অন্ধ শিকারী – ২.৩

তিন

বাঁ হাতের চেটোয় মাথা রেখে প্রায় শুয়ে আছে গিলটি মিয়া টেবিলের ওপর। কাগজে আঁকিবুকি করছে। নাকি সুরে চাপা কণ্ঠে গাইছে, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঁজে-এ-এ…।’

রানা এজেন্সির ফ্রন্ট অফিস এটা। বেলা তিনটে। ব্যক্তিগত কাজে রানার পি.এ মেয়েটি ছুটি নিয়েছে আজ আধবেলার জন্যে। গিলটি মিয়া সামলাচ্ছে তার কাজ। ‘হাছন রাজার মন ময়না’ পর্যন্ত পৌঁছেছে সে, এমন সময় নক হলো দরজায়। বিরক্ত মুখে ওই অবস্থায়ই ঘুরে অকাল গিলটি মিয়া। ‘ক্যা?’

খুলে গেল দরজা দড়াম করে। কেঁপে উঠল পার্টেক্স পার্টিশন। সেই সঙ্গে গিলটি মিয়াও। পরক্ষণেই চমকে গেল দোরগোড়ায় দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চীফ অ্যাড- মিনিস্ট্রেটর, সোহেল আহমেদ। বাঘের দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে সোহেল। অসাড় আঙুলের ফাঁক গলে কলমটা খসে পড়ল গিলটি মিয়ার! স্প্রিঙের মত তড়াক করে আসন ছাড়ল সে, সালাম করার ভঙ্গিতে কপালে উঠে গেছে ডান হাত।

এই ‘হাত কাটা সায়েবকে’ যমের চেয়েও বেশি ভয় করে সে। তার চোখের দিকে তাকালে হিম হয়ে যায় বুকের ভেতরটা। কী চাউনি! ঠিক যেন শামসুদ্দীন দারোগা। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে জ্বর উঠে যায় গতরে। ‘স্যা· স্যার, আপনি?’

‘রানা কোথায়?’ হুঙ্কার ছাড়ল সোহেল।

‘ওপরে, স্যার। ঘুমুচ্চেন।’

ভেংচি কাটল সোহেল, ‘বা বা বা! ঘুমুচ্চেন! একজন ভর দুপুরে ঘুমুচ্ছেন, আরেকজন শুয়ে শুয়ে গলা সাধছেন। ভালই চালাচ্ছ তোমরা অফিস। দাঁড়াও, বার করছি তোমাদের…।’ ঘুরে দাঁড়াল সোহেল আহমেদ। পা চালাল সিঁড়ির দিকে।

রূম ছেড়ে বেরিয়ে এল গিলটি মিয়া, পা বাড়াতে গেল পিছন পিছন। কিন্তু সোহেলকে ঘাড় ফেরাতে দেখে থেমে পড়ল। ‘তুমি কেন আসছ?’

‘না, স্যার,’ এক পা পিছাল গিলটি মিয়া। ‘আসচি নে। আসবো কোতায়?’ সুড়ৎ করে রূমে সেঁধিয়ে গেল সে।

অনেক কষ্টে এতক্ষণ হাসি ঠেকিয়ে রেখেছিল সোহেল। আর পারল না। হাসতে হাসতে ওপরে চলল সে। ওদিকে দিবাস্বপ্নে বিভোর মাসুদ রানা। ধানমণ্ডি লেকে মাছ ধরছে ও আর সোহেল। টোপ ফেলামাত্র টান পড়ল সোহেলের ফাৎনায়। ‘ওরেশ শা-লা!’ বলে ছিপ ধরে হ্যাঁচকা টান লাগাল সোহেল। কিন্তু বাধল না মাছটা, ছুটে গেছে। ওদিকে টান খেয়ে পানি ছেড়ে উঠে পড়েছে বড়শি, ঘুরে এসে ‘কুট’ করে বিঁধে গেল ওটা রানার বাঁ কানের লতিতে।

‘উফ্!’ নড়ে উঠল মাসুদ রানা। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে সচকিত হলো। চোখ না মেলেই বুঝল বড়শি বেঁধার জন্যে নয়, আর কোন কারণে ব্যথা করছে কান। চট করে চোখ মেলল রানা।

‘কি, চাঁদ?’ কানটা ধরে মৃদু ঝাঁকি দিল সোহেল, মোলায়েম কণ্ঠে বলল, ‘খুব তো কাজের কথা বলে দিনের পর দিন বিদেশে পড়ে থাকা হচ্ছে। টিএ ডিএর নাম করে রোজ শ’শ’ ডলার ড্র করা হচ্ছে। এই নাকি সে কাজের নমুনা?’

‘আরে! দোস্ত, তুই?’ ঝট করে উঠে বসল মাসুদ রানা। ঘুমের রেশ মুহূর্তে কেটে গেছে। অনেক দিন পর প্রিয়তম বন্ধুর দেখা পেয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল রানা। নিশ্চয়ই কোথাও কোন গণ্ডগোল আছে। নইলে কথা নেই বার্তা নেই লণ্ডনে কেন সোহেল? ‘ব্যাপার কি, সোহেল? তুই হঠাৎ?’

‘সে কি!’ কৃত্রিম অবাক হলো সোহেল। বসে পড়ল বিছানায়। ‘তুই জানিসনে?’

‘কিসের কথা?’ চোখ কোঁচকাল রানা।

‘তোকে ছাঁটাই করা হয়েছে! একেবারে যাকে বলে ডিসমিস।’ গম্ভীর হলো ও। আমার অপরাধ?’

যেন খুব দুঃখ পেয়েছে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সোহেল শব্দ করে। ‘অযোগ্যতা, দোস্ত। অযোগ্যতা। আমি অনেকদিন ধরেই বুড়োকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, দোস্ত, যে তুই আর আগের সেই মাসুদ রানা নেই। ছাতা পড়েছে তোর রেপুটেশনে। তা কে শোনে কার কথা? তুই-ই বল, আমি তোর সবচে’ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি তুই হচ্ছিস উলুবনের শেয়াল…’ রানাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে শঙ্কিত হলো সোহেল, চট্ করে ছিপি আঁটল মুখে। ওর গতিবিধি লক্ষ করছে সতর্ক চোখে।

মুখ টিপে হাসল মাসুদ রানা। ‘বোস্। হাত-মুখ ধুয়ে আসি,’ অ্যাটাচড্ বাথরূমের দিকে পা বাড়াল ও।

‘ওই সঙ্গে শেষ গোসলটাও সেরে আসিস, দোস্ত,’ পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল সোহেল। ‘পাক সাফ হয়ে আসিস। পরে আর সুযোগ পাবি বলে মনে হয় না। বুড়ো আসছে,’ তর্জনী দিয়ে জবাই করার ভঙ্গি করল সে। ‘আজই সেরে ফেলবে কাজটা।’

দরজা বন্ধ করতে গিয়েও থমকে গেল মাসুদ রানা। উবে গেছে হাসি। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘বুড়ো আসছে মানে?’

সোহেলের হাসিখুশি চেহারা বিগড়ে গেল। ‘অ্যাহ্! মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল তো শালাকে নিয়ে, সোজা কথার মানে বোঝে না!

খেপে গেল রানা। কিন্তু তলপেটের চাপ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অসহায় ও। ‘রাখ, শালা! এসে দেখাচ্ছি মজা।’ দড়াম করে দরজা লেগে গেল।

এরপর দুই বন্ধু মুখোমুখি হলে সচরাচর যা হয়ে থাকে তাই হলো। মিনিট দুয়েক ঘরময় ছোটাছুটি, কিল, চড়, চিমটি, এ বলে ‘তুই ছাড়!’ ও বলে, ‘আগে তুই ধরেছিস, তুই ছাড়!’ চলল। তারপর জয়-পরাজয় অমীমাংসিত রেখেই মুখোমুখি বসে পড়ল দু’জন।আপাতত সন্ধি।

কফিতে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল রানা। ‘তুই তাহলে ঢাকা থেকে নয়?’

‘উঁহুঁ! বার্লিন থেকে।’

‘বার্লিন! কেন?’

দাঁত খিঁচাল সোহেল। ‘তোকে তার কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?

‘ফের যদি কথা বাড়াস, এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে দেব তোর, শালা। যা জিজ্ঞেস করি, সরাসরি তার উত্তর দিবি।’ ডান হাত মুঠো করে ওর নাকের সামনে ধরল রানা।

তৎক্ষণাৎ মাথা দোলাল সোহেল ভাল মানুষের মত। ‘জ়ে, আজ্ঞে।’ চোখ ট্যারা করে চেয়ে আছে হাতটার দিকে।

হেসে ফেলল রানা। ‘ফাজলামো রাখ, দোস্ত। টেনশনে আমার অবস্থা টাইট। খুলে বল সব।’

কফি শেষ করে সিগারেট ধরাল সোহেল। প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে গিয়েও হাত টেনে নিল। ভেতর থেকে একটা বের করে ছুঁড়ে দিল রানার দিকে। ‘আমি আসলে অন্য কাজে বার্লিনে গিয়েছিলাম। কাজ সেরে ঢাকায় রিপোর্ট করতে বুড়ো বলল এখানে চলে আসতে। বলল, আমি আসছি লণ্ডন। তুমি অপেক্ষা করো ওখানে, এক সঙ্গে ঢাকা ফিরব।’

‘ব্যাস? কেন লণ্ডন আসছে, তা বলেনি?’

‘না। তবে খানিকটা আভাস দিয়েছে। ওঁর আসার পিছনে কেজিবির হাত আছে।

‘কেজিবি?’

‘আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ফার্স্ট চীফ ডিরেক্টরেট প্রধান জেনারেল ভাদিম বরিসভ।’

‘জেনারেল বরিসভ?’ কপাল কুঁচকে উঠল রানার আপনাআপনি।’হ্যাঁ। ওরা নাকি ঢাকায় তোর খোঁজ জানতে চেয়েছিল। ব্যাপার কি, রানা? ওদের লেজ মাড়িয়ে দিয়েছিস নাকি?’

মুহূর্তের জন্যে ডি অ্যাঙ্গাসের কথা ভাবল মাসুদ রানা। পরক্ষণেই বাতিল করে দিল চিন্তাটা। না, ওটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই আর কিছু আছে ভেতরে। কিন্তু এমন কি ব্যাপার থাকতে পারে যে কারণে জেনারেল বরিসভ ওকে খুঁজবেন, ভেবে পেল না।

‘কিরে, কিছু বলছিস না যে?

‘কই, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না।

‘পড়বে পড়বে,’ আপনমনে মাথা দোলাল সোহেল। ‘ধোলাই সব মনে পড়ে যাবে।

‘চুপ থাক, শালা! কখন আসছে বুড়ো? ক’টায় ফ্লাইট?’

‘সাতটায় হিথ্রোয় ল্যাণ্ডিঙ।’

ঘড়ি দেখল মাসুদ রানা। ‘সোয়া পাঁচ। চল, ওঠ।’

‘কোথায়!’

‘এয়ারপোর্ট যেতে হবে না বসকে রিসিভ করতে?’

‘না। নিষেধ আছে।’

‘কেন?’

‘গোপনে আসছেন রাহাত খান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা আছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ডাউনিং স্ট্রীটে যাবেন তিনি। মীটিং সেরে নিজেই চলে আসবেন এখানে।’

‘বলিস কি রে!’ ভীষণ বিস্মিত হলো রানা। ‘শুনে মনে হচ্ছে যেন…। এত কিছু ঘটছে লংফেলো জানেন না?’

‘জানেন, তবে তোর চেয়ে কম।’

‘মানে?’

‘আমার আসার খবর জানা নেই তাঁর। জানেন কেবল রাহাত খানের খবর। তা-ও কেবল আসছেন, এটুকুই। কেন, জানেন না। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বুড়োর মীটিঙের সময় সব জানতে পারবেন। তাঁকে ওখানে থাকতে বলা হয়েছে।’

‘কিন্তু তুই এত খবর জানলি কি করে? তোকে নাকি কেবল আভাস দিয়েছে বুড়ো? এ যদি আভাস হয় তো ডিটেল বলে কাকে?’

মারফতি হাসি দিল সোহেল। ‘এই কথা? তা আভাস থেকে যদি এসব সামান্য ব্যাপার বুঝে না-ই নিতে পারলাম, তাহলে কি আর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হওয়া চলে এত বড় এক ইন্টেলিজেন্স নেটওঅর্কের, তুই- ই বল?’

আচমকা গাঁট্টা চালাল রানা সোহেলের চাঁদি সই করে। ষাঁড়ের মত চেঁচিয়ে উঠল সোহেল গলা ফাটিয়ে। যন্ত্রণার চোটে লাফাচ্ছে তড়াক তড়াক। ‘শালা, গণ্ডার! উহুরে, খুলি বোধহয় ফুটোই হয়ে গেছে রে! অমায়িক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মাসুদ রানার চেহারা। ‘এই কথা? তা মেরে যদি এক আধটু ব্যথা না-ই দিতে পারলাম, তাহলে কি আর স্পাই হওয়া চলে, তুই-ই বল?’

ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। এক আধটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। এমন সময় ইয়র্কশায়ারের মেনউইথ লিনিঙ স্টেশনে ধরা পড়ল আরেকটা স্কোয়ার্ট ট্র্যান্সমিট করার ঘটনা। ওয়েলসের ব্রডি এবং চিকস্যাণ্ডস স্টেশন ট্রেস করল ওটা। ট্র্যান্সমিশনের বিয়ারিঙ ও ক্রসবিয়ারিঙ গ্রহণ করল তারা একই সঙ্গে। শেফিল্ডের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে পাঠানো হয়েছে বার্তাটা।

দ্রুত জায়গামত পৌঁছে গেল শেফিল্ড পুলিস। বারনলি-পন্টিফ্র্যাক্ট সড়ক ওটা। কেউ নেই কোথাও। শূন্য সড়কটা যেন উপহাস করল দলটিকে।

‘সেই একই ট্র্যান্সমিটার, স্যার,’ গভীর রাতে রিপোর্ট করল চেনটেলহ্যামের হতাশ চীফ অ্যানালিস্ট। এবারও বার্তার মর্মোদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। ‘আগের মতই তিন সেকেণ্ড স্থায়ী। কোন সন্দেহ নেই স্পাই বন্ধুটি কার-বোর্ন। ট্র্যান্সমিট সেরেই গাড়ি চালিয়ে সটকে পড়ে।

‘ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার,’ বললেন কর্মকর্তা। ‘লেগে থাকো। ভেবে পাই না ব্যাটা কাকে কি সংবাদ পাঠাচ্ছে!’ শেষেরটুকু অন্যমনস্কের মত যেন নিজেকেই শোনালেন তিনি।

মস্কোয় ততক্ষণে বার্তাটা ডিকোড হয়ে পৌঁছে গেছে জেনারেল সেক্রেটারির সামনে। ওটা এরকম : কুরিয়ার টু নেভার শোড। ইনফর্ম সূনেস্ট রি-অ্যারাইভেল সাবস্টিটিউট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *