অন্ধ শিকারী – ২.১

এক

বিপজ্জনক! অন্যমনস্কের মত মাথা দোলালেন ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিচ বরিসভ, অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন জেনারেল সেক্রেটারি। উল্টোপাল্টা কিছু ঘটে গেলে অকল্পনীয় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে। পুরো পৃথিবী তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যবশত, তেমন মুহূর্ত যদি উপস্থিত হয়, নিজ বলয়ের বন্ধু দেশগুলোর সহানুভূতিও পাবে না সোভিয়েত ইউনিয়ন। মুখ ঘুরিয়ে নেবে সবাই, কারণ এ কাজে হাত দেয়ার আগে তাদের জানানোই হয়নি।

তাদের কথা না হয় বাদ, ভাবছেন বরিসভ, কেজিবিকে পর্যন্ত সামান্য আভার্স দেয়া হলো না, এ কী আজব কথা! গ্রু আছে, কেজিবি নেই! কেউ কখনও শুনেছে এমন ছন্নছাড়া অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কথা?

যদিও বরিসভ জানেন, রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে যে- কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার জেনারেল সেক্রেটারির রয়েছে। গোটা বিশ্বকে যে-কোন মুহূর্তে পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন তিনি, বরিসভ একশোবার স্বীকার করেন। কিন্তু সে জন্যে ক্ষেত্র তো চাই! কি, না, লেবার পার্টিকে জেতাবার জন্যে দেড় মেগাটন ক্ষমতাসম্পন্ন একটা নিউক্লিয়ার বোমা ফাটাতে চলেছেন তিনি ব্রিটেনের কলজের মধ্যে পাগলামিরও তো একটা সীমা আছে।

দু’হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভাল করে দু’চোখ রগড়ালেন বরিসভ। কাল সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। দুই চোখের ধারেকাছেও আসেনি ঘুম। বিছানায় ছটফট করে কেটেছে তাঁর। প্রথমে ক্রোধ, পরে বিস্ময় এবং সবশেষে অজানা এক ভয় চেপে বসেছে ভেতরে একটু একটু করে। ডক্টর পাভলভের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর থেকেই সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে আছেন জেনারেল কি হয় কি হয় ভেবে।

ড্রয়ার থেকে একটা মাইক্রো ক্যাসেট রেকর্ডার বের করলেন তিনি কাল জিনিসটা পোর্ট ফোলিওর ভেতরে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ড. পাভলভের বাসায়। প্ল্যান অরোরা সম্পর্কে কায়দা করে ডক্টরের পুরো বক্তব্য রেকর্ড করে এনেছেন। কাল বাসায় ফিরে এবং আজ অফিসে এসে অসংখ্যবার বাজিয়ে শুনেছেন তাঁদের দু’জনের কথোপকথন। তবু যেন আশ মেটে না। বারবার শুনতে মন চায়।

ফিতে পুরোটা পিছিয়ে আনলেন জেনারেল, তারপর ভল্যুম ফুল করে ‘প্লে’ বোতাম টিপে দিলেন।

‘…শুরু হয়েছে মাস দুয়েক আগে,’ ড. পাভলভের গলা শোনা গেল।’আমরা কেউ এ ব্যাপারে জানতাম না কিছুই। জেনারেল সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কো এর হোতা। গত গ্রীষ্মে নিজের সামার রিট্রিটে ছুটি কাটানোর সময়, ব্রিটেনের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের পরাজিত করে লেবার পার্টিকে কী উপায়ে ক্ষমতায় আনা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত এক রিপোর্ট তৈরি করেন তিনি। এবং ছুটি শেষে মস্কো ফিরে সেটা সাবমিট করেন কমরেড জেনারেল সেক্রেটারির সামনে। ওতে জেনারেল দাবি করেন, ব্রিটিশ লেবার পার্টির ভেতরকার হার্ড লেফট উইঙ, অর্থাৎ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ক্যাডারের সহযোগিতায় কাজটা প্রায় অনায়াসেই করা সম্ভব।’’কি ভাবে?’ জেনারেল বরিসভের প্রশ্ন ‘বলতে দিন।’

‘শিওর।’

‘জেনারেলের মত, যদিও আমরাও তাই মনে করি, নির্বাচনে লেবার পার্টি জয়ী হবে এবং পার্টি প্রধান নীল কিনকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করবে। এর ঠিক পরপরই শুরু হবে জেনারেল মার্চেঙ্কোর প্রার্থিত ‘খেলা’। জেনারেল, আপনার মনে আছে, ১৯৮১ সালের ৭ মে বৃহত্তর লণ্ডন কাউন্সিল নির্বাচনের মাত্র ষোলো ঘণ্টা পর কি ঘটেছিল?’

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। ‘না, কমরেড। মনে করিয়ে দিলে বাধিত হব।’

‘ওয়েল। স্যার হোরেস কাটলারের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি ছিল তখন গ্রেটার লণ্ডন কাউন্সিল বা জিএলসি’র নেতৃত্বে। সেদিনের নির্বাচনে অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা অ্যান্ড্রু ম্যাকিনটোশের লেবার পার্টি জয়ী হয়।.এই বিজয়ের ষোলো ঘণ্টা পর, মাইণ্ড ইট, মাস নয়, সপ্তা নয়, এমন কি একটি দিনও পুরো হওয়ার সুযোগ হয়নি, মাত্র ষোলো ঘণ্টা পর পার্টি গভর্নিং কমিটির এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সিদ্ধান্তে দলীয় প্রধানের পদটি হারাতে হয় ম্যাকিনটোশকে। সে পদে বসানো হয় কেন লিভিংস্টোন নামে এক কট্টর বামপন্থী অ্যাকটিভিস্টকে। এর আগে পাঁচ শতাংশ সাধারণ লণ্ডনবাসীও যার নাম পর্যন্ত শোনেনি জীবনে কোনদিন। অবশ্য খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে কেন লিভিংস্টোনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ম্যাকিনটোশ। ওটা ছিল ব্রিটিশ মার্কস-লেনিনপন্থীদের শতাব্দীর সেরা বিজয়।

‘রাজনীতিক হিসেবে কেন লিভিংস্টোন ছিলেন সাংঘাতিক চৌকস। জনগণ না চিনলেও দলের প্রত্যেকে খুব ভাল করেই চিনত তাঁকে। খুব অল্প বয়সে মার্কস এবং লেনিনবাদে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। পার্টির প্রাথমিক সদস্য পদ পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বড় নেতাদের নজর পড়ে তাঁর ওপর। কারণ লিভিংস্টোন সেই ধরনের রাজনীতিক, যাঁর চব্বিশ ঘণ্টার ধ্যান-জ্ঞানই ছিল রাজনীতি। লেবার পার্টির কোন সভায় লিভিংস্টোন উপস্থিত নেই বা ছিলেন না, এমন অভিযোগ তাঁর চরম শত্রুও করতে পারবে না। তা সে যতই গুরুত্বহীন বৈঠক হোক না কেন।

‘সে যা-ই হোক। জিএলসি প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর লিভিংস্টোন কাউন্টি হলকে মার্কস-লেনিনপন্থীদের স্প্রিংবোর্ড হিসেবে গড়ে তোলেন। যা-তা কথা নয়, কমরেড জেনারেল। গ্রেটার লণ্ডনের জনসংখ্যা এখন এগারো মিলিয়ন। সারা দেশের জনসংখ্যার প্রায় বিশ শতাংশ। যা লিখটেনস্টেইন বা লুক্সেমবুর্গের মত মিনি স্টেটের জনসংখ্যার চাইতেও বেশি। আর লণ্ডন শহরের বাজেট? জাতিসংঘের আশিটি সদস্য দেশের মিলিত বাৎসরিক বাজেটের চাইতেও বেশি।’

‘আমরা বোধহয় আসল বক্তব্য থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি, কমরেড,’ জেনারেল বরিসভের কণ্ঠে ধৈর্যের অভাব ঘটার আবছা ইঙ্গিত।

‘হ্যাঁ। খানিকটা। আসন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টি কী করে বিজয়ী হবে, সে কথায় একটু পরে আসছি। আগে শুনুন পরে কি ঘটবে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর অ্যান্ড্রু ম্যাকিনটোশের মতই পাৰ্টি প্রধানের পদটি হারাবেন বর্তমান নেতা নিল কিনক। সেই একই উপায়ে পদচ্যুত করা হবে কিনককে। তাঁর জায়গায় বসানো হবে এক কট্টর মস্কোপন্থী, আই মীন, হার্ড লেফটিস্টকে।’

‘কি নাম তার?’

‘দুঃখিত। জানা নেই আমার।’

‘শুনে মনে হয় জেনারেল মার্চেঙ্কোই সব করেছেন। তাহলে আপনারা তিনজন কেন এর মধ্যে?’কমরেড জেনারেলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন আমাদের কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। তাঁর নির্দেশ ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারার, সেই অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হয়েছে।

‘এক পাখি নিশ্চয়ই কনজারভেটিভ পার্টি?’

‘হ্যাঁ।’

‘অন্যটা?’

‘ইংল্যাণ্ডের মাটি থেকে সব ধরনের মার্কিন সামরিক স্থাপনা তুলে নিতে ওয়াশিংটনকে বাধ্য করা। অবশ্যই ব্রিটিশ জনমতের চাপে।’

‘কি রকম?’

‘নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকেই এসব স্থাপনার ক্ষতিকারক দিক এবং সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে জনসাধারণের মনে ভয় ভীতি ঢোকানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে লেবার পার্টির হার্ড লেফট উইঙ। ন্যাটো নিয়ন্ত্রিত ও দেশে মার্কিন এবং ইঙ্গ-মার্কিন যতগুলো সামরিক ঘাঁটি আছে, সবগুলোতেই পারমাণবিক বোমা, মিজাইল মজুত আছে। ওগুলো নিয়েই ভয়-ভীতি ছড়ানো হচ্ছে তাদের মধ্যে। যে কোন সময় ওর যে কোন একটায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যা হবে চেরনোবিল দুর্ঘটনার চাইতেও ভয়ঙ্কর, তাতে হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এই সমস্ত বলে আর কি! সেই সঙ্গে তাদের বোঝানো হচ্ছে, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে আমেরিকানদের সঙ্গে সব সামরিক সহযোগিতা চুক্তি বাতিল করে দেয়া হবে, ন্যাটোর সব ঘাঁটি তুলে দেয়া হবে ইংল্যাণ্ডের মাটি থেকে।

‘ওঁদের ভীতির আগুনে ঘি ঢালার আয়োজন করা হয়েছে। নির্বাচনের সপ্তাখানেক আগে সত্যি সত্যি ছোটখাট একটা পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটবে এক মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে।’’এ পরামর্শটা কার?’ এই জায়গায় সিধে হয়ে গিয়েছিলেন জেনারেল বরিসভ। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিলেন ড. পাভলভের দিকে।

‘কমরেড জেনারেল মার্চেঙ্কোর।’

‘কি করে ঘটবে আপনাদের সো কলড় দুর্ঘটনা?’

‘একজন টপ্‌ ক্লাস সোভিয়েত এজেন্ট ইনফিলট্রেট করবে ইংল্যাণ্ডে। তার হাতে বিভিন্ন দিক থেকে নয়টা নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়া হবে। ওগুলো জুড়ে বোমা তৈরি করা হবে, তারপর বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। কাজটা এমনভাবে করা হবে, যাতে সবাই পরিষ্কার বোঝে যে ওটা দুর্ঘটনাই, এবং মার্কিনীদের অসাবধানতার জন্যেই ঘটেছে। সাফোকের বেন্টওয়াটার্সে মার্কিনীদের এফ-ফাইভ স্ট্রাইক বিমান ঘাঁটিটি বেছে নেয়া হয়েছে এ জন্যে। বেশ কিছু ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ডিভাইস মোতায়েন আছে ওখানে। সম্ভাব্য সোভিয়েত সামরিক হুমকি মোকাবেলার জন্যে।’

কত কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা ফাটানো হবে?’

‘বেশি না, দেড় কিলোটন। বড় বোমা হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে প্রচুর, তাতে নির্বাচনই পিছিয়ে যাবে। এই দুর্ঘটনার পর লেবার এমপিদের আর ভোট চাইতে হবে না, কম করেও আশি পার্সেন্ট ভোট পাবে তারা। আরও আছে। জানা কথা, এ ব্যাপারে মার্কিন প্রতিক্রিয়া হবে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত। সরাসরি অস্বীকার করবে তারা যে এ দুর্ঘটনার জন্যে তারা দায়ী নয়। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এর পরদিন কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি রেডিও-টিভিতে ভাষণ দেবেন। তাতে বিশ্বাবাসীকে জানানো হবে আমেরিকানরা উন্মাদ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সোভিয়েত ফোর্সেসের জন্যে রেড অ্যালার্ট ঘোষণা করা ছাড়া তাঁর কোন বিকল্প নেই।

‘ওই দিনই লণ্ডনের সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত স্বয়ং মিস্টার নিল কিনককে মস্কো সফরে যাওয়ার আহব্বান জানাবেন। অনুরোধ করবেন তিনি যেন কমরেড জেনারেল সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ জটিলতা নিয়ে আলোচনা করেন, মানবতার স্বার্থে শান্তি প্রার্থনা করেন। ভোট নিজের পক্ষে টানতে হলে কিনকেরও কোন বিকল্প থাকবে না এ ছাড়া। আর আমাদের বিশ্বাস, ওয়ার্ল্ড প্রেসের হাজারো রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার আর টিভি ক্যামেরার সামনে তাকে মস্কো যেতে বাধা দেয়ার কথা ভুলেও চিন্তা করবে না কনজারভেটিভরা।

‘কয়েক মিনিটের মধ্যে কিনকের ভিসা তৈরি হয়ে যাবে। পরদিন সকালে অ্যারোফ্লোটের বিশেষ রিমানে মস্কো যাবেন কিনক। কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি তাঁকে রিসিভ করবেন, দু’জনে বৈঠক করবেন। তারপর ফিরে আসবেন কিনক। তাঁর বিমান হিথ্রো ল্যাণ্ড করার আগেই আবার রেডিও-টিভিতে ভাষণ দেবেন কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। জানাবেন, ব্রিটিশ লেবার পার্টি প্রধানের আবেদনে সাড়া দিয়ে আর্মর্ড ফোর্সেসকে গ্রীন স্ট্যাটাসে প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

‘এরপর, ভোটের আগের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন নিল কিনক। ঘোষণা করবেন, তাঁর পার্টি নির্বাচিত হলে শান্তির উদ্দেশ্য ছাড়া কোনরকম সামরিক উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে নিষিদ্ধ করে দেয়া হবে। ওদিকে, সবার ধারণা, এই ক’দিনে ব্রিটেন আর আমেরিকার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী খান খান হয়ে যাবে। বাধ্য হয়েই সমস্ত সামরিক ঘাঁটি প্রত্যাহার করতে হবে ওয়াশিংটনকে। অন্য সব পশ্চিম ইউরোপীয় দেশেও একই দুর্গতি ঘটবে তার, মৈত্রীর বন্ধন ছিঁড়ে পালিয়ে আসার পথ পাবে না ওরা।’

‘তারপর?’ জেনারেল বরিসভের থমথমে কন্ঠের প্রশ্ন।

‘তারপর নির্বাচনে বিজয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পার্টির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কিনককে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। বসানো হবে এক হার্ড লেফটিস্টকে। গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম মার্কস-লেনিনবাদী প্রধানমন্ত্রী হবে সে।’

‘উদ্দেশ্য?’

‘ক্রমান্বয়ে সামরিক দিক থেকে ব্রিটেনকে নির্জীব করা। তারপর একে একে আর সব পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকেও। এসব পরিকল্পনা অনেক আগেই সেরে ফেলেছেন জেনারেল মার্চেঙ্কো। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে, গোটা পাঁচেক পদক্ষেপ নেবে লেবার পার্টি। যার মধ্যে আছে, যত বাধ্যবাধকতাই থাকুক, সব চুক্তি বাতিল করে ইইসি থেকে ব্রিটেনের প্রত্যাহার। অনতিবিলম্বে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর আকার এক পঞ্চমাংশে নামিয়ে আনা, সকল পারমাণবিক বোমা ধ্বংস ও হারওয়েল আর অ্যালডারমাস্টনের ‘অ্যাডভান্সড ওয়েপনস্ রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টের বিলুপ্তি। ব্রিটেন থেকে সকল মার্কিন কনভেনশনাল এবং নিউক্লিয়ার অস্ত্র ও পারসোনেল অপসারণ। এবং সবশেষে ন্যাটো জোট থেকেও ব্রিটেনের নিজেকে প্রত্যাহার।

‘এসব পদক্ষেপ যদি নিতে সক্ষম হয় লেবার, চিরদিনের জন্যে মুখ থুবড়ে পড়বে ব্রিটেন, গুঁড়িয়ে যাবে মেরুদণ্ড। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না কোনদিনও।

দীর্ঘ নীরবতা। ‘কতটা ক্ষতি হবে এই বিস্ফোরণে?’

‘বেন্টওয়াটার্স এয়ার বেস, রেনডলেসহ্যাম ফরেস্ট, তিনটে হ্যামলেট এবং পুরো একটা গ্রাম, সব বাষ্প হয়ে উবে যাবে।’

‘কত লোকের মৃত্যু হবে?

‘তা…কয়েক হাজার তো বটেই।’

‘কিন্তু যদি আমেরিকানরা ভেতরের ব্যাপার টের পেয়ে যায়? বা এ নিয়ে যদি কোন সন্দেহ দেখা দেয় ব্রিটেনের? যদি ধরা পড়ে যায় আমাদের এজেন্ট?’

‘পড়বে না। এসব খুঁটিনাটি প্ল্যান করেছেন…

‘ভিক্টরোভিচ।’

‘হ্যাঁ। লোকটিকে বলা হয়েছে, বোমার বাটন টেপার দু’ঘণ্টা পর বিস্ফোরণ ঘটবে। এই সময়ের ভেতর সে সরে যেতে পারবে নিরাপদ দূরত্বে। আসলে তা নয়। ওটার সীলড্ টাইমার ইউনিট তৈরি করা হয়েছে তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণের জন্যে। ধরা পড়ার প্রশ্নই আসে না তার।’

‘বেচারা, মেজর ভ্যালেরি!’ বরিসভের চাপা কণ্ঠ।

‘কিছু বললেন, কমরেড জেনারেল?’

‘অ্যা? না। কিন্তু এটা যে দুর্ঘটনাই, তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার কি ব্যবস্থা?’

‘আছে। সে ব্যবস্থাও আছে। দুর্ঘটনার দিন সন্ধের পর এক ইসরায়েলি নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট ডক্টর নাহুম ওয়েজম্যান প্রাগে এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলন ডাকবেন। এ মুহূর্তে লণ্ডনে আছেন ভদ্রলোক, মার্কিন এক সামরিক স্থাপনায় কর্মরত। ভদ্রলোক কভার্ড রুশ এজেন্ট। সম্মেলনে ডক্টর জানাবেন, গত কয়েক বছর যাবত আমেরিকানদের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে কাজ করছেন তিনি। ওই ঘাঁটিতে কিছু নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছিল আমেরিকানরা। কিন্তু ডক্টর নাহুম বার বার তাদের সতর্ক করে আসছিলেন যে ওয়ারহেডগুলো বিপজ্জনক।

‘ব্যাপারটা হলো, বোমাগুলো আকারে বেশ বড়। ওগুলো নিয়ে উড়তে প্রচুর তেল লোড করতে হত বিমানে। এতে বিমানের গতিও পুরোপুরি তোলা যেত না। তাই মার্কিনীরা ওগুলোর আকার ছোট করে আল্ট্রা স্মল ওয়ারহেডে পরিণত করার জন্যে কাজ করে চলেছে। ডক্টর ওয়েজার দাবি করবেন, ওগুলোকে ভেঙে ছোট করতে গিয়ে ওরাই এ বিপদ ডেকে এনেছে। কেউ অবিশ্বাস করবে না তাঁকে, কারণ ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্যি। এবং ডক্টর নাহুম বাস্তবিক পক্ষেই মার্কিনীদের এ গবেষণা বন্ধ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। আরও কয়েকজন নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট এর সাক্ষী।’

ডক্টর নাহুমকে খুব ভাল করে চেনেন ভাদিম বরিসভ। বিপত্নীক ওয়েজম্যানের একমাত্র পুত্র ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ছিল এক সময়। ‘৮২ সালে বৈরুতে কর্মরত ছিল সে। যে রাতে ভারী অস্ত্রসজ্জিত ফালাঞ্জিস্ট বাহিনী ফিলিস্তিনী রিফিউজি ক্যাম্প শাবরা ও শাতিলায় গণহত্যা চালায় সে রাতেই তার মৃত্যু হয়।

ঘাতকদের নিরস্ত করার জন্যে জীপ নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল লেফটেন্যান্ট। তারাই হত্যা করে তাকে। কেজিবির ভাগ্য ভাল, লেফটেন্যান্টকে গুলি করা হয়েছিল উজি দিয়ে। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার দেহ থেকে উজির সাত সাতটি বুলেট বের করে ডাক্তাররা। সুযোগ চিনতে ভুল করেনি কেজিবি। শোকার্ত ডক্টর ওয়েজম্যানকে তারা বোঝাতে সক্ষম হয় যে ফালাঞ্জিস্ট নয়, ইসরায়েলি সৈন্যের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর ছেলের। লিকুদ পার্টির নামও শুনতে পারতেন না ভদ্রলোক। চিরকাল বিরোধীদলের সমর্থক ছিলেন।

এই ঘটনার পর ঘৃণায়, ক্রোধে উন্মাদপ্রায় হয়ে উঠলেন তিনি।যে সরকার তাঁর একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, তার ক্ষতি করা যায় কি ভাবে, সারাক্ষণ সেই ফিকিরে থাকলেন। যখন মনে হলো সময় হয়েছে, আলগোছে এগোল কেজিবি। রাশিয়ার হয়ে আজীবন কাজ করে যাওয়ার শপথ করলেন নাহুম ওয়েজম্যান।

সচকিত হলেন ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভ বরিসভ। হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিলেন রেকর্ডার। কিন্তু আতঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। কাল রাত থেকেই তাড়িয়ে ফিরছে তাঁকে এ আতঙ্ক, জান্তব এক দুঃস্বপ্ন। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন জেনারেল, কিন্তু কোন পথ বের করতে পারেননি।

আসন ছাড়লেন বরিসভ। পায়চারি শুরু করলেন। মিনিট দশেক পর হঠাৎ করেই মাথায় এল আইডিয়াটা। দাঁড়িয়ে পড়লেন জেনারেল। দেখতে দেখতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চেহারা। পাওয়া গেছে! মুক্তির পথ পাওয়া গেছে। তিনি একজন সরকারি চাকুরে। অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে তাঁর, যা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব।

যে কারণে এ ব্যাপারে নিজে সরাসরি কিছুই করতে পারবেন না। এছাড়া পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির পিছনে লাগার পরিণতি…ভাবতেই শিউরে উঠলেন জেনারেল বরিসভ। সর্বনাশ হয়ে যাবে। জ্ঞাতি-গুষ্ঠি নিয়ে ধনে-প্রাণে মরতে হবে যদি জানাজানি হয়ে যায়। তাই বলে পিছিয়ে গেলেও চলবে না। বাধা দিতেই হবে। এর ওপরই নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কেরল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইংল্যাণ্ডই নয়, এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে সমগ্র মানবজাতিকে।

তা হতে দিতে পারেন না জেনারেল বরিসভ। হতে দেয়া যায় না। নিজে এর পিছনে লাগতে পারবেন না, ঠিক আছে। কিন্তু আর কাউকে সব জানিয়ে লাগিয়ে দিতে বাধা কোথায়? তাই করতে যাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিচ বরিসভ। বুকের ওপর চেপে বসা একটা ভার যেন নেমে গেল তাঁর হঠাৎ করেই। আতঙ্কিত দিশেহারা ভাবটাও কেটে যেতে থাকল একটু একটু করে।

চিকস্যাণ্ডস, বেডফোর্ডশায়ার। রাত এগারোটা। ইউএস মাস্টার সার্জেন্ট গ্যারি লুইস বসে আছে ব্রিটিশ-আমেরিকান লিসনিঙ স্টেশনের মাস্টার কম্পিউটরের সামনে। সুন্দরী ব্রিটিশ বান্ধবীর কথা ভাবছে সে মনে মনে। বেডফোর্ডে থাকে লুইসের বান্ধবী। সপ্তাহে একদিন মিলিত হওয়ার সুযোগ পায় লুইস মেয়েটির সঙ্গে। রোববার।

কাল সেই দিন। এ দিনটির আগমনের প্রতীক্ষায় সপ্তাহের বাকি ছয় দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সার্জেন্ট। কাজেই মনটা আজ তার বেশ প্রফুল্ল। গুন গুন করে গান গাইছে। আঙুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে হাঁটুতে। চোখ মাস্টার কম্পিউটরের পর্দায়।

এটি ব্রিটিশ ইলেক্ট্রোনিক মনিটরিঙ অ্যাণ্ড কোড় ব্রেকিং কমপ্লেক্সের একটি শাখা। গ্লস্টারশায়ারের চেলটেনহ্যামে এর হেড অফিস। সংক্ষেপে গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস্ হেডকোয়ার্টার্স বা জিসিএইচকিউ বলা হয় একে। সারা দেশে এর অনেক শাখা রয়েছে। যার কয়েকটা যৌথভাবে পরিচালনা করে জিসিএইচকিউ এবং আমেরিকান ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি বা এনএসএ। চিকস্যাণ্ডসের এ স্টেশনটিও তেমনি একটি।

অতীতের মত ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে আত্মগোপন করে থাকা কোন শত্রু দেশের স্পাইয়ের মোর্স-কীর মাধ্যমে পাঠানো বার্তা ইথার থেকে উদ্ধার এবং তা রেকর্ড করার প্রাণান্তকর খাটুনির দিন গত হয়েছে অনেক আগেই। আজকাল সে কাজ করে কম্পিউটর। বার্তা কেবল রিসিভ আর রেকর্ডই করে না ইলেক্ট্রোনিক পরিবারের এই বিস্ময়কর জাদুর বাক্সটি, করে আরও অনেক অ-নে-ক কিছু।

অতএব চিন্তার কিছু নেই, জানে মাস্টার সার্জেন্ট গ্যারি লুইস। সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকারও প্রয়োজন নেই। বাতাসে যদি কোন ইলেক্ট্রোনিক ফিসফিসানি ওঠে, ইথারে অস্বাভাবিক কম্পন ধরায়, তার মাথার ওপর, ভবনের হাতে এরিয়েলের জঙ্গলে তা ধরা পড়বেই। পরমুহূর্তে তা লুইসের সামনের জাদুর বাক্সের মেমোরি ব্যাঙ্কে প্রবেশ করবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

এরপর পলকে ঘটে যাবে আরও অনেক কিছু। প্রথমেই মাস্টার কম্পিউটরের ‘হিট’ বাটনটি ঝপ্ করে বসে পড়বে নিজের এনট্রেইলে। মেসেজটা রেকর্ড হয়ে যাবে। এবার অটোমেটিক ব্যাণ্ড স্ক্যানার লেগে পড়বে নিজের কাজে। ফিসফিসানিটা কোত্থেকে এল, তার বিয়ারিঙ আত্মস্থ করে নেবে সে। তারপর সারা দেশের সবগুলো লিসনিঙ স্টেশনের ব্রাদার কম্পিউটরকে নির্দেশ পাঠারে তার ক্রসবিয়ারিঙ গ্রহণের। এবং সবশেষে মৃদু ‘পিঁ-হ-হ-হঁ’ গান গেয়ে সতর্ক করবে ডিউটি অফিসারকে।

এগারোটা তেতাল্লিশ। আরও সতেরো মিনিট ডিউটি করতে হবে গ্যারি লুইসকে। তারপর মুক্তি। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল সে, কিন্তু কাজটা পুরো করতে পারল না। অদ্ভুত এক নাচের ছন্দে ত্যাড়াবাঁকা দেহটা শক্ত হয়ে গৈল তার। নিমেষে কপালে উঠে গেছে চোখ, হাঁ বন্ধ করার কথা ভুলে গেছে। চোখের সামনে ‘হিট’ বাটনটা এনট্রেইলে বসে পড়েছে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না মাস্টার সার্জেন্ট।

বায়ুমণ্ডলে সারাক্ষণ ভেসে বেড়ানো শব্দজটের ভেতর অস্বাভাবিক একটা কিছু সনাক্ত করেছে মাস্টার কম্পিউটর। ইলেক্ট্রোনিক ফিসফিসানি! মাই গড! ঝট করে সিধে হয়ে বসল গ্যারি, ঝাঁপ দিল সামনের টেলিফোনের রিসিভার লক্ষ্য করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জ্যান্ত হয়ে উঠল লিসনিঙ স্টেশন। হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল।

দু’মিনিট পর বোঝা গেল, কম্পিউটর যা সনাক্ত করেছে তা সেকেণ্ড তিনেক স্থায়ী জট পাকানো কিছু শব্দের এক গোলাক ধাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকগুলো শব্দ যেন আটকে রাখা হয়েছিল পাইপের ভেতর, ট্যাপের প্যাঁচ খুলতেই ফোয়ারার মত হড় হড় করে বেরিয়ে এল একযোগে। স্কোয়ার্ট বলা হয় একে। সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে প্রেরিত কোন ক্ল্যানডেস্টাইন মেসেজ (গোপন বার্তা)। অত্যন্ত নিরাপদ। যার মর্মোদ্ধার মানুষ তো দূরের কথা, কম্পিউটরেরও সাধ্যের অতীত।

এ জাতীয় বার্তা তৈরি করতে প্রচুর সময় এবং শ্রম ব্যয় হয়। প্রথমে বার্তাটা পরিষ্কার করে যথাসম্ভব সংক্ষেপে লিখতে হয়। পরে তা রূপান্তর করা হয়-কোডে। এরপর ক্যাসেট রেকর্ডার চালিয়ে মোর্স-কী টিপে ওটা রেকর্ড করা হয়। কী-র ট্যাপ ট্যাপ উঁচু-নিচু পর্দার আওয়াজের ভেতরই লুকিয়ে থাকে বার্তা। বলা বাহুল্য রেকর্ডারটি এ ধরনের ‘বিশেষ কাজের’ জন্যেই তৈরি।

এবার নির্দিষ্ট একটি বোতাম টিপলেই কয়েক ইঞ্চি ফিতে জুড়ে রেকর্ড হওয়া কী-র ট্যাপিঙের আওয়াজগুলো এগিয়ে এসে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে আধ ইঞ্চি কি বড়জোর পৌনে এক ইঞ্চি ফিতের ভেতর অবস্থান নেয়। ফলে বার্তাটা যখন ট্র্যান্সমিট করা হয়, সবগুলো অক্ষর বা ডষ্ট-ড্যাশ ইত্যাদি ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে এসে ইথারে মুহূর্তের জন্যে ফিসফিসানির সৃষ্টি করেই গায়েব হয়ে যায়, পৌঁছে যায় জায়গামত।স্কোয়ার্টে কোন প্যাটার্ন বা রিপিটেশন থাকে না, কাজেই এর মর্মোদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব।

সেটা না পারলেও কোত্থেকে স্কোয়ার্ট ট্র্যান্সমিট করা হলো, বিয়ারিঙ আর ক্রসবিয়ারিঙের সাহায্যে জায়গাটা পিন-পয়েন্ট করতে সময় লাগে না কম্পিউটরের। কাজেই, কম্মটি সেরেই ঘটনাস্থল ছেড়ে তক্ষুণি সরে পড়তে হয় প্রেরককে। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটল। দশ মিনিট পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতাশ হলো স্থানীয় পুলিস। ডার্বিশায়ার পিক ডিস্ট্রিক্টের জনশূন্য এক রাস্তার পাশের ছোটখাট একটা ঝোপ ওটা। যার ত্রিসীমানার মধ্যেও কেউ নেই।

নিয়ম আনুযায়ী চেলটেনহ্যামের জিসিএইচকিউ হেড কোয়ার্টার্সে পৌছল ক্ল্যানডেস্টাইন মেসেজটা। ঝটপট কাজে লেগে পড়ল ওখানকার ঝানু চীফ অ্যানালিস্ট। স্লো মুভিঙ রেকর্ডারে নতুন করে টেপ করা হলো স্কোয়ার্ট, ফুটখানেক ফিতে জুড়ে জায়গা নিল ওটা। যাতে প্রতিটি অক্ষর ডট-ড্যাশ আলাদা আলাদা সনাক্ত করা সম্ভব হয় সহজেই। কিন্তু কোন লাভ হলো না! চব্বিশ ঘণ্টা একনাগাড়ে চেষ্টা চালিয়ে হার স্বীকার করতে বাধ্য হলো মানুষ এবং কম্পিউটর ব্রেনের মিলিত শক্তি। ফল দাঁড়াল বড় একটা অশ্বডিম্ব।

‘এ নিশ্চয়ই কোন স্লীপার ট্র্যান্সমিটার, স্যার,’ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের কাছে রিপোর্ট করল চীফ অ্যানালিস্ট। ‘ডেড ছিল, অ্যাকটিভ করা হয়েছে। উত্তর মিডল্যাণ্ডের কোথাও আছে ওটা খুব সম্ভব। আমাদের স্পাই বন্ধুটি প্রতি শব্দের জন্যে একটা করে ফ্রেশ ওয়ান-টাইম প্যাড ব্যবহার করেছে।

সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ‘স্পাই বন্ধুটি’ যে চ্যানেলে স্কোয়ার্ট ট্র্যান্সমিট করেছে তার ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। যদিও সবাই নিশ্চিত, ফের যদি ট্র্যান্সমিট করে সে নিঃসন্দেহে অন্য চ্যানেলের মাধ্যমে করবে। তবুও। পরদিন দুপুরের আগেই গোপন মাধ্যমে ঘটনার লিখিত পূর্ণ বিবরণ পৌঁছে গেল লণ্ডনে, বিএসএস চীফের টেবিলে।

এর অনেক আগে, স্থানীয় সময় রাত দুটো তেতাল্লিশে বার্তাটা রিসিভ করা হয়েছে মস্কোয়। ওর বক্তব্য ছিল, মার্টিন ফ্যানারি জায়গামত প্ৰস্তুত। প্রথম ‘চালান’ পৌঁছার অপেক্ষায় আছে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *