এগারো
রাত দশটা। খোলা জানালার সামনে বসে আছে মাসুদ রানা। তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে রয়েছে সামনের অন্ধকার বাড়িটির দিকে। অন্য দুই জানালায় রয়েছে আরও চারজন। এ বেলা ব্রায়ান স্মিথ, গিলটি মিয়া ও পুলিসের দুই ওয়াচার নজর রাখছে দুই গ্রীকের ওপর। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে রানার দুশ্চিন্তা। চেক স্পাইটিকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছে কি না, সবে ভাবতে শুরু করেছে রানা, এই সময় কমিউনিকেটরে গিলটি মিয়ার কণ্ঠ শোনা গেল।
‘স্যার, হারামী দুটোর ন্যাজ নড়তে শুরু করেচে বোদহায়।’
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সিধে হলো মাসুদ রানা। অন্য সবাই একযোগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এদিকে। ‘যমজ দু’ভাইয়ের কথা বলছ?’
‘ওই হলো,’ উত্তর দিল গিলটি মিয়া। ‘একই কতা।’
‘কি হয়েছে?’
‘আজব এক কাণ্ড, স্যার। একটু আগে ওদের টেলিফোনে দু’বার রিঙ বেজে থেমে গেচে। এক মিনিট পর ফের দু’বার বেজে ঠাণ্ডা মেরে গেচে। এইমাত্র আবারও ঘটেচে ব্যাপারটা। পর পর তিনবার।
‘ওরা কেউ ধরেছে টেলিফোন?’ উত্তেজনায় মৃদু কাঁপুনি উঠে রানার।
‘না, স্যার। সে চেষ্টাই করেনি কেউ…স্যার!’
‘কি হয়েছে, গিলটি মিয়া?’
‘স্যার, ওদের একটা বেরিয়ে আসচে পেচন দরজা দিয়ে। গাড়িতে গিয়ে উটেচে।’
‘তুমি ওখানেই থাকো,’ চাপা গলায় দ্রুত নির্দেশ দিল মাসুদ রানা। ‘স্মিথকে বলো অন্যদের নিয়ে ওকে ফলো করতে। লোকটা শহর করছে হয়তো।’
কিন্তু না। পাঁচ মিনিট পরই সামনের রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনতে পেল মাসুদ রানা। অ্যানড্রিয়াস স্টেফানিডেস ফিরে এসেছে বাসায় অসময়ে। গাড়ি গ্যারেজে রেখে ঘরে ঢুকল সে। বন্ধ করে দিল দরজা। ভারি পর্দার ওপাশে আলোর আভাস টের পাওয়া গেল একটু পরই। তারপর সব চুপচাপ, কোন তৎপরতা নেই। কোথাও টেলিফোনও করছে না লোকটা।
এগারোটা বিশে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিল স্পিরিডন। অস্বাভাবিক! মন্তব্য করল পুলিসের এক ওয়াচার। বারোটার আগে কোনদিন এমন হতে দেখেনি সে গত তিন বছরে। ওদেরকে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল মাসুদ রানা। পুলিসের দুটো আনমার্কড ভ্যানে আছে ওরা। ধীর গতিতে ওদেরকে এ রাস্তা ও রাস্তা ঘোরাঘুরি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল রানা।
এগারোটা পঁয়তাল্লিশে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে এল স্পিরিডন। তারপর আবার নীরবতা। আলো জ্বলছে এখনও ভেতরে।
বারোটা বাজতে এক মিনিট বাকি থাকতে ঘড়মড় আওয়াজ উঠল মাসুদ রানার সেটে। ‘এক লোককে দেখতে পাচ্ছি, চীফ,’ বলল স্মিথ কণ্ঠে।
‘কোথায়?’
‘ক্রস স্ট্রীট আর কম্পটন স্ট্রীট জাংশনে।’
‘কি করছে?’
‘কিচুই না,’ উত্তর দিল গিলটি মিয়া। ‘অন্ধকারে স্রেফ ভেঁড়িয়ে আচে।’
‘নজর রাখো। এদিকেই আসবে ও।’
ঘরের ভেতর কালিগোলা অন্ধকার। কার্টেন সরান। জানালার কিনারা থেকে সামান্য পিছিয়ে বসেছে ওরা সবাই। সুপার স্যাম রসটনের দেয়া ক্যামেরাটা গলায় ঝোলাল মাসুদ রানা। ইনফ্রা রেড লেন্সে চোখ রেখে বাইরে তাকাল। বিশ গজ দূরের একটা লাইট পোস্ট স্পষ্ট করে তুলল ফোকাসিং নব্ ঘুরিয়ে। যদি আসে লোকটা এদিকে, যদি নয়, আসবেই সে। এবং ওর নিচে দিয়েই আসবে। তখন ছবি তুলবে ও লোকটার।
‘পা বাড়িয়েছে! আপনার দিকেই যাচ্ছে, চীফ।’
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে মাসুদ রানা। ক্যামেরা দু’হাতে বুকের কাছে ধরা। গরম রক্তের নাচন শুরু হয়ে গেছে শিরায় শিরায়। নাক কান দিয়ে গরম ভাপ্ বেরচ্ছে।
‘লম্বা ছয় ফুটের ওপরে,’ বলল ব্রায়ান। ‘গাঢ় রেইনকোট পরা।
এক মিনিট পর হঠাৎ করেই লাইট পোস্টের নিচে উদয় হল দীর্ঘ কাঠামোটা। মেশিনের মত পর পর পাঁচবার শাটার টিপল মাসুদ রানা। ফ্ল্যাশহীন ক্যামেরা নিঃশব্দে কাজ সারল তার। দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে ঊনষাট নম্বর বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।
মৃদু নকের আওয়াজ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। হলরুমটা অন্ধকার। দেখা গেল না কিছু। এক মুহূর্ত পরই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ক্যামেরার ব্যাক কাভার খুলে দ্রুত ফিল্মটা বের করে আনল মাসুদ রানা। কি যেন একটা মনে পড়ব পড়ব করছে ওর, অথচ পড়ছে না। লোকটার কোথায় যেন কি এক অসামঞ্জস্য চোখে পড়েছে রানার। কি সেটা?
বিএসএসের হ্যারি নিগেলের হাতে রোলটা তুলে দিল ও নীরবে। কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। লোকটা জানে কি করতে হবে। ওটা নিয়ে স্থানীয় পুলিস ল্যাবে যাবে নিগেল। ছবি ডেভলপ করিয়ে ফিরে আসবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিগেল দুই মিনিটের ভেতর।
হঠাৎ করেই খেয়াল পড়ল রানার ব্যাপারটা। রেইনকোট! রেইনকোট কেন পরে ছিল সে? বৃষ্টির দেখা নেই, অথচ রেইনকোট! কেন? সঙ্গে নিয়ে আসা কিছু লুকিয়ে রাখার জন্যে? ‘লোকটার পরনে কি ছিল, স্মিথ?’
‘রেইনকোট, চীফ।’
‘আর?’
‘জ্যাকবুট।’
চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল মাসুদ রানা। বাকি চার জনের উদ্দেশে চাপা কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘বেরোও সবাই! লোকটা মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছে। ধারেকাছেই কোথাও রেখে এসেছে ওটা। খুঁজে বের করো গিয়ে। গাড়ি নিয়ে নয়, পায়ে হেঁটে খোঁজো। ফাস্ট, ফাস্ট!’
দুদ্দাড় করে ছুটল সবাই। কমিউনিকেটরের সাহায্যে একই নির্দেশ দিল রানা বাইরের সবাইকে। ‘পাওয়া গেলে ওটার রিয়ার মাডগার্ডে ডিএফ রীপার প্ল্যান্ট করতে হবে,’ স্মিথকে বলল ও। ‘মুভ! সব রাস্তা খুঁজে দেখো।’
কতক্ষণ থাকবে লোকটা ও বাড়িতে? ভাবতে লাগল মাসুদ রানা, দশ মিনিট, বিশ মিনিট, এক ঘণ্টা? নাকি এখনই বেরিয়ে আসবে? ইয়াল্লা! আর অন্তত কিছুক্ষণ যেন থাকে লোকটা। হাতের কাছে নিচু একটা টেবিলে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল মাসুদ রানা। এ বাড়ির প্রায় প্রতিটি রূমেই টেলিফোন প্লাগ আছে। বলতে হয়নি, প্রয়োজন হতে পারে ভেবে ব্যারি ব্যাংকস্ নিজেই একটা সেট জুড়ে দিয়ে গেছেন ওদের সুবিধের জন্যে।
ঘুম ভাঙাল রানা পুলিস সুপারের। ঝড়ের বেগে কথা বলে গেল পাঁচ মিনিট। ‘ডোন্ট উত্তরি,’ ওর বক্তব্য শেষ হতে বললেন স্যাম রসটন। ‘আমি এখনই বেরচ্ছি।’
বিশ মিনিট পর একজনের সাড়া পাওয়া গেল। লোকটা স্থানীয় পুলিসের ওয়াচার। ‘মোটর সাইকেলটা পাওয়া গেছে, স্যার। বড় একটা বিএমডব্লিউ। কুইন স্ট্রীটের শেষ মাথায়। এঞ্জিন, এগজস্ট পাইপ এখনও গরম।’
‘রেজিস্ট্রেশন নাম্বার?
লিখে নিল রানা নম্বরটা। পুলিস স্টেশনে ফোন করে আবার সুপারকে ধরল ও। অনুরোধ করল যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে রানাকে জানানো হয়। পনেরো মিনিট পর খবর এল, ওটা ডরচেস্টারের জনৈক কম্পিউটর এঞ্জিনিয়ার মিস্টার মার্টিন ফ্যানারির নামে রেজিস্টার্ড।
আমার সন্দেহ ওটা হয় চুরি করা, নয়তো ফলস্ প্লেট। অথবা ব্লাইও অ্যাড্রেসও হতে পারে,’ বলল মাসুদ রানা। ‘আপনি ডরচেস্টার পুলিসের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা কনফার্ম করে আমাকে জানান, প্লীজ।’
ফোন রেখে কমিউনিকেটর তুলে নিল মাসুদ রানা। বাইকটায় ব্লীপার প্ল্যান্ট করে পুলিসের ওয়াচার দু’জনকে ফিরে আসার নির্দেশ দিল। ওদের বাড়িটার ওপর নজর রাখার কাজে লাগিয়ে নিজে মাঠে নামতে চায়। ব্যারি ব্যাংকস্ দম্পতিকে কষ্ট স্বীকার করার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল মাসুদ রানা।
দশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নিল ও। গিলটি মিয়া, ব্রায়ান স্মিথ ও হ্যারি নিগেলকে সঙ্গে নিয়েছে ও, অন্যরা আপাতত এখানেই থাকছে। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রথম গাড়িতে রানা ও গিলটি মিয়া, অন্যটায় বাকি দু’জন। কোথায় কোন্ জাহান্নামে যায় লোকটা, কে জানে! দুটো গাড়ি সঙ্গে রাখাই ভাল।
সেন্ট মার্গারেট’স ড্রাইভে বসে আছে ওরা। অনেক দূরে, আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে মার্টিন ফ্ল্যানারির মোটর সাইকেলটা। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কোন খবর আসছে না পুলিস ওয়াচারদের তরফ থেকে। করে কি লোকটা বসে বসে? ভাবনাটা শেষ হয়নি রানার, এই সময় কথা বলে উঠল কমিউনিকেটর।
‘হি ইজ মুভিঙ!’
‘অল রাইট,’ বলল রানা। ‘স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সুপারকে ঠিক এক ঘণ্টা পর ইন করতে বলবেন ফিফটি নাইনে।’ ড্যাশবোর্ডের ওপর যন্ত্রটা রাখল ও। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর রেইনকোট পরা দীর্ঘ ছায়াটা উদয় হলো বিএমডব্লিউর পাশে। স্টার্ট নিল দৈত্যাকার বাইক। চলতে শুরু করবে এখনই।
কোন ব্যস্ততা নেই রানার। সামনের প্যানেলে ফিট করা রীপার কনসোলের ওপর সেঁটে আছে দৃষ্টি। জিনিসটা খুদে রাডার স্ক্রীনের মত দেখতে। উজ্জ্বল একটা বিন্দু খানিক পর পর পর্দার এক মাথায় উদয় হচ্ছে, তারপর সোজা গিয়ে ও মাথা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্ল্যান্টেড ব্লীপার মুভ করলেই ওটার আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, পথ দেখাতে আরম্ভ করবে সে।
আচমকা জার্ক করল বিন্দুটা, চলতে শুরু করেছে বিএমডব্লিউ। ‘এক মাইল এগিয়ে থাকার সুযোগ দিচ্ছি ওকে,’ দ্বিতীয় গাড়ির আরোহীদের জানাল মাসুদ রানা। ‘তারপর।’
শহরের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ-পুব দিকে এগোচ্ছে বিন্দুটা। সময় মত গিয়ার দিল রানা, রওনা হয়ে গেল। শহর ছেড়ে এ-সিক্স সেভেনটিনে পড়ল মোটর সাইকেল, ম্যাসফিল্ড-নিউআর্কের দিকে চলেছে। ওটা যদি কার হত, খুশি হত মাসুদ রানা। দু’পেয়ে যান অনুসরণ করা মুশকিল। বিশেষ করে দিনের বেলা। প্রয়োজনে উড়ে চলে ওগুলো। তবে লোকটার বুদ্ধি আছে, এ কাজে ঠিক জিনিসটিই বেছে নিয়েছে। ওর জায়গায় রানা হলেও তাই করত।
প্রয়োজনে ইচ্ছেমত মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া সম্ভব। যেখানে কার চলতে পারবে না, সে-সব জায়গায় ওগুলো চলবে তুফানের মত। ঠিক কাজই করেছে মার্টিন ফ্ল্যানারি, ওরফে যেই হোক, ভাবল রানা।
একই গতিতে ড্রাইভ করছে লোকটা, স্পীড লিমিট ব্রেক করছে না। বরং কখনও কখনও স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে চালাচ্ছে। বাঁক নেয়ার সময় ঘটছে’ ব্যাপারটা। ঘুমন্ত ম্যানসফিল্ড পেরিয়ে নিউআর্কের দিকে চলল এবার সে। শহরে নাক ঢোকাবার আগে গতি কমে এল তার। কারের সঙ্গে মোটর সাইকেলের ব্যবধান কমে আসতে লাগল খুব দ্রুত।
হেডলাইট নিভে গেল পিছনের দুই কারের। থেমে দাঁড়াল সাইড করে। সরু একটা গলিতে মোটর সাইকেল রেখে বড় রাস্তায় ফিরে এল তাতায়েভ। ঝাড়া দশ মিনিট পিছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে। পিছনে ওরাও বসে থাকল চুপ করে একটা বড় ট্রাক বাতাসে ঝড় তুলে নিউআর্কের দিকে ছুটে গেল কেবল। তারপর আর কিছু নেই। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল ভ্যালেরি তাতায়েভ। রওনা হয়ে গেল আবার। পিছু নিল জোড়া সেডান। মাঝে এক মাইল দূরত্ব রেখে এগোতে লাগল। ট্রেন্ট নদী পর্যন্ত চলন একনাগাড় ধাওয়া। ডানে বিশাল এক সুগার রিফাইনারি রেখে যখন শহরে পৌঁছল ওরা, তখন তিনটে বাজে। শহর ছাড়িয়ে এ-সেভেনটিন ধরল মোটর সাইকেল—স্লিফোর্ড চলেছে।
চেস্টারফিল্ড। সুপারিনটেনডেন্ট স্যাম রসটনের নেতৃত্বে বারোজন পুলিসের একটি দল কম্পটন স্ট্রীটের ঊনষাট নম্বর বাড়ির ওপর চড়াও হলো দুটো পঞ্চান্ন মিনিটে। সঙ্গে সাদা পোশাকের আরও দু’জন রয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চের। আর পাঁচ মিনিট আগে এলে দুটোকে খুব সহজেই পাকড়াও করা যেত। ব্যাপারটাকে দুর্ভাগ্য বলে মেনে নিলেন সুপার।
দলটা যখন বাড়ির মাত্র দশ ফুট দূরে, এই সময় আচমকা দরজা খুলে গেল। স্লীপার ট্র্যান্সমিটারটা নিয়ে বেরিয়ে আসছিল দুই ভাই। ওর মধ্যে তাতায়েভের রেকর্ড করা কোডেড স্কোয়ার্ট মেসেজটা রয়েছে, ওটা ট্র্যান্সমিট করতে যাচ্ছে তারা। অ্যানড্রিয়াস স্টেফানিডেস ছিল সামনে, পিছনে ট্র্যান্সমিটার হাতে স্পিরিডন স্টেফানিডেস। জমে গেল প্ৰথমজন।
সামনেই ইউনিফর্ম পরা পুলিস বাহিনী দেখে আঁতকে উঠল সে। ‘পুলিস!’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে সতর্ক করল ভাইকে, পরমুহূর্তে দু’পা পিছিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল সে, দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। সঙ্গে সঙ্গে বিশালদেহী দুই পুলিসও ঝাঁপ দিল, কাঁধ দিয়ে পড়ল তারা দরজার ওপর।
কয়েক সেকেণ্ড পর দরজা এবং তার পিছনে দাঁড়ানো অ্যানড্রিয়াসকে নিয়ে ভেতরের সরু হলরূমে আছড়ে পড়ল তারা। কোনমতে ভারমুক্ত হয়েই দুই পুলিসের সঙ্গে ক্ষিপ্ত জানোয়ারের মত লড়াই শুরু করে দিল অ্যানড্রিয়াস। নাকেমুখে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে ভয়ঙ্কর এক আঘাত বসিয়ে দিতেই ঠাণ্ডা মেরে গেল লোকটা।
এবার হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল অন্যরা। স্পিরিডনকে দেখা গেল না কোথাও। নিচতলার রুমগুলো সার্চ করে দোতলায় ছুটল সবাই। সবার আগে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দু’জন। লোকটাকে পাওয়া গেল বাথরূমে। ট্র্যান্সমিটারটা তার পায়ের কাছে, ফ্লোরে রাখা। ওটার প্লাগ ওয়াল সকেটে ঢোকানো। কনসোলে টকটকে লাল আলো জ্বলছে। বার্তাটা যাই হোক, পাঠাতে পেরেছে স্পিরিডন।
বিনা বাধায় ধরা দিল সে।
মেনউইথ হিল জিসিএইচকিউ লিনিঙ পোস্ট একটা সিগন্যাল স্কোয়ার্ট ইন্টারসেপ্ট করল দুটো সাতান্ন মিনিটে। ওটা ট্র্যান্সমিট করা হয়েছে চেস্টারফিল্ডের পশ্চিম প্রান্তে ফুটবল গ্রাউণ্ডের কাছাকাছি থেকে, ব্যাপারটা জানা যেতেই সুপার স্যাম রসটনের সঙ্গে যোগাযোগ করল ওরা।
‘আমি জানি, হাসিমুখে উত্তর দিলেন সুপার। ‘ধরে নিয়ে এসেছি ব্যাটাদের।’
মস্কো। ওয়ারেন্ট অফিসার রেডিও অপারেটর হেডফোন নামিয়ে পাশের টেলিপ্রিন্টার মেশিনটির দিকে তাকাল। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘দুর্বল সিগন্যাল। তবে বোঝা গেছে পরিষ্কার।’
স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে গেল মেশিনটা, টপাটপ টাইপ হয়ে চলেছে অর্থহীন একের পর এক শব্দ। ওটা থেমে পড়তে টাইপ হওয়া কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে বসল ওয়ারেন্ট অফিসার, ফিড করল ডিকোডার মেশিনে। ওর সঙ্গের কম্পিউটর চালু হলো এবার, প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে এল মূল বার্তাটা।
পড়ল তা রেডিও অপারেটর। হাসি ফুটল মুখে। টেলিফোন তুলে একটা নাম্বার ঘোরাল সে। ও প্রান্তের সাড়া পেয়ে নিজের পরিচয় জানাল প্রথমে, তারপর যে ধরেছে ফোন তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলো। সবশেষে ঘোষণা করল ওয়ারেন্ট অফিসার, ‘অরোরা ইজ ‘গো’।
•
স্লিফোর্ড ছেড়ে লিঙ্কনশায়ারের দিকে চলেছে এখন বিএমডব্লিউ। একসময় ওটাও অতিক্রম করল। তীরের মত সোজা হাইওয়ে ধরে ফেন কাউন্টির দিকে এগোতে লাগল। তারপর ওয়াশ এবং কাউন্টি অভ নরফোক। আরও দু’বার থেমেছিল তাতায়েভ পিছনের দিগন্তে চোখ বোলাবার জন্যে। দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট করে। কিন্তু দেখা পায়নি কারও।
সাটারটন গ্রামে ঢোকার মুখে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল মাসুদ রানা। যে পথে এসেছে ওরা এতক্ষণ, সাটারটনের মাঝামাঝি জায়গায় ওয়াই-এর মত ভাগ হয়ে গেছে সেটা। ওটা থেকে দ্বিতীয় হাইওয়ে; এ-সিক্সটিন, বেরিয়ে চলে গেছে সোজা দক্ষিণে, স্পালডিঙে। আর এ-সেভেনটিন গেছে দক্ষিণ-পুবে, লঙ সাটন, তারপর নরফোক কাউন্টি বর্ডার কিংস লিন।
পুরো দু’মিনিট পর কনসোলের ব্লিপ নিশ্চিত করল এ-সেভেনটিনেই রয়েছে এখনও বিএমডব্লিউ। ততক্ষণে প্রায় তিন মাইল পিছনে পড়ে গেছে ওরা। এক্সিলারেটর দাবিয়ে ধরল রানা ফুটবোর্ডের সঙ্গে। দুই মিনিটে স্পীডোমিটারের কাঁটা উঠে গেল নব্বইয়ে। ওই গতি বজায় রাখল রানা যতক্ষণ না আগের মত এক মাইলে নেমে এল ব্যবধান।
কিংস লিনের দক্ষিণে প্রশস্ত আওজ নদী অতিক্রম করল ওরা। ব্রিজ থেকে নেমে মাইলখানেক এগিয়েই ডানের বাই-পাস রোড ধরল মোটর সাইকেল। ডাউনহ্যাম মার্কেট হয়ে থেটফোর্ড গেছে ওটা।
‘জ্বালিয়ে মারলে তো হারামজাদা,’ আর সহ্য করতে না পেরে বিড়বিড় করে বলল গিলটি মিয়া’।
‘আর বেশি দেরি নেই,’ বলল রানা। ‘আশেপাশেই কোথাও ঘাঁটি ওর যতদূর মনে হয়। আলো ফোটার আগেই সেখানে পৌঁছতে চাইবে লোকটা।’
কিন্তু রানার ধারণায় ভুল ছিল। আলো ফুটতে শুরু করেছে। এখনও চলছে তো চলছেই মোটর সাইকেল, থামার লক্ষণ নেই। হেডলাইট অফ করে দিল ও দশ মিনিট পর। কেবল সাইড লাইট জ্বলছে দু’পাশে।
ওরাও সাইড লাইট জ্বেলে এগোচ্ছে। অত্যন্ত ধীরগতিতে। দৈত্যাকার যাত্রীবাহী কোচের সুবিশাল এক কলাম। সাফোকের বারি সেন্ট এডমাণ্ডস অতিক্রম করছে ওরা এ মুহূর্তে। কেবল কোচই হবে দু’শোর বেশি। তার ওপর সামনের কার, মোটর সাইকেল, বাই-সাইকেল এবং পদযাত্রীদের সংখ্যার তো কোন সীমা পরিসীমাই নেই। গজেন্দ্রচালে এগোচ্ছে লেবার পার্টির অ্যান্টি নিউক্লিয়ার মিছিল।
ব্যানার আর প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে আছে তার আগামাথা। শহর ছেড়ে এ ওয়ান ফর্টি থ্রী ধরে ইক্সওয়ার্থ জাংশনের দিকে এগোল মিছিল। ওখানে খানিক বিশ্রাম নিয়ে ফের চলা শুরু হবে।
ডাউনহ্যাম মার্কেট ছাড়িয়ে পাঁচ মাইল দক্ষিণে এগোবার পর পুবদিকে ঘুরে গেল সামনের ওটা। ম্যাপের ওপর চোখ বোলাল মাসুদ রানা। এ ওয়ান থার্টি ফোর ধরেছে লোকটা। তার মানে থেটফোর্ড চলেছে। সূর্য উঠতে বেশি দেরি নেই। সামনে চমৎকার একটি উজ্জ্বল দিনের আভাস। আধ ঘণ্টা পর কয়েক মাইল দীর্ঘ বিশাল বীচ, ওক আর পাইন বনে ঢুকল ওরা। দু’পাশে আকাশছোঁয়া সবুজ গাছ, মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে বন পেরিয়ে গ্যালোম হিল। তারপরই থেটফোর্ড। শহরে ঢোকার আগে ফের থামতে হলো মাসুদ রানাকে। কারণ আবার থেমে দাঁড়িয়েছে মোটর সাইকেল।
‘আবার ডেঁড়িয়ে পড়েচে?’ তেড়ে উঠল গিলটি মিয়া। রেগে উঠেছে।
রেঞ্জ ইণ্ডিকেটর পরীক্ষা করে বুঝল রানা, থেটফোর্ডের ঠিক মাঝখানে রয়েছে এখন লোকটা। কি করছে ওখানে সে? কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে? হতে পারে। এত দীর্ঘ পথ ড্রাইভ দিয়ে এসে খিদে ওর নিজেরও লেগেছে। দশ মিনিট অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল মাসুদ রানা।
এক চুলও নড়ল না ব্লিপ পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও। কেমন সন্দেহ হলো রানার। ব্যাপার কি? লোকটা কি ওর গাড়িতে ব্লীপার প্ল্যান্ট করার ব্যাপার টের পেয়ে গেছে? জিনিসটা খুলে ফেলে দিয়ে কেটে পড়েছে? নাকি ওখানেই ওর ঘাঁটি? যাই হোক, চেক করে দেখার হয়েছে এখন। আবার রওনা হলো রানা।
জেগে উঠেছে থেটফোর্ড। রীপারের নির্দেশমত ম্যাগডালেন স্ট্রীটের একসার বন্ধ গ্যারাজের সামনে এসে থামল ওরা। গাড়ির নাক বার কয়েক ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে ওর একটার সামনে স্থির করল মাসুদ রানা। টানা ‘টু- উঁ-উঁ’ আওয়াজ করছে ব্লীপার। এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে পর্দার বিন্দুটা।
‘ওটার ভেতর আছে লোকটা,’ বলল মাসুদ রানা।
নেমে পড়ল সবাই গাড়ি থেকে। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। যার যার অস্ত্র বের করে হাতে নিল প্রত্যেকে। তারপর পায়ে পায়ে এগোল। গ্যারেজের দরজায় তালা মারা নেই। ভেড়ানো আছে কেবল। বাঁ হাতে একটা পাল্লা ধরল মাসুদ রানা, লম্বা করে দম নিল। তারপর এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা। ডান হাতে উদ্যত ওয়ালথার পিপিকে। মুহূর্তে মুখটা কালো হয়ে উঠল ওর হতাশায়।
গ্যারাজের মাঝখানে স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড মোটর সাইকেলটা। ঘাড় কাৎ করে এক চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। যেন নীরবে প্রশ্ন করছে, কারা তোমরা? কি চাও এখানে?
দেয়ালের পেরেকে ঝুলছে রাইডারের লেদার জ্যাকেট, জিপ্ সাইডেড ট্রাউজার ও রেইনকোট। মেঝেতে পড়ে আছে জ্যাকবুট। মাটিতে আরও একজোড়া চাকার দাগ দেখে ঝুঁকে বসল মাসুদ রানা। ছোট আকারের কোন কারের হবে। বুঝে ফেলল রানা ব্যাপারটা। মোটর সাইকেল রেখে অনেক আগেই গাড়ি নিয়ে কেটে পড়েছে রুশ স্পাইটি। শেষ মুহূর্তে মস্ত এক ঠক্ দের দিয়ে গেছে ওদের লোকটা।