দুই
রোববার। বিকেল পাঁচটা। হিথ্রো এয়ারপোর্টে অবতরণ করল অ্যারোফ্লোটের বিশালবপু এক টুপোলভ। নিয়মিত সরাসরি মস্কো-লণ্ডন ফ্লাইট। এই সংস্থার প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে একজন করে অফিসার থাকে কেজিবির ‘এজিয়েন্ট’। এদের কাজ পাইলট-ক্রুদের ওপর নজর রাখা এবং বিদেশে অবস্থানরত কেজিবির ‘রেসিডেন্টুরা’-দেরকে প্রয়োজনে মেসেজ বা ‘আর কিছু পৌঁছে দেয়া।
এই ফ্লাইটেও রয়েছে তেমনি একজন, ফার্স্ট অফিসার ভলকভ। ঘণ্টা দুয়েক পর বিমানটি ক্লোজ ডাউন করে রাতের মত হস্তান্তর করা হলো গ্রাউণ্ড ক্রুদের হাতে। কাল ফিরে যাবে ওটা মস্কো। তার প্রতিটি স্টাফ টার্মিন্যাল ভবনের ফ্লাইট-ক্রু এনট্রি পথে ভেতরে ঢুকল। সবার সঙ্গে একটা করে ব্যাগ এবং গ্রিপ। এছাড়াও কয়েকজনের কাঁধে স্ট্র্যাপে ঝোলানো পোর্টেবল রেডিও ট্রানজিস্টরও রয়েছে।
ব্যাগ আর গ্রিপ চেক করে ছেড়ে দিল তাদের কাস্টমস। অন্যগুলোর মত ভলকভের সনি মডেল পোর্টেবল সেটটার দিকেও দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাল না কেউ। ওরা পশ্চিমা বিলাস সামগ্রীর ভক্ত, জানে হিথ্রো কাস্টমস। বেরিয়ে এসে নিজেদের বিমান সংস্থার অপেক্ষমাণ মিনিবাসে করে গ্রীন পার্ক হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলো দলটা।
মস্কো ত্যাগের তিন ঘণ্টা আগে পোর্টেবলটা ফার্স্ট অফিসার ভলকভকে গছিয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা ভালই জানে, এসবের ওপর খুব একটা নজর দেয় না হিথ্রো কাস্টমস। নিজের স্যুইটে পা রাখতে পেরে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল ভলকড়। বড্ড টেনশনে ছিল এতক্ষণ। জিনিসটার ওপর নজর বোলাবার প্রবল ইচ্ছে সংবরণ করতে পারল না ফার্স্ট অফিসার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সে ওটা। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে রেখে দিল বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে।
দরজায় তালা মেরে পা চালাল ভলকভ বারের উদ্দেশে। কাল সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে পোর্টেবলটা কোথায় কাকে হস্তান্তর করতে হবে খুব ভাল জানে সে। কেবল জানে না, মস্কো ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে তাকে এয়ারপোর্টেই। প্ল্যান অরোরার স্বার্থে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে ফেলা হবে তাকে। ওটা যে আসলে ‘চিরদিনের জন্যে’, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি এবং মেজর কিরলভ ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
‘আপনি!’ দরজা খুলে বিস্মিত হলেন রবার্ট ফিলবি। মনে মনে প্রতি মুহূর্তে লোকটির ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন তিনি। তার অবসান হলো খানিকটা চমকে ওঠার মধ্যে দিয়ে।
‘ভেতরে আসতে পারি?’ ভরাট, কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন করল মাসুদ রানা।
‘শিওর শিওর।’
লক্ষ করল রানা, মুখ শুকনো শুকনো লাগছে লোকটির। কালো দাগ পড়েছে চোখের নিচে। দুশ্চিন্তায় নিশ্চয়ই। দরজা বন্ধ করে রানাকে পথ দেখিয়ে সিটিংক্রমে নিয়ে এলেন ফিলবি। ‘বসুন, প্লীজ।
‘ধন্যবাদ।’ কোটের পকেট থেকে পেট মোটা একটা খাম বের করলমাসুদ রানা। ভেতর থেকে বেরল সাতটা টাইপ করা ফুলস্ক্যাপ কাগজ। ওপরে ডি অ্যাঙ্গাসের ক্রিকেট খেলার ছবিসহ পিন আপ করা। মুখ তুলল ও। ‘আপনাকে যে পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলাম তা ফলো করেছেন?’
‘কোনটা? ও হ্যাঁ, করেছি।’
‘যোগাযোগ হয়েছে এর মধ্যে অ্যাঙ্গাসের সাথে?’ ‘হ্যাঁ, দু’বার। টেলিফোনে কথা হয়েছে।’
মিথ্যে নয়, জানে মাসুদ রানা। প্রথমবার ফিলবির সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই তার টেলিফোনের প্রতিটি আউট গোয়িং ইন কামিং কল ট্যাপ করার ব্যবস্থা করেছিল ও। ওদের রেকর্ডে দু’বারের কথাই আছে। দুটোই ইন কামিং। ডি অ্যাঙ্গাস করেছিল। তেমন কোন আলাপ হয়নি দু’জনের। সংক্ষিপ্ত, সাঙ্কেতিক দু’চারটে বাক্য বিনিময় হয়েছে কেবল।
‘ঠিক আছে। এগুলো পড়ুন,’ কাগজগুলো এগিয়ে দিল মাসুদ রানা। :কি এসব?’
‘পড়ে দেখুন,’ নির্দেশের সুরে বলল ও।
ছবিটার দিকে চেয়ে থাকলেন খানিক রবার্ট ফিলবি। তারপর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ওটা উঁচু করে ধরে পড়তে শুরু করলেন। প্ৰথম পাতার মাঝামাঝি পর্যন্ত পড়া হতে মুখ তুললেন। ‘আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন?
দু’হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে পলকহীন চোখে তাঁকে দেখছে রানা। ‘কীপ রীডিং, প্লীজ।’
আবার পড়ায় মন দিলেন ফিলবি। প্রথম দু’পাতা খুব দ্রুত পড়ে গেলেন। পরের প্রতিটি পাতায় কয়েকবার করে হোঁচট খেল তাঁর দৃষ্টি। কোন কোন জায়গা দু’বার তিনবার করেও পড়লেন। শ্বাস গ্রহণ বর্জনেরভারি আওয়াজ ব্যাহত হলো কয়েকবার। এক সময় শেষ হলো পড়া। প্রায় এক মিনিট ধরে ছবিটা দেখলেন আবার তিনি। রক্ত সরে গিয়ে মত হয়ে গেছে ততক্ষণে চেহারা।
দু’হাতে মুখ ঢাকলেন রবার্ট ফিলবি। দেহ অল্প অল্প দোল খাচ্ছে সামনে পিছনে। ‘ওহ্, গড! এ আমি কি করেছি!’
‘আ হেল্ অভ আ লট অভ ড্যামেজ, অ্যাকচুয়ালি।’
ভদ্রলোক নিজের বুদ্ধির দৈন্য অনুধাবন করতে পারছেন এখন হাড়ে হাড়ে, ভাবল মাসুদ রানা। চোখেমুখে তার চিহ্ন পরিষ্কার ফুটে আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে চেহারা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, ঝোড়ো কাকের মত হয়েছে। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে দেখতে দেখতে। মুখ তুললেন রবার্ট ফিলবি। ফ্যাসফেঁসে গলায় বললেন, ‘এমন কোন উপায় কি আছে যাতে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়, মিস্টার মাসুদ রানা?’
‘যারা আপনাকে অৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করাতে চাইছিল, আমি প্রিটোরিয়া থেকে ফিরে আসার পর তাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। একসঙ্গে এতজনকে সামাল দিতে গিয়ে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছি আমি।’
‘মিস্টার রানা,’ প্রায় মিনতি ফুটল ফিলবির কণ্ঠে। ‘আপনি যা করতে বলবেন, তাই করব আমি। যে কোন কাজ…
‘তিনটে কাজ করতে হবে আপনাকে আসলে,’ বাধা দিয়ে বলল রানা।
‘আমি প্রস্তুত। আই মীন ইট। যে-কোন কাজ, মিস্টার রানা।
‘ওয়েল। নাম্বার ওয়ান, নিয়মিত অফিস করতে থাকুন। সব রুটিন মাফিক চলতে হবে। শান্ত সারফেসে একটিও যেন বুদ্বুদ না ওঠে। নাম্বার টু, লেডি ফেডোরা যাতে আরও মাসখানেক শেফিল্ডে থাকেন, তা নিশ্চিত করতে হবে যে ভাবে পারেন। কাল রাতে কয়েকজন লোক আসবে বিএসএস থেকে। ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্টের কাজ করবে ওরা। ডি অ্যাঙ্গাসের হাতে আপনি কোন্ কোন্ ডকুমেন্ট তুলে দিয়েছেন, তার পূর্ণ বিবরণ দিতে হবে ওদের। মনে রাখবেন, প্রতিটির হদিস চাই আমি। ডিটেল জানাবেন। একটি দাঁড়ি কমাও যদি উল্লেখ করতে ভুল করেন, সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেব আমি।’
‘ভুল হবে না,’ ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন রবার্ট ফিলবি। ‘একটুও ভুল হবে না। প্রত্যেকটি ডট-কমা মনে আছে আমার।’
‘দেখা যাবে।’
‘ইয়ে, তিনটে কাজ বলেছিলেন আপনি।’
‘হ্যাঁ। মাঝে মধ্যে ডকুমেন্ট হস্তান্তর করবেন ডি অ্যাঙ্গাসকে। আপনার ইউজুয়াল চ্যানেলে।’
‘কিসের ডকুমেন্ট?’
‘সময়মত তৈরি করে দেয়া হবে।’
‘ডিজইনফর্মেশন?’
‘এগজ্যাক্টলি। নিজের দেশের প্রচুর ক্ষতি করেছেন, মিস্টার ফিলবি। এবার ওদের কিছু ক্ষতি করুন। মনে রাখবেন, অ্যাঙ্গাসের মুখোমুখি হওয়া চলবে না এখনই। আপনার চেহারা দেখলেই বিপদ টের পেয়ে যাবে ও, হয়তো সটকে পড়বে। সে ক্ষেত্রে মাঝখান থেকে আপনি ফেঁসে যাবেন।
‘কিন্তু ও যদি দেখা করতে চায়?’
‘যে-কোন ব্যস্ততার অজুহাতে কাটিয়ে দেবেন। আমি না বলা পর্যন্ত দেখা করা চলবে না।’
পাঁচ মিনিট পর ফন্টেনয় হাউস থেকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা।
সকাল সাড়ে নয়টা। হিথ্রোর এয়ার লাইনার স্টাফদের ক্যান্টিনে প্রচুর সময় নিয়ে নাশতা সারল অ্যারোফ্লোটের ফার্স্ট অফিসার ভলকভ। তারপর দু’কাপ কালো কফি এবং দুটো সিগারেট ধ্বংস করল। ঠিক পৌনে দশটায় মেনস টয়লেটে এসে ঢুকল সে। আগে একবার এসে দেখে গেছে সে ঠিক কোন কিউবিক্-এ ঢুকতে হবে তাকে। একদম শেষ মাথার দ্বিতীয়টা। চেক করে দেখেছে, প্রথমটির দরজা কথা মত লক করা আছে।
নির্দিষ্ট কিউবি-এ ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ফার্স্ট অফিসার। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ছয় শব্দের একটি প্রশ্ন লিখল। তারপর ঝুঁকে ওটা পার্টিশনের নিচ দিয়ে ঠেলে দিল প্রথমটির ভেতরে। একটা হাত তুলে নিল কার্ডটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দিল আবার। উল্টোপিঠে প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে।
সন্তুষ্ট মনে মাথা ঝাঁকাল ভলকভ, ঠিকই আছে। এবার সনি পোর্টেবলটা আলতো করে ওপাশে পাঠিয়ে দিল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা। বাইরে ইউরিনালে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ, ছর ছর শব্দ আসছে। কমোড ফ্লাশ করল ভলকভ। বেরিয়ে এসে বেসিনের সামনে দাঁড়াল। ইউরিনাল ব্যবহারকারীর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাত ধোয়া চালিয়ে গেল সে। তারপর বেরিয়ে এল তার পিছন পিছন।
কাস্টমস ব্যারিয়ার পেরিয়ে এসে নিজেদের বিমানে উঠল ফার্স্ট অফিসার আর সবার সঙ্গে। কাঁধে যে তাঁর পোর্টেবলটা নেই, চোখেই পড়েনি কাস্টমসের। ওদিকে তার সঙ্গীরা ভাবল জিনিসটা নিশ্চয়ই তার গ্রিপে রয়েছে। ঠিক একটায় মাটি ত্যাগ করল অ্যারোফ্লোটের টুপোলভ। মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ ওরফে মার্টিন ফ্ল্যানারির প্রথম চালান নিরাপদেই হস্তান্তর করে যেতে পেরেছে ভলকভ।
পরদিন রাত আটটায় বিএসএস আর ডিফেন্স মিনিস্ট্রির অ্যানালিস্টদের একটি যৌথ ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্ট টীম বেলগ্রাভিয়া রোডের ফন্টেনয় হাউসে প্রবেশ করল। প্রস্তুত ছিলেন রবার্ট ফিলবি। শুরু হলো বৈঠক। প্রথম কাজ সনাক্তকরণ। যে সব ডকুমেন্ট এ পর্যন্ত মস্কো গেছে অ্যাঙ্গাসের হাত দিয়ে, সেগুলো চিহ্নিত করা। প্রায় সারা রাত ধরে চলল বৈঠক।
মিনিস্ট্রির ওরা ডকুমেন্ট উইথড্রআল আর রিটার্নের রেজিস্ট্রি সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ওতে কবে কোন সেকশন থেকে কি কি ডকুমেন্ট নিজ ডেস্কে আনিয়েছেন ফিলরি, কবে তা ফেরত দিয়েছেন, সব রেকর্ড আছে। ভদ্রলোক এক-আধটার কথা ‘ভুলে’ গিয়ে থাকলে তা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে আনা হয়েছে ওটা। সঙ্গে ডকুমেন্টগুলোর একটা করে ফটোকপিও। কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না। দেখা গেল কিছুই ভোলেননি ফিলবি, প্রতিটির কথাই মনে আছে।
এর পরদিন বেশ কিছু ‘ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট’ তৈরির কাজে লেগে পড়ল যৌথ দলটি। উপযুক্ত সময়ে ডি অ্যাঙ্গাসের হাত হয়ে মস্কো পৌঁছুবে ওগুলো।
ফিনিয়েস্টন কী। গ্লাসগো। সোভিয়েত কার্গো শিপ আকাডেমিক কোমারভ বাঁধা আছে জেটিতে। আজই দুপুরে পৌঁছেছে ওটা মালামাল নিয়ে। সন্ধে পর্যন্ত পোর্ট অথরিটির হেভি ক্রেনগুলো আনলোডিং চালিয়েছে বিরতিহীন। আপাতত বন্ধ কাজ, কাল ফের শুরু হবে।
এখানে কাস্টমস বা ইমিগ্রেশন চেকিঙের ঝামেলা নেই। বিদেশী ক্রুরা ইচ্ছে করলেই নিজ জাহাজ ত্যাগ করতে পারে, ঘোরাঘুরি করতে পারে শহরে। রাত বারোটা। আকাডেমিক কোমারভের ডেকহ্যাণ্ড আঁদ্রেই পাভলভ গ্যাঙপ্ল্যাঙ্কের মাথায় এসে দাঁড়াল। সতর্ক চোখে ডানে বাঁয়ে বোলাতে লাগল সে।
মানুষজন আছে এখনও কিছু, তবে দূরে দূরে। কেউ নজর রাখছে না ওদের ওপর। তবু ভাল করে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কয়েক মিনিট ব্যয় করল ডেকহ্যাণ্ড। তারপর তর তর করে নেমে এল জেটিতে। বন্দর সীমানা গেটের বাইরেই মুখোমুখি একটি বার, বেটি’স বার। নিয়ম অনুযায়ী ঠিক বারোটায় বন্ধ হয়ে গেছে ওটার দরজা। কিন্তু বেশ কিছু মাতাল নাবিক হল্লা করছে সামনে দাঁড়িয়ে, আরও পান করতে চায়। ঠিক ঘড়ি ধরে বার বন্ধ করে দেয়াটা পছন্দ হয়নি তাদের।
দূর থেকে জটলাটার পাশ কাটিয়ে ফিনিয়েস্টন স্ট্রীটে এসে পড়ল পাভলভ। কর্ড ট্রাউজারস, গোল গলা সোয়েটার আর অ্যানোরাক পরেছে সে। পায়ে ভারী জুতো। পাভলভের চেহারা-সুরত নিতান্তই সাধারণ। বাঁ বগলের নিচে একটা ছোট ক্যানভাসের গানি স্যাক ঝুলছে তার। কাঁধের ওপর, ঘাড়ের কাছে ড্রাস্ট্রং দিয়ে বাঁধা, যাতে পড়ে না যায়।
ক্লাইডসাইড এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে এসে আরজিল স্ট্রীটে পৌঁছল লোকটা। বাঁয়ে ঘুরে জোর পা চালাল প্যাট্রিক ক্রসের উদ্দেশে। জীবনে কোনদিন এ শহরে আসেনি সে, কাজেই রাস্তাঘাট চেনার প্রশ্নই আসে না। সঙ্গে সিটি ম্যাপও নেই পাভলভের। তবু সঠিক পথেই এগোচ্ছে সে। কারণ দেশ ত্যাগ করার আগে কম্পিউটরের পর্দায় কোন পথে কোন পর্যন্ত যেতে হবে ভাল করে দেখে আত্মস্থ করে নিয়ে এসেছে সে।
এখন আর কোনদিকে তাকাবার গরজ দেখা যাচ্ছে না পাভলভের ভেতর।রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। কদাচিৎ এক-আধটা গাড়ি চোখে পড়ে। অতএব নিশ্চিন্ত মনে হন্ হন্ করে এগিয়ে চলেছে ডেকহ্যাণ্ড গন্তব্যের উদ্দেশে। প্যাট্রিক ক্রস ধরে পুরো এক মাইল উত্তরে এগোল সে। ডানে বাঁক নিয়ে গ্রেট ওয়েস্টার্ন রোডে পৌঁছল।
চট করে হাতঘড়ির ওপর চোখ বোলাল আঁদ্রেই পাভলভ। একটা ত্রিশ। এখনও পুরো আধঘণ্টা সময় হাতে আছে, অথচ গন্তব্যে পৌঁছতে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। আবার ডানে চলল সে। পণ্ড হোটেল বাঁয়ে রেখে বোটিং লেকের তীর ধরে হাঁটছে। হঠাৎ করেই জায়গাটা চোখে পড়ল পাভলভের। আলো ঝলমলে এক বিপি সার্ভিস স্টেশন। ওই পর্যন্তই তার দৌড়। আর বড়জোর দুশো গজ, তারপরই মুক্তি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাচ্ছিল আঁদ্রেই, এই সময় আবছা কাঠামোগুলো চোখে পড়ল। ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠল সে। হোটেল এবং সার্ভিস স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় অন্ধকার এক বাস স্টপের যাত্রী ছাউনির নিচে বসে আছে ওরা। পাঁচজন। দশাসই ফিগার একেকজনের। সব ক’টা মাতাল, দেখেই টের পেল ডেকহ্যাণ্ড। গতি কমে এসেছে তার আপনাআপনি। এগোবে না কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
এদেশের কোথাও কোথাও এদের বলা হয় ‘স্কিনহেডস্’ অথবা ‘পাঙ্কস’। তবে গ্লাসগোয় বলা হয় ‘নেডস্। রাস্তা অতিক্রম করবে কি না, ভাবল একবার পাভলভ। ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না তার। একভাবে ওকেই দেখছে ব্যাটারা। হঠাৎ করেই ওদের একজন হাঁক ছাড়ল তার উদ্দেশে। পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে দল বেঁধে বেরিয়ে এল সবাই ছাউনি ছেড়ে। ঘিরে ধরল পাভলভকে।
ওদের আকার এবং রক্ত জমা লাল চোখের অস্থির চাউনি আতঙ্কিত করে তুলল লোকটিকে। একজন কি যেন জিজ্ঞেস করল জড়ানো কণ্ঠে, কিছুই বুঝল না পাভলভ। কাজ চালিয়ে নেয়ার মত ইয়েস নো ভেরি গুড জাতীয় দু’চারটে ইংরেজি জানে সে ঠিকই, কিন্তু একে জড়ানো কণ্ঠ, তারওপর গ্লাসগোর বাজে অ্যাকসেন্ট, একটা শব্দও পরিচিত মনে হলো না তার। বেকুবের মত এর-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল অসহায় দৃষ্টিতে।
উত্তর না পেয়ে খেপে গেল মাতাল। দুহাতে সবলে জাপটে ধরল তাকে। কানের কাছে বাজখাঁই গলায় আবারও একই প্রশ্ন করল। ‘হোয়া’ হা’ ইয়া গট ইন ইয়া উয়ী স্যাক, দেন?’
জোরে জোরে মাথা দোলাল পাভলভ। লোকটিকে বোঝাতে চাইল তার বক্তব্য বুঝতে পারেনি সে। একই সঙ্গে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে মোড়ামুড়ি শুরু করল। পর মুহূর্তে বৃষ্টির মত এলোপাতাড়ি কিল ঘুসি আর লাথির তোড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল আঁদ্রেই পাভলভ। শক্ত রাস্তায় ভীষণ, জোরে নাক ঠুকে গেল তার। সমানে চেঁচাচ্ছে নেডের দল আর নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে তাকে। ওরই মাঝে কেউ তার গানি স্যাকটা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, টের পেয়ে গেল আঁদ্রেই কাঁধের পেশীতে ড্রস্ট্রিঙের টান বেড়ে যেতে।
মরিয়া হয়ে উঠল ডেকহ্যাণ্ড। জান যায় যাক, ওটা ছিনিয়ে নিতে দেবে না সে। দু’হাতে বুকের কাছে ব্যাগটা চেপে ধরল সে, বহুকষ্টে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল মাটি কামড়ে। পিছন থেকে কিডনি আর মাথার ওপর সমানে লাথি হেঁকে চলেছে লোকগুলো, থামাথামির লক্ষণ নেই। নীরবে প্রতিটি মার হজম করতে লাগল পাভলভ। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মাথার ভেতর মগজ বিস্ফোরিত হচ্ছে যেন প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে তার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা মুখ।
ঘটনাস্থলের সামান্য দূরে দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের কলোনি, ডেভনশায়ার টেরেস। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ভবন। ওর একটির চারতলায় থাকেন নিঃসন্তান, বিপত্নীক মিস্টার বেরেনসন। বাতের ব্যথায় ঘুম হয় না রাতে। নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ কানে আসায় দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ কপালে তুলে কয়েক সেকেণ্ড ব্যাপারটা লক্ষ করলেন, তারপর বাতের ব্যথা ভুলে ছুটে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুললেন।
কাছাকাছিই ছিল একটা পেট্রল কার। স্টেশন-ইন-চার্জের নির্দেশ পেয়ে ঝড়ের বেগে এসে হাজির হলো ওটা জায়গামত। সাইরেনের আওয়াজ আর হেডলাইটের আলো দেখে গানি স্যাকের আশা ছেড়ে দিল নেডের দল। নিঃসাড় আঁদ্রেইকে ছেড়ে তীরবেগে ছুট লাগাল অন্ধকার বোটিং লেকের দিকে। অজ্ঞান দেহটিকে রক্তের নদীতে ভাসতে দেখে ওদের ধাওয়া করার চিন্তা বাদ দিল কারের দুই আরোহী, সার্জেন্ট হিউই এবং সার্জেন্ট ব্রায়ান।
পাভলভের পালস্ পরীক্ষা করল হিউই এক মুহূর্ত। ‘এক্ষুণি অ্যাম্বুলেন্স ডাকো, ব্রায়ান!’
ওয়েস্টার্ন ইনফার্মারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছল চার মিনিটের মধ্যে। পাভলভের দেহটা ততক্ষণে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে হিউই। কাঁধ থেকে খুলে নিয়েছে গানি স্যাক। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো তাকে। ‘তুমি ওর সঙ্গে যাও!’ পেট্রল কার থেকে চেঁচিয়ে বলল ব্রায়ান। ‘আমি আসছি পিছন পিছন।’
এবার আরও দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছল অ্যাম্বুলেন্স। ট্রলি ঠেলে দু’তিনটে সুইং ডোর, করিডর পেরিয়ে ভবনের পিছনদিকের এমার্জেন্সি অ্যাডমিশনে ঢোকানো হলো আঁদ্রেইকে।
‘আমি ভেতরে চললাম,’ ব্রায়ানকে বলল হিউই। ‘তুমি থাকো এখানে। এর ভর্তি ফরমটা পূরণ করে ফেলো।
‘ওকে।’
গানি স্যাক দোলাতে দোলাতে করিডর ধরে ভেতরে চলল সার্জেন্ট হিউই। ব্যাগের ভেতর কি আছে দেখা হয়নি এখনও। তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথাও নেই তার। ক্যাজুয়ালটিতে পা রাখল সার্জেন্ট। দু’পাশে পর্দা ঢাকা বারোটা রূম। একটা ডিউটি নার্সের অফিস, এগারোটা একজামিনেশন রূম। জায়গাটা হাসপাতালের রিয়ার এন্ট্রান্সের একেবারে কাছে। ওদিকে সামনের পোর্টারস ডেস্কে বসে পড়ল ব্রায়ান। আঁদ্রেই পাভলভের ভর্তির ফরম তৈরি করার জন্যে।
এদিকে ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকল হিউই। কয়েকজন নার্স ব্যস্ত ট্রলি ঘিরে। লোকটা আছে না গেছে বোঝা যাচ্ছে না। নাইট শিফটের ডিউটিতে আছে অল্পবয়সী পাকিস্তানি এক ডাক্তার। লম্বা সময় নিয়ে ডেকহ্যাণ্ডের নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা করল সে। তারপর মাথা এক্স-রে করার নির্দেশ দিয়ে ছুটল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আরেকজনকে দেখতে।
কিন্তু যন্ত্রটা এ মুহূর্তে ব্যস্ত, ওয়ার্ড সিস্টারের টেলিফোনের উত্তরে জানাল এক্স-রে ইউনিট। কাজ শেষ হলে জানানো হবে সিস্টারকে। কাজেই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। নিজের জন্যে কফির পানি চড়াল ওয়ার্ড নার্স। আরেক জুনিয়র নার্স আঁদ্রেইর রক্তাক্ত অ্যানোরাক খুলে এনে রাখল তার টেবিলের ওপর।
কফি চলবে?’ হিউইকে প্রশ্ন করল সিস্টার।
‘খুব চলবে। ধন্যবাদ।’ অ্যানোরাকের পকেট হাতাতে শুরু করল সার্জেন্ট। দ্বিতীয় পকেট থেকে বের হলো একটা সীম্যানস পে-বুক। ভেতরে মৃতপ্রায় লোকটির ছবি সাঁটা। রুশ এবং ফরাসী ভাষায় লেখা বইটা। তবে ফরাসী অংশে রোমান হরফে লেখা ডেকহ্যাণ্ডের নামটা রয়েছে। ওটা পড়ল সে। আর কিছুই বুঝল না।
কে লোকটা?’ সার্জেন্টের সামনে কফির কাপ রেখে জানতে চাইল সিস্টার।
‘সীম্যান,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল হিউই। ‘রাশান।’ লোকটা এখানকার কেউ হলে কোন সমস্যা ছিল না। একে বিদেশী, তাও আবার রাশিয়ান। তুলোধোনা হয়েছে নেডদের হাতে। ঝামেলায়ই পড়া গেল, তিক্ত মনে ভাবল সার্জেন্ট। এ গেরো থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। এবার গানি স্যাকে হাত ঢোকাল সে।
ভেতরে পুরু উলের একটা সোয়েটার। ওটা দিয়ে শক্ত কিছু একটা মুড়ে রাখা হয়েছে। জিনিসটা বের করল সার্জেন্ট—একটা টোব্যাকো টিন পেঁচিয়ে ওটার মুখ খুলল। ভেতরে ঠেসে ঢোকানো আছে এক দলা কটন উল। টিনটা উপুড় করে ঝাঁকি দিল হিউই। সড়াৎ করে বেরিয়ে এল কটন উল, টেবিলের ওপর ঠক্ ঠক্ আওয়াজ তুলে তিনটে ধাতব ডিস্ক আছড়ে পড়ল। দুটো অ্যালুমিনিয়াম এবং একটা হালকা ধূসর রঙের। তিনটেই দুই ইঞ্চি ডায়ার। কি এগুলো? ভাবল সার্জেন্ট। উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর যেমন ছিল তেমনি ভরে রাখল টিনের মত। উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, তাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
‘
কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল হিউই। এখনই ডিভিশনে ফোন করা উচিত, ভাবল সে। নইলে পরে ধাতানি খেতে হতে পারে। যা- তা নয়, রাশিয়ান নাবিক লোকটা। গুরুত্ব দেয়া দরকার। ‘আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি?’
‘শিওর,’ মাথা ঝাঁকাল ওয়ার্ড সিস্টার। বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
রিসিভার তুলে নাম্বার ঘোরাতে আরম্ভ করল সার্জেন্ট। এই সময় হঠাৎ করেই জ্ঞান ফিরে পেল আঁদ্রেই পাভলভ। কিন্তু পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, মাথার ভেতর কেমন একটা ধোঁয়াটে ভাব। সব কিছু দুলছে। বহু কষ্টে মাথা তুলল সে ইঞ্চি দুয়েক। কালো ইউনিফর্ম পরা হিউইকে দেখেই কলজে লাফিয়ে উঠল। পুলিস!
তার ডান কনুইয়ের কাছে টেবিলের ওপর নিজের পে-বুক আরটোব্যাকো টিনটা দেখতে পেয়ে চক্কর দিয়ে উঠল পাভলভের মাথার মধ্যে। সর্বনাশ! ভেতরের জিনিসগুলো কি দেখেছে লোকটা? চিনে ফেলেছে ওগুলো কি? সেই খবরই জানাতে যাচ্ছে ফোন করে? কোন এক অজানা শক্তি যেন ধাক্কা মেরে ট্রলি থেকে নামিয়ে দিল পাভলভকে।
কাঁধে কারও শক্ত গুঁতো খেয়ে চমকে উঠল সার্জেন্ট, পাশে তাকাল। ততক্ষণে টোব্যাকো টিনটা ঝটকা মেরে তুলে নিয়েছে আঁদ্রেই। ‘হেই, ম্যান…।’ রিসিভার ফেলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল হিউই।মাথায় আঘাত পেয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে হয়তো লোকটা, ভেবে তাকে শান্ত করার জন্যে জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। ‘শান্ত হও, ব্রাদার। কোন ভয় নেই।
কিন্তু শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই পাভলভের মধ্যে। গায়ের জোরে টানা হ্যাঁচড়া করে নিজেকে মুক্ত করে নিল সে। জোর খাটাতে গিয়েই হঠাৎ করে টিনটা ছুটে গেল তার হাত থেকে। গড়িয়ে চলে গেল নাগালের বাইরে। সেদিকে চেয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত পাভলভ,
তারপরই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল করিডর ধরে।
‘হেই, ম্যান! কাম ব্যাক, কাম ব্যাক!’ সার্জেন্টও ছুটল পাভলভের পিছন পিছন।
সামনেই এক্স-রে রূম। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রাস্টি ইনগ্রাম। লোকটি মাঝবয়সী কারখানা শ্রমিক। ডিউটির সময় ছাড়া বাকি সময় মদে বুঁদ হয়ে থাকা একমাত্র নেশা তার। আজ তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। তাই সকাল থেকে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত মদ গিলেছে বারে বসে। পকেট খালি করে বাসায় ফেরার পথে একটা ল্যাম্পপোস্ট আচমকা অন্যায় ভাবে পথরোধ করে দাঁড়ায় তার। প্রথমে নরম সুরেই তাকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল রাস্টি। কাজ হলো না, বরং আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আরও কাছে এসে দাঁড়াল ওটা। আত্মরক্ষার্থে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাস্টি। ওটার কি হাল হয়েছে জানার সুযোগ হয়নি, কারণ লড়াইয়ের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই পুলিস তাকে পাকড়াও করেছে। বলে কি না, রাস্টি ইনগ্রামের ডান হাত ভেঙে গেছে।
তার হাজারো আপত্তি কানেই তোলেনি পুলিস, হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। ওদের ওপর তাই বড় রাগ ইনগ্রামের। আধা মাতাল সে এখনও। এক্স-রে সেরে ডাক্তার তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছে বলে করিডরে বসার জন্যে এসেছে। এই সময় ধুম্ ধাম্ পায়ের শব্দে মুখ তুলল সে। চোখ পড়ল আতঙ্কিত রক্তাক্ত পাভলভের ওপর। এবং পরক্ষণেই সার্জেন্ট হিউইর ওপর।
কালো পোশাকের ওপর রাগটা চেগিয়ে উঠল রাস্টি ইনগ্রামের। ওই লোকটিকেও নিশ্চয়ই ওর মত…ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই ঝড়ের গতিতে ইনগ্রামকে পাশ কাটাল পাভলভ। তার ঠিক চার ফুট পিছনেই সার্জেন্ট হিউই। আস্তে করে ডান পা-টা বাড়িয়ে দিল ইনগ্রাম। ল্যাঙ খেয়ে শূন্যে উঠে পড়ল হিউইর ভারী দেহটা।
‘ইউ স্টুপিড উয়ী বাগার!’ প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠল হিউই, পরক্ষণেই দড়াম করে আছড়ে পড়ল ফ্লোরে। সড় সড় করে ফুট কয়েক পিছলে এগিয়ে গেল দেহটা। মেঝে কেঁপে উঠতে পিছনে তাকাল আঁদ্রেই এক পলক, বাড়িয়ে দিল ছোটার গতি।
রাগে গা জ্বলে গেলেও কিছু করার নেই হিউইর। আঁদ্রেই ততক্ষণে প্রায় দশ গজ পিছনে ফেলে দিয়েছে তাকে। ইনগ্রামের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলার ভঙ্গি করল সে, তারপর আবার ছুটল ডেকহ্যাণ্ডের পিছনে। করিডরের শেষ মাথায় পৌঁছেই পাশাপাশি দুটো এলিভেটরের ওপর চোখ পড়ল পাভলভের। একটার দরজা আধখোলা, বন্ধ হতে শুরু করেছে, ভেতরে নেই কেউ।
দিশে না পেয়ে সেদিকেই ছুটল ডেকহ্যাণ্ড। একেবারে শেষ মুহূর্তে কাত হয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল এলিভেটরে। বন্ধ দরজার গায়ে হিউইর দমাদম কিলের আওয়াজ উঠছে, অনবরত চেঁচাচ্ছে লোকটা। দুলে উঠে ওপরদিক রওনা হলো এলিভেটর। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে হাঁপাতে লাগল আঁদ্রেই।
ওদিকে এলিভেটর শ্যাফটের পিছনেই স্টেয়ারওয়েল। ক্যাঙ্গারুর মত একেক লাফে চারটে করে ধাপ টপকে ওপরে উঠতে শুরু করল সার্জেন্ট হিউই। প্রতি ফ্লোরেই ছুটে ছুটে এসে এলিভেটর ইণ্ডিকেটরের ওপর চোখ বোলাচ্ছে। কোন ফ্লোরে আছে ওটা, নিজে কতখানি পিছিয়ে পড়েছে বোঝার জন্যে। কোথাও না থেমে সোজা টপ ফ্লোরে, দশতলায় উঠে গেল এলিভেটর। ছুটতে ছুটতে জিভ বেরিয়ে পড়ল হিউইর। দম ঝড়ের বেগে।
শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল সে। জায়গামত পৌছে দেখল দাঁড়িয়ে রয়েছে এলিভেটর। দরজা খোলা, কেউ নেই ভেতরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিক হাঁপাল সে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আঁদ্রেইর খোঁজে। দীর্ঘ করিডর ফাঁকা। কোথাও কোন চিহ্ন নেই তার। ছুটল সার্জেন্ট। দশতলার প্রতিটি ওয়ার্ড, কেবিন খুঁজে দেখল, নেই সে। কেউ কিছু বলতে পারল না।
হঠাৎ কি মনে হতে আবার স্টেয়ারওয়েলের দিকে ছুটল হিউই। তিন- চার লাফে উঠে এল ছাতে। দরজা পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আঁৎকে উঠল সে। তারা জ্বলা আকাশের গায়ে ছায়া পড়েছে পাভলভের। উত্তর দিকের প্যারাপেটে উঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা, ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে।
‘আঁদ্রেই!’ গলার স্বর আটকে গেল হিউইর। ‘পাভেল! নেমে এসো, ভাই। কোন ভয় নেই তোমার। নেমে এসো, তোমার চিকিৎসা দরকার।’
পা বাড়াল সে। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। নিচের ঘরবাড়ি, রাস্তার আলোয় আঁদ্রেইর মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে।
নিজের শূন্য দু’হাত তুলে দেখাল সার্জেন্ট। ‘এই দেখো, কোন অস্ত্র নেই আমার হাতে, আঁদ্রেই। কোন ভয় নেই তোমার। প্লীজ, নেমে এসো। পা পিছলে গেলে…।’
সার্জেন্ট বিশ ফুটের মধ্যে এসে পড়েছে দেখে কিছুটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল পাভলভ। দ্রুত একবার নিচে তাকাল। দম নিল লম্বা করে। চোখ বুজল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শূন্যে। আহাম্মক হয়ে গেল সার্জেন্ট। কয়েক সেকেণ্ড বিশ্বাসই করে উঠতে পারল না যা দেখল তা মিথ্যে নয়। সত্যি। নিচের স্টাফ কার পার্কে পতনের ভারী আওয়াজ উঠল।
চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠল সার্জেন্টের। ‘হা ঈশ্বর! মরে গেছি!’ কাঁপা হাতে বেল্টে ঝোলানো পারসোন্যাল রেডিওটা বের করল সে।
বিপি সার্ভিস স্টেশনের একশো গজ ওপাশে বিশাল বিএমডব্লিউর ওপর মূর্তির মত বসে আছে মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। একটা বড় ঝোপের আড়ালে। একে জায়গাটা অন্ধকার, তারওপর কালো মোটরসাইকেল লেদার পরে থাকায় ভাল করে তাকালেও কেউ দেখতে পাবে না তাতায়েভকে।
ঘড়ি দেখল সে। তিনটে। দুটোয় পৌঁছার কথা তার দ্বিতীয় চালান। কিন্তু এল না। আর অপেক্ষা করারও উপায় নেই। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা পরও যদি চালান না পৌঁছায়, তো সে স্থান ছেড়ে সরে পড়ার নির্দেশ আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করল মেজর। আবার মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে তাকে। জানাতে হবে ব্যাক-আপ কুরিয়ার পাঠাবার কথা। এঞ্জিন স্টার্ট দিল তাতায়েভ।
ঘর্মাক্ত কলেবরে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘প্রতিবেশীকে’ (স্থানীয় ভাষায় সহকারী) ছুটে আসতে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সার্জেন্ট ব্রায়ান। ‘কি ব্যাপার!’ হিউইর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সে। ‘লোকটার পরিচয় জানা গেল?
‘লোকটা…লোকটা ছিল সীম্যান, রাশান।
‘এই রে! বেঁচে আছে, না…।’
‘নেই,’ দ্রুত মাথা দোলাল হিউই। চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে বুঝি। ‘লোকটা আত্মহত্যা করেছে, ব্রায়ান। লাফিয়ে পড়েছে ছাদ থেকে।’
অবিশ্বাস মাখা দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ ব্রায়ান। ‘বলো কি!’ পরক্ষণে বিস্ময় আর অবিশ্বাসের জায়গা দখল করল পুলিসী, ট্রেনিং। সে জানে, যখনই কোন গণ্ডগোল দেখা দেবে, আগে নিজের পিঠ আর চাকরি বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হবে। তা যে করেই হোক। প্রতিটি পা ফেলতে হবে প্রসিডিওর অনুযায়ী। কোন কাউবয় ট্যাকটিক নয়। নয় কোন অতি স্মার্ট চালাকি। ‘ডিভিশনে যোগাযোগ করেছ?’
‘আয়ি,’ মাথা ঝাঁকাল হিউই।
‘চলো, ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাক।’