সাত
কেজিবির হেড অফিস মস্কো কেন্দ্রের দুই নম্বর দরেঝিনস্কি স্কয়ারে হলেও এর বিভিন্ন ডিরেক্টরেট ছড়িয়ে আছে সারা শহরময়। ওখানে স্থানাভাবের কারণে। শহর বেষ্টন করা আউটার রিঙ রোড ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে, ইয়াসিনেভোয় তার এক শাখা; ফার্স্ট চীফ ডিরেক্টরেটের হেড অফিস।
ভবনটি সাততলা। অ্যালুমিনিয়াম আর পুরু টিনটেড গ্লাস মোড়া ভবনটির সঙ্গে ইঁট-সিমেন্টের কোন সংশ্রব আছে দেখলে মনেই হয় না। ডিজাইন সর্বাধুনিক। ওর মাথায় শোভা পাচ্ছে বড় চকচকে এক স্টীলের বৃত্তের মাঝে তিন কোনা বিশিষ্ট নক্ষত্র। অনেকটা মার্সিডিজ গাড়ির লোগোর মত। এফসিডির প্রতীক ওই নক্ষত্র। শহরের বাইরে বলে সুবিধেই হয়েছে, এফসিডির, অন্যদের মত তাদের ওপর সারাক্ষণ নজরদারি করতে পারে না পশ্চিমা চোখ, বিশেষ করে সিআইএ।
গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে ফার্স্ট চীফ ডিরেক্টরেট শীর্ষে। বাইরে তো বটেই, দেশের ভেতরেও ছদ্ম পরিচয়ে থাকে এর অপারেটররা। বিদেশে যারা আছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ‘কূটনীতিক’। এফসিডির অধীনে আরেক ডিরেক্টরেট, ‘এস’ বা ইলিগ্যালস্ ডিরেক্টরেট। এফসিডি যদি সিক্রেট হয়, তো ‘এস’ টপ্ সিক্রেট। ডিরেক্টরেটের অন্য সব শাখার সহকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা দূরে থাক, ওরা নিজেরা নিজেরা পর্যন্ত মুখোমুখি হয় না কখনও। এদের ট্রেনিঙ এবং ব্রিফিঙ হয় ওয়ান-টু-ওয়ান, কেবলমাত্র গুরু এবং শিষ্য পদ্ধতিতে। এরা অন্যদের মত নিয়মিত হাজিরা দেয় না অফিসে, কারণ তাতে মুখ চেনাচিনি হয়ে যাবে। ইল্লিগ্যালসদের মধ্যে পুরুষ যেমন আছে, তেমনি মেয়েও আছে। এরা হাইলি ট্রেইনড্। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে এরা ‘ডীপ কাভার’ এজেন্ট হিসেবে।
এত যাদের সতর্কতা, গোপনীয়তা, তাদের প্রধান কিন্তু এই ভবনে বসেন না। বসেন দুই দযেরঝিনস্কি স্কয়ারে। কারণ তাতে সহকর্মীদের’ সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সুবিধে। পঁয়ষট্টি প্রায় ছাড়িয়ে গেছে ভদ্রলোকের বয়স। মেজর জেনারেল ভ্লাদিমির চেরনোভস্কি। জীবনের চারভাগের তিনভাগই কেটেছে তাঁর বিদেশে বিদেশে, ডীপ কাভার এজেন্ট হিসেবে।
অ্যালবিয়ন কমিটি তাদের ‘প্ল্যান অরোরা’ ঘোষণা করার দুদিন পরের ঘটনা। দুপুরের দিকে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন জেনারেল আয়েশ করে, অপরিচিত দুই ব্যক্তি ঢুকল ভেতরে। তাদের একজন একটা চিঠি এগিয়ে দিল। পড়লেন ওটা চেরনোভস্কি। মেজাজ খিঁচড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।যদিও ভাবটা সযত্নে গোপন করে গেলেন। নিচু গলায় বললেন, ‘আপনারা যেমন চাইছেন, তেমন একজনই মাত্র আছে আমার অধীনে। কিন্তু হাতের কাছে নেই সে। দূরে আছে।’
‘তাহলে, কমরেড মেজর জেনারেল,’ চিঠি হস্তান্তরকারী লোকটি বলল। ‘আজই ওকে ডিটাচ করুন। এবং এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলুন,’ সেন্ট্রাল কমিটির একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল সে ‘এস’ প্রধানের দিকে।
আগন্তুক দু’জন বিদেয় নিতে আরেকবার চিঠিটা পড়লেন মেজর জেনারেল। চোখ বোলালেন কার্ডটির ওপরও। তারপর মাথা দোলালেন। কিচ্ছু করার নেই। যাঁর কাছ থেকে এসেছে এই চিঠি এবং কার্ড, তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রশ্নই আসে না। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন চেরনোভস্কি। সেরা মানুষটিকে হাতছাড়া করতে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি আর করা, উপায় নেই। ছাড়তেই হচ্ছে।
বাঁ হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ টিপলেন তিনি। ‘মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভকে বলো আমার অফিসে রিপোর্ট করতে।’
দাচার বিশাল সীটিংরূমে যখন নিয়ে আসা হলো তাকে, রীতিমত কাঁপুনি উঠে গেছে মেজর তাতায়েভের। ঘন ঘন ঢোক গিলছে সে। জীবনে কখনও সামনাসামনি হয়নি সে প্রেসিডেন্টের, হবে বলে স্বপ্নেও ভাবেনি। ভয়ে ভয়ে আছে বেশ। গত তিনটে দিন বড্ডো আতঙ্কে কেটেছে তার।
স্পেশাল ডিউটি থেকে সরিয়ে এনে সেন্ট্রাল মস্কোর এক ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছে তাকে এ ক’দিন। নাইনথ্ ডিরেক্টরেটের দু’জন করে গার্ড সরাক্ষণ পাহারা দিয়েছে সে ফ্ল্যাট। প্রথম প্রথম ভেবেছে তাতায়েভ, না জানি কী মারাত্মক অন্যায় করে ফেলেছে সে অজান্তে। কিন্তু সেটা যে কি ভেবে পায়নি প্রচুর মাথা খাটিয়েও।
তারপর, হঠাৎ করেই নির্দেশ এল গোসল-শেভ সেরে নিজের সেরা সিভিলিয়ান স্যুটটি পরে তৈরি হয়ে নেয়ার। নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে, দূরে কোথাও যেতে হবে। দাচার সীটিংরুমে ঢোকার সময়ই কেবল জানতে পেরেছে ভ্যালেরি তাতায়েভ, কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনি শুরু হয়েছে সর্বাঙ্গে। জিভ শুকিয়ে কাঠ। নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে চালাতে ভাবল মেজর, প্রেসিডেন্টের যে কোন অভিযোগের সদুত্তর দিতে প্রস্তুত সে। কোন অন্যায় সে করেনি। কাজেই তার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।
কিন্তু ভেতর থেকে প্রেসিডেন্টকে বেরিয়ে আসতে দেখেই সব সৎসাহস উবে গেল মেজরের। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাটেনশন হয়ে গেল সে। নীরবে তার সামনের এক সোফায় এসে বসলেন প্রেসিডেন্ট। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকলেন সুদর্শন, সুঠাম তাতায়েভের দিকে। তারপর হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন তাকে। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে গুণে গুণে চার কদম এগোল মেজর মার্চ করে। দাঁড়িয়ে পড়ল।
যখন মুখ খুললেন প্রেসিডেন্ট, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না সে। ‘মেজর তাতায়েভ, তুমি কোন টেইলরের ডামি নও। তাহলে কেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ? কাছে এসো, বোসো আমার মুখোমুখি।’
প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ভ্যালেরি। প্রেসিডেন্টের সামনে কোন মেজর কোন কালে আসন গ্রহণ করেছে, বাপের জন্মেও শোনেনি সে। সামান্য দ্বিধায় ভুগল মেজর, তবে নির্দেশ পালন করতে দেরি করল না। সামনের একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে পড়ল। দু হাঁটু সেঁটে থাকল পরস্পরের সঙ্গে। চোখ তুলতে পারল না সে চেষ্টা করেও।
‘তোমাকে কেন ডাকিয়ে এনেছি এখানে জানো, মেজর?’
‘না, ‘কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি।’
‘বলছি। শোনো। বিদেশের মাটিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশন পরিচালনার দায়িত্ব তোমাকে দেব আমি ঠিক করেছি। দেশের স্বার্থে পরিচালিত হবে সে মিশন। যদি সফল হতে পারো, প্রচুর লাভ হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের। আর যদি বিফল হও, ক্ষতি হবে অকল্পনীয়। এ কাজে একমাত্র তোমাকেই আমার উপযুক্ত মনে হয়েছে, মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ।’
মাথার ভেতর সব গড়বড় হয়ে গেল তার। তোলপাড় চলছে বুকের মধ্যে। এসব কি সত্যি শুনছে সে? প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে ঠিক এই কথাগুলোই বেরিয়েছে? শুনতে ভুল হয়নি তো তাতায়েভের? কোথায় ধরেই নিয়েছিল অজানা কোন অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে তাকে। মাত্ৰা বুঝে র্যাঙ্ক কেড়ে নেয়া অথবা সাইবেরিয়া বা উরালের কোন ‘চরিত্র সংশোধনাগারে পাঠানো হবে, তার বদলে কি না।
আনন্দে চোখে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় ভ্যালেরি তাতায়েভের। মাস্কো ইউনিভার্সিটির ব্রিলিয়ান্ট স্কলার ছিল সে। ছোটবেলা থেকে মনে গেঁথে বসেছিল দেশসেবার বাসনা। চাকরিতে ঢুকেছে আট বছর। সেই প্রথম থেকেই অপেক্ষা করে আছে সে বিদেশে সত্যিকার এক মিশন নামের এই সোনার হরিণটির সন্ধানে। যদি কান বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে, যদি এসব কমরেড প্রেসিডেন্টের কোন নির্মম রসিকতা না হয়ে থাকে, তাহলে…।
মুখ তুলল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। সরাসরি তাকাল প্রজাতন্ত্রের প্রধানের নীল চোখের দিকে। মৃদু, কাঁপা গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি।’
‘অন্যরা তোমাকে মিশনের বিস্তারিত ব্রিফ করবে। সময় খুব একটা নেই হাতে। জানি তুমি সর্বোচ্চ ট্রেনিঙের চূড়ান্ত শিখর অতিক্রম করেছ সফলতার সঙ্গে। তাই তোমাকেই বেছে নিয়েছি আমি। যদি সফল হতে পারো, আমার বিশ্বাস পারবে, যে সম্মান আর প্রমোশন অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে,’ মৃদু হাসি ফুটল পার্টি প্রধানের, ‘তা তোমার কল্পনারও অতীত। আমি নিজে দেখব ব্যাপারটা।
‘তবে, যদি কোথাও কোন ভুল হয়ে যায়, গণ্ডগোল হয়ে যায়, মানে, তোমার পরিচয় ফাঁস হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, কোন অবস্থাতেই শত্রুর হাতে ধরা দেয়া চলবে না। এর সঙ্গে তোমার মাতৃভূমির মান-ইজ্জত জড়িত, কথাটা মনে রেখো। ওরা যেন জীবিত মেজর তাতায়েভকে ধরতে না পারে। বুঝতে পারছ, মেজর, ঠিক কি বলতে চাইছি আমি?’
‘হ্যাঁ, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। বুঝতে পারছি।’
মাথা দোলালেন বৃদ্ধ গ্র্যাণ্ড মাস্টার। ‘ধরতে পারলে ওরা তোমার মুখ খোলাবে। নির্যাতন করেই হোক বা কেমিক্যাল প্রয়োগ করেই হোক, খোলাবেই। মানবদেহে এমন কোন প্রতিরোধক নেই যা কেমিক্যালের শব্দহীন নির্যাতন ঠেকাতে পারে। যদি ধরা পড়ো, সোভিয়েত ইউনিয়নের যে অকল্পনীয় ক্ষতি হবে তা কোনদিন পূরণ হবে না।
লম্বা করে শ্বাস টানল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। ‘আমি ব্যর্থ হব না, ‘ দৃঢ় আস্থার সুর ফুটল তার কণ্ঠে, ‘কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। তারপরও যদি দুর্ভাগ্যবশত তেমন সময় আসেই, ওরা আমাকে জীবিত পাবে না।’
‘গুড!’ বাযার টিপলেন প্রেসিডেন্ট টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে। দরজা খুলে গেল। বাইরে পাথরমুখো মেজর কিরলভ দাঁড়িয়ে।
‘যাও তাহলে, ইয়াংম্যান,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘এখানেই ব্রিফ করা হবে তোমাকে, এক্ষুণি। এরপর আর কোথাও দেয়া হবে ইনটেনসিভ ব্রিফিং। গুড বাই, কমরেড মেজর। উইশ ইউ ভেরি বেস্ট অভ লাক। তুমি সফল হয়ে ফিরে এলে আমাদের আবার দেখা হবে।
তাতায়েভের পিছনে বন্ধ হয়ে গেল ভারি দরজা। দীর্ঘ সময় পর চোখে পলক পড়ল গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড মাস্টারের।
সকাল সাড়ে দশটায় প্রিটোরিয়ার জান সুটস্ এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বৃহদাকার এয়ারবাস। ভিড় খানিকটা পাতলা হতে ধীরেসুস্থে নেমে এল মাসুদ রানা। দুজন এনআইএস ফিল্ড এজেন্ট অবজার্ভেশন টাওয়ার থেকে লক্ষ রাখল রানার ওপর। তবে কাছে আসার চেষ্টা করল না। ওরা কেবল জানে মাসুদ রানা আসছে। কেন, জানে না।
ত্রিশ মিনিট ব্যয় হলো কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন ব্যারিয়ার পার হতে। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো রানা। আফ্রিকা সম্পর্কে যাদের তেমন পরিচয় নেই, এ দেশে এলে হোঁচট খাবে তাদের অনুমান- নির্ভর ধারণা। প্রশস্ত ছয় লেনের কুচকুচে কালো কার্পেটিঙ করা আধুনিক হাইওয়ে ধরে ছুটছে ওর ট্যাক্সি। অবাক বিস্ময়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে মাসুদ রানা। বিশ্বাস হতে চায় না, কোন আফ্রিকান দেশ এত আধুনিক হতে পারে।
সেন্ট্রাল প্রিটোরিয়ার ভ্যান ডের ওয়াল্ট স্ট্রীটের বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেল বার্গার স্পার্কে স্যুইট বুক করা আছে মাসুদ রানার নামে। সময় আছে দেখে হোটেলেই উঠল ও প্রথম। শাওয়ার শেভ সেরে তখনই বেরিয়ে পড়ল আবার। ঠিক এগারোটায় এনআইএস চীফ জেনারেল ডিয়েটার গেরহার্ডের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এগারোটা বিশে কার্ক স্ট্রাটের দীর্ঘ, তিনতলা কফি রঙা এনআইএস হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছল মাসুদ রানা।
ছোটখাট একটা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে দক্ষিণমুখো ভবনটি। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলো ও। তিনতলার একদম পশ্চিম প্রান্তে জেনারেলের অফিস। নিচতলায় রিসেপশনে ওরই জন্যে অপেক্ষমাণ এক তরুণ এনআইএস এজেন্ট রিসিভ করল রানাকে যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে। দু’-চার কথায় শুভেচ্ছা বিনিময় করল দু’জন, লিফটে করে উঠে এল তিনতলায়।
জেনারেল গেরহার্ড বিশালদেহী। প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা। বয়স ষাটের মত। শক্তপোক্ত গড়ন। উঠে এসে হাত মেলালেন তিনি রানার সঙ্গে। ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশি হলাম, মেজর মাসুদ রানা।’
‘ধন্যবাদ, জেনারেল।’ অফিস রুমটা বেশ বড়, তবে অনাড়ম্বর। দেয়ালে ঝুলছে অনেকগুলো ম্যাপ, অপারেশনাল। ঘরের এক প্রান্তে দরজার দিকে মুখ করা বিশাল এক গ্লাস টপ্ সেক্রেটারিয়েট টেবিল। এপাশে কোন চেয়ার নেই ওটার। আরেক মাথায়, জানালার কাছে একটা নিচু টেবিল। চারটে ক্লাব চেয়ার রয়েছে ওটা ঘিরে। ওখানেই বসালেন জেনারেল মাসুদ রানাকে।
‘আপনি পৌছার খানিক আগেই কথা হয়েছে আমার রাহাতের সঙ্গে, ‘ হাসি মুখে ওর দিকে চেয়ে আছেন গেরহার্ড। ‘আপনি জানেন, রাহাত আর আমি এক সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম? জেনারেল রোমেলের প্যান্জার ডিভিশনের বিরুদ্ধে তবরুক ফ্রন্টে লড়েছিলাম আমরা। ও আর আমি দু’জনেই মেজর ছিলাম তখন, একই ইউনিটের।’
‘জ্বি, স্যার। শুনেছি।’
‘রাহাতের মত দুর্দান্ত সাহসী আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি আমি। ওর যোগ্য পরিচালনার ফলেই বিসিআইয়ের এত সুনাম আজ। অবশ্য, তার পিছনে আপনার ভূমিকাও কম নয়।
‘আপনি বাড়িয়ে বলছেন, জেনারেল।’
হা হা করে হেসে উঠলেন গেরহার্ড। ‘মোটেই না, মোটেই না।’
আরও মিনিট পাঁচেক হালকা আলোচনা চলল দু’জনের। বেশিরভাগ কথা জেনারেলই বলছেন। রানা বুঝল, মানুষটি গল্পবাজ, বেশি সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। কাজেই সময় বুঝে আলতো করে ওর আসার কারণ সম্পর্কে সামান্য আভাস দিল রানা। ব্যস্, ওতেই কাজ হলো। মুহূর্তে কাজের মানুষ বনে গেলেন জেনারেল।
‘তো, মেজর মাসুদ রানা, কাল টেলিফোনে আমাদের আলোচনার সময় আপনি বলেছেন, ডি অ্যাঙ্গাস কার বা কাদের হয়ে কাজ করে জানতে চান আপনি, ঠিক?’
‘রাইট, জেনারেল।’
অন্যমনস্কের মত মাথা দোলালেন তিনি কয়েকবার। ‘লংফেলো এবং আপনাকে তো বটেই, রাহাতকেও আমি কথা দিয়েছি এ জন্যে যতদূর আমার পক্ষে সম্ভব, করব। তবে ও আমাদের লোক নয়। ছিলও না কোনদিন। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।’
‘আমার একজন পার্সোন্যাল স্টাফ অফিসারকে আপনার সঙ্গে দিচ্ছি, যে-কোন কাজেই ও আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ফাইল পরীক্ষা করা, ইন্টারপ্রিট করা, এসবে আপনার ওকে লাগবে। আমাদের ভাষা জানেন?’
‘না, জেনারেল।’
‘অসুবিধে নেই। ছেলেটা বেশ চটপটে, ওকে দিয়েই দোভাষীর কাজ চালিয়ে নেবেন।’
ইন্টারকমে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিলেন ডিয়েটার গেরহার্ড। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল রানারই বয়সী এক যুবক। আদা রঙের চুল। গোঁফও একই রঙের। মুখটা লম্বাটে। রানার উদ্দেশে সামান্য নড করল সে।
‘পরিচয় করিয়ে দিই। এর নাম ক্যাপ্টেন অ্যানড্রিয়াস পিয়েনার। অ্যানডি, ইনি মেজর মাসুদ রানা। যার কথা তোমাকে কাল বলেছি। এখন থেকে এঁর সঙ্গে থাকবে তুমি। যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়।
‘হাত মেলাল রানা আর অ্যানড্রিয়াস। সম্ভবত পরীক্ষা করার জন্যেই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি খাটাতে গেল আফ্রিকান, কিন্তু রানার পাল্টা চাপ খেয়ে ঢিল দিল মুঠোয়।
‘আপনার সুবিধের জন্যে এই ফ্লোরেই একটা রূমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে বসে শুরু করুন কাজ,’ বললেন গেরহার্ড।
জেনারেলের কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা দুজন। দীর্ঘ করিডরের মাঝামাঝি জায়গায় রানার নির্ধারিত রূম। ভেতরটা বেশ সাজানো-গোছানো। একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। ‘বলুন, মেজর, ঠিক কোনখান থেকে শুরু করতে চান কাজ।’
‘ডি অ্যাঙ্গাসের ব্যক্তিগত ফাইল থেকে, ক্যাপ্টেন।’
‘ঠিক।’ ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট মোড়া পুরু ফাইল বের করল পিয়েনার। ‘বসের নির্দেশে আজই ফরেন মিনিস্ট্রির পার্সোন্যাল রেজিস্ট্রি থেকে এটা নিয়ে এসেছি আমি।’ মাসুদ রানার সামনে রাখল সে ফাইলটা প্যাকেট থেকে বের করে। ‘পুরো ফাইলটা পড়েছি আমি। সংক্ষেপে বলতে পারি, যদি তাতে আপনার কিছুটা সাহায্য হয়।’
‘প্লীজ, ক্যাপ্টেন।’
‘১৯৪৬ সালে কেপটাউনে সাউথ আফ্রিকান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন ডি অ্যাঙ্গাস। চল্লিশ বছরের কিছু বেশি হয়েছে তাঁর চাকরির বয়স, আগামী ডিসেম্বরে রিটায়ার করার কথা। ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোন রকম অভিযোগ নেই, ব্যাক্ গ্রাউণ্ডেও কোন খুঁত নেই। পা’ফেক্ট সাউথ আফ্রিকানার।’
‘ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন।’ সিগারেট ধরাল মাসুদ রানা। অ্যানড্রিয়াসকেও অফার করল। তারপর মোড়ক ওল্টাল ফাইলটার। প্রথমেই ইংরেজিতে হাতে লেখা কয়েকটা শীট।
‘ডি অ্যাঙ্গাসের নিজহাতে লেখা অটোবায়োগ্রাফি ওটা। ফরেন সার্ভিসের সবাইকেই সাবমিট করতে হয় নিজের পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত। জান স্মুটের ইউনাইটেড পার্টি ছিল তখন ক্ষমতায়, আফ্রিকান ভাষার বদলে সে সময় লেখালেখির ব্যাপারে ইংরেজি ব্যবহার হত অফিস-আদালতে। এখন অবশ্য হয় না।’
..ভালই,’ বলল মাসুদ রানা। ‘সুবিধেই হলো আমার। আমি পড়ে দেখি এগুলো, এই ফাঁকে আপনি দয়া করে লোকটির দেশ-বিদেশে পোস্টিং আর অবস্থানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তৈরি করে ফেলুন। ওকে?’
‘অল রাইট।’ অটোবায়োগ্রাফিটা রানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফাইল আর কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলের অন্য মাথায় বসে পড়ল ক্যাপ্টেন পিয়েনার।
দেখা যাক্, ওর ভেতর থেকে সাপ-ব্যাঙ কিছু বেরোয় কিনা। আমার মনে হয়, লোকটা যদি সত্যিই মচকে গিয়ে থাকে, তো বিদেশেই কোথাও ঘটেছে ব্যাপারটা। দেশে নয়।’
ক্যাপ্টেনের ‘যদি’ শুনে মনে হলো, কোন আফ্রিকান বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, সে তা মনে করে না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে অ্যাঙ্গাসের জীবনীর দিকে মন দিল মাসুদ রানা।
‘উত্তর ট্রান্সভালের ডুয়েলক্লুফ শহরে ১৯২৫ সালের ৮ আগস্ট আমার জন্ম। আমার বাবা, ভ্যান অ্যাঙ্গাস ছিলেন কৃষিজীবী। খাঁটি আফ্রিকানার। কিন্তু আমার মা ছিলেন অ্যাঙলো। তখনকার দিনে এ ধরনের অসম বিয়ে বিরল ঘটনা ছিল। তবে এর ফলে আমি বেশ উপকৃত হই, ছোটবেলা থেকেই পিতৃভাষার সঙ্গে মাতৃভাষার ওপরও সমান দক্ষতা অর্জন করি আমি। আমি ছিলাম বাবা-মার একমাত্র সন্তান।
আমার বাবা আর মার বয়সের ব্যবধান ছিল বিস্তর। আমার জন্মের সময় বাবার বয়স ছিল চৌষট্টি, আর মার মাত্র ছাব্বিশ, দ্বিগুণ থেকেও অনেক বেশি। আমার দশ বছর বয়সের সময় টাইফয়েডে মৃত্যু হয় মার সে সময় ওই অঞ্চলে কিছুদিন পর পরই এই বিশেষ রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিত।’
পড়ে যেতে থাকল মাসুদ রানা…’১৯৩৯ সালে বেধে গেল. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাবা ছিলেন ইউনাইটেড পার্টির কড়া সমর্থক। সেই সূত্রে মিত্রজোট তথা ব্রিটেনের সমর্থক। যুদ্ধের খবর শোনার জন্যে সারাক্ষণই একটা ট্র্যানজিস্টর সঙ্গে থাকত তাঁর। মা মারা গেছেন।বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না আমার, তাই আমি সবসময় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম। বিবিসি, ভোয়া, রেডিও অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদির খবর শুনতাম আর বাবার মত উদ্দীপ্ত হতাম।
‘সে সময়ই যুদ্ধে যোগ দেয়ার ইচ্ছে জাগল মনে। কিন্তু বয়স অল্প বলে বাবা সায় দিলেন না। পরে ১৯৪৩ সালের ১০ আগস্ট, আমার আঠারোতম জন্মদিনের দু’দিন পর, বাবার প্রচণ্ড আপত্তি অগ্রাহ্য করে পিটার্সবার্গের উদ্দেশে ডুয়েলফ ত্যাগ করি আমি। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হয় আমার পিটার্সবার্গ রেল স্টেশনে। আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে না পেরে আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন বাবা ওই পর্যন্ত। ওখান থেকে অন্য ট্রেনে চেপে প্রিটোরিয়া রওনা হই আমি।
‘শেষ দেখার সেই বিশেষ সময়টি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত মনে থাকবে আমার। ট্রেন চলতে শুরু করেছে, বাবা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে হাত নাড়ছেন। চোখে টলটল করছে পানি। প্রিটোরিয়া পৌঁছে পরদিন সকালে উপস্থিত হই প্রতিরক্ষা সদর দফতরে এবং আর্মিতে নাম লেখাই। একদিন পর আরও অনেক নতুন রিক্রুটের সঙ্গে রবার্টস হেইটস্ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। ওখানেই যুদ্ধের মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয় আমার।
মুখ তুলল মাসুদ রানা। সিগারেট ধরাল। ‘লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, মেজর মাসুদ রানা,’ বলে উঠল ক্যাপ্টেন অ্যানড্রিয়াস। ‘চলুন, আমাদের ক্যান্টিনে যাই।’
পড়ায় ডুবে যেতে যেতে বলল রানা, ‘এখানেই কিছু আনিয়ে খেয়ে নেয়া যায় না? স্যাণ্ডউইচ আর কফি?’
‘শিওর। ফোন করে আনিয়ে নিচ্ছি আমি।’
কানে গেল না রানার। ছেড়ে ছেড়ে দ্রুত পড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ এক জায়গায় এনকেভিডি, পরবর্তীতে কেজিবি, লেখা দেখে সতর্ক হয়ে উঠল ও। বাক্যটা ছিল : ‘আমাকে এনকেভিডির হাতে তুলে দেয়া হয়’। কেন? কয়েক প্যারা পিছিয়ে গেল মাসুদ রানা। একটি অক্ষরও বাদ না দিয়ে পড়তে শুরু করল আবার।
‘আমরা তখন সাইলেসিয়ান প্লেইনে। হঠাৎ করেই সামনের দিক থেকে আমাদের ট্রাকের ওপর শুরু হলো জার্মানদের গুলি বৃষ্টি। চোখের সামনে সঙ্গীদের টপাটপ্ মরতে দেখে ভয়ে হাত পা অসাড় হয়ে এল আমার। ভাগ্য ভাল, ট্রাকের একেবারে পিছনদিকে ছিলাম আমি।তাই তখনও গুলিবিদ্ধ হইনি। থেমে ‘পড়ল ট্রাক, কারণ ড্রাইভার মারা গেছে।
‘আমার পাশেই ছিল আরেক অপরিচিত আফ্রিকানার। বেশ সাহসী ছিল সে, অন্তত আমার থেকে। হাত ধরে টেইলবোর্ডের দিকে টানল সে আমাকে। বলল, ‘চলো, পালাই’। আরও অনেকে থাকতে আমাকেই কেন ধরল সে জানি না। সে যাই হোক, ভাবলাম, এখানে বসে থাকলে মরতেই হবে। কারণ শত্রুর অ্যামবুশের একেবারে মাঝখানে পড়ে গেছি আমরা। কেবল পিছন বাদে অন্য তিন দিক থেকেই সমানে গুলি চলছে তখন। কাজেই বসে না থেকে একবার চেষ্টা করেই দেখি বাঁচা যায় কি না।
‘পরের ঘটনা, কেবল মনে আছে, সেই ছেলেটা আর আমি প্রাণভয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে ঢোকার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। পালাবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করিনি বলেই বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। কিন্তু পরে টের পেলাম, আসলে ফুটন্ত কড়াই থেকে পড়েছি আমরা জ্বলন্ত চুলোয়। রাতে সাইলেসিয়ান প্লেইনের তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের ত্রিশ ডিগ্রী নিচে। সে যে কী অমানুষিক কষ্ট, বলে বোঝানো অসম্ভব।
‘প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে গেল আমার প্রাণ রক্ষাকারী সঙ্গীর। ওই পরিস্থিতিতে যথাসম্ভব চেষ্টা করলাম আমি তার সেবা শুশ্রূষা করার কিন্তু কাজ হলো না। মাত্র দু’দিন ভুগেই মারা গেল ছেলেটা। …এর সম্ভবত তিন দিন পর রুশ সৈন্যরা জঙ্গল থেকে পাকড়াও করে আমাকে। জার্মান স্পাই সন্দেহ করে তুলে দেয় এনকেভিডির হাতে।
‘আমি জার্মান স্পাই, কথাটা আমার মুখ থেকে বের করার জন্যে দীর্ঘ পাঁচ মাস প্রচণ্ড নির্যাতন চালায় ওরা আমার ওপর। কিন্তু আমি স্বীকার করিনি। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ততদিনে, অথচ আমি জানি না। যা হোক, ১৯৪৫ সালের আগস্টে জার্মানির পটসড্যামে ব্রিটিশ আর্মির কাছে আমাকে হস্তান্তর করে এনকেভিডি। আমি তখন মৃতপ্রায়। কিছুদিন বেলিফেল্ড হাসপাতালে রাখা হয় আমাকে, তারপর ওখান থেকে ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওখানে আরও তিন মাস গ্লাসগোর কিলার্ন ইএমএস হসপিটালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয় আমাকে।
‘ডিসেম্বরে সাউদাম্পটন থেকে ইলি ডি ফ্রান্স নামের জাহাজে চড়ে কেপ টাউন রওনা হই আমি। এবং সেখানে পৌঁছে জানতে পাই আমার একমাত্র আত্মীয়, পৃথিবীর একমাত্র বন্ধন, আমার বাবা মারা গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি। ভর্তি হই কেপ টাউনের ওয়েনবার্গ মিলিটারি হসপিটালে। ওখানে দু’মাস চিকিৎসাধীন রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয় আমাকে। আমি, ডি অ্যাঙ্গাস, এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বিধায় সাউথ আফ্রিকান ফরেন সার্ভিসে চাকরির আবেদন করছি।’
মুখ তুলল মাসুদ রানা। ‘পড়া শেষ?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন। ‘হ্যাঁ। আপনার কাজ?’
‘শেষ। কোথাও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। একদম ঝরঝরে ক্যারিয়ার। বলছি, শুনুন। মোট আটটি দেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন ডি অ্যাঙ্গাস, প্রতিটি প্রো-ওয়েস্টার্ন দেশ। বিয়ে করেননি, ব্যাচেলর।’ রানার কপালের কুঞ্চন কমছে না দেখে প্রশ্ন করল পিয়েনার, ‘আপনি কি এখনও ভাবছেন ভদ্রলোকের মধ্যে সত্যিই কোন গড়বড় আছে?’
কাঁধ ঝাঁকাল মাসুদ রানা। ‘এই লাইফ স্টোরি, এর মধ্যে কোথাও যেন গণ্ডগোল আছে। ধরতে পারছি না, ক্যাপ্টেন।’
‘অল রাইট,’একটু যেন বিরক্তি প্রকাশ পেল পিয়েনারের কণ্ঠে। ‘বলুন, এরপর কি। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্যেই আছি। কোত্থেকে শুরু করতে চান?’
‘একদম শুরু থেকে,’ অ্যাঙ্গাসের জীবন বৃত্তান্তের ওপর ‘ঠক্’ ঠক্ করে টোকা দিল রানা। ‘এই গ্রাম, ডুয়েলফ থেকে। কতদূর জায়গাটা?’
‘চার ঘণ্টার ড্রাইভ। যেতে চান?’
‘ইয়েস, প্লীজ।’
‘আজই?’
‘না, কাল খুব সকালে। ধরুন ছটায় স্টার্ট করতে চাই।’
‘কোন অসুবিধে নেই। ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাব আমি আপনার হোটেলে।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ। আজই যেতাম, কিন্তু ফাইলটা আরও খানিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন।’
মস্কো। মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভকে ডিটাচ করার পরদিন সোভিয়েত আর্মড ফোর্সেসের আরও দু’জনকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্টে বদলি করা হলো তাড়াহুড়ো করে।
মস্কোর একশো মাইল পশ্চিমে, মস্কো-মিনস্ক হাইওয়ের পাশে পাইনের বিশাল এক বন। ওর মাঝে, লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ আড়ালে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ লিসেনিঙ কমপ্লেক্স। বহির্বিশ্ব থেকে পাঠানো ওয়ারশ প্যাক্টের রেডিও সিগন্যাল ধারণ করা হয় এখানে আকাশ- ছোঁয়া অজস্র রেডিও ডিশ এরিয়েলের সাহায্যে।
কেবল তাই নয়, সোভিয়েত সীমান্তের ওপারে, আরও বহু বহুদূরের সিগন্যালও ধারণ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম এই পোস্ট। এর একটা বড় অংশ পুরোপুরি আলাদা অন্য অংশ থেকে, শুধুমাত্র কেজিবির ব্যবহারের জন্যে। এখান থেকেই বদলি করা হলো একজনকে—ওয়ারেন্ট অফিসার রেডিও অপারেটর সে।
‘লোকটা ছিল আমার পোস্টের সেরা অপারেটর,’ কমপ্লেক্সের কম্যাণ্ডিং কর্নেল তাঁর ডেপুটির উদ্দেশে আক্ষেপ করে বললেন। তাকে ডিটাচ করার সেন্ট্রাল কমিটির নির্দেশ পৌঁছে দিয়ে খানিক আগে বিদেয় নিয়েছে সেই দুই ব্যক্তি, আগেরদিন যারা মেজর জেনারেল ভ্লাদিমির চেরনোভস্কির অফিসে গিয়েছিল।
‘খুব ভাল ছিল?’
‘ভাল মানে?’ ডেপুটির প্রশ্নে রেগে উঠলেন কর্নেল। ‘আমি তো বলি আমাদের সেরা রেডিও অফিসার ছিল ও। প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট পেলে ক্যালিফোর্নিয়ার কোথায় কোন্ তেলাপোকা পিঠ আঁচড়াচ্ছে, পরিষ্কার ট্রেস করতে পারে ও।’
অন্যজন আর্মির এক কর্নেল। আর্টিলারির। আসলে কর্নেল যতটা না সৈনিক, তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞানী। কাজ করে রিসার্চ ডিভিশনের অর্ডন্যান্স ডিরেক্টরেটে।
মেজর কিরলভকে অনুসরণ করে দাচার চোখ ঝলসানো গেস্ট উইঙে এসে পৌঁছল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ। মনে হচ্ছে, অসহ্য উচ্ছ্বাস আর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দে বুকটা যে-কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে তার। ইংরেজিতে তুখোড় ভ্যালেরির জানা আছে সেই ফ্রেজ, ‘টু ডাই ফর গড, কিং অ্যাণ্ড কান্ট্রি’।
তার গড নেই, তবে কিং আছে, আছে কান্ট্রি—মাদার রাশিয়া। তার জন্যে যে কোন মুহূর্তে মরণকে বরণ করতে সে প্রস্তুত। একটা বন্ধ দরজার সামনে থামল মেজর কিরলভ। নক করল। তারপর আস্তে করে মেলে ধরল। সরে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল তাতায়েভকে ভেতরে ঢুকতে।
পা বাড়াল সে। পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। আরেকজন আছেন ভেতরে। বিশালবপু ড. পাভলভ। ‘মেজর ভ্যালেরি?’ এগিয়ে এলেন তিনি। বাড়িয়ে ধরলেন ডান হাত।
বিস্মিত হলো মেজর। এ মুখ তার খুব চেনা, যদিও পরিচয় নেই। সে জানে, এ লোক কমরেড জেনারেল সেক্রেটারির খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দাবার গ্র্যাণ্ড মাস্টার। ‘ইয়েস, কমরেড পাভলভ।’ হ্যাণ্ডশেক করল সে তাঁর সঙ্গে।
‘বসুন, মেজর-।’
‘ধন্যবাদ।’
কয়েক মুহূর্ত মেজরের দিকে চেয়ে থাকলেন পাভলভ অপলক। এর জীবনী প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে তাঁর। উচ্চতা ছয় ফুট দুই, বয়স আটাশ। দশ বছরের একাগ্র সাধনার ফলে একজন লিমির মতই ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে সে, তাতে রুশ অ্যাকসেন্টের সামান্যতম আভাসও খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু চোস্ত ইংরেজিই নয়, ওয়েলস এবং আইরিশেও সমান ওস্তাদ ভ্যালেরি।
এর আগে দু’ দফা ব্রিটেনে থেকে এসেছে ভ্যালেরি ছয় মাস করে, ডীপ কভার এজেন্ট হিসেবে। এ ধরনের ট্রিপকে ‘ফ্যামিলিয়ারাইজেশন’ বলে ডিরেকটরেট ‘এস’। পরে কাজে লাগে এর অভিজ্ঞতা। ওদেশে গিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে এখন তেমন অসুবিধে হবে না তাতায়েভের। বহিরাগত মনে হবে না নিজেকে সারাক্ষণ।
অবশ্য শুধু ঘুরতেই পাঠায় না এদের ‘এস’। সঙ্গে কিছু কাজও করতে হয়। যে দেশেই পাঠানো হোক, প্রথমেই নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় সেখানে এজেন্টকে। জানতে হয় ড্রাইভিং লাইসেন্স করার পদ্ধতি। ট্রেন, ট্রাম, বাস, আণ্ডার গ্রাউণ্ড রূট ভাল করে চিনে নিতে হয়। শিখতে হয় নতুন নতুন জনপ্রিয় বচন, গালাগাল।
‘ওয়েল, জেন্টলম্যান,’ ইংরেজিতেই শুরু করলেন জোসেফ পাভলভ। একসময় মস্কো ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্র ছিলেন তিনিও। দু’ঘণ্টা ধরে প্ল্যান অরোরার নাড়ি নক্ষত্র ব্যাখ্যা করলেন ডক্টর.। ‘এগুলো সব গেঁথে নিন মনের ভেতর। ওদেশে যাওয়ার সময় সঙ্গে থাকবে আপনার শুধু একটা ওয়ান-টাইম প্যাড, আর কিছুই নয়।’
বলার প্রয়োজন ছিল না, এতক্ষণ যা যা শুনেছে তাতায়েভ, তৎক্ষণাৎ তা হজম করে ফেলেছে। একটা কমা ফুলস্টপও ভুল হবে না তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়। ‘ইয়েস, কমরেড পাভলভ। সময় মত অন্য সব সাপ্লাই পৌঁছলে আর কিছুই প্রয়োজন হবে না আমার।’
‘গুড। এবার আপনাকে মস্কোয় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানে আরও একবার ইনটেনসিভ সেশনে বসতে হবে কয়েকজন এক্সপার্টের সঙ্গে। দেশত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবেন আপনি।’
মাথা দোলাল মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভ।
বাযার টিপলেন জোসেফ পাভলভ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দোরগোড়ায় উদয় হলো কিরলভ। ‘ওয়েল,কমরেড,’ বললেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। ‘আনটিল উই মিট আগেইন, গুড লাক। অ্যাণ্ড গুড বাই। ‘