বারো
‘সো, মেজর মাসুদ রানা,’ বললেন জেনারেল ডিয়েটার গেরহার্ড। নিজ অফিস রূমে ভিজিটরস্ টেবিলে মুখোমুখি বসে আছেন তিনি আর রানা। ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাট ডি অ্যাঙ্গাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন নিশ্চই?’
‘হ্যাঁ, জেনারেল।’
‘কি প্রমাণ হলো, গিলটি?’ মাথা দোলাল মাসুদ রানা। ‘অ্যাজ হেল।
স্থির হয়ে থাকলেন জেনারেল। ডান চোখের নিচের একটা রগ তিরতির করে লাফাচ্ছে। ‘আমার সার্ভিসের নাম ভাঙিয়ে কার হয়ে কাজ করে সে, জানার অধিকার আছে আমার। না কি বলেন, মেজর?’
‘অবশ্যই, স্যার। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার আগে ছোট্ট একটা অনুরোধ আছে আমার।
‘বেশ তো, বলুন।’
‘এখনই অ্যাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে যাবেন না আপনি দয়া করে। ওর দ্বারা ন্যাটোর যে ক্ষতি হয়েছে, তার খানিকটা হলেও পুষিয়ে নিতে চাই আমি। এজন্যে সময় দরকার।
‘কি করে পূরণ করবেন ক্ষতি, ডিজইনফর্মেশন?’
‘জি।’
কত সময় লাগতে পারে?’
‘একটু বেশিই লেগে যাবে হয়তো। কিন্তু আপনি জানেন তাড়াহুড়ো করে এ কাজ করা যায় না। তাতে কোন লাভ হবে না। ধরুন, মাস তিনেক।’
‘এর মধ্যে বিএসএস ওকে পাকড়াও করবে না গ্যারান্টি দিতে পারেন?’
‘পারব। এবং স্যার লংফেলোও দেবেন। কাল লণ্ডন পৌছেই সে ব্যবস্থা করব আমি।’
‘বেশ। সে ক্ষেত্রে আপনার অনুরোধ রক্ষা না করার কোন কারণ দেখি না।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’
‘এবার বলুন, কোথায় ভুল করেছে অ্যাঙ্গাস! কখন পক্ষ বদল করেছে?’
‘এর কোনটিই করেনি সে, জেনারেল। কোন ভুল করেনি, পক্ষ বদলও করেনি। আপনি ওর অটোবায়োগ্রাফি পড়েছেন?’
‘নিশ্চই। এবং লংফেলোর টেলিফোন পাওয়ার পর যতদূর সম্ভব ওর সত্যতা যাচাইও করেছি। কিন্তু কোথাও কোন গরমিল পাইনি।’
‘পাননি, কারণ ওর সাথে সত্যের কোন অমিল আসলেই নেই। অ্যাঙ্গাসের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণে বর্ণে সত্যি, জোনারেল, দাঁড়ি কমাসহ।
হতভম্ব দেখাল জেনারেল গেরহার্ডকে। ‘তার মানে সব সত্যি?’
‘সব সত্যি, অন্তত অ্যাঙ্গাস এবং তার সহযোদ্ধা সাইলেসিয়া প্লেইনে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়া পর্যন্ত। পরেরটুকু ডাহা মিথ্যে। সর্বৈব মিথ্যে।
বিস্ময় আরও বেড়ে গেল এনআইএস চীফের। কিন্তু প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকলেন।
‘প্রথমে আপনাকে জানতে হবে, ডি অ্যাঙ্গাসের সঙ্গে অন্য আরেকজন যে ছিল, তার ইতিহাস। ফ্রিকি বা ফ্রেডরিখ ব্রান্ট নাম ছিল তার। হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসার দু’বছর পর, ১৯৩৫ সালে এক জার্মান রেলওয়ে কর্মচারী, নাম জো বা জোসেফ ব্রান্ট, বার্লিনের সাউথ আফ্রিকান লিগেশনে গিয়ে তাকে ইমিগ্রেশন ভিসা দেয়ার অনুরোধ জানায়, কমপ্যাশনেট গ্রাউণ্ডে। কারণ সে ইহুদি বলে তার এবং তার পরিবারের জানমালের নিরাপত্তা নাকি প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়েছে।
‘ব্যাপারটা বিশ্বাস করে লিগেশন, এবং ভিসা দিয়ে দেয় জোসেফ ব্রান্টকে। সে তথ্য প্রমাণ আমার হাতে আছে। কাল আমি ইস্ট লণ্ডন থেকে টেলিফোন করার পর আপনার নির্দেশে ইউনিয়ন বিল্ডিং এ ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য টেলেক্স করে পাঠিয়েছিল আমাকে।’
‘হ্যাঁ,’ অন্যমনস্কের মত মাথা দোলালেন জেনারেল গেরহার্ড। সে সময় অনেক ইহুদিকে ইমিগ্রেশন ভিসা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রচুর ইহুদি এদেশে আসে তখন। অবশ্য কেবল ওরাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এসেছিল।’
‘ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রেমারহেভেন থেকে জাহাজে চড়ে জোসেফ ব্রান্ট, স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তান ফ্রিকিকে নিয়ে। ছয় সপ্তাহ পর ইস্ট লণ্ডন বন্দরে ভেড়ে জাহাজ। ওখানে অনেক জার্মান ছিল। তাদের মধ্যে দুই একটা পরিবার ছিল ইহুদি।ইস্ট লণ্ডনেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জোসেফ এবং ওখানকার মাশার্লিং ইয়ার্ডে চাকরি জুটিয়ে নেয়। অভিজ্ঞতা ছিল বলে এতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাকে।
‘একটা নতুন ইহুদি পরিবার এসেছে, কথাটা ছড়িয়ে গেল। একদিন স্থানীয় র্যাবি, ইহুদি ধর্মযাজক, জোসেফের সঙ্গে দেখা করতে এল। জুইশ কমিউনিটিতে যোগ দিতে অনুরোধ করল তাকে। কিন্তু সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হলো সে। কষ্ট পেল র্যাবি মনে, ফিরে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ল না। কিছু সন্দেহও করল না।
‘৩৮ সালে বালক ফ্রিকির বয়স হলো তেরো। ইহুদিদের এই বয়সে ধর্মমতে দীক্ষা নেয়ার সময়, যাকে ‘বার-মিজবাহ্’ বলে। যাদের একটিই সন্তান, তাদের জন্যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ সময় আবার ওদের বাড়ি এল র্যাবি। জানতে চাইল ছেলেকে জোসেফ অফিশিয়েট করতে চায় কিনা। জবাবে র্যাবির গালে প্রচণ্ড এক চড় মেরে বসে লোকটা। ঘাড় ধরে বের করে দেয় তাকে বাসা থেকে। তখনই র্যাবির মনে জাগল সন্দেহ।
‘কি সন্দেহ?’ জেনারেলকে হতবুদ্ধি মনে হলো।
‘ওরা আদৌ ইহুদি নয়,’ বলল মাসুদ রানা।
‘অ্যাঁ?’
‘হ্যাঁ। সৌভাগ্যের ব্যাপার, পঁচানব্বই বছর বয়স নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন সেই র্যাবি। র্যাবি শ্যাপিরো। কাল তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে আমার। ‘বার-মিজবাহ্’-এর মাধ্যমে র্যাবি ইহুদি ‘সন্তানকে ধর্মমতে দীক্ষা দেয় এবং আশীর্বাদ করে। তবে আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হয় তাকে যে ছেলেটির বাবা-মা সত্যিই ইহুদি। এটা জানতে হয় তাকে ছেলের মার কাছ থেকে, বাবার কাছ থেকে নয়। এবং মাকে এ সময় ‘কেতুবাহ্’ নামে এক ডকুমেন্ট দেখাতে হয় র্যাবিকে, যা প্রমাণ করে সে ইহুদি। এই ‘কেতুবাহ্’ দেখতে চেয়েছিল বলেই চড় খেতে হয়েছিল শ্যাপিরোকে।’
‘তার মানে মিথ্যে ইহুদি সেজে এদেশে ঢোকে ওরা?’
‘নিঃসন্দেহে। ‘তারপর?’
‘পরের ঘটনাগুলো আমার অনুমান, প্রমাণ করতে পারব না। তবে বিচার করে দেখলে অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যাবে। জোসেফ ব্রান্ট আপনাদের পশ্চিম জার্মান লিগেশনকে এক অর্থে সত্যি কথাই বলেছে। গেস্টাপোৱা তার জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তা ইহুদি হওয়ার অপরাধে নয়, সে একজন মিলিটান্ট, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাকটিভিস্ট, সেই অপরাধে। সে কথা বললে ভিসা পেত না জোসেফ ব্রান্ট।’
‘গো অন।’
‘আঠারো বছর বয়সে ফ্রিকি ব্রান্ট কমিউনিস্ট পিতার আদর্শের দীক্ষায় পরিপূর্ণ দীক্ষিত হয়ে ওঠে। খুব সম্ভব এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি কমিনটার্নের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ে সে। ১৯৪৩ সালে দুই তরুণ আফ্রিকানার যুদ্ধে যায়। একজন, ডুয়েলফের ডি অ্যাঙ্গাস, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বিট্রিশ কমনওয়েলথের পক্ষে। অন্যজন, ইস্ট লণ্ডনের ফ্রেডরিখ ব্রান্ট, তার ইডিওলজিক্যাল মাদারল্যাণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে।
‘স্বাভাবিকভাবে যেটা হতে পারত, বেসিক ট্রেনিঙের সময় দু’জনের পরিচয় হওয়া, অ্যাঙ্গাস বা ব্রান্টের মধ্যে ব্যাপারটা সেভাবে ঘটেনি ঘটেছে তারা দুজন যখন একই ট্রাকে চড়ে সাইলেসিয়ার জঙ্গল অতিক্রম করছিল, তখন। অ্যাঙ্গাসের অটোবায়োগ্রাফিতেও এর স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। ইফ ইউ রিকল, প্রথমেই সে দ্বিতীয়জনকে আরেক অপরিচিত আফ্রিকানার বলে উল্লেখ করেছে।
‘ব্রান্ট অ্যাঙ্গাসকে পালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। করে এই জন্যে যে তার মাথায় একটা সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল।
‘জঙ্গলে কয়েকদিন কাটায় ওরা। এই সুযোগে অ্যাঙ্গাসের সঙ্গে আন্তরিকতা জন্মায় ব্রান্টের। গল্পে গল্পে তার ছোটবেলাকার এটা-ওটা খুঁটিনাটি আত্মস্থ করে নেয় সে। এরপর রুশবাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় অ্যাঙ্গাসকে নিয়ে ধরা দেয় ব্রান্ট। যে করেই হোক, ওদেরকে নিজ পরিকল্পনার কথা বোঝাতে সক্ষম হয় সে, এবং খুশি হয়ে দুজনকেই এনকেভিডির হাতে সমর্পণ করে রুশ বাহিনী।
‘এবার মূল কাজে হাত দেয় এনকেভিডি। নির্যাতন করে ডি অ্যাঙ্গাসের পুরো ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করে নেয় তার পেট থেকে। যা পুরো মুখস্থ করে ফেলে ব্রান্ট। এর পর তার চেহারা পরিবর্তন করে রুশরা প্লাস্টিক সার্জারি করে, প্রায় অবিকল ডি অ্যাঙ্গাসে পরিণত করে ব্রান্টকে। এমনিতেই দু’জনের আকার-গঠন, এমনকি চুলের রঙ পর্যন্ত একই রকম ছিল। কাজেই অসুবিধের কিছু ছিল না। তার ডগ ট্যাগ পরিয়ে দেয় এর গলায়। মোটামুটি যখন নিশ্চিত হলো রুশরা যে ব্রান্টকে এখন অনায়াসে অ্যাঙ্গাস বলে চালানো যাবে, তখনই হত্যা করা হয় আসল অ্যাঙ্গাসকে। এরমধ্যে শেষ হয়ে যায় যুদ্ধ।
‘এরপর নকল অ্যাঙ্গাসের কাহিনী সবাইকে বিশ্বাস করানোর জন্যে নকল অ্যাঙ্গাসের ওপর খানিকটা আর্টিফিশিয়াল টর্চারের ব্যবস্থা করে ওরা। কিছু কেমিক্যাল প্রয়োগ করে সত্যি সত্যি অসুস্থ করে তোলা হয় ওকে এবং পটড্যামে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। বেলিফিল্ড আর গ্ল্যাসগো হাসপাতালে কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থেকে ‘৪৫ এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা রওনা হয় নকল অ্যাঙ্গাস। তার জাহাজ কেপ টাউন পৌঁছায় ‘৪৬ এর জানুয়ারিতে।
‘কিন্তু এখানে বড় একটা সমস্যা ছিল আসল অ্যাঙ্গাসের বাবা, ভ্যান অ্যাঙ্গাস। তাঁর সামনে পড়লেই জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। ‘আকার-গঠন-চেহারা যতই এক হোক, যতই প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়ে থাকুক, আপন সন্তানকে বাপ চিনতে পারবেন না, এ অসম্ভব। তাই কমিনটার্নের পুরানো বন্ধুদের সাহায্য কামনা করে ব্রান্ট। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার ভান করে ওয়েনবার্গ মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি হয়।
‘বন্ধুরা ভ্যান অ্যাঙ্গাসকে কেব্ল্ করে জানায় সে কথা। এবং দেরি না করে তাকে কেপ টাউন চলে আসার অনুরোধ জানায়। কার নাম দিয়ে টেলিগ্রাম করা হয় জানি না। তবে অনুমান করতে পারি, হয়তো ডিফেন্স হেডকোয়ার্টারের, অথবা হতে পারে আর কোন কল্পিত নাম দিয়ে। ওটা কোন বড় ব্যাপার ছিল না দীর্ঘদিন একমাত্র পুত্রের অদর্শনে ব্যাকুল পিতার কাছে, বড় ছিল বার্তাটা।
‘বার্তা পেয়েই কেপ টাউনের পথে রওনা হয়ে যান ভ্যান অ্যাঙ্গাস। এবং পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী ডুয়েলক্লুফের বাইরে, মূটসেকি ভ্যালি হাইওয়েতে তাঁকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। গাড়ির ফুটো হয়ে যাওয়া ঢাকা পথের ওপর বদল করছিলেন বৃদ্ধ, এই সময় দ্রুতগামী এক ট্রাক পিষে দিয়ে যায় তাঁকে। হিট-অ্যাণ্ড-রান অক্সিডেন্ট। পরেরটুকু সোজা। ছেলে ‘অসুস্থ’, তাই পিতার শেষকৃত্যে যোগ দেয়ার জন্যে যেতে পারেনি। ডুয়েলফের কেউই সন্দেহ করেনি কিছু। এরপর ওখানকার ভ্যান অ্যাঙ্গাসের লইয়ারকে ডি অ্যাঙ্গাসের তরফ থেকে তার নামে পিতার উইল করে রেখে যাওয়া যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার অনুরোধ করা হয়। সেইমত কাজ করেন ভদ্রলোক, বিক্রয়লব্ধ টাকা পাঠিয়ে দেন ওয়েনবার্গ হাসপাতালের ঠিকানায়।
থামল মাসুদ রানা। নীরবতা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল। উইণ্ডো পেনে একটা মাছির মৃদু ‘পোঁ পৌঁ’ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই সাউণ্ড প্রুফ অফিস রূমে। থেমে থেমে মাথা দোলাতে লাগলেন জেনারেল। আনমনে উদাস চোখে চেয়ে আছেন জানালা দিয়ে বাইরে। অনেক দূরে, একসার পাহাড়ের মাথায় পড়ন্ত বিকেলের রোদের খেলা দেখছেন।
—ইট মেকস্ সেন্স, মেজর,’ অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন ডিয়েটার গেরহার্ড। ‘আমারও মনে হয় আপনার প্রতিটি অনুমানই মোটামুটি সঠিক। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এসব অনুমান। প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
মাথা দুলিয়ে সায় দিল মাসুদ রানা। ‘ঠিক বলেছেন, জেনারেল।’ পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন তিনি। ‘মেজর, এমন কিছু কি আছে, যাতে আপনার ধারণা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে সাহায্য করবে?’
কোটের ভেতরের পকেটে হাত চালিয়ে একটা ছবি বের করল ও, এগিয়ে দিল জেনারেলের দিকে। ‘ছরিটা আসল ডি অ্যাঙ্গাসের সর্বশেষ তোলা ছবি, স্যার, ‘৪৩ সালের। তার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগ্রহ করা। ক্যাপশন পড়লে বোঝা যায় মোটামুটি ভালই ক্রিকেট খেলত। বোলার ছিল সে। বল ছোঁড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে নেয়া হয়েছে ছবিটা। লক্ষ করলে দেখবেন, অ্যাঙ্গাসের বল ধরার কায়দাটা একজন স্পিনারের এবং বাঁ হাতে বল করছে সে।’
‘সো?’
‘এদেশে আসার আগে পুরো চারদিন ডি অ্যাঙ্গাসের ওপর সারাক্ষণ কড়া নজর রেখেছি আমি, স্যার। গাড়ি চালানো, ধূমপান, খাওয়া সব কাজ ডান হাতে করে সে। চেষ্টা করলে একজন মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবকিছুই বদলে দিতে পারবেন আপনি আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে। কিন্তু একজন বাঁ-হাতিকে ডান হাতিতে পরিণত করতে পারবেন না কোনদিনই।’ নীরব হয়ে গেলেন এনআইএস চীফ। ছবিটার ওপর ঘন ঘন স্থান বদল করছে দৃষ্টি! ভাবনার মেঘ ক্রমেই ঘন হয়ে চেপে বসছে চেহারায়।
‘কমিউনিস্ট?’
ডেডিকেটেড কমিউনিস্ট জেনারেল। যে সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আছে সাউথ আফ্রিকান ফরেন সার্ভিসে। অথচ কাজ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে।’
আবার পাহাড়গুলোর দিকে তাকালেন গেরহার্ড। ডুবে গেছে সূর্য। রেশ খানিকটা এখনও আছে। ‘আই উইল টিয়ার দ্যাট বাস্টার্ড অ্যাপার্ট।
‘আমাকে এবার বিদেয় নিতে হয়, জেনারেল। ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে ফ্লাইটের। আপনার সহযোগিতার জন্যে অনেক ধন্যবাদ,’ আসন ছেড়ে হ্যাণ্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল মাসুদ রানা।
ডিয়েটার গেরহার্ডও উঠলেন। ‘সব ধন্যবাদ সব অভিনন্দন কেবল আপনার প্রাপ্য, মেজর। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার এই তৎপরতার কথা আজীবন স্মরণ থাকবে আমার। দেখুন চেষ্টা করে, তিন মাসের মধ্যে ন্যাটোর ক্ষতি কতটা পুষিয়ে নেয়া যায়। ঠিক নব্বই দিন পর ধরব আমি ওকে।’
‘অল রাইট, জেনারেল, স্যার। গুড বাই।’
‘গুড বাই, মেজর। রাহাতকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাবেন।’ রাত ন’টা। জান স্মুটস্-এর ডিপারচার লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে আছে রানা এবং ক্যাপ্টেন অ্যানড্রিয়াস পিয়েনার। সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের লণ্ডন ফ্লাইট প্রস্তুত। যাত্রীদের বিমানে উঠে আসন গ্রহণের শেষ আহবান জানাচ্ছে মহিলা অ্যানাউন্সার। টারমাকে বেরিয়ে এল ওরা, পাশাপাশি এগোচ্ছে গ্যাঙওয়ের দিকে।
‘আপনাকে একটা উপাধি দিতে চাই, মেজর।’
‘কি?’
‘জ্যাগহণ্ড,’ ঠোঁট টিপে হাসল পিয়েনার।
‘ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন,’ মৃদু নড করল মাসুদ রানা। যেন মাথা পেতে গ্রহণ করল উপাধিটা। ‘কথাটার অর্থ?’
‘কেপ হান্টিং ডগ। ধীরস্থির কিন্তু অনমনীয়। নাছোড়বান্দা।’ পরিবেশ ভুলে হো হো করে হেসে উঠল রানা। দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ বলল ক্যাপ্টেন।
‘অবশ্যই।’
‘সেদিন ভ্যান অ্যাঙ্গাসের কবরে ফুল দিয়েছিলেন কেন?’
মুখ ঘুরিয়ে অপেক্ষমাণ এয়ার লাইনারের দিকে তাকাল মাসুদ রানা। আনমনা হয়ে পড়েছে হঠাৎ করে। অজস্র কেবিন লাইটের উজ্জ্বল আভায় ঝলমল করছে দৈত্যাকার ডিসি টেন থার্টি। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ও। যখন বুঝলাম ওরা তার একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, পুত্রের দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে একাকীত্বের যন্ত্রণায় কাতর এক বৃদ্ধ পিতাকে নিজেদের পাপ ঢাকা দিতে গিয়ে কাপুরুষের মত নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তখন হতভাগ্য বিদেহী মানুষটির প্রতি সহানুভূতি জানানোর আর কোন সহজ উপায় খুঁজে পাইনি, তাই দিয়েছিলাম ফুল।’
দশ মিনিট পর রানওয়ে ত্যাগ করল বিমান। নাক উঁচু করে খাড়া তর্জনির মত আরোহণ করল অসীম শূন্যে। তারপর উত্তরে বাঁক নিয়ে ভেসে চলল ইউরোপের দিকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মাসুদ রানা। এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল প্রিটোরিয়া।
(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)