অন্ধ শিকারী – ১.১০

দশ

একটা কিছু চলছে ভেতরে ভেতরে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তাতে জেনারেল বরিসভের। কোন গোপন অপারেশন চালানো হবে হয়ত ব্রিটেনে। মেজর ভ্যালেরি তাতায়েভের বিশেষত্ব জানা আছে তাঁর। প্রয়োজন পড়লে একজন ইংলিশম্যান, মার্টিন ফ্ল্যানারি হিসেবে সে দেশে পুশ ইন করানোর জন্যে বছরের পর বছর ধরে ঘষেমেজে তৈরি করা হয়েছে তাকে। চেরনোভস্কির কাছ থেকে, নিয়ে যাওয়াও হয়েছে। ওরই জন্যে প্রস্তুত সেই লিজেণ্ড।

পপলার ট্রান্সমিটার, ভাবছেন এফসিডি চীফ, উত্তর মিডল্যাণ্ডের কোন এক জায়গায় স্থাপন করেছিলেন, তিনি ওটা নিজ হাতে। মেজর ক্রিপচেঙ্কোকে যদি ‘প্যাকেজ’ চোরাচালানের জন্যে বদলি করা হয়ে থাকে, তাহলে আরও কয়েকজনকেও করা হয়েছে নিঃসন্দেহে। বিভিন্ন ডিরেক্টরেট থেকে। সে যাই হোক, সব এক সুতোয় বাঁধা। ব্রিটেনেই পাঠানো হচ্ছে মেজর তাতায়েভকে, অথবা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এরই মধ্যে।

ভেতরে ভেতরে রেগে উঠছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। তাঁকে পর্যন্ত জানানো হলো না ব্যাপারটা, এ কেমন কথা? তাঁর কষ্টে লাগানো গাছের ফল খেয়ে আসবে গিয়ে আরেকজন, তাও তাঁকে না জানিয়ে? চেরনোভস্কির ধারণাই ঠিক, জেনারেল সেক্রেটারি নিজেই কোন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। কেজিবিকে বাদ দিয়ে।

বিপদের গন্ধ পেলেন ভাদিম ভ্লাদিমিরোভিচ বরিসভ। জি. এস. কোন অভিজ্ঞ ইন্টেলিজেন্স অফিসার নন। তার ওপর অসুস্থ, হার্টের রোগী। মাথারও হয়তো ঠিক নেই। কে জানে কোন্ মহাকেলেঙ্কারিতে ফাঁসিয়ে দেবেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে। যতই জোর গলা করে চেঁচানো হোক না কেন, এদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর বিশ্ববাসীর আস্থা একেবারেই নেই বলা চলে। কিছু যদি সত্যিই বেতাল হয়ে যায়, বারোটা বেজে যাবে।

আজ সকালে অফিসে এসেই লোক লাগিয়ে দিয়েছেন জেনারেল গোপনে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে। প্রথমে জিআরইউ প্রধানের সন্ধান বের করবে তারা।সত্যিই তিনি অসুস্থ, না আর কিছু? সেই সঙ্গে আরও কেউ কাজে অনুপস্থিত আছেন কিনা। থাকলে কে কে, কতদিন থেকে, জানতে চান তিনি। খবর আসতে পারে, তাই লাঞ্চ করতে বেরোননি বরিসভ রোজকার মত, সেরে নিয়েছেন অফিসেই।

ঘড়ি দেখলেন তিনি। দুটোর বেশি বাজে, এখনও কারও পাত্তা নেই। গেল কোথায় ব্যাটারা? ভাবতে ভাবতেই ইন্টারকম বেজে উঠল। ‘কমরেড জেনারেল! কমরেড ‘এ’ দেখা করতে চান আপনার সঙ্গে।’

‘পাঠিয়ে দাও,’ হুঙ্কার ছাড়লেন বরিসভ।

ভেতরে ঢুকল রোগা-পাতলা এক যুবক। পিঠটা সামান্য সামনের দিকে বাঁকা। লোকটার পেট আছে কিনা, শার্টের ওপর থেকে ঠাহর করা যায় না। দেখে মনে হয় ছয় মাস দানাপানি জোটেনি, পেট একেবারে পিঠে ঠেকেছে গিয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত হালকা নীল চোখ। সোনালি চুল। চেহারা সব মিলিয়ে হাফ প্রতিভাবানের মত। অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, নিচু কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে রিপোর্ট করল ‘এ’, বা আঁদ্রেই। ভেতরের খোঁজ খবর জানার জন্যে সকালে বরিসভ যাদের পাঠিয়েছিলেন, তাদের দলনেতা।

‘ওয়েল ওয়েল ওয়েল, ভাবলেন তিনি। হাড় হাভাতে, হাড়গিলে, ঘাটের মড়া ভিক্টরোভিচও? নামগুলো শোনামাত্র মাথার ভেতরের প্রাকৃতিক কম্পিউটরে ‘ফিড’ করে ফেলেছেন জেনারেল। ভুল হওয়ার চান্স নেই। ঠিক আছে, আঁদ্রেই। ওয়েল ডান। যেতে পারো এবার তুমি।দরকার হলে পরে খবর দেব।

‘ইয়েস, কমরেড জেনারেল।’

যুবক বেরিয়ে যেতে ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি আবার। মনের সুখে ধুমসে গালাগাল করছেন ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভকে। তুমি শালা কেজিবির পুরানো অভিজ্ঞ অফিসার। আর যে থাকে থাকুক, তুমি কেন এর মধ্যে? কিছু যদি উল্টোপাল্টা হয়ে যায়? কোথায় পালাবে তখন? রাখো, প্রতিজ্ঞা করলেন জেনারেল, বার করছি তোমাদের অপারেশন।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। তিন কু-পরামর্শদাতার একজন, ড. পাভলভকে ইচ্ছে করলেই ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন বরিসভ। সে রসদ আছে তাঁর হাতে। ওগুলো ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখালে বাপ-বাপ করে পেটের সব কথা উগড়ে দেবে সে, কোন সন্দেহ নেই। তবে তার আগে আরেকটা ব্যাপার জানতে হবে। কষ্ট করে বরিসভ নিজেই জেনে নেবেন, সাহায্য নেবেন না কারও। তাতে বিপদ হতে পারে।

সন্ধের পর মস্কোর বারো মাইল পশ্চিমের এক অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে এসে হাজির হলেন তিনি। অবসর নেয়ার পর থেকে এই বিল্ডিঙেই আছেন ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভ। ছ’ তলায় লিফট থেকে বেরোলে সামনেই দরজা। প্রতি ফ্লোরে একটাই ফ্ল্যাট এখানে। দরজা খুললেন মিসেস গ্রেগরিয়েভ। স্বামীর ঠিক উল্টো মহিলা। ভীষণ মোটা।

‘হ্যালো!’ হাসলেন বরিসভ।

কিন্তু মহিলা গভীর। ‘কমরেড জেনারেল?’

‘কমরেড ভিক্টরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।উনি নেই?’

‘না।’

‘ও-হো! কোথায় গেছেন?’

‘শহরের বাইরে।’

শহরের বাইরে! ভাবলেন বরিসভ। ‘আপনাকে রেখে? আয় হায়! ওনার স্বাস্থ্যের যে অবস্থা, গাড়ি চালালে ক্ষতি হবে না? বিশেষ করে একবার যখন স্ট্রোক…।’

‘সঙ্গে ড্রাইভার আছে,’ একেঘেয়ে সুরে বলল মহিলা।

যাক, তাও ভাল। আমি তাহলে চলি।’

‘কেন এসেছিলেন, বললেন না?’

‘এমনিই। এদিক দিয়েই ফিরছিলাম। ভাবলাম, অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই, একটু খোঁজ নিয়ে যাই। এই আর কি!’

‘ও, আচ্ছা।’

শহরে ফিরে এলেন জেনারেল বরিসভ। চিন্তিত। বাসায় ফিরে কেজিবি মোটর পুলে ফোন করলেন তিনি। নিজের পরিচয় জানিয়ে অ্যাটেনডেন্টকে নির্দেশ দিলেন চীফ ক্লার্ককে ডেকে আনতে, কথা বলবেন তার সঙ্গে। কয়েক সেকেণ্ড পরই লোকটার উৎকণ্ঠিত গলা শুনতে পেলেন বরিসভ। দৌড়ে আসতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে।

‘ইয়েস, কমরেড জেনারেল?’

‘তুমি একটা দারুণ কাজ করেছ আমার বন্ধুর জন্যে পুলের সেরা ড্রাইভারটিকে পাঠিয়ে, বুঝলে? রিটায়ার্ড জেনারেল ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভের কথা বলছি। খুব প্রশংসা করলেন ভিনি তোমার দেয়া ড্রাইভারের…ইয়ে, কি যেন নাম…?’

‘গ্রেগরিয়েভ, কমরেড জেনারেল। ওর নামও গ্রেগরিয়েভ।’

বা বা বা, সোনায় সোহাগা! হ্যাঁ হ্যাঁ, গ্রেগরিয়েভ। যাক, শোনো। ক’দিন পর ছুটিতে যাচ্ছে আমার ড্রাইভার। তখন আমার ওকেই চাই।

‘নিশ্চই, কমরেড জেনারেল, নিশ্চই।’

তিন দিন পর লোকটা নিজেই টেলিফোন করল জেনারেলকে। ‘কমরেড জেনারেল, সেদিন বলেছিলেন আপনার ড্রাইভার ছুটিতে যাবে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

গ্রেগরিয়েভ ফিরে এসেছে, কমরেড় জেনারেল। যদি বলেন…’

‘কাল সকালেই আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো ওকে। ঠিক আছে?’

‘জ্বি।’

‘ফোন করার জন্যে ধন্যবাদ। আর হ্যাঁ, তোমার প্রমোশনের জন্যে সুপারিশ করব আমি।

‘অনেক ধন্যবাদ, কমরেড জেনারেল। অনেক ধন্যবাদ।’

নিজের নিয়মিত ড্রাইভারকে ডেকে দু’দিনের জন্যে ছুটি দিয়ে দিলেন জেনারেল। বউ-বাচ্চা নিয়ে বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসার পরামর্শও দিলেন তাকে। কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে তাঁর। আমার সঙ্গে বিটলামি? ভাবছেন তিনি, দাঁড়াও। দেখাচ্ছি মজা!

পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গ্রেগরিয়েভকে কথার জালে একটু একটু করে জড়িয়ে ফেললেন বরিসভ। সে ব্যাটাও তেমনি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল তার ব্যাপারে পুলে খোঁজ-খবর নিয়েছেন ফোনে, যা তা কথা! তার ওপর অন্য অসংখ্য ড্রাইভার থাকতেও বেছে নিয়েছেন তাকেই। কাজেই গ্রেগরিয়েভও জেনারেলকে সন্তুষ্ট করতে উদগ্রীব।

‘কেমন লাগছে আমার গাড়ি চালাতে, গ্রেগরিয়েভ?’

‘খুব ভাল লাগছে, কমরেড জেনারেল।’ এত বড় এক অফিসার সাধারণ ড্রাইভারের অনুভূতি জানতে চাইছেন, ব্যাপারটা কল্পনারও বাইরে। গলে গেল লোকটা। ‘খুব ভাল লাগছে।

তোমার খুব প্রশংসা শুনেছি রিটায়ার্ড জেনারেল ভিক্টরের কাছে। ভিক্টরোভিচ গ্রেগরিয়েভের কাছে। আমার খুব বন্ধু মানুষ।

মুখের কৃতার্থ মার্কা হাসি জমাট বেঁধে গেল ড্রাইভারের, ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন বরিসভ ভিউ মিররের সাহায্যে। তার মানে এ বিষয়ে মুখ খুলতে বারণ আছে তার। ‘জানতাম ও নিজেই ড্রাইভ করে,’ যেন কথার কথা, গুরুত্বহীন, শুনলে শুনতে পারো, না শুনলে নেই, এমন ভঙ্গিতে বললেন তিনি।

‘জ্বি, আমিও তাই শুনেছি, কমরেড।’

‘তারপর? কোথায় কোথায় গিয়েছ. ওকে নিয়ে?’

দীর্ঘ নীরবতা। লোকটা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, দেখতে পাচ্ছেন জেনারেল। ‘মস্কোর আশেপাশেই, কমরেড। ‘

‘নির্দিষ্ট কোন জায়গা, গ্ৰেগ?’

‘জ্বি না।’

ড্রাইভার, গাড়ি থামাও,’ এইবার স্বমূর্তি ধারণ করলেন তিনি।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটা। তাড়াতাড়ি চইকা লেন ছেড়ে ঢুকে পড়ল দক্ষিণমুখি ট্রাফিকের মিছিলে। কিছুদূর এগিয়ে বাঁ হাতি একটা বাই লেন দেখে সেঁধিয়ে দিল লিমুজিন, দাঁড় করিয়ে ফেলল।

সামনে ঝুঁকে বসলেন বরিসভ। তেমনি কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি জানো আমি কে?’

কুঁকড়ে গেল গ্রেগরিয়েভ। ‘জানি, কমরেড জেনারেল।

‘কেজিবিতে কোন পদে আছি জানো?’

দ্রুত মাথা দোলাল লোকটা। ‘জানি।

‘এদিকে তাকাও! ঘোরো!’

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ফিরে তাকাল সে। পরক্ষণেই কলজের পানি বরফ হয়ে গেল জেনারেলের রক্তচক্ষু দেখে। ‘সোজা সত্যি কথা বলো, কোথায় কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে ভিক্টরকে।’

দীর্ঘ সময় নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করল ড্রাইভার লোকটা। অভিজ্ঞ লোক, পরিস্থিতি বুঝে নিল। মুখ খোলার ব্যাপারে কঠোর নিষেধ ছিল মেজর কিরলভের। কিন্তু সে মেজর। আর ইনি…একজন জেনারেল জেনারেলই। ‘প্রতিদিন একই জায়গায় নিয়ে গিয়েছি তাঁকে, কমরেড জেনারেল।’

‘কোথায়?’

‘উসভোয়। কমরেড জেনারেল সেক্রেটারির দাচায়।

হুঁম! হিসেবে তাহলে ঠিকই আছে আমার। ‘কেন?’

‘জানি না। রোজ ভোর অন্ধকার থাকতে নিয়ে গেছি। আবার মস্কো ফিরিয়ে এনেছি গভীর রাতে।’

‘কতদিন চলেছে এই আসা-যাওয়া?’

‘আঠারো দিন, কমরেড জেনারেল।’

‘আর কাকে কাকে দেখেছ সেখানে, বিগ শট!’

‘চারজন ছিলেন। তবে একজনকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না। ‘৮৫ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহারে ছিলাম আমি, কমরেড। সে সময় গ্রু মোটর পুলে চাকরি করতাম, ওদের একজন কর্নেলের গাড়ি চালাতাম।’

‘জেনারেল মার্চেঙ্কো? ‘

‘রাইট, কমরেড জেনারেল।’ ভুরু কুঁচকে গেল গ্রেগরিয়েভের। বরিসভ জানলেন কি করে সে কথা বুঝে উঠতে পারছে না।

‘বেশ। এবার বলো, তোমাকে মুখ খুলতে নিষেধ করে দিয়েছিল কে, মেজর কিরলভ?’

ভেতরে ভেতরে আস্ত একটা ডিগবাজি খেয়ে উঠলেও তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না। ‘জ্বি।’

‘ওকে, গ্রেগ। চলো, ফিরে চলো। ঘাবড়িয়ো না, এসব কথা গোপনই থাকবে।

চমৎকার সুট পরা দীর্ঘদেহী যুবককে মৃদু হাসি উপহার দিল যুবতী রিসেপশনিস্ট। ‘কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে, স্যার?’

‘আমি এখানে নতুন এসেছি। একটা বাড়ি ভাড়া নিতে চাই।’

‘এক মিনিট। আপনাকে মিস্টার স্মিথের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হাউজিঙের ব্যাপারটা উনিই দেখেন,’ ফোনের রিসিভার তুলল মেয়েটি। ‘কি বলব তাঁকে, স্যার?’

মিষ্টি করে হাসল যুবক। ‘ফ্ল্যানারি। মার্টিন ফ্ল্যানারি।’ অফিসটা পুরানো ধাঁচের। ভাবল তাতায়েভ। ইন্টারকম নেই।

দু’মিনিট পর স্মিথের কক্ষে ডাক পড়ল তার। ‘আমি এ অঞ্চলে নতুন। ব্যবসার খোঁজে ডরসেট থেকে এসেছি। ফ্যামিলি আনতে পারিনি বাসার কারণে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ভাল বাসা চাই, মিস্টার স্মিথ।’

‘আপনি কি বাড়ি কেনার কথা মীন করছেন, স্যার?’

‘না, এখনই নয়। পরে ভালমত দেখেশুনে কিনব। এখন চাই ভাড়া বাড়ি। দুই-এক মাসের জন্যে। মানে হেড অফিস যতদিন থাকতে বলে আর কি! এর পরও যদি থাকতে হয়, তাহলে ঠিক করেছি কিনেই ফেলব একটা।’

‘বুঝেছি, শর্ট লীজ।’

‘ঠিক তাই,’ বলল ভ্যালেরি তাতায়েভ।

‘আনফার্নিশড় নাকি ফার্নিশড়, স্যার?’

‘ফার্নিশড়, যদি সম্ভব হয়।’

‘নিশ্চই হবে, স্যার।’ কতগুলো বাছাই করা ফোল্ডার বের করল লোকটা ড্রয়ার থেকে। ‘এগুলো দেখুন। চারটে আছে। অল আর ফার্নিশড্।

সব শেষেরটি পছন্দ হলো মেজর তাতায়েভের। একেবারে যেমনটি সে চাইছিল মনে মনে। দোতলা বাড়ি। ছোট, ছিমছাম বাংলো। ‘এটাই চাই আমার।’

‘অল রাইট। বাড়ির মালিক এঞ্জিনিয়ার, সৌদি আরবে চাকরি করেন। ছ’ মাস পর দেশে ফিরে আসার কথা। প্রয়োজনে ওই পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন আপনি।’

‘চমৎকার। বাসাটা দেখতে চাই একবার।’

‘একশোবার, স্যার।’

এলাকাটা ‘দ্য হে’জ’ নামে পরিচিত। ভ্যালেরির পছন্দের বাড়ির নাম্বার টুয়েলভ, চেরিহে’জ ক্লোজ। অন্য বাড়িগুলোর কোনটা ব্যাকেনহে’জ, কোনটা গরসহোজ, অ্যালমণ্ডহে’জ, হিদারহে’জ ইত্যাদি ইত্যাদি। বারো ফুট পাকা রাস্তা থেকে ছয় ফুট তফাতে চেঁরিহে’জ। কোনদিকেই সীমানা দেয়াল নেই। এক পাশে ছোট একটা গ্যারাজও আছে বাড়িটার। যেটা পরে বিশেষ কাজে লাগবে ভ্যালেরির। পিছনে ছোট্ট ফুলের বাগান। এক্সপ্যাণ্ডেড মেটাল নেট দিয়ে ঘেরা। কিচেন থেকে বাগানে যাওয়ার পথ আছে।

ওপরে তিন বেড তিন বাথ। নিচে বেশ বড় হলরূম-কাম-ডাইনিং, কিচেন ইত্যাদি। প্রতিটি আসবাব, যেখানে যেটা প্রয়োজন, মজুত আছে। ভেতরের সব দরজা কাঠের হলেও মূল দরজা পুরু কাঁচের, স্লাইডিঙ।

‘খুব পছন্দ হয়েছে আমার বাড়িটা। এটাই চাই।’

অফিসে ফিরে ভাড়া গ্রহণের শর্তাদির ব্যাপারে জানাল তাকে স্মিথ। সঙ্গে দু’মাসের ভাড়া অগ্রীম। রেফারেন্স হিসেবে নিজ কোম্পানির জেনেভা হেড অফিসের ঠিকানা দিল তাতায়েভ এবং ডরসেটের বারক্লেজ ব্যাংকের ওপর একটা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করল।

তাকে নিশ্চয়তা দিল স্মিথ, এ দুটোর ব্যাপারে যদি কোন আপত্তি না আসে, তো দু’দিন পর, সোমবার বাড়ি হস্তান্তর করা হবে। গভীর আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল মার্টিন ফ্ল্যানারি ওরফে ভ্যালেরি আলেক্সেইভিচ তাতায়েভ। ভাল করেই জানে কোন আপত্তি আসবে না। সোমবার সকালে কোলচেস্টারের এক কার রেন্টাল এজেন্সি থেকে চমৎকার লেটেস্ট মডেলের একটা ফ্যামিলি সেলুন ভাড়া নিল সে। ওদের জানাল তাতায়েভ যে ডরচেস্টার থেকে এসেছে সে অফিসের কাজে। এসেক্স এবং সাফোকে হাউস-হান্টিঙে আছে।

নিজের গাড়ি স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের ব্যবহারের জন্যে ডরসেটে রেখে এসেছে। ক’দিন এখানে থাকতে হবে ঠিক নেই, তাই এখনই গাড়ি কেনার ব্যাপারে চিন্তা করছে না। তবে কম করেও দিন পনেরো থাকবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তাতায়েভের ড্রাইভিং লাইসেন্সে কোন খুঁত নেই। ওতে তার ডরচেস্টারের ডরসেটের ঠিকানাও আছে। তার ওপর ওটা ইন্টারন্যাশনাল লাইসেন্স। নগদে এক সপ্তাহের ভাড়া এবং ইনশিওরেন্সের টাকা পরিশোধ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ভ্যালেরি।

এবার একজন ইনশিওরেন্সের দালাল খুঁজে বের করল সে। তার কাছে ব্যাখ্যা করল নিজের সমস্যা। অনেক বছর বিদেশে চাকরি করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছে মার্টিন ফ্ল্যানারি। বিদেশে যাওয়ার আগে নিজের গাড়িই চালাত। বিদেশে চাকরির মেয়াদ শেষ, এখানেই আবার স্থায়ী হতে চায় সে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটা ভেহিকেল কিনবে। সেজন্যে ইনশিওরেন্স কভার প্রয়োজন, লোকটা কি পারবে সে ব্যবস্থা করে দিতে?

কি ধরনের ভেহিকেল কেনার ইচ্ছে মিস্টার ফ্ল্যানারির? মোটর সাইকেল? হ্যাঁ, ভাল সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তিনি। রাস্তাঘাটে গাড়ির যা ভিড়, ছোটখাট জিনিসই ভাল। ফাত্রা পোলাপান, হলে হয়তো ঝামেলা হত, কিন্তু মিস্টার ফ্ল্যানারি একজন দায়িত্বশীল পূর্ণবয়স্ক, কাজেই, তাছাড়া যখন ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, ও হয়ে যাবে। অসুবিধে হবে না করাতে।

ঠিকানা? ও, হাউস-হান্টিং? খুব স্বাভাবিক। ইপসউইচের গ্রেট হোয়াইট হল হোটেল? সে তো আরও ভাল হলো। নিশ্চিন্তমনে মোটর সাইকেল কিনে ফেলতে পারেন মিস্টার ফ্ল্যানারি। পরে রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা কেবল তাকে জানালেই চলবে। সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনতে চান? সে জন্যে অবশ্য থার্ড পার্টি ইনশিওরেন্স কভার প্রয়োজন হবে। ঠিক আছে, সব কাজ সেরে রাখবে সে। আর—হোটেল ছেড়ে যদি এরমধ্যে ভাড়া বাসায় উঠে যান তিনি তো সে ঠিকানাটাও দরকার হবে।

সন্ধে নাগাদ ইপসউইচ ফিরে এল তাতায়েভ। মোটামুটি একটা ব্যস্ত দিন গেল আজ। কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক না করেই প্রাথমিক কাজগুলো সেরে ফেলা গেছে। কোন ট্রেইলও রেখে আসেনি সে। হোটেল এবং কার রেন্টাল এজেন্সিতে নিজের ডরসেটের যে ঠিকানা দিয়েছে তাতায়েভ, তার কোন অস্তিত্বই নেই। এস্টেট এজেন্ট আর ইনশিওরেন্স ব্রোকার জানে তার হোটেলের অস্থায়ী ঠিকানা। বারক্লেস ব্যাঙ্কও তার হোটেলের ঠিকানাই জানে। জার্নে মিস্টার মার্টিন ফ্ল্যানারি ‘হাউস হান্টিং’ অ্যাট দ্য মোমেন্ট ব্রোকার লোকটা তার কাজ করে দিলেই হোটেল ছেড়ে দেবে তাতায়েভ। একমাত্র এস্টেট এজেন্ট ছাড়া কেউ জানবে না কোথায় আছে সে। এ সাবধানতার প্রয়োজন আছে।

পরদিন অ্যাসেক্স-এর স্টো মার্কেটে পেয়ে গেল তাতায়েভ মনে মনে যা খুঁজছিল। একটা বিএমডব্লিউ শ্যাফট ড্রাইভ কে-হান্ড্রেড মোটর সাইকেল। নতুন নয়, তবে কণ্ডিশন চমৎকার। বড়, শক্তিশালী এঞ্জিন। তিন বছর ব্যবহার করেছে আগের মালিক, চলেছে মাত্র বাইশ হাজার মাইল। দামের বিশ পার্সেন্ট নগদ দিয়ে কিনে ফেলল ওটা তাতায়েভ। তবে এখনই নিয়ে যেতে পারছে না। বাকি দাম শোধ করে নিতে হবে।

ওই দোকান থেকেই প্রয়োজীয় আউটফিট কিনল সে। কালো লেদার ট্রাউজারস এবং জ্যাকেট। গন্টলেটস, জিপ-সাইডেড জ্যাকবুট। এবং গাঢ় রঙের স্লাইড-ডাউন ভাইজরওয়ালা একটা ক্র্যাশ হেলমেট। এরপর দোকানিকে অনুরোধ করল বাইকটার রিয়ার হুইলের সঙ্গে বড় একটা প্যানিয়ার সেট করে দিতে, তালাচাবি ওয়ালা একটা ফাইবার গ্লাস বক্সসহ। দু’দিনের মধ্যে গাড়িটা তাতায়েভের ফরমায়েশ অনুযায়ী ডেলিভারি দেয়ার নিশ্চয়তা দিল দোকানি।

এবার একটা ফোন বুদ থেকে ইনশিওরেন্স ব্রোকারকে ফোনে বাইকটার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার জানিয়ে দিল ও। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মিস্টার ফ্ল্যানারির জন্যে ত্রিশ দিনের একটা টেম্পোরারি ইনশিওরেন্স পলিসির ব্যবস্থা করে দেবে বলে আশ্বাস দিল লোকটা। ইপসউইচের হোটেলের ঠিকানায় মেইল করে দেবে সে ওটা কালই।

স্টোমার্কেট থেকে বেরিয়ে উত্তরের থেটফোর্ডের দিকে চলল ভ্যালেরি তাতায়েভ। নরফোক কাউন্টি বর্ডারের সামান্য এপাশে খুদে থেটফোর্ড। মাঝ দুপুরের খানিক পর পেয়ে গেল সে প্রার্থিত জিনিসটি। ম্যাকডালেন স্ট্রীটের স্যালভেশন আর্মি হলের কাছাকাছি এক সারিতে পাশাপাশি একত্রিশটা লক্ আপ গ্যারাজ। দুটোর বন্ধ দরজায় ঝুলছে ‘টু লেট’ নোটিস।

ওগুলোর মালিককে খুঁজে বের করল তাতায়েভ। গ্যারাজের কাছেই বাসা। এক মাসের ভাড়া দিয়ে ওর একটা ভাড়া নিল সে। ভেতরটা ছোট, তবে তাতায়েভের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট। টাকার রশিদ চাইল না তাতায়েভ। ট্যাক্স-ফ্রি ক্যাশ পেয়ে খুশি হলো মালিক। তাকে নিজের কল্পিত নাম-ঠিকানা দিল সে। দরজার চাবি দিয়ে বিদেয় হলো লোকটা।

ভেতরে রাইডারস অ্যাকসেসরিজ রেখে তালা মেরে বেরিয়ে এল তাতায়েভ। আর মাত্র একটা কাজ বাকি। স্থানীয় মার্কেট থেকে দুটো দশ গ্যালনি প্লাস্টিক ড্রাম কিনল সে, দুই দোকান থেকে। এরপর দুটো পাম্প থেকে পেট্রল কিনে ভরল ওদুটো। অ্যাকসেসরিজের সঙ্গে ড্রাম দুটো গ্যারাজজাত করল তাতায়েভ। তারপর সেলুন হাঁকিয়ে ফিরে চলল ইপসউইচ। সুইটে যাওয়ার আগে ক্লার্ককে জানাল সে যে কাল সকালে চেক আউট করবে সে। বিলটা যেন তৈরি করে রাখা হয়।

রাতে গভীর ঘুম হলো তার। এক ঘুমে সকাল। তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল তাতায়েভ। তার লাগেজ বেড়ে গেছে। আগেরগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে পেল্লায় এক সুটকেস। ভেতরে শুধু কাপড়-চোপড়, স্থানীয় মার্কেট থেকে কেনা। রিসেপশনিস্ট ক্লার্ককে জানাল ভ্যালেরি, নরফোক চলেছে সে। তার নামে কোন চিঠিপত্র এলে যেন পেণ্ডিঙ কালেকশনে রেখে দেয়া হয়।

রিসেপশন থেকেই ব্রোকার লোকটাকে ফোন করল সে। জানা গেল, তার পলিসি ঘণ্টাখানেক আগেই ইস্যু করিয়ে ছেড়েছে লোকটা। ধন্যবাদ জানাল তাকে তাতায়েভ, বলল, ওটা যেন সে ডাকে না পাঠায়। নিজেই তার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে ওটা ফ্যানারি। হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই তাই করল তাতায়েভ। তারপর উঠে এল টুয়েলভ চেরিহে’জ-এ।

সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে আসা ওয়ান-টাইম প্যাডে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা কোডেড মেসেজ প্রস্তুত করল সে খুব সতর্কতার সঙ্গে। যত সফিস্টিকেটেড কোড ব্রেকিং কম্পিউটরই হোক না কেন, ওয়ান-টাইম প্যাডের কোড ব্রেক করার ক্ষমতা তার নেই। জানা আছে ভ্যালেরি তাতায়েভের। কোড ব্রেকিং কৌশল নির্ভর করে মূলত মেসেজের প্যাটার্ন আর রিপিটেশনের ওপর।

কিন্তু ওয়ান-টাইম প্যাড ব্যবহারে সে ভয় একেবারেই নেই। ওর একেক পাতায় লেখা হয় একটা করে শব্দ। কোন প্যাটার্ন থাকে না, রিপিটেশনের তো প্রশ্নই আসে না। পরদিন আবার থেটফোর্ড এল তাতায়েভ। সেলুনটা গ্যারাজে রেখে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এল স্টোমার্কেট। আসার সময় তার ক্যানভাস গ্রিপে করে সেদিনের কেনা লেদার জ্যাকেট- ট্রাউজার, বুট আর হেলমেটটা নিয়ে এসেছে।

বিএমডব্লিউর বাকি টাকা শোধ করল তাতায়েভ একটা সার্টিফাইড চেকের মাধ্যমে। তারপর গ্রিপটা প্যানিয়ারের ফাইবারগ্লাস বক্সে ভরে বেরিয়ে এল বাইক নিয়ে। হাইওয়ে ধরে দক্ষিণে এগোল তাতায়েভ।মাইল দশেক এগোবার পর পছন্দমত একটা জায়গা পেয়ে বিরতি দিল। জায়গাটা প্রায় নির্জন, দু’পাশে ঘন বন। সামনে পিছনে যতদূর চোখ যায় ভাল করে দেখে নিল সে। গাড়ি ঘোড়া নেই। চট্ করে মোটর সাইকেল নিয়ে বনের ভেতর ঢুকে পড়ল সে।

দ্রুত হাতে পরনের সাধারণ ট্রাউজার-জ্যাকেট বদলে পরে নিল লেদারেরগুলো। জুতোও বদল করল সে। আগেরগুলো প্রথমে গ্রিপ, পরে প্যানিয়ারে আশ্রয় পেল। হেলমেট আগে থেকেই পরা ছিল। বেরিয়ে আসাটা আগেরবারের মত সহজ হলো না। রাস্তা ফাঁকা হওয়ার জন্যে প্রায় বিশ মিনিট ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করতে হলো তাতায়েভকে। তারপর ভোঁ করে বেরিয়ে এল সে পথে। যথাসম্ভব দ্রুত ছুটল যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে। গন্তব্য অনেক দূরে।

রাত এগারোটায় থেটফোর্ড ফিরে এল ভ্যালেরি তাতায়েভ। গ্যারাজে মিনিট পাঁচেক অবস্থান করল সে। কাপড় পাল্টাল। মোটর সাইকেল ভেতরে রেখে বের করল কারটা। তারপর গ্যারাজে তালা মেরে ইপসউইচের চেরিহে’জ ক্লোজের উদ্দেশে রওনা হলো। প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়েও এতটুকু ক্লান্ত হয়নি সে।

আপনমনে শিস বাজাতে বাজাতে ড্রাইভ করছে তাতায়েভ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *