তিন
অসময়ে নেমেছে ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি। ফলে লম্বা ছুটি কাটিয়ে নতুন করে কর্মোদ্যত লণ্ডন কিছুটা যেন থিতিয়ে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বিরতি দেয় বৃষ্টি, ধোঁয়ার মত সাদাটে কুয়াশা ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কোথাও ঘন কোথাও হালকা, পর্দার মত। বাতাস তেমন একটা নেই। কাজেই তেমন নড়াচড়া করে না পর্দাটা, স্থির হয়ে ভেসে থাকে। দেখতে দারুণ লাগে মাসুদ রানার।
ভীষণরকম প্রতিকূল আবহাওয়া। বৃষ্টির ফলে ঠাণ্ডা বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। হাড়ের ভেতরের মজ্জা পর্যন্ত জমে যাওয়ার জোগাড় কনকনে শীতে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না লণ্ডনবাসীর। হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে নেই কেউ, সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই পথে নেমে এসেছে। পায়ে রেইন বুট, গায়ে বর্ষাতি, মাথায় ছাতা-ব্যস্ত পায়ে যে যার কর্মস্থলের দিকে ছুটছে তারা।
আবহাওয়ার গতিবিধি লক্ষ করার ফুরসত নেই। প্রকৃতির নিয়মে শীত আসবে, বর্ষা আসবে, ওটাই স্বাভাবিক। সেজন্যে কাজ কামাই করতে রাজি নয় এরা। সময়মত খাওয়া-বিশ্রাম যখন চলছে, কাজ চলবে না কোন যুক্তিতে? পাশাপাশি নিজ দেশের চিত্রটা কল্পনা করল মাসুদ রানা। এমন ‘বাদল ঘন’ দিনে বেশিরভাগ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরই হত না। তাস পিটিয়ে, আড্ডা মেরে, খেয়ে-দেয়ে লম্বা ঢেকুর তুলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে বিকেলে জেগে উঠে ভাবত, দারুণ কাটল দিনটা।
সুযোগ পেলেই ফাঁকি মারা বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব। প্রায় সবার মধ্যেই এ দোষ কিছু না কিছু আছে। যে জন্যে অন্যের দুয়ারে হাত পাতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্ভাগা বাংলাদেশের নিয়তি। বৈদেশিক ঋণের ভারে পিঠ কুঁজো হয়ে যেতে বসেছে, তবু বোধোদয় হয় না বাঙালির। কোনদিন হবে কি না ভবিতব্যও হয়তো নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে না।
জানালার কাছ থেকে সরে এসে নিজের ডেস্কে বসল মাসুদ রানা। দু’দিন আগে লণ্ডন এসেছে ও। মনে দ্বিধা আর শঙ্কা ছিল অনেক। এখন তার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। একসময় রানা এজেন্সির কার্যক্রমের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ ছিল এদেশে। তদন্তে নেমে প্রতি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হত। যে কাজ দু’দিনে সেরে ফেলা সম্ভব, সেটা শেষ করতে বিশ দিন লাগত। প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া ছিল এক কথায় অসম্ভব, এমনকি সে তদন্ত সরকারের স্বার্থের অনুকূলে হলেও না।
ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে মাস খানেক আগে কমন্স সভার পরিচিত কয়েকজন সরকারী, কনজারভেটিভ পার্টির প্রভাবশালী সদস্যকে নিজের সমস্যা জানায় মাসুদ রানা। সেই সঙ্গে ইঙ্গিতে এটাও জানিয়ে দেয় যে, এসব বিধিনিষেধ তুলে না নেয়া হলে ব্রিটেনে রানা এজেন্সি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না ওর। এদের প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় উপকৃত হয়েছে রানার মাধ্যমে। ওর সমস্যা শুনে বিষয়টির সুরাহার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হবে বলে কথা দেয় তারা। কথা রেখেছে তারা সবাই।
কিন্তু বিরোধী লেবার পার্টি দাঁড়িয়ে যায় মাসুদ রানার বিরুদ্ধে। এক কথায় ওর দাবি নাকচ করে দেয় তারা। সঙ্গে গলা মেলায় স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড, এমআই ফাইভ, এমআই সিক্স। একমাত্র বিএসএস এ-লড়াইয়ে রানার পক্ষ নিয়ে সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। দীর্ঘ টাগ-অভ-ওয়রের পর রানার দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। সবার প্রচণ্ড বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে গতকালই আনুষ্ঠানিকভাবে রানা এজেন্সির ওপর থেকে সব বিধিনিষেধের বেড়াজাল তুলে নেয়া হয়েছে।
ব্রিটেনের আধা সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার সমমর্যাদা লাভ করেছে রানা এজেন্সি। ক্ষমতা সীমাহীন। এবার তার খানিকটা কাজে লাগাবে মাসুদ রানা। লেবার পার্টির অনেক রথী সম্পর্কেই কনফিডেন্সিয়াল ফাইল আছে ওর এজেন্সিতে। তাদের মতিগতি আরও আগে থেকেই জানা আছে ওর। মায় সুইস ব্যাঙ্কে কার কত টাকা দফায় দফায় জমা হয়েছে, কোত্থেকে এসেছে সে টাকা, তা পর্যন্ত।
কিন্তু জেনেও কিছু করতে পারেনি রানা। কারণ বিধিনিষেধ। ওসব নাড়াচাড়া করার মত ক্ষমতা ছিল না। করতে গেলে বরং হিতে বিপরীত হত। আজ আর সে ভয় নেই। এক এক করে ব্যাটাদের মুখোশ খুলে দেবে ও। দেখতে চায় ধাওয়া খেলে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী ঘেয়ো কুকুরগুলোর চেহারা কেমন হয়। কি ভেবে হেসে ফেলল রানা। লক্ষই করেনি কখন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে গিলটি মিয়া।,
ঢুকেই থমকে দাঁড়াল সে রানাকে নিবিষ্ট মনে চিন্তা করতে দেখে। ভাবল, এখন থাক, পরে আসা যাবে বরং। ভাবনা-চিন্তার সময় ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না। মনস্থির করে ঘুরে দাঁড়াতে গেল গিলটি মিয়া, এই সময় হেসে উঠল রানা। দেখাদেখি তারও দাঁত বেরিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেণ্ড নিঃশব্দে হাসল দুজন।
একসময় সচকিত হলো মাসুদ রানা। টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে চোখ পড়ল দরজার ওপর। গম্ভীর হলো ও। ‘কি ব্যাপার, গিলটি মিয়া? হাসছ কেন?’
‘আপনাকে হাসতে দেকে, স্যার।’ অকপট স্বীকারোক্তি গিলটি মিয়ার। তার মানে বেশ আগেই ঘরে ঢুকেছে ও, ভাবল রানা। ‘কখন এলে? টের পাইনি তো!’
‘আমার আসা-যাওয়া স্বয়ং উনি পর্যন্ত,’ আকাশের দিক নির্দেশ করল গিলটি মিয়া তর্জনী খাড়া করে, ‘টের পান না। আর আপনি তো…কতায় বলে, স্যার, তেলচোট্টাও একটা পাকি। বত্রিশ বচোর ধরে…।’ রানার ভুরু কুঁচকে উঠছে দেখে ব্রেক কষল গিলটি মিয়া। মুহূর্তও দেরি না করে অন্য লাইন ধরল। ‘চেয়েছিলুম চলে যেতে, স্যার। কিন্তু আপনাকে হাসতে দেকে না ভেঁড়িয়ে পারলুম না। হাসলে আপনাকে কি যে…’
‘বলো, কেন এসেছ।’
হতাশায় মুখ কালো হয়ে গেল গিলটি মিয়ার। আরও কিছু বলার ছিল, কিন্তু পারা গেল না। পকেট থেকে লম্বামত সরু একটা প্যাকেট বের করে ছোট ছোট পায়ে রানার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে।যথেষ্ট সঙ্কোচের সঙ্গে প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল। ‘লেবারদের সঙ্গে যুদ্যে আপনার জয় হয়েচে। তাই আমার তরপ থেকে এই ছোট্ট উপহার।
হেসে উঠতে যাচ্ছিল রানা ‘লেবারদের’ শুনে, কিন্তু দমন করতে সক্ষম হলো শেষ পর্যন্ত। তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে জিনিসটা নিল মাসুদ রানা। ‘ধন্যবাদ।’ প্যাকেটের ওপর চমৎকার একটা গ্যাস লাইটারের ছবি। ‘কেন অনর্থক খরচ করতে গেলে বলো তো?’
গলে পানি হয়ে গেল গিলটি মিয়া। ‘বাহ্! অনত্থক হতে যাবে কেন, স্যার? বিজয়ীকে যে বরমাল্য দিতেই হবে। ওটাই যে রেওয়াজ।’
‘তোমার পছন্দ আছে। জিনিসটা দারুণ হয়েছে, গিলটি মিয়া ধন্যবাদ।’
হাত কচলাতে লাগল গিলটি মিয়া। অনবরত হেঁ-হেঁ করছে। মাসুদ রানার মুখে একবার ধন্যবাদ পাওয়াই অনেক, প্রায় আশাতীত। তার ওপর আরও একবার পেয়েছে। আনন্দ রাখার জায়গা হচ্ছে না তার ছোট্ট বুকের ভেতর।
সামাল দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করল মাসুদ রানা। মানুষটি সেন্টিমেন্টাল। তাল হারিয়ে কি করে বসে ঠিক নেই। আবার গম্ভীর হলো ও। ‘তোমার ট্রেনিং কেমন চলছে, গিলটি মিয়া?’
ওকে আড়াল করে চোখের পানি মুছল সে চট্ করে। কেঁদে ফেলেছে খুশিতে। মন্দ নয়, স্যার। ভালই চলচে।’
গিলটি মিয়া বেরিয়ে যেতে আনমনা হয়ে পড়ল মাসুদ রানা। কেমন মানুষ, বকলে হাসে আর স্নেহ-ভালবাসা পেলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আগেও অনেকবার ওর চোখে পানি দেখেছে রানা। আসলে গিলটি মিয়া এসবে অভ্যস্ত নয় বলেই ব্যাপারটা ঘটে। জীবনের দীর্ঘ সম’ পুলিসের লাথি-গুঁতো খেয়ে, মানুষের ঘৃণা, লাঞ্ছনা পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল মানুষটা। মনের মধ্যে গেড়ে বসেছিল ধারণা, এরই নাম বোধহয় জীবন এরই নাম বেঁচে থাকা।
যা কখনও পায়নি, মানুষ হিসেবে মর্যাদা, ভাল কাজের স্বীকৃতি, মাসুদ রানার সান্নিধ্যে এসে তাই পেয়েছে সে। হঠাৎ এই পাওয়ায় এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। সে জন্যেই বুঝি সামান্য স্নেহের পরশ পেলে চোখ ভিজে ওঠে লোকটার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্যাকেট থেকে লাইটারটা বের করল রানা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর ওটা সিগারেট প্যাকেটের ওপর রেখে পুরানো লাইটারটা ওপরের ড্রয়ারে পুরল। চারটের মধ্যে তিনটে ড্রয়ার ভর্তি ছোটবড় আরও অনেক উপহার সামগ্রী রয়েছে। এজেন্সির ‘ফ্রী মুভমেন্টের লাইসেন্স প্রাপ্তি উপলক্ষে বিএসএস এবং রানা এজেন্সির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তরফ থেকে পাওয়া।
একটা সিগারেট ধরাল মাসুদ রানা। রিভলভিং চেয়ারের উঁচু পিঠে হেলান দিয়ে ডুবে গেল চিন্তায়। লণ্ডন ত্যাগ করার আগে অবশ্যকরণীয় কি কি, মনের মধ্যে একটা একটা করে গুরুত্ব অনুযায়ী সাজাতে আরম্ভ করল।
‘কি, ওস্তাদ,’ আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে গিলটি মিয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে জিম। ‘কেমন! বলেছিলাম না?’
কথা নেই গিলটি মিয়ার মুখে। সামনের কফি টেবিলে রাখা আছে ডালা খোলা সুদৃশ্য এক ব্রিফকেস। ভেতরে সাজানো গ্লেন ডায়মণ্ডের উজ্জ্বল দ্যুতি দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দিয়েছে প্রথম দর্শনেই। শিস্যের এতবড় সাফল্যে খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু কেন যেন হতে পারছে না সে। বসে আছে মুখ গম্ভীর করে।
‘কি হলো, ওস্তাদ? মুখ গোমড়া করে আছেন, আপনি খুশি হননি?’
‘হয়েচি। শোন, এ জিনিস কার জানিনে। জানার দরকারও নেই। কিন্তু মন বলচে, এগুনোর সঙ্গে অশুব কিছু একটা রয়েচে। পারলে আজই বিদেয় কর এসব জঞ্জাল। বেচে দে, না হয় নদীতে ফেলে দে, সঙ্গে রাকিসনে। বিপদ হতে পারে তোর।
‘এ কথা কেন বলছেন, ওস্তাদ?’ মুখ শুকিয়ে গেল প্রেসটনের। চট করে ব্রিফকেস বন্ধ করে দিল সে।
‘ঠিক জানিনে কেন বলচি। তবে নাকে বিপদের গন্ধ পাচ্চি আমি। যা বললাম তাই কর। দেরি করা ঠিক হবে না।’
‘জ্বি, আচ্ছা।’
দুপুর পর্যন্ত বেরোই বেরোই করেও ঘরে বসে থাকল জিম। মন খারাপ হয়ে গেছে। ভেবে রেখেছিল, এমন দামী জিনিস, রয়ে-সয়ে ভাল দামে বিক্রি করবে। কিন্তু বিপদের আশঙ্কার কথা বলে গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়ে গেল ওস্তাদ। তবে এ-ও ভালই জানে সে, গিলটি মিয়ার মন শুধু শুধু ভয় পায় না। তার পিছনে কারণ থাকে। অতীতে বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছে সে।
ঠিক আছে, যা পাওয়া যায় তাই সই, ভাবল জিম প্রেসটন। তবু ওস্তাদকে অমান্য করবে না। আজই বিদেয় করে দেবে ডায়মণ্ডগুলো। তবে খানিক চিন্তা-ভাবনার পর ব্রিফকেসটার ব্যাপারে অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিল সে। ওটা হাতছাড়া করবে না, রেখে দেবে নিজের কাছে। এত সুন্দর ব্রিফকেস আর চোখে পড়েনি প্রেসটনের। জিনিসটা সে প্রকাশ্যে বের করবে না কখনও। রেখে দেবে গোপনে। কে-ই বা জানবে?
বণ্ড স্ট্রীট। পরিচিত এক জুয়েলারি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করল জিম প্রেসটন। দোকানটা ছোট। তবে এদের হাতের কাজের সুনাম আছে খুব। গাঢ় রঙের স্যুট পরেছে আজ প্রেসটন। সিল্কের শার্ট, মিউটেড টাই্। হাতে সাধারণ একটা অ্যাটাশে কেস।
খুদে কাউন্টারের ওপাশে বসা সুন্দরী অভ্যর্থনাকারিণী মুখ তুলে মধুর হাসি দিল এক চিলতে। ‘কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে, স্যার?’
‘কিরলনস্কির সাথে দেখা করতে চাই,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে। ‘বলুন, জেমস দেখা করবে।’ এ দোকানের মালিক লোকটা।
মেয়েটি নড়ার আগেই দোকানের পিছনদিকের টিনটেড গ্লাসের দরজাটা খুলে গেল। খাটো, ভীষণ মোটা এক টাক মাথা দাঁড়িয়ে ওখানে। জিমের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়ল তার। ‘মিস্টার জেমস! কী সৌভাগ্য! আসুন, আসুন,’ বলে মেয়েটির দিকে তাকাল। ‘আমার বন্ধু, বুঝলে? অনেকদিন পর দেখা।’
মাথা দুলিয়ে আরেক চিলতে হাসি দিল মেয়েটি। সামান্য পিছিয়ে গিয়ে প্রেসটনকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দিল লুইস কিরলনস্কি। কাঁচের বন্ধ করে নিজের ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। কেবল ডেস্কের ওপর একটা শেড পরানো বাতি জ্বলছে, গোল আলোটা পড়েছে টেবিলের মাঝখানে বিছানো সাদা একখণ্ড ব্লন্টারের ওপর। প্রেসটনকে পাশের একটা চেয়ার ইঙ্গিত করে নিজের আসনে বসল মোটা। ‘তারপর, জেমস? ইন্টারেস্টিং কিছু?’
‘আমি সব সময় ইন্টারেস্টিং জিনিসই এনে থাকি। কেবল তুমিই ওতে ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পাও না।’ কেসটা খুলে ভেতরের জিনিসগুলো বের করে ব্লন্টারের ওপর রাখল জিম প্রেসটন।
‘আরে না! আমি কি সত্যি সত্যি…।’ সামনের ঝলমলে পাথরগুলোর ওপর চোখ পড়তে ভাষা হারিয়ে ফেলল লুইস কিরলনস্কি। দম বন্ধ হয়ে এল তার। অবিশ্বাসে চোখ উঠে গেছে কপালে। ‘গ্লেন…’ দম নিল সে। তুমি প্লেন ডায়মণ্ড…?
হাসল জিম প্রেসটন। ‘কি মনে হয়, ইন্টারেস্টিং?’
‘ও-ও মাই গড়!’ টাকে হাত বোলাতে লাগল কিরলনস্কি। ঝাড়া দশ মিনিট বসে থাকল সে বাকহারা হয়ে। প্রেসটন যেমন এগুলোর ইতিহাস জানে, তেমনি সে-ও জানে। সোজা পথে কিরলনস্কি যত অর্থ কামিয়েছে, তার হাজার গুণ বেশি কামিয়েছে বাঁকা পথে। এগুলোর ওপর নজর ছিল তারও। কিন্তু থাকলে কি হবে? সে-তো আর জিম প্রেসটন নয়।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল টেকো। ‘ইউ, নটি বয়। ট্যালেন্টেড নটি বয়, ‘ মন্তব্যটা দ্রুত যেন সংশোধন করল। পোলিশ অ্যাকসেন্টে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে কিরলনস্কি। কারণ সে পোল, ইহুদি।
১৯৩৯ সালে নাজি বাহিনীর পোল্যাণ্ড আগ্রাসনের সময় বন্দী হয় লুইস জিরলনস্কি। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত জার্মানদের হাতে আটক ছিল সে। পরে মিত্রবাহিনী অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে অন্যদের সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেয়। সে বছরই ইংল্যাণ্ড চলে আসে কিরলনস্কি। প্ৰথমে কয়েক বছর এক জুয়েলারি দোকানে চাকরি করে। তারপর নিজেই একদিন দোকান দিয়ে বসে।
এতগুলো বছর এ দেশে কাটিয়েও ইংরেজিটা ভালমত রপ্ত করতে পারেনি লুইস কিরলনস্কি। অবশ্য শেখার তেমন চেষ্টাও ছিল না তার। প্রচুর টাকার মালিক মানুষটি। সংসারে মেয়ের বয়সী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই তার। মেয়েটি এদেশী, এক সময় জিম প্রেসটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। একটি গুণ আছে লুইস কিরলনস্কির, জীবনে কখনও কারও বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি। অন্যদের তুলনায় পয়সা কিছু কম দেয় সে, কিন্তু তবুও এখানেই বারবার আসে প্রেসটন তার ওই গুণটির জন্যে। জান চলে গেলেও একটি গোপন তথ্যও কেউ বের করতে পারবে না লুইসের পেট থেকে।
‘কী এত ভাবছ?’
‘ভাবছি অনেক কিছুই, বয়। এগুলো কোন সাধারণ পাথর নয় যে…। কি যে করি!’
‘রাস্তা যা হোক কিছু একটা বের করো।’
‘এগুলোর দাম কত হতে পারে অনুমান করতে পারো?’
‘অনেক। এক মিলিয়ন পাউণ্ডের কম তো নয়-ই।’
‘বোঝো তাহলে ঠ্যালা। এর জন্যে এমন এক ক্রেতা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে, যে জনসমক্ষে এগুলো বের না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিনতে রাজি হবে। এমন ক্রেতারও অভাব নেই। আছে, তবে খুব কম। তাদের কাছে এর ন্যায্য দামও আশা করতে পারো না তুমি। যা চাইব, নির্ঘাত তার অর্ধেক দাম বলবে।
ভাগ্যিস, ব্যাটা আরও কমিয়ে বলেনি, ভাবল জিম প্রেসটন। ‘কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?’
কাঁধ ঝাঁকাল লুইস কিরলনস্কি। ‘তার কি কোন ঠিক আছে? কাল- পরশুও পেয়ে যেতে পারি যদি ভাগ্য ভাল হয়। আবার দু’চার বছরও লেগে যেতে পারে।
‘মুসিবত!’
‘আরেকটা উপায় আছে তাড়াতাড়ি বিক্রি করার।’
‘কি?’
‘সেটিং ভেঙে সোনা আর ডায়মণ্ড আলাদা আলাদাভাবে বিক্রি দেয়া। তাতে দাম অবশ্য অনেক কমে যাবে।
‘আমাকে কত দিতে পারবে তাই বলো,’ একটা সিগারেট ধরাল জিম প্রেসটন।
খানিক হিসেব কষল লুইস কিরলনস্কি। টাক চুলকাল। ‘খাটনি অনেক, সময়ও লাগবে প্রচুর…সে যাক্। তোমাকে পুরো বিশ হাজার দেব আমি। তবে এখনই সব দিতে পারব না। অর্ধেক আজ, নগদ। বাকিটা এগুলো বিক্রি করে।’
আরও মিনিট পাঁচেক কথা হলো দুজনের। তারপর নগদ দশ হাজার পাউণ্ড পকেটে পুরে আসন ছাড়ল প্রেসটন। সেদিন এবং তার পরদিন পিছনের রূমের দরজা বন্ধ করে কাজ করল লুইস কিরলনস্কি এক মনে।কাজ শেষ করে বেরিয়ে এসে এক পাবলিক ফোন বুদ থেকে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে টেলিফোন করল।
এরপর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ভোরের প্রথম ব্রাসেলস্ ফ্লাইটের একটা আসন বুক করল সে নিজের জন্যে। দিনের আলো পুরোপুরি ফোটার আগেই হিথ্রো এয়ারপোর্টের লণ্ডন-ব্রাসেলস ডেইলি প্যাসেঞ্জার ব্যবসায়ীদের জটলা থেকে সামান্য তফাতে, সোফায় বসা দেখা গেল কিরলনস্কিকে। আনমনা। পরনে ভারি ওভারকোট, মাথায় নরম টুইডের হ্যাট। হাতে হ্যাণ্ডগ্রিপ, মুখে বড়সড় একটা ব্রায়ার পাইপ। কিন্তু পাইপ টানছে না লুইস। তামাক ওতে আছে ঠিকই, তবে তামাকের তলায় অন্য জিনিসও আছে। চেপেচুপে বসানো আছে চার চারটে গ্লেম ডায়মণ্ড। বিমানে আসন নিতেই হাসিমুখে এক হোস্টেস এগিয়ে এল লুইস কিরলনস্কির দিকে। মুখ নামিয়ে যথেষ্ট নম্রতার সঙ্গে বলল, ‘পাইপটা দয়া করে পকেটে রাখুন, স্যার, প্লীজ। কেবিনে ধূমপান নিষেধ।
‘নিশ্চই নিশ্চই।’ পাইপটা পকেটে রাখার সুযোগ পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল কিরলনস্কি। ব্রাসেলস নেমে ট্যাক্সি চেপে উত্তরে ছুটল সে। মোটরওয়ে ধরে প্রথমে মিসিলেন, তারপর ডানে বাঁক নিয়ে উত্তরপুবের লিয়ের এবং নিয়েলেনের উদ্দেশে। বেলজিয়ামের পৃথিবী বিখ্যাত ডায়মণ্ড ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় অ্যান্টওয়ার্পের পেলিকানস্ট্রাট এবং তার আশেপাশে।
বিশাল সব ডায়মণ্ড এন্টারপ্রাইজের শো-রুম এবং কারখানা আছে এখানে। দৈনিক কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা হয়। সারা দেশে এদের হাজারো সরবরাহকারী আছে। এমনই এক সরবরাহকারী রাউল লেভি। সে- ও পোলিস, এবং ইহুদি। লুইসের মত লেভিও বিশ্বযুদ্ধের পরে এদেশে এসে ব্যবসা শুরু করে। আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে দুজনের। নিয়েলেন গ্রামে থাকে সে।
লাঞ্চের সামান্য আগে বৈঠকে বসল লুইস কিরলনস্কি ও রাউল লেভি। এক ঘণ্টা আলোচনা, দর কষাকষির পর পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ডে গ্লেন ডায়মণ্ডগুলো কিনে নিতে সম্মত করানো গেল লেভিকে। অর্ধেক টাকা এখন, বাকিটা বিক্রির পর পরিশোধের শর্তে। টাকা নিয়ে ওইদিনই লণ্ডন ফিরে এল কিরলনস্কি।
জানুয়ারির ছয় তারিখ, মাঝরাতের সামান্য আগে লণ্ডন ফিরে এলেন রবার্ট ফিলবি। একা। স্ত্রী রয়ে গেছেন ভাইয়ের ওখানে, কিছুদিন বেড়িয়ে ফিরবেন। টানা ছয় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত ফিলবি। ভদ্রলোক দীর্ঘদেহী। স্লিম ফিগার। বয়স পঞ্চান্ন। দুই কানের ওপরে চুল বেশিরভাগই পাকা। অভিজাত চেহারা।
সোজা আণ্ডারগ্রাউণ্ড কার পার্কে ঢুকে পড়লেন রবার্ট ফিলবি। গাড়ি লক্ করে স্যুটকেস নিয়ে উঠে এলেন নিজের ফ্লোরে। মন-মেজাজ ভাল নেই। স্ত্রীর এ-সময় গ্রামের বাড়িতে থেকে যাওয়া পছন্দ হয়নি তাঁর। কারণ ফেডোরার এই ‘কিছুদিন’ প্রায় সময়ই মাস ছাড়িয়ে যায়। এবার কতদিন লাগবে কে জানে। তালা খুলে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর পা রাখলেন রবার্ট ফিলবি।
দাঁড়িয়ে গেলেন চট্ করে। কুঁচকে উঠেছে কপাল। অ্যালার্ম সিস্টেম থেকে ‘পিপ্’ ‘পিপ্’ সঙ্কেত বেজে ওঠার কথা। কিন্তু উঠল না। কেন? যাওয়ার সময় তো তিনি নিজ হাতেই মাস্টার সুইচ অন করে দিয়ে গিয়েছিলেন অ্যালার্মের। নষ্ট হয়ে গেল নাকি সিস্টেম? বিরক্ত মুখে ক্লোক রূমে ঢুকলেন ফিলবি। অফ করে দিলেন ওটার মাস্টার সুইচ। তারপর স্যুটকেস রেখে সীটিংরূমে এলেন। বাঁ-হাতে টাইয়ের নট্ আলগা করতে করতে আলোর সুইচ টিপলেন।
এবং জায়গায় জমে গেলেন সামনের দৃশ্য দেখে। বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ, ধীরে ধীরে হাঁ হয়ে গেল চোয়াল। দেহের পাশে ঝুলে পড়ল বাঁ হাত।সামনের দেয়াল এবং সেফটার অবস্থা দেখে মাথা ঘুরে উঠল। ধাতস্থ হতে এক মিনিট লাগল। লম্বা পায়ে ঘর অতিক্রম করে সেফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন রবার্ট ফিলবি। উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখলেন। তারপর পায়ের কাছে পড়ে থাকা একরাশ কাগজপত্র, কলম, নোটবই ইত্যাদির দিকে তাকালেন।
অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘ওহ্, গড! আমার ব্রিফকেস!’
পিছিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ফিলবি ধপ্ করে। শ্বাস বইছে ঝড়ের বেগে। গালে হাত দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছেন। মুখের রক্ত সরে গিয়ে চেহারা হয়ে উঠেছে কাগজের মত। দশ মিনিট পর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন রবার্ট ফিলবি। রূমের এক কোণে স্ট্যাণ্ডের ওপর রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নাম্বার টিপতে লাগলেন।
রিঙের,পর রিঙ হচ্ছে ও-প্রান্তে, কিন্তু ধরছে না কেউ।
একটানা তিন দিন প্রচেষ্টা চালানোর পর ও-প্রান্তের সাড়া পেতে সমর্থ হলেন রবার্ট ফিলবি, ওয়েস্ট এণ্ডের এক নামী-দামী হোটেলের অ্যালকোভে সেদিনই সন্ধেয় লোকটির মুখোমুখি হলেন তিনি। তার আগের দিন রাতে অ্যান্টওয়ার্প থেকে ঘুরে এসেছে লুইস কিরলনস্কি।
বয়স ষাটের মত হবে লোকটির। আয়রন গ্রে চুল। হালকা খয়েরি চোখজোড়া অস্থির, কি যেন খুঁজে ফিরছে সারাক্ষণ। পোশাক-আশাক মূল্যবান, সুন্দর ছাঁটের। গোবেচারা ভাব, তবে দেখার চোখ দিয়ে দেখলে মানুষটি যে সাধারণ আর দশজনের মত নয়, ‘অসাধারণ’, সহজেই বোঝা যায়। আইনের দেয়ালের ওপাশে বসবাস তার।
দুঃখিত। তিনদিন বাইরে ছিলাম। আপনার অসুবিধের জন্যে…বোঝেনই তো। ব্যাচেলর মানুষ। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে যেতেই হলো। এবার বলুন কেন খুঁজছেন আমাকে।’
অল্প কথায় ব্যাপারটা তাকে খুলে জানালেন রবার্ট ফিলবি। শুনতে শুনতে দৃষ্টি আরও চঞ্চল হয়ে উঠল লোকটির। ‘পুলিসকে জানিয়েছেন?’
‘না,’ দ্রুত মাথা ঝাঁকালেন ফিলবি। ‘ভাবলাম, আগে আপনাকে জানাই। তারপর অবস্থা বুঝে যা করার করব।’
‘এখন আর চাইলেও ওদের জানাতে পারছেন না আপনি,’ কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল অসাধারণ। ‘দেরি হয়ে গেছে। তাতে উল্টো বিপদ হবে। আপনি নিজেই ফেঁসে যেতে পারেন।
‘অবশ্য…।’
‘কি?’
‘যদি এমন করা যায়, সেফ পাল্টে সব আগের মত…না, সম্ভব নয়। এ ক’দিন নিশ্চই শেফিল্ডে ছিলেন না আপনি। ছিলেন এখানেই। বাইরের কেউ না দেখে থাকলেও অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের কেউ না কেউ দেখেছে আপনাকে। কাজেই ওসব করতে গেলে কেঁচে যাবে।’
‘ঠিক।’
‘আপনার স্ত্রী ক’দিন থাকবেন ভাইয়ের ওখানে?
‘ঠিক জানি না। তবে দুই এক সপ্তা তো বটেই। ‘
‘গুড। এর ভেতর একই মডেলের আরেকটা সেফ বসাতে হবে জায়গায়। যে করে হোক, নকল গ্লেন ডায়মণ্ড জোগাড় করতে হবে। সময় লাগবে। ধৈর্য ধরে কাজটা সারতে হবে। নইলে আপনার স্ত্রী ফিরে যদি দেখেন তাঁর সখের অলঙ্কার চুরি হয়েছে, তাহলেই হয়েছে। ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়া যাবে না তাঁকে ব্যাপারটা।’
‘সে না হয় হলো, কিন্তু আসলগুলো উদ্ধারের কি ব্যবস্থা করা যায়?’
‘আমার ওপর ছেড়ে দিন সে ভার। আজই খোঁজ-খবর শুরু করছি আমি। আমার ধারণা, অনেক আগেই লণ্ডনের বাইরে চলে গেছে ডায়মণ্ডগুলো। হয়তো এতক্ষণে কেটেকুটে অন্যরকম আকার দেয়া হয়েছে। চেনা সহজ হবে না। সে আমি বুঝব। আপনাকে যা বললাম, তাই করুন। সেফটা পাল্টান। ঘর, অ্যালার্ম সিস্টেম মেরামত করে ফেলুন। আর আপনার স্ত্রী যতদিন সম্ভব ভাইয়ের ওখানেই যেন থাকেন সে ব্যবস্থা করুন।
সবার সঙ্গে পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে। বাকি সব সামলাব আমি। আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। সময় হলে আমিই যোগাযোগ করব।’
আসন ত্যাগ করল লোকটা। কোনদিকে না তাকিয়ে ছোট ছোট পায়ে বেরিয়ে গেল হোটেল ছেড়ে। বসে থাকলেন রবার্ট ফিলবি। চিন্তিত। সেই সঙ্গে আতঙ্কিত। পারবে তো লোকটা?