অন্ধ শিকারী – ১.৮

আট

চওড়া মোটরওয়ে ধরে ডুয়েলফের দিকে ছুটছে রানা আর পিয়েনার। এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে এসেছে ওরা এরমধ্যে। নাইলস্ট্রম আর পটজিয়েটারস্বাস পিছনে ফেলে পিটার্সবার্গের দিকে চলেছে এখন। দুপাশে ধু-ধু আফ্রিকার বিশাল বিস্তৃতি। তারও ওপাশে, উত্তরে, যেখানে মাটি ছুঁয়েছে আকাশ, জিম্বাবুয়ের দক্ষিণ সীমান্ত।

হঠাৎ করেই রেবেকা সাউলের মুখটা ভেসে উঠল রানার মনের পর্দায়। একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করল ও। ভালবেসে ফেলেছিল মেয়েটি দুর্দান্ত ‘বেপরোয়া বাঙালি যুবক মাসুদ রানাকে। আজও ভুলতে পারেনি ও রেবেকার স্মৃতি। ভুলতে পারেনি সবিতা আর অনিতার স্মৃতিও। পারবেও না কোনদিন। থেকে থেকেই স্মৃতির আরশিতে উদয় হয় ওরা, বুকের কোথায় কোন গভীর গহনে অব্যক্ত এক বেদনা অনুভব করে মাসুদ রানা।

নড়েচড়ে বসল ও। একটা সিগারেট ধরিয়ে ডি অ্যাঙ্গাসের মধ্যে ডুবে গেল। ঠিক নয়টা পঞ্চাশে ডুয়েলফ পৌছল ওরা। গতি কমিয়ে খুদে শহরটির প্রধান রাস্তা বোথা অ্যাভিনিউতে গাড়ি ঢোকাল পিয়েনার। ‘কোথায় যেতে চান প্ৰথমে?’

‘লইয়ারের অফিসে,’ বলল রানা। গতকাল কথায় কথায় জেনারেল গেরহার্ডের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ও, এ দেশের ছোট ছোট মফস্বল শহরে সরকার নিয়োজিত একজন করে লইয়ার থাকে। সব ধরনের দলিল তার অফিসেই সম্পাদিত হয়।

একটা কাফের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল ক্যাপ্টেন অ্যানড্রিয়াস। ‘এদের কাছ থেকে লইয়ারের ঠিকানা জানতে হবে। চলুন, এই ফাঁকে এক কাপ কফিও পান করা যাক।

কফি সার্ভ করার আগেই ম্যানেজারকে প্রশ্ন করে ঠিকানা বের করে ফেলল ক্যাপ্টেন। ‘লোকটা অ্যাংলো,’ ফিরে এসে বলল সে। ‘নাম জনসন। কাছেই অফিস, রাস্তার ওপারে।’

অ্যানড্রিয়াসের ওয়ালেটে চোখ বুলিয়েই তড়াক করে আসন ছাড়ল জনসনের সেক্রেটারি। ভেতরের অফিসে গিয়ে ঢুকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসে বলল, ‘আসুন, প্লীজ।’

জনসন মাঝবয়সী, সম্ভবত পঞ্চাশের কাছাকাছি, অনুমান করল মাসুদ রানা। আমুদে স্বভাবের, বেশি কথা বলার মানুষ। মাসুদ রানাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল অ্যানড্রিয়াস। ‘লণ্ডন থেকে এসেছেন। কিছু তথ্য জানতে চান আপনার কাছে।’

ওদের বসতে ইশারা করল জনসন। ‘বলুন, কি সাহায্য করতে পারি।’

‘আপনার সঠিক বয়স কত, বলবেন দয়া করে?’ ভূমিকা বাদ দিয়ে সরাসরি জানতে চাইল রানা।

বিস্ময় চেপে পাল্টা প্রশ্ন করল লইয়ার, ‘লণ্ডন থেকে এতদূর এসেছেন আপনি আমার বয়স জানতে?’ পরক্ষণেই হাসল সে। ‘সরি।আমার তেপ্পান্ন চলছে।’

তার মানে ১৯৪৬ সালে আপনি বারো বছরের ছিলেন?’

একটু চিন্তা করে মাথা দোলাল লোকটা। ‘হ্যাঁ।’

‘ওই বছর এখানকার লইয়ার কে ছিলেন, বলতে পারেন?’

‘নিশ্চই। আমার বাবা, হ্যারি জনসন।’

‘উনি বেঁচে আছেন?’

‘হ্যাঁ, বহাল তবিয়তে। আশি ছাড়িয়ে গেছে বাবার বয়স। হলে হবে কি, এখনও প্রায় আমার মতই কর্মঠ। পনেরো বছর আগে রিটায়ার করেছেন তিনি।’

‘তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব?’

‘এক মিনিট,’ রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করল পুত্র জনসন। এক মিনিট লাগল না, আধ মিনিট পর রিসিভার রেখে রানার দিকে ফিরল। সম্ভব। উনি আসছেন। একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে।’ 

‘শিওর। এই ফাঁকে আপনাকেও একটু কষ্ট করতে হবে। পুরানো ফাইল ঘেঁটে চেক করে দেখুন, ওই বছর এখানকারই. এক কৃষিজীবী, নাম ভ্যান অ্যাঙ্গাস, কোন উইল সম্পাদন করেছিলেন কিনা।’

‘নিশ্চই, দেখছি,’ আসন ছাড়ল জনসন। ‘একটু সময় লাগতে পারে, অনেক দিন আগের কথা তো! এক্সকিউজ মি।’ বেরিয়ে গেল সে অফিস ছেড়ে।

মিনিট দশেক পর বাপ-বেটা এক সঙ্গে অফিসে ঢুকল। ছেলের হাতে ধুলোমাখা একটা কার্ডবোর্ড বক্স। মাথার চুল ধপধপে সাদা হ্যারি জনসনের। বয়সের ভারে সামান্য নুয়ে পড়েছে দেহ সামনের দিকে। কিন্তু দেখলেই বোঝা যায়, এখনও যথেষ্ট শক্তি ধরেন। রানাকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ছেলে। ঘুরে ডেস্কের ওপাশে গিয়ে বসলেন বৃদ্ধ ছেলের আসনে। আরেকটা চেয়ার টেনে বাপের পাশে বসল সে।

‘হ্যাঁ,’ বললেন প্রাক্তন লইয়ার। ‘ভ্যান অ্যাঙ্গাসের কথা পরিষ্কার মনে আছে আমার। সম্পত্তির উইল ‘করিয়েছিল সে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে। আমিই করেছি সে উইল।’ বক্স খুলে ভেতর থেকে ধূসর কভারের একটা ফাইল বের করলেন বৃদ্ধ। সোনালি ফ্রেমের একটা চশমা নাকে লটকে চোখ বোলাতে আরম্ভ করলেন ওটার ভেতরে। ‘হ্যাঁ, এই তো। সব আছে এখানে। বিপত্নীক ছিল ভ্যান অ্যাঙ্গাস। মৃত্যুর সময় কেউ ছিল না কাছে। একটিই সন্তান তার, ডি অ্যাঙ্গাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছে সে। যুদ্ধ শেষে ডি অ্যাঙ্গাস যখন দেশে ফিরে আসে, ঠিক তখনই মৃত্যু হয় ভ্যানের। ছেলেকে রিসিভ করতে কেপ টাউন যাওয়ার পথে,’ থেমে মাথা দোলালেন বুড়ো জনসন। ‘খুবই দুঃখজনক।’

‘সম্পত্তি কাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি?’ প্রশ্ন করল মাসুদ রানা।

‘ছেলেকেই। যাবতীয় কিছু। অনেক বড় কৃষি খামার ছিল ভ্যানের। খামার, বাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতি সব দিয়ে গেছে ছেলেকে।’

‘আর কাউকে কিছুই দেননি তিনি?’

চোখ নামিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টালেন বৃদ্ধ। ‘হ্যাঁ, একটা আইভরির দাবা সেট দিয়ে গিয়েছিল তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। অবসর সময়ে তার সঙ্গেই দাবা খেলত ভ্যান ওই সেট দিয়ে।’

‘এই খামার আর অন্যান্য সম্পত্তি এখন কি অবস্থায় আছে, মিস্টার জনসন?’

‘অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে।

‘আপনার উপস্থিতিতে নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ। তবে বিক্রি করেছে আসলে অকশনিয়ার। আমি উপস্থিত ছিলাম উইলের এক্সিকিউটর হিসেবে।’

‘ওসবের মধ্যে ভ্যান অ্যাঙ্গাসের এমন কোন ব্যক্তিগত কিছু কি ছিল, যা বিক্রি হয়নি? আই মীন আপনার জানামতে?’

ভুরু কুঁচকে ভাবলেন বৃদ্ধ। ‘না, তেমন কিছু ছিল না। সবই বিক্রি…হ্যাঁ, ছিল, মনে পড়েছে। একটা পারিবারিক ফটো অ্যালবাম ছিল ভ্যানের। কমার্শিয়াল মূল্য নেই বলে ওটা বিক্রি হয়নি।’

উৎসাহিত হয়ে উঠল মাসুদ রানা। মনে মনে এ ধরনেরই কিছু একটা চাইছিল ও। ‘ওটা আছে আপনার কাছে?’

‘না, দুঃখিত। ভ্যানের সেই বন্ধুই ওটা চেয়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে।

‘তিনি কে?’

‘নাম ভ্যান বার্গ,’ বলল ছেলে, ‘আমার স্কুল শিক্ষক ছিলেন ভদ্রলোক।’

‘বেঁচে আছেন?’

‘না। প্রায় দশ বছর আগে মারা গেছেন,’ বললেন বুড়ো জনসন। ‘তাঁর এক মেয়ে আছে, সিসি। আমার ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল,’ আবার নাক ঢোকাল ছোট জনসন।

‘কোথায় আছে সে, জানেন?’

‘হ্যাঁ, এই শহরেই আছে। যানিন রোডে বাসা।’

বৃদ্ধের দিকে ফিরল মাসুদ রানা। ‘ভ্যান অ্যাঙ্গাসের সম্পত্তি কেন বিক্রি করা হয়েছিল? কার কথায়?’

তার ছেলের কথায়, অবশ্যই। সে সময় ছেলেটা কেপ টাউনের ওয়েনবার্গ মিলিটারি হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিল। টেলিগ্রামে সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল সে আমাকে। টেলিগ্রাম পেয়ে তার সত্যতা যাচাই করার জন্যে আমি ডি অ্যাঙ্গাসের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠাই। নিজে যাওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তখনকার দিনে ট্রেন ছাড়া যোগাযোগের আর কোন পথ ছিল না। অতদূর আসা-যাওয়ায় প্রায় আট-দশদিন লেগে যেত। তাই, মানে, ব্যবসার কথা চিন্তা করে ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারিনি। অ্যাঙ্গাসের কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় সম্পর্কে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে চিঠি পাঠায়। তারপর ওগুলো বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং টাকাগুলো অ্যাঙ্গাসের অনুরোধে ওই হাসপাতালের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই।’

‘পিতার শেষকৃত্যে আসেনি সে?’

‘না। এলেও পেত না। জানুয়ারি আমাদের এখানে পুরো গরমের সময়। মর্গের সুবিধে সেকালে তেমন ছিল না; তাই তাড়াতাড়ি সমাধিস্থ করা হয় ভ্যান অ্যাঙ্গাসকে। আর সুযোগ থাকলেই যে আসত সে, আমি মনে করি না। শেষ সম্বল বাপই যখন নেই, এতদূর ছুটে এসে কি লাভ হতো তার?’

মন্তব্যটা যেন মনে ধরেছে ক্যাপ্টেন পিয়েনারের। এই প্রথম মুখ খুলল সে এতক্ষণে। ‘ঠিক। ভ্যান অ্যাঙ্গাসের কবরটা কোথায়?’

‘পাহাড়ের ওপর। কবরস্থানে।’

জনসন জুনিয়রের কাছ থেকে স্কুল শিক্ষকের মেয়ে সিসির ঠিকানা নিয়ে বাপ-বেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। সিসির স্বামীর করাত কলের ব্যবসা আছে। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না অফিসে। এক কর্মচারী কারখানার পিছনে মালিকের বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল রানা আর পিয়েনারকে। স্থানীয় ভাষায় সিসিকে ওদের আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করল সে।

সব শুনে নেতিবাচক মাথা দোলাল মহিলা। দাবার কথা মনে আছে। কিন্তু অ্যালবাম…নাহ্! মনে পড়ছে না।’

‘আপনার বাবার মৃত্যুর পর তার জিনিসপত্র আপনিই তো পেয়েছেন?’ ‘না। ওসব বাবার বাড়িতেই আছে। তার অনেক আগেই বিয়ে হয় আমার। তারপর আর ওসব দিকে নজর দেয়ার খুব একটা সুযোগ পাইনি বাবার বিধবা এক বোন আছেন ও বাড়িতে। তিনিই বর্তমানে ওগুলোর মালিক।’

ঠিকানা নিয়ে আবার পথে নামল ওরা দুজন। ভাইয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই চোখে পানি এসে গেল বৃদ্ধার। উঠে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে একটা ছোট কাঠের বাক্স বের করে নিয়ে এল। ‘বেচারা! সারাদিন এই দাবা নিয়েই পড়ে থাকত। এটাই তো খুঁজছেন আপনারা?’

‘না, এটা নয়। আরেকটা জিনিস। একটা অ্যালবাম।’

‘অ্যালবাম!’ কিছু ভাবল বৃদ্ধা। ‘দাঁড়ান, দেখি। আছে মনে হয়। একবার দেখেছিলাম।’ ভেতরে চলে গেল সে।

ফিরে এল পুরো দশ মিনিট পর। হাতে একটা চামড়া বাঁধানো অ্যালবাম। ‘এই যে, পেয়েছি।’

নিল ওটা মাসুদ রানা। পুরু কভার তুলে ভেতরে তাকাল। হ্যাঁ, ঠিকই আছে। ভ্যান অ্যাঙ্গাসের পারিবারিক অ্যালবাম। সেই ১৯২০ সাল থেকে তোলা নানা উপলক্ষের ছবি। ডি অ্যাঙ্গাসের অ্যাংলো মায়ের বিয়ের পোশাক পরা লাজুক হাসিমাখা একটা ছবি দেখল রানা কিছুক্ষণ। ‘২০ সালে, বিয়ের সময় তোলা। অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন মহিলা। ‘২৫ সালে জন্ম হয় তার একমাত্র সন্তানের। বিয়ের পাঁচ বছর পর। ‘৩০ সালে তোলা তাঁর আরেকটা ছবির ওপর নজর পড়ল। শিশু অ্যাঙ্গাসকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন।

কাগজ লাল হয়ে এলেও ছবিগুলো এখনও বেশ স্পষ্ট। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার থামল রানা। জীবনে প্রথম টাট্টু ঘোড়ার পিঠে ওঠার কসরৎ করছে কিশোর অ্যাঙ্গাস। দূরে দাঁতে পাইপ কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছেন ভ্যান অ্যাঙ্গাস। চোখেমুখে তাঁর ফুটে আছে পিতৃত্বের অহঙ্কার। পায়ের সামনে এক দল খরগোশ হুটোপুটি করছে।

সবার শেষের ছবিটার ওপর আবার দৃষ্টি থমকাল রানার। সতেরো বছরের তরুণ, স্মার্ট ডি অ্যাঙ্গাস। পরনে ক্রিকেট ফ্যানেল। উইকেটের দিকে ছুটে আসছে বল করতে। ছবির নিচে ক্যাপশন : ডি অ্যাঙ্গাস, ক্যাপ্টেন অভ ক্রিকেট, মেরেনস্কি হাই স্কুল, ১৯৪৩। ওটাই শেষ ছবি অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল রানা ছবিটার দিকে। ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে চেহারা।

‘আমরা অ্যালবামটা নিয়ে যেতে পারি?’ রানার মনের ভাব টের পেয়ে আগেভাগে নিজে থেকেই বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করল ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রিয়াস।

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার ভাই কখনও মিস্টার ভ্যান অ্যাঙ্গাসের গল্প করেছেন আপনার সঙ্গে?’

করবে না কেন! অনেকবার। কতদিনের পুরানো বন্ধুত্ব ছিল ওদের।’

‘কিভাবে অ্যাঙ্গাস মারা যান, শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ। কেন, আপনাদের বলেনি বুড়ো জনসন? আসলে বুড়োর স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অ্যাঙ্গাস মারা গেছে একটা হিট্‌-অ্যাণ্ড রান অ্যাকসিডেন্টে।’ কথাটা কানে যাওয়ামাত্র শক্ত হয়ে গেল মাসুদ রানা। ‘ছেলেকে রিসিভ করতে কেপ টাউন যাচ্ছিল সে। পথের মাঝে গাড়ির ফুটো হয়ে যাওয়া টায়ার বদল করার সময় একটা দ্রুতগামী ট্রাক চাপা দেয় বেচারা অ্যাঙ্গাসকে। প্রথমে ধারণা করা হয়, ট্রাক চালক মাতাল ছিল। কিন্তু…।’ আচমকা থেমে গেল বৃদ্ধা, চেপে ধরল নিজের মুখ। আড়চোখে মাসুদ রানার কঠিন মুখের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন এক পলক।

‘দুঃখিত। এসব নিয়ে আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে না আমার। সে যাই হোক, সেই চালকটির খোঁজ আর কোনদিন পাওয়া যায়নি।’

গাড়িতে এসে উঠল রানা আর পিয়েনার। রানা গম্ভীর। অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে টোকা মারছে অনবরত অ্যালবামের শক্ত চামড়ার ওপর।

‘এবার?’ বলল ক্যাপ্টেন।

‘পাহাড়ে। কবরস্থানে। ‘

ভুরু কুঁচকে গাড়ি স্টার্ট দিল পিয়েনার। ডুয়েলসূফ্লুফের মাইল দুয়েক উত্তরে, ছোটখাট এক পাহাড়ের ওপর জায়গাটা। কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত, সমাহিত। ঠিক কবরের মতই। অনেক নিচে ডুয়েলফ। ছবির মত। বিশাল এক মাওয়াটাবা গাছের নিচে ভ্যান অ্যাঙ্গাসের কবর। ওর মাথার কাছে পাথরের স্মৃতি ফলকে বসে অদ্ভুত সুরেলা কণ্ঠে গান গাইছে ছোট একটা নাম না জানা পাখি। যেমন সুন্দর সুর, তেমনি পাখির চেহারা।

রানাকে এগিয়ে আসতে দেখে গান থামিয়ে গলা টান করে উড়ি উড়ি ভাব নিয়ে বসে থাকল পাখিটা। কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মাসুদ রানা। চোখ বোলাল ফলকে। গ্র্যানিট পাথরে খোদাই করে লেখা : ভ্যান অ্যাঙ্গাস, জন্ম ১৮৭৯, মৃত্যু ১৯৪৬, অলওয়েজ উইথ গড। অনেকক্ষণ ধরে সেদিকে চেয়ে থাকল ও।

পায়ের কাছে একটা জংলা গাছের লম্বা ডালওয়ালা ফুল ছেঁড়ার জন্যে ঝুঁকল ও। বিপদ ভেবে সুড়ৎ করে উড়াল দিল পাখি। ফুলটা নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে কবরের মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রানা। আলতো করে রেখে দিল ওটা ভ্যান অ্যাঙ্গাসের বুক সোজা। তাজ্জব হয়ে ওর কার্যকলাপ দেখছে পিয়েনার দূর থেকে।

একটু পর রওমা হলো ওরা ফিরতি পথে। পিছন ফিরে পাহাড়টার দিকে তাকাল রানা শেষবারের মত। গাঢ় মেঘ জমেছে ডুয়েলফের আকাশে। এখনই নামবে হয়তো বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে সব পাপ-পঙ্কিলতা হয়তো ধুয়েমুছে যাবে, যাবে না কেবল একটি সত্য, গোপন করে যাওয়া চরম এক সত্য। যা আবিষ্কার করেছে হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসা অনুসন্ধিৎসু এক বাঙালি যুবক, মাত্র কিছুক্ষণ আগে।

কবরে ফুল দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করবে বলে মুখ ঘোরাল অ্যানড্রিয়াস পিয়েনার। কিন্তু চোখ বুজে রানাকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে করল না।

মস্কো। ইয়াসিনেভোর সাততলা ফার্স্ট চীফ ডিরেক্টরেটের চারতলায়, নিজের বিশাল অফিস রূমে চিন্তিত মুখে বসে আছেন এর প্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিচ বরিসভ। ছয় ফুটের মত লম্বা ভদ্রলোক। বয়স বাষট্টি। গোল থালার মত বড়সড় মুখটা টকটকে লাল। বুদ্ধিদীপ্ত বড় বড় নীল চোখ। সোনালি চুল, এলোমেলো। জানালা দিয়ে সড়কের দু’ পাশে বরফের টুপি পরে দণ্ডায়মান সারি সারি পাইনের দিকে চেয়ে আছেন তিনি।

আজ রোববার। সরকারি ছুটির দিন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী সবাই পেরেদেলকিনোয় তাঁর দাচায় অবসর কাটাতে গেছে। যেতে পারেননি কেবল জেনারেল বরিসভ। এ ধরনের উঁচু পদে থাকলে যা হয়; বিনা নোটিসে ঘাড়ে এসে চাপে ঝামেলা, আজও তাই হয়েছে। কোপেনহেগেন থেকে জরুরি এক বার্তা আসার কথা, তাই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বসে আছেন তিনি প্রায় জনমানবহীন এফসিডি বিল্ডিঙে।

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠলেন বরিসভ। রিসিভার তুললেন। ‘ইয়েস?’

‘কমরেড মেজর জেনারেল ভ্লাদিমির চেরনোভস্কি লাইনে অপেক্ষা করছেন, কমরেড জেনারেল।

‘লাইন দাও,’ কোঁচকানো ভুরু আরও কুঁচকে উঠল তাঁর। ‘ভ্লাদিমির, কি ব্যাপার? এমন অসময়ে?’

‘হ্যাঁ, দুঃখিত। বাসায় না পেয়ে দাচায় চেষ্টা করেছিলাম। লুদমিলা বলল কি কাজে অফিসেই রয়েছ তুমি।’

‘হ্যাঁ। জরুরি একটা কাজ পড়ে গেছে। সে যাক, বলো, কি খবর?’ ‘তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। খুব জরুরি, বরিসভ।’

‘বেশ তো, চলে এসো। নাকি চাইছ, আমি আসি?’

‘এলে খুব ভাল হয়।’

‘ঠিক আছে; কাল আসা যাবে।

‘কাল নয়, বরিসভ। আজই।’

‘আজই! কপালও কুঁচকে উঠল এবার জেনারেলের। ‘ভ্লাদিমির, ব্যাপার কি? কোন অসুবিধে?’

‘সামনা-সামনি বলব।’

ঠিক, নিশ্চয়ই কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে। চেরনোভস্কি তাঁর স্কুল জীবনের বন্ধু। খুব সহজে উতলা হওয়ার মানুষ তিনি নন। খুব সম্ভব জটিল কিছু হবে। ‘অল রাইট, স্টারেট। কোথায় আসতে হবে?’

‘আমার বাসায় চলে এসো।’

‘কখন?’

‘সন্ধেয়। ধরো, ছ’টায়?’

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন বরিসভ। যাও বা একটু আশা ছিল বিকেলে দাচায় যাওয়ার, দিল ব্যাটা নষ্ট করে। তবে তা নিয়ে মনে আক্ষেপ নেই তাঁর। ভ্লাদিমির যখন এত জরুরিভাবে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই মারাত্মক কিছু না হয়ে যায় না। ক্ষতিটা পুষিয়ে যাওয়ার চান্স আছে। ‘ঠিক আছে। ঠিক ছ’টায় পৌঁছে যাব আমি।’

‘ধন্যবাদ,’ চেপে রাখা দম ছাড়লেন চেরনোভস্কি। ‘তোমার জন্যে স্পেশাল ভদকা রেডি থাকবে।

রিসিভার রেখে দিলেন জেনারেল বরিসভ। বেশিরভাগ রুশ থেকে উল্টো তিনি, মদ খুব একটা পছন্দ করেন না। যখন করেন, হয় আমেরিকান ব্র্যাণ্ডি, নয়ত স্কচ। ওগুলো তাঁর জন্যে লণ্ডন থেকে আসে। বহু বছর ওদেশে কাটিয়ে এসেছেন জেনারেল। তখনই রুচির পরিবর্তন ঘটে তাঁর। ভদকা তেমন রোচে না। তবুও, খেতেই হয় মাঝেমধ্যে, নানান সরকারি পার্টিতে- ফাংশানে। তা-ও বড়জোর ভদকা। ভদকা? নাক কোঁচকালেন জেনারেল, অসহ্য!

ঠিক ছ’টায় মেজর জেনারেলের স্পাসকায়া প্রসপেক্টের ফ্ল্যাটে পৌছলেন বরিসভ। সাইবেরিয়ান শার্ট, কর্ড ট্রাউজারস আর নরম সোলের জুতো পরা চেরনোভস্কি নিজেই দরজা খুললেন। ভদ্রলোক পার্মানেন্ট ব্যাচেলর। আধ গ্লাস করে কড়া ভদকা নিয়ে মুখোমুখি বসলেন দুই বন্ধু। টুকটাক মামুলি দুয়েকটা বাক্য বিনিময়ের পর বরিসভই প্রথম প্রসঙ্গ তুললেন। ‘তারপর, স্টারেট, বলো কি সমস্যা।’

চেরনোভস্কি তার তিন-চার বছরের বড়। তাবে সার্ভিসে এক র‍্যাঙ্ক নিচে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, রাশভারি মানুষ। চেহারা অনেকটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের মত। সহকর্মীরা প্রায় সবাই তাঁকে পছন্দ করে তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে। তারাই মেজর জেনারেলের নাম দিয়েছে স্টারেট। অর্থাৎ, দ্য ওল্ড ম্যান বা বন্ধু বরিসভের চোখে চোখ রাখলেন চেরনোভস্কি। ‘আমাদের বন্ধুত্ব কত বছরের ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিচ?’

বিস্মিত হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। ‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন? ‘বলোই না।’

‘বহু বছরের। সত্যি কথা বলতে, স্মরণাতীত কালের।’

‘এর মধ্যে আমি কি তোমার কোন অসুবিধে করেছি? কখনও?

‘তোমার হয়েছে কি, চেরনোভস্কি?’

আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

‘তুমি আমার বন্ধু, তুমি কেন আমার অসুবিধে করতে যাবে?’

‘আবারও ঘুরিয়ে বলছ?’

‘আচ্ছা বারা, না। করোনি। হলো?’ হয়েছে কি আজ ওর? ভাবলেন তিনি।

‘তাহলে তুমি কেন এই শেষ বয়সে আমার ডিপার্টমেন্টের পিছনে লেগেছ?’

প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে বসলেন বরিসভ। এ অভিযোগ কেন আমার বিরুদ্ধে?

‘কি ঘটেছে তোমার ডিপার্টমেন্টে, খুলে বলছ না কেন, ভ্লাদিমির?’

‘কি আর ঘটবে!’ তীব্র হতাশা আর আক্ষেপ প্রকাশ পেল তাঁর কণ্ঠে। ‘বরবাদ করে দেয়া হয়েছে আমার সব। বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়েছে এস- এর। হয় তুমি রয়েছ এর পিছনে, নয়ত জানো কী চলছে ভেতরে ভেতরে। কি করে কাজ চালাব আমি, যেখানে আমার সেরা মানুষগুলোকে, সেরা ডকুমেন্টস, ফ্যাসিলিটিজ সব বিনা নোটিসে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে? আমার এত বছরের সাধনা…সব এক নিমেষে তছনছ করে দেয়া হয়েছে!’

সম্ভবত এই প্রথম ভ্লাদিমির চেরনোভস্কিকে রাগতে দেখলেন এফসিডি চীফ। অথচ সবাই জানে এঁর মত ঠাণ্ডা মানুষ খুব কমই হয়। মনের ভেতর সতর্ক সঙ্কেত বেজে উঠল লেফটেন্যান্ট জেনারেলের। যা-ই ঘটে থাকুক, ঘটেছে। অথচ তিনি জানেন না বিন্দু বিসর্গ। কেন? তিনি ডিরেক্টরেট চীফ, তাঁকে না জানিয়ে ‘এস’-এর ওপর হাত দেয়ার ক্ষমতা নেই কারও। অন্তত তা তাঁর নলেজে থাকতে হবে। ব্যাপার যত গোপনীয়ই হোক। সামনে ঝুঁকে বসলেন জেনারেল বরিসভ। ‘স্টারেট, তুমি বিশ্বাস করো আর না-ই করো, আমাদের বন্ধুত্বের শপথ করে বলছি, এ ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি। কিচ্ছু জানি না। সত্যি বলছি। এবার দয়া করে খুলে বলো কি হয়েছে।

এবার চেরনোভস্কি বিস্মিত হলেন। কারণ তাঁরও জানা আছে, চীফকে না জানিয়ে তারই অঙ্গ সংগঠনে হাত দেয়ার কারও উপায় নেই।কয়েক মুহূর্ত আহাম্মকের মত চেয়ে থাকলেন জেনারেল বন্ধুর দিকে। ‘বেশ, শোনো। প্রথম দিন দুই হারামজাদা এল আমার অফিসে, সেন্ট্রাল কমিটির অনুমোদন নিয়েই। বলল, আমার সেরা ইল্লিগ্যালটিকে তাদের চাই। ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও কমিটির নির্দেশ, কি করব, দিয়ে দিলাম। ভেবে দেখো, যাকে আমি নিজে বছরের পর বছর ট্রেনিঙ দিয়েছি ভবিষ্যতে বড় কোন কাজে লাগানোর আশায়, এক কথায় দিয়ে দিতে হলো তাকে।’

‘তারপর?’

‘ভাবলাম, আপদ বিদেয় হয়েছে। কিন্তু দুদিন পর আবার হাজির ওরা।’

‘কারণ?’

‘আমার সেরা ‘লিজেণ্ড’ ওদের চাই,’ টেবিলের ওপর প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিলেন মেজর জেনারেল। ‘দশ বছরেরও বেশি লেগেছে আমার ওই কভার স্টোরি ফুলপ্রুফ করতে, জানো?

কোনটা কি, জানা আছে ভ্যাসেলিয়েভিচ বরিসভের। এক সময় তিনিও ছিলেন ‘এস.’-এর প্রধান পদে। এসব তখন তাঁকেও করতে হয়েছে। ধীরস্থির গলায় জানতে চাইলেন, ‘কাকে দিয়েছ ওদের?’

‘কাকে আবার, মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভকে! মনে আছে তোমার ওর কথা?’

নীরবে মাথা দোলালেন বরিসভ, আছে। বেশিদিন নয়, মাত্র বছর দুয়েক তিনি ‘এস’-এর প্রধান ছিলেন। তবু, এখনও ভ্যালেরিকে মনে আছে তাঁর। অন্যদের কথাও। ‘ইনডেন্টগুলোর অথরিটি কে ছিল?’

‘টেকনিক্যালি সেন্ট্রাল কমিটি। তবে রেটিং…।’ ডান হাতের তর্জনি তুললেন তিনি সিলিঙের দিকে।

কি বোঝাতে চাইছেন বন্ধু, বুঝে নিলেন বরিসভ পলকে। ‘ঈশ্বর?’

‘কাছাকাছি,’ মুখ বিকৃত করলেন চেরনোভস্কি। ‘আমাদের প্রিয় জেনারেল সেক্রেটারি। অন্তত আমার তাই ধারণা।’

‘হুঁম! আর কিছু?’

‘অনেক কিছু। আবারও এসেছিল ওরা।’

‘কি চাইল সেবার?’

‘চার বছর আগে তুমি ব্রিটেনে যে গোপন ট্র্যান্সমিটারগুলো স্থাপন করে রেখে এসেছিলে, তার একটা রিসিভার ক্রিস্ট্যাল। এই কারণেই আমি ভেবেছি তুমি এর পিছনে না থেকে পারো না।’

চোখের পাতা সরু হয়ে এল জেনারেল বরিসভের। যখন ইল্লিগ্যালস- এর প্রধান ছিলেন তিনি, ন্যাটো তখন ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে পার্সিং টু এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র বাড়িয়েই চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। এ নিয়ে পলিট ব্যুরোর দুশ্চিন্তা দিন দিন বেড়ে চলছে, ঘন ঘন মীটিঙে বসছে ব্যুরোর সদস্যরা।

এরপর এক সময় তাদের নির্দেশ এল, পশ্চিম ইউরোপে নাশকতামূলক অপারেশন চালানোর জন্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, প্রস্তুত করতে হবে অপারেশনের ক্ষেত্র। কন্টিঞ্জেন্সি প্ল্যান তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে যাতে সংক্ষিপ্ততম সময়ের নোটিসে পুরো পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র যুগপৎ কার্যকর করা যায় প্ল্যানগুলো।

ওই নির্দেশের ভিত্তিতেই সে অঞ্চলে অনেকগুলো ক্যানডেস্টাইন রেডিও ট্র্যান্সমিটার স্থাপন করেছিলেন জেনারেল বরিসভ। ওর মধ্যে তিনটে বসানো হয় ব্রিটেনে। মস্কো থেকে পাঠানো যে কোন বার্তা গ্রহণ করতে সক্ষম অত্যাধুনিক সেট ওগুলো। ওদের মাধ্যমে পাঠানো বার্তার বক্তব্য ধারেকাছে অবস্থানরত কেজিবির কোন এজেন্টকে উদ্ধার করতে হলে বিশেষভাবে তৈরি ক্রিস্ট্যাল রিসিভার ব্যবহার করতে হবে। কোডেড বার্তা ডি-কোড করে দিয়ে তার সময় ও পরিশ্রম, দুটোই বাঁচিয়ে দেয় এই রিসিভার। অবশ্যই তাকে ‘প্রোগ্রামড্’ ক্রিস্ট্যাল হতে হবে। এগুলো সব সময় ‘এস’-এর স্টোরে, কড়া নিরাপত্তার মাঝে রাখা হয়।

ট্র্যান্সমিটারগুলোর প্রহরার দায়িত্বে ইউরোপে রয়েছে যে সব কেজিবি এজেন্ট. তারা সবাই ‘স্লীপার’। জেগে জেগে ঘুমিয়ে আছে। ঘুম তখনই ভাঙবে, যখন আর কোন এজেন্ট তাদের সামনে সঠিক আইডেন্টিফিকেশন কোডটি উচ্চারণ করবে।

‘রিসিভার কোনটা নিয়ে গেছে,’ যেন কিছুই হয়নি, কিছুই ঘটেনি, এমনভাবে জানতে চাইলেন বরিসভ।

‘যেটার নাম তুমি দিয়েছিলে পপলার।

মাথা দোলালেন এফসিডি প্রধান। নিজ হাতে ব্রিটেনেরগুলো স্থাপন করেছিলেন তিনি। কোথায় কোনটা আছে, কোনটার কোড নেম কি, ওগুলোর পাহারায় যারা রয়েছে, তাদের কার কি নাম, কি কোড নেম, কোড নম্বর, সব আজও পরিষ্কার মনে আছে তাঁর। তিনটেই লণ্ডন ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে বসানো আছে। অন্য দুটোর নাম হ্যাকনি এবং সোরেডিচ্। ‘আরও কিছু, স্টারেট?’

‘হ্যাঁ। মেজর ক্রিপচেঙ্কোকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ডিপার্টমেন্ট ‘ভি’ বা এক্সিকিউটিভ অ্যাকশনে ছিল মেজর এক সময়। এখন কিসে আছে জানেন না জেনারেল। ‘এর স্পেশালিটি কি?

‘ক্যানডেস্টাইন প্যাকেজ এদেশ ওদেশ আনা-নেয়া করা।’

‘মানে স্মাগলিঙ?’

হ্যাঁ। পশ্চিম ইউরোপের সবগুলো বর্ডার পয়েন্ট তার নিজ হাতের তালুর মতই পরিচিত। জানে কি করে কাস্টমস্ আর ইমিগ্রেশনকে পাশ কাটানো সম্ভব।’

‘তোমাকে প্রথমেই বলেছি, স্টারেট, আমি এর কিছুই জানি না। এ আমার অপারেশন নয়, বিশ্বাস করো। কোন সন্দেহ নেই; এটা অনেক ওপরের মহলের কাজ। তোমার-আমার ধরাছোঁয়ার বাইরের। কাজেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিপদ ডেকে আনতে পারে। শান্ত থাকার চেষ্টা করো, লোকসানের কথা ভুলে যাও। আমি খোঁজ-খবর কিছু বের করতে পারি কি না, দেখব। তুমি একদম চেপে যাও সব। ডু নাথিং, সে নাথিং।’

‘ঠিক আছে।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন এফসিডি চীফ। একেবারে আচমকা চিন্তাটা ঢুকল তাঁর মাথায়।গত প্রায় দুই সপ্তাহ দেখা নেই জিআরইউ প্রধান জেনারেল মার্চেঙ্কোর। কেন? কোথায় তিনি? এর সঙ্গে তাঁর কি কোন যোগসাজশ আছে? জানালার কাঁচ ইঞ্চি খানেক নামিয়ে মাথায় ঠাণ্ডা বাতাস লাগালেন জেনারেল কিছুক্ষণ। প্রশ্নটা মাথা গরম করে তুলেছে।

কালই এ ব্যাপারে পুরোপুরি খোঁজ নেবেন তিনি গোপনে। তাঁকে না জানিয়ে কোথায় কি ঘটতে চলেছে, জানার পুরো অধিকার রয়েছে কেজিবির ‘ইল্লিগ্যালস তথা এস’ ডিরেক্টরেট প্রধানের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *