অন্ধ শিকারী – ২.৪

চার

টেবিলের ওপাশে বসেছেন বিসিআই চীফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। তাঁর ডানদিকে বিএসএস চীফ লংফেলো। এপাশে মাসুদ রানা ও সোহেল আহমেদ। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। মিনিট পাঁচেক হলো দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীট থেকে ফিরেছেন দুই বৃদ্ধ।

লংফেলোর মুখে রক্ত নেই এক বিন্দু। চেহারা মরার মত ফ্যাকাসে। মাত্র গতকাল সকালেই ভদ্রলোকের সঙ্গে শেষবার সাক্ষাৎ হয়েছে রানার। এই কয় ঘণ্টার ব্যবধানে কোন মানুষের চেহারা যে এমন অস্বাভাবিকভাবে বদলে যেতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। দু’গাল চুপসে ঢুকে গেছে ভেতরে। ত্বকের স্বাভাবিক লাবণ্য গায়েব হয়ে গেছে, খসখসে হয়ে উঠেছে চেহারা চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত।অন্তঃসারশূন্য। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে ফাঁসীর হুকুম হয়েছে বুঝি লংফেলোর। ধরেরেঁধে ঝোলাতে নিয়ে যাওয়া হবে এখনই।

রাহাত খানের অবস্থাও কম-বেশি একই রকম। কাঁচাপাকা ভুরুর নিচে চোখ দুটো লালচে। নিচে কালির প্রলেপ। কপালের দু’পাশের রগ ফুলে উঠেছে, লাফাচ্ছে তড়াক তড়াক। রানার মাথার ওপর দিয়ে পিছনের দেয়ালের দিকে চেয়ে আছেন বৃদ্ধ। খেয়াল নেই কোনওদিকে, অন্যমনস্ক গভীর দুশ্চিন্তার চিরাচরিত সেই লক্ষণটিও বিদ্যমান হাতে লাইটার থাকতেও আগুন না ধরিয়েই পাইপ টেনে চলেছেন।

মুখে তালা মেরে বসে আছেন দুই বৃদ্ধ। কথা নেই কারও মুখে। কি ঘটেছে, কেন আচমকা রাহাত খানের লণ্ডন ছুটে আসার প্রয়োজন হলো, কেন সোভিয়েত জেনারেল ঢাকায় খোঁজ করেছেন ওকে, এমনকি অনুমান করতেও ব্যর্থ হয়েছে মাসুদ রানা। সোহেলকে বার বার জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পায়নি। আসলে ঢাকার বাইরে ছিল বলে ও-ও রানার মতই অন্ধকারে আছে। জানে না ভেতরের খবর। নিশ্চয়ই অভাবনীয় একটা কিছু ঘটতে চলেছে, ভাবল রানা। নাকি ঘটেই গেছে?

‘রানা, কেজিবির এফসিডি চীফ তোমার খোঁজ করেছিলেন ঢাকায়। শুনেছ নিশ্চই?’ হঠাৎই মুখ খুললেন রাহাত খান।

‘জি, স্যার।’ আনুষ্ঠানিক পরিচয় নেই রানার ভদ্রলোকের সঙ্গে, তবে দু’জন দু’জনের খুব ভালই চেনা! অতীতে বহুবার কর্মক্ষেত্রে তাঁর মুখোমুখি হতে হয়েছে মাসুদ রানাকে। ব্যক্তি বরিসভের নয়, তাঁর পরিকল্পিত কেজিবির কয়েকটি মিশনের। তিনি যেমন জানেন মাসুদ রানা কী চীজ, তেমনি ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্যে রানাও রীতিমত শ্রদ্ধা করে জেনারেলকে। ‘কিন্তু কেন, স্যার? আমাকে তাঁর কি প্রয়োজন!

‘বলছি,’ তর্জনী দিয়ে ডান চোখের পাতা চুলকালেন বৃদ্ধ। ‘তবে তার আগে খানিকটা ভূমিকা প্রয়োজন। পুরোটা অল্প কথায় বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবু, যতটা সংক্ষেপে পারা যায়, বলছি। ‘৬৮ সালের পয়লা জুলাই, তখনকার বিশ্বের প্রথম তিন পারমাণবিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফিকেশন ট্রিটি নামে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার, তার প্রয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কিত ওটাই ছিল সর্বপ্রথম অফিশিয়াল চুক্তি। পৃথিবীর সবাই জানে এ চুক্তির কথা।

‘পরে চার দফার আরও একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেশ তিনটি, যার কথা ওরা ছাড়া আর কেউ জানে না। এটি অত্যন্ত গোপনে করা হয়। ওরা বুঝতে পেরেছিল যে যে হারে এগোচ্ছে নিত্য নতুন নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্র উদ্ভাবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তাতে ভবিষ্যতে চরম অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে নিজেদেরই! নিজেরাই সৃষ্টি করে বসতে পারে হাজারো সমস্যা। যে কারণে বাধ্য হয়েই ওই চার দফা প্রটোকলে স্বাক্ষর করতে হয় ওদের। ওর প্রথম তিনটি প্রটোকল ছিল কে কি ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে বা বানাতে পারবে এইসব সম্পর্কিত।

‘কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, শেষ প্রটোকলটি বাদে অন্যগুলো মেনে চলার ব্যাপারে কোন পক্ষেরই বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বরং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল তারা কে কত বেশি বেশি ভাঙতে পারে ওগুলো। যে সব অস্ত্র ওই চুক্তিতে তৈরি নিষেধ ছিল, সেগুলো তো বটেই, তা ছাড়াও আরও মারাত্মক সব অস্ত্র বানিয়ে মজুদের পাহাড় গড়ে ফেলল দেশ তিনটি। তাতে লাভই বলি, আর লোকসানই বলি, কাজ হয়েছে এই, কেউ একটা ভয়ানক কিছু তৈরি করে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দু’পক্ষ তার অ্যান্টিডোট আবিষ্কার করে তার হুমকি মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এতে শেষ পর্যন্ত কেউ কারও জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

‘তবে সর্বশেষ, অর্থাৎ প্রটোকলটির ব্যাপারে সবাই খুব সচেতন ছিল। ওটা অমান্য করার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। ওটার আতঙ্ক তখনও যেমন ছিল, আজও তেমনি…কি বলব, একটা জান্তব দুঃস্বপ্নের মত বিরাজ করছে সবার ভেতর। কারণ কেউ যদি চতুর্থ প্রটোকল ভঙ্গ করে, তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে যাবে পৃথিবী ধ্বংসের প্রক্রিয়া।’ হঠাৎ করেই যেন পাইপের কথা মনে পড়ল বৃদ্ধের। চোখ কুঁচকে তাকালেন ওটার দিকে। তারপর তামাকে আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলেন আনমনে।

‘ওই প্রটোকলের অঙ্গীকার কি ছিল, স্যার?’ প্রশ্নটা করল সোহেল।

ঘুরে বিএসএস চীফের দিকে তাকালেন রাহাত খান। এর অর্থ বুঝতে দেরি হলো না স্যার লংফেলোর। ‘আমি বলছি,’ বললেন তিনি। ‘পঁয়তাল্লিশ সালে হিরোশিমা-নাগাসাকির ওপর প্রথম আণবিক বোমা বর্ষণের পর থেকেই এই তিন দেশের নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টরা বোমাগুলোর আকার কত ছোট করা সম্ভব তা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। সে সময় ওগুলোর আকার হত অনেক বড়, বিশাল। স্থানান্তর, পরিবহন ইত্যাদিতে সমস্যা হত খুব। সে গবেষণার ফল ফলেছে আশির দশকে। একটা আস্ত পারমাণবিক বোমা এখন ব্রিফকেসে ভরে অনায়াসে যেখানে খুশি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। শুধু তাই-ই নয়, নয়-দশটা প্রিফ্যাব্রিকেটেড অংশ যেখানে-সেখানে বসে বাচ্চাদের খেলনা কনস্ট্রাকশন কিটের মত জুড়ে বানানোও যাবে এ বোমা ইচ্ছে করলে। অদূর ভবিষ্যতে এমনটি যে ঘটবে, ষাটের দশকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে শেষ প্রটোকলের সৃষ্টি। এর মূল বক্তব্য ছিল এই তিন দেশের কেউ কোন অবস্থাতেই সহজে বহনযোগ্য খুদে পারমাণবিক বোমা বা তার বিযুক্তকৃত প্রিফ্যাব্রিকেটেড অংশসমূহ অপর দু’পক্ষের কারও ভৌগলিক সীমানার অভ্যন্তরে নিয়ে যেতে পারবে না। বিজ্ঞানীদের অভিমত ছিল, এই চুক্তি কঠোরভাবে মেনে চলা না হলে পরস্পরের ভেতর স্যাবোটাজ আর কাউন্টার স্যাবোটাজে দেশ তিনটির ভবিষ্যৎ রকেট-মিজাইল মজুদ, ইলেক্ট্রোনিক কাউন্টারমেজারস্, আর্মস এবং ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাবে।

‘তার মানে…বলতে চাইছেন…।’ থেমে গেল মাসুদ রানা। ঢোক গিলল। অজান্তেই পিঠের পেশী শক্ত হয়ে গেছে। সোহেলেরও একই অবস্থা। দুই বন্ধুর হতভম্ব দৃষ্টি ঘন ঘন নেচে বেড়াচ্ছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দুই বৃদ্ধের মুখের ওপর।

‘ঠিকই ধরেছ তুমি, রানা,’ বললেন রাহাত খান।

‘রাশিয়া?’

ওপর-নিচে মাথা দোলালেন তিনি। ‘মাঠে নেমে পড়েছে ওরা এরই মধ্যে। টপ্‌ ক্লাস এক কেজিবি এজেন্ট ঢুকে পড়েছে ব্রিটেনে। কিন্তু জেনারেল বরিসভ ব্যাপারটা ঘটতে দিতে চান না। তিনি চান তাঁর এজেন্টটিকে বোমা অ্যাসেম্বলিঙের ব্যাপারে বাধা দেয়া হোক। তাই কাজে তোমার সাহায্য আশা করে ঢাকায় যোগাযোগ করেন জেনারেল। তোমার লণ্ডন অবস্থানের কথা জানেন তিনি। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ করতে সাহস পাননি। প্রচুর ঝুঁকি ছিল ওতে।’

‘কিন্তু, স্যার…’

‘জানি কি বলতে চাইছ। উত্তরটা হলো: এর সঙ্গে কেজিবির অফিশিয়ালি কোন সংশ্রব নেই। সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অ্যাসাইনমেন্ট এটা। প্ল্যান অরোরা। অরোরার মূল পরিকল্পনা জিআরইউ চীফ মেজর জেনারেল সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কোর। ব্রিটেনের আগামী সাধারণ নির্বাচনের ঠিক ছয় দিন আগে কোন এক ইঙ্গ-মার্কিন বিমানঘাঁটিতে দেড় কিলো টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নিউক্লিয়ার বোমা ফাটাতে চলেছে রুশ এজেন্টটি। কিন্তু মুশকিল হলো লোকটি কে, কোথায় আছে, কোন্ বিমানঘাঁটিতে বোমা হামলা চালাতে যাচ্ছে, কিছুই জানা যায়নি। ইচ্ছে করেই জানাননি বরিসভ।’

‘যাহ্!’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল সোহেলের।

চোখ মুদলেন রাহাত খান। মনে হলো উপায় নেই দেখে মনে মনে চূড়ান্ত হার স্বীকার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ঝাড়া দু’মিনিট পর মুখ খুললেন তিনি। ‘রুশরা কেন এ পরিকল্পনা নিয়েছে, সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু এদিকে নির্বাচনের আর মাত্র একুশ দিন বাকি। যদি তার ছয়দিন আগে ফাটানো হয় বোমা, তাহলে হাতে থাকে মাত্র চোদ্দ দিন।’

‘কিন্তু জানালেনই যখন, পুরোটা কেন জানালেন না ভদ্রলোক, স্যার?’ ঝড়ের বেগে এলোমেলো সব ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে রানার মাথায়।

‘কারণ আছে। এ কাজে যাকে ব্রিটেনে পাঠিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট, সে হাইলি ট্রেইনড্ এক কেজিবি স্পাই। ইললিগ্যালস্। লোকটি টপ ক্লাসদের মধ্যেও টপ ক্লাস।কেজিবির অমূল্য এক সম্পদ। তাই তাকে হারাবার ঝুঁকি নিতে চান না জেনারেল। সব জানিয়ে দিলে ধরা পড়ে যাবে লোকটা, সেই জন্যে। তাঁর সমস্যাটা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে তুমি, রানা। জেনারেল চান না এমন দুনিয়া কাঁপানো কিছু ঘটুক, মৃত্যু হোক অসংখ্য নিরীহ নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের। লক্ষ ওদের কোন বিমানঘাঁটি হলেও নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলও বিরান হয়ে যাবে বিস্ফোরণে। এর কোনটিই কাম্য নয় বরিসভের।’

মোনাজাত করার মত দু’হাতে অনবরত মুখ ডলছেন রিচার্ড লংফেলো। নিজের মাঝে ডুবে গেছেন বৃদ্ধ। কোন দিকে, কারও দিকে খেয়াল নেই। মানুষটির বুকের ভেতর কি তুফান চলছে, ভেরে খুব খারাপ লাগল রানার।

‘এই বোমা হামলার পরিকল্পনা মস্কোর বাইরে উসভোয় করা হয়েছে। অত্যন্ত গোপনে। এতই গোপনে যে কেজিবিকেও জানানো হয়নি কিছু। জানেন কেবল এর মূল হোতা মার্চেঙ্কো, প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আর তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত তিন বন্ধু। কোনও আভাস-ইঙ্গিত পেয়ে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ভেতরের খবর উদ্ধার করেছেন বরিসভ, পিছ পা হননি মারাত্মক ঝুঁকি আছে জেনেও। তিনি যেটুকু করেছেন, আমি মনে করি অনেক করেছেন।’

‘ঠিক,’ বলল মাসুদ রানা। ‘স্বীকার করতেই হবে।’ লোকটির প্রতি শ্রদ্ধা আরও কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেল ওর। তাঁর এ তদন্তের খবর ফাঁস হয়ে গেলে পরিণতি কি হবে ভাবতেও শিউরে উঠল রানা। সব জেনে-বুঝেও এ পথে পা রেখেছেন জেনারেল, রীতিমত অবিশ্বাস্য। একইসঙ্গে নতুন এক শিক্ষাও হলো মাসুদ রানার। যে কেজিবিকে এতদিন পাষণ্ড, কসাই, হৃদয়হীন ভাবত ও, তার ভেতরে এমন এক-আধজন মানবদরদী ও আছেন। কী আশ্চর্য! 

‘তবে লাঠির ক্ষতি না করে সাপ মারার পথটিও ভদ্রলোক দেখিয়ে দিয়েছেন। ঠিকমত এগোতে পারলে তাতে কাজ হবে।’

মেজর জেনারেলের মন্তব্যে নিকষ কালো আঁধারের মাঝে সামান্য এক চিলতে আলোর আভাস পেল রানা।

‘প্রায় খালি হাতেই এদেশে ঢুকেছে স্পাইটি। সঙ্গে আছে কেবল একটা ওয়ান টাইম প্যাড।’

‘আচ্ছা!’

‘লংফেলোর ধারণা ওটার সাহায্যে এরইমধ্যে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সে অজ্ঞাত এক ফ্লীপার ট্র্যান্সমিটারের মাধ্যমে।

ঝট করে বিএসএস চীফের দিকে ফিরল রানা। ‘তাই?’

করুণ হাসি ফুটলতার মুখে। ‘আমাদের চেলটেনহ্যাম জিসিএইচকিউর একটা রিপোর্ট পেয়েছি কাল দুপুরে। ওরা নাকি,’ চট করে হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন বৃদ্ধ। ‘এখন থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার কিছু বেশি আগে একটা স্কোয়ার্ট মেসেজ ট্রেস করেছে।’

‘কোথায়?’ পলকহীন চোখে চেয়ে আছে রানা।

‘ডার্বিশায়ার পিক ডিস্ট্রিক্টের একটা রাস্তা থেকে ট্র্যান্সমিট করা হয় ওটা। কাজ সেরে সঙ্গে সঙ্গে জায়গা ছেড়ে সরে পড়েছে স্পাইটি। প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু রাহাতের মুখে সব শুনে বুঝলাম এ সে না হয়েই যায় না।’

স্কোয়ার্টের বক্তব্য উদ্ধার অসম্ভব, জানে মাসুদ রানা। তাই ও নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না। চিন্তিত মুখে ফিরল রাহাতু খানের দিকে। ‘যা বলছিলাম,’ বললেন তিনি। ‘বরিসভ জানিয়েছেন, বোমা তৈরির ছোট ছোট নয়টা উপাদান হাতে হাতে নয়দিক থেকে ঢুকবে ব্রিটেনে, এক এক করে পৌঁছবে তার হাতে। সবগুলো হাতে পেলে তবেই বোমা তৈরি সম্পূর্ণ করতে পারবে সে। নইলে নয়।’

‘তার মানে যে কোন দিক থেকে, যে কোন পথে ঢুকতে পারে ওগুলো, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল রানা। ‘সড়ক-আকাশ-সমুদ্র, নিশ্চই সব পথই ব্যবহার করবে ওরা?

‘নিশ্চয়ই!’ জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে সায় জানালেন স্যার লংফেলো।

‘এখন,’ বললেন রাহাত খান, ‘যদি এর দু’তিনটে চালান কোনমতে ঠেকিয়ে দেয়া যায়, তাহলেই ব্যর্থ হতে বাধ্য ওদের মিশন।’

‘দু’তিনটে?’ আবার চোখে আঁধার দেখতে আরম্ভ করল রানা।

‘হ্যাঁ।’ পাইপ ধরালেন বৃদ্ধ। ঘন ঘন টান দিয়ে পুরু ধোঁয়ার একটা পর্দা দিয়ে আড়াল করে ফেললেন নিজেকে। ‘কারণ আমরা জানি না এক আধটা চালান খোয়া গেলে তার বিকল্প চালান পাঠাবার ব্যবস্থা ওরা রেখেছে কি না। আমার মনে হয় না রেখেছে। পুরো ব্যাপারটা সময় সাপেক্ষ, অথচ ওটারই বড় অভাব। এর মধ্যে নয়টা চালানই জায়গামত পৌঁছানো কঠিন। আর যদি রেখেও থাকে বিকল্প ব্যবস্থা, দু’তিনটের রিপ্লেসমেন্ট পাঠানোর সময় থাকবে না। সময়মত জিনিস না পৌঁছলে মস্কোকে জানাতে হবে, তারপর ওরা আবার তা পাঠাবে, সে তো আরও লম্বা সময়ের ব্যাপার। তবু, পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে যে করেই হোক অন্তত দু’তিনটে চালান আটক করতেই হবে। তা যদি সম্ভব হয়, নির্ধারিত তারিখে যদি কাজটা করতে ব্যর্থ হয় ওরা। তাহলে বাধ্য হয়েই মস্কোকে মিশন পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ এর পিছনে ওদের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তা হাসিলের উপায় না থাকলে শুধু শুধু এত বড় একটা কাণ্ড ঘটাবার ঝুঁকি মস্কো নেবে না।

‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এর প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে আমাদের। তোমার ওপর ভদ্রমহিলার প্রচুর আস্থা।কপাল চুলকালেন রাহাত খান। ঘন ঘন টান দিতে লাগলেন পাইপে। ‘ওদিকে জেনারেল বরিসভও তোমার ওপর নির্ভর করে আছেন। তুমি যদি…।’

করণীয় ঠিক করে ফেলল মাসুদ রানা। ‘দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি স্যার।’

‘ভাল করে ভেবে সিদ্ধান্ত নাও, রানা। সাঙ্ঘাতিক ঝুঁকি আছে এ কাজে। তাছাড়া কাজটা তুমিই করে দেবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি আমি ওঁদের কাউকেই দেইনি। আমি এসেছি প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাটা বিস্তারিত জানাতে। কাজটা তুমি করবে কি না, তা সম্পূর্ণ তোমার নিজের ব্যাপার। ইচ্ছে হলে করতে পারো, ইচ্ছে না হলে ভদ্রভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগও রয়েছে।’ কপাল চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ।

‘ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্যার,’ দৃঢ় আস্থার সুর ফুটল রানার স্বরে। ‘ঝুঁকির চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে চাই আমি।’

‘বেশ।’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাহাত খানের চেহারা, চেষ্টা করেও মনের ভাব চেপে রাখতে পারলেন না। স্যার মারভিন লংফেলোর মুখের মেঘও পলকে কেটে গেল। এমন ভাবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি, দেখে মনে হলো এতক্ষণ যেন দম বন্ধ ছিল বুকের ওপর মস্ত কোন চাপের কারণে। হঠাৎ করেই চাপমুক্ত হয়েছেন।

‘তবে একটা কথা, স্যার।’

‘জানি।’ হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ওকে বৃদ্ধ। ‘অপারেশন নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ ক্ষমতা তোমার হাতেই থাকবে। ওসব আমি দেখব।’ মন দিয়ে সার্জেন্ট হিউই ও ব্রায়ানের মৌখিক স্টেটমেন্ট শুনলেন প্রবীণ চীফ সুপারিনটেণ্ডেন্ট অভ পুলিস। মাঝে মধ্যে একটা দুটো প্রশ্ন করলেন। সব শেষে নিশ্চিত হলেন যে এরা মিথ্যে বলেনি। সত্যি কথাই বলেছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এ পেশায় দীর্ঘদিন জড়িত বলে সুপারের অভিজ্ঞতার ঝোলাটিও বেশ বড়। ভালই জানেন তিনি, সত্য বলেও কখনও কখনও এ ধরনের গেরো থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল হয়ে পড়ে।

এই ঘটনাটির কথাই ধরা যাক। রুশ নাবিকটি ছিল পুলিস কাস্টডিতে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সার্জেন্ট হিউইর বক্তব্য অনুযায়ী ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে লোকটি। এর কোন সাক্ষী নেই। ছাতে ছিল তখন একমাত্র হিউই। তাছাড়া এমন কোন কিছু ঘটেওনি যে নাবিকটির আত্মহত্যা করা জরুরি হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে কঠিন হবে ‘প্রেসকে সামাল দেয়া। এমন একটা বাজার গরম করার সুযোগ ওরা ছাড়বে না কিছুতেই।

পুলিসি নৃশংসতা, ভাবলেন সুপার, এ ব্যাপারে স্থানীয় পত্রিকাগুলোর হেডিং নিশ্চয়ই এই হবে। কাজেই নিরীহ দুই সার্জেন্টকে রক্ষা করার জন্যে নাবিকটি টেম্পোরারি হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়ে এ কাজ করেছে বলে প্রমাণ করার ব্যবস্থা করতে হবে তাঁকে। এরপর সোভিয়েত কনসালের ধাক্কা তো রয়েইছে।

কোন জাহাজের নাবিক ছিল লোকটা, জানতে হবে, ভাবতে লাগলেন সুপার। তার ক্যাপ্টেনের জবানবন্দী নিতে হবে, তাকে দিয়ে দেহটা আইডেন্টিফাই করাতে হবে। আরও আছে, পুলিসে ফোন করেছিল কে, তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সের দুই স্টাফ, ড্রাইভার আর মেল নার্স, ওদের জবানবন্দী নিতে হবে। ওয়ার্ড সিস্টার এবং পাকিস্তানি ডাক্তার ইকবালের জবানবন্দীও চাই। সব শেষে ফ্রন্ট- ডেস্ক পোর্টার। ভোর চারটে থেকে টানা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শেষের পাঁচজনের বক্তব্য রেকর্ড করলেন পুলিস সুপার। চারজনের বক্তব্যে বোঝা গেল সত্যিই প্ৰচণ্ড মার খেয়ে জখম হয়েছে নাবিকটি, অমানুষের মত পিটিয়েছে ওকে নেডরা। সবার শেষে, ফ্রন্ট-ডেস্ক পোর্টারের বক্তব্যে খানিকটা আশার আলো দেখা গেল। লোকটা জানাল, মৃত লোকটিকে দৌড়ে এসে লিফটে উঠতে দেখেছে সে। পরপরই সেখানে পৌঁছায় সার্জেন্ট হিউই। লিফটে উঠতে না পেরে সার্জেন্ট পিছনের স্টেয়ারওয়েলে গিয়ে ঢোকে। পরের ঘটনা তার জানা নেই।

আটটায় হাই তুলতে তুলতে অফিসে রওনা হলেন সুপার। রাতের ঘুম তো গেছেই, দিনেও হয়তো বিশ্রাম জুটবে না কপালে। অফিসে এসেই পোর্ট ট্রাফিক অফিসারকে ফোন করলেন তিনি। তার কাছে জানা গেল, আকাডেমিক কোমারভ নামে একটিই রুশ জাহাজ আছে জেটিতে। গতকালই এসেছে। ওটার ক্যাপ্টেনকে নিয়ে আসার জন্যে গাড়ি পাঠালেন সুপার। তারপর টেলিফোন করলেন গ্লাসগোর সোভিয়েত কনসালকে।

টেলিফোনের আওয়াজে গাল ভর্তি একরাশ শেভিং ফোম নিয়ে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল বিএসএসের গ্লাসগো স্টেশন চীফ, হ্যারি ফরবস। এক হাতে রেজর। অন্য হাতে রিসিভার তুলল সে। ‘হ্যালো!’

‘মিস্টার ফরবস? আমি ক্রেইগ।

কপাল কুঁচকে উঠল স্টেশন চীফের। ক্রেইগ প্যাট্রিক পুলিস স্টেশনের একজন প্লেন ক্লথ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর।

‘ইয়েস, ক্রেইগ। হোয়াট ইজ ইট?’ চুপ করে দু’মিনিট লোকটির কথা শুনল স্টেশন চীফ। তারপর যেন নিজেকে শোনাচ্ছে এমন ভাবে বলল, ‘রিয়েলি?’

‘হ্যাঁ। এর মধ্যে আরও গভীর কিছু আছে।’

‘ঠিক আছে, আসছি আমি।’

লাইন কেটে দিয়ে খানিক চিন্তা করল হ্যারি ফরবস। তারপর জোর পায়ে বাথরূমে গিয়ে ঢুকল। সাড়ে আটটা বাজে। তাড়াহুড়ো করে শেভ সেরে পোশাক পরল সে। অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। ছুটল সোজা পুলিস সুপারের অফিস। একই সময় সিটি’ মর্গে পৌঁছল আকাডেমিক কোমারভের ক্যাপ্টেন আর পলিটিক্যাল অফিসার। এক পলক আঁদ্রেই পাভলভের দেহের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল দু’জনেই।

‘ঠিকই আছে,’ বলল দ্বিতীয়জন। ‘এ আমার শিপের ডেকহ্যাণ্ড। আমরা আমাদের কনসালের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

দুজনকেই বেশ বিচলিত দেখে মর্গের ডিউটি সার্জেন্ট ভাবল, একজন শিপমেট হারিয়ে বড্ড দুঃখ পেয়েছে নিশ্চয়ই। ‘চলুন,’ ওদের পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এল সে। ‘আমাদের সুপারিনটেণ্ডেন্টের অফিসে যাওয়া যাক। ন’টায় ওখানে আসবেন আপনাদের কনসাল।

ওরা পৌঁছার আগেই এসে পড়েছেন সোভিয়েত কনসাল। পুলিস সুপারের মুখোমুখি বসে আছেন তিনি। পাশেই আরেকজন বসা, বিএসএস স্টেশন চীফ।

‘এ আমি বিশ্বাস করি না যে লোকটা আত্মহত্যা করেছে,’ ক্যাপ্টেন আর পলিটিক্যাল অফিসার ভেতরে পা রাখতেই ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন কনসাল। ‘অনতিবিলম্বে আমার এমব্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই…’

বাহু ধরে কনসালকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল পলিটিক্যাল অফিসার। রূমের এক কোণে নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে কী সব যেন বোঝাল তাঁকে। পলকে চেহারা বদলে গেল ক্রুদ্ধ কনসালের। তিন মিনিট পর সুপারের টেবিলে ফিরে এলেন তিনি।

একেবারে শান্ত হয়ে গেছেন। জানালেন, এমব্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ তিনি অবশ্যই করবেন। তবে পরে হলেও চলবে, তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।

কনসাল আশা করেন, আঁদ্রেইকে যারা মারধর করেছে, পুলিস সেই নেন্ডদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। মাননীয় সুপারের পক্ষে কি সম্ভব হবে, আঁদ্রেই পাভলভের মৃতদেহ এবং তার সঙ্গে যা যা ছিল সে সব আকাডেমিক কোমারভে তুলে দেয়া? জাহাজটি আগামীকালই লেনিনগ্রাদ রওনা হবে।

অত্যন্ত প্রশান্ত মেজাজে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে অনুরোধটা প্রত্যাখ্যান করলেন সুপার। যতক্ষণ না বখাটেগুলোকে পাকড়াও করা যায়, দেহটা সিটি মর্গেই থাকবে। আর তার জিনিসপত্র যত্ন করে রেখে দেয়া হবে প্যাট্রিক পুলিস স্টেশনে। মৃদু হাসির ভঙ্গি করে সিদ্ধান্তটা মেনে নিলেন সোভিয়েত কনসাল। নিয়ম কানুন ভালই জানেন তিনি। এরপর বিদেয় হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বেরিয়ে পড়লেন তিনি কনসুলেটের উদ্দেশে।

পিছন পিছন বেরিয়ে এল হ্যারি ফরবসও। মর্গের দিকে গাড়ি ছোটাল সে। পোস্টমর্টেম রূমের এক কোণে ড্রেনের ওপর বসানো বড় একটা স্ল্যাবে শোয়ানো আছে পাভলভের দেহটা। ব্যবচ্ছেদ শুরু করার জন্যে পুলিস প্যাথলজিস্ট প্রস্তুত।

‘দেহটা আমি একটু দেখতে পারি?’ লোকটিকে জিজ্ঞেস করল ফরবস।

তার আইডি কার্ডে চোখ বুলিয়ে মাথা দোলাল সে। ‘শিওর।’

খুব কাছ থেকে দশ মিনিট ধরে দেহটা পর্যবেক্ষণ করল ফরবস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তারপর বেরিয়ে এসে নিজের অফিসে রওনা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *