চার
দুটো গাড়িতে এল ওরা চারজন। গাট্টাগোট্টা, বিশালদেহী সবাই। ভীতিকররকম হিংস্র চেহারা। মলেনস্ট্রাটে রাউল লেভির বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল দুই আরোহীসহ একটা কালো সেডান। অন্য দুজনকে নিয়ে আরেকটা সেডান দাঁড়াল শ’ খানেক গজ এগিয়ে। দুটো গাড়ির প্যাসেঞ্জার সীটে বসা দুজন নেমে পড়ল। ড্রাইভার দুজন নামল না। আলো নিভিয়ে বসে থাকল চুপচাপ এঞ্জিন চালু রেখে।
সন্ধে সাতটা। প্রচণ্ড শীত পড়েছে আজ। মানুষজনের কোন চিহ্নই নেই রাস্তায়। আরোহী দুজন লেভির বাংলোর ফ্রন্ট ডোরে এসে নক্ করল। লেভি স্বয়ং খুলল দরজা। পাথরমুখো দুই বিশালদেহী ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। প্রতিবাদ জানাবার জন্যে মুখ খুলতে গেল রাউল লেভি, কিন্তু সোলার প্লেক্সাসে ভয়ঙ্কর এক পাঞ্চ খেয়ে স্বর আটকে গেল গলার কাছে। চিত হয়ে পড়েই যাচ্ছিল সে আরেকটু হলে।
কলার চেপে ধরে ঠেকাল অন্যজন। দরজার কাছের একটা স্ট্যাণ্ডে ঝুলছে লেভির ওভারকোট, ওটা তার কাঁধের দুদিকে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। তারপর দুজন দু’পাশ থেকে ধরে বাংলো থেকে বের করে নিয়ে এল তাকে। ব্যথায় এখনও চোখে আঁধার দেখছে রাউল লেভি। বাধা দেয়ার মত শক্তি বা ক্ষমতা কোনটাই নেই। ঘোরের মধ্যে হাঁটছে সে আগন্তুকদের সঙ্গে।
বাংলোর গেটে অপেক্ষমাণ সেডানের পিছনের দরজা মেলে ধরেছে ড্রাইভার ওদের এগিয়ে আসতে দেখে। ভেতরে ঠেলে ঢোকানো হলো রাউল লেভিকে। দু’পাশে বসল দুই বিশালদেহী। অবাক ব্যাপার, এতক্ষণে লোকগুলোর মুখ থেকে একটা শব্দও বের হতে শোনেনি লেভি। যেন কথা বলতে জানে না কেউ, বোবা। রওনা হয়ে গেল সেডান।
গ্রামের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের পঞ্চাশ একর জোড়া বিশাল পাবলিক পার্ক কেসেলসি হেইডের ঠিক মাঝখানে এসে থামল গাড়ি দুটো। দ্বিতীয় গাড়ির একমাত্র আরোহী-কাম-চালক বেরিয়ে এসে প্রথমটির চালকের পাশের সীটে বসল। সে-ই দলনেতা। পিছন ফিরে সঙ্গীদের কিছু একটা ইঙ্গিত করল সে। এবার রাউল লেভির ডানদিকে বসা লোকটি দু’হাতে শক্ত করে ঠেসে ধরল তাকে। যাতে নড়াচড়া করতে না পারে লেভি।
বাঁ পাশের জন পকেট থেকে বের করল ভারি একজোড়া প্লায়ার্স। অত্যন্ত ধীর স্থির ভঙ্গিতে লেভির বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে পর পর তিনটে আঙুলের গাঁট গুঁড়ো করে ফেলল সে প্লায়ার্সের প্রচণ্ড চাপে। চিৎকার করতে পারছে না রাউল, কারণ ঘুরে বসে তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে ড্রাইভার। সীটের নরম গদিতে প্রায় সেঁধিয়ে গেছে তার মাথার অর্ধেকটা।
মাথা ঝাঁকাল দলনেতা। ‘কথা বলতে চাও?’
বুকের ভেতর ঘড় ঘড় করছে রাউল লেভির। মুখ চেপে ধরে রাখার ফলে বের হওয়ার পথ পাচ্ছে না আর্ত গোঙানি। দ্রুত মাথা দোলাল সে, চায়।
মুখ চেপে ধরা হাতটা সরে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় নেতিয়ে পড়ল লেভি। দীর্ঘ পাঁচ মিনিট ফোঁপাল সে, গোঙাল। বাধা দিল না কেউ। মূর্তির মত বসে থাকল চার বিশালদেহী। আরও পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হলো তাকে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার। তারপর মুখ খুলল দলনেতা। ‘লণ্ডন থেকে চুরি যাওয়া ডায়মণ্ড। কোথায় আছে ওগুলো?’
পোলিস অ্যাকসেন্টের ফ্লেমিশ ভাষায় গড়গড় করে বলে গেল রাউল লেভি। দেরি করল না এক মুহূর্তও।
মাথা দোলাল দলনেতা সন্তুষ্ট হয়ে। ‘সেফের চাবি?’
লেভির পকেটেই ছিল চাবি। গোছাটা নিয়ে দ্বিতীয় সেডান চালিয়ে তার বাংলোয় ফিরে চলল লোকটা। ডায়মণ্ডগুলো নিয়ে আসতে যাচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে পার্কের গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেল গাড়িটা। ভাঙা আঙুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরে অনবরত গোঙাতে লাগল রাউল লেভি। পাশের লোক দুটো একবার তাকালও না তার দিকে। যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ড্রাইভারও তেমনি। সোজা সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে। স্টিয়ারিঙ হুইলে তবলা বাজাচ্ছে গ্লাভস পরা আঙুল দিয়ে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর ফিরে এল দলনেতা। নিজের গাড়ি ছেড়ে এটায় এসে উঠল। ‘শেষ একটা প্রশ্ন। এগুলো কে দিয়ে গেছে তোমাকে, কি নাম তার।’
মাথা দোলাল লেভি। বলবে না। কিন্তু বলতে বাধ্য করা হলো তাকে। ভাল হাতের আরও দুটো আঙুল খোয়াবার পর মুখ খুলল সে। বলে দিল লুইস কিরলনস্কির নাম। নিঃশব্দে পার্ক ত্যাগ করল গাড়ি দুটো। একটায় রাউল লেভিসহ তিনজন। অন্যটায় দলনেতা একা। টানা বিশ মিনিট পর নিয়েলেনের দু’মাইল পুবে লূই স্ট্রাট ক্রসিঙে পৌঁছল তারা। সামনেই লিয়ের-হেরেন্টাল রেল লাইন, তীরের মত সোজা চলে গেছে।
রেল লাইনের দুই পারে ছড়ানো-ছিটানো কয়েকটা খামারবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। জনমানবের কোন সাড়া নেই কোথাও। রেল ক্রসিঙের সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে পড়ল সেডান দুটো। আলো নিভিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে দেয়া হলো। প্রথম গাড়ির চালক বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে ঘরে তৈরি বিশেষ এক ধরনের মদ ভরা বোতল তুলে দিল লেভির ডানপাশের সঙ্গীর হাতে।
জোর করে বোতলের সবটুকু গেলানো হলো রাউল লেভিকে। তারপর চুপ করে বসে থাকল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেল লেভি। ঢুলছে মৃদু মৃদু। তার বরং ভালই লাগছে। অ্যালকোহলের প্রভাবে হাতের ব্যথা এখন আর খুব একটা টের পাচ্ছে না। এগারোটা পনেরোয় গাড়ি থেকে ধরাধরি করে বের করা হলো তাকে।
রেল গাড়ির আওয়াজ আসছে। এগারোটায় লিয়ের থেকে ছাড়া মালবাহী ডিজেল-ইলেক্ট্রিক নন স্টপ লোকো আসছে। সাধারণত সত্তর মাইল বেগে এই ক্রসিং অতিক্রম করে ওটা। রাউল লেভি তখন প্রায় অজ্ঞান। দেহটা রেলের ওপর শুইয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেল লোকগুলো। অপেক্ষা করতে লাগল শেষটুকু দেখার জন্যে।
একেবারে অন্তিম মুহূর্তে নিথর পড়ে থাকা দেহটার ওপর চোখ পড়ল লোকো চালকের। পলকে ব্রেকের ওপর দাঁড়িয়ে গেল সে। রেল আর হুইলের প্রচণ্ড ঘর্ষণে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। আতশবাজির ফুল্কির মত স্ফুলিঙ্গের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। গতি অনেকটা মন্থর হয়ে পড়ল মালগাড়ির। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
কম করেও ত্রিশ মাইল গতিতে রাউল লেভির দেহটা দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে গেল লিয়ের-হেরেন্টাল লোকো। লাইনের ওপর চাকা ঘষে ঘষে আরও এক-দেড়শো গজ এগিয়ে থামল দীর্ঘ গাড়িটা। লাফিয়ে নামল চালক টর্চলাইট নিয়ে। কাছে এসে এক পলক দেখল সে রক্ত মাংসের খণ্ড দুটো। তারপর কাছের খামারবাড়ির দিকে ছুটল পুলিসে টেলিফোন করতে।
তার আগেই নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে গেছে কালো সেডান দুটো।
লোকগুলোকে দেখামাত্রই চিনে ফেলল লুইস কিরলনস্কি। চেহারাতেই ফুটে আছে তাদের প্রকৃতি। বাসায় লুইস একা, স্ত্রী মেলিণ্ডা গেছে শপিঙে। টিভিতে খবর দেখছিল সে। রোজই আশা করে, আজ হয়তো গ্লেন ডায়মণ্ড চুরি হওয়ার খবর বলবে টিভি। কিন্তু পাঁচ দিন পেরিয়ে গেল, এখনও কোন খবর নেই। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। এমন গরম খবর কি করে গোপন থাকে?
করাঘাতের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দিল সে। ভেবেছে বুঝি মেলিণ্ডা। পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল লোক তিনটে। ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। ইস্ট এণ্ডের মাস্লম্যান এরা। আণ্ডারওয়ার্ল্ডে ‘স্ল্যাগ’ নামে পরিচিত। এদের দুটোকে বোধবুদ্ধিহীন রোবট বলে মনে হলো কিরলনস্কির। হুকুম পেলে করতে পারে না এমন কাজ নেই।
অন্যজন, মাথায় নোংরা সোনালি চুল। ছুঁচোর মত চেহারা। পেটা স্বাস্থ্যের অধিকারী। দলনেতা। এই চেহারা এবং প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে অনেক আগেই পরিচয় হয়েছে লুইস কিরলনস্কির। অসউইজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। তাদের অবশ্য ইউনিফর্ম ছিল পরনে। কাজেই বাধা দেয়ার কোন চেষ্টাই করল না সে। জানে বাধা দিয়ে বা দয়া ভিক্ষা করে কোন লাভ নেই। ওরা যা করতে এসেছে তা করবেই। ঠেলতে ঠেলতে সীটিংক্রমে নিয়ে এল তারা কিরলনস্কিকে। ধাক্কা মেরে বসিয়ে দিল একটা আর্মচেয়ারে। পিছনে গিয়ে দাঁড়াল একজন, লুইসের দু’হাত টেনে নিয়ে গেল পিছনে, ধরে থাকল শক্ত করে। আরেকজন সামনে দাঁড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ বিশাল ডান হাতে ‘চটাশ্’ ‘চটাশ্’ ঘুসি মারছে বাঁ হাতের তালুতে। একটা টুল নিয়ে এসে লুইস কিরলনস্কির মুখোমুখি সামান্য ডানদিকে সরে বসল দলনেতা।
‘মারো!’ হুকুম দিল সে।
লুইসের নাকমুখ লক্ষ্য করে ভয়ঙ্কর শক্তিতে ঘুসি মেরে বসল সামনেরজন। তামার তৈরি পাঞ্জা পরে নিয়েছে সে কখন যেন, খেয়াল করেনি কিরলনস্কি। চোখের পলকে চেহারা পাল্টে গেল তার। সামনের দিকের উভয় পাটির দাঁত মাড়ি সব ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল কেটে।থুতনি বেয়ে দরদর করে গড়িয়ে নামতে লাগল তাজা রক্ত। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে পিছনে হেলে গেল মাথাটা তার বেকায়দা ভঙ্গিতে।
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল ছুঁচো। ‘ওখানে নয়, হাঁদা! ওকে দিয়ে কথা বলাতে হবে জানো না? নিচে মারো।’
এবার লুইসের বুকের দু পাশে রিবের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে পর পর দুটো ঘুসি চালাল লোকটা। ভেতরের হাড় ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল পরিষ্কার ভাঙা গলায় প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল কিরলনস্কি। আবার হেসে উঠল দলনেতা। ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছে সে। এ জাতীয় দৃশ্য সব সময়ই আনন্দ দেয় তাকে।
গায়ের সবটুকু জোর এক করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিরলনস্কি। কিন্তু পিছনের হাত দুটো যেন লোহায় গড়া, নড়ানো গেল না একচুলও। এই সময় কথা বলে উঠল দলনেতা। ‘তুমি মানুষটা ভাল নয়, লুইস। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে খেপিয়ে তুলেছ তুমি। কার কাছ থেকে পেয়েছ জিনিসগুলো?’
কুলি করে মুখ ভর্তি রক্ত আর গোটা চারেক দাঁত ফেলল লুইস। উত্তর দিল না।
‘বলে ফেলো কার কাছ থেকে পেয়েছ জিনিসগুলো। যত তাড়াতাড়ি বলবে ততই তোমার মঙ্গল। তার আগে শুনে রাখো, রাউল লেভির খোঁজ পেয়ে গেছি আমরা।’
চোখ বুজল লুইস কিরলনস্কি। মুখ খোলার লক্ষণ নেই কোন।
রেগেমেগে পাঞ্জা পরা সঙ্গীকে ইঙ্গিত করল ছুঁচোমুখো। আবার শুরু হলো ঘুসি বৃষ্টি। যতক্ষণ না নামটা উচ্চারণ করল সে, ততক্ষণ চলল নির্দয় মার। নামটা শোনামাত্র হাত তুলে আঘাতকারীকে থামতে বলল নেতা। পিছনেরজন হাত ছেড়ে দিল লুইসের। গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল মৃতপ্ৰায় জুয়েলার। দম নিচ্ছে ছোট ছোট। নীল হয়ে গেছে ঠোঁটের চার পাশ।
‘হার্ট অ্যাটাক করেছে ব্যাটার,’ বলল একজন। ‘মরল বলে।’
‘চলো, কেটে পড়ি।’
দ্রুত বেরিয়ে এল দলটা। দূরে রেখে আসা পুরানো একটা ভ্যানের দিকে চলল জোর পায়ে। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল মেলিণ্ডা। দু হাতে গোটা পাঁচেক ঢাউস শপিঙ ব্যাগ নিয়ে নিজের দামী মেট্রো থেকে বেরিয়ে বাংলোর দিকে পা বাড়াল। বাংলোর সামনের দরজা খোলা দেখে বেশ অবাক হলো সে।
দু’ মিনিট পর ব্যস্ত হাতে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতে দেখা গেল মেলিণ্ডাকে। কাঁদছে ঝর ঝর করে। ছয় মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল অ্যাম্বুলেন্স, রয়্যাল ফ্রী হাসপাতালের দিকে ছুটল মৃতপ্রায় লুইস কিরলনস্কিকে নিয়ে। তার এক হাত ধরে পাশে বসে থাকল মেলিণ্ডা। অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হঠাৎ করেই চোখ খুলল লুইস।
আঙুলের ইশারায় তার মুখের সামনে কান পাততে বলল সে স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে বসল মেলিণ্ডা। প্রাণান্তকর চেষ্টায় ফিস্ ফিস্ করে দু’চারটে শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম হলো কিরলনস্কি। শুনে কপাল কুঁচকে উঠল মেলিণ্ডার। হতভম্ব হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স হ্যাম্পস্টেড পৌছার আগেই মারা গেল লুইস কিরলনস্কি।
হাসপাতালের ‘ডেড অন অ্যারাইভেল’ রেজিস্টারে নাম উঠল তার। লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হলো ব্যবচ্ছেদের জন্যে। এর কয়েক মিনিট পর টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল জিম প্রেসটনের। ফোন ধরে আহাম্মক হয়ে গেল সে। ওপাশে একটি নারীকণ্ঠ, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কথা বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ লাগল মেলিণ্ডার নিজেকে সামলাতে। রয়্যাল ফ্রীর ক্যাজুয়ালটি অ্যাডমিশন থেকে ফোন করেছে সে।
তার বক্তব্য মন দিয়ে শুনল জিম প্রেসটন। ঘুমের রেশমাত্র অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে। ‘ঠিক আছে, মেলিণ্ডা। অনেক ধন্যবাদ। আর…লুইসের জন্যে আমি খুব দুঃখিত, খুবই দুঃখিত। ঝামেলা মিটিয়ে তোমার ওখানে আসছি আমি, কেমন? রাখলাম।’
রিসিভার রেখে কয়েক মুহূর্ত ভাবল প্রেসটন। তারপর বিরতি না দিয়ে দু জায়গায় দু’টো ফোন করল। তার মেশিন ওয়ার্কশপের দুই কর্মচারী, স্মিথ ও টাশকে। দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছল প্রেসটনের ওখানে। নিৰ্দেশমত যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে। এর ঠিক ত্রিশ মিনিট পর নক্ হলো দরজায়।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল প্রেসটন। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে শেষবারের মত দেখে নিল সঙ্গীদের অবস্থান। বুক ভরে বাতাস টানল, তারপর খুলে দিল দরজা। ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়ল অমার্জিত, ইতর চেহারার দুই মাসলম্যান। পিছনে দলনেতা, সোনালি চুলের ছুঁচোমুখো। দ্রুত পিছিয়ে এল জিম প্রেসটন, ছোট্ট করিডর পেরিয়ে সীটিংরূমে এসে দাঁড়াল। করিডরের একদিকে কিচেনের দরজা, অন্যদিকে কোট’স কাবার্ড।
সঙ্গীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে এল দলনেতা, চেঁচিয়ে পিছনের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিল। সশব্দে লেগে গেল দরজা। পরক্ষণেই বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো অল্প পরিসর করিডরে। কাবার্ড ও কিচেনের মুখোমুখি দরজা নিঃশব্দে বিস্ফোরিত হলো। প্রথম আঘাত হানল বিল টাশ। কিচেন থেকে বেরিয়েছে সে। ভারি একটা স্লাইড রেঞ্চ সজোরে বসিয়ে দিল সে ছুঁচোর এক স্যাঙাতের মাথার পিছনে। হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল লোকটা জ্ঞান হারিয়ে।
বিপদ বুঝে অন্যজন পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘাড় ঘোরাতেই মাথার ওপর একটা নেইলবার তুলে ধরে অপেক্ষমাণ বিকট চেহারার রজার স্মিথকে দেখে জানের পানি শুকিয়ে গেল তার। ধাঁই করে ওটা তার মাঝ কপালে ঝেড়ে দিল স্মিথ। আঘাত পাওয়া জায়গাটা স্পর্শ করার জন্যে হাত তুলল সে, কিন্তু খানিক উঠেই থেমে গেল হাতটা। ঝুলে পড়ল শিথিল হয়ে। ঝপ্ করে বসে পড়ল সে, তারপর সটান শুয়ে পড়ল চিত হয়ে।
পরের দৃশ্যটা হলো দেখার মত। ঠিক তাড়া খাওয়া ছুঁচোর মতই দশা হলো ছুঁচোমুখোর। সঙ্গীদের দেহ টপকে টপকে দরজার সামনে পৌঁছে গেল সে দুই লাফে। খামচা-খামচি করছে দরজার গায়ে, হাতল ধরতে চাইছে। হাত বাড়িয়ে লোকটার স্কার্ফ মুঠো করে ধরল জিম প্রেসটন। পিছনে টেনে এনে দড়াম করে দেয়ালের সঙ্গে ঠুকে দিল মুখের একটা পাশ।
সঙ্গে সঙ্গে আরেক হেঁচকা টানে এ-পাশের দেয়ালে এনে ফেলল তাকে প্রেসটন। দেয়ালে ঝোলানো মোনালিসার বড় একটা কাঁচ বাঁধানো পোর্ট্রেটের ওপর পড়ল সে, কাঁচ ভেঙে গালের কয়েক জায়গায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলো তার। বিল আর স্মিথ ওদিকে অজ্ঞান দুটোকে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে হতভম্ব দলনেতাকে সীটিংক্রমের রাস্তার দিকে পিকচার উইণ্ডোর সামনে নিয়ে এল জিম প্রেসটন।
এক মিনিট পর তার ফ্ল্যাটের জানালা গলে দেহের অর্ধেকটা শূন্যে ভেসে পড়ল ছুঁচোর। বিল এবং রজার কোমর আর পা ধরে ঠেকিয়ে রেখেছে তার পতন। ‘কার পার্কটা দেখতে পাচ্ছ নিচের?’ শান্ত গলায় প্রশ্ন করল প্রেসটন।
ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল লোকটার। প্রেসটনের এখানে আসতে চায়নি সে প্রথমে। লুইস কিরলনস্কির ওখান থেকে বেরিয়ে ডেরায় ফিরে যাওয়ার পথে থেমে ওদের নিয়োগকর্তাকে টেলিফোনে প্রেসটনের নামটা জানিয়ে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু পারেনি। এ দায়িত্বটাও লোকটা গছিয়ে দিয়েছে তার ঘাড়ে।অবশ্য মোটা টাকার বিনিময়েই।
ওই লোভই কাল হলো শেষ পর্যন্ত। ওরা যত বড় মাস্তানই হোক, ইস্ট লণ্ডনের। এ অঞ্চলে সম্পূর্ণ অনাহৃত। তাছাড়া যতই নির্দয় আর কসাই হোক না কেন, এসব সাউথ লণ্ডনারদের তুলনায় ওরা দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া কিছু নয়। এদের হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতার কেচ্ছা শুনলে শহরের অন্য সব এলাকার মাস্তানদের মত ওদের মাথাও চক্কর খায়। বোঝা যাচ্ছে তেমনি এক দলের হাতেই ধরা খেয়েছে আজ ওরা কপাল দোষে।
দুঃখে চোখে পানি এসে পড়ার জোগাড় দলনেতার। আসার সময় ভেবেছিল এত রাতে কেউ কিছু টের পাবে না। কেউ জানবে না তাদের ‘বর্ডার ক্রসিঙের’ ব্যাপারটা। অথচ ঘটল কিনা উল্টো, পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে!
মাথা দোলাল দলনেতা, পাচ্ছে। তীব্র আতঙ্কে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে তার কপালে। ঢোঁক গিলছে সে ঘন ঘন।
‘ওখানে আছড়ে পড়ে লাশ হয়ে যাবে তুমি এখনই। দারুণ একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে।’
শিউরে উঠল সোনালিচুলো। ‘না! প্লী-ই-জ! মেরো না আমাকে।’
‘ঠিক আছে, মারব না। বিনিময়ে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।’
‘হ্যাঁ, দেব। সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’
সীটিংরুমে নিয়ে আসা হলো লোকটাকে চ্যাঙদোলা করে। বসিয়ে দেয়া হলো মেঝেতে। প্রেসটন বসল তাঁর মুখোমুখি একটা সোফায়। ‘বুড়ো মানুষটাকে কেন খুন করলে তোমরা?’ গলায় বিন্দুমাত্র রাগের আভাস তার।
‘কথা আদায় করতে গিয়ে…’
‘কিসের কথা? কার হুকুমে?
‘একটা চোরাই জিনিসের কথা। ওটা নাকি তোমার কাছ থেকে পেয়েছে লোকটা, শুনলাম।’
না।’
‘লোকটাকে যে তোমরা মেরে ফেলেছ, তা জানো?’
একটু থমকাল ‘স্ল্যাগ’। ‘দুঃখিত। লোকটার হার্টের অবস্থা জানতাম না।’
‘কে গায়ে হাত তুলেছে ওর?’
‘না। আসলে তেমন…’
‘চড়াৎ’ করে লোকটার ডান কানের ওপর প্রচণ্ড এক চড় বসাল জিম। ‘শুয়োরের বাচ্চা! পুরো মুখ থেঁতলে গেছে লোকটার। চার-পাঁচটা রিব ভেঙে গেছে বুকের। কার হুকুমে করেছিস তোরা এসব!’
‘নাম জানি না। টেলিফোনে নির্দেশ পেয়েছি আমরা। শুধু কাগজগুলো পেলেই…’
‘কিগুলো’ হতভম্ব হয়ে গেল জিম প্রেসটন।
‘কাগজগুলো।
‘কিসের কাগজ!’
‘তা জানি না। ব্রিফকেসের মধ্যে ছিল। ওগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাকে।’
কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তায় ডুবে থাকল প্রেসটন। মাথায় খেলছে না কিছু। অমন বহুমূল্য ডায়মণ্ড বাদ দিয়ে কয়েকটা কাগজ…। ‘ওগুলো নেই। ফিরে গিয়ে তোমার বেশ্যার বাচ্চা নিয়োগকারীকে বলবে, ব্রিফকেসটা পুড়িয়ে ফেলেছি আমি। ওর মধ্যে কাগজ-টাগজ ছিল কি না জানি না আমি। ঠিক আছে?’
জোরে জোরে মাথা দোলাল লোকটা। ‘হ্যাঁ।’
‘হারামজাদাগুলোকে ওয়াটারলু ব্রিজ পার করে দিয়ে এসো,’ বিল এবং স্মিথের উদ্দেশে বলল জিম প্রেসটন। আরেকটা চড় কষাল ছুঁচোর গালে। ‘জীবনে আর কখনও ভুলেও যদি দক্ষিণ লণ্ডনে পা রেখেছিস, সেদিনই হবে তোর শেষ দিন। মনে থাকবে কথাটা?’
ভদ্রলোকের মত সম্মতি জানাল লোকটা। ‘থাকবে।’
‘যা, মড়াখেকোর বাচ্চা!
ঠেলে গুঁতিয়ে ওদের তিনটেকে দরজার কাছে নিয়ে গেল বিল আর রজার। আহত দুটো চাপা গলায় কাতরাচ্ছে। পিছন থেকে ডাকল জিম। ছুঁচোমুখোকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার হয়ে ওকে কিছুদিন মনে রাখার মত শুভেচ্ছা জানিয়ে দিয়ো। বুড়োর আত্মা খানিকটা শান্তি পাবে তাতে।’
হাসি ফুটল দাগী দুই সাউথ লণ্ডনারের কাটাকুটি ভরা মুখে। ‘অবশ্যই। ভাববেন না,’ বলল বিল টাশ।
দরজা লাগিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে এল প্রেসটন। কড়া করে এক কাপ এসপ্রেসো বানাল। আজ রাতে আর ঘুম আসবে না ওর কিছুতেই। কাজেই অহেতুক শুয়ে গড়িয়ে পিঠ ব্যথা না করে খানিক চিন্তা ভাবনা করা যাক।
কাপ নিয়ে বেডরূমে এসে বসল সে। ব্রিফকেসের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ আছে? ওগুলো উদ্ধার করার জন্যে ভাড়াটে গুণ্ডা পাঠিয়েছে ওর মালিক? কিসের কাগজ? কি করে জিমের সন্ধান পেল লোকটা?
তার কাছে ডায়মণ্ড নয়, কাগজগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ? গোপন জায়গা থেকে ব্রিফকেসটা বের করল জিম প্রেসটন। ভেতরটা ফাঁকা, জানা আছে তার। অর্থাৎ আর কিছু থেকে থাকলে আছে ওটার কোন ফলস্ কম্পার্টমেন্টে। এই সম্ভাবনার কথা ভুলেও ভাবেনি সে আগে।
এবার পেশাদার ক্র্যাকম্যানের মত ব্রিফকেসটা পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করল জিম। এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলল ব্যাপারটা। আছে! দুই চুমুকে ঠাণ্ডা হয়ে আসা পানীয়টুকু ভেতরে চালান করে দিল প্রেসটন। তারপর একটা কাগজ কাটা ছুরি নিয়ে লেগে পড়ল কাজে। ছ’ মিনিট পর শিস্ বাজাল সে ঠোঁট গোল করে। খুলে গেছে ফলস্ বেইস। ভেতর থেকে বের হলো দশটা ফটোকপি শীট।
সরকারী কাগজপত্রের ব্যাপারে খুব একটা জ্ঞান নেই জিম প্রেসটনের। তবে ওগুলোর মাথায় মিনিস্ট্রি অভ ডিফেন্সের ছাপ এবং বড় অক্ষরে লেখা ‘টপ সিক্রেট’ কথাটার অর্থ বুঝতে দেরি হলো না বিন্দুমাত্র। আনমনে শিস্ বাজিয়েই চলেছে প্রেসটন। ব্রিফকেসের মালিকের পেশাগত পরিচয় খুব ভাল করেই জানে সে। ওরকম একজন সম্মানিত পদস্থ কর্মকর্তা…না কি এর মধ্যে দোষের কিছু নেই?
বড় অফিসাররা অফিসের কাজ কখনও কখনও বাসায় বসেও করে থাকেন ফাইল-পত্র নিয়ে এসে। এক্ষেত্রেও কি সে রকম কিছু…? না, প্রবলবেগে মাথা দোলাল জিম। হতে পারে না। হলে অবশ্যই ব্যাপারটা পুলিসকে জানানো হত এতদিনে। টিভি-পত্রিকায় গ্লেন ডায়মণ্ড চুরি হওয়ার খবর প্রকাশ হত। তাহলে? কাগজগুলো নিয়ে কি করা যায় ভাবতে বসল প্রেসটন।
ঠিক যেন ফণাতোলা বিষধর সাপ দেখছে খুব কাছ থেকে, এমন চেহারা করে কাগজগুলোর দিকে চেয়ে আছে গিলটি মিয়া। মুখোমুখি গালে হাত দিয়ে বসা জিম প্রেসটন। রাতেই কাগজগুলো পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে গিলটি মিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার জন্যে। সংস্কারাচ্ছন্ন জিমের দৃঢ় বিশ্বাস, ওস্তাদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়েছিল বলেই ডায়মণ্ডগুলো চুরি করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাকে।
সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে তার সতর্কবাণী। চোরাই মাল দেখেই গিলটি মিয়া তাকে সাবধান করে বলেছিল, এর মধ্যে অশুভ কিছু আছে। কাজেই তার সঙ্গে কথা না বলে ওগুলো নষ্ট করা ঠিক হবে না বলে রেখে দিয়েছিল। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চেয়ে চেয়ে দেখছে গিলটি মিয়া, একটা শীটও স্পর্শ করেনি কেন যেন।
‘কি নাম বললি এর মালিকের?’ ব্রিফকেসটা দেখাল সে ইঙ্গিতে। ‘রবার্ট ফিলবি। ডিফেন্স মিনিস্ট্রির বড় অফিসার।’
‘হুঁম!’ ঠোঁট মুড়ে আরও খানিক ভাবল গিলটি মিয়া। ‘খালি হাতে ছুঁনি তো কাগজগুলো?’
‘ছুঁয়েছি, ওস্তাদ। তখন আসলে অত ভেবে দেখিনি। ঝোঁকের মাথায়…।’
‘ঠিক করিনি, ভাবা উচিত ছিল। ফিলবি লোকটা বিশ্বাসঘাতক, বেঈমানি করচে দেশের সাতে কুনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয় এগুলোয় হারামজাদার হাতের ছাপ পাওয়া যেত খুঁজলে। কিন্তু তুই ধরেই ঝামেলা পাকিয়ে ফেললি। যাকগে, এগুলো নিয়ে একন কি করবি ঠিক করেচিস্?’
‘আমি ওসব বুঝি না, ওস্তাদ। আপনি যা বলেন তাই হবে।’
যেন এমন কিছু শোনার অপেক্ষায়ই ছিল গিলটি মিয়া। কাগজগুলো কাছে টেনে নিয়ে এল সে হাতে ধরে।
‘করেন কি, ওস্তাদ, করেন কি! আপনার হাতের ছাপ…’
‘চুপ থাক্! ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করিনে। এক টুকরো কাপড় লিয়ে আয় দিকিন! ‘
বিনা বাক্য ব্যয়ে নির্দেশ পালন করল জিম প্রেসটন। ঝুঁকে বসে কাজে লেগে পড়ল গিলটি মিয়া।