্ট।’ সিগারেট ধরাল মাসুদ রানা। স্টেশন চীফকেও অফার করল। ‘কিন্তু লোকটা যে মার্চেন্ট নেভি ছিল না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন কি করে?’
‘লাশ দেখতে মর্গে গিয়েছিলাম আমি। পতনের ফলে হাড়গোড় চুরমার হয়ে দেহটা দেখার যোগ্য না থাকলেও ব্যাটার মুখ সামান্য দু’চারটে কাটাকুটির চিহ্ন ছাড়া প্রায় অক্ষতই ছিল। আমি এ শহরেই মানুষ, জীবনে কম ডেকহ্যাণ্ড দেখিনি। ওদের চেহারা হয় রোদে পোড়া, তামাটে। কিন্তু এ ছিল ধপধপে ফর্সা। এছাড়া হাতের উল্টোপিঠও তামাটে হয়। তালু হয় কর্কশ। কিন্তু এর হাতে তেমন কোন আলামত ছিল না। মনে হয়েছে আকাডেমিক কোমারভে পা রাখার আগ পর্যন্ত ফাইল ওঅর্ক করেই অন্ধ কাটিয়েছে পাভলভ।
‘আরও একটা সন্দেহের কারণ লোকটার সোনা বাঁধানো দুটো দাঁত। রুশ ফোরডেক ক্রুদের দাঁত সব সময় দেখে এসেছি স্টীল বাঁধানো হয়ে থাকে, রাশান স্টাইলে। ওদেশে সোনা দিয়ে…ব্যাপারটা নিশ্চয়ই প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। অন্তত একজন ডেকহ্যাণ্ডের পক্ষে।’
আনমনে মাথা দোলাল মাসুদ রানা। মনে মনে লোকটির তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। কিছুই দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘আর কিছু?’
‘হ্যাঁ,’ ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসল হ্যারি ফরবস। ‘আর একটা পয়েন্ট।’ সুপারের সামনে সোভিয়েত কনসালের আকস্মিক রেগে ওঠা, পরমুহূর্তে জাহাজের ক্যাপ্টেন ও পলিটিক্যাল অফিসারের আগমন, অতঃপর কানে কানে আলোচনা এবং সবশেষে কনসালের সুমতির উদয় ইত্যাদি খুলে জানাল সে। ‘আমার ধারণা বিষয়টি যাতে বেশি গড়াতে না পারে, সে জন্যে পলিটিক্যাল অফিসারের পরামর্শেই ভিজে বেড়াল বনে গিয়েছিল কনসাল। নইলে লোকটা যে ভাবে খেপে উঠেছিল, অত সহজে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা নয় ব্যাপারটা।’
সোজা প্যাট্রিক পুলিস স্টেশনে এল ওরা। অপারেশন ব্লাইণ্ড হান্টের কম্যাণ্ডিং অফিসার মাসুদ রানার আসার খবর স্টেশন চীফকে আগেই দিয়ে রেখেছিল হ্যারি ফরবস। স্টেশন চীফ নিজে স্বাগত জানাল ওদের কারপার্কে। সময় নষ্ট না করে পথ দেখিয়ে ভবনের পিছনদিকের ফাইলিং কেবিনেটে ঠাসা খুদে একটা রূমে নিয়ে এল সে ওদের দুজনকে।
‘সার্জেন্ট হিউই আর ব্রায়ানের রিপোর্ট পাবেন টেবিলের ড্রয়ারে, ‘ ঘরের একমাত্র টেবিলটি দেখিয়ে বলল চীফ। ‘পাভলভের জিনিসপত্রও ওখানেই আছে। আমি আমার অফিসে আছি। কোন প্রয়োজন হলে খবর দিতে দ্বিধা করবেন না, প্লীজ।’
‘ধন্যবাদ।
একজন সার্জেন্টকে রানার প্রয়োজনের ওপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে বিদেয় নিল লোকটি। প্রথমেই হিউই ও ব্রায়ানের বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ায় মন দিল মাসুদ রানা। ওর জানা হলো না যে ছুটে পালাবার আগে ডেকহ্যাণ্ড পাভলভ হিউইর সামনে থেকে তার টোব্যাকো টিনটা তুলে নিয়েছিল, পালাতে চেয়েছিল ওটা নিয়েই। জানা হয়নি কারণ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে গেছে সে। কয়েকবার করে পড়ল রানা রিপোর্ট দুটো।
তারপর ভাবতে বসল। ধরা যাক, পাভলভ এদেশে প্রবেশ করেছে। করে থাকতে পারে। অসম্ভব নয়। তবে ফরবসের কাছে শুনেছে রানা, জাহাজের ক্রু লিস্টে তার নাম ছিল। এর একটাই অর্থ হতে পারে, এ লোক নকল পাভলভ। আসল ডেকহ্যাণ্ড পাভলভের পরিবর্তে নকল পে-বুক তৈরি করে পাঠানো হয়েছে একে লেনিনগ্রাদ থেকে।
ঠিক আছে, না হয় তাই। কিন্তু কেন এসেছিল সে? অত রাতে জাহাজ ত্যাগ করার কি কারণ তার? গ্রেট ওয়েস্টার্ন রোডে কেন গিয়েছিল? কারও হাতে গোপন কিছু তুলে দেয়ার জন্যে? কাজটা কি সম্পন্ন করতে পেরেছে পাভলভ? যদি পেরে থাকে, তাহলে গানি স্যাকটা রক্ষার জন্যে পড়ে পড়ে মার খেল কেন সে?
রিপোর্ট দুটোর সঙ্গে পিন আপ করা পাভলভের সঙ্গে প্রাপ্ত আলামতের তালিকাটার ওপর চোখ বোলাল রানা আবার। ওটা লেখা এভাবেঃ হাতঘড়ি ১টি, অ্যানোরাক ১টি, রোলনের পুলওভার ১টি, ক্যানভাস গানি স্যাক ১টি, পুরু নিট জার্সি ১টি, টোব্যাকো টিন ১টি, ট্রাউজার ১টি, অন্তর্বাস ১টি, পুরু উলের মোজা একজোড়া এবং চামড়ার জুতো একজোড়া।
নিচের ড্রয়ার খুলল ও। বড় একটা পলিথিন ব্যাগে রাখা আছে আলামতগুলো। জুতোজোড়া দিয়ে শুরু করল রানা। হিলের ভেতর কোন গোপন কুঠুরি আছে কি না, সোল বিযুক্ত করে ভেতরে কিছু রাখার ব্যবস্থা আছে কি না বা ভেতরে, একদম মাথার দিকে কোন গহ্বর আছে কি না আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখল রানা। কিন্তু না, নেই তেমন কিছু। ও দুটো ছেড়ে হাতঘড়ি নিয়ে পড়ল ও।
কাঁচের কোন খবর নেই। সেকেণ্ডের কাঁটাটিও উধাও। ভালমত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো রানা হাতঘড়িটা স্রেফ হাতঘড়িই। অন্য কিছু নয়। এরপর ট্রাউজার। কোমর বা ফ্লাইয়ের কোথাও কোন নতুন সেলাই পড়েছে কি না, চাপ দিলে শক্ত কিছু বাধে কি না ওসব জায়গায়, কোথাও কোন পট্টি আছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। নেই।
এরপর অ্যানোরাক, রোলনেক পুলওভার, নিট জার্সি এবং মোজা। কোনটির সঙ্গেই সন্দেহজনক কিছু নেই। এবার গানি স্যাক। ওটা স্পর্শ করামাত্রই কেন যেন মনে হলো মাসুদ রানার যে রহস্যময় নাবিকটি যদি সঙ্গে করে সত্যিই কিছু এনে থাকে, তা এর মধ্যেই রয়েছে। টোব্যাকো টিন রেখে ব্যাগটাই ধরল ও প্রথম। অনেকক্ষণ পর নিশ্চিত হলো ও যে আসলেই ওটা একটা ব্যাগ। তলাটা দুই পাল্লা ক্যানভাসের, বাকি চারদিক এক পাল্লার। এবং ওর আইলেট দুটো মিনিয়েচার কোন ট্র্যান্সমিটার নয় বা ড্রস্ট্রিং কোন গুপ্ত অ্যারিয়েলও নয়।
সবশেষে টোব্যাকো টিন। রাশিয়ায় তৈরি সাধারণ স্ক্রু-টপ টিন। মুখ খুলতে ভেতরে তামাকের মৃদু গন্ধও পাওয়া গেল। টিন উপুড় করে ভেতরের জিনিসগুলো টেবিলের ওপর ঢালল মাসুদ রানা। আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে এল হ্যারি ফরবস। ‘কি ওগুলো?’
চোখ কুঁচকে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল রানা। শুনতে পায়নি প্রশ্নটা। তিনটে ধাতব চাকতি। দুটো অ্যালুমিনিয়ামের মত চকচকে, হালকা। অন্যটার রঙ সীসার মত, ওজনেও বেশ ভারি। চাকতি তিনটে পাশাপাশি সাজিয়ে চেয়ে থাকল রানা। ফরবস এবং সার্জেন্টও চেয়ে আছে। হালকা চাকতি দুটোর ব্যাস তিন ইঞ্চি, অন্যটির দুই ইঞ্চি। কেমন শির শির করে উঠল রানার গায়ের ভেতর। কি ওগুলো!
রাত ন’টায় লণ্ডন ফিরে এল মাসুদ রানা। এয়ারপোর্টের শর্ট-টার্ম পার্ক থেকে নিজের গাড়িটা সংগ্রহ করে এম-ফোর মোটরওয়ের দিকে চলল। মোটরওয়েতে উঠে গতি বাড়াল ও, দ্রুতবেগে ছুটল দক্ষিণে। দশ মিনিট চলার পর এক তেমাথায় পৌঁছল। বাঁ দিকেরটা গেছে লণ্ডন, ডানদিকেরটা বার্কশায়ার!
ডানে বাঁক নিল মাসুদ রানা। টানা আধঘণ্টা ছোটার পর পৌঁছল গন্তব্যে। আলডারমাস্টন জায়গাটার নাম। ব্রিটেনের ইনস্টিটিউট অভ অ্যাটমিক ওয়েপনস্ রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্ট-এর বিশাল কমপ্লেক্স রয়েছে এখানেই। নাম শুনে বোঝা না গেলেও এটি আসলে মাল্টি ডিসিপ্লিন ইউনিট। নিউক্লিয়ার ডিভাইস ডিজাইন’ এবং তৈরি করা ছাড়াও কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, এঞ্জিনীয়ারিং, অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকস্, রেডিও বায়োলজি, ইলেক্ট্রোনিকস্ ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ের ওপরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় এখানে। একই সঙ্গে মেটালারজি ডিপার্টমেন্টও রয়েছে এর।
শেষের এই ডিপার্টমেন্টের এক বিজ্ঞানীকে চেনে মাসুদ রানা। অনেক দিন আগে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা বোমা তৈরির কাজে কোন কোন ধাতব বেশি ব্যবহার করে, লণ্ডনে একদল ইন্টেলিজেন্স অফিসারের উদ্দেশে তা নিয়ে বিশেষ এক কোর্সে ভাষণ দিয়েছিলেম ভদ্রলোক। রানাও ছিল ওই অফিসারদের মধ্যে।
‘ওয়েল ওয়েল,’ রানার পরিচয় এবং তাঁর সঙ্গে ওর পরিচয়ের সূত্র শুনে মৃদু হাসলেন বিজ্ঞানী, প্রফেসর ডেভিড ওয়েন। ওয়েলশ অ্যাকসেন্টে বললেন, ‘দারুণ স্মরণশক্তি আপনার। নাম-ধাম সব মনে রেখেছেন আমার! অল রাইট, মিস্টার মাসুদ রানা। বলুন কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে।
পকেট থেকে ধাতব চাকতি তিনটে বের করল মাসুদ রানা। টিনটা আনেনি ও, রুমালে মুড়ে নিয়ে এসেছে এগুলো। ‘এই জিনিসগুলো ঠিক চিনতে পারছিনে, প্রফেসর। এগুলো কি, কি কাজে লাগে যদি দয়া করে জানান, খুব উপকৃত হব।’
চাকতিগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন প্রফেসর ওয়েন। ‘কি এগুলো!’ আপনমনে বললেন। ‘কোন দুরভিসন্ধিমূলক কাজে ব্যবহার হতে পারে বলে ভাবছেন?’ মুখ তুললেন তিনি।
‘হতে পারে না?’
‘হ্যাঁ, পারে। পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।’
‘কত সময় লাগতে পারে, প্রফেসর?’
‘ঘণ্টাখানেক লাগবে। সকালে ল্যাব টেস্ট সেরে আপনাকে জানাতে পারব। যদি এগুলো রেখে যেতে আপত্তি না থাকে আপনার।’
পকেট থেকে ‘কার্ড বের করে প্রফেসরের দিকে বাড়িয়ে ধরল মাসুদ রানা। ‘কোন আপত্তি নেই। তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রফেসর। আমার সন্দেহ এর সঙ্গে ব্রিটেনের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। টেস্ট সেরে এর যে কোন একটি নাম্বারে ফোন করলেই পাবেন আমাকে। এবং দয়া করে গোপন রাখবেন বিষয়টা।’
কার্ডে চোখ বুলিয়ে মাথা দোলালেন ধাতু বিশারদ। ‘অফকোর্স।’
পরদিন সকাল দশটায় ফোন করলেন প্রফেসর ডেভিড ওয়েন। ‘মিস্টার মাসুদ রানা?’
‘ইয়েস, প্রফেসর।’’আপনার জিনিসগুলো পরীক্ষার কাজ শেষ করলাম এইমাত্র।’ ‘কি বুঝলেন?’
‘খুবই ইন্টারেস্টিঙ। সম্ভব হলে এখনই চলে আসুন। ফোনে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়তো ঠিক হবে না।’
মনে করুন রওনা হয়ে গিয়েছি আমি, প্রফেসর।
‘গুড।’
আলডারমাস্টন কমপ্লেক্সের ভিজিটর’স কার পার্কে একটাই মাত্র স্লট খালি। সাঁ করে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল রানা ওর মধ্যে। পঁচিশ-ত্রিশ পা হেঁটে মেইন কমপ্লেক্স বিল্ডিঙের রিসেপশন ডেস্কে পৌঁছে নিজের নাম জানাল অ্যাটেনডেন্টকে। বাঁ দিকে রাখা একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ির ভেতর থেকে কয়েকটা পাস তুলে নিয়ে চোখ বোলাল লোকটা। ওর থেকে একটা আলাদা করে বলল, ‘কি নাম বললেন, স্যার? মিস্টার মাসুদ রানা?’
‘হ্যাঁ।’
পাসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল সে। ‘তিন তলায় প্রফেসর ওয়েনের রূম, স্যার। রুম নাম্বার দুশো বারো। সোজা গিয়ে ডানে ঘুরলেই লিফট।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ইউ ওয়েলকাম।’
দরজা খোলার শব্দে নাকে ঝোলানো চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে তাকালেন ডেভিড ওয়েন। ‘সীট ডাউন, বয়ো (বয়)।’
বসল মাসুদ রানা। প্রফেসরের সামনে রাখা একটা কাঁচের সীলড জার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর। ভেতরে রয়েছে ওরই দেয়া সেই তিন চাকতির একটি—সীসার তৈরি ছোটটি।
‘এই জিনিসটা কোথায় পেয়েছেন আপনি জানতে পারি কি, মিস্টার রানা?’
‘গ্লাসগোয়, অ্যাকচুয়ালি। অন্য দুটো…?’
‘হ্যাঁ, ওগুলোও টেস্ট করেছি। সাধারণ অ্যালুমিনিয়াম ডিস্ক ও দুটো। এটার বডিগার্ড বলতে পারেন ওদের। এটার যাতে ক্ষতি না হয়, তাই দু’পাশটা গার্ড দেয়ার জন্যে তৈরি। এমনিতে মূল্যহীন। জিনিস হচ্ছে এইটা,’ চোখ নাচিয়ে জারটা দেখালেন প্রফেসর।
‘জিনিস!’
‘হ্যাঁ।’
‘কি ওটা, প্রফেসর?’
‘খাঁটি পোলোনিয়াম। কঠিন তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ বিশেষ।’ ভুরু কোঁচকাল মাসুদ রানা। আগে কখনও এ নাম শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। ‘শুনিনি কখনও এর নাম।
‘ওয়েল,’ কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর। ঠোঁট ওল্টালেন। ‘না শোনার ই কথা। এটা খুবই বিরল এক ধাতু।
‘কি কাজে ব্যবহার হয়?’
‘কখনও কখনও ওষুধ তৈরিতে লাগে, তাও খুবই কম। যার কাছে পেয়েছেন এটা, তিনি কি গ্ল্যাসগোয় ‘কোন মেডিকেল এক্সিবিশন বা সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন?’
‘জ়ি না, প্রফেসর,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। ‘সে ধরনের কোন কিছুর সাথে তার আদৌ সম্পর্ক নেই।’
‘ওয়েল, সম্পর্ক আছে এমনটি কিন্তু আমিও ভাবিনি, মিস্টার মাসুদ রানা। সেক্ষেত্রে সম্ভবত আমার আশঙ্কাটাই সত্যি।’
‘আশঙ্কা’ শুনেই সিধে হয়ে গেল ও। ‘কি রকম?’
‘এই সাইজের এক খণ্ড পোলোনিয়ামের একা কিছু করার ক্ষমতা নেই। তবে এর সঙ্গে আরেক মেটাল, লিথিয়ামের যদি সংযোগ ঘটানো হয়, তাহলেই ওটা এক অশুভ সংবাদের কারণ হয়ে উঠবে। এ দুটো মিলিত হয়ে যা হবে, তার নাম সোজা কথায় ইনিশিয়েটর।’
‘কি বললেন?’
‘ইনিশিয়েটর, বয়ো ‘
‘কি কাজে লাগে এ জিনিস, প্রফেসর?
নিউক্লিয়ার বোমা ডেটোনেট করতে।’
ওইদিনই দুপুরের দিকে প্যারিস থেকে আসা ব্রিটিশ মিডল্যাণ্ড এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং অবতরণ করল বার্মিংহামের পশ্চিমে মিডল্যাণ্ডস এয়ারপোর্টে। যাত্রীদের ভেতরে রয়েছে ডেনিশ পাসপোর্টধারী এক যুবক। আর সবার সঙ্গে কাস্টমস চেকিঙের মুখোমুখি হলো সে।
পোশাক-আশাকে বেশ স্মার্ট যুবকটি। বাঁ হাতটি তার ভাঙা, প্লাস্টার করা। কেউ যদি সন্দিহান হয়ে ডেনিশে প্রশ্ন করত তাকে, জবাব পেত অনর্গল ডেনিশে। যুবকের মা ডেনিশ, বাবা জার্মান। এ দুটো ছাড়াও রুশ এবং ইংরেজি ভাষাতেও সমান দখল যুবকের। পুব জার্মানির এরফুর্ট শহরে জন্ম। ভেতরের কথা, ওদেশের এইচভিএ ইন্টেজিলেন্স সার্ভিসের স্টাফ অফিসার সে। কেন তাকে ব্রিটেনে আসতে হয়েছে জানে না যুবক, জানার কোন ইচ্ছেও নেই।
তার ওপর যে নির্দেশ পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে সে। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন চেকিং শেষ হতে বেরিয়ে এল যুবক বন্দর ভবন থেকে। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলো.নিউ স্ট্রীটের মিডল্যাণ্ড হোটেল। বিমানে সারাপথ এবং অবতরণের পর চেকিঙের সময় ভাঙা হাতের সঙ্গে যাতে কারও কোন সংঘর্ষ না ঘটে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল যুবক। এখনও আছে। ওই হাতে ভুলেও কিছু স্পর্শ করছে না সে।
হোটেল রূমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তালা মেরে দিল সে। তারপর কাজে লেগে পড়ল। তার ট্রাভেল ব্যাগের তলায় বসানো পেস্টবোর্ডের সাপোর্টারের ভেতর থেকে একটা পাতলা স্টীল কাটার বের করে কবজির কাছে লম্বালম্বিভাবে প্লাস্টার কাটতে শুরু করল যুবক। কাজটা শেষ হতে ভেতর থেকে ‘ভাঙা’ হাতটা বের করে আনল সে। কাটা কাস্টটুকু কাগজে মুড়ে ভরে ফেলল একটা প্লাস্টিক ক্যারিয়ার ব্যাগে।
সন্ধে ছয়টা পর্যন্ত রূম থেকে বের হলো না যুবক। কারণ ডে-স্টাফরা তার ভাঙা হাত হঠাৎ করে ‘ভাল’ হয়ে যাওয়ার রহস্য নিয়ে ধাঁধায় পড়ে যেতে পারে। রাত আটটায় বের হলো ডেনিশ। নির্দেশমত নিউ স্ট্রীট স্টেশন নিউজপেপার কিয়স্কটা খুঁজে বের করল সে অনায়াসে। নির্ধারিত সময়ে, ঠিক দশটায়, কালো লেদার জ্যাকেট ও ট্রাউজার পরা দীর্ঘ এক লোক এসে দাঁড়াল যুবকের পাশে।
বিড় বিড় করে আইডেন্টিফিকেশন কোড আওড়াল দুজনে। হস্তান্তরিত হলো প্লাস্টার কাস্টের ব্যাগ। মুহূর্তের মধ্যে নেই হয়ে গেল কালো পোশাকধারী। আশপাশের কারও চোখেই পড়ল না ব্যাপারটা।
হোটেলে ফিরে ডিনার সারল যুবক। রাত দুটোর খানিক আগে চেক আউট করল। ট্রেনে ম্যানচেস্টার এসে বিমানে চাপল। এখানে কেউ চেনে না তাকে, দেখেনি কোনদিন। অতএব অসুবিধে হলো না বিন্দুমাত্র। নিরাপদেই ব্রিটেন ত্যাগ করল ডেনিশ। প্রথমে হামবুর্গ, তারপর বার্লিন। সবশেষে চেক পয়েন্ট চার্লি হয়ে প্রাচীর পেরিয়ে ওপারে, নিরাপদ আশ্রয়ে সেঁধিয়ে গেল যুবক।
তৃতীয় চালান খুব সহজেই পৌঁছে দিতে পেরেছে সে মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ ওরফে মার্টিন ফ্ল্যানারির হাতে।