অন্ধ শিকারী – ১.৯

নয়

সুইডিশ পাসপোর্ট নিয়ে একেবারে নির্বিবাদে ইংল্যাণ্ডে ঢুকে পড়ল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। অ্যারোফ্লোটে প্রথমে জুরিখ পৌছল সে মস্কো থেকে। কাস্টমস ঝামেলা চুকিয়ে চলে এল কনকোর্সে। তারপর সুইডিশ পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি একটা খামে পুরে স্থানীয় কেজিবির এক সেফ হাউসের ঠিকানায় পোস্ট করে দিল।

এয়ারপোর্টেই বেনামে ভাড়া করা কেজিবির এক পোস্ট বক্সে আগে থেকে রাখা ছিল তাতায়েভের নতুন পরিচয় পত্র, বের করে নিল সে ওটা। সুইস কম্পিউটর এঞ্জিনিয়ারের পরিচয় আছে ওতে। ঘণ্টাখানেক পর কানেকটিং ফ্লাইটে ডাবলিনের উদ্দেশে উড়াল দিল তাতায়েভ। একই বিমানে রয়েছে তার এসকর্ট। সে অবশ্য জানে না কাকে এসকর্ট করছে সে। খুব কাছাকাছিই রয়েছে দুজনে, কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। ছক যে ভাবে বাঁধা, তাতে চেনারও অবশ্য প্রয়োজন পড়ে না।

ডাবলিন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হোটেলের এক রূমে মিলিত হলো তারা নির্ধারিত সময়। কোন কথা হলো না দুজনের মধ্যে। নীরবে পরনের ইউরোপিয়ান কাপড়-চোপড়, জুতো-মোজা মায় জাঙ্গিয়া পর্যন্ত সব খুলে ফেলল তাতায়েভ। ওগুলো নিজের হাতব্যাগে ভরল এসকর্ট। তার আগেই ওর ভেতর থেকে মেজরের জন্যে নিয়ে আসা ব্রিটিশ পোশাক, জুতো ইত্যাদি বের করে রেখেছে সে।

এরপর বড়সড় একটা লেদার স্যুটকেস এগিয়ে দিল লোকটা মেজরের দিকে। ওর মধ্যে রয়েছে নিত্য ব্যবহার্য সাধারণ এটা-ওটা। হোটেল রূমে আসার আগে, এয়ারপোর্টের মেসেজ বোর্ডে পিন দিয়ে গেঁথে রাখা একটা খাম সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে সে। কল্পিত এক নাম লেখা ছিল খামের ওপরে। ভেতরে আগের রাতের এলবানা থিয়েটারের একটা টিকেটের দর্শকের অংশ, নিউ জুরি’স হোটেলে রাত কাটানোর রিসিট এবং এয়ের- লিঙ্গাসের লণ্ডন-ডাবলিন-লণ্ডন রূটের একটা টিকেট ছিল, যার ‘আপ’ ব্যবহার করা হয়েছে, ডাউন বহাল।

এবং ভ্যালেরি তাতায়েভের নতুন পাসপোর্ট। বিশাল ল্যাভেটরির ভেতরের এক সিঙ্কের তলায় স্কচ্ টেপ দিয়ে আটকানো ছিল, ওটাও সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে এসকর্ট। তৈরি হয়ে যখন কনকোর্সে ফিরে গেল তাতায়েভ, কেউ ভাল করে তাকালই না তার দিকে। ডাবলিনে একদিনের বিজনেস ট্রিপ সেরে লণ্ডন ফিরে চলা ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের দলে ভিড়ে মিলেমিশে গেছে সে।

ডাবলিন-লণ্ডন রূটে পাসপোর্ট চেকিঙের ঝামেলা নেই, লণ্ডন পৌঁছে যাত্রীকে কেবল বোর্ডিং পাস বা টিকেটের অবশিষ্টাংশ দেখালেই মামলা খতম। হিথ্রোর এক্সিটওয়ের দু’ পাশে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুজন দাঁড়িয়ে আছে উদাস ভঙ্গিতে। দেখলে মনে হবে কিছুই দেখছে না। আসলে প্রায় কোনকিছুই তাদের চোখ এড়ায় না।

নিশ্চিন্ত মনে তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে এল ভ্যালেরি তাতায়েভ। এই প্রথম ভ্যালেরিকে দেখছে তারা, তবু কিছু জিজ্ঞেস করল না। করলে দেখতে পেত মার্টিন ফ্ল্যানারি একজন খাঁটি ইংলিশম্যান। অন্তত তার পাসপোর্টে সেরকমই বলত। এবং ওটা মোটেই জাল নয়, খোদ লণ্ডন পাসপোর্ট অফিস থেকে ইস্যু করা। কাস্টমস পেরিয়ে এল মেজর বিনা চেকিঙে। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল কিংস ক্রস স্টেশনের দিকে। ওখানকার লেফট- লাগেজ লকারে তার জন্যে রাখা আছে একটা সীলড্ প্যাকেট। দু’দিন আগে মস্কো থেকে এসেছে ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে, লণ্ডনের রুশ দূতাবাসে।

দূতাবাসের কেজিবির এক অপারেটর প্যাকেটটা রেখে গেছে লকারে। বেনামে ভাড়া নিয়ে রাখা কেজিবির এরকম অসংখ্য লকার, পোস্ট বক্স আছে এদেশে। প্রতিটির ডজন খানেক করে চাবি রয়েছে, নকল করে বানিয়ে নিয়েছে নিজেরা। ওর একটা ভ্যালেরির কাছেও আছে। প্যাকেটটা হ্যাণ্ডগ্রিপে ভরে ফেলল ভ্যালেরি। ভেতরে কি আছে দেখার তাড়া নেই। সে জানে কি আছে ওতে। কাজেই পরে দেখলেও চলবে।

ওখান থেকে আরেকটা ট্যাক্সি চেপে লিভারপুল স্ট্রীট স্টেশনে এল সে। টিকেট কেটে উঠে পড়ল সাফোক কাউন্টির ইপসুইগামী ট্রেনে। সন্ধে ঠিক সাতটায় সেখানকার গ্রেট হোয়াইট হর্স হোটেলে চেক ইন করল ভ্যালেরি তাতায়েভ। ট্রেনে যদি কোন পুলিস চেক করতে চাইত তার হ্যাণ্ডগ্রিপ, নিঃসন্দেহে চোখ কপালে উঠত তার।

লকার থেকে সংগ্রহ করা প্যাকেটের ভেতর নিরীহ বেড়ালছানার মত শুয়ে রয়েছে একটা ফিনিশ সাকো অটোমেটিক পিস্তল। সঙ্গে পুরো একটা ম্যাগাজিন। প্রতিটি বুলেটের সূঁচোল অগ্রভাগ খুব সতর্কতার সঙ্গে ইংরেজি X এর মত করে কাটা। কাটা অংশটুকু ভরাট করা আছে সিরিশ আঠা ও পটাশিয়াম সায়ানায়িডের মিকশ্চার দিয়ে। কেবল আহতই করবে না ওই বুলেট। যার দেহে বিধবে, মিকশ্চারের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু তার অবধারিত। কেউ বাঁচাতে পারবে না।

এছাড়া একটা কভার স্টোরি বা লিজেণ্ডও আছে গ্রিপের ভেতর। মার্টিন ফ্যানারির ‘লিজেণ্ড’। যে ব্যক্তির কোন অস্তিত্বই নেই, তার জীবন বৃত্তান্তকে বলা হয় ‘লিজেণ্ড’। যা প্রস্তুত করা প্রচুর ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের ব্যাপার। অস্তিত্বহীন ব্যক্তিটির প্রতিটি বানানো কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে প্রয়োজন হয় হাজারো খুঁটিনাটি, বর্ণনা, সাপোর্টিং ডকুমেন্টস ইত্যাদি।

আসলে এই ‘অস্তিত্বহীন’ ব্যক্তিটির অস্তিত্ব কোন একসময় ছিল, কিন্তু বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে, পরিবেশে, মৃত্যু ঘটেছে তার সবার অজান্তে। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে সে নীরবে, নিভৃতে। ঠিক এ ধরনের সুযোগ গ্রহণ করার জন্যে সব সময় ওঁৎ পেতে থাকে দুনিয়ার সব বড় বড় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। মরা মানুষটিকে বাঁচিয়ে তোলে ওরা। প্রয়োজনে কাজে লাগাবার উদ্দেশে।

আসল মার্টিন ফ্ল্যানারির মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই, ১৯৭৬ সালে।

জাম্বেজি নদীর দক্ষিণ তীরের গভীর জঙ্গলে পড়ে আছে তার মৃতদেহ অথবা কঙ্কাল যাই হোক। স্কটল্যাণ্ডের কিলব্রাইডে ১৯৫০ সালে জন্ম হয়েছিল মার্টিন ফ্ল্যানারির। বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ব্রিটেনের অপর্যাপ্ত রেশনিং সিস্টেমের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে তার বাবা, মারিয়াস ফ্ল্যানারি এবং মা জুলিয়ান ফ্ল্যানারি একমাত্র সন্তান মার্টিনকে নিয়ে তৎকালীন দক্ষিণ রোডেশিয়ায় অভিবাসন গ্রহণ করেন, ১৯৫১ সালে।

মারিয়াস ফ্ল্যানারি ছিলেন কৃষি প্রকৌশলি। একটা চাকরি সেখানে জুটিয়ে নিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। নয় বছর চাকরি করার পর, ১৯৬০ সালে ব্যবসা শুরু করেন ভদ্রলোক। মোটামুটি ভালই চলছিল। ১৯৭১ সাল। ছেলে ততদিনে স্কুল ছেড়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়ছে নামকরা মাইকেলহাউস কলেজে। দেশে তখন তুমুল রাজনৈতিক অসন্তোষ। রোডেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আয়ান স্মিথকে গদিচ্যুত করতে জশুয়া নকোমোর ‘যিপ্রা’ (জেড আই পি আর এ) এবং রবার্ট মুগাবের ‘যানলা’ (জেডএএনএলএ), এই দুই গেরিলা বাহিনী বদ্ধপরিকর। চারদিক থেকে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের বেপরোয়া অগ্রাভিযান দেখে সরকারী বাহিনী দিশেহারা।

আইন করা হলো দেশের প্রতিটি সক্ষম যুবককে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হবে। বাধ্য হয়ে কলেজ ত্যাগ করতে হলো মার্টিনকে। রোডেশিয়ান লাইট ইনফ্যান্ট্রিতে নাম লেখাল সে। এর কয়েক বছর পর ১৯৭৬ সালে, জাম্বেজির দক্ষিণ তীরে যিা বাহিনীর অ্যামবুশের মাঝে পড়ে যায় মার্টিন এবং নিহত হয়।

মারা যাওয়ার সময় মার্টিনের সঙ্গে কোন পরিচয়পত্র ছিল না। ছিল তার মেয়ে বান্ধবীর পাঠানো একটা চিঠি। কমব্যাট জ্যাকেটের পকেটে ছিল চিঠিটা। পরে জাম্বিয়া নিয়ে আসা হয় চিঠিটা আরএলআই হেডকোয়ার্টার্সে জমা দেয়ার জন্যে। একদিন সেটা গায়েব হয়ে যায় এবং কেজিবির হাতে পড়ে।

সে সময় লুসাকায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ছিল কেজিবির সিনিয়র এক অফিসার, ভ্যাসিলি সলোদভনিকভ। আফ্রিকার দক্ষিণাংশের দেশগুলোতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করত সে। চিঠিটা মার্টিনের বান্ধবী লিখেছিল তার শহরের ঠিকানায়, মারিয়াস ফ্যানারির কেয়ারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাপ-ছেলে জন্মগতভাবে ব্রিটিশ।

ব্যাপারটাকে বোনাস হিসেবে ধরে নিল সলোদভনিকভ। রোডেশিয়ায় থাকলেও তাদের দুজনেরই ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। ওগুলো সমর্পণ করেনি মারিয়াস বা মার্টিন। অতএব ‘লিজেণ্ড’ তৈরির কাজে লেগে পড়ল সে, বেঁচে উঠতে হলো মার্টিন ফ্ল্যানারিকে।

স্বাধীনতা পেয়ে রোডেশিয়া হলো জিম্বাবুয়ে। মনের দুঃখে মারিয়াস এবং জুলিয়ান সে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু ছেলে, মার্টিন, ‘ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল’। অদৃশ্য এক হাত লণ্ডনের সমারসেট হাউসে সংরক্ষিত মার্টিনের বার্থ সার্টিফিকেটটা সরিয়ে ফেলল। অন্য আরেক হাত তার নাম ঠিকানার ওপর ভিত্তি করে নতুন একটা পাসপোর্টের জন্যে দরখাস্ত পাঠাল ডাক মারফত। দরখাস্ত পরীক্ষা করে দেখা হলো, এরপর মার্টিন ফ্ল্যানারির পাসপোর্ট পেতে দেরি হলো না বিশেষ।

নিখুঁত, ফুলপ্রুফ লিজেণ্ড প্রস্তুতের কাজে প্রয়োজন হয় ‘অতি বিশেষ’ যত্নের। প্রচুর সাহায্যকারী এবং অর্থের। সেই সঙ্গে সময়। প্রথম দুটোর অভাব কেজিবির কখনও ছিল না, ছিল না ধৈর্যের অভাবও। একেকটা লিজেণ্ডকে নিখুঁত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে কখনও কখনও অবিশ্বাস্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করে কেজিবি। যেমন করেছে মার্টিন ফ্ল্যানারির ব্যাপারে—এতে লেগেছে প্রায় দশ বছর।

‘দেশে ফিরে এসে’ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছে ফ্ল্যানারি। সময় শেষ হওয়ার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স রিনিউ করিয়েছে নিয়মিত। বেশ কয়েকটা গাড়ি তার নামে কেনাবেচা হয়েছে যাতে ভেহিকেল লাইসেন্সিং সেন্টার কম্পিউটর চেক করলেই তার সন্ধান পাওয়া যায়। কেজিবির এক দঙ্গল জুনিয়র স্টাফ নিষ্ঠার সাথে ফ্ল্যানারিকে বাঁচিয়ে রেখেছে লণ্ডনের কাগজে-কলমে।

আরও আছে। লিজেণ্ডারি চরিত্রটির অতীত জানতে লেগে পড়ে আরেক দল। তার ডাকনাম কি ছিল? শিশুকালে বাপ-মা আদর করে তাকে কি বলে ডাকত? কোন প্রিপারেটরিতে প্রথম ভর্তি হয়েছে সে, তারপর কোন স্কুল, কলেজ? স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষককে পিছন থেকে কি বলে খেপাত সে? তার কুকুরের কি নাম ছিল? কবে বাথরূমে আছাড় খেয়ে তার থুতনি কি আর কোথাও কেটে গিয়েছিল?

ঠিক এমনি এক সন্দেহাতীত লিজেণ্ড বহন করছে ভ্যালেরি তাতায়েভ তার মাথায় এবং হ্যাগুগ্রিপে। সে-ই মার্টিন ফ্ল্যানারি, প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবে না। ডরসেটের ড্রচেস্টার থেকে এসেছে সে, একটি সুইস বেজড্ কর্পোরেশন মার্কেটিং কম্পিউটর সফটওয়্যার কোম্পানির নতুন শাখা খুলতে। ডরচেস্টারের বারক্লেজ ব্যাঙ্কে মোটা টাকা জমা আছে মার্টিন ফ্ল্যানারির। দুয়েক দিনের মধ্যেই টাকাটা কলচেস্টারে ট্র্যান্সফার করতে যাচ্ছে সে।

ব্রিটেন এমনই এক দেশ, যে দেশে কোন ইংলিশম্যানের পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে ঘোরার প্রয়োজন পড়ে না। ড্রাইভিঙ লাইসেন্স, নিদেন তাকে উদ্দেশ করে লেখা কোন চিঠি, যথেষ্ট। অতএব, এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই, গ্রেট হোয়াইট হর্স হোটেলে রাজকীয় ডিনার সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবল মেজর ভ্যালেরি আলেক্সেইভিচ তাতায়েভ। রিসেপশন ডেস্ক থেকে ইয়েলো পেজ ডাইরেক্টরিটা রূমে আনিয়ে নিল সে। খুঁজে বের করল এস্টেট এজেন্ট সেকশন।

‘এবার?’ প্রশ্ন করল ক্যাপ্টেন অ্যানড্রিয়াস পিয়েনার। ‘কোত্থেকে আরম্ভ করতে চান নতুন করে, মেজর?’

‘এখান থেকে,’ ডি অ্যাঙ্গাসের জীবন বৃত্তান্তের এক জায়গায় দুটো টোকা দিল মাসুদ রানা। ‘ওরা দুজন ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়ার পর থেকে। দ্বিতীয় সৈনিকটির ব্যাপারে কিছু তথ্য চাই।’

‘দ্বিতীয় সৈনিক?’

‘যে অ্যাঙ্গাসকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েছিল ট্রাক থেকে।’

‘কিন্তু সে তো মৃত!’

‘জানি,’ অন্যমনস্কের মত বলল রানা। ‘কেবল ‘সঙ্গী’ বলে তার উল্লেখ করেছে অ্যাঙ্গাস এখানে, নাম কি ছিল, লেখেনি কেন?’

‘হতে পারে প্রয়োজন মনে করেনি।’

মাথা দোলাল মাসুদ রানা। ‘হতে পারে।’ ‘অথবা হয়তো জানিয়েছিল কাউকে।’

‘সৈনিকটির পরিচয় জানতে হবে,’ যেন শুনতে পায়নি ক্যাপ্টেনের বক্তব্য, এমন ভাবে বলল রানা।

‘তা কি করে সম্ভব, মেজর? মাইণ্ড ইট, কয়েক দশক আগে মারা গেছে লোকটা। কোন পোলিশ ফরেস্টে পুঁতে ফেলা হয়েছে তার লাশ। এত বছর পর সেই স্থানটিই বা লোকেট করব কিভাবে?’

‘অ্যাঙ্গাসের মতে ১৯৪৪ সালের বড়দিনের ঠিক দু’দিন আগে জার্মান অ্যামবুশের মধ্যে পড়েছিল তার ইউনিট, স্টালাগ থ্রী ফোর ফোর। ঠিক?

‘হ্যাঁ।’

‘এই স্টালাগের কেউই কি বেঁচে নেই? নিশ্চয়ই আছে।’

‘পেয়েছি,’ মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্যাপ্টেন পিয়েনারের।

যুদ্ধফেরত প্রাক্তন সৈনিকদের একটা সংগঠন আছে, ‘অর্ডার অভ টিন হ্যাটস’। এর সদস্যদের বলা হয় মথ। গোটা ছয়েক শাখা আছে এর। ওদের কাছে খোঁজ নেয়া যেতে পারে।’

খুব উৎসাহ নিয়ে টেলিফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পিয়েনার। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই সব উৎসাহ-উদ্দীপনা তার উবে গেল কর্পূরের মত। ‘নাহ, হলো না। কেউ কোন সঠিক তথ্য দিতে পারছে না, উল্টোপাল্টা বলে। দেখি, সবাইকে ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছি। অনুরোধ করেছি খোঁজ- খবর নিয়ে সম্ভব হলে জানাতে। দেখি কি হয়।’

‘প্রিটোরিয়ায় ক’টা টিন হ্যাটস্ আছে?’ জানতে চাইল মাসুদ রানা। ‘দুটো।’

আসন ছাড়ল ও। ‘চলুন, ঘুরে আসি ওদের ওখান থেকে।’

‘যাবেন? চলুন।’

দরজা খুলেছে রানা বেরিয়ে পড়ার জন্যে, এমন সময় ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোন। থেমে পড়ল ও, রিসিভার তুলে কথা বলতে শুরু করেছে পিয়েনার। দুর্বোধ্য ভাষায় গড় গড় করে কী সব বলছে। বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেনকে। ভুরু কুঁচকে দোড়গোড়ায় অপেক্ষা করছে রানা।

রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে ঘুরে তাকাল অ্যানড্রিয়াস। ‘কেপ টাউন থেকে ফোন করেছে এক লোক। বলছে, স্টালাগ থ্রী ফোর ফোরে ছিল সে।’

দ্রুত ডেস্কের কাছে ফিরে এল মাসুদ রানা। ‘ইংরেজি জানে?

‘হ্যাঁ। লোকটা অ্যাংলো,’ রিসিভার ধরিয়ে দিল সে ওর হাতে।

‘হ্যালো! মিস্টার হেণ্ডারসন? হ্যাঁ, আমার নাম মাসুদ রানা। আপনাদের স্টালাগ থ্রী ফোর ফোর নিয়ে রিসার্চ করছি আমি…ধন্যবাদ, অনেক দয়া আপনার ::হ্যাঁ। ওয়েল, ১৯৪৪ সালের বড়দিনের কথা মনে আছে আপনার, মিস্টার হেণ্ডারসন? জার্মান অ্যামবুশের ভেতর পড়ে দুই আফ্রিকান সৈনিক ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়ে…অ্যা? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওদের কথাই বলছি। ওদের নাম মনে আছে আপনার? নেই, না? ওয়েল, আপনাদের ইউনিটের সিনিয়র সাউথ আফ্রিকান এনসিও কে ছিলেন বলতে পারেন? আই সী. ওয়ারেন্ট অফিসার অ্যান্থনি!…ওয়ালি অ্যান্থনি? ঠিক মনে আছে আপনার? অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

রিসিভার রেখে দিল রানা। ওয়ারেন্ট অফিসার ওয়ালি অ্যান্থনি, ভাবল ও, সম্ভবত ওয়াল্টার অ্যান্থনি। ‘আপনাদের মিলিটারি আর্কাইভে যেতে চাই।’

টোয়েন্টি ভিসাজি স্ট্রীটে কফি রঙের চারতলা এক ভবন, সাউথ আফ্রিকান মিলিটারি আর্কাইভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও অনেক বছর ইংরেজির চল ছিল এদেশের সরকারি কাজকর্মে। পুরো তালিকা ইংরেজিতে লেখা। ওতে একশোরও বেশি অ্যান্থনি আছে। প্রথম অক্ষর ডব্লিউ পাওয়া গেল তার মাত্র উনিশ জনের। মেলে না।

খানিকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝল রানা, এভাবে হবে না। এ. থেকে ক্রমানুসারে চেক করতে শুরু করল ও ভেবেচিন্তে। ঝাড়া এক ঘণ্টা লাগল নামটা বের করতে। জেমস ওয়াল্টার অ্যান্থনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। উত্তর আফ্রিকার তবরুক ফ্রন্টে ধরা পড়েছিলেন তিনি। যুদ্ধের বাকি সময় ইটালি এবং জার্মানিতে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে।

১৯৭২ সালে অবসর নেয়ার আগে কর্নেল পর্যন্ত পদোন্নতি হয় অ্যান্থনির-।

‘প্রার্থনা করুন মানুষটা যেন বেঁচে থাকে,’ বলল পিয়েনার।

‘এর ঠিকানা সম্ভবত আপনাদের পেনশন ডিপার্টমেন্ট দিতে পারবে।’ হ্যাঁ, জানা গেল নিয়মিত পেনশনের টাকা তুলছেন কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জেমস ওয়াল্টার অ্যান্থনি। জোহান্সবার্গের একশো মাইল দক্ষিণে অরেঞ্জভিল নামে ছোট এক শহরে সস্ত্রীক থাকেন তিনি। খুশি মনে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা আর অ্যান্ড্রিয়াস পিয়েনার। রাত নেমেছে একটু আগে। সিদ্ধান্ত নিল রানা, কাল ভোরে রওনা হবে অরেঞ্জভিল।

চারদিক লেক আর ঘন গাছ-গাছালি ঘেরা ছিমছাম শহর। কর্নেলের বাড়ি ছোট এক টিলার ওপর, দূর থেকে ছবির মত লাগে। দরজা খুললেন মিসেস অ্যান্থনি। ক্যাপ্টেন পিয়েনারের পরিচয়পত্রের ওপর নজর বোলালেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় নিয়ে। তারপর বললেন, ‘ওদিকে,’ হাত তুলে পশ্চিম দিক নির্দেশ করলেন বৃদ্ধা। লেকের পাড়ে পাবেন তাকে। মাছ ধরছে।’

কর্নেলও বেশ অনেকক্ষণ ধরে উল্টেপাল্টে পরখ করে দেখলেন কার্ডটা। তারপর ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন। ‘কি জানতে চান।’

ছিয়াত্তর বছর বয়স কর্নেলের। কিন্তু দেহের শক্ত বাঁধুনি এখনও বহাল। পরনে টুইড, কড়া পালিশ দেয়া ঝকঝকে কালো শু। ‘হ্যাঁ, পরিষ্কার মনে আছে সব।

‘ওদের দুজনের নাম মনে আছে আপনার, কর্নেল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘অবশ্যই। একদিনের পরিচিতের নামও ‘মনে করতে ভুল হয় না আমার কখনও। দুজনেই অল্পবয়সী ছিল ওরা, আফ্রিকানার। একজন ডি অ্যাঙ্গাস। অন্যজন কর্পোরাল ফ্রিক্‌কি। ফ্রিকি ব্রান্ট।’

বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রিটোরিয়া ফিরে এল ওরা। আবার এল মিলিটারি আর্কাইভে। ফ্রিকি অর্থাৎ ফ্রেডারিখ। এর সঙ্গে যে ব্রান্ট, তার শেষে একটা টি আছে বাড়তি। একটা খুব কমন ডাচ নাম। সুদীর্ঘ সাধনার পর আর্কাইভের এক কর্মচারীর সহায়তায় ছয়জন কর্পোরাল ফ্রেডারিখ ব্রান্টের নাম পাওয়া গেল। তাদের কেউই বেঁচে নেই আজ।

ফাইলগুলো এক এক করে চেক করতে লাগল মাসুদ রানা। দু’জন মারা গেছে উত্তর আফ্রিকা রণাঙ্গণে। দু’জন ইটালিতে। বাকি দু’জনের একজন ল্যাণ্ডিং ক্র্যাফটের সঙ্গে আটলান্টিকে ডুবে, অন্যজন…। ষষ্ঠ ফাইলের মোড়ক উল্টে স্থির হয়ে গেল মাসুদ রানা।

‘একি!’ বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছে পিয়েনার ফাইলটার দিকে। কে করল এ কাজ?’

‘কে জানে।’ শূন্য দৃষ্টিতে ফাইল দেখছে রানা। ‘যে-ই হোক, বহু বছর আগেই ঘটেছে হাত সাফাইটা।’

ভেতরটা শূন্য। কিচ্ছু নেই ফাইলে।

‘দুঃখিত। মনে হচ্ছে এখানেই পথের শেষ।

কোন উত্তর দিল না মাসুদ রানা। চিন্তিত মনে বেরিয়ে এল আর্কাইভ থেকে। হোটেলে ফিরে কর্নেল (অব:) জেমস অ্যান্থনির নাম্বারে টেলিফোন করল।

‘আপনাকে আবার বিরক্ত করতে হলো বলে দুঃখিত, কর্নেল।’

‘দ্যাটস অল রাইট, ইয়াংম্যান। বলুন, কি সাহায্য করতে পারি।’

‘কর্পোরাল ফ্রিকি ব্রান্টের কোন মেট বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কি না, মনে করতে পারেন, কর্নেল? আর্মিতে আমার নিজ অভিজ্ঞতায় জানি, প্রত্যেকেরই একজন ক্লোজ মেট থাকে।’

‘ঠিকই বলেছেন। থাকে। কিন্তু দুঃখিত, এই মুহূর্তে খেয়াল পড়ছে না। এ নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আমি, মেজর। মনে পড়লেই জানাব আপনাকে। সে, কাল সকালে?’

‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ, কর্নেল। নামটা পেলে খুব সুবিধে হয় আমার।’

‘চিন্তা করবেন না। পেয়ে যাবেন।’

সকাল আটটায় এল বহু কাঙ্ক্ষিত টেলিফোন। ‘মনে পড়েছে, মেজর। আরেক কর্পোরাল ছিল ওর মেট। হ্যারিসন, জেমস হ্যারিসন। আর ডিএলআই।’

‘আই বেগ ইওর পান?’

‘রয়্যাল ডারবান লাইট ইনফ্যানট্রি।’

ফোন করে অ্যানড্রিয়াসকে আর্কাইভে আসতে বলে ছুটল রানা ট্যাক্সি চেপে। এবার মাত্র পনেরো মিনিট সময় ব্যয় হলো। ফাইল পড়ে জানা গেল হ্যারিসনের জন্ম ডারবানে। যুদ্ধের পর চাকরি ছেড়ে দেয় কর্পোরাল, কাজেই পেনশন পায় না সে। ঠিকানাও নেই।

ডারবানের টেলিফোন ডিরেক্টরি নিয়ে পড়ল মাসুদ রানা। ক্যাপ্টেন পিয়েনার ওখানকার পুলিস হেডকোয়ার্টার্সে ফোন করে হ্যারিসনের ঠিকানা বের করার অনুরোধ জানাল। উত্তরের আশায় বসে থাকল ফোনের পাশে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর জেমস হ্যারিসনের নামে ইস্যু করা দুটো পার্কিং টিকেট উদ্ধার করল ডারবান পুলিস। ওতে তার ঠিকানা ফোন নাম্বার আছে, জানিয়ে দিল তারা পিয়েনারকে।

‘পরিষ্কার মনে আছে ফ্রিকির কথা,’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দিল হ্যারিসন। … হ্যাঁ, হ্যাঁ। জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। না, আর কখনও দেখা হয়নি তার সঙ্গে।’

সার্ভিসে কোত্থেকে এসেছিল ফ্রিকি, জানেন?’ প্রশ্ন করল পিয়েনার। ‘ইস্ট লণ্ডন।’

‘তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে কি জানেন আপনি?’

‘তেমন কিছু না,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল হ্যারিসন। ‘পরিবারের ব্যাপারে খুব একটা কিছু বলত না ও। তবে একবার যেন…মনে পড়েছে! একবার শুনেছিলাম, ওর বাবা ওখানকার রেলওয়ে ইয়ার্ডের শান্টার ছিল। এইটুকুই।’

‘ধন্যবাদ।’

পরদিন সকালে নির্ধারিত সময় ওদের জোহান্সবার্গ-ইস্ট লণ্ডন ফ্লাইট অবতরণ করল বেন স্কোয়েমেন এয়ারপোর্টে। টার্মিনাল ভবনটি ছোটখাট। নীল এবং সাদা রঙে অপূর্ব দেখতে। ইস্ট লণ্ডন দক্ষিণ আফ্রিকার চার নম্বর বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সামনের কার পার্কে ইনসিগনিয়া বিহীন একটা পুলিস কার অপেক্ষায় ছিল। ফোর্ড সেলুন। কনকোর্স থেকে ওদের পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এল ওটার চালক।

কোনদিকে যেতে হবে, ক্যাপ্টেন?’ পিয়েনারকে প্রশ্ন করল সে।

নীরবে পাশে বসা মাসুদ রানার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন। ‘রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার্স। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং,’ বলল রানা।

মাথা দুলিয়ে গাড়ি ছাড়ল চালক। এখানকার রেলওয়ে স্টেশন ফ্লীট স্ট্রীটে। বেশ আধুনিক কমপ্লেক্স। বড় রাস্তার পাশে একসার সবুজ ও ক্রীম রঙের একতলা ভবন—প্রশাসনিক দফতর। ভেতরে পিয়েনারের চিচিং ফাঁক’ মার্কা পরিচয়পত্র দেখে প্রায় হুড়োহুড়ি পড়ে গেল কর্মচারীদের মধ্যে। অবিলম্বে ফিনান্স ডিরেক্টরের কক্ষে ডাক পড়ল ওদের। আগ্রহ নিয়ে রানার বক্তব্য শুনলেন তিনি।

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলালেন কর্মকর্তা। ‘প্রতিটি অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারীকেই ভাতা দিয়ে থাকি আমরা। আপনার এই লোকের নাম কি যেন বললেন?’

‘বলিনি এখনও। তার নাম ব্রান্ট। তবে প্রথম নাম বলতে পারব না, দুঃখিত। লোকটা শান্টার লোকো চালক ছিল অনেক বছর আগে।’

একজন সহকারীকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিলেন ডিরেক্টর। বেরিয়ে গেল লোকটা। পনেরো মিনিট পর ফিরে এল একটা পেনশন স্লিপ নিয়ে। ধরিয়ে দিল সেটা বর্সের হাতে।

‘হ্যাঁ। এই যে, পাওয়া গেছে,’ বললেন তিনি। ‘এই একজনই ব্রান্ট আছে আমাদের তালিকায়। তিন বছর আগে অবসর নিয়েছে। অটো ব্রান্ট।’

বয়স কত হতে পারে অটো ব্রান্টের?’

চোখ নামিয়ে স্লিপটা দেখলেন ডিরেক্টর। তেষট্টি।’

মাথা নাড়ল রানা আপন মনে। ডি অ্যাঙ্গাস আর ফ্রিকির বয়স যদি একরকম হয়ে থাকে বা তার কাছাকাছি, এবং বাপ-ছেলের বয়সের ব্যবধান ধরা যায় ত্রিশ বছর, তাহলে এ লোকের বয়স নব্বইয়ের ওপরে হতে হবে। বা ওইরকম। ব্যাপারটা জানাল ও ডিরেক্টরকে। কিন্তু তিনি আর সহকারী নিশ্চিত, তালিকায় আর কোন ব্রান্ট নেই।

সেক্ষেত্রে দয়া করে, সবচে’ বেশি বয়সী তিনজন পেনশনিয়ারের নাম- ঠিকানা দিন আমাকে। যারা এখনও বেঁচে আছে।’

মাথা দোলালেন তিনি। ‘সম্ভব নয়। এখানে বয়স নয়, অ্যালফাবেটিক্যাল অর্ডারে লিস্ট সংরক্ষণ করি আমরা।’

হাত ধরে রূমের এক কোণে টেনে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেন ডিরেক্টরকে। নিচু কণ্ঠে গড়গড় করে বলতে লাগল কী সব। হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা ডেস্কে ফিরে এসে। সহকারীর উদ্দেশে বলল, ‘খুঁজতে শুরু করো তালিকা। যত লোক পাও লাগিয়ে দাও সবাইকে। ভদ্রলোকের চাহিদা পূরণ না করে উপায় নেই।’

পুরো তিন ঘণ্টা পর তিনটে পেনশন স্লিপ নিয়ে ঘরে ঢুকল লোকটা। ‘নব্বই বছর বয়সী একজন পেনশনিয়ারকে পাওয়া গেছে। কিন্তু লোকটা টার্মিন্যাল পোর্টার ছিল। আরেকজনের বয়স আশি। ক্লিনার ছিল। শেষের এই লোক মার্শালিঙ ইয়ার্ডের শান্টার ছিল। বয়স একাশি। নাম কূজ। ফ্রেডরিখ কূজ কুইগনির কোথাও বাসা তার,’ জানালেন কর্মকর্তা।।

শহরের নিম্ন মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা কুইগনি, মূর স্ট্রীটে। বাসাটা খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না ফ্রেডরিখ কূজকে। বাসায় নেই সে। মাঝবয়সী এক লোক জানাল, ইনস্টিটিউটে পাওয়া যাবে তাকে। রেলওয়ে রিক্রিয়েশন ক্লাবে।

‘ফ্রেডরিখ?’ পিয়েনারের প্রশ্ন শুনে বলল ক্লাবের বারম্যান। ‘শিওর। ওই যে, ওখানে বসে আছে।’

উদাস ভঙ্গিতে দূরের একসার পাহাড় দেখছে বৃদ্ধ। হাতে বিয়ারের ক্যান’। খোলা ব্যালকনিতে বড় একটা রঙচঙে ছাতার নিচে বসা। মাথা দুলিয়ে সায় দেয়ার আগে অ্যানড্রিয়াস পিয়েনারের দিকে চেয়ে থাকল বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত। ‘খুব মনে আছে ব্রান্টের কথা। কিন্তু সে তো কবেই মারা গেছে।’

‘তাঁর এক ছেলে ছিল ফ্রিকি। ফ্রিকি ব্রান্ট।’

‘ঠিক। গুড হেভেনস্, ম্যান। প্রায় ভুলে যাওয়া অতীত মনে করিয়ে দিলেন আপনি। হ্যাঁ, ফ্রিকি। খুব ভাল ছেলে ছিল। স্কুল ছুটির পর মাঝেমধ্যে আসত ইয়ার্ডে। ওর বাবা জো ব্রান্ট ছেলেকে শান্টিং লোকোয় চড়িয়ে ঘোরাত।’

‘কতদিন আগের কথা? ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি?

‘হ্যাঁ, হবে হয়তো। জো পরিবার নিয়ে এখানে আসার পরপরই।’

‘১৯৪৩ সালের দিকে যুদ্ধে যোগ দিতে যায় ফ্রিকি, তাই না?’

আবার উদাস হয়ে গেল বৃদ্ধ। যেন কয়েক দশক পিছনে ফেলে আসা অতীত দেখার চেষ্টা করছে। ‘হ্যাঁ। আর ফিরল না ছেলেটা। যুদ্ধে পোল্যাণ্ডের কোথায় নাকি মৃত্যু হয়েছে তার। খবর পেয়ে একেবারে ভেঙে পড়ল জো। ছেলেই ছিল তার সব। তাকে নিয়ে অনেক আশা-ভরসা ছিল। তারপর…টেলিগ্রামে ফ্রিকির মৃত্যু-সংবাদ শোনার অল্প কয়েক বছর পর জো’রও মৃত্যু হলো। পঞ্চাশ সালে। লোকটার দুঃখের কথা মনে পড়লে এখনও কষ্ট হয়। এরপর তার বউটাও মরল।’

‘একটু আগে আপনি বললেন, ‘জো পরিবার নিয়ে এখানে আসার পরপরই’। কোত্থেকে এসেছিলেন জো? দক্ষিণ আফ্রিকার কোন অংশ থেকে?’ মাসুদ রানা প্রশ্ন করল। অনুবাদ করে দিল পিয়েনার।

মুখ দেখে মনে হলো যেন অবাক হলো ফ্রেডরিখ কূজ। ‘দক্ষিণ আফ্রিকা!’

‘তারা তো আফ্রিকানার ছিল, তাই না?’ মৃদু কণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন। আরও অবাক হলো বৃদ্ধ। ‘কে বলেছে-আপনাদের?’

‘আমরা তো তাই জানি। তাছাড়া আর্মির রেকর্ডেও সেরকমই লেখা।’

‘ও, বুঝেছি,’ হাসল লোকটা। ‘ফ্রিকি চালাকি করেছে। আফ্রিকানার বলে চালিয়ে দিয়েছে নিজেকে আর্মিতে।’

‘তাহলে ওরা…?’ প্রশ্নটা শেষ করতে পারল না হতভম্ব পিয়েনার। ‘জার্মান ছিল।’

‘জার্মান!’

ইয়েস, ক্যাপ্টেন। ইম্মিগ্রান্টস।’

ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইল রানা, ‘বহিরাগতদের রেকর্ডস কারা সংরক্ষণ করে আপনার দেশে?’

‘প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন বিল্ডিং।’

হাতঘড়ি দেখল মাসুদ রানা। ‘জেনারেল গেরহার্ডকে একটা টেলিফোন করতে চাই।’

‘শিওর। পুলিস স্টেশনে চলুন।

ওটাও ফ্লীট স্ট্রীটেই। দোতলা, হলুদ ইঁটে তৈরি। রানার অনুরোধের উত্তরে বললেন জেনারেল, ‘নিশ্চয়ই। অপেক্ষা করুন। চেক করছি আমি।’

ভাগ্যই বলতে হবে, ইউনিয়ন বিল্ডিঙের প্রায় সব কিছুই কম্পিউটর নিয়ন্ত্রিত। দু’মিনিটে ফাইল নম্বর বের করে ফেলল ওরা জেনারেল গেরহার্ডের নির্দেশে। ফাইলটা বের করে টেলেক্স মেশিনের সামনে বসল রেকর্ড কীপার স্বয়ং।

ইস্ট লণ্ডন পুলিস স্টেশনে কফি পান করার ফাঁকে মেসেজটার ওপর চোখ বোলাল মাসুদ রানা। তারপর নির্বিকার মুখে তুলে দিল ওটা অ্যানড্রিয়াসের হাতে।

দীর্ঘ মেসেজটা পড়া শেষ করে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল সে, ‘গুড গড! কে ভেবেছিল?’

‘এখানে ইহুদিদের কোন উপাসনালয় আছে?’ এক পুলিস অফিসারকে জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আছে, পার্ক অ্যাভিনিউতে। মাত্র দু’মিনিটের পথ।

ধপধপে সাদা রঙ করা, ওপরে কালো গম্বুজ। গম্বুজের শীর্ষে স্টীলের দণ্ড, ডেভিডের নক্ষত্র ধরে রেখেছে ওটা। প্রায় ফাঁকা সিনাগগ। একজন কেয়ারটেকার আছে কেবল। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে বয়স। মাথায় উলের কালো বনেট। মাসুদ রানার প্রশ্নের উত্তরে সিনাগগের বর্তমান র‍্যাবির ঠিকানা বলল লোকটা। বলল, ‘তাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।

কেয়ারটেকার সমবয়সীই হবে র‍্যাবি। তবে বেশ স্বাস্থ্যবান। গাল ভরা কাঁচাপাকা দাড়ি। আয়রন গ্রে চুল। এক নজর দেখেই বুঝে নিল মাসুদ রানা, একে খুঁজছে না ও। খুঁজছে আরও অনেক বয়স্ক একজনকে।

‘আপনার আগে কে র‍্যাবি ছিলেন এখানে, বলতে পারেন?’ প্রশ্ন করল ও।

‘আমার চাচা। র‍্যাবি শ্যাপিরো।’

‘বেঁচে আছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় পেতে পারি তাঁকে?’

‘ভেতরে আসুন।’

অন্দর মহলের দিকে রানাকে নিয়ে চলল র‍্যাবি। লম্বা করিডরের একেবারে শেষ মাথায় বন্ধ একটা দরজা। দু’বার মৃদু নক করে দরজা খুলল সে।

‘আঙ্কেল শ্যাপিরো, এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন আপনার সঙ্গে।

ঘর অন্ধকার বলে এতক্ষণ কিছু দেখতে পায়নি মাসুদ রানা। চোখ সয়ে আসতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই ভেতরে চোখ বোলাল ও। আসবাবপত্ৰ প্ৰায় কিছুই নেই ঘরে। চল্টা ওঠা কার্পেটের ওপর জড় পদার্থের মত বসে আছে থুরে এক বুড়ো। ছানি পড়া চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘন ঘন ওপর-নিচ করছে মুখটা। বোঝা গেল দেখতে পায় না।

ভেতরে ঢুকল রানা। ক্যাপ্টেনকে সঙ্গে আনেনি এবার। গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছে। দীর্ঘ সময় পর বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল ও।

এয়ারপোর্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *