এগারো
কমসোমলস্কি প্রসপেক্টের এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের টপ ফ্লোরে থাকেন ড. জোসেফ পাভলভ। এর জানালা দিয়ে মস্কো ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ দিক এবং মস্কভা নদীর অনেকটা দেখা যায়। সন্ধে ছ’টায় ডোরবেলের আওয়াজ উঠল। তিনি নিজেই এসে দরজা খুললেন। আগন্তুকের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকলেন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। চিনতে পারলেন না। লোকটির হাতে একটা পোর্ট ফোলিও।
‘কমরেড প্রফেসর পাভলভ?’
‘হ্যাঁ!’
‘আমি জেনারেল বরিসভ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিচ বরিসভ। জরুরি একটা বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি আপনার সঙ্গে।’
জেনারেলের বাড়িয়ে ধরা পরিচয়পত্রটা ভাল করে লক্ষ করলেন প্রফেসর। মাত্র এক নজরই যথেষ্ট। ওটা ফিরিয়ে দিয়ে জেনারেলকে ভেতরে ঢোকার আহবান জানালেন তিনি। এনে বসালেন দামী আসবাবে সাজানো সীটিংরূমে। মানুষটি কে, জেনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত নন প্রফেসর। যেখানে দেশের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তাঁর বন্ধু, সেখানে এসব জেনারেল-ফেনারেলকে দেখে বিচলিত হওয়ার কোন কারণ নেই তাঁর। সে যে জন্যেই এসে থাকুক।
‘ওয়েল, জেনারেল,’ বরিসভের মুখোমুখি বসলেন তিনি। ‘অধমের প্রতি এই অযাচিত সম্মান দেখানোর কারণ? ‘
কথাগুলো পছন্দ হলো না জেনারেলের। ইচ্ছে হলো ব্যাটার ফোলা গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিতে। কিন্তু লোকটা পার্টির খুব উঁচু পদে আসীন, সুপ্রীম সোভিয়েতের সদস্য, তাই ওটা সম্ভব নয়। তোমার দাঁত কেলানো বার করছি, দাঁড়াও। ‘কমরেড প্রফেসর, এখানে এসেছি আমি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের স্বার্থে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ তো।’
‘আপনি এবং আরও তিনজন, গত প্রায় তিন সপ্তা উসভোয় কী কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কমরেড?’
আক্ষরিক অর্থেই প্রচণ্ড এক চড় খেলেন যেন প্রফেসর। এবং মনে মনে যেটা আশা করছিলেন বরিসভ, দাঁত কেলানোও বন্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্ত লাগল তাঁর নিজেকে চরম বিস্ময়ের ঘূর্ণি থেকে উদ্ধার করতে। প্রকাণ্ড মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠল রাগে।
‘জেনারেল বরিসভ!’ ছোটখাট একটা হুঙ্কার ছাড়লেন পাভলভ। ‘আপনি আপনার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন।
নিরীহ কণ্ঠে বললেন জেনারেল, ‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে তাঁকে।’
‘কিসের কথা বলছেন? আমি বুঝতে পারছি না!’
‘আমার বিশ্বাস, পারছেন। এবং এ-ও বিশ্বাস করি আপনি আমাকে জানাবেন, ওখানে কেন প্রতিদিন যেতেন আপনারা। কেন মেজর তাতায়েভ, মেজর ক্রিপচেঙ্কোকে ডিটাচ করা হয়েছে তাদের ইউনিট থেকে।
হাত প্রসারিত করলেন প্রফেসর। ‘আপনার অথরিটি, প্লীজ।’
‘আমার র্যাঙ্ক আর সার্ভিসই এ-জন্যে যথেষ্ট।’
‘কমরেড জেনারেল সেক্রেটারির স্বাক্ষর করা কোন অথরাইজড্ লেটার যদি সঙ্গে না এনে থাকেন, তো ওই অথরিটি আমি মানি না,’ শীতল কণ্ঠে বললেন জোসেফ পাভলভ। উঠে ফোনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ‘আপনার বিষয়টা কমরেড জেনারেল সেক্রেটারিকে রিপোর্ট না করে পারছি না, জেনারেল।’
‘কাজটা বোকার মত হয়ে যাবে, প্রফেসর,’ তাঁর চেয়েও শীতল গলায় বললেন জেনারেল বরিসভ।
ডায়ালের ওপর হাত থেমে গেল প্রফেসরের। হিসেব উল্টে গেছে তাঁর, মনে করেছিলেন ফোন করার হুমকি দেখালেই চুপসে যাবে লোকটা। হয়তো কাকুতি-মিনতি শুরু করে দেবে ও-কাজ না করতে, পালাবার পথ খুঁজবে। কিন্তু গ্যাঁট হয়ে বসে তো আছেই, আবার ভয় দেখাবারও চেষ্টা করছে।
প্রফেসরের মনে দ্বিধা ঢুকিয়ে দেয়া গেছে ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন বরিসভ। ‘মাথা ঠাণ্ডা করে বসুন, কমরেড প্রফেসর। আমার কথাগুলো আগে শুনুন। ফোন তো পালিয়ে যাচ্ছে না। পরেও করতে পারবেন।’
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলায় দুললেন কিছুক্ষণ ড. পাভলভ। কি এমন কথা থাকতে পারে লোকটার তাঁর সঙ্গে? কি করে এত নিশ্চিন্ত মনে বসে আছে সে? ইতস্তত পায়ে ফিরে এলেন প্রফেসর। বসলেন। ‘ঠিক আছে, বলুন, কি বলতে চান। তবে শুনে রাখুন, যে বিষয় আপনি জানতে চাইছেন, তা নিয়ে আপনি কেন, কারও সঙ্গেই কথা বলব না আমি।’
‘এত তাড়াতাড়িই প্রতিজ্ঞা করে বসবেন না। আমি জানি, আমার পুরো বক্তব্য শুনলে আপনি সেধেই সব জানাতে চাইবেন। বাদ দিন। কমরেড প্রফেসর, আপনার তো একটিই ছেলে, তাই না? গ্রোমিকো?’
হঠাৎ করেই যেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন জোসেফ পাভলভ। ‘হ্যাঁ। কেন?’
‘মাস দুয়েক আগে কানাডা ঘুরে এসেছে গ্রোমিকো আমাদের এক ট্রেড ডেলিগেশনের ইন্টারপ্রিটার হিসেবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ। তাতে কি?’
‘ওখানে এক সুন্দরী কানাডিয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয় আপনার ছেলের। কয়েকদিনের মধ্যেই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ওরা দু’জন। এ সময়…’
‘এতবড় আস্পর্ধা আপনার!’ প্রায় ফেটে পড়লেন প্রফেসর রাগে। ‘আমার ছেলে কোথায় কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে, তার ভয় দেখিয়ে অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স এবং সুপ্রীম সোভিয়েতের একজন সদস্যকে ব্লাকমেইল করতে এসেছেন আপনি! অল রাইট, কালই পার্টিকে জানাব আমি সব কথা। দেখে নেব আপনাকে! কেজিবির যত বড় অফিসারই হন, আমি ছাড়ব না আপনাকে।‘
‘ঠিক আছে। সে কালকের কথা কাল দেখা যাবে। আগে আমাকে বক্তব্য শেষ করতে দিন। আমার কাছে প্রমাণ আছে মেয়েটি সিআইয়ের এজেন্ট।
‘হোয়াট!’ তুলে আছাড় মেরেছে যেন কেউ প্রফেসরকে। চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেছে পলকে। ‘কি বললেন?’
‘ভুল শোনেননি আপনি, কমরেড প্রফেসর।’
‘তা-তারপর?’
‘মেয়েটি শিকারী ঘুঘু। ফাঁদে ফেলেছে গ্রোমিকোকে।
‘তার মানে…।’
‘ঠিক ধরেছেন। নিভৃত হোটেল কক্ষে তাকে অজান্তেই এমন সব তথ্য দিয়ে ফেলেছে আপনার ছেলে, যা কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি।’
ডাঙায় তোলা বোয়ালের মত কয়েকবার খুলল আর বন্ধ হলো প্রফেসরের প্রশস্ত চোয়াল। ‘আমি…।’ গলা ভেঙে গেল বলতে গিয়ে
‘আমি…আমি বিশ্বাস করি না! কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে সত্যিই গ্রোমিকো এ-কাজ করেছে?’
‘কি প্রমাণ চান আপনি, কমরেড প্রফেসর? রেকর্ড করা ওদের যাবতীয় আলাপ? ছবি?’ পোর্ট ফোলিওটা হাঁটুর ওপর রেখে খুললেন জেনারেল বরিসভ। বের করলেন বড় বড় অনেকগুলো ছবি এবং একটা মিনি টেপ রেকর্ডার।
কিন্তু ওগুলো স্পর্শ করলেন না প্রফেসর। মনে হলো সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়ে গেছেন। ‘কেন, কেন লেগেছিলেন আপনি আমার ছেলের পিছনে?’
‘পার্টি লাগিয়েছে, কমরেড প্রফেসর। ইচ্ছে করে লাগিনি আমি।’
‘মানে?’
‘ব্যাপারটা হলো, আমাদের যেসব ডেলিগেশন অন্য দেশে যায়, তার প্রতিটি সদস্যের জন্য বুক করা হোটেল রূমে আগে থেকেই ক্যামেরা-টেপ রেকর্ডার প্ল্যান্ট করে রাখি আমরা। আই মীন, আমার ডিরেক্টরেট। সে এমনকি নিজেদের ব্লকের দেশ হলেও। এ সিস্টেম পার্টির করা, কমরেড, আমি করিনি। দুঃখিত, সন্তান আমারও আছে। আমি জানি মনের মধ্যে কেমন লাগছে আপনার।কিন্তু বোঝেনই তো, আমি হুকুমের চাকর। হুকুম মানাই আমার কাজ।’ ছবিগুলো গোছাতে শুরু করলেন বরিসভ।
‘কি করতে যাচ্ছেন আপনি ওগুলো নিয়ে?’
কাঁধ শ্রাগ করলেন জেনারেল। ‘আমার করণীয় একটাই কাজ আছে, কমরেড। পার্টিকে রিপোর্ট করা। কালই কাজটা সেরে ফেলব ভাবছি। দেরি করে ফেলার জন্যে কৈফিয়ত দিতে না হয় আবার।’
গলার স্বর চড়ে গেল প্রফেসরের। ‘জেনারেল, আপনি আইন জানেন। এসব সেন্ট্রাল কমিটি জেনে গেলে কি হবে গ্রোমিকোর তাও বোঝেন।
‘বুঝি। দশ বছরের ক্লোজ কনফাইনমেন্ট। উরাল, সাইবেরিয়া অথবা ব্ল্যাক সী’র কাছাকাছি কোথাও। কোন রেমিশন নেই। কিন্তু তাতে কি? আপনি অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স এবং সুপ্রীম সোভিয়েতের সম্মানিত সদস্য। আপনার ছেলের ব্যাপারটা ওরা নিশ্চই বিবেচনা করবে।’
‘না না, প্লীজ। বিকল্প রাস্তা বলুন।’
শালা! কর্ এখন টেলিফোন, বানচোত্! সাইক্লোনের বেগে গাল পাড়তে লাগলেন বরিসভ। ডাক তোর বাবাকে। ডেকে বল ব্ল্যাকমেইলিঙের কথা।
‘প্লীজ, কমরেড জেনারেল! আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি আছি। কিন্তু দয়া করে ও কাজটি করবেন না। আমার ছেলে সিআইএকে তথ্য দিয়েছে, আর সে অপরাধে তার সাজা হয়েছে, জানাজানি হলে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না আমার, জেনারেল।’ ভাব দেখে মনে হলো এখুনি কেঁদে উঠবেন প্রফেসর ভেউ ভেউ করে। বরিসভের পায়ে আছড়ে পড়াও বিচিত্র নয়।
‘বেশ। ঠিক আছে।’
‘প্রশ্ন করুন, কি জানতে চান প্ল্যান অরোরা সম্পর্কে?’
‘অরোরা? তা সে যাই হোক। পুরোটা শুনতে চাই আমি। একদম শুরু থেকে শুরু করুন।’
আরম্ভ করলেন প্রফেসর জোসেফ পাভলভ। নিচু গলায় প্ল্যান অরোরার পুরো পরিকল্পনা খুলে বলতে লাগলেন তিনি। মাঝে মধ্যে বেশ কয়েকবার থামতে হলো তাঁকে বরিসভের নানান প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে।
শুনতে শুনতে পাথর হয়ে গেলেন ভাদিম ভ্যাসিলিয়েভিস বরিসভ। প্ল্যানটির ভয়ঙ্করত্ব অনুধাবন করতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ন্যাটো জোটভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনাহীন, প্রায় শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন এক সময় অরোরার মত প্ল্যান যারা করেছে, এবং যে তা অনুমোদন করেছে, তারা প্রত্যেকে একেকটা বদ্ধ উম্মাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
যারা বিনা যুদ্ধে, বিনা উস্কানিতে হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যা করার পরিকল্পনা করতে পারে, তাদের আর কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় ভেবে পেলেন না তিনি।
নো ফোর-মিনিট ওয়ার্নিঙ? ভাবছেন তিনি, নো রাডার ডিটেকশন অভ অ্যান ইনকামিং মিজাইল, নো চান্স ফর কাউন্টার স্ট্রাইক, নো আইডেন্টিফিকেশন অভ প্রিপারেটর? জাস্ট আ মেগাটন নিউক্লিয়ার বম্ব এক্সপ্লোশন ইন আ পুশ ট্রলি?