অন্ধ শিকারী – ১.১

এক

মস্কো। প্রসপেক্ট মিরা ওয়ান ইলেভেন। সুউচ্চ এক ফ্রন্ট অ্যাপার্টমেন্টের চারতলা। বিলাসবহুল সীটিংরূমে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়সী, রাশভারি এক ব্যক্তি-জেনারেল পিওতর সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কো। গ্লাভনোই রাযভেদিভেটেলনোই আপ্রাভলেনিয়ে বা জিআরইউ বা সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স প্রধান। বেলা বাজে এগারোটা। এখনও রোব পরে অলস পায়ে ঘরময় পায়চারি করছেন জেনারেল।

আজ অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই তাঁর। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় কর্তা, প্রেসিডেন্ট ও পার্টির সাধারণ সম্পাদকের গোপন নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ছুটি নিয়েছেন। অসুস্থতার অজুহাতে। আজই শুরু হয়েছে ছুটি। কেন হঠাৎ করে ছুটি নিতে বলা হয়েছে জানেন না জেনারেল মার্চেঙ্কো, তবে অনুমান করতে পারেন।

গত গ্রীষ্মের ছুটিতে সপরিবারে নিজের সরকারী সামার রিট্রিট কিসলভসক্‌-এ গিয়েছিলেন মার্চেঙ্কো। ওখানে অবসর কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিটেনের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের পরাজিত করে লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে বিস্তারিত এক রিপোর্ট তৈরি করেন তিনি। লেবার পার্টি মস্কোপন্থী, ওদের ক্ষমতায় বসানো গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাভ। ছুটি সেরে মস্কো ফিরে রিপোর্টটা সাধারণ সম্পাদককে নিজে যেচে পড়তে দিয়েছিলেন জেনারেল মার্চেঙ্কো।

তিনি জানেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করেন, তাঁর দেখিয়ে দেয়া পথে এগোতে পারলে লেবার পার্টির জয় ঠেকাতে পারবে না কেউ। ওরা ক্ষমতায় গেলে দলের ভেতর যেসব কট্টর মার্কস-লেনিন ও ট্রটস্কিপন্থী আছে, তাদের সাহায্যে চরম এক বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া যাবে ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিতে। তাঁর এ বিশ্বাসের কারণ আছে। গত দু’বছর ধরে টাকা, মেয়েমানুষ এবং আনুষঙ্গিক এটা-ওটার দেদার চাহিদা মিটিয়ে আসছেন জেনারেল ওই দলের বাঘা বাঘা সব ‘পন্থীদের’।

অর্থের অভাব নেই জেনারেল মার্চেঙ্কোর। রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে দেশের স্বার্থে যত খুশি খরচ করার অধিকার রয়েছে তাঁর। তেমনি লোকবল। শুধু ব্রিটেনেই আছে ছোটয়-বড়য় মিলিয়ে কয়েক হাজার জিআরইউ রেসিডেন্ট। প্রায় সবাইকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। আর মেয়েমানুষ? ওর চেয়ে সস্তা আর কি আছে দুনিয়ায়? এর ফলও তেমনি পেয়েছেন জেনারেল মার্চেঙ্কো। সম্প্রতি ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রির এক রাঘব বোয়ালের কাছ থেকে এক হাত ঘুরে ন্যাটোর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হাতে পড়েছে তাঁর, যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। কাজেই ছুটি নেয়ার গোপন নির্দেশের কারণ যে তাঁর সেই রিপোর্ট, অনুমান করতে পারেন জেনারেল পিওতর সের্গেইভিচ মাৰ্চেঙ্কো।

ডিসপেনসার থেকে গরম এক কাপ কালো কফি নিয়ে আবার সীটিংরূমে ফিরে এলেন তিনি। বাসায় এ মুহূর্তে আর কেউ নেই। স্ত্রী দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বরফ জমা গোর্কি পার্কে স্কেট্ করতে গেছেন। আকাশের মুখ ভার। আধ ঘণ্টাখানেক হলো বরফ পড়া বন্ধ হয়েছে। তবে ভার দেখে বোঝা যায় আবার শুরু হলো বলে। অ্যাপার্টমেন্টের সামনের প্রশস্ত রাস্তায় জমে ওঠা বরফ নিরলসভাবে পরিষ্কার করে চলেছে গোটা ছয়েক বাবুশকা।

আনমনে ওদের কাজ দেখছেন সের্গেইভিচ মার্চেঙ্কো। থেকে থেকে চুমুক দিচ্ছেন গরম কফিতে। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। ভুরু কুঁচকে দরজার দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি। কে এল? স্ত্রী বা ছেলেমেয়েরা হতে পারে না, ঘণ্টাখানেকও হয়নি বেরিয়েছে তারা।

প্রসপেক্ট মিরা ওয়ান ইলেভেন মূলত জিআরইউর সিনিয়র অফিসারদের আবাসিক এলাকা। এদের পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের আর কেউ প্রবেশ করতে চাইলে হোস্টের অনুমতি প্রয়োজন হয়। এছাড়া গার্ড পোস্টের ঝামেলা তো রয়েইছে। কাজেই বাইরের কেউ হতে পারে না। তাহলে কে? ভাবতে ভাবতে দরজা খুললেন জেনারেল।

দীর্ঘদেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে সামনে। অচেনা। এ নিশ্চয়ই অন্য কারও কাছে এসেছে, ভাবলেন তিনি। পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না বয়স। পরনে চমৎকার ছাঁটের গ্রে ওভারকোট, মাথায় ফারের শাপকা। শীতল, স্থির চাউনি তার নীল দু-চোখে। তার খটখটে শুকনো পালিশ করা জুতো ইঙ্গিত দিচ্ছে, উষ্ণ গাড়ি থেকে সরাসরি সেন্ট্রালি এয়ারকণ্ডিশও এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে প্রবেশ করেছে সে।

ওপরে উঠে এল জেনারেলের দৃষ্টি। চোখাচোখি হলো দুজনের। এই সময় কথা বলে উঠল যুবক। ভরাট, প্রায় গমগমে কণ্ঠে বলল, ‘কমরেড জেনারেল পিওতর মার্চেঙ্কো?’

‘হ্যাঁ!’ বিস্মিত হলেন তিনি। এ তাঁরই কাছে এসেছে! আশ্চর্য! কই, গেটের সিকিউরিটি তো হোস্টের অনুমতি চায়নি! এ জাতীয় ব্যতিক্রম আর কখনও এই ব্লকে হয়েছে বলে জানা নেই জেনারেলের।

‘আমি মেজর কিরলভ। নাইনথ্ ডিরেক্টরেট। সিপিএসইউ জেনারেল সেক্রেটারির পার্সোন্যাল স্টাফ।’

কেজিবির অসংখ্য শাখার একটি নাইনথ্ ডিরেক্টরেট। উঁচু পদের পার্টি নেতাদের ব্যক্তিগত এবং অফিস ও বাসস্থানের নিরাপত্তা বিধান এদের কাজ। এদের মত সব বিষয়ে কড়া ট্রেইনড্, বিশ্বস্ত এবং নির্দয় বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে আর একটিও গড়ে ওঠেনি। ক্রেমলিন গার্ড এদের আরেক পরিচয়। জেনারেলের কোঁচকানো ভুরু সমান হয়ে গেল। নামটা কানে যাওয়ামাত্র বুঝতে পেরেছেন, এই মেজরই পরশু জেনারেল সেক্রেটারির তরফ থেকে ফোনে তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ছুটি নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল।

‘বলুন, মেজর?’

‘একটা চিঠি, কমরেড জেনারেল,’ গ্রেটকোটের পকেট থেকে বাদামি রঙের একটা খাম বের করে এগিয়ে ধরল মেজর কিরলভ।

‘ধন্যবাদ।’ খামটা রোবের পকেটে রাখতে যাচ্ছিলেন জেনারেল মার্চেঙ্কো। থেমে গেলেন মেজরকে মাথা দোলাতে দেখে।

দুঃখিত, জেনারেল। ওটা পড়ে এখনই ফেরত দিতে হবে। কৌতুক বোধ করলেন মার্চেঙ্কো। ‘কার নির্দেশে?’

‘জেনারেল সেক্রেটারি, সিপিএসইউ,’ বলতে গিয়ে একটু যেন কঠোর হয়ে উঠল মেজরের চেহারা।

মুহূর্তে কৌতুক উবে গেল জিআরইউ প্রধানের। ‘আই সী! তা…ইয়ে, ভেতরে আসুন, মেজর।’

‘ধন্যবাদ, কমরেড জেনারেল। আমি এখানেই অপেক্ষা করতে চাই।’

‘বেশ।’ কয়েক পা পিছিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়ালেন জেনারেল মার্চেঙ্কো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভেতরের চিঠিটা বের করে পড়লেন। পলকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর মুখমণ্ডল। মোটা নিবের সাহায্যে স্বয়ং জেনারেল সেক্রেটারি লিখেছেন চিঠিটা। ছাপার মত ঝরঝরে হস্তাক্ষর, চেয়ে চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত চিঠি, বাড়তি কথা নেই একটিও।

যা অনুমান করেছিলেন জেনারেল, ঠিক তাই। আচমকা তাঁকে ছুটি নেয়ার নির্দেশের পটভূমি তাঁর সেই রিপোর্টটিই। এবং আজই, ৩১ ডিসেম্বর, এ ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকেছেন সাধারণ সম্পাদক। মাঝরাতে। পড়া শেষে চিঠিটা মেজর কিরলভের হাতে ফেরত দেয়ার নির্দেশও আছে ওতে। খামে পুরলেন জেনারেল চিঠিটা। ফিরে এলেন দরজার কাছে।

ওটা পকেটে রেখে বলল মেজর, ‘ঠিক সাড়ে এগারোটায় আপনার জন্যে গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করব আমি, কমরেড জেনারেল।’

‘আমি অধীর অপেক্ষায় থাকব,’ হাসি ফুটল মার্চেঙ্কোর মুখে।

মেজরের গাম্ভীর্যেও যেন সামান্য ফাটল ধরল এবার। তবে তা খুবই সামান্য। জেনারেলকে সম্মান জানানোর জন্যে নড করল কিরলভ। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে লিফটের দিকে চলল। এক মিনিট পর সীটিংরুমের জানালা দিয়ে কুচকুচে কালো একটা চইকা লিমুজিন বেরিয়ে যেতে দেখলেন জেনারেল। সেন্ট্রাল কমিটির এমওসি নাম্বার প্লেট ওটার। শোফার নেই, মেজর নিজেই ড্রাইভ করছে। বড় রাস্তায় উঠে দক্ষিণমুখো ছুটল চইকা।

ঘুরে দাঁড়ালেন জেনারেল। হাসতে শুরু করলেন। ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে চেহারা। তাঁর রিপোর্টটা মনে ধরেছে জেনারেল সেক্রেটারির, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। আরও সুখের এবং তৃপ্তির ব্যাপার যে ওটা প্রস্তুতের আর কোন ভাগীদার নেই। সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাঁর একার। সব যদি ঠিকঠাক মত চলে, তাহলে অল্পদিনের মধ্যেই ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর একদিন পশ্চিম ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলোর, এক এক করে। হুঁম! মাঝরাতে, ভাবলেন মার্চেঙ্কো।

মস্কোর হাজার মাইল পশ্চিমে, লণ্ডনে, আরও একজন ভাবছে মাঝরাতের কথা। অভিজাত ওয়েস্ট এণ্ডের বেলগ্রাভিয়া রোডের এক কার পার্কে ভাড়া করা পিচ্চি এক ভলভো এস্টেটে বসে আছে সে। নজর উল্টোদিকের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ফন্টেনয় হাউসের ওপর।

পাকা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে জিম প্রেসটনের, আজ রাতেই মহামূল্য গ্লেন ডায়মণ্ডগুলো হাতাবে সে। ঠিক মাঝরাতে। সারা শহর যখন নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবে বেসামাল উন্মত্ত থাকবে, তখন। তবে আগে নিশ্চিত হতে হবে ওগুলো সে সময় জায়গামতই থাকবে, স্থান বদল করবে না। এবং ওগুলোর মালিক, শেফিল্ডের ডিউকের ছোটবোন, লেডি ফেডোরা; যেমনটি খবর সংগ্রহ করা গেছে, ডিউকের আমন্ত্রণে তাঁর উত্তর ইয়র্কশায়ারের বাগানবাড়িতে আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে স্বামীসহ লণ্ডন ত্যাগ করছেন।

জিম প্রেসটন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। জন্ম কলকাতায়। বছর পনেরো আগে এ দেশে আগমন তার। আর ফিরে যায়নি। রয়ে গেছে দূর সম্পর্কীয় এক চাচার আশ্রয়ে। প্রায় ছয় ফুট দীর্ঘ প্রেসটন। নারকেলের রশির মত পাক দেয়া পেশীবহুল চওড়া দেহ। চেহারা শিশুসুলভ। একমাথা কোঁকড়া কটা চুল, আগোছাল। পেশায় আগে ছিল প্রেসটন ছিঁচকে চোর। হাতে খড়ি নিয়েছিল কোলকাতায় বাঙালি এক ওস্তাদের কাছে। বর্তমানে চুরি ছেড়ে খানিকটা জাতে উঠেছে সে। লণ্ডনের অন্যতম সেরা ক্র্যাকম্যান এখন জিম প্রেসটন।

পিঠ সোজা করে বসে আছে সে। পরনে শোফারের ইউনিফর্ম। এটাও ভাড়া করা। ফন্টেনয় হাউসে থাকে তার শিকার। স্থির, নিষ্কম্প দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে প্রেসটন। পার্কে আরও অনেক গাড়ি আছে, প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই রয়েছে ইউনিফর্ম পরা শোফার। কাজেই প্রেসটন নিশ্চিত, কেউ সন্দেহ করবে না তাকে। ঠিক সাড়ে সাতটায় মৃদু হাসি ফুটল তার মুখে। বেরিয়ে আসছে শিকার। লেডি ফেডোরা এবং তাঁর স্বামী, রবার্ট ফিলবি।

ভবনের আউট লেখা গেটের বিশাল স্টীলের পাল্লা খুলে গেছে। ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে বিশাল এক লিমুজিন-ডিমলার জাগুয়ার। রবার্ট ফিলবি নিজেই ড্রাইভ করছেন। ভদ্রলোক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন হোমরা চোমরা। পাশেই লেডি ফেডোরা। চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো প্রেসটন। সকালের মিষ্টি রোদ জাগুয়ারের মসৃণ চকচকে দেহে পড়ে পিছলে এসে ধাঁধিয়ে দিয়েছে চোখ।

এক মুহূর্ত থেমে থাকল গাড়িটা। বড় রাস্তায় ওঠার আগে ডানে-বাঁয়ে দেখে নিলেন ফিলবি। তারপর নিঃশব্দে গড়িয়ে দিলেন ভারি জাগুয়ারটিকে। মসৃণ গতিতে জিম প্রেসটনের নাকের ডগায় এসে বাঁক নিল ওটা, তারপর রাজকীয় চালে ছুটল হাইড পার্ক কর্নারের দিকে। ত্রিশ সেকেণ্ড পর স্টার্ট দিল প্রেসটন, লট থেকে বেরিয়ে এসে রওনা হলো পিছন পিছন।

দশ মিনিট পর পার্ক লেনে পড়ল গাড়ি দুটো। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল প্রেসটন। সামনে কাউটস্ ব্যাঙ্কের একটি শাখা রয়েছে। লকার ভাড়া দেয়াই এদের মূল ব্যবসা। ভয় হলো ডায়মণ্ডগুলো হয়তো ওদের কাছে গচ্ছিত রেখে যাবেন লেডি ফেডোরা। কিন্তু না, থামল না জাগুয়ার ব্যাঙ্কের সামনে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রেসটন।

গতি ক্রমেই বাড়ছে সামনের গাড়ির। গ্রেট কাম্বারল্যাণ্ড প্লেস ছাড়িয়ে গ্লস্টার প্লেসে পড়ল ওটা। ঝড়ের গতিতে ছুটছে এখন উত্তরমুখো, ইয়র্কশায়ারের দিকে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এম ওয়ান মোটরওয়েতে ওঠা পর্যন্ত জাগুয়ারের পিছনে লেগে থাকল জিম। তারপর খুশি মনে ফিরে চলল শহরের দিকে। ইয়র্কশায়ার পৌঁছতে পুরো ছয় ঘণ্টা লাগবে ডিমলার জাগুয়ারের।

তাহলে? ভাবছে জিম প্রেসটন, ডায়মণ্ডগুলো স্থান বদল করেনি। ফন্টেনয় হাউসেই আছে। না থাকার কোন কারণ নেই। ব্যাঙ্কে রেখে যাননি ওগুলো লেডি ফেডোরা। গত এক সপ্তাহ তার চ্যালা বিল সাইমন কড়া নজর রেখেছে ফিলবি দম্পতির ওপর। এর মধ্যে কোন ব্যাঙ্কেই যাননি ওঁরা। সঙ্গে করেও নিয়ে যাননি। এক মিলিয়ন পাউণ্ডে ইনশিওর করা আছে ডায়মণ্ডগুলো, লণ্ডন থেকে অতদূরে নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ওগুলো নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে না ইনশিওরেন্স কোম্পানি।

অতএব? নিশ্চিন্ত মনে চড়াও হবে সে আজ ফন্টেয় হাউসে। কাজ সারতে এক ঘণ্টা, বড়জোর দেড় ঘণ্টা লাগবে তার। বাজারে চালু যে-কোন তালা বা সেফ খোলা বিশেষ কোন ব্যাপার নয় জিম প্রেসটনের কাছে। মাত্র কয়েক মিনিটের খেল্। আসল হলো কৌশল, ওটা জানা চাই প্রথমে। তারপর তার প্রয়োগ। এ সব শিখেছে প্রেসটন চাচার কাছে। দু বছর হলো মারা গেছে চাচা। তার আগে দূর সম্পর্কের ভাতিজাকে নিজের জানা সমস্ত কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গেছে লোকটা।

প্রেসটনের মত সে-ও ছিল নামকরা ক্র্যাকম্যান। দীর্ঘদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাতিজাকে মনের মত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল সে মৃত্যুর আগে। এ লাইনে কাজ করে প্রচুর কামিয়েছে প্রেসটন। টাকার কোন অভাব নেই তার। তবে অন্যের হয়ে এ কাজ করে না সে কখনও, করে কেবল নিজের জন্যে। আত্মতুষ্টির জন্যে। বয়স ত্রিশ পার হতে চলল, এখনও বিয়ে থা’ করেনি জিম প্রেসটন। দক্ষিণ লণ্ডনের ওয়াগুওঅর্থে চার রূমের বিশাল এক ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাজার হালে থাকে। একজনের তুলনায় ফ্ল্যাটটা অতিরিক্ত বড়, ভাড়াও তেমনি। কিন্তু তাতে পরোয়া নেই প্রেসটনের। দু-হাতে খরচ করে।

তবে বাইরে প্রেসটন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। চোখে পড়ার মত দামী কাপড় চোপড় পরে না। চলাফেরা করে ঝক্কর মার্কা একটা ফিয়াটে। ওটা ছিল চাচার। মারা যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে ওকে। সামর্থ্য থাকলেও নতুন গাড়ি কেনেনি, পরিচিতদের চোখ টাটাতে পারে, তাই।

আরাম আয়েশের সব রকম আধুনিক উপকরণ আছে তার ফ্ল্যাটে। একটা বড় বদ-অভ্যেস প্রেসটনের, কিছু একটা চোখে পড়লে বা মনে ধরলেই হলো। সেটা তার চাই-ই চাই। তার জন্যে যে-কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত সে। গত কয়েক মাস আগে থেকে লেডি ফেডোরার গ্লেন ডায়মণ্ডগুলোর ওপর চোখ পড়েছে তার। সেই থেকে লেগেছে ওর পিছনে।

লণ্ডন আণ্ডারওয়ার্ল্ডে প্রচুর প্রভাব প্রেসটনের। যদিও সেখানকার কেউ নিশ্চিত জানে না কি কাজ করে সে। পুলিসের কাছে ‘ফেস’ বা ‘প্রোফাইল’ হিসেবে পরিচিত সে। তবে ওদের ‘ফর্ম বুকে’ কোন অভিযোগ নেই প্রেসটনের বিরুদ্ধে। লোক দেখানো একটা ব্যবসা আছে তার। কার রেকিঙের ব্যবসা। সেই সুবাদে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সজ্জিত এক মেশিন ওয়ার্কশপের মালিক সে। এর জন্যে আছে দুই কর্মচারী। যারা আসলে দক্ষিণ লণ্ডনের দাগী মাস্তান। ঝুট্ ঝামেলায় পড়তে হয় প্রেসটনকে প্রায়ই, তখন ওদের প্রয়োজন পড়ে।

রেন্টাল কোম্পানিতে প্রথমে গাড়িটা ফেরত দিল জিম প্রেসটন তারপর শোফারের ইউনিফর্ম। ওর নিচে একটা গরম পোলো গেঞ্জি এবং ট্রাউজার পরাই ছিল তার। টুকটাক কিছু কেনাকাটা সেরে ট্যাক্সি চেপে রওনা হলো সে দক্ষিণ লণ্ডনের দিকে। মাইল তিনেক এগিয়ে হঠাৎ ফুটপাথে অতিপরিচিত একজনকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল প্রেসটন বসা অবস্থায়। ড্রাইভার! পুল ওভার! পুল ওভার!!’

ডানদিকের ফুটপাথ ধরে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেছে মানুষটি। ঘন ঘন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ পিছনেই ব্রেক কষার কড়া আওয়াজে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল সে।

যেমন অস্বাভাবিক রোগা, তেমনি ছোটখাট লোকটা। ছোট্ট গোল মুখ, টিকালো নাক। ভাসা ভাসা চোখ। দৃষ্টিতে অদ্ভুত সারল্য। গিলটি মিয়া। পরনে চকলেট রঙের ট্র্যাক স্যুট। ভুরু কুঁচকে যথাসম্ভব দ্রুত পা চালাচ্ছে। ভাব দেখে মনে হয় কারও ওপর চটে আছে মনে মনে।

আসলেই তাই। ভীষণ চটে আছে গিলটি মিয়া। বেহায়া, বেলেহাজ, বেতমিজ ইংরেজদের ওপর। আরে বাবা, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন পেরোলেই যে বচর ঘোরে, এ তো জানা কতা। তাই লিয়ে এত হাঙ্গামা-হুজ্জতের কী আচে? ভাবছে সে। রাস্তাঘাটে ছোঁড়াছুঁড়ি থেকে শুরু করে বুড়োবুড়িরা পর্যন্ত দলে দলে জটলা করছে। পরিচিত হলে তো কথাই নেই, অপরিচিতরা পর্যন্ত এ-ওর কোমর ধরে এক পাক্ নেচে নিচ্ছে। আর সেই সঙ্গে চলছে পাইকারি চুমু।

লাজ-লজ্জার বালাই নেই ব্যাটাদের। কেন, আনন্দ প্রকাশ করার কি এছাড়া আর কোন উপায় নেই। তার ওপর একেকজনের পোশাকের কি ছিরি! গায়ে ওগুলো না থাকলেই বরং ভাল লাগত। তাও তো অনেক মানুষই শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে লম্বা ছুটিতে। তারা সবাই থাকলে না জানি কি অবস্থা হত লণ্ডনের। ময়-মুরুব্বি দেখাদেখি নেই, ছোটবড় বাছ-বিচার নেই…হ্যাঁ, আপনমনে মাথা দোলাল গিলটি মিয়া।

যাকে বলে সত্যিকার উৎসব, ক্যালকাটায় দেখেছে সে। দুগ্গা পুজো কি হোলি, অথবা ঈদ, বরি’দ, বড়দিন, উফ্! সে যে কী আনন্দের ব্যাপার ছিল! ওসবের পায়ের কাচেও লাগে না ইংরেজদের এ উৎসব। আচমকা ব্রেক কষল গিলটি মিয়া। ওর পথ আগলে দাড়িয়েছে চার-পাঁচটা উদ্ভট পোশাক পরা যুবক-যুবতী। চুলের দৈর্ঘ্য প্রায় সবারই সমান। কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে, মাঝ বরাবর ভালমত না তাকালে ঠাহর করা মুশকিল।

খুব সম্ভব গিলটি মিয়ার আকার এবং গায়ের রঙ আকৃষ্ট করেছে ওদের। মজা করার জন্যে তার বাঁ কাঁধে হাত রাখল একটি মেয়ে। পুরু মেক আপ্ নিয়েছে মেয়েটি। তার ওপর বাঁ গালে একজোড়া নগ্ন, আলিঙ্গনাবদ্ধ নারী- পুরুষের উল্কি। ডান হাতে ধরা একটা বিয়ারের খোলা ক্যান গিলটি মিয়ার মুখের সামনে নিয়ে এল মেয়েটি।

‘কামন, ডার্লিং! হ্যাভ আ সিপ্!’

চট্ করে মুখটা দু’ইঞ্চি পিছিয়ে নিল গিলটি মিয়া। ‘ধন্যবাদ। অপাত্রে না ঢেলে ওগুলো তোমার মাতায় ঢালো, মা জননী। মাতা ঠাণ্ডা করো। আর বুকটাও ঢাকো দয়া করে। যে ভাবে উদোম করে রেকেচো, আমার মরা বাপেরও জীবন-যৌবন ফিরে আসবে দেকে।

বুঝল না কেউই কিছু, তবুও হেসে উঠল সবাই। কাঁধের হাতটা আলতো করে সরিয়ে দিল গিলটি মিয়া। নাক কুঁচকে উঠতে চাইছে আপনাআপনি, কষ্ট করে সামলে রেখেছে। ‘ছেড়ে দে, মা,’ বিড় বিড় করে বলল ও। ‘মুকের দুর্গন্ধে ভেঁড়িয়ে থাকাই দায়।’

এক পা এক পা করে জটলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গিলটি মিয়া। তারপর হন হন করে হাঁটা ধরল। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল ও রোজকার মত। ফরসা হওয়ার পর থেকে ইংরেজদের তামাশা দেখতে দেখতে অজান্তেই অনেকটা দূরে চলে এসেছে কখন যেন। অচেনা জায়গায় এসে পড়েছে। তাই ভেতরে ভেতরে খানিকটা ব্যস্ত। চেষ্টা করছে কারও সাহায্য ছাড়াই পথ খুঁজে বের করতে।

আটাশ তারিখ লণ্ডন এসেছে গিলটি মিয়া। ওর জন্যে নতুন নিয়ম করা হয়েছে, রানা এজেন্সির প্রতিটি শাখায় ছ’মাস করে কাজ করতে হবে ওকে। এতে দেশ দেখা যেমন হবে, তেমনি সে সব দেশের মানুষ, ভাষা, আদব-কায়দা ইত্যাদি সম্পর্কেও খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে। ব্রাঞ্চ-এজেন্টরাও অনেক কিছু শিখবে ওর কাছে। এসব ভবিষ্যতে কাজে দেবে।

এখানকার অফিশিয়াল কাজ এখনও শুরু হয়নি গিলটি মিয়ার। বড়দিন এবং নববর্ষ উপলক্ষে লম্বা ছুটি চলছে। এজেন্সির এ-দেশি এজেন্টরা প্রায় সবাই অনুপস্থিত। সিকিউরিটি গার্ড আর দু’-চারজন বাঙালি অফিসার ছাড়া কেউ নেই। তাদেরও ফাইল ওঅর্ক ছাড়া করার কিছু নেই তেমন। সবকিছুতে গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব। তাই গিলটি মিয়াও মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে গা ছেড়ে।

ক’দিন পর আসছে মাসুদ রানা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এজেন্সির কী এক জরুরি ফাইল অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, ওটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে খুব শিগগির। সে সময় ওর লণ্ডন উপস্থিতি প্রয়োজন।

আবার ব্রেক কষল গিলটি মিয়া। দু’পাশের বাড়িঘরের দিকে তাকাল। নাহ্! মহাবিরক্তিতে চোখমুখ কোঁচকাল ও। আবারও ভুল পথে এসেছে। এদিক-ওদিক তাকাল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিস কনস্টেবলের ওপর চোখ পড়ল। হল্লারত একদল যুবতীর দিকে চেয়ে আছে হাঁ করে। তার কাছ থেকে পথের হদিস জেনে নিলে কেমন হয়?

থাক, ভাবল গিলটি মিয়া। আরাকবার চেষ্টা করে দেকি। তারপর নাহায় জিজ্ঞেস করা যাবে। আবার পা চালাল ও। জটলা দেখলেই চোখ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভাবখানা, করগে তোদের যা.মন তাই। মিনিট পাঁচেক চলার পর বুঝল গিলটি মিয়া, এবারও ভুল পথেই এসেছে সে। গতি মন্থর হয়ে এল। থেমে দাঁড়াতে যাবে, এই সময় ঠিক পিছনেই ব্রেক কষার তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনে চমকে উঠল।

লাফিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গিলটি মিয়া। পরক্ষণেই একটা ট্যাক্সি থেকে উড়ে বেরিয়ে এল তালগাছের মত লম্বা কে একজন, জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল তাকে। হতভম্ব হয়ে পড়ল ও। হড়বড় করে কী যেন বলছে তালগাছ। কানে আসছে ঠিকই, কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে ওর। কোন্ ভাষা ওটা?

‘…চিনতে পারছেন না, ওস্তাদ! আমি প্রেসটন; জিম প্রেসটন!’ কানের কাছে পরিষ্কার বাংলায় লাউড স্পীকারের মত চেঁচাচ্ছে লোকটা। ‘ওস্তাদ, আমি বউবাজারের সেই প্রেসটন।

এবার স্বর ফুটল গিলটি মিয়ার। ট্যাক্সি ড্রাইভার হাঁ করে দেখছে ওদের। পথচারীরাও ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। ‘আরে আরে, ছাড়ুন! কি করচেন, ছাড়ুন!’

আলতো করে গিলটি মিয়াকে নামিয়ে দিল প্রেসটন। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে চেয়ে আছে। আনন্দ যেন উপচে পড়ছে তার দু’চোখ দিয়ে। আবার বলল সে, ‘ওস্তাদ, আমি প্রেসটন।’

এবার বুঝল গিলটি মিয়া। মুখ তুলে তাকে দেখছে তো দেখছেই। ‘আ- আপনি…মানে, তুমি…পেস্টন! ক্যালকাটার পেস্টন?’

‘হ্যাঁ, ওস্তাদ,’ হাসি দু’কান স্পর্শ করল তার। অভিভূতের মত কতক্ষণ ওস্তাদের দিকে চেয়ে থাকল সে। ‘আজ আমার এমন সুদিনে আপনার দেখা পেলাম, কি যে আনন্দ হচ্ছে, ওস্তাদ! আমার ভাগ্যটা সত্যিই ভাল।’

গিলটি মিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বিস্ময়ের ঘোর এখনও তার কাটেনি। সেই এতটুকুন পেস্টন, যাকে ক্যালকাটায় নিজহাতে মহাবিদ্যা শিখিয়েছে সে, আজ এত বছর পর কি না সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে এসে লণ্ডনে তার সঙ্গে দেকা? ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে ঠিক ভরসা হচ্ছে না।

‘আসুন আমার সাথে,’ তার বাহু ধরে আকর্ষণ করল জিম প্রেসটন। ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, কোতায়…’

‘যেখানে আমি নিয়ে যাব।’

‘কিন্তু…’ শিষ্যের কথার তোড়ে বাকি কথা বলার ফুরসত পেল না গিলটি মিয়া।

‘কোন কিন্তু-টিন্তু নেই। আগে গরীবখানায় চলুন, তারপর শুনব আপনার কথা।’

প্রায় টেনে হিঁচড়ে ট্যাক্সিতে তুলল তাকে জিম প্রেসটন। রওনা হয়ে গেল ট্যাক্সি ওয়াটারলু ব্রিজের দিকে। সারাপথ একাই বক্ বক্ করল প্রেসটন, গিলটি মিয়াকে মুখ খোলার বিশেষ একটা সুযোগ দিল না। তার ফ্ল্যাটে পা রেখে থমকে গেল গিলটি মিয়া। অবাক বিস্ময়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ঘরগুলো। ‘এই তোর গরীবখানা?’

হাসল প্রেসটন। ‘এইবার বোঝা গেল সত্যিই চিনেছেন আপনি আমাকে।

‘মানে?’

‘তখন থেকে তো কেবল একবার আপনি একবার তুমি করে আসছেন। ‘এই কতা? তা তুই কি আর আগের মতন ছোটটি আচিস? অতবড় জোয়ান মরদকে কি চাইলেই তুই তুকারি করা যায়?’

‘শুরু যখন একবার করেই ফেলেছেন, চালিয়ে যান। আপনার মুখে ওসব সম্বোধন মোটেই ভাল লাগে না, ওস্তাদ। কেমন পর পর মনে হয় নিজেকে।’

শিষ্যটি তার আগের মতই বিনয়ী আছে বুঝতে পেরে আটাশ ইঞ্চি বুকের ছাতি আরও দু’ইঞ্চি প্রসারিত হলো গিলটি মিয়ার।

‘বাদ দিন ওসব, কি খাবেন বলুন। খিদে পেয়েছে নিশ্চই?’

এইবার খেয়াল হলো গিলটি মিয়ার, ন’টা বাজতে চলেছে, এখনও পেটে কিছু দেয়ার সুযোগ হয়নি। ‘পেয়েচে মানে? সেই ভোর সক্কাল থেকে রাস্তা হারিয়ে কানা মুরগির মতন ইদিক-উদিক ঘুরে মরচি। পেটে ধাড়ি ছুঁচোর কেত্তন চলচে।

‘পথ হারিয়েছিলেন!’ বিস্মিত হলো জিম। ‘সে কি!’

‘তবে আর বলচি কি?’ পেটে হাত বোলাল গিলটি মিয়া।

‘আচ্ছা এখন থাক। পরে শুনব। আগে খাবারের ব্যবস্থা করি,’ কিচেনের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল সে। খাবার ব্যাপারে গুরুর কড়া বাছ-বিচারের কথা মনে পড়ে গেছে। ‘ওস্তাদ, আপনার জন্যে…?’

‘সেদ্ধ ডিম আর কলা। আচে না?’

‘অবশ্যই। সঙ্গে কফি, না চা?’

‘নিভেজাল সাদা পানি।’

নাশতা সেরে সীটিংরুমে এসে বসল ওরা। ‘তুই তাহালে একনও টায়াড?’ প্রশ্ন করল গিলটি মিয়া।

বুঝতে না পেরে চেয়ে থাকল জিম প্রেসটন।

‘বুজলিনে? থ্রী সেবেনটি নাইনের কতা বলচি, একনও চলচে ওসব? আমি বাপু রিটায়াড, ছেড়ে দিয়েচি।’

হেসে উঠল প্রেসটন। অকপটে নিজের বর্তমান পেশা সম্পর্কে জানাল গিলটি মিয়াকে। ‘এখন বেশ ভাল আছি, ওস্তাদ। একটা দান মারতে পারলেই বেশ কিছু দিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। অনেক ভাল আছি আগের চেয়ে।’

‘সে তো বুজতেই পারচি,’ ঘরের চারদিকে নজর বোলাল সে। ‘সুদিন সম্পর্কে তকন কি যেন শুনলুম? কিসের সুদিন?’

‘আজ রাতে খুব বড় একটা দাঁও মারতে যাচ্ছি, ওস্তাদ। খুব বড় দাঁও!’

‘যা। সাবধান থাকিস। পেচলে একটা চোক রাকবি সব সোমায়,’ ডান হাত তুলল গিলটি মিয়া শিস্যকে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে।

‘এমন দিনে আপনার দেখা পেলাম, বুকের বল অনেক বেড়ে গিয়েছে, ওস্তাদ।’

আরও আধ ঘণ্টা গল্প-গুজব করে আসন ছাড়ল ওস্তাদ। ‘এবার যেতে হয়। দেরি হয়ে গেচে।

‘সে কি!’ আকাশ থেকে পড়ল জিম। ‘কোথায় যাবেন?’

হেসে ফেলল গিলটি মিয়া। ‘যেকেনে যেতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলুম, সেকেনে।

বেকুবের মত চেহারা হলো প্রেসটনের। ‘তাই তো! কিন্তু, ওস্তাদ, আপনি এখানে কেন, কি কাজে এসেছেন, কোথায় উঠেছেন, কিছুই তো জানা হলো না।’

‘বলব, বলব। কিন্তু আজ নয়, সোমায় নেই। আরাকদিন।’

ব্যস্ত হয়ে উঠল জিম প্রেসটন। ‘আরেকদিন নয়, ওস্তাদ। কালই আসুন, একটা জিনিস দেখাব আপনাকে। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, অমন জিনিস আগে কখনও দেখেননি আপনি।’

‘জিনিসটা কি?’

‘উঁহুঁ, বলব না। দেখাব।’

একটু ভেবে রাজি হয়ে গেল গিলটি মিয়া। ‘ঠিক আচে। আসবো।’

‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘কুনো দরকার নেই। একাই যেতে পারব আমি ট্যাক্সি লিয়ে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *