অন্ধ শিকারী – ১.২

দুই

ঘরে ফিরে নিজের জন্যে এক কাপ এসপ্রেসো তৈরি করল প্রেসটন। মনটা খুশি খুশি লাগছে। জন্মের পর বহু বছর কোলকাতায় কেটেছে তার। সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক কারণেই হোক বা আর যেভাবেই হোক, ছেলেবেলা থেকেই মনের ভেতর বেশ কিছু সংস্কার স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে তার ভারতীয়দের মত। জিম প্রেসটনের স্থির বিশ্বাস, এমন দিনে যখন অপ্রত্যাশিতভাবে শিক্ষাগুরুর দর্শন পাওয়া গেছে, তখন সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, গ্লেন ডায়মণ্ড চুরির স্বপ্ন আজ সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হবে তার।

এসপ্রেসো পান করতে করতে একটা স্কেচের ওপর চোখ বোলাতে বসল জিম। তার শিক্ষানবিস বিল সাইমনের আঁকা। বিল বয়সে কিশোর। কাজ যত কঠিনই হোক, জটিল হোক, পিছ পা হতে জানে না। লেগে থাকে আঠার মত। শেখার আগ্রহের কমতি নেই। জিমের ধারণা, ভবিষ্যতে বিলও তারকা হতে পারবে এ লাইনে।

ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে সাইমনকে ফন্টেনয় অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পাঠিয়েছিল জিম প্রেসটন। অত্যন্ত দামী বিশাল এক ফুলের তোড়া নিয়ে। ব্লকের আটতলায় থাকেন ফিলবি-ফেডোরা দম্পতি। ডোরবেলের শব্দ শুনে স্বয়ং লেডি ফেডোরা দরজা খুললেন। সামনে নিষ্পাপ চেহারার বিল সাইমনের হাতে তোড়াটা দেখে বিস্ময়ে, খুশিতে হেসে উঠলেন মহিলা। ‘ওহ্, হাউ লাভলি!’

তোড়ার ভেতর রাখা প্রেরকের নেমকার্ডটা তুলে নিয়ে পড়লেন তিনিঃ কমিটি অভ দ্য ডিসট্রেড ভেটেরানস্ বেনেভোলেন্ট ফাণ্ড। এরকম অজস্র সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক লেডি ফেডোরা। প্রায় নিত্যই এ ধরনের সৌজন্য উপহার এক আধটা গ্রহণ করতে হয় তাঁকে। কালও নিলেন। তোড়াটা সামলে ধরার কসরৎ করছেন ফেডোরা, এই সময় বেয়ারার ছেলেটা প্রাপ্তি রসিদ এবং একটা বল পেন এগিয়ে দিল।

একসঙ্গে এত কিছু করা অসম্ভব, তাই সাইমনের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার হাসি হাসলেন হার লেডিশিপ। ‘এক মিনিট, প্লীজ!’ তোড়া নিয়ে সীটিংরূমের দিকে ছুটলেন তিনি। খুদে হলওয়েতে কয়েক মুহূর্ত একা থাকার সুযোগ পেয়ে গেল বিল সাইমন। দ্রুত দরজার ফ্রেমের ওপর শকুন চোখ বোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে এই ফাঁকে। ফ্রেমের ভেতরদিক এবং আশপাশের দেয়ালে কোন বায়ার বা সুইচ আছে কি না নিশ্চিত হতে চায়।

কাজটা পুরো হওয়ার আগেই ফিরে এলেন লেডি ফেডোরা। সাইমনের হাত থেকে স্লিপ এবং কলম নিয়ে সই করতে গেলেন। কিন্তু আঁচড় পড়ছে। না কলমের। কালি নেই। নেই করেই ওটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে বিল। লেডিকে বিব্রত হতে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল সে, বারবার করে ক্ষমা চাইতে লাগল। ফেডোরার হাসিটা প্রশস্ত হলো তার অবস্থা দেখে। দ্যাটস অল রাইট, মাই বয়। আমার হাতব্যাগে একটা পেন আছে মনে হয়। দেখি খুঁজে পাওয়া যায় কি না,’ ঘুরে দ্রুত পা চালাতে চালাতে বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো’

ব্যগ্র দৃষ্টিতে আবার কাজে লেগে পড়ল বিল সাইমন। এবং মুখ তুলতেই নজর পড়ল জিনিসটার ওপর। দরজার পাল্লার সঙ্গে, হিঞ্জের সামান্য ওপরে, চিরুনির মোটা দাঁতের মত, আধা ইঞ্চি কি তারও ছোট একটা প্লানজার কন্ট্যাক্ট ফিট করা আছে। ওদিকে ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে খুদে একটা সকেট। দরজা বন্ধ হলে সকেটে প্রবেশ করবে প্লানজার, অ্যাকটিভেট হবে ওটা অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করলেই। সকেটের ভেতর, জানা আছে নিষ্পাপ বিলের, আছে একটা মাইক্রোসুইচ।

প্লানজার যতক্ষণ ওই সুইচের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, ততক্ষণ সব ঠিক আছে। কিন্তু যেই ও দুটো বিচ্ছিন্ন হবে পরস্পর থেকে, অর্থাৎ দরজা খোলা হবে, বেজে উঠবে অ্যালার্ম। অবশ্য ওটা চালু না থাকলে অন্য কথা! বেজে ওঠার আগে ত্রিশ সেকেণ্ড মৃদু ‘পিপ্‌…পিপ্’ শব্দে জানান দেবে সে। এর মধ্যে মাস্টার সুইচ অফ করতে হবে ঘরের মালিককে।

বাকি কাজটুকু সারতে মাত্র তিন সেকেণ্ড সময় লাগল বিল সাইমনের। পকেট থেকে সুপারগ্লুর একটা টিউব আর খুদে একটা প্লাস্টিসিন বল বের করল সে। বলটা সকেটে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা গ্লু ঢেলে দিল তার ওপর। একটু পর বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে জায়গাটা চাপ দিয়ে পরখ করে দেখল সে। লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে। প্লানজার ঢুকতে পারবে না এখন আর ভেতরে। মাইক্রোসুইচের সঙ্গে সংযোগ ঘটার উপায় রইল না ওটার।

অকেজো হয়ে গেল অ্যালার্ম সিস্টেম। যতক্ষণ না প্লানজার আবার সকেটে ঢোকার পথ পাবে, ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট টেরই পাবে না কখন দরজা বন্ধ হলো কি খুলল। সই করা রসিদ নিয়ে ফিরে এলেন লেডি ফেডোরা। দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সাইমন। সিধে হলো সে। কাগজটা নিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে চলে এল।

স্কেচে পরিষ্কার করে ওই অ্যাপার্টমেন্টের এন্ট্রান্স, পোর্টার’স লজ ইত্যাদির এবং সিঁড়ি ও এলিভেটরের লোকেশন এঁকেছে বিল সাইমন।

খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেয়নি। চোখে যা যা দেখেছে তার সবই স্থান পেয়েছে স্কেচে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবল প্রেসটন, যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই অ্যালার্ম সিস্টেম অন করে রেখে গেছেন ফিলবি।

হাসি পেল। বিলের কাছে শুনেছে, দরজায় দুটো তালা দেখেছে সে। দুটো কেন, চারটে হলেও কিছু আসে যায় না। সময় খানিকটা বেশি নষ্ট হবে, এই যা। তাতে অসুবিধে নেই। কেউ দেখে ফেলবে, তেমন কোন চান্সও নেই। কারণ সিঁড়ি বা এলিভেটর, দু’টোই অ্যাপার্টমেন্টের ফ্রন্ট ডোর থেকে দূরে এবং চোখের আড়ালে।

তবে এ ধরনের পয়সাওয়ালাদের বাসস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে প্রেসটন। সে নিশ্চিত, কেবল অ্যালার্ম বা তালাই নয়, আরও দু’চারটা ফাঁদ অবশ্যই আছে ভেতরে। সে সবের মোকাবেলার জন্যেও প্রস্তুত সে। কফি শেষ করে একটা নিউজ পেপার কাটিঙের ফাইল বের করল জিম। অন্য সব তারকা রত্নচোরের মত সে-ও সচিত্র সোসাইটি গসিপ্ কলামের নিয়মিত পাঠক-সংগ্ৰাহক।

এই ফাইলটি সম্পূর্ণ লেডি ফেডোরা এবং তাঁর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি সম্পর্কিত। এ সব অনুষ্ঠান মর্যাদার লড়াইয়ের স্থান। প্রতিটি লড়াইতেই জিত হয়েছে ফেডোরার, যার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া গ্লেন ডায়মণ্ডের অলঙ্কার সেটের।

সবার ওপরের ছবিটির দিকে চেয়ে থাকল প্রেসটন। সর্বশেষ পেপার কাটিং এটা। প্রিন্স চার্লস পত্নী লেডি ডায়ানার সঙ্গে বাকিংহাম প্যালেসের এক পার্টিতে হাস্যোজ্জ্বল লেডি ফেডোরাকে দেখা যাচ্ছে। এদিনও ডায়মণ্ডের সেটটি পরেছিলেন ফেডোরা। জিম প্রেসটনের মুখস্থ এই ডায়মগুগুলোর ইতিহাস।

১৯০৫ সালে মার্গটের তরুণ আর্ল দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে ফেরার পথে চারটে আনকাট পাথর নিয়ে আসেন দেশে। ১৯১২ সালে বিয়ে করেন আর্ল। তার কিছুদিন আগে কার্টার অভ লণ্ডনকে পাথরগুলো কেটে আকার দেয়ার দায়িত্ব দেন তিনি। নববধূর জন্যে ওগুলো দিয়ে অলঙ্কার তৈরি হবে। সে সময়ে আমস্টার্ডামের আশারস্ ছিল সেরা ডায়মণ্ড কাটার। কাটিঙের কাজটা তাদের ওপর অর্পণ করে কার্টার।

টানা দু’মাস পরিশ্রম করে পাথরগুলোকে দু’জোড়া চমৎকার আটান্ন ফ্যাসেটের নাশপাতির আকার দেয় আশারস্। একজোড়ার প্রতিটির ওজন দাঁড়ায় দশ ক্যারেট, অন্য জোড়ার বিশ ক্যারেট। এরপর পাথরগুলো লণ্ডন নিয়ে আসে কার্টার বাকি কাজ সারার জন্যে। তারা সাদা সোনা ও অনেকগুলো ছোট ছোট ডায়মণ্ডের সমন্বয়ে ছোট দুটো দিয়ে চোখ ঝলসানো ইয়ার রিঙ এবং অন্য দুটো দিয়ে কম্পোজড্ টায়রা তৈরি করে।

অলঙ্কার গড়ার কাজ শেষ হওয়ার আগেই আর্লের বাবা, শেফিল্ডের সপ্তম ডিউক মারা যান। আর্ল হন পরবর্তী ডিউক। তাঁদের বংশের উপাধি ছিল প্লেন, সেই সূত্রে ডায়মণ্ডগুলোও লোকের মুখে মুখে গ্লেন নামে ফিরতে থাকে। কালে ওটাই হয়ে যায় ওগুলোর পরিচয়। ১৯৩৬ সালে মারা যান অষ্টম ডিউক। এক ছেলে ছিল তাঁর।

এঁর দুই ছেলে মেয়ে। ছেলের জন্ম ১৯৪৪ এবং মেয়ের ১৯৪৯ সালে। লেডি ফেডোরাই সেই মেয়ে। শেফিল্ডের নবম ডিউকের কন্যা, দশম ডিউকের ছোট বোন। মেয়েকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসতেন নবম ডিউক, তাই মৃত্যুর আগে ডায়মণ্ডগুলো তাঁকেই দিয়ে যান তিনি। এতে তাঁর ভাইয়ের কোন আপত্তি ছিল না।

ছবির ওপর চোখ রেখে ধীরে ধীরে মাথা দোলাতে লাগল জিম প্রেসটন। ‘ওগুলো পরার সৌভাগ্য আর কোনদিনও হবে না তোমার, ডিয়ার লেডি, ‘ বিড়বিড় করে বলল সে।

*

রাত ন’টা থেকে দশটা পর্যন্ত ফন্টেনয় হাউসের উল্টোদিকের কার পার্কে বসে থাকল প্রেসটন আরেকটা ভাড়া করা গাড়িতে। এ মুহূর্তে চমৎকার ছাঁটের দামী কাপড়ের ডিনার স্যুট পরে আছে সে। পাশের সীটে রাখা বড়সড় রিবন বো বাঁধা এক বোতল বিখ্যাত কোম্পানির শ্যাম্পেন। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রেসটন বাড়িটির দিকে। সবগুলো ফ্লোরে আলো জ্বলছে, জ্বলছে না কেবল আটতলায়।

প্রতি তলাতেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। দশটার পর থেকে একে একে পৌছতে শুরু করল অভ্যাগতরা। ক্রমেই বাড়ছে ভিড়। দশটা পাঁচে গাড়ি ত্যাগ করল জিম প্রেসটন। বাঁ হাতের চিত করা তালুতে শ্যাম্পেনের বোতলটা ধরে দৃঢ় পায়ে রাস্তা পার হলো। সোজা এসে দাঁড়াল ফন্টেনয় হাউসের লবিতে। হাতের ডানে পোর্টার’স লজ, ঠিক যেমনটি এঁকেছে সাইমন স্কেচে। কোমর সমান উঁচু কাঁচের জানালার ওপাশে নাইট পোর্টারকে দেখা গেল, এক চোখ সামনের টিভির পর্দায়, অন্যটা প্রবেশ পথের ওপর।

জিম প্রেসটনকে দেখে উঠে এল লোকটা। মনে হলো কিছু বলবে। কিন্তু লোকটাকে সুযোগ দিল না সে। ‘ইভনিং,’ হাসি ফুটল জিমের চোখে মুখে। একই সঙ্গে পা বাড়াল এলিভেটরের উদ্দেশে। ‘ওহ, অ্যান্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার।

প্রশ্ন করার কথা ভুলে গেল পোর্টার। বিনয়ে গলে গেল। ‘থ্যাংক ইউ, স্যার। হ্যাপি নিউ ইয়ার!’ সত্যিই প্রেসটনকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সে কোন ফ্লোর তার গন্তব্য। কিন্তু সামলে নিল। অমন দামী পোশাক-আশাক পরা একজন ভদ্রলোককে সরাসরি প্রশ্নটা করতে বাধল। অন্য দিন হলে প্রশ্নটা অবশ্যই করত সে। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। আট-নয়টা ফ্লোরে নিউ ইয়ার’স পার্টি আছে, ভদ্রলোক যে-কোন ফ্লোরের গেস্ট হতে পারেন। ফিরে গিয়ে টিভি দেখায় মন দিল সে।

লিফটে ওঠার আগে পিছনে চাইল একবার জিম প্রেসটন। ওর সঙ্গী হওয়ার জন্যে নেই কেউ। তাই চাইছিল সে। মৃদু শিস বাজাতে বাজাতে সেভেনথ ফ্লোরে উঠে এল জিম। পা চালিয়ে ফিলবি-ডেবোরার ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে দরজার ফ্রেম এবং সংলগ্ন দেয়ালে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল। এক সময় মাথা ঝাঁকাল সন্তুষ্ট মনে, ঠিকই দেখেছে বিল, কোন বাযার নেই। দুহাতে দস্তানা পরে নিল সে।

এবার দরজার তালায় মন দিল জিম প্রেসটন। বিশ ইঞ্চি ব্যবধানে দুটো তালা, একটা সাব মরটিজ, অন্যটা সেলফ ক্লোজিং ইয়েল লক। ভাল কী- ম্যানের জন্যে পরেরটা খুব একটা কঠিন সমস্যা নয়। তবে সাবটা ভোগাবে বেশ! হুইস্কির বোতল নামিয়ে রাখল জিম প্রেসটন, তারপর পকেট থেকে নিজের তৈরি বারোটা স্কেলিটন চাবির একটা গোছা বের করল।

প্রথমে সাব নিয়েই পড়ল। একটা একটা করে ভেতরে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। ষষ্ঠ চাবিটা পছন্দ হলো জিমের, খুব সহজেই ভেতরে প্রবেশ করেছে ওটা। এবার খুব আস্তে আস্তে ডানে-বাঁয়ে ঘোরাতে লাগল চাবিটা ভেতরের কোথায় কোথায় প্রেশার পয়েন্ট আছে অনুমান করার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ পর থামল সে, মনে হলো পয়েন্টগুলো ট্রেস করতে সক্ষম হয়েছে। এবার হাঁটু গেড়ে বসে সরু একটা ফাইল দিয়ে নরম ধাতুর স্কেলিটনের ওপর কাজ শুরু করল প্রেসটন।

এগারোটা পাঁচে নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। ভেতরে অন্ধকার। কিন্তু করিডরের আলোয় মোটামুটি দেখা যায় হলওয়ের আউটলাইন। চলে এল সে ভেতরে। বন্ধ করে দিল দরজা। কিন্তু তখুনি নড়ল না দরজা ছেড়ে। হলরুমটা আট ফুট বাই আট ফুট। পুরোটাই পুরু কার্পেট মোড়া। সন্দেহ করল প্রেসটন, নিশ্চয়ই এর নিচে কোথাও প্রেশার প্যাড আছে। থাকতেই হবে।

তবে দরজার খুব একটা কাছে থাকার সম্ভাবনা কম। তাতে ঘরের লোকেরও প্যাড মাড়িয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। নিঃশঙ্ক চিত্তে আলো জ্বালল জিম প্রেসটন। বাঁ দিকে আধখোলা একটা দরজা, ওপাশে ল্যাভেটরি। ডানে আরেকটা দরজা-ক্লোক রূম। অ্যালার্ম কন্ট্রোল সিস্টেমটা ওই রূমেই, নিশ্চিত জানে সে। কিন্তু ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

হিপ পকেট থেকে একজোড়া প্লায়ার্স বের করে কার্পেটের এক কোনা তুলল জিম, সরে খালি ফ্লোরের ওপর দাঁড়াল। এক মিনিটের মধ্যে প্যাডটা আবিষ্কার করে ফেলল সে। ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে ওটা। একটাই। কার্পেট ছেড়ে দিল প্রেসটন, জায়গাটাকে দূর থেকে পাশ কাটিয়ে সীটিংরূমের দরজা খুলল এসে। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল আলোর সুইচের খোঁজে।

ঘরটা আয়তাকার। আঠারো বাই পঁচিশ হবে অনুমান। হাতের ডানেই রয়েছে সুইচ। প্রচুর ঝুঁকি আছে জেনেও হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে আলো জ্বালল সে। সামনের রূমে জানালা ছিল না, বাইরে থেকে ভেতরের আলো দেখার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এ ঘরে আছে। নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে আলো যাচ্ছে বাইরে। কিন্তু প্রেসটন নিরুপায়। বুবি ট্র্যাপে ভরা কোন রূমে পেন্সিল টর্চ জ্বেলে কাজ করতে রাজি নয় সে। তাছাড়া যখন জানাই আছে যে এ-ফ্ল্যাটের মালিক শহরে নেই, এ মুহূর্তে তার ফিরে আসারও কোন কারণ নেই, তখন দুশ্চিন্তারও কিছুই নেই।

অত্যন্ত দামী, রুচিশীল আসবাবে সাজানো ঘরটা। সামনের ঘরের চাইতেও পুরু এ ঘরের কার্পেট। সম্ভবত অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো হয়েছে ওটা ঘরের মাপে। এক ইঞ্চি ফ্লোরও দেখার উপায় নেই। প্রেসটনের ঠিক সামনেই ভারি কার্টেন ঝুলছে। জানালা নিশ্চয়ই। ডানে ছোট পাথরের ফায়ার প্লেস। তার পাশে একটা বন্ধ দরজা। ওটা বোধহয় মাস্টার বেডরুম, অনুমান করল জিম প্রেসটন।

বাঁয়ে দুটো দরজার একটা বন্ধ, অন্যটা খোলা। ফাঁক দিয়ে বিশাল ডাইনিং টেবিলের এক প্রান্ত দেখা যায়। ঝাড়া দশ মিনিট একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল জিম প্রেসটন। কেবল চোখ দুটো ঘুরছে অনবরত, চার দেয়াল আর সিলিঙ পরীক্ষা করছে। এর কারণ আছে। ভেতরে স্ট্যাটিক মুভমেন্ট অ্যালার্ম সেট করা থাকতে পারে। দেহের উত্তাপ বা নড়াচড়া সনাক্ত করতে পারলেই বেজে উঠবে তা বিকট শব্দে।

শক্ত হয়ে থাকা পেশীতে ঢিল দিল জিম প্রেসটন। নেই ওসব। থাকলে বেজে ওঠার কথা এতক্ষণে। তৈরিই ছিল সে। তেমন কিছু ঘটলে তিন সেকেণ্ডে পৌঁছে যেত করিডরে। তারপর ভাগলবা। কিন্তু তাই বলে বিপদ পুরোপুরি কাটেনি এখনও। প্রেশার প্যাড তো রয়েইছে, টাচ্ বেলও আছে হয়তো এ ঘরে। ছুঁয়ে ফেললেই শেষ। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে কিছু স্পর্শ করা যাবে না, নিজেকে মনে করিয়ে দিল জিম প্রেসটন।

সেফটা হয় এ-রূমে, নয়ত মাস্টার বেডরূমে আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই তার। এবং অবশ্যই বহির্দেয়ালের গায়ে বসানো। কারণ সেফ ধরে রাখার মত চওড়া নয় ভেতরের দেয়ালগুলো। এগারোটা বিশে সেফটা সনাক্ত করতে সক্ষম হলো জিম প্রেসটন। সীটিংরূমে, ওর নাক বরাবর সোজা, প্রশস্ত একজোড়া ডবল-গ্লেজড্ পিকচার উইণ্ডোর মাঝের ফাঁকা দেয়ালে ঝুলছে বড় একটা সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আয়না। ওটার পিছনে।

যেমনটি থাকার কথা, দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে নেই আয়নার পিঠ। বরং ইঞ্চি দেড়েক ফাঁক আছে দুটোর মাঝখানে। ফাঁকটা কেন রয়েছে বুঝতে এক মুহূর্তও লাগল না জিম প্রেসটনের। মুচকে হেসে প্লায়ার্স জোড়া বের করল সে। ফ্লোর থেকে টেনে তুলে ফেলল কার্পেটের সবচেয়ে কাছের প্রান্ত, তারপর এক পা দু পা করে এগিয়ে চলল আয়নার দিকে ওটা সরিয়ে সরিয়ে।

আয়নাটার ঠিক নিচেই রয়েছে এ ঘরের একমাত্র প্রেশার প্যাডটি। এক মুহূর্ত ভাবল জিম। তারপর দরজার কাছে ফিরে গিয়ে ঘুরে ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা একটা কফি টেবিল তুলে নিয়ে এল। দুই ফুট বাই দেড় ফুট প্রেশার প্যাডটার ওপর বসিয়ে দিল ওটা। টেবিলের চার পায়া প্যাডের বেশ দূরে দূরে সেট হয়েছে, চাপ পড়ার কোন চান্সই নেই।

এবার দেয়াল আর আয়নার সংযোগস্থানের দিকে নজর দিল প্রেসটন। আয়নার পিছনে ফিট করা আছে বড় একটি ম্যাগনেটাইজড্ স্টীলের খণ্ড। ওদিকে দেয়াল থেকে সামান্য বেরিয়ে রয়েছে একটি শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ক্যাচ্। ওই ক্যাই ধরে রেখেছে আয়নাটিকে। অ্যালার্ম ম্যাগনেট। আয়নাটা খুললেই বেজে উঠবে। অতএব স্টীলের খণ্ডটির সঙ্গে সংযোগ ছুটে গেছে, ব্যাপারটা টের পেতে দেয়া যাবে না চুম্বক বাবাজীকে।

এ জন্যেও তৈরি জিম প্রেসটন। বুক পকেট থেকে চার বাই চার ইঞ্চি এক খণ্ড ম্যাগনেটাইজড্ স্টীল পাত বের করে ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে দেয়ালের চুম্বক আর আয়নার স্টীলের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিল সে। তার বাঁ হাতে পাতটা চুম্বকের সঙ্গে ঠেসে ধরে অন্য হাতে হ্যাঁচকা টানে আয়নাটা খসিয়ে আনল। আয়না সরে গেলেও কিছুই টের পেল না চুম্বক পাতটির কারণে।

হাসি ফুটল জিম প্রেসটনের মুখে। ওয়াল সেফটা চমৎকার একটা হামবার মডেল ডি। জানে সে, এর দরজা আধ ইঞ্চি পুরু হাই-টেনসিল, কঠিন ইস্পাতের তৈরি। হিঞ্জের জায়গায় আছে মোটা রড, সেফের সিলিঙ এবং ফ্লোরের মাঝে সেঁধিয়ে আছে তার দু’মাথা। এর তালাও তেমনি।

তিনটে হার্ডেনড্ স্টীলের লিভার, ডোর ফ্রেমের দেড় ইঞ্চি গভীরে ঢুকে থাকে বন্ধ অবস্থায়।

দরজার ভেতর দিকে রয়েছে টিনপ্লেট বক্স, লকিঙ লিভার কন্ট্রোলার। আর বাইরে, জিম প্রেসটনের দিকে চেয়ে রয়েছে চমৎকার দেখতে একটি তিন চাকার হুইল কম্বিনেশন লক। কিন্তু তালা খোলার ঝামেলায় আজ আর যাবে না সে। যা করবে সরাসরি। দরজার হিঞ্জ সাইডের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত উড়িয়ে দেবে বিস্ফোরকের সাহায্যে। তাতে যদিও দরজাটা পুরোপুরি খোলা সম্ভব হবে না, তবে যেটুকু ফাঁক সৃষ্টি হবে, ওতেই চলে যাবে কাজ।

শ্যাম্পেনের বোতলটা কফি টেবিলের ওপর রাখল জিম প্রেসটন। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খুলে ফেলল ওটার তলা। ফলস্ বোতল। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়া জিনিসগুলোর ওপর নজর বোলাল সে। কটন উলে যত্নের সঙ্গে মুড়ে রাখা একটা ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটর, ছোট ছোট কয়েক খণ্ড চুম্বক, নিত্য ব্যবহার্য ফাইভ এএমপি তারের খুদে একটা রীল এবং ইংরেজি ‘ভি’- এর মত দেখতে একখণ্ড ধাতব, সিএলসি। চার্জ লাইনার কাটিং।

জিনিসটা শক্ত, তবে ইচ্ছেমত টেনে লম্বা করা বা সোজা-বাঁকা করা যায়। এক দলা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে মোড়া রয়েছে জিনিসটা। আধ ইঞ্চি পুরু স্টীলের দেয়াল কি করে সহজে কাটা সম্ভব, ভালই জানে জিম প্রেসটন। দ্রুত, দক্ষ হাতে কাজ শুরু করে দিল সে। সিএলসিটাকে টেনে খানিকটা লম্বা করল, তারপর দরজার হিঞ্জ সাইডে সাঁটিয়ে দিল প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভে মুড়ে।

ওটার এক মাথায় ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটরটা বসিয়ে দিল সে। ওর এক প্রান্তে দুটো তামার তার, উঠে এসেছে ভেতর থেকে। একটা অন্যটার সঙ্গে লেগে পরে শর্ট সার্কিটের বিপদ যাতে ডেকে না আনে, সে জন্যে তার দুটো টেনে দুদিকে সরিয়ে দিল প্রেসটন। এবার ফাইভ এএমপি তারের একপ্রান্তের দু’মাথা ভাল করে পেঁচাল তামার তার দুটোর সঙ্গে। ওর অন্য মাথায় আগে থেকেই ফিট করা আছে একটা থ্রী পিন প্লাগ।

এবার তারের রীল খুলে প্লাগ লাগানো প্রান্তটা হাতে নিয়ে মাটিতে চোখ রেখে সাবধানে পিছিয়ে আসতে শুরু করল জিম প্রেসটন। গেস্ট বেডরূমে যাওয়ার করিডরে এসে দাঁড়াল সে। বিস্ফোরণের সময় আড়ালটা প্রয়োজন হবে। প্লাগটা রেখে পকেট থেকে বড় একটা পলিথিন ব্যাগ বের করল প্রেসটন। কিচেনে এসে পানি ভরে ঢোল বানাল ব্যাগটা।

ওটা নিয়ে সেফের সামনে ফিরে এল, সেফের ঠিক ওপরেই একটা থাম্ব ট্যাক লাগিয়ে তার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল ব্যাগটা। সেফের ডালা পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গেছে ওটার। বিনে পয়সার শক্ অ্যাবজরবার। পানির মত শক্ অ্যাবজরবার আর হয় না। করিডরেই পাওয়া গেল একটা প্লাগ পয়েন্ট। সুইচটা অফ আছে কি না চেক করে প্লাগটা পয়েন্টে ঢুকিয়ে দিল প্রেসটন।

ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। মাথার ওপরে, পায়ের নিচে নিউ ইয়ার’স পার্টির হল্লা ক্রমেই বাড়ছে। অংশগ্রহণকারীদের দুম্-দাম্ নাচ আর চেঁচামেচি বন্ধ ঘরে থেকেও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সে। সীটিংরূমে এসে টিভির সুইচ অন করে দিল প্রেসটন। এবার অপেক্ষার পালা। ক্রমেই বাড়ছে পার্টির হল্লা। অসহ্য লাগছে। বারোটা বাজতে এক মিনিট থাকতে যেন যাদুমন্ত্রবলে আচমকা থেমে গেল সব আওয়াজ। এখন টিভির ঐতিহ্যবাহী স্কটিস গান শুনতে পাচ্ছে জিম। অথচ পাঁচ হাতের মধ্যে থেকেও এতক্ষণ একটা অক্ষরও কানে প্রবেশ করেনি তার।

হঠাৎ করেই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। পর্দায় ভেসে উঠল পার্লামেন্ট হাউসের মাথায় বসানো বিশাল বিগ বেন ঘড়ি। প্রেসটন জানে, সমগ্ৰ ব্রিটেনবাসী এই মুহূর্তে যার যার পানীয়ের গ্লাস মাথার ওপর তুলে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে টিভির পর্দায় চোখ রেখে। আর কয়েক সেকেণ্ড পরই বিস্ফোরিত হবে তাদের কণ্ঠ। বারোটা বাজতে পনেরো সেকেণ্ড বাকি থাকতে একজন ধারা বর্ণনাকারীর মুখ ভেসে উঠল বিগ বেনের পাশে। কাউন্ট ডাউন করছে।

দ্রুত করিডরে এসে প্লাগ পয়েন্টের সামনে বসে পড়ল প্রেসটন হাঁটু গেড়ে। কাউন্ট ডাউন শেষ। সামান্য বিরতি। তারপরই শোনা গেল বিগ বেনের মেঘ ডাকার মত গম্ভীর ‘ডঙ-ঙ-ঙ-ঙ-ঙ! ডঙ-ঙ-ঙ-ঙ-ঙ!’ একই সঙ্গে হাইড্রোজেন বোমা পড়ল যেন ফন্টেনয় হাউসের মাথায়। জিয় প্রেসটনের কানে পর্যন্ত পৌছল না সিএলসি বিস্ফোরণের আওয়াজ।

এক মিনিট অপেক্ষা করে প্লাগ বের করে নিল সে পয়েন্ট থেকে। তার পেঁচাতে পেঁচাতে ফিরে চলল সেফের কাছে। অতবড় প্লাস্টিকের ব্যাগ বা ভেতরের পানির কোন চিহ্নমাত্র নেই। কেবল কফি টেবিল এবং তার আশপাশে পানির সামান্য আভাস, তাও ভাল করে না তাকালে বোঝা যায় না। সেফের দরজা দেখে মনে হয় কোন দানব বুঝি ধারাল কুড়ালের কোপে হিঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে ওটা।

ভেতরে একটা ক্যাশ বাক্স এবং একটা ভেলভেট ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। বাক্সটার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাল না প্রেসটন। ব্যাগ বের করে ভেতরের জিনিসগুলো ঢালল কফি টেবিলের ওপর। গ্লেন ডায়মণ্ড। ঝলমল করছে ঘরের আলোয়। যেন নিজের আগুনে জ্বলছে ওরা। সঙ্গে আনা সবকিছু ঝট্‌পট্ গুছিয়ে ফেলল প্রেসটন। ইয়ার রিঙ জোড়া ঢুকিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে।

কিন্তু সমস্যা হলো টায়রাটা নিয়ে। ওটা এত বড় হতে পারে ভাবেনি প্রেসটন। পকেটে ভরা যাবে না জিনিসটা, বিশ্রিভাবে ফুলে থাকবে পকেট। ওদিকে ফলস্ বোতলটাও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে তাকে। ওটাও কারও চোখে পড়া চলবে না। পার্টিতে পান করার জন্যে আনা শ্যাম্পেন কেউ ফিরিয়ে নিয়ে যায় না। খুঁজেপেতে একটা সুদৃশ্য ব্রিফকেস নিয়ে এল জিম প্রেসটন। খোলাই আছে। ভেতরের জিনিসপত্র কার্পেটের ওপর ফেলে দিল সে কেসটা উপুড় করে।

দু-মিনিট পর হাতে ব্রিফকেস ঝুলিয়ে ফন্টেনয় হাউস ত্যাগ করল জিম প্রেসটন।

নরম তুষার মোড়া চওড়া রাস্তা ধরে তীরবেগে চইকা লিমুজিন ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে মেজর কিরলভ। এ মুহূর্তে গাড়িঘোড়া তেমন একটা নেই। আর থাকলেও অসুবিধে ছিল না। কারণ চইকা চলছে রাস্তার মাঝখানের ‘ভ্লাস্তি’ বা এলিটদের জন্যে রিজার্ভ লেন ধরে। কেবলমাত্র সেন্ট্রাল কমিটির এমওসি নাম্বার প্লেটওয়ালা গাড়িই চলতে পারে ওই লেনে। আশপাশে ট্রাফিকের যত চাপই পড়ুক, এই লেনে পড়ে না কখনও।

মেজরের পাশেই বসেছেন জেনারেল পিওতর মার্চেঙ্কো। সময়মতই নিচে মজুদ ছিল মেজর। জেনারেল উঠে বসতে রওনা হয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে। তারপর পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে, একটা কথাও হয়নি দু’জনের মধ্যে। কোথায় নিয়ে চলেছে আমাকে মেজর? ভাবলেন জেনারেল। বৈঠকের কথা তিনি জানেন, কিন্তু তা কোথায় বসবে জানেন না। চিঠিতেও কিছু লেখেননি প্রেসিডেন্ট। একবার জায়গাটার নাম মেজরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়ার ইচ্ছে উঁকি দিল মনে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছেটা বাতিল করে দিলেন মার্চেঙ্কো। দরকার কি? গেলেই তো জানা যাবে।

ছবির মত আলো ঝলমল উক্রেইন হোটেল পিছনে ফেলে উত্তরে চলছে এখন চইকা লিমুজিন। অনুমান করলেন জেনারেল, বোধহয় উসভোয় চলেছে, প্রেসিডেন্টের স্বর্গতুল্য দাচায়। ওখানেই বসবে বৈঠক। কিন্তু আরও পাঁচ মিনিট পর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। আচমকা ডানে বাঁক নিয়ে টোয়েন্টি সিক্স কুট্যুস্কি প্রসপেক্টে ঢুকে পড়ল গাড়ি।

সামনেই সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আশিতলা এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। এর অবিশ্বাস্যরকম বড় প্রতিটি ফ্ল্যাটে থাকেন একজন করে পলিটব্যুরোর সদস্য। ভবনটির উঁচু দেয়ালের বাইরে, সামনের পেভমেন্টে গিজগিজ করছে সাদা পোশাক পরা নাইনথ্ ডিরেক্টরেটের গার্ড। এদের সংখ্যা অনুমান করাও মুশকিল। তবে ভেতরে ঢোকার প্রকাণ্ড বিদ্যুৎচালিত গেটে মোতায়েন গার্ডদের পরনে ইউনিফর্ম আছে।

পুরু ধূসর গ্রেটকোট, ইয়ারফ্ল্যাপ নামানো ফারের শাপকা। শাপকার সামনে গাঁথা নীল রঙের ক্রেমলিন গার্ডের প্রতীক। গেটে নিজের পরিচয়পত্র দেখাল মেজর কিরলভ। খুলে গেল গেট। ভবনটির সামনে দাঁড়ানো অসংখ্য গাড়ির ফাঁকে চইকা পার্ক করে নেমে পড়ল মেজর। একটি কথাও না বলে জেনারেলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ভেতরে।

আরও দু’জায়গায় পরিচয়পত্র দেখাতে হলো কিরলভকে। তারপর একজোড়া লুকোনো মেটাল ডিটেক্টর ও একজোড়া এক্স-রে স্ক্যানারের বাধা পেরিয়ে লিফট। চারতলায় নেমে পড়ল মেজর জেনারেলকে নিয়ে। এই ফ্লোরে থাকেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদক হাত বাড়িয়ে ঝকঝকে পালিশ করা পুরু কাঠের দরজায় নক্ করল মেজর কিরলভ।

খুলে গেল দরজা। সাদা পোশাকে আরেক মেজর দাঁড়িয়ে সেখানে। মাথা ঝাঁকিয়ে জেনারেলকে ভেতরে ঢোকার অনুরোধ করল সে। পা বাড়ালেন তিনি। ওদিকে মেজর কিরলভ পিছিয়ে গেল। ঘুরে লিফটের দিকে চলল। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

একজন স্টুয়ার্ড এগিয়ে এসে জেনারেলকে গ্রেটকোট এবং শাপকার ভারমুক্ত করল। এরপর বিশাল এক সীটিংক্রমে নিয়ে এল তাঁকে সাদা পোশাকধারী মেজর। অস্বাভাবিক উষ্ণ ভেতরটা, অন্তত জেনারেল মার্চেঙ্কোর তাই মনে হলো। তবে বিস্ময়কররকম অনাড়ম্বর। আসবাবপত্র যা আছে সাধারণের চেয়ে সামান্য উঁচু মানের হতে পারে বড়জোর, তার বেশি নয়। সুইডিশ অথবা ফিনিশ সাদা কাঠের তৈরি। বাড়তি বা শোভা বর্ধনের জন্যে অতিরিক্ত কিছুই নেই। যা আছে, ব্যবহৃত হওয়ার জন্যেই আছে।

ব্যতিক্রম শুধু কার্পেট। দেখেই বোঝা যায় দুষ্প্রাপ্য বোখারা কার্পেট এত পুরু আর চমৎকার ডিজাইনের কার্পেট দ্বিতীয়টি দেখেননি জেনারেল। ঘরের মাঝখানে নিচু একটা কফি টেবিল ঘিরে পাঁচটা চেয়ার সাজানো। তিনজন প্রায় বৃদ্ধ লোক রয়েছেন ঘরে, জেনারেল ঢুকতে ঘুরে তাকালেন সবাই। সব ক’জনকেই চেনেন জিআরইউ প্রধান। তেমনি তাঁরাও চেনেন ওঁকে। সবাই মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন জেনারেলের সঙ্গে।

ওদের একজন, মাথা ভরা টাক যাঁর, ভ্লাদিমির ইলিচ পেত্রোফস্কি, মস্কো ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রফেসর। আরও তিনটে পরিচয় আছে ভদ্রলোকের। এক, সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্য, দুই, অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের সদস্য এবং তিন, সেন্ট্রাল কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা।

দ্বিতীয়জন, হালকা পাতলা গড়নের, ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভ, কেজিবির অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক কলাকৌশলের পিছনে মাথা খাটিয়েছেন যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, প্রেসিডেন্টের বাল্যবন্ধু।

এবং তৃতীয়জন, চার মন ওজনের বিশালবপু, ড. জোসেফ পাভলভ। অ্যাকাডেমিশিয়ান। অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স এবং সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্য। ভদ্রলোক দাবার গ্র্যাণ্ড মাস্টারও বটেন। এবং প্রেসিডেন্টের বাল্যবন্ধু। জেনারেল মার্চেঙ্কো জানেন, এই মানুষটির ওপর প্রেসিডেন্ট অনেক ব্যাপারেই নির্ভরশীল। জরুরি কোন পরিস্থিতি দেখা দিলেই পরামর্শ করার জন্যে গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে ডেকে পাঠান তিনি। এঁরা এখানে কেন, ভাবছেন জেনারেল সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কো।

সীটিংরূমের অন্দরমহলের দিকের দরজার জোড়া পাল্লা খুলে গেল। দু’পাশে শীতল চাউনির দুই প্রকাণ্ডদেহী রোবট সদৃশ বডিগার্ডের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত মানুষটি। পাঁচ ফুট আটের বেশি হবেন না ভদ্রলোক। মাথার ঠিক মাঝখানে ছোট্ট চকচকে টাক। চোখে পুরু কাঁচের চশমা। নীল চোখ। নাকটা খাড়া। থুতনিতে খাঁজ। চওড়া, মসৃণ কপাল।

‘আপনারা দয়া করে বসুন,’ কাছে এসে ফ্যাসফেঁসে গলায় বললেন প্রেসিডেন্ট। চেহারা ফ্যাকাসে লাগছে। ভদ্রলোক অসুস্থ, হার্টের রোগি। যত না বয়স, অসুস্থতার কারণে তারচেয়ে অনেক বেশি মনে হয়। এক বছর আগে ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে বুকে পেসমেকার স্থাপন করা হয়েছিল তাঁর। সেই থেকে জনসমক্ষে বলতে গেলে প্রায় বেরই হন না তিনি।

কুটুযস্কি প্রসপেক্টের এক মাইল পশ্চিমে, পঁচিশ একর জুড়ে রয়েছে বার্চের বিশাল এক বনানী। লেনিনের দাচা ছিল ওখানে, সরকারী অবসর যাপন কেন্দ্র। ১৯১৭ সালের পর জীবনের বেশির ভাগ সময় ওখানেই কেটেছে তাঁর। মৃত্যুও হয়েছে লেনিনের ওই দাচায়। স্ট্যালিনের আমলে ওটাকে রূপান্তরিত করা হয় হাইপার এক্সক্লুসিভ সেন্ট্রাল কমিটি হসপিটালে।

বর্তমান বিশ্বের সেরা, সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সম্বলিত হসপিটাল ওটা। তার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ছয়জন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোজ দল বেঁধে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন প্রেসিডেন্টের। সবার ধারণা, তাঁদের ঐকান্তিক এবং একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলেই আজও খাড়া আছেন ভদ্রলোক। আক্ষরিক অর্থেই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ওঁরা।

প্রেসিডেন্ট বসতে একে একে অন্যরা বসলেন। জেনারেল মার্চেঙ্কোর আসন পড়েছে ঠিক তাঁর পাশেই। হাসি হাসি মুখে ওঁর দিকেই চেয়ে আছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের চোখে পলক পড়ে খুব কম। যখন পড়ে, খুবই ধীরগতিতে পড়ে। ঠিক শিকারী বাজের মত। সময় নষ্ট করলেন না তিনি, কোন রকম ভূমিকার ধারও মাড়ালেন না। ‘আমাদের বন্ধু, কমরেড় জেনারেল মার্চেঙ্কোর রিপোর্টটি পড়েছেন আপনারা সবাই।’

ওটা কোন প্রশ্ন ছিল না। তবুও সম্মতিসূচক মাথা দোলালেন অন্য তিনজন। ওদিকে জেনারেল বিস্মিত হলেন। এঁদের সবাইকে পড়তে দেয়া হয়েছিল তাঁর রিপোর্ট?

‘ওয়েল। আমি তাঁর ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আশা করি আপনাদেরও কারও দ্বিমত নেই। নাকি আছে?’

নেতিবাচক মাথা দোলাল সবাই।

এরপর ঝাড়া এক ঘণ্টা ভাষণ দিলেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর প্রতিটি কথা গোগ্রাসে গিলল সবাই। ভাষণ শেষে মত বিনিময় পর্ব। তারপর চারজনের একটা কমিটি গঠন করা হলো। অ্যালবিয়ন কমিটি। জেনারেল মার্চেঙ্কোর রিপোর্ট বাস্তবায়নের কার্যকর রূপরেখা তৈরি করবে কমিটি। অত্যন্ত গোপনে, মস্কোর বাইরে বসে। রূপরেখার ডকুমেন্ট প্রস্তুতের কাজে কেউ সেক্রেটারির সাহায্য নিতে পারবেন না, যার যার নোট নিজেকেই করতে হবে। পনেরো দিনের মাথায় কমিটি প্রেসিডেন্টের কাছে চূড়ান্ত রিপোর্ট করবে ঠিক হলো। এই সময়টা তাদের সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে হবে। বাতাসও যেন কিচ্ছুটি টের না পায়।

ব্যাপারটা প্রেসিডেন্ট সাংঘাতিক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, ভেবে খুশির অন্ত নেই জেনারেল সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কোর। এ জাতীয় বৈঠক সবসময় নোভাইয়া প্লোশেদের সেন্ট্রাল কমিটি ভবনে হয়ে থাকে। স্ট্যালিনের আমল থেকে তাই হয়ে আসছে। ব্যতিক্রম ঘটল আজই। কারণটা সহজ। তাঁদের একত্র হওয়া, বৈঠক করা ইত্যাদি পলিট ব্যুরোর অন্য সদস্যদের চোখে পড়তে পারে, অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারে তাদের, সে ঝুঁকি নিতে চাননি প্রেসিডেন্ট।

আরেকটা ব্যাপার আছে লক্ষ করার মত। এমন গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে কেজিবিকে যুক্ত করেননি তিনি। যদিও ফার্স্ট চীফ ডিরেক্টরেটের ব্রিটেন সম্পর্কে জ্ঞান বলতে গেলে অগাধ। একজন অবশ্য আছেন কেজিবির, কিন্তু তিনি অবসরপ্রাপ্ত। ওদের না রাখার কারণ যাই হোক, জেনারেল খুশি। বহির্বিশ্বে ঘটতে চলা কোন রুশ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্ভবত এই প্রথম কেজিবি অনুপস্থিত।

‘কারও কিছু বলার আছে?’ প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট।

নড়ে উঠলেন ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভ, কেজিবির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ‘বলুন, ভিক্টর।’

‘কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি, আমার শোফার নেই। নিজেই গাড়ি চালাই, কখনও কখনও আমার স্ত্রীও ড্রাইভ করেন সাহায্যের জন্যে। কিন্তু আপাতত তাঁকে দিয়ে কাজ চালাতে চাই না আমি গোপনীয়তার স্বার্থে। একজন বিশ্বস্ত শোফার পেলে উপকৃত হতাম।’

‘ঠিক আছে,’-একটু চিন্তা করে বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘আপনার জন্যে কেজিবির একজন ড্রাইভার নিয়োগের ব্যবস্থা করছি। সকালে রিপোর্ট করবে সে। লোকটা খুবই বিশ্বস্ত। এক সময় আমার অফিশিয়াল শোফার ছিল।’

‘ধন্যবাদ, কমরেড জেনারেল সেক্রেটারি।’

এর মিনিট পাঁচেক পর শেষ হলো বৈঠক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *