পাঁচ
ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস। দু’হাতে কপালের দু’পাশের রগ চেপে ধরে বসে আছেন সংস্থার প্রধান, স্যার মারভিন লংফেলো। দৃষ্টি উদভ্রান্ত। সামনে বিছিয়ে রাখা কাগজগুলোর ওপর মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছেন প্ৰাণপণে, কিন্তু পারছেন না। সারা দেহ কাঁপছে বৃদ্ধের, দুর্বল বোধ করছেন। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কপালের রগ ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়।
কাগজগুলো একটু আগে পৌঁছেছে লংফেলোর টেবিলে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। বাদামি রঙের পুরু খামে। ওপরে ফেল্ট টিপ্ পেনে আঁকাবাঁকা অক্ষরে তাঁর নাম এবং সংস্থার ঠিকানা লেখা। লেখার ধরনটা আকৃষ্ট করেছিল লংফেলোকে। তাই আগ্রহ নিয়ে ওটাই প্রথমে খুলেছিলেন। পরমুহূর্তে চোখ কপালে উঠে গেছে, হাঁ করে ভেতর থেকে বেরোনো কাগজগুলোর দিকে চেয়ে আছেন বৃদ্ধ তখন থেকে। সাধারণ খামে, নিয়মিত ডাকে এসব ‘টপ্ সিক্রেট’ ডকুমেন্ট আসতে পারে, ব্যাপারটা তাঁর কল্পনারও অতীত।
এগুলো কে পাঠাল; সে কোথায় পেল, কি করা যায় এ ব্যাপারে, কি করা উচিত ইত্যাদি হাজারো দুশ্চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা লংফেলোর।মাথা খারাপ হওয়ার দশা প্রায়। ঘোলা চোখে আবার কাগজগুলোর ওপর নজর বোলালেন তিনি। নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এগুলো। পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের ওপর সোভিয়েত সামরিক হুমকি প্রতিহত করার কনটিঞ্জেন্সি প্ল্যান। অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
শেষবারের মত কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন লংফেলো। খালি হাতেই নাড়াচাড়া করছেন, কারণ প্রথমবারই গুরুত্ব না বুঝে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন তিনি ওগুলো। কাঁপা হাতে শীটগুলো গোছালেন বৃদ্ধ একটা একটা করে, যথাসম্ভব আলগোছে। এমন সময় ইন্টারকম বেজে উঠল। ‘মিস্টার মাসুদ রানা এসেছেন, স্যার।’
‘রানা!’ অথৈ সমুদ্রে পড়া মরণাপন্ন মানুষ ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তে যেন জীবনতরীর সন্ধান পেয়েছে। তড়াক করে আসন ছাড়লেন লংফেলো। কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘শো হিম ইন, প্লীজ!’ দ্রুত পা বাড়ালেন দরজার দিকে। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। সামনেই দাঁড়িয়ে স্যুটেড বুটেড মাসুদ রানা।
‘রানা!’ ইংরেজি কেতা ভুলে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ। ‘কংগ্রাচুলেশনস! মাই বয়, কংগ্রাচুলেশনস!’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ অনেক কষ্টে লংফেলোর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে যুক্ত করল ও।
‘এসো এসো, বোসো। তোমার এজেন্সি ফ্রি ইনভেস্টিগেশন লাইসেন্স পাওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি, রানা। আয়্যাম সো হ্যাপি।’
‘ধন্যবাদ, স্যার। এ ব্যাপারে বিএসএস এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনি আমার জন্যে যা করেছেন, সেই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না আমি।’
‘শুধু শুধু বাড়িয়ে বলছ তুমি, রানা। বরং তোমার ঋণই আমরা শোধ করতে পারব না কোনদিন। প্রচুর করেছ তুমি বিএসএস-এর জন্যে। তোমাকে সাপোর্ট দিয়ে সেই ঋণই খানিকটা শোধ করলাম এই সুযোগে। সে যাক্, বলো, তোমার নেক্সট প্রোগ্রাম কি?’
আপাতত ঢাকায় ফেরা।’
‘তাই?’ চেহারা নিষ্প্রভ হয়ে গেল লংফেলোর। ‘কবে যেতে চাইছ?’
‘আজ রাতেই, স্যার।’
‘আজই?’ পুরোপুরি হতাশ হলেন বৃদ্ধ। ওর আসার খবরে যার-পর- নাই খুশি হয়েছিলেন, ভাবছিলেন সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু ও চলে যাচ্ছে শুনে সিদ্ধান্তটা পাল্টালেন লংফেলো। না, থাক। তাতে রানা ভাববে, সাহায্য করার প্রতিদান হিসেবে ওর ঘাড়ে কায়দা করে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
‘খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে?
‘চিন্তা? হ্যাঁ, না মানে তেমন…।’ খেই হারিয়ে থেমে পড়লেন লংফেলো।
‘নতুন কোন ঝামেলা?’
খানিক আমতা আমতা করলেন তিনি। বলবেন, কি বলবেন না,
ঠিক করতে পারছেন না। কিন্তু মাসুদ রানা এক দৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে আছে, এ অবস্থায় না বলে থাকাও সম্ভব নয়। যা হয় হোকগে, ভাবলেন বৃদ্ধ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, রানা। ঝামেলাই। বেশ অভাবনীয় ঝামেলা। কি করে যে এ থেকে উদ্ধার পাব বুঝতে পারছি না। আগে এই কাগজগুলোয় চোখ বোলাও, তারপর শুনো, ‘ ফটোকপিগুলো ওর দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।
দুটো শীট দেখেই মুখ তুলল রানা। ‘ন্যাটো ডকুমেন্ট!’ ভুরু কুঁচকে উঠেছে ওর। ‘এসব আপনার কাছে কেন?’
সে প্রশ্ন তো আমারও, রানা।’
‘বুঝলাম না।’
অল্প কথায় ঘটনাটা খুলে বললেন লংফেলো। ‘প্রত্যেকটা হাইলি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট। কি করে হোয়াইটহলের বাইরে এল, কার মাধ্যমে, বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই জানাজানি হয়ে গেছে এসব। ফলে কী পরিমাণ ক্ষতি হলো ব্রিটেন এবং তার ন্যাটো মিত্রদের অনুমান করাও অসম্ভব। সবচে’ বেশি যেটা ভাবাচ্ছে আমাকে, তা হলো হোয়াইটহল থেকে এগুলোর বাইরে আসার ব্যাপারটা। এ অবিশ্বাস্য! বিশেষ ব্যবস্থাধীনে ছাড়া কোনমতেই এসব ডকুমেন্টের বাইরে আসার কথা নয়, রানা।
‘বিশেষ ব্যবস্থাটা কি?’
‘প্রয়োজন পড়লে সীল করা ব্যাগে, কড়া সিকিউরিটির মাধ্যমে হোয়াইটহলের বাইরে আসতে পারে এগুলো। শুধুমাত্র ফরেন অফিস আর কেবিনেট অফিসে যাওয়ার জন্যে। আর কোথাও নয়। তাও খুব কম, খুবই কম।’
‘এই আসা-যাওয়ার পথেই কেউ হয়তো ওগুলো বের করে ফটোকপি করিয়ে নিয়েছে সিকিউরিটিকে টাকা খাইয়ে, হতে পারে না?’
‘পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাগের সীল ভাঙতে হবে, যা আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় কারও পক্ষেই, এবং সীলে কোন অস্বাভাবিকতা থাকলে ফরেন বা কেবিনেট অফিস তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করবে আমাদের কাছে। কিন্তু তেমন কোন রিপোর্ট কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কালপ্রিট নিশ্চয়ই এতজনকে ঘুষ খাইয়ে…মানে, তা সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ সীল করা এবং ভাঙা, উভয় সময়ই চারজন করে সচিব পর্যায়ের হাই অফিশিয়াল সামনে উপস্থিত থাকেন।’
সেক্ষেত্রে সত্যিই সম্ভব নয়, মনে মনে স্বীকার করল মাসুদ রানা।
‘আবার ধরো, কেউ ডকুমেন্টগুলো বাসায় বসে স্টাডি করবে বলে নিয়ে গেছে; তাও সম্ভব নয়। এ ধরনের নিয়ম নেই। বাকি থাকে একটাই বিকল্প। কখনও কখনও এসব স্টাডি করে দেখার জন্যে বড় বড় অফিসারদের টেবিলে দেয়া হয়। আমার বিশ্বাস, সেই সুযোগটাই কেউ নিয়েছে। গোপনে ফটোকপি করিয়েছে সুযোগ বুঝে, তারপর অফিসেরটা অফিসে ফিরিয়ে দিয়েছে। চোর যে-ই হোক, সচিব পর্যায়ের নিচে নয়।
কয়েক মুহূর্ত ভাবল মাসুদ রানা। ‘এখানে পৌছার আগে কয় হাত ঘুরেছে খামটা?’
‘সর্টিং অফিসে দু’চারহাত ঘুরেছে নিশ্চয়ই। তারপর পোস্টম্যান, যে ডেলিভারি দিয়ে গেছে।’
ভেতরের ওগুলো আপনি ছাড়া আর কেউ দেখেছে?’
‘নাহ, আমিই খুলেছি খাম।
‘যে হাতিয়েছে, খুঁজলে হয়তো তার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে এতে, অন্যমনস্কের মত বলল রানা। খেয়াল করেছে ও, দশটা ডকুমেন্ট একই মাসে প্রস্তুত করা হয়েছে, দশটা বিভিন্ন তারিখে, প্রায় পুরো মাস ধরে। সবগুলো হাতানোর জন্যে পুরো মাস চলেছে চৌর্যবৃত্তি। কারণ প্রতিটি দলিল হাইলি ক্লাসিফায়েড। সাংঘাতিক গুরুত্ববহ, অবশ্যই ন্যাটোর প্রতিপক্ষের জন্যে।
‘ঠিক বলেছ,’ মাথা দোলালেন লংফেলো। ‘ল্যাবে পাঠিয়ে দেখা যাক, কি ফল হয়।’
দলিলগুলো যে-ই পাঠিয়ে থাকুক এখানে, সে কোথায় পেল? ভাবল মাসুদ রানা। নিশ্চয়ই পথেঘাটে কুড়িয়ে নয়, তাহলে?
ওগুলো ল্যাবে পাঠানো হলো। এক ঘণ্টা ধরে সবকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল চীফ টেকনিশিয়ান, তারপর হতাশ হয়ে মাথা ঝাঁকাল উপস্থিত লংফেলো ও মাসুদ রানার উদ্দেশে। দুঃখিত, স্যার। আপনাদের দুজনের ছাড়া আর কারও প্রিন্ট নেই। তবে ছিল, কোন সন্দেহ নেই।
‘মুছে ফেলা হয়েছে?’ প্রশ্ন করল মাসুদ রানা।
‘রাইট, স্যার। কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলা হয়েছে। ফাইবারের বসে যাওয়া দাগ বোঝা যায় পরিষ্কার।
মস্কোর পশ্চিমে, উসপেনস্কো ব্রিজ পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই মস্কভা নদীর তীর ঘেঁষে চোখে পড়বে দাচা কমপ্লেক্স। কয়েক হাজার একর জুড়ে সাজানো-গোছানো, নয়নাভিরাম অসংখ্য কৃত্রিম গ্রাম। একটার পর একটা, গুণে শেষ করা যায় না। প্রতিটি দাচা বার্চ আর পাইনঘেরা। কর্মকর্তাদের শ্রেণী অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে ওগুলোর আকার।
নামকরা শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের দাচা পেরেদেলকিনোয়। এগুলোর আকার এবং গঠনশৈলি মোটামুটি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পলিটব্যুরোর সদস্যদের নিচের কর্মকর্তাদের দাচা ঝুকভকায়। এগুলো মোটামুটির থেকে যথেষ্ট বড় আর উন্নত। এর পরেরগুলো উসভোয়। সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্যদের দাচা।१७
এগুলোর আকার, সৌন্দর্য আর জৌলুসের ছড়াছড়ি এক কথায় শ্বাসরুদ্ধকর। সবশেষে রয়েছে প্রজাতন্ত্রের প্রধানের দাচা। ওটাও উসভোতেই।
রাশিয়ায় দাচা বলা হয় গ্রামের বাড়িকে। সেই দাচার সঙ্গে এই দাচার কোন মিলই নেই। শ’ শ’ আকাশছোঁয়া বার্চ আর পাইনঘেরা প্রতিটি দাচার পাহারায় রয়েছে সাদা পোশাকের নাইনথ ডিরেক্টরেট বা ক্রেমলিন গার্ড বাহিনী। ভ্লাস্তিদের নিরাপত্তা রক্ষায় সদা প্রস্তুত।
এখানেই ইনটেনসিভ সেশনে বসছে রোজ অ্যালবিয়ন কমিটি। দিন- রাত মাথা ঘামাচ্ছেন তাঁরা প্রেসিডেন্টের অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্যে।
চিন্তায় পড়ে গেছে রানা মারভিন লংফেলোর সমস্যাটা নিয়ে। ও যদি ব্যাপারটা না জানত, কোন কথা ছিল না। নিশ্চিন্তে রওনা হয়ে যেতে পারত ঢাকার পথে। কিন্তু জানতে গিয়েই বিপদ বাধিয়ে ফেলেছে ও। জেনে শুনে মুখ বুজে থাকা যায় না, অন্তত বিএসএস না হোক, লংফেলোর কথা ভেবে হলেও একটা কিছু করা উচিত। এই ‘একটা কিছু’ যে কি, তা নিয়েই চিন্তায় পড়ে গেছে মাসুদ রানা।
রানা এজেন্সির ফ্রি ইনভেস্টিগেশন লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য করেছেন ওকে বৃদ্ধ। এই লাইনের সবাই যখন রানার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তখন লংফেলোই নিয়েছিলেন ওর পক্ষ। সতীর্থদের ভ্রূকুটি, অনুযোগ কিছুই গায়ে মাখেননি। সেই মানুষটি এতবড় বিপদে পড়েছেন জেনেও কি করে যায় রানা? বিবেক সায় দেয়নি। তাই যাত্ৰা কয়েকদিন পিছিয়ে দিয়েছে ও। যদিও লংফেলো মুখে বলেননি, কিন্তু ওঁর চোখ দেখেই রানা বুঝে নিয়েছে কি চাইছেন তিনি মনে মনে। আশা করে আছেন, ডকুমেন্টগুলো চুরি রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব ও নিক।
কিন্তু বলতে পারছেন না। কেন পারছেন না, বোঝে মাসুদ রানা। বললে ও অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। ভাবতে পারে, ওকে সাহায্য করে তার প্রতিদান চাইছেন লংফেলো। তাই ইচ্ছে থাকলেও মুখ ফুটে বলতে পারেননি। ওদিকে গিলটি মিয়াও পড়েছে সমস্যায়। সবকিছু ঠিকঠাক, অথচ শেষ সময় রানা মন পাল্টাল কেন ভেবে পাচ্ছে না। একবারই বাইরে গিয়েছিল আজ রানা। কোথায়, জানে গিলটি মিয়া। ওটাই হয়েছে সমস্যা। বারবার প্রেসটনের চুরি করা ব্রিফকেসের কাগজগুলোর কথা মনে আসছে।
কাগজগুলো গিলটি মিয়া নিজ হাতে বিএসএস-এর ঠিকানায় পোস্ট করে দিয়েছিল। তখন আসলে এতটা ভেবে দেখেনি সে। মাথায় ছিল ওগুলো সঠিক স্থানে পৌঁছে দেয়ার চিন্তা। এখন তার মনে হচ্ছে, ওটাই মাসুদ রানার যাত্রাবিরতির কারণ। অনেকক্ষণ থেকেই রানার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে সে কারণে-অকারণে। ব্যাপারটা খুলে জানাতে চায় ওকে। কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাছাড়া রানাও চিন্তিত। হঠাৎ করেই সুযোগটা পাওয়া গেল। নড়েচড়ে বসল মাসুদ রানা। সিগারেট ধরাল।
‘তুমি কিছু বলবে, গিলটি মিয়া?’ ঘোরাঘুরি করছে লোকটা, নজর এড়ায়নি রানার।
মাথা চুলকাল গিলটি মিয়া। ‘স্যার, মানে একটা কতা…’
‘কি কতা তাড়াতাড়ি বল। আমি ব্যস্ত।’
‘ভেবেচেন আমি তা বুজিনি? ওসব আমি, স্যার, খুব…।’ রানাকে ভুরু কোঁচকাতে দেখে প্যাচাল থামাল গিলটি মিয়া। মানে ক্যালকাটার আমার এক সাকরেদ…।’এবারও থেমে পড়তে বাধ্য হলো সে টেলিফোন বেজে উঠতে। মাসুদ রানার টেবিলের লাল ফোনটা। থাবা চালাল রানা রিসিভার লক্ষ্য করে, অন্য হাতে গিলটি মিয়াকে অপেক্ষা করতে বলল।
‘হ্যালো!’
‘রানা?’ জলদগম্ভীর চিরপরিচিত গলাটা চিনতে পারা মাত্র বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর। ঢাকা থেকে বিসিআই প্রধান মেজর জেনারেল রাহাত খান (অবসরপ্রাপ্ত)।
‘জ্বি, স্যার,’ সিধে হয়ে বসল ও। চট করে হাতঘড়ির ওপর নজর বুলিয়ে নিল। বিকেল চারটা। তারমানে ঢাকায় রাত দশটা। বাসা থেকে করেছে নিশ্চয়ই বুড়ো। কি এমন জরুরি…।
‘কেমন আছো?’
‘জ্বি, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন, স্যার?’
‘হ্যাঁ, ভাল। তোমার ফ্রি ইনভেস্টিগেশনের লাইসেন্স পাওয়ার খবর শুনলাম। কংগ্রাচুলেশনস।’
‘ধন্যবাদ, স্যার।’ জিভ কাটল মাসুদ রানা। খবরটা ওর নিজেরই দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু নানান ঝামেলায় দিতে পারেনি।
‘তোমার ফ্লাইট ক’টায়। রওনা হচ্ছো আজ?’
‘না, স্যার। একটু ঝামেলায় পড়ে গিয়েছি, স্যার। বিএসএস-এ হঠাৎ করে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু ন্যাটো ডকুমেন্ট…’
‘আমি শুনেছি, রানা। কথা হয়েছে লংফেলোর সঙ্গে। তা ইয়ে, ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছ কিছু?’
‘ভাবছি এখনও, স্যার। কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। এই কারণেই যাওয়া পিছিয়ে দিয়েছি।
‘ভালই করেছ। আমার মনে হয় এ সময় লংফেলোকে খানিকটা সাহায্য করা গেলে মন্দ হত না। যথেষ্ট করেছে ও তোমার জন্যে।
‘আমিও তাই ভাবছি, স্যার।’
‘গুড।’
‘এ ব্যাপারে স্যার লংফেলো আপনাকে কোন অনুরোধ করেছেন, স্যার?’
‘না না। কেবল ঘটনাটা জানিয়েছে। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে ওকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলাম। তখন ঘটনাটা বলল লংফেলো। ও হয়তো লজ্জায় পড়ে গেছে। বলতে পারেনি আমি অন্য কোন কিছু মনে করে বসতে পারি ভেবে।
‘আমারও সেরকমই ধারণা, স্যার। অন্য সময় হলে ভদ্রলোক কাজটা করে দেয়ার অনুরোধ করতে দ্বিধা করতেন না। আপনি কি, স্যার, কাজটা নিতে বলছেন?’
‘না, রানা। নেয়া না নেয়া তোমার ইচ্ছে। তবে আমার মনে হয় নিলে মন্দ হত না। অনেক সাহায্য করেছে তোমাকে লংফেলো।
ভড়ং গেল না বুড়োর, ভাবল মাসুদ রানা। রাহাত খান মনে মনে ঠিকই চাইছেন কাজটা ও নিক। অফিশিয়াল কাজের বাইরে কাউকে কিছু করতে সরাসরি কখনোই বলেন না কট্টর বুড়ো। বলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, যাতে কেউ না ভাবে তার ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। কৌশলটা মন্দ নয়। ‘কাজটা তাহলে নিচ্ছি আমি, স্যার।’ সোজাসুজি বললেই হয়, কাজটা নিয়ে নাও, তা নয়। গজ গজ করল ও মনে মনে।
‘ভালই হয় তাহলে, রানা। লংফেলো খুব খুশি হবে।’
সব স্যার লংফেলোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে, নিজের যেন কোন অনুভূতি নেই। ‘ঠিক আছে, স্যার। নিলাম আমি কাজটা।’
‘ভেরি গুড। তো, রাখলাম তাহলে।’
‘জ্বি। স্লামালেকুম।’
রিসিভার রেখে কিছুক্ষণ ভাবল রানা। তারপর গিলটি মিয়ার দিকে তাকাল। ‘কি যেন বলছিলে তখন তুমি?’
‘আমার এক সাকরেদের কতা, স্যার।’११
কোন লাইনের, থ্রী সেবেনটি নাইন?’
হেসে ফেলল গিলটি মিয়া রানা ওকে নকল করছে দেখে। ‘জ্বি, স্যার।’
‘কি হয়েছে তার?’
‘ওর কিচু হোইনিকো।’
‘তবে?’
‘কদিন আগে এক বাসায় চুরি করতে গেছল ও। গতমাসের শেষ তাঁরিকে।’
‘একত্রিশে ডিসেম্বর?’
‘জ্বি। ওর পচোন্দের ক’টা ডায়মন।’
‘হুঁম! তারপর? ধরা পড়েছে?’
‘না, স্যার। পেসটন ধরা পড়ার বান্দাই লয়।
‘আচ্ছা, বুঝলাম। তাড়াতাড়ি শেষ করো। কাজ আছে আমার, বাইরে যাব।’
‘আপনি যে কাজে যাচ্চেন, সেই ব্যাপারেই…মানে…।’ থেমে মাথা চুলকাতে লাগল গিলটি মিয়া।
থমকে গেল মাসুদ রানা। ‘সেই ব্যাপারেই মানে! তুমি জানো আমি কি কাজে যাচ্ছি?’
‘জানি, স্যার। সকালে যেকেনে গিয়েচিলেন, সেকেনেই যাচ্ছেন আবার। কাগজগুনো কে পেটিয়েচে ওদের ঠিকানায়, তা…’
সিধে হয়ে গেছে রানা আগেই। তাজ্জব হয়ে চেয়ে আছে গিলটি মিয়ার দিকে। তুমি কি করে জানো ওগুলোর কথা?’
‘লে হালুয়া! জানব না কেন, স্যার। আমিই তো পেটিয়েছি ওগুনো।’ ‘কি!’ চোখ কপালে উঠল মাসুদ রানার।
‘তবে আর বলচি কি! ভেবেচিলুম কেউ কিছু টের পাবে না। কিন্তুক আপনাকে এই ঝামেলায় এঁটকে…জ্বি?’
‘এদিকে এসো। বোসো আমার সামনে।
নীরবে নির্দেশ পালন করল গিলটি মিয়া। মাটি থেকে চার ইঞ্চি ওপরে ঝুলছে ওর পা জোড়া। স্ট্যাণ্ডার্ড সাইজ চেয়ারে বসলে এই অবস্থাই হয় লোকটার।রানাকে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠতে দেখে খানিকটা ভড়কে যেন।
‘খুলে বলো পুরো ঘটনা। একটিও বাড়তি কথা নয়।
‘জ্বি,’ একান্ত বাধ্যগতের মত মাথা দোলাল সে। ‘নাও, শুরু করো।’
শুরু করল গিলটি মিয়া। অভ্যেসবশে কয়েকবারই মুখ থেকে বাড়তি বেফাঁস দুই একটা শব্দ যে বেরোয়নি, তা নয়। তবে প্রতিবারই রানার নীরব শাসানি বেলাইন থেকে খুব দ্রুত লাইনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে তাকে। এক সময় থামল গিলটি মিয়া।
উঁচু পিঠের রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকল মাসুদ রানা। চোখ টেবিল ল্যাম্পের গোড়ায় বসানো সুইচের ওপর। অন্যমনস্ক। ওকে এখনই একবার নিয়ে আসতে পারবে আমার কাছে? কোন বাসা থেকে চুরি করেছে দেখিয়ে দেবে দূর থেকে।’
‘নিশ্চয় পারব। কিন্তু…।’
‘ভয়ের কোন কারণ নেই। কোন ক্ষতি হবে না তোমার সাগরেদের। শুধু বাসাটা আমাকে দেখিয়ে দিলেই চলবে।’
‘ঠিক আচে,’ টুপ করে নেমে পড়ল গিলটি মিয়া। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নিজেকে বাহবা দিল রানা হাতে নেয়ার আগেই অর্ধেক সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হয়ে গেল বলে। এখন কায়দা করে ডকুমেন্ট চোরের স্বীকারোক্তিটা আদায় করা গেলেই বাকি অর্ধেক সমাধা হয়ে যাবে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর ফিরল গিলটি মিয়া। কি বলেছে জিম প্রেসটনকে, সে-ই জানে। নিশ্চিন্ত মনে চলে এসেছে। কিন্তু রানার অফিসরূমে পা দিয়েই মুখের চেহারা বদলে গেল প্রেসটনের। আইনের লোক চিনতে ভুল হয় না তার। থেমে পড়ল সে মাসুদ রানাকে দেখে। চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘এই ছিল তোমার মনে, ওস্তাদ?’
‘চুপ কর! ম্যালা ম্যালা কতা বলিস। স্যার, এই আমার সাকরেদ।
‘জিম প্রেসটন?’ মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা। বুঝে ফেলেছে লোকটার মনোভাব।
‘জ্বি, স্যার।’
‘বোসো।’
বিহ্বল দৃষ্টিতে ওস্তাদের দিকে তাকাল প্রেসটন। খেঁকিয়ে উঠল গিলটি মিয়া। ‘কলাগাচের মতন ভেঁড়িয়ে আচিস যে তবু?’
এগিয়ে এসে রানার মুখোমুখি বসল প্রেসটন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে লোকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ও। ‘যে বাসা থেকে ডায়মণ্ড চুরি করেছ, সে বাসাটা আমাকে শুধু চিনিয়ে দেবে তুমি। ঘাবড়াবার কিছু নেই, তোমার কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছি না আমি।’
উত্তর দেয়ার আগে আরেকবার গিলটি মিয়ার দিকে তাকাল প্রেসটন। ‘ভয় পাসনে। কুনো ক্ষতি হবে না তোর। স্যার খুব দয়ালু মানুষ। শুদু বাসাটা দেকিয়ে দিয়েই তুই খালাস। বুজলি?’
দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল জিম প্রেসটন। ‘আচ্ছা।’
‘আরে, রানা!’ অবাক হয়ে গেলেন লংফেলো। ‘তোমার না আজই চলে যাওয়ার কথা?’
o ‘ছিল। কিন্তু পরে আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ হাসছে রানা।
‘কেন?’
‘ঠিক করেছি কাজটা শেষ করেই ফিরব।’
চশমাটা ঠেলে ওপর দিকে তুললেন বৃদ্ধ। আরও একটু ভাল করে তাকালেন ওর দিকে। ‘কোন কাজ?’
‘ন্যাটোর ডকুমেন্টস চোরকে ধরা।’
‘তুমি সিরিয়াস, রানা?’
‘অবশ্যই।’
খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল বৃদ্ধ লংফেলোর। ‘গড ব্লেস ইউ, মাই চাইল্ড।’