ছয়
ডোরবেলের আওয়াজে রবার্ট ফিলবি নিজেই দরজা খুললেন। সামনে দাঁড়ানো প্রায় তাঁর সমান লম্বা নিষ্ঠুর চেহারার যুবকের দিকে চেয়ে থাকলেন বিমূঢ়ের মত। চেহারাটা খুবই পরিচিত মনে হলেও চিনতে পারছেন না। হাতে একটা ব্রিফকেস যুবকের।
‘গুড ইভনিং,’ বলল আগন্তুক।
‘ইভনিং?’ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়েই আছেন রবার্ট ফিলবি।
হিপ পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল যুবক, তুলে ধরল চোখের সামনে। পরমুহূর্তে চেহারা বদলে গেল ফিলবির এবং একই সঙ্গে যুবককেও চিনে ফেললেন। মনের ভেতর বেজে উঠল বিপদের ডঙ্কা। এ লোক কি চায় আমার কাছে? ভাবলেন ফিলবি। ‘মিস্টার মাসুদ রানা?’
‘ভেতরে আসতে পারি?’ গমগমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা। প্রথমেই লোকটার মনে ভয় এবং দ্বিধা ঢুকিয়ে দিতে চায় ও। এতে বাকিটা সহজ হয়ে যাবে।
‘নিশ্চই। আসুন,’ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন রবার্ট ফিলবি। তাঁর চোখের তারায় আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখল মাসুদ রানা। দরজা বন্ধ করার আগে একবার করিডরে উঁকি দিলেন তিনি। সম্ভবত ওর সঙ্গে আর কেউ আছে কি না দেখে নিলেন। ঘুরে জোর করে ফোটানো হাসি মুখে রানাকে সীটিংরুম নির্দেশ করলেন।
‘লেডি ফেডোরা বাসায় নেই?’ বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘না। ও ওর ভাইয়ের কাছে বেড়াতে গেছে। শেফিল্ডে।’ ওর মুখোমুখি বসলেন ফিলবি। ‘বলুন, কি উপকারে লাগতে পারি আপনার?’ –
সামনের দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটার দিকে তাকাল মাসুদ রানা। তারপর পুরো ঘরের ওপর। ঠিকই বলেছিল জিম প্রেসটন। এ ঘরের ব্যাপারে তার দেয়া বর্ণনা হুবহু মিলে যাচ্ছে। দেয়ালটা নিশ্চয়ই রিপেয়ার করিয়েছে লোকটা, ভাবল ও।
‘মিস্টার রানা…!’
সরাসরি ফিলবির চোখে চোখ রাখল মাসুদ রানা। এমনভাবে চেয়ে থাকল যেন ঘোরের মাঝে আছে। পায়ের কাছে রাখা ব্রিফকেসটা দু’হাঁটুর ওপর রেখে খুলল ও। ভেতর থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে এগিয়ে দিল সামনে। ‘বলছি। তার আগে দয়া করে এগুলো দেখুন।’
নিলেন ওগুলো রবার্ট ফিলবি। দ্রুত চোখ বোলালেন প্রথম শীটটার ওপর। তারপর দ্বিতীয় শীট। তৃতীয় শীট। এই শীটটার মাঝামাঝি এসে থমকে গেল তাঁর দৃষ্টি। ফ্যাকাসে হয়ে উঠল চেহারা। ‘এগুলো… এগুলো…।’
‘হ্যাঁ। গ্লেন ডায়মণ্ডের সঙ্গে এগুলোও চুরি গিয়েছিল আপনার,’ যেন কথার কথা, এমনভাবে বলল মাসুদ রানা। ‘কিন্তু চোর লোকটা বোঝা যায় ভালই। নষ্ট না করে দলিলগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিল বিএসএসের ঠিকানায় তাকে ট্রেস করতে পেরেছি আমরা এবং তার কাছ থেকেই পেয়েছি আপনার নাম।’
কয়েক মুহূর্তের জন্যে বোবা-কাল্ম বনে গেলেন রবার্ট ফিলবি। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ। বুকের ভেতর হাতুড়ি পিছে কেউ অনেকক্ষণ পর গলায় স্বর ফোটাতে সমর্থ হলেন ফিলবি। ‘এগুলো বিএসএসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে? কিন্তু আপনি…?’
‘এ কেসের দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে, তাই।’
আবার দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন ফিলবি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ঝড়ের গতিতে কাজ করছে মাথা। ‘অস্বীকার বা কথা লুকোবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, মিস্টার ফিলবি। ওর প্রতিটিতে আপনার অসংখ্য হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। আপনার ফলস কম্পার্টমেন্টওয়ালা ব্রিফকেসটাও বর্তমানে আমার হেফাজতে। অতএব বুঝতেই পারছেন, সব বলে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেক্ষেত্রে আমি হয়তো আপনার বাঁচার একটা উপায় বাতলে দিতে পারব।’ একগাদা মিথ্যে বলে গেল রানা।
চিন্তিত মুখে ডান জুলফির গোড়া চুলকালেন রবার্ট ফিলবি। চোখ মাটির দিকে। আমি শেষ হয়ে গেছি, ভাবছেন তিনি। সব শেষ। অর্থ-যশ, সম্মান-চাকরি, সব গেল। কি সাজা হবে তাঁর? আজকের পর এ মুখ কি করে বাইরে দেখাবেন?
‘মিস্টার ফিলবি, একটা মহল উঠেপড়ে লেগেছে আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যে। ইন্টারোগেট করতে চায় আপনাকে। তারপর কি জুটবে আপনার ভাগ্যে জানেন? স্রেফ দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হবে। ক্রাউন কাউন্সিল বিন্দুমাত্র কৃপা দেখাবে না। মিডল-ক্লাস কারাগার জুটবে কপালে। বিচার হবে মিডল ক্লাস কোর্টে। সারাদেশ জানবে, দুনিয়া জানবে একজন ব্রিটিশ দেশদ্রোহীর পরিচয়, সেটা কি ভাল হবে?’
আরও একগাদা ডাঁহা মিথ্যে বলে গেল রানা গড়গড় করে। রবার্ট ফিলবিকে গ্রেফতার করলে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় মামলা দায়ের করতে হবে। ওখানে কোন সমস্যা হবে না, হবে তার পরপরই। কোর্টে টিকবে না মামলা প্রমাণের অভাবে। মাসুদ রানা জানে, ফিলবিই হোয়াইটহল থেকে চুরি করেছে ডকুমেন্টগুলো। কিন্তু জানা আর কোর্টে তা প্রমাণ করা এক নয়। তাছাড়া কোর্টে মামলা উঠলেই জেনে যাবে প্রেস।
জানাজানি হয়ে যাবে সব। কিন্তু মাসুদ রানা তা হতে দিতে চায় না। ভয় দেখিয়ে গোপনে মুখ খোলাতে হবে রবার্ট ফিলবিকে। জানতে হবে কতদিন থেকে এ কাজ করছে সে। কাকে দিচ্ছে বা কোথায় পাঠিয়েছে চুরি করা ডকুমেন্ট, ন্যাটোর কতটা ক্ষতি এরইমধ্যে হয়ে গেছে। তারপর বিশেষ এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই হয়ে যাবে ওর সাজানো ছক্।
‘ওয়েল,’ মুখ খুললেন রবার্ট ফিলবি। ‘সবইতো জেনে গেছেন, আ…বলুন, আর কি জানতে চান।’
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল রানা। আসন নেয়ার পরপরই কোটের ডান পকেটে রাখা মিনিয়েচার টেপ রেকর্ডারটির বোতাম টিপে দিয়েছিল ও। লোকটার স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে কিনা ভেবে এতক্ষণ খুব টেনশনে ছিল। কেটে গেছে তা। ‘কতদিন ধরে এসব গোপনীয় দলিলপত্র চুরি করছেন আপনি হোয়াইটহল থেকে?’
‘এক বছরের কিছু বেশি হবে।’
‘কেন করছেন। আই মীন, কাদের সরবরাহ করছেন আপনি এসব তথ্য?’
‘সাউথ আফ্রিকানদের।’
‘সাউথ আফ্রিকা!’ আকাশ থেকে পড়ল মাসুদ রানা। ‘সাউথ আফ্রিকা? ওরা কি করবে এসব দিয়ে?’
‘ওদের বর্জন করে, একঘরে করে চরম বোকামি করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। আহাম্মকের মত কাজ করেছে। চরম এক অনিশ্চয়তার মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে প্রিটোরিয়াকে। ন্যাটো আর ওয়ারশ জোটের মধ্যে যদি কোনদিন বেধে যায় লড়াই, ওদের ছেড়ে কথা কইবে না কেউ, আই মীন, স্ট্র্যাটেজিক্যালি সাউথ আফ্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। আপনি নিশ্চই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভুলে যাননি। সে যুদ্ধের মূল রণাঙ্গনই বলতে গেলে ছিল সাউথ আফ্রিকা এবং সাহারার দক্ষিণাংশ। কিন্তু আর যাতে সেরকম পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে জন্যে প্রিটোরিয়াও ন্যাটোর কন্টিঞ্জেন্সি প্ল্যানের অনুকরণে নিজেদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। ডকুমেন্টগুলো ওদের অনেক কাজে লাগবে বলে ওরা আমার সাহায্য চেয়েছিল।’
‘এবং ওদের সাহায্য করা আপনি প্রয়োজন মনে করেছেন,’ প্রশ্ন নয়,
মন্তব্য করল মাসুদ রানা।
‘হ্যাঁ।’
‘অফিশিয়াল সিক্রেটস্ অ্যাক্ট জেনেও?’
‘হ্যাঁ।’
‘যে উদ্দেশে আপনি ওদের সাহায্য করেছেন, ঠিক সেইমত কাজ প্রিটোরিয়া করেছে বা করছে কিনা, সে ব্যাপারে জানেন কিছু?’
‘না।’
‘না কেন, খোঁজ নেননি?’
‘না।’
তাজ্জব হয়ে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে থাকল মাসুদ রানা। একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তার মুখ থেকে এসব কথা বেরোচ্ছে, কানে শুনেও বিশ্বাস হচ্ছে না।
‘বেশ। এবার বলুন, কার মাধ্যমে ওদেশে ডকুমেন্টস্ পাঠিয়ে আসছেন আপনি।’
‘ডি অ্যাঙ্গাস। এখানকার সাউথ আফ্রিকান এমব্যাসির একজন ডিপ্লোম্যাট।’
‘তথ্য পাচারের অনুরোধ প্রথমে কার কাছ থেকে পান আপনি, সরাসরি ওদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কাছ থেকে, নাকি অ্যাঙ্গাসের কাছ থেকে?’
‘অ্যাঙ্গাসের কাছ থেকে। সে আসলে এনআইএস রেসিডেন্ট।’
‘এর সঙ্গে আপনার পরিচয় কখন কিভাবে হয়? আপনি যখন প্রিটোরিয়ায় পোস্টেড ছিলেন, তখন?’
মুখ তুললেন ফিলবি। ‘আপনি জানেন কিভাবে?’
‘আমাদের জানতে হয়। বলে যান, প্লীজ।’ এখানে আসার আগে রবার্ট ফিলবির সার্ভিস রেকর্ড ফাইল ঘেঁটে এসেছে রানা হোয়াইটহলের রেকর্ড সেকশন চীফের সাহায্যে। ও নিজে, স্যার মারভিন লংফেলো এবং সেকশন চীফ ছাড়া আর কেউ জানে না ব্যাপারটা। ওতেই পেয়েছে রানা, প্রিটোরিয়ার ব্রিটিশ দূতাবাসের সেকেণ্ড সেক্রেটারি হিসেবে বছর আড়াই ওদেশে ছিলেন ফিলবি।
‘হ্যাঁ।’
‘লোকটা সত্যিই এনআইএসের কি না, তাও নিশ্চই জানেন না আপনি, আই মীন, ফর শিওর?’
দ্বিধাগ্রস্তের মত মাথা দোলালেন তিনি। ‘না, জানি না।’ চেহারা দেখে মনে হলো একটু যেন থতমতও খেয়ে গেছেন। হয়তো ভাবছেন, এ প্রশ্নটা মনে জাগেনি কেন তাঁর এতদিন?
‘ডি অ্যাঙ্গাসের সঙ্গে দেখা হয় প্রায়ই?’ চোখ বুজে প্রশ্ন করল মাসুদ রানা। মাথায় অন্য লাইনের চিন্তা ঢুকেছে।
‘কখনও কখনও। তবে খুব কম।’
‘এই ডকুমেন্টগুলো কবে হস্তান্তর করেছেন তার কাছে?’
‘মাস দুয়েক আগে।’
‘ঠিক আছে। এবার মন দিয়ে শুনুন। লোকটার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখবেন আপনি আরও কিছুদিন।’
চোখ বড় বড় হয়ে উঠল ফিলবির। ‘কি…?’
‘ঠিকই শুনেছেন। তবে সামনাসামনি হবেন না। কারণ আপনার মুখ দেখলেই সে অনুমান করে নেবে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। সাবধান! খুব সতর্ক থাকতে হবে আপনাকে এ ব্যাপারে। কোনমতেই যেন কিছু আঁচ করতে না পারে ডি অ্যাঙ্গাস। মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে অন্য আর যেভাবে পারেন, টেলিফোন বা আর কোন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন, আপাতত। নিয়মিত অফিসে যাবেন। এতদিন যা যা করেছেন, ঠিক তাই করে যাবেন। এরপর আরেকটা কাজ করতে হবে আপনাকে।’
‘কি কাজ?’ আগ্রহের আতিশয্যে আধ ফুট এগিয়ে এলেন ফিলবি।
‘সময় হলে জানবেন। মনে রাখবেন, যদি শেষ পর্যন্ত আমার কথামত চলেন, বেঁচে যাবেন আপনি। নইলে…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল মাসুদ রানা। চট্ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাগজগুলো আগেই ভরে রেখেছে ব্রিফকেসে। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ওটা। ‘চললাম।’
উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাইলেন রবার্ট ফিলবি। কিন্তু সুযোগ দিল না ও। দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে এল দ্রুত পায়ে।
উসভো। প্রেসিডেন্টের দাচায় সমবেত হয়েছেন অ্যালবিয়ন কমিটির চার সদস্য। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে যাচ্ছে কমিটি। দাচার অবিশ্বাস্য রকম বড় এবং চোখ ধাঁধানো বিলাসের ছড়াছড়িতে ভরা সীটিংরূমে প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি বসেছেন সবাই। আজ আর বডিগার্ড নেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। কেবল মেজর কিরলভকে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে মস্কো ত্যাগ করেছেন তিনি প্রয়োজন নেই বলে। দাচার গার্ড সংখ্যা প্রেসিডেন্ট মস্কো ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা আগেই চারগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সঙ্গে ডজনখানেক ডগ হ্যাওলারও রয়েছে।
চার মণ ওজনের বিশালবপু ড. জোসেফ পাভলভ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকেই কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করেছেন অন্য তিন সদস্য। বলতে লাগলেন তিনি, ‘মাননীয় কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী আমরা অত্যন্ত সুচতুর, নিশ্ছিদ্র এক নাশকতামূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছি। আপনাকে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের বন্ধু, কমরেড জেনারেল মার্চেঙ্কোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ব্রিটেনে জিআরইউ পরিচালিত সর্বশেষ জনমত জরীপে দেখা গেছে, কনজারভেটিভরা লেবারদের চেয়ে প্রায় পনেরো শতাংশ এগিয়ে রয়েছে। পনেরো শতাংশ, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। এর তিন শতাংশ এদিক- ওদিক হবে ধরেই নিয়েছি আমরা। ফকল্যাণ্ড যুদ্ধে বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের পড়ন্ত জনপ্রিয়তা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে, ফলে ব্যবধান যেরকম হবে বলে আশা করা হয়েছিল, তেমনটি হয়নি।
‘সে যাই হোক, আমাদের এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তাহলে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, শতকরা আশিভাগ ভোট পড়বে লেবার পার্টির পক্ষে। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই পরিকল্পনার নাম দিয়েছি আমরা প্ল্যান অরোরা।’
একে একে বাকি তিনজনের ওপর দিয়ে ঘুরে এল জেনারেল সেক্রেটারির নীল বাজপাখির দৃষ্টি। তারপর ড. পাভলভের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসির ভঙ্গি করলেন তিনি। ‘এবার তাহলে শোনা যাক আপনাদের প্ল্যান আরোরার বক্তব্য।’
‘নিশ্চয়ই। কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি।’
টাইপ করা প্ল্যান পড়তে শুরু করলেন ড. পাভলভ। এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত কিছু বিস্তারিতভাবে সাজানো হয়েছে ওতে যে ছোটখাট একটা বই ই হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। মাঝে মাঝে চোখ তুলছেন প্রেসিডেন্টের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হয় কি না দেখার জন্যে। কিন্তু তাঁর থেকে অনেক অনেক বড় খেলার গ্র্যাণ্ড মাস্টার প্রেসিডেন্ট। বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়ার আভাসও বোঝা গেল না।
প্রায় দেড় ঘণ্টা টানা বলে যাওয়ার পর থামলেন ড. পাভলভ। পড়া শেষ। অখণ্ড নীরবতা নেমে এল ঘরে। এক সময় মুখ খুললেন প্রেসিডেন্ট। ‘এতে প্রচুর ঝুঁকি আছে। কি নিশ্চয়তা আছে যে আগের…অন্যান্য পরিকল্পনার মত এটাও ব্যর্থ হবে না?’
কোন পরিকল্পনার কথা বোঝাতে চাইছেন তিনি, প্রকাশ না করলেও অন্যরা বুঝে নিলেন। বছর তিনেক আগে সুইডেনে এক নাশকতামূলক প্রকল্পে হাত দিয়ে ফেঁসে গিয়েছিল কেজিবি। প্রচুর ভোগান্তি পোহাতে হয় সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। প্রায় এক বছর লেগেছিল মস্কোর সে গেরো থেকে বেরতে। যদিও, এখনও মাঝেমধ্যে তা নিয়ে সুযোগ পেলেই খোঁচাতে ছাড়ে না পশ্চিমা মিডিয়া।
‘উইথ অল রেসপেক্ট, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি, পুরো নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, ওটার সঙ্গে প্ল্যান অরোরার কোন তুলনাই চলে না। এটা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের, ব্যতিক্রমি। এর প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে ফল ব্যাক, কাটআউট। যে এর নির্বাহী অপারেটর হবে, তাকে হতে হবে টপ্ প্রফেশনাল। দেশের স্বার্থে বিনা প্রশ্নে নিবেদিতপ্রাণ। কোথাও কোন গণ্ডগোল যদি এত সাবধানতার পরও ঘটেই যায়, ধরা পড়ার আগেই আত্মহত্যা করতে হবে তাকে। এবং মৃত্যুর পর তাকে কেউ যেন সোভিয়েত স্পাই বলে সনাক্ত করতে না পারে, সেদিক থেকেও তাকে উপযুক্ত হতে হবে। খুঁজলে এমন লোক সংগ্রহ করা কঠিন হবে বলে আমি মনে করি না, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি। যদিও,’ থেমে নাক চুলকালেন ড. পাভলভ। ‘প্ল্যান কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে তারও মৃত্যু হবে, প্ল্যানেরই অংশ হিসেবে। অরোরায় কোন রকম লুজ এণ্ড রাখেনি অ্যালবিয়ন কমিটি।
‘এর পরপরই আমাদের সাব-প্ল্যানের কাজ শুরু হবে। বিশ্ববাসীকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করানোর ব্যবস্থা করা হবে যে মস্কো নয়, এজন্যে দায়ী ওয়াশিংটন।’
মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলেন প্রেসিডেন্ট। দু মিনিট পর মুখ তুললেন। অন্য তিনজনের মতামত চাইলেন তিনি। ‘প্ল্যান অরোরা কার্যকর করা সম্ভব?’
বিনা দ্বিধায় সম্মতি জানালেন সবাই। ‘সম্ভব।’
ওঁদের সামনের গ্লাস টপ্ কফি টেবিলের ওপর স্তূপ হয়ে থাকা এক গাদা ফাইল, ফোল্ডার দেখলেন প্রেসিডেন্ট। প্ল্যান আরোরার খসড়া এবং মূল পরিকল্পনা। মুখ তুলে সেদিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। ‘প্ল্যানের সব খুঁটিনাটি এখানে আছে?’
‘হ্যাঁ, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি,’ বললেন জেনারেল সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কো।
‘এর বাইরে আর কিছুই নেই, টেপ রেকর্ডার বা ফেলে দেয়া কাগজ যাতে এসবের আর কোন তথ্য বা টুকিটাকি লেখা আছে, বেখেয়ালে ফেলে দিয়েছেন কেউ?’
‘কিচ্ছু নেই,’ জোর দিয়ে বললেন চার কমিটি সদস্য।
‘সব রেখে যান আপনারা। ড. পাভলভ বাদে আর সবাই কাল থেকে যার যার স্বাভাবিক কাজে লেগে পড়ুন। ভুলে যান অ্যালবিয়ন কমিটি, প্ল্যান অরোরার কথা। গুড বাই, কমরেডস্।’
আসন ছাড়লেন বাকি তিনজন। দরজার কাছের ক্লোক কাবার্ড থেকে যার যার গ্রেটকোট বের করে পরে নিলেন। মাথায় চাপালেন শাপকা। কেউ কারও চোখের দিকে তাকাচ্ছেন না। মিনিট তিনেক পর সামনের কোর্ট ইয়ার্ডে এক এক করে তিনটে চইকা লিমুজিন স্টার্ট নিল। নাক ঘুরিয়ে সার বেঁধে রওনা হলো বুলেভার্ডের দিকে। সামনের বার্চ আর পাইনের বন আলোকিত হয়ে উঠল তিন জোড়া শক্তিশালী হেডলাইটের আলোয়।
ভেতরে তেমনি বসে আছেন জেনারেল সেক্রেটারি। উপস্থিত আরেকজনের অস্তিত্ব ভুলে গেছেন যেন। অনেক, অনেকক্ষণ পর চোখে পলক পড়ল তাঁর দীর্ঘ সময় নিয়ে। এমন বেপরোয়া বিপজ্জনক এক প্ল্যান তৈরি করবে অ্যালবিয়ন, স্বপ্নেও কল্পনা করেননি তিনি। ঝুঁকি আছে, তেমনি সফল হওয়ার সম্ভাবনাও ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে হাত দিতে হবে। নির্বাচনের আর এক মাসও বাকি নেই।
‘ড. পাভলভ, কাছে আসুন।’
রাগে কাঁপছেন স্যার মারভিন লংফেলো। ‘এনআইএস?’ চোখ গরম করে মাসুদ রানার দিকে চেয়ে আছেন, যেন সব দোষ ওর। ‘এনআইএস ভর করেছে ফিলবির মত এক টপ্ ক্লাস অফিসারের কাঁধে?’ বাঘের দৃষ্টিতে সামনে রাখা টেপ রেকর্ডারটির দিকে তাকালেন এবার লংফেলো। পরক্ষণেই করুণ হয়ে উঠল চেহারা। বিকৃত কণ্ঠে বললেন, ‘ওহ্, মাই ল-অ-র্ড!’
এনআইএসের সঙ্গে খুব একটা অন্তরঙ্গতা নেই বিএসএসের, জানে মাসুদ রানা। যেটুকু আছে কেবল আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থেই। জোহান্সবার্গে বিএসএসের একজন হেড অভ স্টেশন আছে। প্রিটোরিয়ার অনুমতি আছে তাতে। তেমনি লণ্ডনেও এনআইএসের একজন হেড অভ স্টেশন আছে, জানে বিএসএস। কিন্তু সে ডি অ্যাঙ্গাস নয়।ওটাই বৃদ্ধের রাগের কারণ। সে যদি সত্যিই এনআইএসের হয়ে থাকে, তাহলে হবে দু’ নম্বর, বা তিন নম্বর, বা আল্লা মালুম কত নম্বর।
তার মানে চুক্তি ভঙ্গ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। চুক্তিতে উভয় দেশের একজন করে হেড অভ স্টেশন বিনিময়ের কথা থাকলেও তার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে প্রিটোরিয়া। ভদ্রলোককে ঘন ঘন বুড়ো আঙুলের নখ দাঁতে খুঁটতে দেখে বলল রানা, ‘শান্ত থাকার চেষ্টা করুন, স্যার। মাথা গরম করে লাভ হবে না।’
‘এতকিছুর পরও কি করে মাথা ঠাণ্ডা রাখি, বলো?’
‘ওদের চীফ, জেনারেল ডিয়েটার গেরহার্ডের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করুন। অ্যাঙ্গাস সত্যিই ওদের লোক কি না জানতে হবে আগে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’
কয়েক সেকেণ্ড ভাবলেন বৃদ্ধ। ‘একটা বুদ্ধি দাও।যে-পথে এগোলে দ্রুত কাজ উদ্ধার করা যাবে।
লণ্ডনের নির্দেশে জোহান্সবার্গের বিএসএস প্রতিনিধি পরদিন প্রিটোরিয়া গিয়ে দেখা করল জেনারেল গেরহার্ডের সঙ্গে। এবং জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার ফলাফল সেদিনই লণ্ডনে রিপোর্ট করল সে।
‘জেনারেল বাইবেলের শপথ করে বলেছেন, ডি অ্যাঙ্গাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না তিনি,’ বললেন লংফেলো। ‘এ নামে কেউ নেই এনআইএসে। ছিলও না কোনকালে,’ বলেই দুম্ করে ঘুসি মেরে বসলেন টেবিলে। ‘আমি বিশ্বাস করি না! মিছে কথা বলছে লোকটা!’
‘মনে হয় না,’ শান্ত কণ্ঠে বলল মাসুদ রানা। লোকটা যদি সত্যিই তাঁর সংস্থার হত, তাহলে বিএসএসের হাতে ধরা পড়ার আগেই তাকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করতেন তিনি। অন্তত গতকাল বিএসএস প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ঘটা উচিত ছিল। কিন্তু জেনারেল তা করেননি। এখনও বহাল তবিয়তে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডি অ্যাঙ্গাস।’