দশ
সীটিং রূমেই কাজ করবে ঠিক করল সেমিয়ানভ। মেঝেয় বসে অবশ্যই।
তাকে সাহায্য করার জন্যে বসে আছে তাতায়েড। ‘প্রথমে গারবেজ ব্যাগ চাই একটা,’ বলল সেমিয়ানভ। সঙ্গে সঙ্গে পালিত হলো নির্দেশ।
‘এবার আমি যেটা যেটা চাইব, এগিয়ে দিন এক এক করে,’ বলল সে। ‘প্রথমে চুরুটের বাক্স।
ওটা হাতে নিয়ে সীল খুলল অ্যাসেম্বলার। ঢাকনা তুলল। ভেতরে পঁচিশটা চুরুট। নিচের সারিতে বারোটা, ওপরে তেরোটা। প্রতিটি আলাদা আলাদা অ্যালুমিনিয়ামের মুখ-বন্ধ টিউবে মোড়া। টিউব কেটে বের করতে হয় ওগুলো। ‘নিচের সারির বাঁ দিক থেকে তৃতীয়টা,’ নিজের মনে বলল সে।
ওটা বের করে ব্লেড দিয়ে কেসিঙটা কেটে ফেলল সেমিয়ানভ। তারপর আলতো এক পোচে চুরুটের এ মাথা ও মাথা কেটে তামাকের ভেতর থেকে বের করে আনল ইঞ্চি দুয়েক লম্বা, সরু কাঁচের শিশি। ওর এক মাথা কোঁচকানো। ভেতর থেকে দুটো প্যাঁচানো, শক্ত তার বেরিয়ে আছে। ‘ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটর,’ তাতায়েভকে শুনিয়ে উচ্চারণ করল বিজ্ঞানী। ওটা বাদে আর সব গারবেজ ব্যাগে ভরল সে।
‘প্লাস্টার কাস্ট।’
ওটা তৈরি দুই স্তর প্লাস্টার দিয়ে। প্রথম স্তর শক্ত হওয়ার পর ওপরে আরও এক স্তর জোড়া হয়েছে। দুটোর ভেতর রয়েছে ছাই রঙের পাটির মত নরম কিছু একটার আরেক স্তর। প্লাস্টারের আঁঠার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে পলিথিনে মুড়ে মাঝে স্থাপন করা হয়েছে জিনিসটা। প্লাস্টার অভ প্যারিসের দুটো স্তর আলাদা করল সেমিয়াভ। পলিথিন প্যাকেটটা বের করে ওটা থেকে খসিয়ে নিল নরম জিনিসটা। তারপর জিনিসটা দলা করে মুঠোয় পুরে চেপে চেপে বল বানাতে বানাতে বলল, ‘হাফ পাউণ্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।’
পুরো প্লাস্টার স্থান পেল গারবেজ ব্যাগে।
‘এবার জুতোজোড়া।’
দুটোরই হিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলল সেমিয়ানভ। একটায় পাওয়া গেল দুই ইঞ্চি ডায়া, এক ইঞ্চি পুরু একটা স্টীল ডিস্ক। ওটার রিম প্যাঁচ কাটা। সমতল পিঠের একদিকে এ মাথা ও মাথা গভীর খাঁজ। চওড়া মাথায় স্ক্রু- ড্রাইভার ধারণ করার জন্যে কাটা হয়েছে খাঁজটা। অন্যটার ভেতর আছে আরেক গ্রে-মেটাল ডিস্ক। এটাও দুই ইঞ্চি ডায়ার।
‘লিথিয়াম,’ পরেরটা দেখিয়ে ঘোষণা করল বিজ্ঞানী। ‘ইনিশিয়েটর। অ্যাটমিক পাওয়ারকে ফুল ফোর্সে বিস্ফোরিত হতে সহায়তা করবে।’ জুতো এবং হিলের অবশিষ্টাংশ ফেলে দিল সে ব্যাগে।
‘শেভার।’
ওর ভেতর থেকে বেরোল বিকল্প পোলোনিয়াম ডিস্কটি। গ্লাসগোয় ডেকহ্যাণ্ড পাভলভ এরই পয়লা চালানটি খুইয়েছিল। এটার ব্যাপারে রানিং কমেন্ট্রি দিতে ভুলে গেল বিজ্ঞানী। এরপর হিট রেজিসট্যান্ট প্যাড খুলে ভেতর থেকে দেড় ফুট লম্বা, বিশ কেজি ওজনের স্টীল টিউবটা বের করার কাজে লেগে গেল।
চার ইঞ্চি ডায়ামিটারের একটা টিউব ওটা। হার্ডেনড্ স্টীলের তৈরি, এক মাথা খোলা টিউব। ভেতরে দুই ইঞ্চি ফাঁকা, এক ইঞ্চি পুরু স্টীলের তৈরি জিনিসটা। টিউবের উন্মুক্ত মাথার ভেতরদিকটা প্যাঁচ কাটা। অন্য প্রান্তে স্টীলের সংযুক্ত ক্যাপ পরানো, ঠিক মাঝখানে ছোট একটা ফুটো আছে ক্যাপটার। কাজে গভীরভাবে মনোনিবেশ করার ফলে কথা বন্ধ হয়ে গেছে সেমিয়ানভের। নীরবে হাত চলছে তার। তাতায়েভ হাঁ করে দেখছে লোকটার কাজ।
ফার্স্ট অফিসার ভলকভের পোর্টেবল থেকে বের হলো টাইমার ডিভাইস। আকার দুটো ফাইভ-ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট লম্বালম্বিভাবে জুড়লে যতটা দীর্ঘ হয়, ততটা। পাশেও তেমনি। দুই সমতল মাথার একদিকে আছে দুটো সুইচ। একটা হলুদ, অন্যটা লাল। আরেক মাথা দিয়ে বেরিয়ে আছে দুটো রঙিন তার; নেগেটিভ, পজিটিভ। ওটার চার কোণে চারটে ফুটো। যে স্টীল কেবিনেটে রাখা হবে তৈরি বোমা, ওটার দরজার সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে জুড়ে দেয়ার সুবিধের জন্যে।
এবার ফায়ার এক্সটিংগুইশার। ওর তলাটা কাটা, প্যাঁচ কষেলাগানো। কাজটা এত নিখুঁতভাবে সারা হয়েছে যে চোখেই পড়েনি কাস্টমসের। ওটাই স্বাভাবিক, কারণ কাটা মুখ যাতে সহজে চোখে না পড়ে সে জন্যে নতুন করে পুরু রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছিল পুরো জিনিসটায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মোটা প্যাড বের করল সেমিয়ানভ। প্যাডের ভেতর রয়েছে সীসার মত দেখতে একটা ধাতব রড। পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, দুই ইঞ্চি ডায়া। ওজন সাড়ে চার কেজি। ওটা স্পর্শ করার আগে হেভি ডিউটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল গ্লাভস পরে নিল বোমা বিশেষজ্ঞ। কারণ ওটা খাঁটি ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ।
‘জিনিসটা রেডিওঅ্যাকটিভ, তাই না?’ প্রশ্ন করল মোহাচ্ছন্ন তাতায়েড।
‘হ্যাঁ।’
‘ডেঞ্জারাস?’
‘ততটা নয়। সবাই ভাবে রেডিওঅ্যাকটিভ মানেই বুঝি বিপজ্জনক, আসলে তা নয়। লিউমিনাস হাতঘড়িও রেডিওঅ্যাকটিভ, কিন্তু আমরা তা হাতে পরি। ইউরেনিয়াম আসলে আলফা-এমিটার, লো-লেভেল। তেমন তেজস্ক্রিয় কিছু নয়। এটা বিপদজনক হয়ে উঠবে তখনই, যখন বোমাটা ফাটবে।’
•
এবার হেডল্যাম্প বাউল দুটো মুক্ত করল সে ইউনিট থেকে। দুটো অর্ধবৃত্ত, এক ইঞ্চি পুরু হার্ডেও স্টীলে তৈরি বাউল। দুটোরই প্রান্ত বাইরের দিকে সামান্য ভাঁজ করা, ষোলোটা করে ছিদ্র আছে তাতে পরস্পরের সঙ্গে নাট-বোল্ট দিয়ে যুক্ত করার জন্যে। দুটো এক হলে নিখুঁত একটা গ্লোব তৈরি হবে।
একটা বাউলের পিছনদিকে, ঠিক মধ্যিখানে দুই ইঞ্চি ডায়ার ছিদ্র আছে, ভেতরটা প্যাচ কাটা। প্রথম জুতোর হিল থেকে বের হওয়া খাঁজ কাটা স্টীল ডিস্কটা সময়মত নিখুঁতভাবে ফিট্ হবে ওই ছিদ্রে। অন্য বাউলের একই জায়গায় দুই ইঞ্চি ডায়ার খাটো একটা রড ঠেলে বেরিয়ে আছে। ‘রডটা প্যাচ কাটা, যাতে হ্যানোমাগ জাগারনাটে করে বয়ে আনা দেড় ফুটি পাইপটার প্যাঁচ কাটা প্রান্তে জুড়ে দেয়া যায় ওটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে।
সবশেষের আইটেমটি জার্মান ক্যাম্পার ভ্যান মালিকের ছেলেমেয়ের খেলার বল। ওপরের রঙচঙে রাবারের খোলটা কেটে ফেলল সেমিয়ানভ। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল আরেকটা ধাতব বল, ব্রিশ কেজি ওজনের। এটাও ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ। আবার রানিং কমেন্ট্রি দেয়ার কথা খেয়াল হলো বিজ্ঞানীর। ‘এটা ইউরেনিয়ামের একটা বল, ওপরটা পাতলা সীসা দিয়ে মোড়া।’
সবগুলো কমপোনেন্টের ওপর নজর বুলিয়ে সন্তুষ্ট হলো নিউক্লিয়ার সাইনটিস্ট। এবার স্টীলের ফাইলিং কেবিনেট নিয়ে পড়ল সে। ওটাকে মেঝের ওপর শুইয়ে দরজা হাট করে খুলে রাখল। তারপর খুদে কড়িকাঠ ও ব্যাটন দিয়ে ওটার ভেতরে একটা ইনার ফ্রেম তৈরি করল। ফ্রেমটা মুড়ে দিল সে পুরু শক্-অ্যাবজরবেন্ট ফোম রাবার দিয়ে।
‘দু’পাশে এবং ওপরেও ফোম জুড়বার ব্যবস্থা করতে হবে পরে, ‘ ব্যাখ্যা করল সেমিয়ানভ। বোমা ভেতরে সেট করার পর।’
ব্যাটারি চারটে পাশাপাশি সাজিয়ে একটার সঙ্গে অন্যটার টার্মিনাল পেঁচিয়ে লাগাতে আরম্ভ করল এবার লোকটা। তারপর মাস্কিং টেপ দিয়ে সবগুলো ব্যাটারি গায়ে গায়ে লাগিয়ে শক্ত করে আটকে দিল যাতে একটা অন্যটা থেকে আলাদা হতে না পারে। ড্রিল মেশিন দিয়ে কেবিনেটের দরজায় চারটে ছিদ্র করল সে। তারপর দরজার ভেতরদিকে ব্যাটারি ব্লকটা ঠেকিয়ে ফুটোর মধ্যে দিয়ে তার কয়েকবার করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জুড়ে দিল ওটা দরজার সঙ্গে। তখন মাঝ দুপুর।
‘নিউক্লিয়ার বোমা দেখেছেন কখনও?’ প্রশ্ন করল সেমিয়ানভ।
‘না,’ ফ্যাসফেঁসে শোনাল তাতায়েভের কণ্ঠ। আন-আর্মড কমব্যাটে সে একজন এক্সপার্ট। পিস্তল-ছুরি চালনাতেও ‘এ’ ক্লাস সার্টিফিকেট রয়েছে তার। কিন্তু এই মাঠে একেবারেই আনাড়ি। একটা ছোটখাট শহর উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে যে জিনিসগুলো, তা নিয়ে সেমিয়ানভ ঠাণ্ডা মাথায় যে-সব কাণ্ড করছে, দেখে গলা শুকিয়ে এসেছে তার।
‘এক সময় ছিল, যখন এ কাজ ছিল খুবই কঠিন। খুব অল্প শক্তির নিউক্লিয়ার বোমাও আকারে বিশাল হত। ল্যাবরেটরির সাহায্য ছাড়া তৈরি করার কথা ভাবাও যেত না। কিন্তু সে দিন আর নেই। একটা বেসিক অ্যাটমিক বোমা আজকাল একটা ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর বসেও তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজনীয় কমপোনেন্ট, একটু সতর্কতা, আর নোহাউ, এই তিনটে হলেই হলো।’
‘তাই তো দেখছি,’ ঢোক গিলল তাতায়েভ।
ইউরেনিয়াম বলের ওপরকার পাতলা সীসার আবরণ কেটে ফেলল সেমিয়ানভ। আসল জিনিসের ওপর চোখ বোলাল। বলটা পাঁচ ইঞ্চি ডায়ার। ঠিক মধ্যিখানে দুই ইঞ্চি ডায়ার এক ফুটো, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। একদিকে চার-পাঁচটা হালকা গর্ত আছে বলটার গায়ে।
‘এর কি কাজ জানতে চান?
‘হ্যাঁ।’
বোমার সুইচ অন করা হলে এটা ফিজ করতে আরম্ভ করে। কোল্ড ড্রিঙ্কস্ বা শ্যাম্পেন গ্লাসে ঢালার পর যেমন মৃদু হিস্ হিস্ আওয়াজ ওঠে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনি। আপনাকে বোঝাবার জন্যে বলছি, শব্দ কিন্তু আসলে হয় না। ফিজ করে ঠিকই, তবে সেটা রেডিওঅ্যাকটিভ টার্মে। ওই ফিজ গিয়ে আঘাত করে ডেটোনেটরে,’ মেজরকে ঠোঁট চাটতে দেখে দ্রুত যোগ করল সেমিয়ানভ, ‘না, এখনই তেমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। পুরোটা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ভয়ের কিছু নেই।
‘গ্রেট।’
‘এই যে এটা,’ ফায়ার এক্সটিংগুইশার থেকে বের করা পাঁচ ইঞ্চি লম্বা রডটা তুলে নিল বিজ্ঞানী। ‘বলের এই ফুটো দিয়ে যখন ঢুকিয়ে দেয়া হবে এই রড, তখন ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে পৌঁছবে জিনিসটা। ওই যে দেড় ফুট লম্বা টিউব, বন্দুকের নলের মত, ওর ভেতর দিয়ে বুলেটের বেগে ছুটবে এই রডটা। যখন….
‘বুম!’ সমঝদারের মত মাথা দোলাল ভ্যালেরি তাতায়েভ।
ঠোঁট মুড়ে হাসল সেমিয়ানভ। ‘নট কোয়াইট। বুম হবে, তবে যখন ইনিশিয়েটর সেট করা থাকবে তখন। ওই যে লিথিয়াম আ র পলোনিয়ামের দুই ডিস্ক, ও দুটোই হলো সেই জিনিস। দুটো আলাদা আলাদা যতক্ষণ আছে, চিন্তা নেই। কিন্তু এক হলেই বদ কম্মটি ঘটিয়ে বসবে। রিঅ্যাকশন ঘটতে শুরু করবে। ঝড়ের বেগে নিউট্রন ছড়াতে শুরু করবে ওরা। এবং এই ইউরেনিয়াম বল ও টিউব অবিশ্বাস্য শক্তিতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে নিজেদের। অ্যাণ্ড দ্যাট উইল টেক ওয়ান হান্ড্রেড মিলিয়নথ্ অভ আ সেকেণ্ড।
‘বুঝলাম না। আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে দিন।’
‘বেশ।’ মুখ দেখে মনে হলো ওস্তাদি দেখাবার সুযোগ পেয়ে খুশিই হয়েছে নিউক্লিয়ার সাইনটিস্ট। ‘দেখতে থাকুন।’
পলোনিয়াম ডিস্কটার এক পিঠে এক ফোঁটা সুপারগ্লু লাগাল বিজ্ঞানী, তারপর জুতোর হিল থেকে সংগৃহীত খাঁজ কাটা স্টীল ডিস্কের সঙ্গে জুড়ে দিল ওটা। পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লেগে গেল ডিস্ক দুটো। এবার পলোনিয়াম চাকতিটা ভেতর দিকে রেখে দুই হেড ল্যাম্প বাউলের মধ্যে যেটার প্যাচ কাটা ফুটো আছে পিছনে, সেটার সঙ্গে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে টাইট করে লাগিয়ে দিল সে স্টীল ডিস্ক। এরপর বাউলটা চিত করে ইউরেনিয়াম বলটা রাখল তার পেটের ভেতর। পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকল পলোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম।
বাউলের ভেতরে চার-পাঁচটা খুদে ঢিপিমত আছে। বলের গর্তগুলোর মধ্যে ঢুকে গেল ঢিপিগুলো নিখুঁতভাবে। একচুলও নড়ছে না এখন বল। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে বলের ছিদ্র দিয়ে তলার দিকটা দেখল বিজ্ঞানী। বলের দুই ইঞ্চি ডায়া ছিদ্রের সঙ্গে তলায় বসানো দুই ইঞ্চি ডায়ার পলোনিয়াম ডিস্কটা একদম মুখে মুখে সেট হয়েছে।
এবার অন্য বাউলটা তার ওপর উপুড় করে বসাল সেমিয়ানভ। একটা গোলকের আকার পেয়েছে এখন বাউলজোড়া। ষোলোটা নাট-বোল্ট জুড়ে বাউল দুটো যুক্ত করল সে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজটা সারতে হলো তাকে। সময় ব্যয় হলো পুরো এক ঘণ্টা।
‘এইবার বন্দুক,’ মন্তব্য করল বিজ্ঞানী।
দেড় ফুটি টিউবটা তুলে নিল সে। দলা পাকানো আধ পাউণ্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ঢুকিয়ে দিল ভেতরে খোলা মুখ দিয়ে। কিচেন থেকে লম্বা হাতলওয়ালা একটা ঝাড়ু আনাল সে তাতায়েভকে দিয়ে, ওটার হাতল দিয়ে তলার দিকে যতটা যায়, চেপে চেপে, ঠেসে ঢোকানো হলো বলটা। তারপর টর্চ জ্বেলে ভেতরটা দেখল আবার সেমিয়ানভ। মাথা দোলাল, সন্তুষ্ট হয়ে।
এবার সুপারগ্লুর সাহায্যে পাঁচ ইঞ্চি ইউরেনিয়াম রডের এক মাথায় দ্বিতীয় জুতো থেকে পাওয়া লিথিয়াম ডিস্কটি সাঁটিয়ে দিল সে শক্ত করে। শক্ অ্যাবজরবিঙ টিস্যু দিয়ে খুব ভাল করে মুড়ে নিল ও দুটো, তারপর ডিস্ক নিচের দিকে রেখে রডটা সেঁধিয়ে দিল টিউবে, ঝাড়ুর হাতল দিয়ে ঠেসে তলায় বসানো প্লাস্টিকের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিল লিথিয়াম ডিস্ক। টিস্যু দিয়ে মোড়া হলো যাতে ভাইব্রেশনের ফলে পিছলে সামনে চলে আসতে না পারে ওটা। সংযোগটা মজবুত করার জন্যে আরও খানিক চাপাচাপি করা হলো জিনিসটা হাতল দিয়ে। একসময় সন্তুষ্ট হলো বিজ্ঞানী, দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়েছে ও দুটো।
এবার যে বাউলটির পিছনদিকটায় প্যাঁচ কাটা দুই ইঞ্চি রডমত আছে, টিউবের উন্মুক্ত প্রান্তের ভেতরের থ্রেডের সঙ্গে যতদূর সম্ভব শক্ত করে আটকে দেয়া হলো সেদিকটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। জিনিসটা দেখতে হলো একটা ব্যাটনের মাথায় সাত ইঞ্চি ব্যাসের একটা বল বসিয়ে প্রস্তুত অর্থহীন কিছু একটার মত। বা বড় আকারের স্টিক গ্রেনেডের মত।
‘হয়ে এসেছে প্রায়,’ বলল সেমিয়ানভ। ‘বাকিটুকু সেরে নিয়ে বলছি।’ সরু শিশির মত দেখতে কাঁচের ডেটোনেটরটা তুলে নিল সে এবার। এক মাথা দিয়ে বেরিয়ে থাকা রঙিন তার দুটো নিরাপত্তার খাতিরে টেনে সরিয়ে দিল দু’দিকে। ফাইভ এএমপি ফ্লেক্সের রোল থেকে এক ফুট আকারের দুটো খণ্ড বের করে কালার কোড অনুযায়ী ডেটোনেটরের দুই তারের সঙ্গে ওগুলোর এক প্রান্ত করে জুড়ে দিল সে। জোড়া দুটো মাস্কিং টেপ দিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে মুড়ে ফেলল সেমিয়ানভ।
বেখেয়ালে কাজের সময় যদি একটা অন্যটার ছোঁয়া পায়, প্রিম্যাচিওর ডেটোনেশন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এবার টিউবের সীলড তলার মাঝখানে যে ছোট ছিদ্র, ওটা দিয়ে ডেটোনেটরের কোঁচকানো, সুচোল মাথাটা আলতো করে ঢুকিয়ে দিল বিজ্ঞানী। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে মৃদু মৃদু চাপ দিতে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ভেতরে ঢুকে গেল ওর প্রান্ত। পরখ করে দেখল সেমিয়ানভ, ঠিকমতই বিঁধেছে। নড়াচড়া করছে না।
আস্ত বোমাটা আলগোছে কেবিনেটের ভেতরে প্যাডের বিছানায় শুইয়ে দিল এবার লোকটা। আরও এক ফুট ফ্লেক্স কাটল সে কয়েল থেকে। ওটার এক মাথা ব্যাটারি ব্লকের পজিটিভ টার্মিন্যালের সঙ্গে আটকে টেপ পেঁচিয়ে দিল। অন্য মাথা পড়ে থাকল পাশে, পরে কাজে লাগবে। ডেটোনেটরের দুই তার দু’হাতে তুলে তাতায়েভের দিকে তাকাল নিউক্লিয়ার সাইনটিস্ট। দাড়ির ফাঁকে মধুর হাসি। ‘এখন,’ বলল সে, ‘যদি এই দুটি তার ওপরের আবরণ কেটে ফেলার পর কোনমতে এক হয়, দ্যাট উইল স্পেল ব্যাড নিউজ। এই যে ডেটোনেটর, এটা অ্যাকটিভেট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভটুকু ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। এই উত্তাপ প্রথমে লিথিয়ামকে এবং লিথিয়াম ইউরেনিয়াম রডটিকে ওপরদিকে সজোরে ঠেলে দেবে। ফিজ শুরু হয়ে যাবে তার আগেই।
‘এই দুই শক্তি টিউবের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে টিউবের মাথার ফুটো গলে ঢুকে পড়বে এই বলের ভেতর, এবং প্রচণ্ড শক্তিতে নিজেদের একসঙ্গে বিস্ফোরিত করবে ওরা সবাই। দ্যাট’স ইট।’
টাইমার ডিভাইসে হাত লাগায়নি এখনও সেমিয়াভ। পাশেই সঙ্গীহীন পড়ে আছে ওটা। হাই-স্পীড ড্রিল মেশিনের সাহায্যে ফাইলিং কেবিনেটের দরজায় আরও পাঁচটা ফুটো করল সে। চার কোণে চারটে, মাঝখানে একটা। ডেটোনেটরের সঙ্গে লাগানো ফ্লেক্সের একটা ব্যাটারি ব্লকের নেগেটিভ টার্মিন্যালে জুড়ল এবার বিজ্ঞানী। তারপর পজিটিভ টার্মিন্যালে আগেই লাগানো ফ্লেক্সের এক মাথা এবং ডেটোনেটরের অন্য ফ্লেক্সটির মাথা মাঝখানের ফুটোটা গলিয়ে দরজার বাইরে নিয়ে এল।
এরপর ঝাঁকি বা দুলুনিতে বোমা যাতে নড়াচড়া করতে না পারে, সেজন্যে ওটার চারদিকে আচ্ছা করে ফোম ইনসুলিশন চাপাল সেমিয়ানভ, একেবারে ভরে ফেলল খুদে কেবিনেট। টাইমার ডিভাইসটা চার ফুটোয় চারটে স্ক্রু বসিয়ে ফিট্ করল সে আস্তে ধীরে। ভাল করে কষে প্যাচ এঁটে দিল। টেনেটুনে দেখল বেশ মজবুত হয়েছে সংযোগটা। এবার কালার কোড মিলিয়ে টাইমারের সঙ্গে ফ্লেক্স দুটো জুড়ে দিল লোকটা। তাতায়েভের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার শব্দে হেসে অভয় দিয়ে বলল সে, ‘ভয়ের কিচ্ছু নেই। এই টাইমার পাঠানোর আগে বহুবার চেক্ করে দেখা হয়েছে। কাটআউট বা সার্কিট-ব্রেকারে কোন খুঁত নেই এর।’
টাইমার-ফ্লেক্সের সংযোগ প্রচুর টেপ খরচ করে জোড়া লাগাল বিজ্ঞানী। কেবিনেটের দরজা বন্ধ করে তালা লাগাল। এবং সবশেষে চাবিটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল টোকা মেরে। ‘হিয়ার ইট ইজ, ক্যাচ!’
ফোঁস করে চেপে রাখা দম ছাড়ল ভ্যালেরি তাতাঁয়েভ। লুফে নিল চাবিটা, চালান করে দিল ট্রাউজারের পকেটে।
‘সো, কমরেড ফ্ল্যানারি, আমার কর্তব্য শেষ। ট্রলিতে বসিয়ে কেবিনেটটা যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন, বোমার কোন ক্ষতি হবে না তাতে। চাইলে গাড়িতে উঠিয়ে লম্বা একটা ড্রাইভ দিয়েও আসতে পারেন, তাতেও কিছু আসবে যাবে না। আর এই যে,’ টাইমারের হলুদ সুইচটা দেখাল সেমিয়ানভ। ‘এটা পুশ করলে শুরু হয়ে যাবে কাজ। তবে ইলেকট্রিক সার্কিট পুরো হতে দু’ঘণ্টা লাগবে এটার ক্ষেত্রে। কারণ সে ভাবেই সেট করা হয়েছে ডিভাইস। আপনার জন্যে। এই সময়ের মধ্যে যাতে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারেন আপনি, সেই জন্যে। ঠিক দু’ঘণ্টা পর ফাটরে বোমা।
‘আর লালটা ম্যানুয়াল ওভাররাইড। তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যে।’
নিউক্লিয়ার সাইন্টিস্টের জানা নেই যে কথাটা আদৌ সত্যি নয়। তাকে যা বলা হয়েছে, তাই সে বলে গেছে। আসলে হলুদে আর লালে কোন তফাৎ নেই, দুটোই ম্যানুয়াল ওভাররাইড—সেট করা হয়েছে তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণের জন্যে।
আঁধার হয়ে গেছে বাইরে। আলো জ্বেলে দিল তাতায়েভ। অপ্রয়োজনীয় সবকিছু গারবেজ ব্যাগে ভরে ফেলেছে ততক্ষণে বিজ্ঞানী ‘এবার পেটে কিছু না দিলেই নয়, কমরেড,’ বলল সে। ‘সঙ্গে দু’চার পেগ হুইস্কি হলে ভাল হয়। তারপর লম্বা ঘুম দিয়ে সকালে ফিরতি পথ ধরতে চাই।’
‘নিশ্চই নিশ্চই।’
পরদিন সকালে সেমিয়ানভকে নিয়ে হিথ্রো রওনা হলো ভ্যালেরি তাতায়েভ। কলচেস্টারের দক্ষিণ পশ্চিমের এক ঘন বন অতিক্রম করার সময় পথের পাশে সেলুন দাঁড় করাল মেজর। তলপেটের ভার মুক্ত না করে পারা যাচ্ছে না। বনের ভেতর ঢুকল সে কাজ সারতে। কয়েক মুহূর্ত পর তার চাপা কণ্ঠের আর্ত চিৎকারে চমকে উঠল সেমিয়ানভ, গাড়ি থেকে নেমেই তীরবেগে ছুটল আওয়াজ লক্ষ্য করে।
মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বুঝল বোকা বিজ্ঞানী, কি ভুল সে করেছে। ঘাড়ের ওপর কারাতের ভয়ঙ্কর এক কোপ খেয়ে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল লোকটা। মৃত্যু হয়েছে তার দেহ মাটি স্পর্শ করার আগেই। মৃতদেহটা টেনে খানিকটা গভীরে নিয়ে গেল তাতায়েভ। খুলে ফেলল পরনের কাপড়- চোপড়। একটা গর্তে ফেলে ডালপালা দিয়ে লাশটা ঢেকে ফেলল সে।
এমনিতে জানাজানির চান্স নেই। তবে পচে গন্ধ ছড়ালে খোঁজ পড়বে। তাতে চার-পাঁচদিন, এমনকি পুরো এক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। তারপর পুলিস এনকোয়ারি হবে নিশ্চয়ই, হয়তো স্থানীয় পত্র- পত্রিকায় সেমিয়ানভের ছবিও ছাপা হবে। ফোলা মুখের সে চেহারা মনে হয় না চিনতে পারবে তাতায়েভের প্রতিবেশি ডানকান রস।
আর চিনতে পারলেই বা কি? সে তো তার অনেক আগেই হাওয়া হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে আরও কয়েকটা ডাল ভেঙে এনে ফেলল সে স্তূপের ওপর। তারপর বিজ্ঞানীর শার্ট-ট্রাউজার ইত্যাদি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ বের করে তাতে ভরল মেজর। ওগুলোয় লোকটার পরিচয় লেখা নেই বটে, তবে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে ওসব রাশিয়ায় তৈরি।
বেন্টওয়াটার্সের ধারেকাছে তাই এ জিনিস সে আবিষ্কৃত হতে দিতে পারে না। সেলুন ঘুরিয়ে ইপসউইচ ফিরে যেতে যেতে ভাবল তাতায়েভ, গারবেজ ব্যাগের সঙ্গে এগুলোরও একটা বিহিত করতে হবে তাকে আজ রাতেই। বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে হয়েছে বলে মনে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই ভ্যালেরি তাতায়েভের! লোকটার বিহিত করার ব্যাপারে মস্কোর নির্দেশই কেবল সে পালন করেছে, অন্য সব নির্দেশের মত। লোকটা কি করে ভাবল যে দেশে ফিরে যেতে পারবে সে, মাথায় এল না মেজরের।
অন্য সমস্যা নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করল তাতায়েভ। এর মধ্যে রেনডলেসহ্যাম ফরেস্ট ঘুরে এসেছে সে দু’-দু’বার। স্পট ঠিক করে রেখে এসেছে। জায়গাটা বিমান ঘাঁটির পেরিমিটার ফেন্সের মাত্র একশো গজ তফাতে। ভোর চারটেয় ট্রলি নিয়ে পৌঁছবে সে জায়গামত, টেরটিও পাবে না কেউ। তারপর হলুদ বোতামটা টিপে দিয়ে বিজ্ঞানীর মতই তার কর্মটিকেও ভালমত ডালপালা দিয়ে আড়াল করে রেখে প্রাণপণে গাড়ি হাঁকাবে লণ্ডনের উদ্দেশে।
এ সব জানা আছে কেজিবির তুখোড় ইললিগ্যালস ভ্যালেরি তাতায়েভের। কেবল জানা নেই কোন দিন বোমা ফাটাতে হবে। ওটা তাকে জেনে নিতে হবে। সব প্রস্তুত, কাজেই আজই তাকে স্কোয়ার্ট মেসেজ ট্র্যান্সমিট করতে হবে। তারপর প্রতিরাতে রেডিও মস্কো থেকে প্রচারিত ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠান, বিশেষ করে রাত দশটার খবরের প্রথম নিউজ আইটেমটা শুনতে হবে তাকে। খবর-পাঠকই জানাবে তাকে কবে কাজটা করতে হবে। প্রথম আইটেম পাঠ করার শুরুতেই ইচ্ছেকৃত একটা ভুল করবে সে। ওটাই তার সঙ্কেত। ওই রাতেই ঝামেলা শেষ করে ভাগবে মেজর প্রাণ নিয়ে। আজই শেষ স্কোয়ার্ট পাঠাবে সে। আর প্রয়োজন পড়বে না। তারপর পপলার ট্র্যান্সমিটারের স্লীপার পাহারাদারের ব্যবস্থা। সে ব্যাপারে ও পরিষ্কার নির্দেশ আছে মস্কোর। ভবিষ্যতে ওদের আর প্রয়োজন পড়বে না কোনদিনও। সন্ধের একটু পর চেরিহে’জ ক্লোজ ত্যাগ করল তাতায়েভ। থেটফোর্ডে পৌঁছল রাত ন’টার দিকে।
সেলুন গ্যারেজে রেখে পরনের কাপড়ের ওপরই লেদার জ্যাকেট- ট্রাউজার পরল সে। তারওপর চাপাল রেইনকোট। পায়ে দিল জ্যাকবুট। সবশেষে ভাইজরড্ হেলমেট। বিএমডব্লিউ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। রওনা হলো উত্তর-পশ্চিমে, ব্রিটিশ মিডল্যাণ্ডের দিকে।