অন্ধ মনিরা

অন্ধ মনিরা

মামীমা, আমি জানি সে বন্দী হয়নি। সে এসেছিলো আমি তার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। মামীমা আমি শুনতে পেয়েছি তার কণ্ঠস্বর। আমার মনে যে গেঁথে রয়েছে সেই আওয়াজ। সে ছাড়া আর কেউ নয়, মামীমা…

মরিয়ম বেগম বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলেন– নিষ্ঠুর এলোই যদি তবে পরিচয় না দিয়ে চলে গেলো কেনো? ওর প্রাণ কি একটুও কাঁদেনি? ঐ হতভাগার জন্য আর তোর এ অবস্থা। পাষণ্ড তোকে..

মামীমা, সে পাষণ্ড নয়, সে নিষ্ঠুর নয় নিরুপায় হয়েই গেছে ও। জানোনা, তাকে গ্রেফতারের জন্য অহরহঃ পুলিশ সতর্ক পাহারা দিচ্ছে? পরিচয় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা মামীমা। ডাক্তারের সহকারীর রূপ নিয়ে কৌশলে সে এসেছিলো আমাদের সন্ধান নিতে! পরিচয় দেবার সুযোগ তার হয়নি। মনিরা কথাগুলো বলতে গিয়ে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠছিলো।

মরিয়ম বেগম সস্নেহে মনিরার পিঠে হাত রেখে বললেন মা মনিরা তোর এই অবস্থার জন্য আমিই দোষী– আমিই দায়ী। আজ যদি ওর সঙ্গে তোর বিয়ে না দিতাম তাহলে আজ তুই অন্ধ হতিস না মা, অন্ধ হতিস না…

মামীমা, এ সব তুমি বলছো? ওকে পেয়ে আমি নিজকে ফিরে পেয়েছি, মামীমা। আমার নারীত্ব সার্থক হয়েছে। অন্ধ হলেও আমার সান্তনা– আমি যার স্ত্রী সে সাধারণ মানুষ নয়, সে অসাধারণ পুরুষ। বলো বলো মামীমা, কোন নারী এমন স্বামী পেয়ে অসুখী হবে? আমার কিছু না থাক, তবু খোদা ওকে মঙ্গলে রাখুন। এই দোয়া তুমি আমাকে করো মামীমা, আমি যেন তার কোলে মাথা রেখে মরতে পারি।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলেন সরকার সাহেব, চোখে-মুখে তার খুশির উচ্ছ্বাস, দক্ষিণ হস্তে কান্দাই পত্রিকা। আনন্দ ভরা কণ্ঠে বললেন তিনি– বেগম সাহেবা, দেখুন এই দেখুন– পত্রিকা খানা এগিয়ে দেন সরকার সাহেব বেগম সাহেবার হাতে।

মরিয়ম বেগম পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে দৃষ্টি বুলান, তার চোখে সব ঝাপসা লাগে। চশমা ছিলনা সে খেয়াল নেই। এবার বলেন তিনি সরকার সাহেব, আপনি পড়ুন, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।

সরকার সাহেব পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন– “গতকল্য সোমবার ভোর রাত্রিতে কান্দাই শহরে চৌধুরী মাহমুদ খান সাহেবের বাড়ির পিছন হইতে পুলিশ বাহিনী দস্যু বনহুর ভ্রমে যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করিয়াছে সে ব্যক্তি দস্যু বনহুর নহে।

রাত্রির অন্ধকারে তাহোকে পুলিশ চিনতে পারেনি।

অদ্য পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহম্মদ ও মিঃ জাফরী হাঙ্গেরী কারাগারে গমন করিয়া বন্দীকে সনাক্ত করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, যাহাকে দস্যু বনহুর বলিয়া গ্রেফতার করা হইয়াছে, সে কান্দাই শহরের কোন এক বিশিষ্ট ব্যক্তি।”

মনিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো– মামীমা, আমি বলেছিলাম– সে গ্রেফতার হয়নি। গ্রেফতার সে আর হয়নি।

মরিয়ম বেগমের চোখে-মুখে আনন্দদ্যুতি ফুটে উঠলো। এতক্ষণে তিনি যেন নিশ্চিন্ত হলেন। উপরের দিকে হাত দুটি তুলে ধরে বললেন- পাক পরওয়ার দেগার, তুমি আমার মনিকে রক্ষা করেছো। তুমিই তাকে হেফাযতে রেখো।

মাতৃহৃদয়ে অভূতপূর্ব পুত্রস্নেহ জেগে উঠলো তিনি দুচোখ মুদিত করে কিছু ভাবতে লাগলেন। হয়তো তার মনের আকাশে ভেসে উঠেছে পুত্রের মুখখানা। অনাবিল একটা শান্তির ধারা তার। সমস্ত অন্তরকে প্লাবিত করে দিলো।

একটু পূর্বেই যে পুত্রকে মরিয়ম বেগম তিরস্কার করছিলেন, যার জন্য তাঁর মনে সদাসর্বদা তুষের আগুন জ্বলছিলো, এক্ষণে সেই পুত্রের কুশল-সংবাদে খুশিতে ভরে উঠলো মাতৃহৃদয়। মনির তাহলে পুনঃ গ্রেফতার হয়নি নিশ্চয়ই সে ভাল আছে– কুশলে আছে।

এখানে মাতা যখন পুত্রের মঙ্গল চিন্তায় আত্মহারা, তখন নিজ আস্তানায় দস্যু বনহুর তার দুগ্ধ-ফেননিভ শুভ্র বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন।

কান্দাই পর্বতের কন্দরে ভূগর্ভে দস্যু বনহুরের আস্তানা।

সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করতে সক্ষম নয়। অহরহ বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা এখানে। কৌশলে হাওয়া প্রবেশের পথ তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। সময় নির্ধারণের জন্য আস্তানায় বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে ঘড়ি টাঙ্গানো রয়েছে।

নূরী দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো, বেলা দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট হয়েছে– এখনও বনহুরের নিদ্রা ভাংলোনা।

নূরী সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললো বনহুরের কক্ষের দিকে।

অতি সন্তর্পণে কক্ষে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো।

শয্যায় নিদ্রামগ্ন বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো, মুগ্ধ নয়নে সে দেখতে লাগলো বনহুরকে। আজ থেকে কত বছর সে দেখে আসছে ঐ মুখখানা, কিন্তু আজও নূরীর তৃপ্তি হয়না। যত সে দেখে ততই ইচ্ছা হয় আরও তাকিয়ে থাকতে আশা যেন মেটেনা নূরীর।

নূরী এক্ষণে বনহুরকে জাগাতে এসেছিলো, কিন্তু পারলোনা। চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। স্মরণ হতে লাগলো গতকালকের বনহুরের কথাগুলো কি অন্যায় আমি করেছি, বলো–জবাব দাও নুরী?

অন্যায় তুমি করোনি, করেছি আমি।

নূরী।

হুর, তুমি আমাকে স্পর্শ করোনা।

কেনো?

 না না, বলতে পারবোনা, বলতে পারবোনা সে কথা আমি।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে টেনে নিয়েছিলো কাছে, গভীর আবেগে বলেছিলো সে– বলতে হবে তোমাকে।

সে কথা না শোনাই তোমার পক্ষে মঙ্গল বনহুর।

নূরী, তুমি আমার কাছে কিছু গোপন করবেনা, আমি সেই আশাই করি।

হুর, জানো তোমার–আমার মধ্যে কত বড় বাধার প্রাচীর রয়েছে?

বাধার প্রাচীর?

হাঁ, আমাদের মুসলমান ধর্মে যতক্ষণ না লোকসমাজে অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয় ততক্ষণ…

হঠাৎ বনহুর তখন আনমনা হয়ে পড়েছিলো, অন্যমনস্কভাবে কি যেন চিন্তা করেছিলো। নূরীকে বাহুর মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো সে, কিন্তু পরক্ষণেই নূরী অনুভব করেছিলো– বনহুরের হাত দুটি ধীরে ধীরে যেন শিথিল হয়ে এলো।

নূরীকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে বলেছিলো– তুমিও কি সমাজ আর অনুষ্ঠান মানো নূরী?

নূরী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলো– আমি না মানলেও নিয়ম মেনে চলাই শ্রেয়।

তাই বুঝি তুমি কাল পালিয়েছিলে আমার কাছ থেকে? হাঁ। গলাটা কেঁপে গিয়েছিলো নূরীর।

বনহুর হেসে বলেছিলো– বাধা-বন্ধনহীন বনহুর কোন নিয়মের দাস নয় নূরী।

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠেছিলো নুরী বনহুর।

না, সেই নামে ডাকো, তোমার মুখে ঐ দু’টি অক্ষরে নামটা শুনবার জন্য আমি সর্বদা ব্যাকুল থাকি নূরী। বনহুর গভীর আবেগে নূরীকে টেনে নিয়েছিলো আবার বুকের মধ্যে।

নূরীর শিরায় শিরায় বয়ে গিয়েছিলো সুষমামন্ডিত এক অনুভূতি। কিছুতেই সে নিজকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারেনি দস্যু বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধন থেকে।

সব কথাগুলি এখন নূরীর মনের মধ্যে তোলপাড় করছিলো। সমস্ত অন্তরের কানায় কানায় অনুভব করছিলো সে বনহুরের হৃদয়ের অভূতপূর্ব এক আকর্ষণ।

নূরী মন্থর পদক্ষেপে বনহুরের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দক্ষিণ হাতখানা রাখলো সে বনহুরের চুলে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের। চোখ মেলে নূরীকে শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশ ফিরে শুলো, কোন কথা বললোনা।

নূরী বুঝতে পারলো বনহুর অভিমান করেছে। একটু দুষ্টামি করতে ইচ্ছা হলো তার। বললো নূরী–ভোর হতে এখনও ঢের বাকি, তুমি ঘুমাও। আমি চললাম …

নূরী বেরিয়ে যাওয়ার ভান করলো, কিন্তু লুকিয়ে পড়লো খাটের আড়ালে।

বনহুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিছানায় উঠে বসলো। মনে করেছে বনহুর নূরী বেরিয়ে গেছে।

শয্যা ত্যাগ করবে, এমন সময় তাকিয়ে দেখলো– খাটের পাশে তার জুতোটা নেই! একটু কিছু চিন্তা করে খালি পায়েই উঠে দাঁড়ালো- কি! আলনায় তার জামাও নেই, তাকালো ওদিকে গামছা বা তোয়ালেও নেই। হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সম্মুখের আয়নায়। আয়নার মধ্যে দেখতে পেলো খাটের পিছন দিকে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে নূরী। বনহুর এবার বুঝতে পারলো সব দুষ্টামি নূরীর। মনে মনে হাসলো সে।

বনহুর এবার বাথরুমে প্রবেশ না করে খাটেই উঠে বসলো তারপর আপন মনে বললো আমার জুতো, তোয়ালে, ব্রাস– সব প্রাতঃভ্রমণে গেছেন, ফিরে আসুন তারা ততক্ষণ আর একটু ঘুমিয়ে নিই।

বনহুর সত্যি সত্যি চাদর টেনে শুয়ে পড়লো।

ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো জোবাইদা, সর্দারকে তখনও ঘুমাতে দেখে ডাকলো- সর্দার!

বনহুর এবার ফিরে তাকাতে বাধ্য হলো, শয্যায় উঠে বসে বললো– জোবাইদা, আমার ঘরে কি চোর প্রবেশ করছিলো?

অবাক কণ্ঠে বললো জোবাইদা চোর।

হাঁ, আমার জুতো, তোয়ালে, ব্রাস কিছুই দেখছিনা।

 সর্দার!

আমার মনে হচ্ছে, চোর প্রবেশ করেছিলো।

 অসম্ভব। এখানে কি করে চোর প্রবেশ করবে, সর্দার?

এই দেখো আমি চোরকে তোমার সম্মুখে হাজির করছি। বনহুর খাটের ওপাশে গিয়ে নূরীর হাত ধরে টেনে তুললো।

সঙ্গে সঙ্গে জোবাইদার মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠলো। এতে করে বলা সত্ত্বেও আবার। সর্দারের কক্ষে নূরী এসেছে।

বনহুর নূরীর হাত থেকে জুতো নিয়ে পায় পরলো আর তোয়ালেটা হাতে নিয়ে হেসে বললো বনহুর–এবার চোখের সাজা কি জানো?

জোবাইদা গম্ভীর কণ্ঠে বললো– সর্দার।

জোবাইদার কণ্ঠস্বরে বনহুর অবাক হয়ে তাকালো তার মুখের দিকে।

জোবাইদা বললো এবার সর্দার নূরীর স্পর্ধা দিন দিন চরমে উঠেছে। নূরীর অসংযত ব্যবহার আমাদের সকলের মনে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে, আমরা তাকে ক্ষমা করবো না।

জোবাইদার দৃঢ় কণ্ঠে বনহুর বিস্মিত হলো।

নূরী আর জোবাইদা সমবয়সী, আস্তানায় তারা সব ব্যাপারে সমান অধিকারী। নূরী যেমন দস্যু কালু খাঁর একজন বিশ্বস্ত অনুচর কন্যা, তেমনি জোবাইদা ও নাসরিনও। বনহুরের সমবয়সী এরা না হলেও কয়েক বছরের ছোট হবে।

বনহুর যুবক। নূরী, নাসরিন, জোবাইদা–এরাও যুবতী। বনহুরের খেলার সাথী শুধু নূরী। একাই ছিলনা, নাসরিন আর জোবাইদাও সহচরী ছিলো বনহুরের অবশ্য বনহুর আর নূরীর মধ্যে যেমন গভীর একটা যোগাযোগ ছিলো ততটা ছিলোনা জোবাইদা আর নাসরিনের মধ্যে।

বনহুর আর নূরী যখন এক সঙ্গে খেলা করতো, ঘুরে বেড়াতো, বনে বনে জীবজন্তু শিকার করতো, তখন জোবাইদা আর নাসরিন তাদের সঙ্গী হতে পারতো না। দূর থেকে দেখতো আর বলতো- ওরা দু’জন বড় স্বার্থপর। রাগ করতো, খেলা করতে যেতোনা আর তাদের সঙ্গে!

কিন্তু সদা হাস্যময়ী নূরীর কাছে বেশিক্ষণ জোবাইদা আর নাসরিন অভিমান করে থাকতে পারতোনা। ওদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতো বনহুরের পাশে।

বনহুর তীর-ধনুক দিয়া গাছ থেকে ফল পেড়ে দিতো– যেটা চাইতো।

নূরী, জোবাইদা আর নাসরিন হাততালি দিয়ে হাসতো, বাহাদুর বলে আখ্যা দিতো ওরা বনহুরকে।

বনহুর আর ওরা তিন জন নদীতে সাঁতার দিতো– কে আগে ওপারে যেতে পারে। সবাইকে ছাড়িয়ে বনহুর ওপারে গিয়ে উঠলো, তখন নূরী, নাসরিন আর জোবাইদা নদীর মাঝখানে পড়ে রয়েছে।

কোন কোন দিন বনহুর ফিরে এসে এদের এক এক জনকে নিয়ে যেতো ওপারে।

 তিন সখী মিলে হাসিতে ভরে উঠতো।

বনহুর নুরীর হাত ধরে বলতো– চলো আমরা দু’জন সাঁতার দি।

নূরী আর বনহুর আবার নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

জোবাইদা আর নাসরিন তাকিয়ে থাকতো। খিলখিল করে হাসতো নাসরিন, জোবাইদা মুখ ভার করে থাকতো অভিমানে।

নূরীর দিকে বনহুরের যে একটা আকর্ষণ ছিলো এটা অনেক পূর্ব হতেই জানতো জোবাইদা আর নাসরিন। নাসরিনের মনে ব্যাপারটা তেমন দাগ কাটতোনা, যেমন করে জোবাইদার হৃদয়ে। আঘাত করতো ওদের দু’জনার মিলামিশাটা।

বনহুর জোবাইদা আর নাসরিনের সঙ্গে গভীরভাবে না মিশলেও জোবাইদার সমস্ত হৃদয় জুড়ে রেখাপাত করেছিলো বনহুর। ওকে নিয়ে জোবাইদা মনে মনে একটা কল্পনার জাল বুনতো– স্বপ্নের রঙ্গিন নেশার মতই। কিন্তু কোন দিন জোবাইদার আশা পূর্ণ হবার নয়, একথাও সে জানতো এবং জানতো বলেই তার হৃদয়ের নিভৃত কোণে মাঝে মাঝে উঁকি দিতো একটা ঈর্ষান্বিত ভাব।

জোবাইদা তার অন্তরের গোপন বাসনা কোনদিন কারো কাছে প্রকাশ করেনি বা করবার সাহসী হয়নি। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের মধ্যে একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিলো যা তাকে ভাবগম্ভীর করে তুলেছিলো। শুধু জোবাইদা কেনো, আস্তানার সকলেই বনহুরের কাছে সংকুচিত হয়ে পড়তো মুখ তুলে কথা বলতে সাহসী হতোনা কেউ।

জোবাইদা সমস্ত অন্তর দিয়ে বনহুরকে কামনা করে এলেও তাকে জানাতে পারেনি কোন দিন সে মনের কথা। সে সুযোগও আসেনি কোন দিন তার ভাগ্যে।

যখনই জোবাইদা বনহুরের সান্নিধ্য লাভের আশায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে, অন্তরের আকর্ষণ ছুটে গেছে সে, কিন্তু দেখেছে ওদের দুজনাকে বনহুর আর নূরী পাশপাশি বসে কথা বলছে বা হাসছে কিংবা দু’জন তাকিয়ে আছে দু’জনার দিকে। কতদিন দেখেছে জোবাইদা বনহুরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নূরী। হয়তো বা বনহুর ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এ দৃশ্য জোবাইদার মনে আগুন ধরিয়ে দিতো। সকলের অজ্ঞাতে অধর দংশন করতো সে, কিন্তু কি করবে নীরবে সয়ে যেতো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ত্যাগ করে।

বনহুর আর নুরীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আস্তানার সবাই স্বাভাবিক মনে করলেও জোবাইদা এটা মেনে নিলোনা, সে গোপনে গুমড়ে মরতো।

বনহুর যখন তাদের সর্দার পদে অধিষ্ঠিত হলো– সে আজ দশ বছর আগের কথা। বনহুরের বয়স তখন আঠার বছর, তরুণ যুবক সে। বয়স কচি হলেও তার সুন্দর দেহে বলিষ্ঠতার ছাপ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছিলো মুখমণ্ডলে পরিলক্ষিত হচ্ছিলো দৃঢ় সঙ্কল্পের ছাপ।

দস্যু কালু খাঁ তখন কার্যক্ষম না হলেও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। বয়স বৃদ্ধি হবার সঙ্গে সঙ্গে মনেও এসেছিলো ভাটা, হঠাৎ কখন কি হয় না হয় মানুষের জীবন পদ্মপত্রে নীরের মত। কাজেই কালু খাঁ বনহুরকে যে উদ্দেশ্যে গড়ে তুলছিলো নিজের মনোমত করে, সেই উদ্দেশ্য সফল। আশায় উন্মুখ হয়ে উঠলো। একদিন সমস্ত অনুচরদের ডেকে কালু খাঁ বনহুরকে তার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলো।

সেদিনের কথা আজও মনে আছে জোবাইদার।

সমস্ত আস্তানায় একটা আনন্দের উৎস বয়ে গিয়েছিলো– দস্যু কালু খাঁর অনুচরগণ সসম্মানে গ্রহণ করেছিলো তাদের তরুণ সর্দার দস্যু বনহুরকে।

সব জোবাইদার মনে গাঁথা হয়েছিলো থরে থরে সাজানো মুক্তার মালার মত একটি পর একটি করে।

বনহুর সর্দার হবার পর আস্তানার সবাই তাকে সর্দার বলে সম্মান করতো। শুধু সম্মানই নয়– ভয়ও করতো সবাই তাকে। দস্যু কালু খাঁ বনহুরকে সর্দারের উপযুক্ত হিসাবেই তৈরি করে নিয়েছিলো।

একদিন নয়–বনহুর দস্যু কালু খাঁকে তিনবার পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলো অস্ত্রযুদ্ধে।

কালু খাঁ সেদিন তরবারী নিক্ষেপ করে বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো, আনন্দ ভরা কণ্ঠে। বলেছিলো– সাবাস!

গর্বে স্ফীত হয়ে উঠেছিলো কালু খাঁর বুক। হৃদয়ের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছিলো তার দুটি চোখে।

একটু দূরেই অন্যান্যদের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলো জোবাইদা, নাসরিন আর নূরী। সকলেরই মুখভাবে খুশি উচ্ছ্বাসে ভরপুর।

বনহুর ছুটে এসে নূরীর হাত দুটি চেপে ধরে বলেছিলো–নূরী, আমি সাফল্য লাভ করেছি।

ঠিক সেই মুহূর্তে জোবাইদার মুখ কালো হয়ে উঠেছিলো। এতোগুলি প্রাণী তারা দাঁড়িয়ে, অথচ বনহুর তার আনন্দ বার্তা জানালো। দারুণ একটা অভিমান ভরে উঠেছিলো সেদিন তার মনে। আর দাঁড়াতে পারেনি সরে গিয়েছিলো জোবাইদা সেখান থেকে।

আজ জোবাইদার মনে সেই ক্ষোভ দানা বেঁধে বেঁধে জমাট হয়ে উঠেছে। ঈর্ষা পরিণত হয়েছে হিংসায়। মনোভাব প্রকাশ না করলেও সে কিছুতেই নিজকে সচ্ছ রাখতে পারছিলোনা। আজ থেকে দশটি বছর সে নীরবে সহ্য করে এসেছে, বনহুর আর নূরীর মধ্যে গভীর একটা যোগাযোগের তীব্র জ্বালা তার হৃদয়কে দগ্ধীভূত করে দিয়েছে। জোবাইদা এখন তার অন্তরের। ব্যথায় জুড়াতে চায়, বনহুর আর নূরীকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে তার যেন স্বস্তি হচ্ছে না।

তাই সে আস্তানায় গোপনে এ সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে। ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করে সবাইকে। এমন কি তাদের বৃদ্ধা দাইমাকেও এ বিষয় নিয়ে উত্তেজিত করে জোবাইদা।

সেদিন যখন জোবাইদা নূরীকে এই কথা নিয়ে বলেছিলো– নূরী, সর্দারকে বলো কলেমা পাঠ করে বিয়ে করতে, না হলে তোমাদের এ মেলামেশা শুধু পাপ নয় জঘন্য।

কিন্তু নূরী জানিয়েছিলো বনহুরের সঙ্গে তার এমন কোন অস্পৃশ্য সম্বন্ধ ঘটেনি যা তাদের জীবনকে কুলষিত করে তুলতে পারে।

সেদিন আরও বলেছিলো নূরী– বনহুর শুধু পবিত্রই নয়– নির্মল, নিষ্পাপ..

কথাটা জোবাইদার মনে মুহূর্তের জন্য একটা সান্ত্বনার খোরাক বয়ে এনেছিলো বটে কিন্তু স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। অবিশ্বাসের স্রোত ভেসে গিয়েছিলো নূরীর উক্তিগুলো। যার সঙ্গে এতো নিবিড় ঘনিষ্ঠতা, যার সঙ্গে এতো ঐকাত্ম কি করে বিশ্বাস করবে জোবাইদা তার কথা। বনহুর সৌম্য-সুন্দর বলিষ্ঠ পুরুষ আর নূরী সুন্দরী চঞ্চলা যুবতী। কিছুতেই জোবাইদা বিশ্বাস করতে পারে না, ওদের মধ্যে নেই কোন অবৈধ সম্বন্ধ।

জোবাইদা চায় নূরী থেকে সরে থাকবে বনহুর– যেমন রয়েছে তাদের সান্নিধ্য থেকে অনেকে দূরে। শত আরাধনা করেও কোন দিন তারা বনহুরের পদ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি। জোবাইদার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলো আজ বনহুর, আর বিস্মিত হয়েছিলো তার কণ্ঠস্বরে। বনহুরের কানে বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো জোবাইদার দৃঢ় কণ্ঠের উক্তিগুলি…. সর্দার, নূরীর স্পর্ধা দিন দিন চরমে উঠেছে। নূরীর অসংযত ব্যবহার আমাদের সকলের মনে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। আমরা তাকে ক্ষমা করবো না… আমরা তাকে ক্ষমা করবো না… আমরা তাকে ক্ষমা করবো না।…

বনহুর ধীর কণ্ঠে বললো– নূরীর অপরাধ?

জোবাইদা কোন জবাব দিতে পারলোনা, একবার চোখ তুলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর মেঝেতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো–জোবাইদা।

বলো নূরীর অপরাধ কি?

সর্দার, আমি দাইমাকে ডেকে আনছি সেই বলবে। না, তোমাকেই বলতে হবে।

আর একবার জোবাইদা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নিলো বনহুর আর নূরীকে।

ঠিক সেই সময় কক্ষে প্রবেশ করলো বৃদ্ধা দাইমা!

 বনহুর ফিরে তাকিয়ে তাকে একবার দেখে নিলো।

দাইমা বললো এবার– বনহুর, তুমি এখন আমাদের সর্দার দলপতি। বাবা, তোমাকে আস্তানার সবাই যেমন সম্মান করে তেমনি করে ভয়। সবাই চায় তাদের সর্দার হবে সবদিকে আদর্শ সত্যবান..

জোবাইদা যা বলতে চাচ্ছিলো, শুনতে চাই।

সে কথা আমি বলবো বাবা।

তবে ভূমিকা না করে বলো। আমি সর্দারের যোগ্য নই?

না, সে কথা না বনহুর।

ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকায় বনহুর দাইমার মুখের দিকে।

দাইমা বলে এবার–বনহুর, তোমার বয়স হয়েছে, নূরীও এখন বয়স্কা যুবতী। তোমার আর নূরীর সধ্যে মিলামিশা নিয়ে একটা–

থেমে পড়ে দাইমা, বনহুরকে সেও ভয় করতো ভীষণভাবে।

বনহুর অবশ্য কোন দিন দাইমাকে অশ্রদ্ধা করেনি বা কঠিন কথা বলেনি।

দাইমা কালু খাঁর এখানে দাসী হিসাবেই এসেছিলো। প্রচুর অর্থের লোভেই সে এসেছিলো, সেকথা অবশ্য মিথ্যা নয়।

কিন্তু বনহুর দাইমাকে কোন হীন বা তুচ্ছ নজরে দেখেনি। বনহুর নিজেও বৃদ্ধাকে দাইমা বলে ডাকতো, অন্য সবাই তাকে দাই-ই বলতো।

বনহুর দাইমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও দাইমা কোনদিন বড় একটা বনহুরের সামনে আসতো না। অবশ্য এটা দাইমার নিজস্ব মনোভাব। বনহুর এখন সর্দার, কাজেই দাইমাও তাকে সমীহ করে চলতো।

দাইমা থেমে পড়তেই বনহুর বললো– কানাঘুষা চলছে।

হ বাবা।

 সে জন্য কি নূরী অপরাধী?

 জোবাইদা আবার চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলো।

 দাইমা কি বলবে ভাবছে বোধ হয়।

বনহুর এবার গর্জন করে উঠলো– নুরীর সঙ্গে আমার মিলামিশা যদি দোষণীয় হয়ে থাকে সে জন্য নূরী দায়ী নয়, দায়ী আমি… কারণ নূরীকে আমিই প্রশ্রয় দিয়েছি, আমিই মিশেছি তার সঙ্গে অপরাধ যদি থাকে সেজন্য আমিই অপরাধী–নূরী নয়। বিচার যদি চাও আমাকে দণ্ড দেবে, আমি তোমাদের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করবো। কিন্তু এর পর যদি দ্বিতীয় বার নূরী সম্বন্ধে আমার আস্তানায় কেউ কোন কুৎসিৎ-ইংগিৎ করে, আমি তাকে আস্তানা থেকে বের করে দিতে বাধ্য হবে। …

বনহুরের কথায় জোবাইদা ফোঁস করে উঠলো বিষধর সর্পের মস্তকে আঘাত করলে যেমন সে ভীষণ হয়ে উঠে। জোবাইদা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে একবার নূরীর দিকে তাকালো, তারপর দ্রুত। প্রস্থান করলো সে ঐ স্থান হতে।

দাইমাও ধীরে ধীরে কক্ষ ত্যগ করে বেরিয়ে গেলো।

জোবাইদা আর দাইমা বেরিয়ে যেতেই, নূরী ছুটে এসে বনহুরের পায়ে পড়লো। তার অশ্রু দিয়ে সিক্ত হতে লাগলো বনহুরের পা দুটি।

বনহুর ওকে তুলে নিলো গভীর স্নেহে।

 নূরী বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে কেঁদে উঠলো উচ্ছ্বসিতভাবে।

বনহুর বললো– নূরী, কেঁদো না। নিজের হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে লাগলো বনহুর।

 নূরী শিশুকাল মাতৃহারা, পিতাকেও সে হারিয়েছে অতি ছোট বেলায়, এ দুনিয়ায় তার আপন বলতে কেউ নেই। দস্য কালু খাঁনকেই আপন জন মনে করে জানতো নূরী কিন্তু সেও যখন চলে গেলো তখন বনহুরকেই সাথী রূপে পাশে পেয়েছিলো নূরী। তারপর থেকে বনহুরই তার ধ্যান জ্ঞান-স্বপ্ন-সাধনা।

বনহুরের মধ্যে নিজকে বিলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। এ দুনিয়ায় তার কিছুই যেন কামনার নয়– একমাত্র বনহুর ছাড়া। তাই আজ নূরী বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে প্রাণ ভরে কেঁদে নিলো।

বনহুর আজ বাধা দিলো না নূরীকে।

কেঁদে কেঁদে এক সময় নূরী শান্ত হয়ে এলো।

বনহুর বললো- নূরী, তুমি কারো কথায় কান দিও না। আমি তোমার, চিরদিনই তোমার থাকবো–

হুর!

নূরী! আমার লক্ষ্মীটি।

*

পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহম্মদ নাসির শাহকে জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি কেনো চৌধুরী বাড়ির প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন, বলুন? জবাব দিন?

পুলিশ অফিসে এক গাদা পুলিশ অফিসার ও আরও অন্যান্যদের সম্মুখে মাথা নত করে একটা চেয়ারে বসে ছিলো নাসির শাহ। চোখেমুখে তার লজ্জা-ক্ষোভ প্রতিহিংসা ফুটে উঠেছে। মুখ কালো করে বসেছিলো সে ইন্সপেক্টারের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালো নাসির শাহ, গম্ভীর কণ্ঠে বললো– দস্যু বনহুরকে বন্দীর উদ্দেশ্যেই আমি চৌধুরী বাড়ি গিয়েছিলাম।

অবাক কণ্ঠে বললেন মিঃ জাফরী– দস্যু বনহুরকে বন্দীর উদ্দেশ্যে আপনি চৌধুরী বাড়ির প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন?

হাঁ, জানতাম সে ঐদিন শহরের যেখানেই থাক একবার চৌধুরী বাড়ি গমন করবেই।

হাসলেন মিঃ আহম্মদ– জানতেন না পুলিশ আপনার চেয়েও সতর্ক ও চৌধুরী বাড়ির। উপরে তাদের কড়া নজর আছে বা ছিলো?

জানতাম, তবু নিজে দস্যুকে গ্রেপ্তার করে…..

কৃতিত্ব লাভ করতে চেয়েছিলেন এই তো? মি জাফরী।

মিঃ আহম্মদ হেসে উঠলেন– সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী যাকে গ্রেপ্তারে হিমসিম খেয়ে যায় আর আপনি তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন অস্ত্রহীন রিক্ত হস্তে! আপনার দুঃসাহস তো কম নয়। এবার কঠিন কণ্ঠে বললেন তিনি–কেননা আপনি আজ রাতে চৌধুরী বাড়িতে গিয়েছিলেন সত্য করে বলুন?

এবার সোজা হয়ে বসলো নাসির শাহ; দৃঢ় কণ্ঠে বললো সে–ঐশ্বৰ্য্য বা অর্থের লোভী আমি নই, কারণ, এসব আমার প্রচুর আছে। তাহলেই বুঝতে পারছেন, চুরি বা ডাকাতি করতে আমি যাইনি।

তাহলে কি জন্য আপনি গিয়েছিলেন–কোন্ অভিসন্ধি নিয়ে বলুন?

বললাম, আমি দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার আশায় গিয়েছিলাম, এবং আমি রিভলভার সঙ্গে নিয়েছিলাম বটে, কিন্তু পুলিশ যখন আমাকে গ্রেপ্তার করে ফেললো তখন আমি ভয়ে রিভলভার দূরে নিক্ষেপ করেছিলাম।

 মিঃ জাফরী এবং মিঃ আহম্মদ আরও কিছুক্ষণ নাসির শাহকে জেরা করার পর মুক্ত করে দিলেন।

নাসির শাহ পুলিশ অফিস থেকে বেরিয়ে সহসা বাড়ি ফিরে যেতে পারলোনা, সে সোজা তার আড্ডায় গিয়ে হাজির হলো।

গত রাতের ব্যাপার নিয়ে চললো নাসির শাহ আর তার দলবলের মধ্যে গভীর আলোচনা। চৌধুরী-কন্যা মনিরাকে চুরি করতে গিয়েই তার জীবনে একটা কলঙ্কের রেখাপাত হলো। হাজত বাস নয়, একেবারে হাঙ্গেরী কারাগারে বন্দী হতে হলো তাকে।

ক্রুদ্ধ জন্তুর মত ফোঁস ফোঁস করেছিলো নাসির শাহ। দু’চোখে তার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছিলো। ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী করছিলো আর বলছিলো সে চৌধুরী-কন্যা মনিরাকে আমার চাই। যেমন করে হোক আমি তকে হরণ করে আনবোই আনবো। হোক সে অন্ধ, হোক সে দৃষ্টিহীন….. আমি যতক্ষণ না মনিরাকে পেয়েছি ততক্ষণ আমার স্বস্তি নেই, শান্তি নেই..

নাসির শাহের সাঙ্গ-পাঙ্গ অর্থলোভে সব সময় তার আসর সরগরম করে থাকতো, কাজেই কুবুদ্ধির জন্য তাকে আর ভাবতে হতোনা। গোটাদিন ধরে চললো শারাব পান আর নানারকম আলোচনা।

*

নাসির শাহ দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে গিয়ে বন্দী হয়েছে, কথাটা এক সময় বোন জুলেখার কানে এসে পৌঁছলো। ভাই এর জন্য সে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লো, এতোবড় দুঃসাহস কি করে হলো তার–যার সব সময় নিজ স্বার্থ ছাড়া কোনদিকে তাকাবার সময় নেই, সেই ভাই গিয়েছিলো রাতের অন্ধকারে দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে! সবাই বিশ্বাস করলেও জুলেখা কথাটা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারলোনা।

আজ নয়, আরও কতদিন নাসির শাহ এমনি মিথ্যা কথা বলে লোক-সমাজকে বঞ্চনা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। জুলেখা বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই কোন কুমতলব নিয়ে সে গিয়েছিলো চৌধুরী বাড়িতে।

অনেক রাত ধরে জেগে কাটালো জুলেখা ভাই-এর প্রতীক্ষায়। হাজার হলেও ভাইতো। মা অসুস্থ মানুষ– শাহ বাড়ির কোন অমঙ্গল হলে সেটা সবার আগে জুলেখাকেই আঘাত করবে বেশি করে। কারণ জুলেখা এখনও অবিবাহিত; এ সংসারই তার আপন এবং নিজের।

আজকাল জুলেখা যদিও নিজের রোগী-পত্তর আর লেটারী নিয়ে ব্যস্ত থাকে তবুও সংসারের খোঁজ-খবরও না রেখে তার চলে না।

নাসির শাহ আজ গৃহলক্ষ্মী ঘরে আনেনি। বিয়ে করলে তার জীবনটা নাকি এক ঘেয়েমিতে পূর্ণ হয়ে উঠবে। তখন দূর্বিসহ জীবনটা বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে নাকি এক দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই নাসির শাহ নিজের জীবনটাকে সীমাবদ্ধ করতে চায় না। মুক্ত বিহঙ্গের মত এখন যে দিকে খুশি বিচরণ করে ফিরছে, তখন সেটি উপায় থাকবে না– এটাই হলো তার বিয়ে না করার একমাত্র কারণ।

 জুলেখাও এ নিয়ে বড় একটা কিছু বলতোনা নাসির শাহকে জানতো, বলে শুধু বাক্যব্যয় ছাড়া কোন ফল হবেনা। নীরব থাকাই সমীচীন মনে করতো সে।

তবু আপন সহোদর তো, জুলেখার হৃদয়ে নাসির শাহর এই অমানুষিকতা চরম আঘাত হানলেও ভিতরে ভিতরে গুমড়ে কেঁদে উঠতো তার মন। বড় ভাইটিকে সংশোধন সংকল্পে আপ্রাণ চেষ্টা করতো জুলেখা অন্তরাল থেকে।

কিন্তু কথায় বলে, কুকুর লেজে রশি বেঁধে টানলেও কোন দিন সোজা হয় না। তাই জুলেখাও ভাইকে সৎ পথে আনবার বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সর্বদিকে।

আজ যখন জুলেখা জানতে পারলো, নাসির শাহ পুলিশ হস্তে বন্দী হয়েছে, তখন তার বুকে কে যেন একটা তীর-ফলা বিদ্ধ করলো সকলের অলক্ষ্যে। জুলেখা ব্যস্ত হলো না বটে কিন্তু উদ্বিগ্ন হলো। সারাটা দিন মনোকষ্ট আর দুর্ভাবনায় কাটিয়ে দিয়ে রাতেও জেগে রইলো ভাইয়ের আগমন প্রতীক্ষায়।

*

রাত বারোটায় ফিরে এলো নাসির শাহ মদের নেশায় চুর চুর হয়ে। টলতে টলতে কক্ষে প্রবেশ করতেই জুলেখা তার সম্মুখে দাঁড়ালো, রাগত কণ্ঠে বললো সে ভাইয়া, তুমি কি দিন দিন অমানুষ হয়ে পড়লে?

অমানুষ! কেনো?

ছিঃ তোমার সঙ্গে কথা বলাও পাপ। কি ছাই পাস খেয়েছো বলতো?

জুলেখা, তুই কি বুঝবি বোন! কথা বলতে বলতে ঢেকুর তুলছিলো নাসির শাহ।

জুলেখা আর দাঁড়াতে পারলোনা বা কোন প্রশ্ন তাকে করলোনা বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

শত চিন্তা করেও জুলেখা ভাইকে সৎপথে আনার কোন উপায় খুঁজে পেলোনা।

কিন্তু নাসিরের চিন্তায় বেশিক্ষণ ভাবার সময় ছিলোনা জুলেখার। তার সাধনা রোগীর সেবা করা। যত কঠিন রোগই হোক, জুলেখা চায় সেই রোগকে তার চিকিৎসায় আরোগ্য করে তোলা।

সারাটা দিন যে সব রোগীদের মধ্যে তাকে কাটাতে হয়, রাতে শয্যা গ্রহণের পরও তাদের নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে সে। শুধু সে ডাক্তারই নয়– মানুষের বিভিন্ন শারীরিক দিক নিয়েই সে বিদেশ থেকে শিক্ষা লাভ করে ফিরে এসেছে। তার কর্তব্য দেশের জনগণকে রোগমুক্ত করা। সে যে কোন রোগই হোক তাকে সারিয়ে তোলাই তার জীবনের ব্রত।

জুলেখা যখনই তার রোগীদের নিয়ে ভাবতে বসে তখনই প্রথমে ভেসে উঠে মনিরার কথা তার মন জুড়ে। যেমন করে হোক মনিরার দৃষ্টি শক্তি তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। জুলেখা শুধু ডাক্তারই নয়- আইজ স্পেশালিস্টও। মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলেই তার সাধনাই ব্যর্থ যাবে।

জুলেখা মনিরাকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। রাতের পর রাত চক্ষু চিকিৎসা সম্বন্ধে মোটা মোটা ডাক্তারী বইগুলো নিয়ে পাতা উল্টে চলে। যেমন করে হোক মনিরাকে স্বাভাবিক করতেই হবে। গোটা রাত কাটিয়ে দেয় জুলেখা অনিদ্রায়।

মনিরা শুধু বান্ধবীই নয়, জুলেখার জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী।

জুলেখা কেনো যেন সব চেয়ে বেশি ভালবাসতো মনিরাকে যদিও মনিরা জুলেখার শিশুকালের সঙ্গী নয়। স্কুল জীবনে ওদের দুজনার পরিচয় ঘটেছিলো, তারপর কলেজ জীবন।

মনিরা বিশ্বাস করতো যেমন জুলেখাকে, জুলেখাও তেমনি মনিরাকে নিজের জীবনের চেয়েও ভালবাসতো। মনিরার অমঙ্গল চিন্তা করতে পারতোনা কোনদিন জুলেখা। মনিরাও ছিলো ঠিক বান্ধবীর মতই, এক প্রাণ এক মন ছিলো ওদের দু’জনার।

এই ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। শহরবাসীদের মন থেকে দস্যু বনহুরের পলায়ন স্মৃতি সম্পূর্ণ অন্তর্হিত না হলেও একটা আতঙ্ক ভরা ভাব যা এ ক’দিন শহরের স্বাভাবিক গতিকে অস্বাভাবিক করে তুলেছিলো, আপাতত সেটা অনেকটা কমে এসেছিলো।

শহরের যান-বাহন চলাচল এবং পথচারীদের অবাধ গতি একেবারে সচ্ছ না হলেও কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে।

পুলিশ পথে, আনাচে-কানাচে নিয়মিত পাহারায় রত থাকলেও এ ক’দিনের মত সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে প্রতিটি নাগরিকদের লক্ষ্য করছেন না বা প্রত্যেকটি গাড়ি পরীক্ষা করে দেখছেনা।

কারণ কান্দাই এর মত মস্ত বড় একটা শহরকে সম্পূর্ণ পুলিশের আয়ত্বের মধ্যে রেখে অনুসন্ধান চালানো কয়েক দিন সম্ভব হলেও সকল সময়ের জন্য সম্ভব ছিলনা। শুধু পুলিশ বাহিনীই নয়, সবাই জানতে পেরেছিলো–দস্যু বনহুর এখন শহরে বসে নাই।

নাগরিকগণ স্বাভাবিকভাবে পথ চলাচল করলেও একেবারে নির্ভয় হতে পারছিলোনা। যত কাজই থাক, তারা রাত দশটার পর আর শহরের মধ্যে আনাগোনা করতে সাহসী হচ্ছিলোনা।

রাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কান্দাই শহরে জনমুখর রাজপথ জনশূন্য হয়ে আসে। যান বাহন চলাচল একেবারে বন্ধ না হলেও কমে আসে অনেক। বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ গাড়ি নিয়ে বের হতে চায় না।

দস্যু বনহুরের অন্তর্ধানের পর নগরবাসীর মনে যে একটা তীব্র আতঙ্ক ভাবের সৃষ্টি হয়েছিলো তা এখনও সমূলে নির্মূল হয়ে যায়নি।

কান্দাই শহর এখন বেশি রাত্রিতে একেবারে নিশ্চুপ নীরব হয়ে যায়। শুধু পুলিশদের হুইসেলের শব্দ আর দু’চারটি মোটরের হর্ণ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না।

সমস্ত শহর যখন সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে, পাশের কক্ষ থেকে ভেসে আসছে নাসির শাহর নেশায় ভরপুর নাসিকার গর্জন ধ্বনি। জুলেখা তখনও তার চক্ষু বিষয়ক ডাক্তারী বইগুলি নিয়ে। মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছিলো।

এক সময় জুলেখার আঁখি দুটি বন্ধ হয়ে আসে, নিদ্রা দেবী আসন গাড়ে তার চোখের পাতায়।

ঘুমিয়ে পড়ে জুলেখা।

চৌধুরী বাড়িতে রাত জাগা প্রহরীর মত মনিরা বসে আছে নিজ শয্যায়। আজ নয়, সেদিনের পর থেকে মনিরার চোখের নিদ্রা অন্তর্হিত হয়েছিল চিরতরে যেদিন মনিরা সংজ্ঞালাভের পর ক্ষণিকের জন্য শ্রবণ করেছিলো সেই দীপ্তগম্ভীর কণ্ঠস্বর।

মনিরা প্রতি মূহুর্তে কামনা করে আসছে স্বামীর। দেখতে সে পায়না এখন কিন্তু কানে শুনতে পায় তো। হঠাৎ যদি এসে ফিরে যায় কিংবা আবার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলে তখন চোখে না দেখলেও কানে শুনতে পাবে তো।

কক্ষ মধ্যে একটু শব্দ হলেই মনিরার চোখ দুটো উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠে। স্বর্গীয় এক প্রতিভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তার মুখমণ্ডল। ব্যাকুল কণ্ঠে কত দিন মনিরা প্রশ্ন করে বসেছে– কে, তুমি এসেছো? ওগো তুমি এসেছো?

কোন সাড়া নেই শব্দ নেই। বাতাস কখন নিঃশব্দে চলে গেছে জানালার শাশীতে মৃদু আঘাত করে। মনিরা বিফল হৃদয়ে আবার বালিশটা আঁকড়ে ধরে। বুঝতে পারে– যার জন্য ব্যাকুল সে, তার সেই প্রতীক্ষিত ব্যক্তির আগমন শব্দ এ নয়। মনিরার ব্যথিত হৃদয় মুষড়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গণ্ড বেয়ে।

হঠাৎ কাঁচের শাশটিা আবার যেন নড়ে উঠলো একটু।

এবার কিন্তু মনিরা চমকালো না, যেমন বসেছিলো তেমনি রইলো। মনে করলো সে দমকা হাওয়া আবার বুঝি নাড়া দিলো কাঁচের শার্শটিায়।

পরক্ষণেই মনিরার ভুল ভেঙে গেলো, এবার পূবালি হাওয়া নাড়া দেয়নি। কেউ যেন সন্তর্পণে প্রবেশ করলো জানালা দিয়ে কক্ষমধ্যে। মনিরার হৃদয়ে একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস আলোড়ন জাগালো। তবে কি সে এসেছে, যার প্রতীক্ষায় মনিরা জেগে আছে আজ ক’টি রাত। কিন্তু সে তো দেখতে পায়না, বিষ পানে তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। উঃ তবে কি আর কোন দিন ওকে দেখতে পাবেনা। না না, সে কি করে সহ্য করবে কি করে সহ্য করবে এই অসহ্য অন্ধকার।

মনিরার মুখে উচ্ছাসিত আনন্দের লোহরী ফুটে উঠেছে। কিন্তু মনিরা এখনও নিশ্চুপ বসে আছে খাটের উপর।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে মনিরাকে খাটে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়, কই তাকে দেখতে পেয়েও মনিরা অমন নিশ্চুপ বসে রইলো কেনো! বনহুরের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো, কয়েক পা এগিয়ে কঠিন কণ্ঠে ডাকলো–মনিরা।

মনিরা স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে অধীর আনন্দে অস্কুট ধ্বনি করে উঠলো– তুমি এসেছো! পর মুহূর্তে খাটের উপর থেকে নেমে ছুটে গেলো সে যেদিক থেকে ভেসে এসেছিলো বনহুরের গলার আওয়াজ।

কিন্তু সোফার সঙ্গে আঘাত পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে।

বনহুর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো, মনিরার আচরণে বিস্মিত হলো। একি! মনিরা তাকে দেখতে পাচ্ছেনা?

তাড়াতাড়ি মনিরাকে ধরে তুলে নিলো বনহুর।

মনিরা স্বামীর স্পর্শে আত্মহারা হয়ে পড়লো, দুই হাত দিয়ে বনহুরের বুকে-মুখে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে বললো তুমি এসেছে।

বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে বনহুর, কিছুক্ষণ তার মুখ দিয়ে কোন কথা উচ্চারণ হলোনা। মনিরার এই অদ্ভুত ব্যবহারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে। বনহুর বললো– মনিরা, তুমি এমন করছো কেননা! মনিরা..

ওগো, আমি যে তোমায় দেখতে পাচ্ছিনা।

 বনহুর প্রায় চিৎকার করে উঠলো– মনিরা।

 হাঁ, আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আমি অন্ধ হয়ে গেছি… স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠে মনিরা।

চিত্রার্পিতের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনহুর।

এই মুহূর্তে তার মস্তকে আকাশ ভেঙে পড়লেও বুঝি এতোখানি মর্মাহত হতোনা বনহুর।

মনিরা স্বামীর জামার আস্তিন চেপে ধরে ঝাঁকুনি দেয়– ওগো তুমি কথা বলছো না কেনো? ওগো তুমি কথা বলছো না কেনো?

বনহুরের জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। বৈচিত্রময় তার জীবনের প্রতিটি ধাপ– কিন্তু একি পরিণতি এলো তার জীবনে।

সহসা বনহুরের কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হলোনা। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো– মনিরা, কেমন করে তোমার এ অবস্থা হলো?

মনিরা কোন কথা বললো না।

বনহুর মনিরাকে নিয়ে খাটে এসে বসলো, মনিরার মুখখানা তুলে ধরে বললো– মনিরা, কেমন করে তোমার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হলো?

মনিরা তবু নীরব।

বনহুর ব্যাকুল কণ্ঠে বললো.. বলবেনা তুমি?

মনিরা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো তোমার মৃত্যু সংবাদ আমার কানে পৌঁছবার পূর্বে। আমি মরতে চেয়েছিলাম…

মনিরা!

আমি– আমি বিষ পান করেছিলাম।

বিষ!

হাঁ, ডাক্তার বোস নানা চেষ্টায় আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি…

বনহুর তার বলিষ্ঠ হাতের মধ্যে মনিরার হাত দুটি দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে– এ তুমি কি করেছো মনিরা? এ তুমি কি করেছো?

ওগো, আর কোনদিন আমি তোমাকে দেখতে পাবোনা? আমার কোন আর দুঃখ নেই ব্যাথা নেই শুধু তোমাকে দেখতে পাবোনা, এই দুঃখ আমার অন্তরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। তোমার ঐ সৌম্য-সুন্দর দীপ্ত চোখদুটো আর আমি দেখতে পাবোনা!

বনহুর গভীর আবেগে মনিরাকে বুকে আঁকড়ে ধরে মনিরা।

মনিরা স্বামীর মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করে তাকে।

 হঠাৎ মনিরার হাত দু’খানা বনহুরের গণ্ডে পড়তেই বুঝতে পারে সে, বনহুর কাঁদছে।

মনিরা বলে উঠে– তুমি কাঁদছো।

বনহুরের চোখের পানি ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পরে মনিরার মাথায়। কেঁদোনা লক্ষ্মীটি। তোমার মনিরার আর কোন দুঃখ নেই। ব্যথা নেই, নেই কোন অনুতাপ। জানো– আজ আমি কত সুখী– তুমি আছো– এটাই আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য। আমি নিজে নিঃশেষ হয়ে যাবো, তবু তুমি বেঁচে থাকো….

মনিরা, তুমি এভাবে নিজকে ধ্বংস করবে, কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস বনহুরের বুক চিরে বেরিয়ে এলো।

বনহুর বললো আবার তোমাকে এভাবে দেখবার পূর্বে আমার মৃত্যু হলেও মঙ্গল ছিলো।

মনিরা তাড়াতাড়ি বনহুরের মুখে হাত-চাপা দিলো–না না, ও কথা বলো না। ও কথা বলোনা তুমি।

মনিরা, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলে। কেননা, কেনো তুমি বিষ পান করেছিলে মনিরা, কেনো তুমি বিষ পান করেছিলে…

মনিরাকে বাহুর মধ্যে টেনে নিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বললো বনহুর।

বনহুর বললো এবার মনিরা, কিছুদিন পূর্বে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম সম্প্রতি লণ্ডন থেকে একজন মহিলা ডক্টর এসেছেন। তিনি শুধু ডাক্তারই নন একজন আইজুস্পেশালিস্টও।

হাঁ, সে আমার একজন অন্তরঙ্গ বান্ধবী, নাম ওর জুলেখা।

 সে তোমাকে দেখেছে?

দেখেছে। আমাকে নিয়ে সে গম্ভীরভাবে চিন্তা করেছে।

সত্যি?

 আমার অন্ধত্ব বান্ধবীদের মধ্যে তাকেই বেশি আঘাত করেছে।

তাহলে…তাহলে মনিরা তোমার বান্ধবীকে আমি নিজে অনুরোধ জানাবো। বনহুরের কণ্ঠে আকুলতা ঝরে পড়ে।

কিন্তু কি করে তা সম্ভব হবে? আমার বান্ধবীকে তুমি পাবে কি করে?

মনিরা ভয় পেওনা, দস্যু বনহুরের আসল রূপ, একমাত্র মিঃ জাফরী ও মিঃ আহম্মদ ছাড়া। কেউ চিনতে পারবেনা, আজ আমি ফিরে যাবোনা মনিরা।

সত্যি বলছো?

 হাঁ, মনিরা।

কিন্তু।

বলো?

এ বাড়ির একমাত্র সরকার সাহেব ছাড়া তোমাকে কেউ দেখেনি কোনদিন। বাড়ির চাকর বাকর অন্যান্য সবাই আশ্চর্য্য হবে যে?

বলো আমার একজন বন্ধু বা আত্মীয়।

তাহলে চলো মামীমার কাছে যাই?

 হুঁ এখন নয় — আরও পরে বনহুর মনিরাকে ঘনিষ্ঠভাবে টেনে নেয় কাছে।

মনিরা নিজেকে উজাড় করে দেয় বনহুরের মধ্যে।

সমস্ত কান্দাই শহর তখন ঝিমিয়ে পড়েছে। যান-বাহন চলাচলের শব্দও থেমে গেছে। পথচারীদের পদশব্দ আর শোনা যাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে শুধু ভেসে আসছে পুলিশের বাঁশির সতর্ক ধ্বনি। আর আকাশে জেগে আছে তারার প্রদীপ।

*

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো মনিরার।

জেগেই অনুভব করলো মনিরা– তার দেহটা কোন শিথিল বাহুবন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে। মনিরার অন্তরে একটা আনন্দের উৎস বয়ে গেলো। শিরায় শিরায় বয়ে গেলো তার এক জ্যোতির্ময় লহরী। মনিরা ঘুমন্ত স্বামীর হাত দু’খানা সরিয়ে দিতে পারলোনা। কত সাধনা, কত কামনার যেন। ঐ বাহু দুটি। মনিরা ভাবছে- সে তো স্বপ্ন দেখছেনা, সত্যি আজ সে স্বামীর বাহুর মধ্যে শায়িতা…. মনিরা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।

ধীরে ধীরে মনিরা স্বামীর বুকে-গলায় মুখে হাত বুলিয়ে অনুভব করছে– বাস্তব না কল্পনা।

বনহুরের ঘুম ভেঙে গেলো, মনিরাকে আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে বললো– মনিরা, কি করছো?

তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা, তাই অনুভব করছি– সত্যি তুমি আমার পাশে আছে কি না?

 মনিরা।

বলো?

আমি শপথ করছি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নিজের জীবন ত্যাগ করতেও কুণ্ঠা বোধ করবোনা। আমার জীবনের বিনিময়েও আমি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে চাই মনিরা।

ছিঃ শপথ করতে নেই অমন করে।

বনহুর নীরব রইলো।

মনিরা বললো আবার– জুলেখা চোখ সম্বন্ধে ভালভাবে শিক্ষা লাভ করে এসেছে, আমার মনে হয় সে আমাকে আরোগ্য করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

আজ আমি তোমাকে নিয়ে যাবো তোমার বান্ধবীর ওখানে। যাও মনিরা, মাকে বলো সব কথা। ওঃ তুমি যাবে কি করে?

হাসলো মনিরা– অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি মুখ-হাত ধুয়ে এসো আমি মামীমাকে ডেকে আনছি।

মনিরা দেয়াল হাতড়ে এগুতে লাগলো।

বনহুর হাত ধরে এগিয়ে দিলো তাকে দরজা অবধি।

মরিয়ম বেগম নামাজ শেষে ছালাম ফিরছিলেন, মনিরাকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তাড়াতাড়ি মোনাজাত শেষ করে উঠে গিয়ে ধরলেন মনিরাকে– মনিরা কি হয়েছে?

মামীমা, ও এসেছে।

সে, আমার মনির?

 হাঁ, মামীমা। চলো তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছে সে।

মরিয়ম বেগমের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো, মনিরাকে আঁকড়ে ধরে বললেন চল, মনিরা–চল, নইলে আবার পালিয়ে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে মরিয়ম বেগমের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর। হেসে বললো না, আর পালিয়ে যাবোনা মা।

সত্যি, সত্যি বলছিস?

 হাঁ, মনিরার চক্ষু চিকিৎসার জন্য আমাকে থাকতে হবে এখানে।

বাবা মনির! আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেন মরিয়ম বেগম। সন্তানকে সব সময়ের জন্য পাশে পাবেন– এ যেন তার পরম সৌভাগ্য।

বনহুরকে পেয়ে মরিয়ম বেগম যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কিন্তু তাকে সব সময় সংযত হয়ে থাকতে হলো। বাড়ির সকলের নিকটে বলা হলো–মনির তার আত্মীয়ের ছেলে। দূর দেশে চাকরী করে–ছুটিতে কয়েক দিন থাকবে বলে এসেছে এখানে।

বাড়ির চাকর-বাকর এবং অন্যান্য সবাই কেউ বনহুরকে দেখে নাই কোনদিন, সকলেই বিশ্বাস করলো কথাটা।

একমাত্র সরকার সাহেব ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে কেউ জানলো না কে এই যুবক- কি এর পরিচয়।

দিনের আলোতে এমন করে বনহুর কোন দিন এ বাড়িতে আসেনি বা থাকেনি। মরিয়ম বেগম বা মনিরা দিনের আলোতে কোন দিন দেখেনি তাকে।

পুত্রকে মরিয়ম বেগম প্রাণভরে দেখতে লাগলেন। শতবার দেখলেও যেন তৃপ্তি হচ্ছেনা।

 বনহুর হেসে বললো– মা অমন করে কি দেখছো?

তোকে প্রাণভরে তোকে দেখছি বাছা।

মা। বনহুর মায়ের বুকে ছোট শিশুর মতই আশ্রয় নেয়।

মনিরা দাঁড়িয়েছিলো পাশে, মাতা-পুত্রের কথাগুলো তার হৃদয়ে মধু বর্ষণ করছিলো। যদিও দেখতে পাচ্ছিলোনা কিছু কিন্তু অন্তরে উপলব্ধি করছিলো সব।

মাতা-পুত্রের মিলন দৃশ্য মনিরার দৃষ্টিতে ধরা না পড়লেও সমস্ত মনের পর্দায় পরিস্ফুটিত হচ্ছিলো। মনিরার মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

বনহুর আজ স্বাভাবিক নাগরিকের বেশে সজ্জিত। মূল্যবান কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত অবস্থায় রয়েছে।

সকাল বেলার চা-নাস্তা খাবার পর বনহুর মাকে জানালো- মা, আমি মনিরাকে তার বান্ধবী ডক্টর জুলেখার ওখানে নিয়ে যেতে চাই?

আতঙ্কগ্রস্ত মনে বললেন মরিয়ম বেগম–কিন্তু হঠাৎ যদি কেউ তোকে চিনে ফেলে বাবা?

হাসলো বনহুর– ভয় পেওনা মা। এ শহরে আমাকে কয়েকজন বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার ছাড়া কেউ চেনেনা।

মরিয়ম বেগম পুত্রের কথায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত না হলেও আর অমত করলেন না। তিনি বললেন– যাও বাবা। যাও– সাবধানে যেও।

বনহুর মনিরাকে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো।

ড্রাইভ করে চললো বনহুর নিজেই।

মনিরা ড্রাইভিং আসনে পাশে বসে রয়েছে, আজ তার মনে অফুরন্ত আনন্দ। স্বামীর পাশে সে বসে রয়েছে–এযে তার কত কামনার কত সাধনার, কত প্রতীক্ষার।

মনিরা অন্ধ হলেও জুলেখার বাড়ির ঠিকানা তার জানা রয়েছে। বনহুর মনিরার কাছে জুলেখার বাড়ির পথের নির্দেশ নিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে।

জুলেখা সবেমাত্র মনিরার ওখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এই মুহূর্তে মনিরাও তার সঙ্গে একটি যুবককে দেখে বিস্মিত হলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে এগিয়ে এলো জুলেখা– হ্যালো মনিরা, তুমি এসে গেছো?

জুলেখা মানিরাকে জড়িয়ে ধরলো, কিন্তু বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই একটু সংকুচিতভাবে সরে দাঁড়ালো।

মনিরা বললো-জুলেখা, তোর কাছে এলাম। হাঁ, আগে তোর সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দি।

বনহুর মনিরার পিঠে হাত রেখে কিছু ইংগিত করলো।

মনিরা হেসে বললো–আমার দূর সম্পর্কে ভাই হন। সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে, আমাদের ওখানে থাকবে কয়েক দিন। আর এ হচ্ছে আমার প্রিয় বান্ধবী জুলেখা– ডক্টর এবং আইজস্পেশালিস্ট।

বনহুর ও জুলেখা ছালাম বিনিময় করলো।

নিজের অলক্ষ্যে জুলেখার দৃষ্টি বার বার চলে যাচ্ছিলো বনহুরের মুখের দিকে। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি নাড়া দিচ্ছিলো তার। বললো জুলেখা–উর নাম তো বললিনা মনিরা?

ওঃ ভুল হয়ে গেছে, প্রথম নাম বলাই উচিৎ ছিলো…

মনিরা বলার পূর্বেই বললে বনহুর আমার নাম মঞ্জুর চৌধুরী। মঞ্জুর বলেই ডাকবেন, চলুন ভিতরে গিয়ে বসি।

সরি, এতোক্ষণ আপনাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি। চলুন।

জুলেখা মনিরার হাত ধরে নিয়ে চললো। বনহুর এগুলো পিছনে পিছনে।

হলঘরে এসে বললো জুলেখা বসুন আপনি। মনিরা, বস্ ভাই। আমি কিন্তু তোর ওখানেই যাচ্ছিলাম।

জুলেখা আর মনিরার মধ্যে উভয়ে উভয়কে কখনও তুমি’ কখনও তুই’ বলে সম্বোধন করতো।

জুলেখার কথায় বললো মনিরা– তাহলে ভালই হতো।

না, তোমরা এসেছো খুব ভাল হয়েছে। আচ্ছা তোমরা একটু বসো আমি তোমাদের জন্য চা আনতে বলি।

জুলেখা চলে গেলো।

বনহুর মনিরার হাতের উপরে হাত রেখে চাপা কণ্ঠে বললো- সতর্কভাবে কথা বলবে মনিরা তোমার বান্ধবী যেন বুঝতে না পারে তোমার আমার গোপন সম্বন্ধ।

আচ্ছা, তুমি যেভাবে বলবে, আমি তাই করবো।

ফিরে এলো জুলেখা, পিছনে বয়ের হাতে চায়ের সরঞ্জাম।

বনহুর আর মনিরার সম্মুখে চায়ের ট্রে নামিয়ে রেখে সরে দাঁড়ালো বয়।

জুলেখা পাশের একটা সোফায় বসে চা তৈরি করে বনহুর ও মনিরাকে সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো।

প্রথম মনিরার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে, পরের কাপটা এগিয়ে ধরলো বনহুরের দিকে নিন।

বনহুর জুলেখার হাত থেকে কাপটা নিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললো–ধন্যবাদ।

চা পান করতে করতে আলাপ শুরু হলো বনহুর, জুলেখা আর মনিরার মধ্যে।

 মনিরার চক্ষু চিকিৎসা নিয়েই আলোচনা চললো।

জুলেখা বললো– আমি যেমন করে হোক আমার বান্ধবীর দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করবো।

বনহুর আগ্রহ ভরা কণ্ঠে বললো– মিস্ জুলেখা, আপনার কি মনে হয় মনিরার দৃষ্টিশক্তি পুনঃ ফিরে আসবে?

আমার মনে হয় আসবে।

বনহুরের চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

জুলেখা শান্তভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো আমি আজ কদিন থেকে মনিরাকে নিয়ে ভাবছি। একটা উপায় খুঁজে পেয়েছি। মনে হয় ওর দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হবো। কিন্তু…মনিরাকে আমার এখানে থাকতে হবে।

মনিরা বললো এবার তোর এখানে?

হাঁ, কারণ তোর চোখের নার্ভ শিথিল হয়ে গেছে! আমাকে নানাভাবে চেষ্টা নিতে হবে– প্রতি এক ঘন্টা পর পর তোর চোখে ঔষধ লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কাজেই তোকে ছেড়ে দিলে চলবেনা। আমি এ জন্যই একটু আগে তোদের ওখানে যাচ্ছিলাম।

কিন্তু…. কিছু বলতে গিয়ে থেমে পড়লো মনিরা।

জুলেখা বলে উঠলো–কোন কিন্তু নয় মনিরা, যতই হোক আমি তোকে ছেড়ে দেবোনা।

মনিরার আজ দেখবার ক্ষমতা নাই, তাহলে স্বামীর মুখভাব লক্ষ্য করে দেখতো। বললো আবার মনিরা–মামীমার কাছে কথাটা পেড়ে দেখবো তিনি কি বলেন।

মনিরার কথা শেষ না হতে বললো বনহুর উনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে অমত করবেন না মনিরা, কারণ এখন তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আনার জন্য সব কিছুতেই রাজি হবেন।

মনিরা বনহুরের কথায় বুঝতে পারলো এ ব্যাপারে অমত নেই তার। জুলেখা বলে উঠলো– ঠিক বলছেন মঞ্জুর সাহেব, মনিরার চোখে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি আমার এখানে থাকতে অমত করতে পারেন না।

কথার ফাঁকে চা পান শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো।

জুলেখা বললো– মামীমাকে আমি গিয়ে সব বলে আসবো।

বনহুর এক মুখ ধোয়া ছুঁড়ে সোফায় ঠেস দিয়ে বসে বললো তাহলে আমার ছুটি কেমন?

মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার পূর্বেই বলে উঠলো জুলেখা– আমার বাড়িতে জায়গার কোন সংকীর্ণতা নেই দেখছেন তো। এতো বড় বাড়িটায় মাত্র আমরা তিনটি প্রাণী। আমার আম্মা, আমার বড় ভাই, আর আমি। আম্মা উপরেই থাকেন– নীচে নামেন না। বড় ভাই সব সময় তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অনেক রাতে ফেরেন। তিনিও উপরে থাকেন। আমিও উপরে শুই। আর এই যে নীচের কামরাগুলো সব ফাঁকা পড়ে থাকে, থাকবার লোক নেই। হলঘরের ওদিকেরটা আমার লেব্রটরী, পাশেরটা চ্যাম্বার। আসুন না আমার সঙ্গে দেখবেন– আয় মনিরা। জুলেখা উঠে দাঁড়িয়ে মনিরার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো।

মনিরা বললো– আমি তো আগেই দেখেছিলাম আর এখন কি দেখতে পাবো?

 তবুও চল। মনিরার হাত ধরে জুলেখা অগ্রসর হলো।

বনহুর অনুসরণ করলো জুলেখাকে।

বাড়িটা সেকেলের তৈরি হলেও আধুনিক ছাঁচে তৈরি। বনহুর এ বাড়িতে আসেনি কোনদিন, ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো। নিচের কক্ষগুলিতে কেউ বাস না করলেও প্রত্যেকটা কক্ষ মূল্যবান আসবাবে সজ্জিত।

জুলেখা নিজ লেব্রটরী আর চ্যাম্বারও দেখালো। চ্যাম্বারের পাশের কামরায় প্রবেশ করে বললো জুলেখা- মনিরা, তুমি এ কক্ষেই থাকবে, একা নয়– আমিও থাকবো তোমার পাশের বেডে।

বনহুর হেসে বললো– তাহলে তো কোন অসুবিধা নেই। আপনি যখন ওর সমস্ত দায়ীত্বভার গ্রহণ করছেন।

কিন্তু আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তবে আমাকে মনিরার ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করতে পারেন। কারণ আমি যখন আমার অন্যান্য পেসেন্টদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবো। তখন মনিরার পাশে থাকবার কেউ থাকবেনা। আসুন মঞ্জুর সাহেব, আপনার কক্ষ দেখিয়ে দি।

বনহুরকে অগত্যা জুলেখার কথায় রাজি হতে হলো।

মনিরার পাশের কক্ষেই বনহুরের থাকার জন্য সাব্যস্ত হলো।

জুলেখা সমস্ত কথা পাকাপাকি করে নিয়ে মনিরা ও বনহুরসহ চৌধুরী বাড়িতে গেলো এবং মরিয়ম বেগমকে সব কথা বুঝিয়ে বললো সে।

মরিয়ম বেগম আপত্তি করতে পারলেননা।

জুলেখা মনিরার মঙ্গলের জন্যই চিন্তা করছে, কাজেই এতে তার আপত্তি কি আছে বরং তিনি খুশিই হলেন।

মনিরা আর জুলেখা পাশের কক্ষে শুয়ে আছে পাশাপাশি বেডে। রাত বেশি না হলেও বাড়িটা নিশুতি হয়ে পড়েছিলো। জুলেখার আম্মা বাতের ব্যথায় ভোগা মানুষ, তিনি সন্ধ্যার পর চারটি খেয়ে নিয়ে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। বিশ্বাসী ঝি আর চাকরগুলো বাড়িটা চালিয়ে নেয় কোন রকমে। তাছাড়া উপাই বা কি আছে। ব্যাপারটা নতুন নয়, কাজেই গা সওয়া হয়ে গেছে সকলের।

নাসির শাহ বাড়ি ফেরে গভীর রাতে; কোন দিন রাত দুটো তিনটা বেজে যায়। টেবিলে তার খাবার ঢাকা থাকে, নাসির শাহ এলে তাদের পুরোন চাকর হবু এসে খাবার আগলা করে দেয়, দাঁড়িয়ে থাকে পাশে।

হবু এ বাড়িতে এসেছে আজ প্রায় বিশ বছর হলো। যুবক এসেছিলো–বুড়ো হয়েছে। নাসির শাহই নয়–এ বাড়িতে সবাই তার হাতে মানুষ হয়েছে। নাসির শাহর জন্য শুধু একদিন নয়, দুদিন নয়–যখন থেকে নাসির শাহ যুবক হয়েছে, তখন থেকে হবুকে এমনি রাতের পর রাত জেগে কাটাতে হয়েছে। একদিন যদি হবুর ঘুম ভাংতে বিলম্ব হয় বা কোনরকম অসুবিধায় আসতে না পারে তাহলে নাসির শাহ থালা বাসন ভেঙে একাকার করে ফেলে। আর যদি কোন দিন মাতাল অবস্থা বাড়ী ফেরে সেদিন খাবার টেবিলে না বসে সোজা বিছানায় গিয়ে ঢলে পড়ে। জুতো খুলবার সময় হয়না।

হবু ওর জুতো খুলে দেয়। মাথাটা তুলে বালিসে রাখে, চাদরটা টেনে দেয় গায়ে।

কাজেই নাসির শাহর আগমন কোন দিন সন্ধ্যা-রাতে হয়না।

বাড়ির চাকর-বাকর সবাই খেয়ে-দেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। হবু অবশ্য জেগে আছে,. তবু বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো নাসিরের প্রতীক্ষায়।

জুলেখা আর মনিরা পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে গল্প করছিলো। পাশের কক্ষে বনহুর একটা সোফায় বসে বই পড়ছে। দক্ষিণ হস্তে বইখানা ধরা রয়েছে তার চোখের সম্মুখে। বাম হস্তের আংগুলের ফাঁকে জলন্ত সিগারেট। বনহুরের দৃষ্টি বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। অত্যন্ত গভীর মনোযোগের সঙ্গে বইখানা পড়ছিলো সে। কোন অনুবাদ কাহিনী হবে।

হঠাৎ হাসির শব্দে বনহুরের মনোযোগ সহকারে বই পড়ার ব্যাঘাত ঘটলো। দৃষ্টি বইএর পাতায় সীমাবদ্ধ থাকলেও কান সজাগ হলো এবার!

পাশের কক্ষ থেকে ভেসে আসছে, জুলেখা আর মনিরার হাসির শব্দ, খিল খিল করে হাসছে ওরা দুজনা। হাসি থেমে গেলো, শুনতে পেলো বনহুর এবার জুলেখার কণ্ঠ–সত্যি করে বলছিস ওর সঙ্গে তোর কোন…

মনিরার কণ্ঠ–বললাম তো ওর সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া আমার কি অতো বড় ভাগ্য হবে?

জুলেখার গলার আওয়াজ শোনা গেল এবার–উনি কিন্তু তোকে বড্ড ভালবাসেন।

 মনিরা বললো–ভালবাসা নয় জুলেখা–অনুগ্রহ করেন।

 কিন্তু আমার যেন মনে হয়, তোর দিকে মঞ্জুর সাহেবের গভীর একটা আকর্ষণ আছে।

কেমন করে তোর মনে হলো?

না হলে সে সব ছেড়ে তোর জন্য এখানে রয়ে গেলো। সত্যি মনিরা, উনাকে আমার বড় ভাল লাগে।

সত্যি নাকি?

 সত্যি।

বলবো নাকি কিছু?

 খবরদার, তাহলে তোর চুল ছিঁড়ে দেবো কিন্তু…

মনিরার কণ্ঠ––উঃ ছেড়ে দাও সত্যি বলবোনা। আঃ বড় জোরে ধরেছিস কিন্তু আমার চুলগুলো।

আচ্ছা ছেড়ে দিলাম কিন্তু ওকে যেন কোন কথা বলিসনে।

না না, আমি কি অবুঝ খুকী।

 জুলেখা, আপন মনে বললো এবার–অদ্ভুত মানুষ!

কে?

মঞ্জুর সাহেব।

কি করে বুঝলি সে অদ্ভুত?

তার চাল-চলনে। আজ কদিন তুই আমার এখানে এসেছিল। উনিও এসেছেন–এতো সুন্দর মধুর স্বভাব আমি কোন পুরুষের মধ্যে দেখতে পাইনি।

বনহুর পাশের কক্ষে সোফায় বসে সব শুনছিলো, বই রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।

কিছুক্ষণ পায়চারী করলো সে নিজের কক্ষে, তারপর শয্যায় এসে বসলো।

আজ কদিন থেকে মনিরার চক্ষু চিকিৎসা চলেছে। এক ঘন্টা পর পর মনিরার চোখে ঔষধ। লাগাতে হয়। মাঝে মাঝে ইনজেকশানও দেয় জুলেখা মনিরার বাহুতে।

পাশের চ্যাম্বারে অন্যান্য পেসেন্টদের ভীড়েও জুলেখা ভুলে যায়না তার কর্তব্য। জুলেখা নিয়মিতভাবে মনিরার চিকিৎসা করে চলে।

.

সেদিন মনিরাকে তার চ্যাম্বারে বসিয়ে চোখ পরীক্ষা করে দেখছিলো জুলেখা। আগের চেয়ে এখন অনেকটা সতেজ মনে হচ্ছে মনিরার চক্ষুসংশ্লিষ্ট নার্ভগুলি।

জুলেখা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো, ভুলে গেলো সে এটা তার চ্যাম্বার। শুধু মনিরাই নয় এখানে আরও অনেক রোগী রয়েছে, জুলেখা জড়িয়ে ধরলো মনিরাকে–মনিরা আমার সাধনা সার্থক হবে। মনিরা আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে…

ঠিক সেই মুহূর্তে চ্যাম্বারে প্রবেশ করে বনহুর। মনিরাকে জুলেখা বাহুর মধ্যে তখনও আকড়ে ধরে রেখেছে, চোখে-মুখে খুশির উৎস ফুটে উঠেছে তার।

বনহুর থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো জুলেখা আর মনিরার দিকে।

জুলেখা উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো–মঞ্জুর সাহেব, আমি মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব বলে আশা করছি।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর।

মনিরার চোখে আজ একটা ছোট্ট অপারেশন হবে। অপারেশন টেবিলে মনিরা শায়িত। জুলেখা নিজে অপারেশন করবে। তাকে সহায়তা করছে তার মহিলা সহকারিণী। পাশে দাঁড়িয়ে। মঞ্জুর চৌধুরী বেশে দস্যু বনহুর।

জুলেখা অত্যন্ত যত্ন সহকারে কাজ করছিলো।

বনহুরও জুলেখাকে সাধ্যমত সাহায্য করছিলো, জুলেখার পাশে থেকে।

অপারেশন শেষ হয়ে যায়, চ্যাম্বারে নতুন একটা পেসেন্টকে ঔষধ দেবার জন্য বেরিয়ে যায় জুলেখার সহকারিণী।

মনিরার চোখে তখন ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলো জুলেখা। বনহুর তাকে সাহায্য করতে লাগলো।

ব্যান্ডেজ শেষ করে যখন পিন-আপ করছিলো জুলেখা, বনহুরের হাতখানা তার হাত স্পর্শ করে। জুলেখার সমস্ত শরীরে একটা অনুভূতি নাড়া দিয়ে যায়। শিরায় শিরায় জাগে একটা শিহরণ।

জুলেখা মনিরার চোখের ব্যান্ডেজ পিন-আপ শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

বনহুর তখন মনিরার কপাল থেকে চুলগুলি সরিয়ে দিচ্ছিলো। ফিরে তাকাতেই বনহুরের দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো জুলেখার!

জুলেখার চোখে-মুখে একটা আবেগভরা ভাব ফুটে উঠেছে। বনহুর চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না।

মনিরা অস্ফুট কণ্ঠে বললো–বড্ড পিপাসা।

জুলেখার সম্বিৎ ফিরে আসে তাড়াতাড়ি পাশের টেবিল থেকে পানির গেলাসটা তুলে নিয়ে মনিরার মুখে ঢেলে দেয়।

মনিরা জুলেখার দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে–জুলেখা।

জুলেখা চট করে জবাব দিতে পারছিলো না, একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বললো–কোন কষ্ট হচ্ছে?

না, কিন্তু কেমন ভয় হচ্ছে আমার।

জুলেখার দৃষ্টি নিজের অজ্ঞাতে আর একবার চলে গেলো বনহুরের মুখে।

বনহুর তখনও তাকিয়ে আছে জুলেখার দিকে।

আবার উভয়ের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো।

মনিরা বললো–আমাকে নিজের ঘরে নিয়ে চলো।

জুলেখা বললো–চলো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

অপারেশনের পর মনিরার চোখ দুটো তুলো আর ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একেই সে দুনিয়ার কিছু দেখতে পায় না, তারপর আরও যেন সব গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সব কেমন জমাট অন্ধকারে ভরা, পৃথিবীর কোথাও যেন এতোটুকু আলো নেই।

নিজের বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলো মনিরা, স্বামীকে পাশে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো সে। মাথায়-চুলে হাতখানা বুলিয়ে একটু সান্ত্বনা ভরা কথা বলবে। কিন্তু এতো কাছে থেকেও কত দূরে,–অসহ্য লাগছিলো মনিরার।

বনহুরও পাশের কামরায় মনিরার সান্নিধ্য লাভের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলো, কিছুতেই নিজকে স্থির রাখতে পারছিলো না। মনিরার জন্য নানা রকম দুঃশ্চিন্তার ঝড় বইছিলো তার মনের মধ্যে। সত্যি কি মনিরা আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। সত্যি কি মনিরা আবার তাকে দেখতে পাবে। দেখতে পাবে সমস্ত পৃথিবীটাকে।

বনহুর নিজের কক্ষে পায়চারী করছিলো। রাত তখন অনেক হয়ে গেছে।

 ঘুমিয়ে পড়েছে মনিরা।

কিন্তু এখনও পাশের বিছানায় জেগে আছে জুলেখা। অনেক চেষ্টা করেও চোখের পাতা দুটো বন্ধ করতে পারছে না। মনের মধ্যে একটা আলোড়ন তাকে করে তুলেছে উন্মত্ত। কয়েক দিন পূর্বেও মনিরার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার চিন্তা তাকে অহরহঃ অস্থির করে তুলেছিলো। তার সাধনা, তার প্রচেষ্টা সফল করে তোলার জন্য হয়ে উঠেছিলো উন্মাদ। রাতের পর রাত চক্ষু চিকিৎসা সম্বন্ধে বইগুলি খুলে গভীর মনোযোগ সহকারে ঘাটাঘাটি করেছে। কেমন করে বান্ধবীকে সে আরোগ্য করবে, কেমন করে ফিরিয়ে আনবে তার চোখের আলো। বান্ধবীর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে তার বিদেশে শিক্ষা লাভ সব পণ্ড হয়ে যাবে। তার সাধনা সগ্রাম সব ব্যর্থতায় পূর্ণ হবে। বান্ধবীর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা তার চাই…

কিন্তু আজ জুলেখার চিন্তার মোড় ফিরে গেছে অন্যদিকে। তার মনে এখন দ্বন্দ্ব চলেছে। মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলেই হারাবে সে মঞ্জুর সাহেবকে। মঞ্জুর চৌধুরীকে সে নিজের অজ্ঞাতে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু সে যে ডাক্তার…ডাক্তারের কর্তব্য রোগীকে আরোগ্য করে তোলা, রোগীকে রোগমুক্ত করা কিন্তু মনিরার দৃষ্টি ফিরে এলে কি করে তা সম্ভব হবে যা সে চায়। জুলেখা চায় মঞ্জুর চৌধুরীকে নিজের করে পেতে।

জুলেখা কিছুতেই মনকে সুস্থির করতে পারছেনা। একদিকে বান্ধবীর চক্ষুদান অন্যদিকে মঞ্জুর চৌধুরীকে হারানোর ভয়। সত্যিই যদি মনিরার দৃষ্টিশক্তি আর কোন দিন ফিরে না আসে, তাহলে–তাহলেই মঞ্জুর চৌধুরী সরে পড়বে তার পাশ থেকে। অন্ধ নারীকে কোন পুরুষ কোনদিন জীবন-সঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করতে পারে না। হাঁ, জুলেখা তাই করবে! জুলেখা তাই করবে, ভুলে যাবে সে কর্তব্য।

*

পরদিন।

লেবরেটরী কক্ষে টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে জুলেখা।

হঠাৎ জুলেখাকে খুঁজতে গিয়ে লেবরেটরী কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর–এই যে মিস জুলেখা, আপনি এখানে…

বনহুরের কণ্ঠস্বরে মুখ তুলে তাকালো জুলেখা, কোন জবাব দিলো না।

বনহুর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, জুলেখার মুখে-চোখে নজর পড়তেই চমকে উঠলো সে, বললো–মিস্ জুলেখা, আপনি কি অসুস্থ?

না।

কিন্তু আপনার চোখ-মুখ স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।

বনহুরের কথায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকে সংযত করে নেবার চেষ্টা করলো জুলেখা।

বনহুর বললো–মিস্ জুলেখা, মনিরা আপনাকে ডাকছে।

উঠে দাঁড়ায় জুলেখা, বলে–চলুন।

বনহুর আর জুলেখা মনিরার কক্ষে প্রবেশ করলো।

পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো মনিরা–কে, জুলেখা?

জুলেখা মনিরার পাশে এসে পিঠে হাত রাখলো।

 বনহুর বললো–মনিরা, তুমি না তোমার বান্ধবীকে খুঁজেছিলে? বলো কি বলতে চাও তাকে।

জুলেখাই বললো এবার–কেমন লাগছে মনিরা?

 ভাল না। আজ বড় অন্ধকার লাগছে সব।

জুলেখা কি যেন ভাবলো, তারপর বললো–এখানে তোর মন টিকছেনা তাই মন অস্থির লাগছে।

হাঁ জুলেখা, আমার মনে হচ্ছে কোথাও দূরে চলে যাই; কোন দূর দেশে…

মনিরা। অস্ফুট কণ্ঠে বললো জুলেখা।

বনহুর বললো এবার–মিস জুলেখা, আমার মনে হয় মনিরাকে কোন সমুদ্রতীরে মুক্ত জায়গায় নিয়ে গেলে ভাল হতো।

মনিরা যদি এমন কোন ইচ্ছা করে থাকে তবে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এক সপ্তাহ। পর মনিরার চোখের ব্যান্ডেজ খুলে নতুনভাবে ঔষধ লাগাতে হবে।

মিস্ জুলেখা, আপনাকেও তাহলে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

আমাকে!

হা। বললো বনহুর।

 জুলেখা অন্যদিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো–সম্ভব নয়।

মনিরা ব্যাকুল কণ্ঠে বললো–কেনো জুলেখা? কেননা সম্ভব নয়?

 আমার রোগী, আমার লেবরেটরী ছেড়ে যাবো কি করে বল?

মনিরা অভিমান ভরা কণ্ঠে বললো–তাহলে আমাকে মেরে ফেল্। আমাকে মেরে ফেল জুলেখা…

মনিরা। জুলেখা মনিরার মাথায় হাত রাখলো।

মনিরা বললো আবার–তুই না গেলে আমি কোথাও যাবোনা– যাবোনা আমি।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো– মিস্ জুলেখা, মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য চলুন। ফিরে এসে ওর চোখের বাধন মুক্ত করে দেবেন।

শেষ পর্যন্ত মনিরাকে হরিদ্রা সাগর সৈকতের ধারে নিয়ে যাওয়াই মনস্থ হলো, কান্দাই শহর ছেড়ে উত্তর দেশ হরিদ্রা। নির্জন সাগর তীরে ছোট্ট একটি বাংলো।

বনহুর মনিরা সহ এই বাংলোয় এসে উঠলো। জুলেখাকেও ধরে এনেছে তারা সঙ্গে করে।

জুলেখা মনিরার জেদ এড়াতে পারেনি, তাছাড়াও বনহুরের অনুরোধেও তাকে আসতে হলো তাদের সঙ্গে।

জুলেখা কয়েক দিনের জন্য তার পেসেন্টদের দায়িত্বভার সহপাঠি মিঃ হামিদের হাতে সঁপে দিয়ে এলো। মিঃ হামিদকে সহায়তা করবে তার অভিজ্ঞ সহকারিণী মিস রীণা রায়।

কাজেই এ ব্যাপারে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে জুলেখা।

সাগর তীরের উচ্চ একটা টিলার উপরে সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি বাংলো।

পাশাপাশি দুটো কামরায় ওরা উঠলো।

একটি বনহুর দ্বিতীয়টিতে জুলেখা আর মনিরা। বাংলোর সম্মুখে কিছুটা দূরে সমুদ্র। চারিদিকে শুধু জল আর জল, প্রচণ্ড প্রচণ্ড ঢেউগুলি উচ্ছলভাবে ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে বাংলোর পাদমূলে পাথরগুলির উপরে।

বাংলার অদূরে কতকগুলি ভীল পল্লী। এছাড়া কোন সভ্য লোকের বসবাস নেই এ অঞ্চলে।

বাংলোটা বেশ নীরব নির্জন সব সময়ের জন্য।

 বনহুরের কাছে খুব ভাল লাগলো জায়গাটা।

জুলেখা সব সময় মনিরার পাশে পাশে থাকে, যখন মনে করে হাত ধরে নিয়ে যায় সমুদ্রতীরে। ঘুরে বেড়ায় ওরা। বনহুরও সঙ্গে থাকে ওদের।

সমুদ্র সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য লক্ষ করে মুগ্ধ হয় বনহুর আর জুলেখা! মনিরার দৃষ্টিশক্তি নেই, তবু আবহাওয়াটা তার মনে একটা অনাবিল আনন্দ এনে দেয়।

বলে মনিরা– কি সুন্দর হাওয়া, তাই না জুলেখা?

হ্যাঁ। ছোট জবাব দেয় জুলেখা।

বনহুর বলে উঠে চলো মনিরা, সাগরের তীরে গিয়ে দাঁড়াই। আসুন মিস জুলেখা, ওকে আমরা সাগরতীরে নিয়ে যাই।

চলুন।

জুলেখা মনিরার হাত ধরে, কিন্তু উঁচুনীচু টিলা বেয়ে নিচে নামতে মনিরার খুব অসুবিধা হচ্ছিলো।

বনহুর মনিরার আর একটি হাত ধরে বললো চলো।

সমুদ্র সৈকতে আসার পর দু’দিন কেটে গেছে, এ দু’দিনের মধ্যে স্বামীর স্পর্শ মনিরা একবারও পায়নি। স্বামীর হাতে হাত রেখে মনিরা স্বর্গের শান্তি হৃদয়ে অনুভব করে।

বনহুর মনিরাকে নিয়ে অতি সাবধানে এগুচ্ছিলো।

জুলেখাও সাহায্য করছিলো মনিরাকে।

 সাগরতীরে এসে দাঁড়ালো ওরা তিন জন।

যে স্থানে এসে দাঁড়ালো সে স্থানে শুধু সোনালী বালুকা রাশি ভোরের সূর্যের আলোতে চিকমিক করছে।

মনিরা, জুলেখা আর বনহুর দাঁড়াতেই ছোট ছোট ঢেউগুলি আছড়ে এসে পড়লো তাদের পায়ের উপরে।

মনিরা দেখতে না পেলেও খুশিতে আত্মহারা হলো। ছুটোছুটি করে বেড়াতে ইচ্ছা হলো, জুলেখা আর বনহুরের পাশ থেকে আপন মনে সরে গেলো। হাঁটু গেড়ে বসে ঢেউগুলি ধরবার জন্য হাত বাড়ালো।

জুলেখা বললো– জামা-কাপড় ভিজে গেলো মনিরা।

যেতে দাও জুলেখা, সব ভিজে যেতে দাও। ইস কি আনন্দ, কি আনন্দ! সত্যি, খুব আনন্দ লাগছে, না?

বনহুর আর জুলেখা ব্যথাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মনিরার মুখে।

মনিরার প্রাণভরে ঢেউগুলিকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে। উচ্ছ্বসিত আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে সে।

বনহুর মনিরার আনন্দে তৃপ্তি লাভ করে। মনিরার দিকে তাকিয়ে হাসে বনহুর।

হঠাৎ ফিরে তাকায় বনহুর জুলেখার মুখে, জুলেখা নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

 জুলেখার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই, জুলেখা দৃষ্টি নত করে নেয়।

এক সময় ওরা তিন জনা ফিরে আসে বাংলোয়।

 বাংলোর বারেন্দায় পাশাপাশি তিনখানা সোফায় বসে পড়ে ওরা তিন জনা।

সমুদ্রের মুক্ত হাওয়া আর মিষ্টি মিষ্টি রৌদ্র ওদের মনে।

নতুন সুর জাগায়।

 বনহুর বয়কে আদেশ দেয় চা আনতে।

 চা পান করতে করতে অনেক কথা চলে ওদের মধ্যে।

 হাসি-গল্প নিয়ে মেতে উঠে ওরা, বিশেষ করে মনিরাকে আনন্দ দেবার জন্য বনহুর অনেক হাসির গল্প বলে। মনিরার মুখে হাসি ফুটাবার আপ্রাণ চেষ্টা বনহুরের।

বনহুর যখন অন্যমনস্কভাবে কথা বলে চলে, জুলেখা তখন চিত্রার্পিতের মত তাকিয়ে থাকে বনহুরের হাস্য-উজ্জল সুন্দর মুখমন্ডলের দিকে। যতই দেখে ততই যেন আর দেখবার বাসনা উন্মুখ করে তোলে, মনের গোপন ইচ্ছা কিছুতেই গোপন রাখতে পারে না জুলেখা। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে যেন স্বপ্নময় হয়ে উঠছে। একটা অগভীর আকর্ষণ নিয়ে হৃদয়ে উপলব্ধি করছে সে।

জুলেখা জানে, মঞ্জুর সাহেব মনিরাকে ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে করাই হয়তো তার বাসনা ছিলো? তাই মঞ্জুর সাহেব চায় মনিরাকে আরগ্য করে তুলতে। তার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনতে। জুলেখা বেশ বুঝতে পেরেছে, মঞ্জুর সাহেব আর মনিরার মধ্যে গভীর একটা সম্বন্ধ লুকানো আছে। কিন্তু জুলেখা এখন জানেনা কি তাদের সম্বন্ধ। জানলে হয়তো নিজকে এতোখানি ছেড়ে দিতে পারতো না সে মঞ্জুর সাহেবের দিকে। এটুকুই জানে জুলেখা ওদের মধ্যে একটা গভীর প্রেম বা প্রীতি রয়েছে, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না যতক্ষণ না মনিরা দৃষ্টিলাভে সক্ষম হয়। আপন মনে হাসে জুলেখা, মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা এখন তার আয়ত্বের মধ্যে।

বনহুর বললো- মিস্ জুলেখা, কি ভাবছেন?

না, কিছু না। চলো মনিরা ভিতরে যাই। জুলেখা মনিরা সহ বাংলার কক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর একাই বসে রইলো সেখানে, ভাবতে লাগলো জুলেখার এই অন্যমনষ্কতার কথা। জুলেখার মনোভাব আজকাল স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। সব সময় সে বেশ ভাবাপন্ন এবং অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। বনহুর বুদ্ধিহীন নয় সে বুঝতে পারে জুলেখার অন্তরের কথা। একটা ক্ষীণ। হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়।

*

জ্যোছনা প্লাবিত রাত।

অদূরস্থ ভীল পল্লী থেকে ভেসে আসছে মাদলের আওয়াজ। সাঁওতালদের কোন উৎসব আছে হয়তো আজ।

বনহুর নিজ কামরায় শুয়ে গভীরভাবে জুলেখার সম্বন্ধেই চিন্তা করছিল। জুলেখা ছাড়া মনিরার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কাজেই জুলেখার মনে কোন রকম অসন্তুষ্টির সৃষ্টি না হয় সেদিকে তাকে সতর্ক থাকতে হবে।

বনহুরের চিন্তাস্রোতে বাধা পড়লো, বয়ের কণ্ঠস্বর–স্যার, ও ঘরে ডাকছেন।

 বনহুর মুখ তুলে তাকালো কোন ঘরে?

স্যার, ও ঘরে।

যা, আসছি। বনহুর উঠে পড়লো। বেশি রাত হয়নি তো কাজেই এখনও তারা রাতের খাবার খায়নি। বনহুর মনে করলো বোধ হয় খাবার জন্য ডাক পড়েছে।

মনিরা আর জুলেখা যে কক্ষে থাকতো সেই কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর।

মনিরা বললো–এসেছো?

 হাঁ, কেনো?

 শুনতে পাচ্ছো কিছু?

পাচ্ছি।

কি?

সাঁওতালদের কোন উৎসব হচ্ছে।

 ইস কি সুন্দর মাদলের বাজনা।

যাবে ওখানে?

আমি কি যেতে পারব? শোন, জুলেখাকে নিয়ে যাওনা একটু, কোন দিনও সাঁওতালদের উৎসব দেখেনি।

বনহুর তাকালো জুলেখার দিকে।

জুলেখা বসে বসে কি যেন একটা কাঁটা দিয়ে বুনছিলো।

বলল সে– থাক, উনার অসুবিধা হবে।

বনহুর বললো– না, না আপনি যদি যেতে চান তাহলে আমার কোন অসুবিধা বা আপত্তি নেই, কিন্তু মনিরা, তুমি একা একা…।

হেসে বললো মনিরা– বাংলোর দারওয়ান আছে, বয় আছে তাছাড়া আমার বীণা আছে– জুলেখা আমার বাণীটা দিয়ে যাও আমার কাছে।

জুলেখা হাতের কাটা এবং উল-সূতার গুটিটা ওপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো–চল্ আমি তোকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাবো।

মাফ কর জুলেখা, যা উঁচু-নীচু জায়গা….

জুলেখা বীণা খানা এগিয়ে দেয় মনিরার হাতে।

মনিরা আসবার সময় বীণাখানা ছেড়ে আসেনি। নির্জন সাগর সৈকতে এটাও তার একজন সঙ্গী।

মনিরা বললো–বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, ওভারকোট পরে নিও তোমরা।

 জুলেখা ওভারকোট পরে নিলো।

বনহুর পাশের কক্ষ থেকে ওভারকোটটা গায়ে পরতে পরতে এসে দাঁড়ালো, মনিরাকে উদ্দেশ্য করে বললো–এক্ষুণি ফিরে আসবো মনিরা, বাইরে দারওয়ানকে বলে যাচ্ছি।

জুলেখা আর বনহুর বেরিয়ে যায়।

মনিরা বীণা খানা টেনে নেয় কোলের উপর।

বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা দু’জনা– জুলেখা আর বনহুর। আজ পূর্ণিমা রাত্রি, আকাশে কোন মেঘের বালাই নেই। জ্যোছনা স্নাত পৃথিবী, কোথাও এতোটুকু যেন অন্ধকার নেই, নেই কোন মলিনতা।

উঁচুনীচু টিলার উপর দিয়ে পাশপাশি এগুচ্ছিলো বনহুর আর জুলেখা। বাংলোর কিছু দূরে ভীলপল্লী, মাদলের শব্দ আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে ভীলবালাদের কণ্ঠের অদ্ভুত গীত।

বাংলোর আশে পাশে খানিকটা জায়গা সমতল হলেও কিছুটা চলার পর শুধু টিলা আর টিলা ছোট ছোট খাদও আছে।

এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালো তারা। জায়গাটা বেশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে।

বনহুর বুঝতে পারলো–জুলেখার এবার নামতে কষ্ট হবে, হঠাৎ নিচে পড়ে গেলে আহত হবার আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য বনহুরের কাছে এসব উঁচু-নীচু বা ঢালু কিছুই নয়। জুলেখাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে বললো বনহুর –আমার হাত ধরুন।

জুলেখা জ্যোছনার আলোতে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। সম্মুখে বনহুরের হাতখানা বাড়ানো রয়েছে।

জুলেখা হাত রাখলো বনহুরের হাতে।

বনহুর বললো আসুন এবার কোন ভয় নেই।

জুলেখার বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে, একটা অনুভূতি তার সমস্ত শিরায় শিরায় শিহরণ জাগালো। এমনি করে সে যদি যুগ যুগ ধরে পথ চলতে পারতো ওর হাতের মধ্যে হাত রেখে।

বনহুর বললো-কষ্ট হচ্ছে না তো?

উঁহু কোন কষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু আপনাকে আমি বড় কষ্ট দিলাম।

হাসলো বনহুর–কি যেন বলেন, এটা আবার কষ্ট নাকি?

সত্যি মঞ্জুর সাহেব, আপনি আশ্চর্য মানুষ। বললো জুলেখা।

বনহুর বললো–কোন ব্যতিক্রম দেখছেন বুঝি আমার মধ্যে?

 তা দেখেছি বই কি?

 কি রকম?

সে কথা আজ বলবো না। কথার ফাঁকে তারা প্রায় এসে যায় ভীল পল্লীর নিকটে।

ভীল পল্লীর সর্দার রতন বনহুরকে জানতো কারণ তার একজন সঙ্গী বাংলোর বাগানের মালীর কাজ করে।

বনহুর জুলেখা আর মনিরা বাংলোয় এসে উঠলেই সর্দার নিজে গিয়ে দেখা করে এসেছিলো, আজকের উৎসবে আমন্ত্রণও জানিয়ে এসেছিলেন সর্দার নিজে।

বনহুর আর জুলেখাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হলো রতন সর্দার।

তাদের ভাল করে একটা উঁচু জায়গায় বসিয়ে ফলমূল এনে দিলো খেতে। কচি ডাব এনে। দিলো পানির পরিবর্তে।

বনহুর আর জুলেখাকে খেতে দিয়ে তাদের চারপাশে নাচ শুরু হলো। মশাল নাচ, জংলী –নাচ, ধিংকি নাচ আরও কতরকম নাচ দেখালো ভীল পুরুষ আর নারীগণ বনহুর আর জুলেখাকে।

জুলেখা কোনদিন এসব নাচ দেখেনি, চিরদিন শহরের মানুষ সে। জংলী বা ভীলদের সংস্পর্শে আসেনি কোনদিন। অবাক হয়ে এ সব দেখতে লাগলো জুলেখা।

মাঝে মাঝে বনহুরের মুখে তাকিয়ে হাসছিলো সে।

 মশালের আলোতে জ্যোছনার আলো স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো সেখানে।

বনহুর নাচ দেখলেও মন তার চঞ্চল হয়ে পড়ছিলো বারবার না জানি মনিরা কি করে? তাকে বলে এসেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে। কিন্তু রাত যে অনেক হয়ে চললো।

বনহুর হাতঘড়ির দিকে তাকালো–ইস রাত দশটা বেজে গেছে।

 জুলেখা উঠে দাঁড়ালো–চলুন।

আবার সেই পথ।

জ্যোছনার আলোতে ঝলমল করছে পাথুরিয়া পথঘাটগুলো।

জুলেখার মুখে আজ আনন্দের উচ্ছ্বাস।

 হেসে বললো জুলেখা–আজকের কথা চিরদিন স্মরণ থাকবে মঞ্জুর সাহেব।

 বনহুর ছোট্ট একটু জবাব দিলো হু।

জুলেখা আবার বললো–অপূর্ব এ দৃশ্য; অপূর্ব এ রাত।

আবার সেই ঢালু পথ। বনহুরের হাতে হাত রেখে জুলেখা এগুতে লাগলো।

এবার জুলেখা ইচ্ছা করেই বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে চলছিলো যেন কতদিনের পরিচয় ওদের দুজনার মধ্যে।

বাংলোর নিকটবর্তী হতেই জুলেখা আর বনহুরের কানে ভেসে এলো বীণার সুরের অপূর্ব ঝঙ্কার।

বনহুর বললো–মনিরা এখনও জেগে আছে।

জুলেখা বললো–এতো রাত ঘুমায়নি–আশ্চর্য।

একা একা বেচারী—

বনহুরের কথায় জুলেখা কোন জবাব দেয়না।

*

বাংলোয় ফিরে সেদিন আর কোন কথা হয়না কারো মধ্যে। বনহুর নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সাঁওতাল পল্লী থেকে যে ফলমূল আর পানীয় পান করে এসেছিলো। তাতে খাবার আর প্রয়োজন হলো না তাদের।

জুলেখাও শয্যা গ্রহণ করলো।

 মনিরা বললো–ভীলদের নাচ কেমন লাগলো বললিনা তো জুলেখা?

 জুলেখা চাদর মুড়ি দিতে দিতে বললো–অপূর্ব।

আজ যদি আমার দৃষ্টিশক্তি থাকতো, সত্যি কি আনন্দ করে ঘুরে বেড়াতাম। তোরা কত সুখী জুলেখা, আর আমি–

মনিরা যখন নিজের দৃষ্টিশক্তির জন্য দুঃখ করছিলো তখন জুলেখার মনে অন্য চিন্তার রেশ ঝঙ্কার তুলছিলো। মনের গহনে উপলব্ধি করছিলো কিছু পূর্বে মঞ্জুর সাহেবের সঙ্গে তার মধুময় মুহূর্তগুলি। জুলেখার অন্তরে অন্তরে এক অপূর্ব শিহরণ জাগছিলো।

মনিরা ঘুমিয়ে পড়ে।

 জুলেখার চোখে ঘুম নেই।

এপাশ ওপাশ করছে জুলেখা।

পাশের ঘরে বনহুরের চোখেও ঘুম নেই। কিন্তু তার মনে জুলেখার চিন্তা নয়, মনিরার সান্নিধ্য লাভ তাকে চঞ্চল করে তুলেছে।

বনহুর শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। মুক্ত জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের সীমাহীন জলরাশি। জ্যোছনার আলোতে ফেনিল জলরাশি ঝলমল করছে যেন একসঙ্গে অনেকগুলো তারার মালা দোল খেয়ে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে।

বনহুর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

অদূরস্থ ভাল পল্লীর উৎসব থেমে গেছে, মাদলের শব্দ আর এখন শোনা যাচ্ছেনা। ছবির মত ঝাপসা লাগছে দূরে থেকে পল্লীর ছোট ছোট কুঠিরগুলো।

বনহুর বাংলো ছেড়ে এগিয়ে চলে সমুদ্রের দিকে।

একটা পাথরখন্ডে বসে পড়ে বনহুর। সম্মুখে সমুদ্র। ছোট ছোট ঢেউগুলি ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে তার পায়ের কাছে। ঠিক যেন কোন অভাগিনী নারী তার পদতলে মাথা কুটে কুটে কেঁদে মরছে।

বনহুর সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে।

হঠাৎ কালো লঘু পদক্ষেপের শব্দে ফিরে তাকালো বনহুর। চমকে উঠলো সে, জ্যোছনার আলোতে স্পষ্ট দেখলো–জুলেখা তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাক নিস্তব্দ পাথরের মূর্তির মত লাগছে তাকে।

বনহুর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো–আপনি!

 জুলেখার ঠোঁট দু’খানা নড়ে উঠলো, কোন কথা বের হলোনা।

বনহুর বললো–চলুন বাংলোয় ফিরে যাই।

জুলেখা শান্ত কণ্ঠে বললো–বসুন না আর একটু।

এখানে এই নির্জন সাগর সৈকত আপনার পক্ষে নিরাপদ নয় মিস্ জুলেখা।

কোন ভয়ের সম্ভাবনা আছে নাকি মঞ্জুর সাহেব?

আছে বই কি? দস্যু বনহুরকে জানেন তো?

দস্যু বনহুর। গলাটা কেঁপে গেলো জুলেখার–কেনো বলুন তো? আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো সে বনহুরের পাশে।

দস্যু বনহুর হঠাৎ যদি এসে পড়ে এখানে? জানেন তো সে এখন মুক্ত রয়েছে।

 দস্যু বনহুর এখানে আসবে?

 তার অসাধ্য কিছু নেই।

সত্যি, দস্যু বনহুর দেশ ও দশের শত্রু।

কি করে বুঝলেন দস্যু বনহুর দেশ ও দশের শত্রু?

শুনেছি দস্যু বনহুর যে কোন মুহূর্তে যার তার উপরে হামলা করে তার সর্বস্ব লুটে নেয়। সমস্ত শহরের প্রতিটি নাগরিক তার ভয়ে সদা কম্পমান রয়েছে। নিরীহ জনগণের বুকে ছোরা বসিয়ে দিতে তার এতোটুকু বাধে না। এমন কি যে কোন যুবতী বা নারীকে সে দেখলে অপহরণ করে নিয়ে যায়–

এমন দস্যুর বাস যে দেশে সে দেশে গভীর রাতে নির্জন সাগর তীরে কখনই নিরাপদ নয় চলুন।

বনহুর অগ্রসর হলো।

জুলেখা অগত্যা ফিরে চললো তার সঙ্গে।

কোনো এসেছিলো কি বলতে চেয়েছিলো, কোন কথাই বলা হলোনা।

ওদিকে মনিরার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো পাশের বিছানায় জুলেখার নিশ্বাসের শব্দ শোনা। যাচ্ছেনা কেননা। দৃষ্টি শক্তি নেই যে তাকিয়ে দেখবে সে। মনিরা নিজের নিশ্বাস বন্ধ করে কান পাতলো না, কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। ডাকলো মনিরা এবার–জুলেখা,জুলেখা–

কোন সাড়া শব্দ নেই।

মনিরার বুকের মধ্যে টিপ টিপ করে উঠলো। তবে কি জুলেখা বিছানায় নেই মনিরা উঠে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলো জুলেখার বিছানার পাশে। বিছানায় হাত বুলিয়ে তার সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো জুলেখা বিছানায় নেই শূন্য শয্যা পড়ে রয়েছে। মনিরার মনের মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হলো। কোথায় গেছে, কেননা গেছে–তবে কি–তবে কি তার স্বামীর কক্ষে জুলেখা–

ঠিক সেই মুহূর্তে শুনতে পেলো মনিরা বাংলোর বাইরে পুরুষ ও নারীকণ্ঠের হাস্যধ্বনি।

জুলেখার কণ্ঠে–গুড নাইট।

 পরক্ষণেই তার স্বামীর কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পেলো মনিরা–গুড নাইট—

মনিরার মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো। জুলেখা কক্ষে প্রবেশ করার পূর্বেই মনিরা নিজের শয্যায় এসে নিশ্চুপ শুয়ে পড়লো, নিস্পন্দ অসারের মত। একটু টু শব্দ সে করতে পারলো না। চোখে না দেখলেও অনুভব করলো– জুলেখা সন্তর্পণে শয্যায় এসে শুয়ে পড়লো।

পাশের কক্ষেও দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে ভেসে এলো মনিরার। তার স্বামী দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো বুঝতে পারলো সে। মনিরার সন্দেহ দৃঢ় হলো, নিশ্চয়ই জুলেখার সঙ্গে তার। স্বামীর গোপন প্রেম জন্মে গেছে।

মনিরার বুকের মধ্যে কে যেন লৌহ শলাকা বিদ্ধ করে দিচ্ছিলো অসহ্য সে যন্ত্রণা। মুখে কোন কথা না বললেও বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিলো তার।

জুলেখা ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু মনিরার চোখে আর ঘুম আসে না। আজ যেন সে তার যথাসর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছে। অন্ধ হয়েও তার মনে এতো দুঃখ ছিলো না, আজ তার জীবনের সবকিছু যেন শূন্যতায় ভরে উঠেছে। জুলেখার প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তার স্বামী–মনিরা আর ভাবতে পারে না। অন্ধ হলেও তার মনের পর্দায় দেখতে পায়–বনহুর আর জুলেখা, ওরা দু’জনা পাশাপাশি পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উঁচু-নীচু পথ বনহুর জুলেখার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে জুলেখা হাসছে ওর হাতে হাত রেখে সন্তর্পনে চলছে। হাসছে ওরা দুজনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে! মনিরা দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেলে কিন্তু মন থেকে তো মুছে ফেলতে পারে না। দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠে একটির পর একটি করে–সাঁওতাল পল্লী বনহুর আর জুলেখা বসে আছে পাশাপাশি। সম্মুখে নাচ দেখাচ্ছে ভীলবালাগণ। বনহুর আর জুলেখা দু’জন তাকাচ্ছে হাসছে উভয়ে। মনিরা আর ভাবতে পারে না, দুই হাতে মাথা টিপে ধরে শক্ত করে।

তারপর মনিরা আর নিজকে ধরে রাখতে পারে না, শয্যাত্যাগ করে নেমে দাঁড়ায় নিচে। অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলে হাতড়ে হাতড়ে।

পাশের বিছানায় জুলেখার নাসিকার শব্দ হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে। জুলেখা।

মনিরা দেয়াল হাতড়ে এগুতে লাগলো। অতি ধীরে ধীরে দরজার খিল খুলে ফেললো মনিরা, বেরিয়ে এলো বাইরে। সমস্ত পৃথিবী আলোর বন্যায় ঝলমল করছে কিন্তু মনিরার চোখে সব অন্ধকার।

মনিরা এগিয়ে চললো বাংলোর বারান্দা বেয়ে সম্মুখের দিকে।

দেয়াল ধরে ধরে এগুচ্ছে মনিরা। কোন দিকে ওর খেয়াল নেই। বাড়ির সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বাংলোর বারেন্দা থেকে নেমে পড়লো। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো একবার আবার উঠে দাঁড়ালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো পিঠের উপর। আঁচলটা খসে লুটোপুটি খেতে লাগলো মাটির মধ্যে। মনিরা এলোপাথারী অগ্রসর হচ্ছে। কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের জলরাশির উচ্ছল কল কল শব্দ।

মনিরা সমুদ্রের দিকে এগুতে লাগলো। জীবনের উপর তার একটা ধিক্কার এসে গেছে। কি হবে এ জীবন রেখে যার সব গেছে–সব নিঃশেষ হয়ে গেছে। যার দৃষ্টি শক্তি নেই। নেই যার সম্বল বলতে কিছু–কি হবে তার জীবন রেখে। মনিরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে আত্মবিসর্জন দেবে।

উঠছে পড়ছে, আবার এগুচ্ছে সম্মুখের দিকে। কখনও পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে ভূতলে! মাথার একস্থানে পাথরের আঘাত লেগে কেটে গেলো অনেকটা। দর দর ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

মনিরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মত এগিয়ে চলেছে। চোখে সে দেখতে না পেলেও কানে শুনতে পাচ্ছে সমুদ্রে জলোচ্ছাসের শব্দ। সেই শব্দ লক্ষ্য করে এগুচ্ছে মনিরা।

*

দারোয়ানের উচ্চকণ্ঠে ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের, দড় বড় দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

দারোয়ান ব্যস্তকণ্ঠে বললো-হুঁজুর, ছোট মেম সাহাব দরিয়া কিনার মে চলা গিয়া—

দরিয়া কিনারে! অস্কুট ধ্বনি করলো বনহুর। কোন ছোটা মেম সাহেব দারোয়ান?

আন্ধা মেম সাহাব–

দারোয়ানের কথা শেষ হয়না, বনহুর স্লিপিং গাউনে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে ছুটলো সমুদ্রতীর অভিমুখে।

মনিরা তখন ঠিক সমুদ্রতীরে উঁচু একটা স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, আর এক মুহূর্ত, তাহলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সমুদ্র বুকে।

ঠিক সেই ক্ষণে বনহুর ধরে ফেললো মনিরাকে–মনিরা।

মনিরা পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গেলো।

বনহুর পুনঃ পুনঃ তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে বললো–মনিরা। কেননা তুমি এ কাজ করতে যাচ্ছিলে? বলো–বলো মনিরা কেনো তুমি সমুদ্রে জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলে? মনিরা– মনিরা—

মনিরা এবার উচ্ছাসিতভাবে কেঁদে উঠলো–ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে, মরতে দাও

কি হয়েছে তোমার? কি হয়েছে মনিরা,বলো? বনহুর মনিরাকে নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে।

আমি অন্ধ আমি দৃষ্টিশক্তিহীন আমি পঙ্গুতোমার উপযুক্তা আমি নই। আমাকে তুমি ত্যাগ করো, ওগো আমাকে তুমি ত্যাগ করো।

এবার বনহুর কঠিন গর্জন করে উঠলো–মনিরা।

না না, আমাকে তুমি মরতে দাও?

কেন মরতে এতো সখ বলবে তো?

মরবার সখ আমার নেই কিন্তু বাধ্য হচ্ছি আমি নিজকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে?

কেনো?

জুলেখাকে তুমি বিয়ে করো–

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো বনহুর-জুলেখাকে বিয়ে করব! গম্ভীর হয়ে পড়লো বনহুর মনিরাকে মুক্ত করে দিয়ে বললো সেকেনো?

মনিরা না বলে পারলো না; বললো এবার মনিরা–জুলেখা আর তোমার মধ্যে–থেমে পড়লো তারপর বললো সে–আমি অন্ধ হলেও অজ্ঞান নই–সব জানি, সব বুঝতে পারি।

এ সব কি আবোল-তাবোল বলছো মনিরা?

কিছুক্ষণ পূর্বেই তুমি আর জুলেখা গোপনে বাংলো থেকে বেরিয়ে যাওনি?

বনহুর এবার সব বুঝতে পারে, কিছু আগে জুলেখা ও তার আগমন টের পেয়েই মনিরা এমনভাবে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছে।

মনিরার মনে সন্দেহ জেগেছে তার এবং জুলেখার উপর।

বনহুর হেসে উঠলো হো হো করে তারপর হাসি থামিয়ে বললো–এ জন্যই তুমি প্রাণ বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলে? মনিরা তুমি বিশ্বাস রেখো তোমার স্বামীকে–

মনিরা বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

বনহুর বলে–মনিরা, কোনদিন আমার উপর তুমি বিশ্বাস হারিও না।

ওগো আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমাকে তুমি ক্ষমা করো—

*

এই ঘটনার কয়েকদিন পর বনহুর মনিরা আর জুলেখা ফিরে এলো কান্দাই শহরে। এক সপ্তাহ তারা কাটিয়ে এসেছে হরিদ্রা সাগর সৈকতে।

হরিদ্রা নির্জন সাগর তীরে বাংলোয় মনিরা আর জুলেখার মধ্যে যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা বনহুর সামলে নিয়েছিলো অত্যন্ত সাবধানে। কারণ এখন জুলেখাকে তাদের একান্ত প্রয়োজন। মনিরার চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনবার জন্য জুলেখা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বনহুর মনিরার জন্য সব ত্যাগ করে পড়ে আছে এখানে। ওদিকে আস্তানায় তার দলবল না জানি কি করছে। নূরী হয়তো কেঁদে কেঁদে সারা হলো। কাউকেই বলে আসেনি বনহুর। ভিতরে ভিতরে সে আস্তানার জন্য অত্যন্ত চিন্তিত ছিলো কিন্তু সব চিন্তার চেয়ে তার মনে আঘাত হানছিলো মনিরার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার চিন্তা। মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে তার সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।

কান্দাই ফিরেই বনহুর আস্তানায় ফিরে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। জুলেখার নিকট বললো সে–আমি কয়েকদিনের জন্য দেশে যেতে চাই। আপনি মনিরার দিকে লক্ষ্য রাখবেন।

জুলেখার নিকটে কথাটা আনন্দদায়ক বলে মনে হলোনা।

মঞ্জুর সাহেবের মনিরার প্রতি অনুরাগ দেখে মনের মধ্যে একটা অহেতুক ঈর্ষা জাগছিলো। অন্ধ মনিরার জন্য তার এতো প্রাণের টান কেননা ভেবে পায়না জুলেখা।

বনহুরের কথায় জবাব দেয় সে–আপনি চলে গেলে সত্যি আমি মনে ব্যথা পাবো মঞ্জুর সাহেব।

জুলেখার কণ্ঠস্বরে আবেগ মাখানো ছিলো, বনহুর গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগলো। তারপর হেসে বললো–মিস্ জুলেখা আমিও আপনাদের সান্নিধ্য ছেড়ে বেশিদিন বিলম্ব করতে পারবোনা। বিশেষ করে আপনার মধুময় ব্যবহার আমার সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

জুলেখা বনহুরের কথায় আত্মহারা হয়ে যায়। নিজকে যেন হারিয়ে ফেলে সে বনহুরের হাতের উপর হাত রেখে–সত্যি বলছেন?

সত্যি।

বনহুর এরপর আর বিলম্ব করেনি জুলেখার লেবরেটরী কক্ষে। মনিরার কাছে বিদায় নিয়ে বনহুর ফিরে এলো তার আস্তানায়।

*

রহমান এবং অন্যান্য সবাই দস্যু বনহুরের অনুচরগণ তাদের সর্দারের অকস্মাৎ অন্তর্ধানে ভয়ানকভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। রহমান গোপনে শহরে অনুসন্ধান নিয়েও সর্দারের কোন সন্ধান পায়নি। চৌধুরী বাড়ি গিয়েও দেখা পায়নি সে মনিরার। সে তবে নকীরের মুখে শুনেছিলো মনিরার চক্ষু চিকিৎসার জন্য তাকে কান্দাই এর কোন এক চক্ষু চিকিৎসকের নিকটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে–এর বেশি রহমান জানতে পারেনি কিছু।

নূরীর মন অত্যন্ত খারাপ ছিলো, লোকে যে যাই বলুক বনহুরকে সমস্ত অন্তর দিয়ে সে ভালবাসে। বনহুরের জন্য সব সময় আনমনা থাকে সে। শত বাধা বিঘ্নও নূরীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেনা বনহুরের চিন্তা থেকে। যদিও মনিকে নিয়ে নূরী সকল সময় ব্যস্ত থাকতো তবু বিমর্ষ হয়ে কাটাতো সর্বক্ষণ।

হঠাৎ সর্দারের অন্তর্ধানে নূরী চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ভীষণভাবে, বুঝতে পেরে জোবাইদা ভিতরে ভিতরে খুশিই হয়।

এমন দিনে ফিরে এলো সর্দার সুস্থ সবল দেহে।

নূরী সংবাদ পেয়ে ছুটে এলো বনহুরের পাশে; খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল।

বনহুর এগিয়ে আসতেই মনি এসে জাপটে ধরলো–বাপি।

বনহুর মনিকে তুলে নিলো কোলে, গালে মৃদু চাপ দিয়ে আদর করে বললো–কেমন আছ মনি?

মনি কিছু বলবার পূর্বেই হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো দরজার দিকে–সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা হস্তে দাঁড়িয়ে আছে জোবাইদা, দরজার একপাশে আড়ালে।

বনহুর মনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো, তারপর বললো–নূরী, যাও মনিকে খেলা দাও গে।

হঠাৎ বনহুরের গম্ভীর অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ্য করে নূরী আর কোন কথা বলেনা মনিকে কোলে করে বেরিয়ে যায় সে।

মনি আর নূরী চলে যেতেই বনহুর দরজার আড়াল থেকে জোবাইদার হাত ধরে টেনে বের করে আনে–দক্ষিণ হস্তে তার তীক্ষ্ণ ধার ছুরি। মশালের আলোতে জোবাইদার হাতে ছোরাখানা ঝকমক করে উঠে।

বনহুর বুঝতে পারে–জোবাইদা তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই তার কক্ষের দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছিলো। নূরী বা মনিকে হত্যা তার মনোভাব হলে সে অনেকভাবে তাদের। হত্যা করতে পারতো আর এভাবে লুকিয়ে থাকার তার প্রয়োজন ছিলো না।

বনহুরের সম্মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো জোবাইদা।

সত্যই সে আজ বনহুরকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এখানে এইভাবে আত্মগোপন করেছিলো। আজ অনেকদিন থেকে জোবাইদা নিজের মনের সঙ্গে দ্বন্দ করেছে। স্মরণ হয়েছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, অতীত হাতড়ে দেখতে পেয়েছে–বনহুরের উপেক্ষা ছাড়া কোনদিন এতোটুকু প্রীতি সে পায়নি। অনুগ্রহের কাঙ্গাল সে নয়, সে চায় বনহুরের হৃদয়ের এতোটুকু নিবিড় অনুভূতি। কিন্তু যা জোবাইদা চেয়েছে তা কোনদিনই পায়নি, পাবেও না জীবনে। সমস্ত অন্তর দিয়ে সে চেয়েছিলো বনহুরের একটুখানি ভালবাসা। নারী হৃদয় যেমনি কোমল তেমনি বিষময় হয়ে উঠে কখন, যখন সে তার কামনার বস্তু থেকে বিমুখ হয়। তখন সে হয়ে উঠে ভয়ঙ্করী। জোবাইদা তার সমস্ত আশা আকাঙ্খ থেকে হতাশ হয়েছে। বিষধর নাগিনীর মত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে সে। যা সে পাবেনা কোনদিন সে জিনিস অপরকেও দেবেনা ভোগ করতে, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে পড়ে জোবাইদা এবং সেই কারণেই আজ সে বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করে গোপনে লুকিয়েছিলো–বনহুরকে হত্যা করবে সে।

বনহুর জোবাইদার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার চোখে মুখে ক্রুদ্ধ ভাব নয় বা কোন রকম রাগান্বিত হয়নি বনহুর। স্বাভাবিক মুখভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে জোবাইদার মুখের দিকে।

বনহুর বুদ্ধিহীন নয়–সে জোবাইদার মনোভাব অনেক দিন লক্ষ্য করেছে। ছোট বেলার সাথী হিসাবে বনহুর কোনদিন জোবাইদাকে অবহেলা করেনি। যতটুকু পেরেছে সমীহ করে চলেছে, স্নেহ মায়া মমতা দিতে কার্পণ্য করেনি কোনদিন, কিন্তু জোবাইদা এতে খুশি হয়নি। বনহুর নিভতে ভেবেছে কতদিন–শুধু জোবাইদার কথা নয়, এমনি আরও কত নারীর প্রেমাই তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। নিজকে সংযত রাখতে গিয়েও মাঝে মাঝে বিচলিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু পদঙ্খলন ঘটেনি তার কোনদিন।

বনহুর জোবাইদার মনোভাব বুঝতে পেরেই রাগান্বিত বা ক্রোধান্বিত হতে পারলনা। এই মুহূর্তে যদি তার অনুচরগণের কেউ জানতে পারে, জোবাইদা সর্দারকে হত্যার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, তাহলে জোবাইদাকে প্রাণ নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে না। শুধু হত্যাই করবেনা, তাহার সমস্ত দেহে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।

বনহুর বললো–জোবাইদা তুমি যে কারণে এখানে আত্মগোপন করেছিলে, আমি বুঝতে পেরেছি। বেশ, তুমি আমাকে হত্যা করে যদি সুখী হও তবে তাই হোক। আমাকে তুমি হত্যা করো। শোন আমাকে হত্যা করার পর নিশ্চয়ই তুমি নিজকে গোপন রাখতে পারবেনা, হয়তো ধরা পড়ে যেতে পারো। তখন রহমান বা আমার অনুচরগণ তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবেনা। তাই আমি তোমাকে একটা গোপন পথের সন্ধান বলে দেবো, যে পথে তুমি আমাকে হত্যা করার পর অতি নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আমার আস্তানার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে দেয়ালে একটি ছোট চাকার মত চাবি আছে। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে এই চক্রাকার চাবিটি তোমার দৃষ্টিতে ধরা পড়বে, তুমি সেই চাবিটি দক্ষিণ দিকে একটু চাপা দিলেই ছোট্ট একটা সুড়ঙ্গ পথ বেরিয়ে আসবে সেই পথে তুমি ফিরে যেতে পারবে পৃথিবীর বুকে। যেখানে খুশি চলে যেও আর কেউ তোমার সন্ধান পাবেনা। করো, হত্যা করো আমাকে–বনহুর বুক পেতে দেয় জোবাইদার। সম্মুখে।

জোবাইদা নত দৃষ্টি তুলে তাকায় বনহুরের মুখে।

সৌম্য-সুন্দর অপরূপ একখানা মুখমুদিত দুটি আঁখি। জোবাইদার মনের মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হলো,হস্তস্থিত ছোরাখানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লুটিয়ে পড়লো বনহুরের পায়ে।

ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা ছোরা এসে বিদ্ধ হলো জোবাইদার পিঠে। তীব্র আর্তনাদ করে মুখ ধুবড়ে পড়ে গেলো জোবাইদা বনহুরের পায়ের উপর।

বনহুর বিস্ময় ভরা চোখে তাকালো প্রথমে জোবাইদার লুষ্ঠিত দেহের দিকে পরক্ষণেই ওদিকের মুক্ত জানালার দিকে দৃষ্টি পড়লো। একখানা হাত দ্রুত সরে গেলো জানালার পাশ থেকে। বনহুর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের একস্থানে চাপ দিলে সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আস্তানায় একটা সংকেতসূচক শব্দ ধ্বনিত হতে লাগলো।

শব্দটা সমস্ত আস্তানায় ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তে।

আস্তানার প্রবেশ পথে এবং সমস্ত স্থানে স্থানে রাইফেলধারী দস্যগণ সজাগ হয়ে দাঁড়ালো। একটি প্রাণী যেন আস্তানার বাইরে যেতে না পারে, এই সংকেত ধ্বনির একটা ইংগিৎ।

রহমান ও বিশিষ্ট কয়েকজন অনুচর ছুটলো বনহুরের কক্ষ অভিমুখে।

বনহুর তখন জোবাইদার পিঠ থেকে ছোরাখানা খুলে নিয়েছে। জোবাইদার মাথাটা তখন তার কোলে।

রহমান বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালো। জোবাইদার রক্তমাখা ভুলুণ্ঠিত দেহের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়লো। ততক্ষণে কায়েসও অন্যান্য কয়েকজন অনুচর গুলীভরা রাইফেল হস্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলেরই চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে।

সর্দারের কক্ষে জোবাইদাই বা এলো কি করতে এবং তাকে এভাবে ছোরাবিদ্ধ করলো কে সব যেন কেবল এলোমেলো লাগছে অনুচরদের কাছে।

রহমান ও অনুচরদের দিকে তাকিয়ে বনহুর ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো –আস্তানা থেকে আমাদের একজনও যেন বাইরে না বের হতে পারে।

রহমান বললো–সর্দার, সংকেত ধ্বনি হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাহারাদারগণ আস্তানার সমস্ত গুপ্তপথের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তারা সাবধানে পাহারা দিচ্ছে। একটি প্রাণীও আস্তানার বাইরে যেতে সক্ষম হবেনা! কিন্তু জোবাইদাকে কে এ ভাবে ছোরাবিদ্ধ করলো সর্দার?

ঐ প্রশ্ন আমার মনেও রহমান–কিন্তু সব কথা পরে হবে, তুমি শীঘ্র ঔষধ আনার ব্যস্থা করো যাও রহমান–

বনহুরের কথা শেষ হয়না, জোবাইদা ক্ষীণ জড়িত কণ্ঠে বলে উঠে–ঔষধ আর আনতে হবেনা–সর্দার, আমি তোমাকে হত্যা–করতে এসেছিলাম–পারলামনা–আমাকে তোমার শত্রু জেনেও–তুমি আমাকে ক্ষমা–করলে–আঃ–আঃ- উঃ বড় কষ্ট হচ্ছে–আমার–

জোবাইদা। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠস্বর বনহুরের। চোখে মুখে তার ফুটে উঠেছে একটা ব্যথা করুণ ভাব।

রহমান ঔষধ আনতে যায়নি এখনও যেতে পারেনি সে। জোবাইদার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলো। কায়েস চলে গেছে ঔষধ আনতে অবশ্য রহমানের ইংগিতেই গেছে সে।

বনহুর জোবাইদার মাথার চুলে-কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে তার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ দিয়ে অস্কুট ধ্বনি বেরিয়ে আসছে–জোবাইদা–জোবাইদা–

জোবাইদা বেশ হাপিয়ে পড়েছিলো খুব কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট ভাবে।

বলছে জোবাইদা–আমাকে যে হত্যা করলো তাকে আমি–দেখেছি কিন্তু আমি বলবোনা–আমি তাকে ক্ষমা করলাম সর্দার, সে যদি–ধরা পড়ে যায়–তাকে–তুমি–ক্ষমা–ক–রো–

জোবাইদার মাথাটা বনহুরের কোলের উপর কাৎ হয়ে ঢলে পড়লো।

বনহুরের কন্ঠ দিয়ে একটি শব্দ আর উচ্চারণ হলো না। চিত্রাপিতের মত বসে রইলো স্থির হয়ে কিছুক্ষণ। জোবাইদার কথা গুলিই পুনরাবৃত্তি হচ্ছিলো তার মনের মধ্যে–আমাকে যে হত্যা করলো তাকে আমি দেখেছি–কিন্তু আমি বলবোনা–আমি তাকে ক্ষমা করলাম—

বনহুর লক্ষ্য করেছে জোবাইদা যখন তার পায়ে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো তখন জোবাইদা একবার তাকিয়ে দেখেছিলো ওদিকের জানালাটা। যে জানালায় একটু পূর্বে বনহুর একখানা হাতকে দ্রুত সরে যেতে দেখছিলো।

কায়েস ঔষধ হস্তে ফিরে এলো কক্ষ মধ্যে।

বনহুর বললো–ঔষধ আর লাগবেনা কায়েস। জোবাইদা চির বিশ্রাম নিয়েছে। জোবাইদার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে রাখলো বনহুর।

সোজা হয়ে দাঁড়ালো বনহুর, গম্ভীর কঠিন তার মুখভাব বললো সে–রহমান এই মুহূর্তে জোবাইদার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করো। আমার অনুচরদের মধ্যেই কেউ তাকে ছোরা নিক্ষেপ করেছে। কে সে পাপিষ্ঠ তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আমি শপথ করলাম তাকে আমি নিজ হস্তে শাস্তি দান করবো।

রহমানের চক্ষুদ্বয় অপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো, গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বললো–সর্দার আমিও শপথ করছি যে জোবাইদার জীবন নাশ করলো তাকে আমি খুঁজে বের করবোই। আমার নিজের পিতা হলেও আমি তাকে মাফ করবো না।

জোবাইদার লাশ কান্দাই বনে দাফন করবার জন্য আদেশ দিলো বনহুর।

সমস্ত আস্তানা ব্যাপী একটা মহা হইচই পড়ে গেলো। কে হত্যা করেছে জোবাইদাকে কে সে ভয়হীন পাপিষ্ঠ?

বনহুর আস্তানার প্রত্যেকটা অনুচরকে তার দরবার কক্ষে আহ্বান জানালো।

 সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট দস্যু বনহুর।

সমস্ত শরীরে তার জমকালো ড্রেস, দস্যুর পোশাক। মুখমন্ডল কঠিন গাম্ভীর্যপূর্ণ, চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে।

আসনের সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান প্রত্যেকটা অনুচরের মুখোভাবে ফুটে উঠেছে একটা ভয়ার্তভাব।

বনহুর গর্জন করে উঠলো–জোবাইদাকে তোমরা কে হত্যা করেছো?

সমস্ত অনুচরগণ একবার মুখ তুলে তাকালো তাদের সর্দারের দিকে। আবার মাথা নত করে দাঁড়ালো সবাই, কারো মুখে কোন শব্দ বের হলো না।

বনহুর বুটের আঘাত করলো ভূতলে–জবাব দাও কে জোবাইদার জীবন নাশ করেছো? জবাব দাও?

সবাই এক সঙ্গে কম্পিত কণ্ঠে বললো–সর্দার, আমরা কেউ জোবাইদার জীবন নাশ করিনি।

একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো নূরী, বনহুর একবার সকলের অলক্ষ্যে তাকিয়ে দেখে নিলো নূরীর মুখোভাব। তার পাশে দাঁড়িয়ে নাসরিন আর বৃদ্ধা দাইমা, মনিও দাঁড়িয়ে আছে নূরীর পাশে।

আজকের দরবারে আস্তানার কেউ বাদ যায়নি, এমনকি বৃদ্ধা দাইমা এবং মনিও উপস্থিত ছিলো।

বনহুর প্রত্যেকের মুখভাব লক্ষ্য করে দেখছিলো।

কিন্তু কারো মুখোভাবে কোন রকম সন্দেহজনক লক্ষণ বনহুরের দৃষ্টিতে ধরা পড়লো না।

বনহুর এবার আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। সম্মুখের পাথরের টেবিলে জোবাইদাকে। যে চোরা দ্বারা নিহত করা হয়েছিলো, সেই ছোরাখানা একটি থালার উপরে রাখা হয়েছে। বনহুর তুলে নিলো ছোরাখানা হাতে তারপর আসন ত্যাগ করে নেমে এলো, অনুচরগণের সম্মুখে এক এক করে ছোরাখানা তুলে ধরলোকার এ ছোরা, জবাব দাও?

বনহুর ছোরাখানা যখন যার সম্মুখে ধরছিলো তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার মুখোভাব লক্ষ্য করছিলো। ছোরাখানা আসল অধিকারীর সন্ধানই বনহুরের উদ্দেশ্য।

আশ্চর্য হলো বনহুর যখন ছোরাখানা নাসরিনের সম্মুখে উঁচু করে ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বললো–এ ছোরাখানা তোমার কি না?

নাসরিনের মুখভাবে একটা বিস্ময়ভাব জেগে উঠলো মুহূর্তের জন্য পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে বললো নাসরিন সর্দার ছোরাখানা আমার নয়।

নাসরিনের কণ্ঠস্বর কেঁপে গেলো যেন।

বনহুরের ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে উঠলো, গর্জন করে উঠলো বনহুর রহমান, নাসরিন ছোরাখানা চিনতে পেরেছে।

বনহুরের ইংগিতে রহমান ও আরও কয়েকজন অনুচর নাসরিনের চারি পাশে রাইফেল উদ্যত করে ধরলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই নাসরিনকে মজবুত বরে বেঁধে ফেলা হলো।

বনহুর বললো– তুমি এই হত্যা ব্যাপারে অবগত আছো আমি বুঝতে পেরেছি নাসরিন। যদি নিজের মঙ্গল চাও তবে স্পষ্ট করে বলো–কার এ ছোরা, কে সে হত্যাকারী।

নাসরিন নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো কোন জবাব দিলো না।

বনহুর এবার রহমানকে আদেশ দিলো–নাসরিন যতক্ষণ না জোবাইদার হত্যাকারীর নাম বলেছে ততক্ষণ তাকে অন্ধকার কারাকক্ষে বন্দী করে রাখবে এবং রোজ তাকে শাস্তিদানপূর্বক আসল কথা উদঘাটনের চেষ্টা করবে।

তখনকার মত দরবার শেষ হলো।

অনুচরগণের মধ্যে এতোক্ষণ একটা ভীতিকর ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিলো সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যদিও তারা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নয়, কারণ এখনও জোবাইদার হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাসরিনকে বন্দী করা হলো সন্দেহজনকভাবে। নাসরিনের বলার উপর এখন নির্ভর করছে জোবাইদার হত্যাকারীর জীবন।

কে সে হত্যাকারী, কি-ই বা উদ্দেশ্য ছিলো তার জোবাইদাকে হত্যা করার পিছনে?

 বনহুর দরবার কক্ষ ত্যাগ করলো। রহমানও তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো।

 কয়েকজন অনুচর নাসরিনকে বন্ধন অবস্থায় নিয়ে চললো অন্ধ কারাগার অভিমুখে।

*

দু’দিন পর।

 বনহুর তার নিজের কক্ষে শয্যায় বসা।

 রহমান তার সম্মুখে দন্ডায়মান।

বনহুর বললো–রহমান আজ থেকে তিন দিন পূর্বে জোবাইদা নিহত হয়েছে।

হাঁ, সর্দার।

আজও জোবাইদার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো না। একটু নিশ্চুপ থেকে বললো আবার বনহুর–আমার আস্তানাতেই আছে জোবাইদার হত্যাকারী আমি বুঝতে পেরেছি।

সর্দার।

হাঁ, আমি ফিরে এসে বিচার করবো। রহমান তুমি সমস্ত আস্তানায় সতর্ক পাহারা নিযুক্ত রাখবে–আমার আস্তানা ছেড়ে একটি প্রাণীও যেন বাইরে না যায়।

রহমান নত মস্তকে বললো–আদেশ ঠিকভাবেই পালন হবে সর্দার।

বনহুর উঠে এবার পায়চারী করতে লাগলো। ললাটে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তারেখা।

 রহমান সর্দারের মুখোভাব লক্ষ্য করে চিন্তিত হলো।

বনহুর কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললো–রহমান তাজকে প্রস্তুত করো আমি এক্ষুণি রওয়ানা দেবো। কথা শেষ করে শয্যায় এসে বসলো বনহুর।

রহমান কুর্নিশ জানিয়ে প্রস্থান করলো।

 বনহুর তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো।

রহমান কুর্নিশ জানালো সর্দারকে। অন্যান্য অনুচরগণ তারাও কুর্নিশ জানিয়ে তাজের দুই পাশে সরে দাঁড়ালো।

বনহুর লম্ফ দিয়ে তাজের পিঠে উঠে বসলো।

বহুদিন পর তাজ প্রভুকে নিজ পৃষ্ঠে পেয়ে আনন্দিত হলো, সম্মুখের পা দু’খানা উঁচু করে শব্দ করে উঠলো–চি চি–

তারপর ছুটতে শুরু করলো তাজ।

ভূগর্ভের সুড়ঙ্গ পথ প্রকম্পিত হয়ে উঠলো তাজের পদ শব্দে।

নিমিষে অশ্বপৃষ্ঠে রহমান নূরী, অদূরে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলো সে।

 রহমান এগিয়ে এলো নূরীর পাশে।

নূরী জিজ্ঞাসা করলো-বনহুর কোথায় চললো রহমান?

সর্দার কোনদিন বলে যায়না নূরী, তবে হাঁ যখন বলার মত হয় বলে যায় বটে। আচ্ছা নূরী, আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি আজকাল সব সময় সর্দারকে এড়িয়ে চলো কেনো? কই আজ সে কোথায় গেলো বা যাচ্ছে–একটিবার কাছেও এলেনা জিজ্ঞাসাও করলেনা–ব্যাপার কি বলো তো?

নূরী একটু ম্লান হাসি হেসে বললো–বনহুরের পাশে যাওয়া আমার মানা তুমি বুঝি জানোনা?

ও তাই নাকি, কিন্তু এতোদিন তো কোন মানা ছিলোনা।

ছিলোনা কিন্তু–নূরী কিছু বলতে গিয়ে থেমে পড়লো।

রহমান আর নূরী এগুচ্ছে আস্তানার অভ্যন্তরে।

বললো রহমান–আস্তানার অনেকেই তোমার আর সর্দারের মিলামিশা ভাল নজরে দেখতোনা। এ নিয়ে অনেক কথাও উঠেছে আস্তানায় অনুচরদের মধ্যে। কিন্তু সর্দারের ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহসী হয়নি। একমাত্র জোবাইদাই প্রতিবাদ জানিয়েছিলো এ ব্যাপারে।

হাঁ জোবাইদাই প্রতিবাদ জানিয়েছিলো।

 আচ্ছা নূরী?

বলো রহমান।

জোবাইদাকে আমাদের আস্তানায় কোন ব্যক্তি ছোরা নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে তাই নয় কি?

জানিনা সে কথা।

জানোনা কিন্তু আস্তানার সকলকেই এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সর্দার নাসরিনকে বন্দী করে রাখলেও আসল হত্যকারীর সন্ধান তিনি জানেন।

নূরী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–তাহলে তুমি তাকে হত্যা করেছো রহমান?

আমার সঙ্গে জোবাইদার মনোমালিন্যের কারণ?

কিছু না থাকলেও জোবাইদার এমন কোন কাজ করতে যাচ্ছিলো যার জন্য বনহুরের যে কোন অনুচর তাকে হত্যা করতে পারে।

নূরী তুমি তাহলে জোবাইদা হত্যারহস্য অবগত আছো?

 রহমান, আমাকে তুমি অবিশ্বাস করছো?

হাসলো রহমান তোমাকে অবিশ্বাস করবার মত সাহস আমার আছে নাকি? কিন্তু নূরী মনে রেখো জোবাইদাকে যেই হত্যা করে থাকুক না কেননা সর্দার জানেন।

নূরী আর কোন কথা বলে না চলে যায় সে নিজের কক্ষের দিকে।

 রহমানের ভ্রূকুঞ্চিত হলো।

রাত বেড়ে আসছে দেখে রহমান চলে গেলো তার দলবলকে সজাগ করে দিতে–একটি প্রাণীও যেন আস্তানার বাইরে যেতে না পারে। নিজেও সে রাইফেল হস্তে ঘুরে ঘুরে সব দিকে লক্ষ্য করতে লাগলো।

সমস্ত আস্তানা ঝিমিয়ে পড়েছে।

যে যার বিশ্রাম স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছে।

কয়েকজন সশস্ত্র দস্যু কড়া পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে তাদের ভারী বুটের আঘাতে পাথুরিয়া মাটিতে প্রতিধ্বনি জাগছে খট খট খট–

লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দস্যু বনহুর এ আস্তানা তৈরি করেছে। কঠিন পাথর কেটে কেটে তৈরি হয়েছে সুড়ঙ্গ পথ। তিরিশ জন বলিষ্ঠ দস্যু অবিরত পরিশ্রম করেছে প্রায় এক বৎসরকাল। কান্দাই পর্বতের নিচে এই আস্তানা, আস্তানায় প্রবেশের সুড়ঙ্গমুখ পর্বতেরই একটি গুহার মধ্যে।

কান্দাই জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এ পর্বত। পর্বতের পাদমূলে গহন জঙ্গল। বাইরের কোন লোক সমাজে এ জঙ্গলে ভুলেও প্রবেশ করতে সক্ষম হয়না। হিংস্র জীবজন্তুর ভয় তো রয়েছেই তাছাড়া এ জঙ্গলে দস্যু বনহুরের আস্তানা একথাও অনেকেরই জানা আছে। স্পষ্টভাবে না জানালেও লোক সমাজে আতঙ্কের সীমা নেই এ জঙ্গল সম্বন্ধে।

পুলিশ মহলেও জঙ্গল সম্বন্ধে নানারকম ধারণা আছে। একবার মিঃ জাফরী জঙ্গল মধ্যস্থ পোড়ো রাজবাড়ী আস্তানাতে হানা দিয়ে বনহুরের বহু সংখ্যক অনুচরকে হত্যা করেছিলো এবং কয়েকজনকে বন্দীও করেছিলো তারা। কিন্তু দস্যু বনহুর তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচররের সন্ধান। পুলিশ বাহিনী পায়নি।

এই সংঘর্ষে শুধু দস্যু বনহুরের অনুচরই নিহত হয়নি, অনেক পুলিশ ফোর্সও জীবন দিয়েছিলো।

এই সংঘর্ষের পর দস্যু বনহুর নতুনভাবে তৈরি করেছিলো তার এই পর্বত তলে ভূগর্ভের আস্তানাটি। শুধু লোক চক্ষুর অন্তরালেই নয়, কোন ভূতত্ত্ববিদও সমস্ত বছর ধরে অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে না।

রহমান এই ভূগর্ভ আস্তানারই সতর্ক পাহারদার হিসাবে পাহারায় রত ছিলো।

আস্তানার বিভিন্ন স্থানের আলোগুলি এখন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

কোন কোন জায়গায় দেয়ালের গোঁজা মশাল থেকে নিভু নিভু আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছিলো। সেই আলোকরশ্মি ভূগর্ভ আস্তানার গাঢ় অন্ধকারকে আরও বিভীষিকাময় করে তুলছিলো।

জোবাইদার মৃত্যুর পর সমস্ত অনুচরগণের মনে একটার গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিলো। দস্যু হলেও তারা তো মানুষ। মন-প্রাণ-হৃদয় সব আছে তাদের। জোবাইদার মৃত্যুতে আস্তানার অনেকেই দুঃখ পেয়েছিলো ভীষণভাবে। আবার অনেকের প্রাণে জেগেছিলো ভীতিভাব। না জানি জোবাইদার মৃত্যুর জন্য কার নসীবে কি আছে কে জানে।

রহমান রাইফেল হস্তে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলো নিস্তব্ধ আস্তানার মধ্যে।

হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি তার সম্মুখ দিয়ে চলে গেলো। চমকে সরে দাঁড়ালো আড়ালে রহমান। পরক্ষণেই অনুসরণ করলো সে ছায়ামূর্তিটিকে। অতি অন্তর্পণে এগুতে লাগলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।

ছায়ামূর্তি এগুচ্ছে সম্মুখের দিকে।

রহমানের বুকের মধ্যে ধক ধক করছে যদিও সে একজন নির্ভীক দস্যু। তবুও আজ কেননা, যেন এমন একটা মনের মধ্যে দুর্বলতা বোধ করছে সে।

দস্যু বনহুরের আস্তানায় ছায়ামূর্তি।

কে এই ছায়ামূর্তি? রহমান রাইফেল ঠিক রেখে ছায়ামূর্তিটিকে অনুসরণ করলো।

ছায়ামূর্তি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

রহমান ফলো করছে তাকে।

 দেয়ালের আড়ালে থামের পাশে আত্মগোপন করে অগ্রসর হচ্ছে ছায়ামূর্তি।

হঠাৎ রহমান বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। ছায়ামূর্তির পিছনে পিছনে সে অগ্রসর হচ্ছিলো। সম্মুখস্থ একটি দেয়ালের পাশে এসে ছায়ামূর্তি মুহূর্তে অদৃশ্য হলো।

সঙ্গে সঙ্গে রহমান তার রাইফেল থেকে গুলী ছুড়লো, পর পর কয়েকটা, কিন্তু কোন আর্তনাদই ফুটে উঠলো না সেখানে।

রহমানের গুলীর শব্দে অন্যান্য অনুচরগণ ছুটে এলো অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে। এক একজনের চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। এই মুহূর্তে তারা যেন শত্রুকে পেলে পিষে মারবে এমনি সকলের মনোভাব।

কায়েস বললো–কি হয়েছে রহমান?

রহমানের চোখের ধাঁধা তখনও কাটেনি, কায়েসের প্রশ্নের জবাবে বললো সে–আশ্চর্য, জোবাইদার আত্মা এসেছিলো এখানে।

আত্মা! এক সঙ্গে কায়েস ও আরও কয়েকজন উচ্চারণ করলো।

রহমান বললো–হাঁ, জোবাইদার আত্মাই হবে, ঠিক সেই রকম পোশাক পরা একটা ছায়ামূর্তি আমি দেখেছি।

কোথায়? বললো কায়েস।

 ঐখানে দেয়ালে মিশে গেছে।

দেয়ালে মিশে গেছে। আশ্চর্য তো?

 হাঁ, আশ্চর্যই বটে। রহমান ধীরে ধীরে কথাটা উচ্চারণ করলো।

ততক্ষণে দাইমা, নূরী, মনিও ঘুম থেকে জেগে এসে দাঁড়িয়েছে অন্যান্য অনুচরদের পাশে। রহমানের কথা শুনে সকলেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ কম কথা নয়–জোবাইদার প্রেত আত্মা।

দস্যু বনহুরের আস্তানায় জোবাইদার প্রেত আত্মা।

সমস্ত আস্তানা জুড়ে একটা ভয়ানক আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। জোবাইদার আকস্মিক মৃত্যুতে একেই সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলো তারপর আবার প্রেত আত্মা–জোবাইদার প্রেত আত্মা।

*

বনহুর জুলেখার লেবরেটরীতে প্রবেশ করতেই জুলেখা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সাদর সম্ভাষণ জানালো –হ্যালো মঞ্জুর সাহেব।

বনহুর হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানালো–মিস্ জুলেখা, ভাল তো?

জুলেখার চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে যেন, বললো সে–ভাল আছি, আপনি?

 খুব ভাল না।

জুলেখা কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি টেনে বললো–কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?

না, শারীরিক নয়–মানসিক। মনিরা কেমন আছে?

জুলেখা গলার স্বর স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো– মনিরা ভাল আছে। ওর চোখের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভাল।

ধন্যবাদ মিস জুলেখা। আপনার অনুগ্রহে মনিরা আজ তার হারানো দৃষ্টি ফিরে পেতে চলেছে–আচ্ছা ওর সঙ্গে দেখা করে আসি কেমন? বনহুর জুলেখার জবাবের প্রতীক্ষা না করে বেরিয়ে গেল লেবরেটরী হতে।

জুলেখা চিত্রাপিতের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একটু পূর্বে যে মুখে রাশিকৃত আনন্দ ঝরে পড়ছিলো, নিমিষে সব আনন্দ কোথায় যেন উবে গেলো কপুরের মত। মুখমন্ডল অন্ধকার বিষণ্ণ হয়ে উঠলো।

বনহুরের আগমনে জুলেখার মনে একটা অপূর্ব অনুভূতি দোলা জাগিয়েছিলো। খুশির আবেগে আত্মবিস্মৃতি ঘটেছিলো তার। ভুলে গিয়েছিলো মঞ্জুর সাহেব তার সীমার মধ্যে নয়।

সহকারী ডক্টর হামিদের কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে আসে জুলেখার। ডক্টর হামিদ তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছেন–সিষ্টার রোগীকে বসিয়ে রেখে এসেছেন, সে এখন ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।

সরি। চলুন–একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ত্যাগ করে অগ্রসর হলো জুলেখা।

একটি রোগীকে বসিয়ে এসেছিলো জুলেখা তার লেবরেটরী কক্ষে, জরুরি কোন একটা কাজে। এসে তখনই ফিরে যাবে, এই উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলো সে। মঞ্জুর সাহেব এসে পড়ায় তার বিলম্ব হয়ে গেছে।

জুলেখা রোগী দেখা শেষ করে ফিরে এলো তার লেবরেটরী কক্ষে। হঠাৎ মনে পড়লো মঞ্জুর সাহেবের কথা, তাছাড়া এখন মনিরার ইনজেকসানের সময় হয়েছে। জুলেখা সিরিঞ্জে ঔষধ ভরে নিয়ে মনিরার কক্ষে প্রবেশ করলো। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো জুলেখা। তার হাত থেকে খসে পড়লো ঔষধ সহ সিরিঞ্জটা। ভূতলে খান খান হয়ে ভেঙে গেলো।

বনহুর মনিরাকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে ফিরে তাকালো।

জুলেখা পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে মেঝেতে। পায়ের কাছে টুকরো ভাংগা সিরিঞ্জের খন্ডগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে। এক রাশ কালি কে যেন মেখে দিয়েছে জুলেখার মুখে।

বনহুর হাস্যউজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসে কি হলো?

জুলেখা কোন কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

 বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো জুলেখার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে।

মনিরার দৃষ্টিশক্তি নেই, সে কিছুই বুঝতে না পেরে বসে থাকে নিশ্চুপ।

 বনহুর মনিরার পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলো।

মনিরা স্বামীর হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠে–কি হলো? আমি কিছু বুঝতে পারছি না যে?

বনহুর মনিরার পাশে বসে পড়ে বললো–মনিরা একদিন আমাকে মিথ্যা সন্দেহ করেছিলে, এবং সে জন্য জীবন নাশ করতেও গিয়েছিলে হরিদ্রা সাগর বক্ষে।

আজ কেন আবার সে কথা তুলছো?

না বলে উপায় নেই মনিরা বলতেই হবে।

 বলো?

তোমার বান্ধবী তোমার স্বামীকে ভালবেসে ফেলেছে মনিরা।

কি বললে। কি বললে তুমি?

অতো ধৈর্যহারা হলে আমি নাচার। যদি স্থির হয়ে শোন তবে আমি বলতে পারি।

বলো শুনবো আমি বলো? আর কোন কথা আমি বলবো না। মনিরা স্বামীর দক্ষিণ হাত চেপে ধরে মুঠায়।

বনহুর বলে চলে–তোমার বান্ধবী মঞ্জুর সাহেবকে ভালবেসে ফেলেছে এবং তাকে না পেলে তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবার উপক্রম–

না না, আর আমি শুনতে চাইনা। নিয়ে চলো আমাকে। চাইনা আমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে। চাইনা–চাইনা–চাইনা–

মনিরা এজন্যই আমি তোমাকে এতোদিন বলিনি কোন কথা। ধৈর্য ধরে সব শুনে যাও। তারপর যা ভাল মনে করো বলো।

কিন্তু এখানে আর এক মুহূর্ত আমি থাকতে চাইনা।

তোমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে চাও না?

না চাই না। আমি চিরদিন অন্ধ হয়ে থাকবো তবুও—

 মনিরা এতো অধৈর্য তুমি। আমি কি তাকে ভালবেসেছি? আমি কি তাকে চাই? কেনো। কেনো তুমি বুঝোনা! মনিরা জীবনে বহু নারীর সান্নিধ্য লাভ আমার ঘটেছে কিন্তু কোন নারীর প্রেমা আমাকে পথচ্যুত করতে সক্ষম হয়নি। তুমি বিশ্বাস কর আমাকে, কোনদিন পথচ্যুত হইনি। মনিরা, জুলেখা জানোনা তুমি আমার স্ত্রী তাকে কথাটা না বলে ভুল হয়েছে। বললো হয়তো এতোটা হতে পারতোনা। একটু নিশ্চুপ থাকার পর বললো বনহুর–মনিরা সব খুলে বলবো আজ তোমার বান্ধবীর কাছে।

না না, তার চেয়ে চলো আমরা চলে যাই এখান থেকে। কাজ নেই আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এনে–

বনহুর রাগতভাবে বললো–তুমি চুপ করে থাকো মনিরা যা করতে হয় বা বলতে হয় আমি জানি। আমি জুলেখার ভুল ভেঙে দিতে চাই।

বনহুর আর বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো কক্ষ হতে। প্রথমে চ্যাম্বারে প্রবেশ করে দেখলো জুলেখা সেখানে নেই। লেবরেটরীতেও নেই। বিস্মিত হলো বনহুর–গেলো কোথায় সে তবে। বনহুর যখন জুলেখার অন্বেষণে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো ঠিক সেই সময় তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো একটা দারওয়ান।

বনহুর তাকে লক্ষ্য করে বললো –ডক্টর কাঁহা, দেখ্যা তুম?

হাঁ দেখ্যা বাবুসাহাব, ডক্টর আপামনি বাগানকা তরফ গিয়া।

বনহুর এবার বাগানের দিকে অগ্রসর হলো। জুলেখাদের বাড়ির সম্মুখেই ছিলো বাগানটা। প্রায় এক বিঘা জমি নিয়ে মস্ত বাগান। নানা রকম ফুলের সমারোহ ছিলো এ বাগানে। জানা অজানা কত রকম গাছ-গাছড়ায় ভর্তি। বাগানের দক্ষিণ দিকে মস্ত বড় পুকুর ছিলো একটা। পুকুর পাড়ে অনেকগুলি পাইন গাছ গোলাকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই সান বাধানো ঘাট। পুকুরের পানিতে ভাসছে পদ্মপাতা, মাঝে মাঝে দু’চারটা পদ্মফুলও ফুটে রয়েছে। সখ করে জুলেখার আব্বা পুকুরে পদ্মগাছ লাগিয়েছিলেন। আগে অসংখ্য পদ্মফুল ফুটে থাকতো পুকুরের পানিতে। আজ যদিও সেরকম নেই, তবু দু’চারটা পদ্মফুল পুকুরের শোভা বর্ধন করে থাকে এখনও।

এই পুকুরঘাটেই বসেছিলো জুলেখা, মুখোভাব গম্ভীর বিষণ্ণ সব আশা-বাসনা যেন নিমিষে মুছে গেছে তার জীবন থেকে আজ পর্যন্ত তাকে বহু পুরুষের সাথে মিশতে হয়েছে, কিন্তু কাউ-ে কই সে ভালবাসতে পারেনি কোনদিন অন্তর দিয়ে। অনেকেই তার কাছে এসেছে, প্রেম নিবেদন। জানিয়েছে–সবাইকে কেমন যেন স্বার্থপর মনে হয়েছে। কাউকে জুলেখা তেমন করে বিশ্বাস করতে পারেনি।

জুলেখা শিক্ষিতা–আদর্শবতী বিদুষী যুবতী। চরিত্রাহীনা বা কু’মনোবৃত্তি মেয়ে সে নয়। যে কোন পুরুষকে সে ভালবাসতে পারবে না, বা পারেনি কোনদিন। কিন্তু তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। মঞ্জুর সাহেবের কাছে পরাজিত হয়েছে সে। নিজের অজ্ঞাতে ভালবেসে ফেলেছে কখন তাকে।

মঞ্জুর সাহেবকে দেখার পর জুলেখা নিজ অন্তরে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছে। সব সময় নানা কাজে লিপ্ত থেকেও বিস্মৃত হতে পারেনি এক দন্ডের জন্যও তাকে। হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে সর্বক্ষণ কামনা করে এসেছে মঞ্জুর সাহেবকে। অনেক সময় জুলেখা নিজেই ভেবে পায়নি, তার মনের এই অহেতুক ভাবান্তরের কারণ কি? সে সম্পূর্ণভাবে জানে, মঞ্জুর সাহেব আর মনিরার মধ্যে কোন সংযোগ রয়েছে। না হলে মঞ্জুর সাহেব মনিরার জন্য এতো করতোনা, পড়ে থাকতো না তাদের এখানে। এতো জেনেও জুলেখা কেননা নিজের মনের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো মঞ্জুর সাহেবকে।

জুলেখার গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা অশ্রু।

ঠিক সেই মুহূর্তে পিছনে এসে দাঁড়ায় বনহুর–মিস জুলেখা!

জুলেখা চট করে হাতের পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে, কোন জবাব দেয়না।

বনহুর পুনরায় ডাকে–মিস জুলেখা, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা জরুরি কথা আছে।

জুলেখা এবার চোখ তুলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে তারপর বললো–বলুন?

বনহুর জুলেখার নিকট হতে একটু দূরে এসে পড়লো। তারপর বললো–মিস জুলেখা, প্রথমেই আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। কারণ একটা ভুল হয়ে গেছে, যার জন্য আমি এবং মনিরা উভয়েই আপনার কাছে অপরাধী।

জুলেখা নতমুখে বসে রইলো আঁচল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো সে।

বনহুর বললো আবার–আপনি না জেনে হয়তো ভুল করে ছিলেন যার জন্য আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। মনিরা আমার বিবাহিতা স্ত্রী….।

জুলেখা নিজের অজ্ঞাতে চমকে উঠলো, দু’চোখে রাশিকৃত বিস্ময় নিয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, তারপর অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো-মনিরা আপনার স্ত্রী!

হা, মিস জুলেখা। কিন্তু লোকসমাজ জানে না একথা, সবাই জানে–মনিরা আজও অবিবাহিতা!

তার মামীমা, তার বাড়ির সবাই?…

 মামীমা আর সরকার সাহেব ছাড়া তাদের বাড়ির কেউ জানে না।

জুলেখা বিস্ময়াবিষ্টের মত বসে রইলো চুপ করে, তার কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হলো না।

বনহুর জুলেখার দিকে তাকিয়ে বললো আবার–মিস্ জুলেখা আমি দোষী। সত্য কথা না বলার জন্য চরম অপরাধী…একটু চুপ করে থেকে আবার বললো সে–আপনার অনুগ্রহ ছাড়া মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসবে না। মিস জুলেখা, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন…

মঞ্জুর সাহেব!

মিস জুলেখা..

আমি কথা দিলাম মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আনতে আমি নিজেকে নিঃশেষ করে দেবো, তবুও চেষ্টা থেকে ক্ষান্ত হবো না।

মিস জুলেখা। বনহুরের কণ্ঠে ঝরে পড়ে রাশিকৃত কৃতজ্ঞতা।

বনহুর ও জুলেখার যখন বাগান বাড়িতে পুকুর ঘাটে কথা হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে নাজির শাহ। জুলেখার খোঁজে সে এ কক্ষে প্রবেশ করেছে। মনিরাকে দেখতে পেয়েই থমকে দাঁড়ায় নাসির শাহ অবাক হয়ে যায় সে। মনিরাকে চিনতে ভুল হয় না।

এতোদিন ধরে মনিরা আর বনহুর জুলেখাদের বাড়ি রয়েছে কিন্তু নাসির শাহ তার সন্ধান জানে না। কারণ সে কোন দিন বাড়ির খোঁজখবর রাখতো না। বাড়ি ফিরতো গভীর রাতে আবার বেরিয়ে যেতো খুব ভোরে সারাদিন ইন্ডাষ্ট্রি দেখাশুনার নাম করে কাটিয়ে দিতো তার গোপন আড়া ক্লাব আর জুয়াখেলায়। মদ না খেলে একদিনও তার চলতো না। গভীর রাতে মদের নেশায়। টলতে টলতে বাড়ি ফিরতো। বাড়ি-ঘর-সংসার বলে তার কোন অনুভূতি ছিলো না। ক্লাব আর। গুন্ডাদের নিয়েই কাটাতো সে সারাটাক্ষণ।

আজ হঠাৎ জুলেখার সন্ধানে এসে দেখতে পেলো মনিরাকে। নাসির শাহর চোখ দুটো চক চক করে উঠলো লালসায়। বিস্মিত হলো না সে, কারণ বুঝতে পারলো, জুলেখা আইজ স্পেশালিস্ট তাই মনিরা এসেছে জুলেখার কাছে চক্ষুর চিকিৎসার জন্য।

নাসির শাহ জানে–মনিরা দৃষ্টিহীন, কজেই মনিরাকে এখন হাতের মুঠায় পেয়েছে। নাসির শাহ মনিরার দিকে অগ্রসর হলো।

এমন সময় বনহুর আর জুলেখা প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

 পদ শব্দে ফিরে তাকালো নাসির শাহ!

জুলেখা আর একটি লোককে তার সঙ্গে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো মাঝপথে, একটু হেসে বললো নাসির শাহজুলেখা, তোমাকেই খুঁজছিলাম। তা ইনি কে?

বনহুরকে দেখিয়ে বললো নাসির শাহ।

নাসির শাহকে মনিরার কক্ষে দেখেই জুলেখার মুখ গম্ভীর কঠিন হয়ে উঠেছিলো, বললো, সে-ইনি আমার বান্ধবী মনিরার স্বামী মিঃ মঞ্জুর সাহেব।

ক্ষণিকের জন্য নাসির শাহর মুখভাব গম্ভীর হয়ে পড়লো! তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো সে বনহুরের মুখের দিকে।

জুলেখা বললো-মঞ্জুর সাহেব, এ আমার বড় ভাই নাসির শাহ।

বনহুর নাসির শাহর দিকে দক্ষিণ হাতখানা এগিয়ে দিলো। হ্যান্ডসেক করার জন্য।

নাসির শাহ অনিচ্ছা সত্বেও হাতখানা বাড়ালো বনহুরের দিকে।

 জুলেখা বললো–ভাইয়া, কি দরকার তোমার আমাকে?

এখন নয়, পরে বলবো। নাসির শাহ বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

তখনকার মত নাসির শাহ বেরিয়ে গেলেও মনিরার নেশা তাকে উম্মত্ত করে তুললো।

সোজা নাসির শাহ হাজির হলো গিয়ে তার গোপন আড্ডায়।

কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিলো নাসির শাহের, যাদের দ্বারা সে তার মন্দ কাজগুলি সমাধা করতো।

নাসির শাহকে দেখেই তারা এগিয়ে এলো।

গোল টেবিলে গোলাকার হয়ে বসলো সবাই।

বয় মদের বোতল আর গেলাস এনে রেখে গেলো টেবিলে।

প্রতিদিন এ টেবিলে বসে নানা রকম কু’পরামর্শের অন্ত নেই তাদের। কোথায় কার সর্বনাশ করবে, সদা এই নিয়েই চলতো আলাপ আর আলোচনা। আজকের আলোচনার বিষয় হলো অন্ধ মনিরা।

নাসির শাহ তার প্রধান সহকারী রাজকে বললো–পেয়েছি, আর আমার হাতের মুঠো থেকে ফসকে যাবে না। কিন্তু ভেবেছিলাম মনিরাকে বিয়ে করবো…

রাজ দাঁত মুখ ভেংচে বললো–আরে ছোঃ একটা অন্ধ মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে নাসির?

তা হচ্ছে কই বন্ধু, মনিরা শুধু অন্ধই নয়–বিবাহিতা।

 অবাক কণ্ঠে বললো রাজ–চৌধুরী মেয়ে মনিরা বিবাহিতা। অবাক করলে বন্ধু?

কেনো, এতে এমন অবাক হবার কি আছে রাজ?

আরে তুমি শুধু অর্থ আর নারীই বোঝ, আর আমরা সবদিকে তাল দিয়ে চলি। দুনিয়ার কোথায় কি ঘটছে সব আমাদের নখদর্পণে।

তাতো বুঝলাম, কিন্তু মনিরার বিয়ে হয়নি, তবে জুলেখা মিথ্যা কথা বলেছে। ঠিক, আমাকে সে ধোকা দিয়ে একটা ভেঁড়া বুঝ বুঝিয়েছে…

যেমন তুমি ভাই, তেমনি তোমার বোন। শোন নাসির, চৌধুরী মেয়ে মনিরাকে ভালবাসে দস্যু বনহুর…শুধু ভালবাসা-বাসি নয়, একেবারে গভীর প্রেম যাকে বলে। কাজেই এমন মেয়ের বিয়ে…নাঃ আমার কেমন সন্দেহ লাগছে।

দস্যু বনহুর মনিরাকে ভালবাসে এ কথা আমিও জানি। তাই বলে শহরে মনিরার সঙ্গে মাখামাখি করবে এমন সাহস তার হবেনা।

দস্যু বনহুরকে তুমি চেনোনা বাছাধন, দেখলে তো কেমন করে শত শত পুলিশ বাহিনীর চোখে দুলো দিয়ে হাওয়ায় উড়ে গেলো। যার জন্য তুমি বেচারাও নাজেহাল পেরেশান কম হলেনা। পুলিশের হাওলা হয়ে হাঙ্গেরী কারাগারটাও দেখে এলে।

এটা আমার কপাল জোর বন্ধ। কারণ কান্দাই-এ বহু লোকই আছে কিন্তু এমন সৌভাগ্য ক’জনার ভাগ্যে জোটে বলো, দস্যু বনহুর সেজে পুলিশকেও ঘাবড়ে তুলেছিলাম।

হেসে উঠে বলে রাজ–আর একটু হলে হয়েছিলো আর কি।

 দস্যু বনহুর ভেবে তোমাকেই ত্রিফলায় বিদ্ধ করে…বাস্ বুঝেছেই।

নাসির শাহকে অতো বোকা পাওনি রাজ। ত্রিফলায় বিদ্ধ হবার পূর্বে আমিও গলায় ফাঁস লাগিয়ে পগার পার হতাম।

খাসা বুদ্ধি হে নাসির তোমার, খাসা বুদ্ধি। বনহুর বেটা এতো নাজেহাল পেরেশান হবার চেয়ে, বাপু তোমার বুদ্ধিটা বেছে নিলেই পারে।

হাঁ, তাহলেই লেঠা চুকে যায়, কি বলো…

ঠিক সেই মুহূর্তে সম্মুখস্থ টেবিলে একখানা ছোরা এসে খচ করে গেঁথে গেলো।

বিস্ময়ে চমকে উঠলো নাসির শাহ ও রাজ, সঙ্গে সঙ্গে কক্ষস্থ অন্যান্য সবাই উঠে দাঁড়ালো আতঙ্কগ্রস্তভাবে।

নাসির শাহ ছোরাখানা হাতে তুলে নিতেই দেখতে পেলো–এক খন্ড কাগজ ছোরায় গাঁথা রয়েছে।

নাসির শাহ ছোরা থেকে কাগজখানা খুলে নিয়ে চোখের সম্মুখে মেলে ধরেই অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো–দস্যু বনহুর।

গোল টেবিলের চার পাশে যারা এখনও বসেছিলো, সবাই এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–কি বললে, দস্যু বনহুর!

সকলের মুখের কথা মুখেই রইলো। জমকালো একটা মূর্তি তাদের পিছনে এসে দাঁড়ালো, দুই হস্তে রিভলভার।

নাসির শাহর হাত থেকে কাগজের টুকরাটা খসে পড়লো। কক্ষস্থ সকলেই মুখমন্ডল ভয়ে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। কারো মুখে কোন কথা সরলো না।

নাসির শাহর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠলো। থর থর করে কাঁপছে, চোখে-মুখে অসহায়ের চাহনী। রাজ একটু সাহসী ধরণের লোক, এক নম্বরের গুন্ডা বলা চলে। রাজ চট করে ছোরাখানা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিয়ে দাঁড়ালো।

ছায়ামূর্তি অন্য কেহ নয় স্বয়ং দস্যু বনহুর।

বৈকালে জুলেখার সঙ্গে বনহুর যখন মনিরার কক্ষে প্রবেশ করেছিলো, তখন মনিরার কক্ষে প্রথম নাসির শাহকে দেখেই বনহুর তার মনোভাব অনুমেয় করে নিয়েছিলো। সুচতুর বনহুরের কাছে নাসির শাহর কুৎসিৎ মনোবৃত্তি গোপন ছিলো না, যদিও সে নিজেকে সংযত করে নিতে যথাসাধ্য চেষ্ট করেছিলো।

নাসির শাহ যেন তাড়াতাড়ি সরে পড়তে পারলে বেঁচে যায়, এমনি ভাবেই সরে পড়েছিলো।

বনহুর জুলেখার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বললেও তার মনের মধ্যে তখন নাসির শাহই উঁকিঝুঁকি মারছিলো। বনহুর বেশিক্ষণ জুলেখার সঙ্গে মনিরার কক্ষে ছিলো না, বেরিয়ে এসে আড়াল থেকে লক্ষ্য করছিলো নাসির শাহকে।

রাজ টেবিল থেকে ছোরাখানা হাতে তুলে নিতেই বনহুর বুটের এক লাথি দিয়ে তার হাত থেকে ছোরাখানা ছিটকে ফেলে দিলো দূরে। গম্ভীর কণ্ঠে বললো সেনাসির শাহ, যে মতলব নিয়ে বুদ্ধির প্যাঁচ খেলছো–তা থেকে ক্ষান্ত থাকবে নচেৎ তোমার মৃত্যু অনিবার্য।

কথা শেষ করার পূর্বেই বনহুর রিভলভার চেপে ধরেছিলো নাসির শাহের বুকে, এবার নাসির শাহর পকেট থেকে দশ হাজার টাকার নোটের একটা ফাইল বাম হস্তে তুলে নিলো। ইতিমধ্যে বনহুর তার বামহস্তের রিভলভারখানা প্যান্টের পকেটে রেখেছিলো।

এক ঘর লোক থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, কেউ একটু টু-শব্দ করতে পারলো না।

 বনহুর যেমন এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো।

 কিছুক্ষণ করো মুখে কারো কথা নেই, সবাই যেন একটা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো।

পরক্ষণেই হুস হলো রাজের, দাঁতে দাঁত পিষে বললো–ফোন, ফোন করো নাসির…পুলিশ অফিসে ফোন করো–দস্যু বনহুর এসেছিলো এখানে।

নাসির শাহর মুখ মরার মুখের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। শুধু মৃত্যু ভয়ই দস্যু বনহুর তাকে দেখিয়ে গেলো না, নিয়ে গেছে তার দশ হাজার টাকা।

রাজের কথায় হুশ হলো নাসির শাহর, হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো নাসির শাহরাজ, পুলিশ অফিসে ফোন করে আর কি হবে। দস্যু বনহুর কি আর দশ হাজার টাকা ফেরৎ দেবে?

তবু পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো ভালো।

যা খুশি তোমরা করো, যেখানে খুশি ফোন করো…মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো নাসির শাহ একটা চেয়ারে।

কক্ষমধ্যে একটা ভয়াবহ থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগলো। যে দস্যু বনহুরের নামে সমস্ত দেশবাসী সদা আতঙ্কগ্রস্ত রয়েছে, যে দস্যুর ভয়ে লোকজন সচ্ছভাবে পথ চলতে পারে না, সেই দস্যু বনহুরের আবির্ভাব ঘটেছিলো এই গোপন আড্ডায়–কম কথা নয়।

নাসির শাহ আর বিলম্ব না করে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। রাজ ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্ট করেও রুখতে পারলো না তাকে।

উদ্ভ্রান্তের মত গাড়ি নিয়ে চললো নাসির শাহ। শুধু দশ হাজার টাকাই তার খোয়া যায় নি, মনিরার উপর হস্তক্ষেপ করা তার চলবে না, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য।

বাড়ি ফিরে হন্তদন্ত হয়ে জুলেখার লেবরেটরী কক্ষে প্রবেশ করে ডাকলো-জুলেখা।

জুলেখা তখন মনিরার কক্ষে মনিরার চোখে ঔষধ লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছিলো। পাশে বসে বসে বনহুর তাকে সহায়তা করছে।

এই কক্ষে এবার প্রবেশ করলো নাসির শাহ, বিক্ষিপ্তভাবে চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে কপালে। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে একরাশ ভয় আর আতঙ্ক। কম্পিত কণ্ঠে ডাকলো নাসির শাহজুলেখা।

বড় ভাইয়ের কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালো জুলেখা এবং বনহুর।

মনিরার চোখে পট্টি বাঁধা তখন হয়ে গিয়েছিলো।

নাসির শাহর বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখোভাব লক্ষ্য করে জুলেখা বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে উঠে ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার?

নাসির শাহ ঢোক গিলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে–জুলেখা, সর্বনাশ হয়ে গেছে–ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ে নাসির শাহ।

বনহুর এবার বলে উঠে–সর্বনাশ? কি হয়েছে নাসির সাহেব?

জুলেখা ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠলো–ভাইয়া কি হয়েছে বলো?

 নাসির শাহ বললো এবার–দস্যু বনহুর আমার…

 জুলেখা শুষ্ক ভয়-কম্পিত কণ্ঠে বললো–দস্যু বনহুর!

 বনহুরও চোখে-মুখে ভীত ভাব টেনে এনে বললো–দস্যু বনহুর আপনার…

 হাঁ, আমার উপর হামলা চালিয়ে দশ হাজার টাকা সে নিয়ে গেছে।

বিস্ময়ে বনহুরের মুখমন্ডল হা হয়ে উঠে, বলে–দশ হাজার টাকা।

জুলেখা বলে–তবু ভালো টাকা নিয়েই সে ক্ষান্ত হয়েছে ভাইয়া। ভাগ্যিস তোমাকে হত্যা করেনি…

হত্যা করেনি কিন্তু হত্যার হুমকি দেখাতে সে কসুর করেনি। জুলেখা, কোন্ মুহূর্তে দস্যু বনহুর আমাকে হত্যা করে বসে তার ঠিক নেই।

জুলেখা বললো–দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই ভাইয়া। সমস্ত কান্দাই শহর যার নামে আতঙ্কগ্রস্ত। পুলিশ বাহিনীকে যে দস্যু নাকানি-চুবানী খাইয়ে ছাড়ছে, তার কথা সত্যি ভয়ানক।

দস্যু বনহুর মনে মনে হাসলো।

মনিরা চোখে না দেখলেও ওদের সব কথা সে শুনতে পাচ্ছো। বুঝতে পারলো সব কিছু।

 ভাই-বোনের ভীতিপূর্ণ আলোচনায় যোগ দিলো বনহুর।

একটু পূর্বে সে নাসির শাহর পকেট থেকে দশ হাজার টাকার নোটের ফাইল আত্নসাৎ করে নিয়েছে, এখনও তার পকেটে সেই টাকা বিরাজমান।

বনহুর বললো নাসির শাহ, আপনি সাবধানে থাকবেন। দস্যু বনহুর নাকি অপরাধীকে কিছুতেই ক্ষমা করে না।

নাসির শাহ আবার ঢোক গিললো, কোন কথা বের হলো না তার কণ্ঠ দিয়ে।

বনহুর এবার মনিরা সহ ফিরে এল চৌধুরী বাড়িতে। জুলেখা মনিরার চোখে একটা ঔষধ লাগিয়ে পট্টি করে দিয়েছে। এক সপ্তাহ পর আবার মনিরাকে আসতে হবে জুলেখার বাড়িতে। সেদিন মনিরার চোখের বাঁধন মুক্ত করে দেওয়া হবে। মনিরার দৃষ্টিশক্তির ভাগ্য নির্ভর করছে সেই দিনটির উপর।

ফিরে এলো মনিরা নিজ বাড়িতে, সঙ্গে দস্যু বনহুর।

বনহুর নিজে মটর ড্রাইভ করছিলো।

পথের ধারে পুলিশগণ পাহারায় রত হয়েছে। বনহুর নির্বিঘ্নে তাদের সম্মুখ দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলো।

মনিরাকে নিয়ে বনহুর যখন চৌধুরী বাড়ি পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা হয় হয়।

মরিয়ম বেগম পুত্র এবং মনিরাকে পেয়ে খুশিতে মেতে উঠলেন। আবার একটা আনন্দের উৎস বয়ে চললো মরিয়ম বেগমের মনে।

মনিরা আর মায়ের কাছে নিবিড় হয়ে বসলো বনহুর আজ। পাশে মা, অদূরে অন্ধ মনিরা।

বললো বনহুর–আমি এক সপ্তাহ পর আবার আসবো মা, আজকের জন্য বিদায় দাও।

মনির, এখনও কি তুই দস্যুতা ত্যাগ করতে পারলিনা? কিসের অভাব তোর–ধন-মাল ঐশ্বর্য সব তোর রয়েছে। বাবা, কি জন্য তুই এখনও দস্যুতা করছিস বল আমাকে।

মা, তুমি কি মনে করো আমি ধন-মাল আর ঐশ্বর্যের লোভে দস্যুতা করি?

তবে কিসের জন্য বল মনির?

এ কথা তোমাকে অনেক বার বলেছি মা। তোমার পুত্র কোনদিনই কুমতলব নিয়ে দস্যুতা করেনা। পরের মঙ্গল চিন্তাই তার একমাত্র পাথেয়। মা গো, তুমি আমাকে কোন সময় ভুল বুঝনা।

বাবা, চিরদিন কি এমনি করে কাটবে ব? আমার দিকে না তাকিয়ে কিন্তু মনিরা…ওর জন্যও তো তেকে ভাবতে হয়। তার জন্য একটি জীবন এমনি করে নষ্ট হয়ে যাবে মনির।

বনহুর ধীরে ধীরে ভাবাপন্ন হয়ে যায়। মায়ের শেষ কথাটার প্রতিধ্বনি হয় কানে…তোর জন্য একটি জীবন নষ্ট হয়ে যাবে মনির…তোর জন্য একটি জীবন নষ্ট হয়ে যাবে মনির…

বনহুর দুই হাতে মাথার দুই পাশে টিপে ধরে। মায়ের কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। মায়ের কণ্ঠের সঙ্গে আরও শত শত কণ্ঠ যেন প্রতিধ্বনি করে উঠে…একটি নয়, এমন অনেক জীবন তুমি নষ্ট করে দিয়েছো বনহুর…একটি নয়, অনেক জীবন নষ্ট করে দিয়েছো বনহুর…ব্যর্থ করে দিয়েছে। যে নারী তোমাকে দেখেছে সেই তোমাকে ভালবেসেছে…চোখের জল ফেলেছে, মন প্রাণ সঁপে দিতে চেয়েছে তোমাকে…কিন্তু তুমি কাউকেই ধরা দাওনি…তোমার নীরব কঠিন হৃদয়ের সাড়া কেউ পায়নি…পাষাণ মূর্তির মতই তুমি অচল অটল রয়েছো…কোন নারীর অশ্রুই তোমাকে বিচলিত–পথ ভ্রষ্ট করতে পারেনি…চিরদিন তারা অশ্রু বিসর্জন করেছে তোমার জন্য…না না, একটি নয়, বহু নারীর জীবন তুমি নষ্ট করে দিয়েছো বনহুর…শুভাষিণী, হীরাবাঈ আতিয়া, সিন্ধিরাণী, এমনি আরও কত যুবতীর জীবনই না তুমি ব্যর্থ করে দিয়েছে, ব্যর্থ করে দিচ্ছো নূরীর জীবন বনহুর তুমি অপরাধী–তুমি দোষী…তোমার জন্য জোবাইদা হারালো তার ফুলের মত একটি সুন্দর জীবন…জোবাইদার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী বনহুর…

বনহুর অধর দংশন করে, কিছুতেই নিজকে সে সংযত রাখতে পারেনা অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে–মা, আমি দোষী…আমিই দোষী-অপরাধী..মা, আমাকে কেউ ক্ষমা করবেনা কেউ ক্ষমা করবেনা।

মনিরা দেখতে না পেলেও স্বামীর মনের ব্যাকুলতা বুঝতে পারলো, চঞ্চল হয়ে পড়লো সে। বললো মনিরা–মামীমা, কে বললো আমার জীবন ও নষ্ট করে দিচ্ছে? কেননা তুমি ওকে এ কথা বলে কষ্ট দিচ্ছো? আমার মত সৌভাগ্যবতী আর কে আছে বলো?

বনহুর বললো আবার–মনিরা, মিছামিছি নিজকে সৌভাগ্যবতী বলে আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করো না। মায়ের কথা অত্যন্ত সত্য আমি তোমার জীবন ব্যর্থ করে দিচ্ছি।

মরিয়ম বেগম বললেন এবার হাঁ, যতদিন তুই আমার মনে আঘাত দিবি ততদিন আমি তোকে ক্ষমা করবো না।

মা! অস্কুট ধ্বনি করে উঠলো বনহুর।

মরিয়ম বেগম কঠিন কণ্ঠে বললেন–মনিরার সুখে আমার সুখ, মনিরার শান্তিতে আমার শান্তি, যতদিন মনিরা মা আমার চোখের পানি ফেলবে, ততদিন আমি।

মনিরা উঠে পড়তে গিয়ে এগিয়ে এলো, চেপে ধরলো মামীমার মুখ–ওকে তুমি অভিশাপ দিওনা মামীমা, ওকে তুমি অভিশাপ দিওনা।

এমন সময় সরকার সাহেব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকলেন বেগম সাহেবা!

মরিয়ম বেগম উঠে দাঁড়ালেন–আসছি।

বেরিয়ে গেলেন মরিয়ম বেগম।

 বনহুর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

মনিরা বুঝতে পারলো, মরিয়ম বেগম সরকার সাহেবের ডাকে বেরিয়ে গেছেন। স্বামী বসে আছে তার অনতিদূরে তাই মনে করে মনিরা বললো–তুমি মামীমার কথায় রাগ করলে? লক্ষীটি রাগ করোনা, মামীমা যাই বলুন আমার-তোমার মঙ্গলের জন্যই বলেন, বুঝলে? ওকি কথা বলছো না কেনো? আমার উপর বুঝি রাগ করছো? ছিঃ ছেলেমানুষী করতে নেই। এসো, আমার কাছে এসো।

মনিরা স্বামীর অন্বেষণে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসে।

সরকার সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে ফিরে আসেন মরিয়ম বেগম। হাতে তার খাবারের প্লেট।

দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়ান, তার কানে ভেসে আসে মনিরার হাসির শব্দ–দুষ্ট, আমি তোমাকে দেখতে পাইনা বলে খুব ভোগানো হচ্ছে। দাঁড়াও মামীমাকে ডাকছি– মামীমা…মামীমা…

এই যে মা আমি আসছি। মরিয়ম বেগম হাসতে হাসতে কক্ষে প্রবেশ করলেন।

কক্ষে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালেন–কোথায় মনির। শুন্য কক্ষ খাঁ খাঁ করছে। চারিদিকে ব্যাকুল আঁখি মেলে দেখতে লাগলেন।

মনিরার মুখে তখনও আনন্দের হাসি লেগে রয়েছে, মামীমার আগমনে একটু লজ্জাও বোধ করছে সে, তর বললো–মামীমা দেখো না আমি দেখতে পাইনা বলে আমার সঙ্গে কথাও বলেনা।

গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মরিয়ম বেগমকে কথা বলবে তোর সঙ্গে? কে কথা বলবে মা?

ও…

হায়রে হতভাগী, কার সঙ্গে তুই এতোক্ষণ কথা বলছিলি! সেকি আছে? কখন চলে গেছে কে জানে…

চলে গেছে! ও চলে গেছে মামীমা?

হাঁ, মরিয়ম বেগম পুত্রের জন্য খাবার এনেছিলেন হাতে করে, ধীরে ধীরে টেবিলে খাবারের প্লেট নামিয়ে রেখে বসে পড়লেন, খাটের পাশে।

অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর–জোবাইদার প্রেত আত্না!

হা সর্দার, রোজ রাতেই প্রেত আত্না গোটা আস্তানায় ঘুরে বেড়ায়। ছায়ার মতই দেখে যায় তাকে, গুলী ছুঁড়লে হাওয়ায় মিশে যায়। নিকটে গেলে দেখা যায় না।

কথাগুলো বললো রহমান।

বনহুরের চোখেমুখে অবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠলো।

দরবার কক্ষস্থ সকলেই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো।

বনহুর সকলের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-দরবার কক্ষে সবাই উপস্থিত আছে?

 হা সর্দার, সকলেই উপস্থিত আছে। বললো রহমান।

 বনহুর গভীর কণ্ঠে বললো–জোবাইদার হত্যাকারীর সন্ধান পেয়েছো রহমান?

না সর্দার, এখনও জোবাইদার হত্যাকারীর কোন সন্ধানই পাওয়া যায়নি।

আস্তানায় আমরা অনুচরদের মধ্যে কেউ কি বাইরে গেছে?

না, আপনার আদেশ অমান্য করার সাহস কারো নেই। আস্তানার বাইরে কেউ যায়নি সর্দার।

বেশ।

সেদিনের মত দরবার শেষ হলো।

.

গভীর রাত।

সমস্ত আস্তানা জুড়ে বিরাজ করছে একটা থমথমে নিস্তব্ধতা।

 প্রহরীদের ভারী বুটের শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই।

আজ কদিন হলো জোবাইদার প্রেত আত্নার আবির্ভাবে বনহুরের সাহসী দুর্ধর্ষ অনুচরগণও ভড়কে গেছে। গোটারাত ধরে তারা জেগে হই-হুল্লোড় করতো, কিন্তু এখন আর তাও করেনা। সদা ভয় কখন জোবাইদার প্রেত আত্না তাদের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে নেবে।

এতোবড় একটা আস্তানায় সদা সর্বদা একটা আতঙ্ক ভাব জেগে রয়েছে।

বনহুর নিজের কক্ষে রিভলভার হস্তে পায়চারী করছে। জোবাইদার প্রেত আত্নাকে আজ সে দেখবে, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে–যদি আপোষে না হয় তবে রিভলভারের গুলীতে হঠাৎ বনহুরের চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে যায় বনহুর।

দরজার বাইরে ফিস ফিস করে ডাকছে রহমান–সর্দার, সর্দার।

বনহুর রিভলভার হস্তে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলো।

রহমানের মত সাহসী যুবকের মুখেও ভয়ার্ত ভাব বনহুরকে দেখে বললো সে সর্দার, সেই ছায়ামূর্তি। জোবাইদার প্রেত আত্না।

কোথায়? বললো বনহুর।

সর্দার, ঐ যে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রহমান আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেলো সম্মুখের দিকে।

বনহুর দেখলো–একটা জমকালো ছায়া ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

রহমান সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল উঁচু করে ধরলো।

 বনহুর বাম হস্তে রহমানের রাইফেল নীচু করে দিলো, মুখে কোন কথা বললোনা।

 কিন্তু ততক্ষণে ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়েছে।

রহমান বললো–সর্দার, দেখলেন কেমন হাওয়ায় মিশে গেলো।

 বনহুর বললো–রহমান, জোবাইদার প্রেত আত্নাকে যেন গুলী করো না।

করেছিলাম সর্দার কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।

আশ্চর্য। বনহুর কথাটা উচ্চারণ করলো।

ফিরে এলো বনহুর আর রহমান নিজেদের কক্ষে।

রহমান বললো–সর্দার, এবার তো বিশ্বাস করেছেন জোবাইদার আত্না কিনা?

বনহুর পায়চারী করতে করতে বললো–জোবাইদার প্রেত আত্না কি চায় রহমান বলতে পারো?

না সর্দার, এ কথা আমরা বলবো কি করে?

 রহমান।

বলুন সর্দার?

 নূরীকে আজ দেখিনি কেনো?

কি জানি, জোবাইদার মৃত্যুর পর নূরী কেমন যেন হয়ে গেছে, এক সঙ্গেই থাকতো কিনা, তাই বোধ হয় শোক পেয়েছে বেচারী।

মিথ্যা নয় রহমান, এটা স্বাভাবিক। নূরী কি ঘুমিয়েছে?

হাঁ সর্দার, এখন তার কক্ষ অন্ধকার দেখছি, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।

তুমি যাও রহমান, নূরী যদি ঘুমিয়ে না থাকে তবে কথা শেষ না করে থেমে পড়লো বনহুর, একটু চিন্তা করে বললো–আচ্ছা আমিই যাচ্ছি ওর ওখানে।

বনহুর রিভলভার টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

 রহমান চলে গেলো রাইফেল হস্তে বিপরীত দিকে।

 বনহুর নূরীর কক্ষে প্রবেশ করেই সুইচ টিপে আলো জ্বালালো।

বনহুরের আস্তানায় ভূগর্ভ জলস্রোত হতে কারেন্ট তৈরি হতো এবং সেই কারেন্ট থেকে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলতো। কিন্তু মশালও ব্যবহার করতো বনহুর তার নিজস্ব কক্ষে এবং দরবার কক্ষে।

বনহুর আলো জ্বালতেই দেখতে পেলো–নূরী মনিকে বুকের কাছে নিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

বনহুর কিছুক্ষণ নূরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চাদরখানা মনি আর নূরীর গায়ে টেনে। দিয়ে বেরিয়ে গেলো লঘু পদক্ষেপে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ওদিকের জানালা হতে সরে গেলো একটি মুখ।

বনহুর ফিরে এলো নিজের কক্ষে।

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই নজরে পড়লো দরজার পাশে একটা ছোরা গাঁথা, ছোরায় একখানা কাগজ ভাঁজ করা আছে মনে হচ্ছে।

বনহুর অবাক হলো, শয্যা ত্যাগ করে উঠে এলো দরজার পাশে। সত্যিই একখানা ছোরা গাঁথা রয়েছে দরজার চৌকাঠে।

বনহুর ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে-অপরিচিত ছোরা। এ ছোরা তার আস্তানায় তৈরি হয়নি। কারণ, বনহুরের আস্তানায় তৈরি ছোরার বাটে একটি সংকেত চিহ্ন আঁকা থাকে। আশ্চর্য হলো বনহুর, তার আস্তানায় অজ্ঞাত ছোরা–দস্যুর উপর দস্যুতা।

বনহুর ছোরা থেকে কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো তার কক্ষস্থ মশালের আলোর সামনে। কাগজে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে। হাসি থামিয়ে ছোরাখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো খাটের নিচে, আর কাগজের টুকরা খানা ভাঁজ করে রেখে দিলো জামার পকেটে।

*

পরদিন।

 বন্দিনী নাসরিনের বিচার দিন।

দরবার কক্ষে বনহুরের সমস্ত অনুচর সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেরই হস্তে রাইফেল বর্শা-বল্লম।

বনহুরের আসনের পাশে উপবিষ্টা বৃদ্ধা দাইমা আর নূরী।

মনি ঠিক নূরীর কোলের কাছে দাঁড়িয়ে।

নাসরিনের হাত দু’খানা লৌহ শিকলে বাধা, বনহুরের সম্মুখে ভূতলে নত মুখে বসে আছে। চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে। মুখমন্ডল করুণ অশ্রুসিক্ত।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–নাসরিন, তুমি মৃত্যু চাও না মুক্তি চাও?

নাসরিন চোখ তুলে তাকালো, ঠোঁট দু’খানা নড়ে উঠলো, কিছু বলতে গিয়ে বলতে পারলো না।

বনহুর পুনরায় কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো–নাসরিন, আমার নিকটে কোন সময় মিথ্যা বলতে বা কিছু গোপন করতে চেষ্টা করোনা, আমি জানি–জোবাইদার হত্যাকারী তুমি, কাজেই মৃত্যু চাও না মুক্তি চাও?

নাসরিন মুহূর্তে চোখ তুলে তাকালো, নূরীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তার।

নূরী অধর দংশন করলো।

বনহুর বললো–কি চাও তুমি? মৃত্যু হলে জোবাইদার হত্যার প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করতে হবে, আর যদি মুক্তি চাও তবে তোমার হস্তদ্বয় ছেদন পূর্বক তোমাকে আমরা আস্তানা থেকে বের করে দেওয়া হবে। বলো কোটা চাও?

নাসরিন এবার মুখ তুলে সোজা হয়ে বসলো–মৃত্যুই আমি চাই।

বেশ, তাই হবে। রহমান, কাল ভোর রাতে নাসরিনকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করা হবে।

রহমান বলে উঠলো–সর্দার।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমার আদেশ অমান্য হরার নয়। যাও, কালকের জন্য প্রস্তুত হও।

বনহুর কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো। সমস্ত দস্যু অনুচরের মুখমন্ডল বিবর্ণ করুণ হলো। তারা সবাই জানে নাসরিন অতি ভাল মেয়ে। সে কিছুতেই জোবাইদাকে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু সর্দারের আদেশ নাসরিনের মৃত্যুদন্ড হবেই।। সমস্ত আস্তানায় একটা গভীর শোকের ছায়া নেমে এলো। সবাই নাসরিনের মৃত্যুদন্ড নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো–এমন কি রহমানের মনেও একটা ব্যাথার ছায়া ঘনিয়ে এলো।

সর্দারের বিচারে কেউ খুশি হতে পারলো না তেমন করে।

নাসরিনকে আবার সেই অন্ধকার কারাকক্ষে বন্দী করে রাখা হলো। রাত ভোরে তাকে হত্যা করা হবে। জোবাইদাকে হত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে–

সর্দারের এ বিচারে কেউ খুশি না হলেও প্রতিবাদ করতেও সাহসী হয়নি কেউ।

গোপনে তারা দু’চারটে আলাপ আলোচনা যে না করলো তা নয়। সবাই দুঃখ করলো, অনুতপ্ত হলো, ব্যথিত হলো নীরবে কেউ কেউ চোখের পানি মুছলো।

বনহুর আজ সকাল সকাল চারটি খেয়ে বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করলো। শরীর নাকি তার ভাল নয় আজ।

রহমান বুঝতে পারলো, নাসরিনের মৃত্যু দন্ডাদেশ দিয়ে সর্দার খুব ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু কি করবে, আইন তো অমান্য করতে পারে না সে।

এক প্রহর দু’প্রহর করে রাত বেড়ে চললো।

রহমান সর্দারকে বিরক্ত না করে আস্তানায় ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগলো। এটা তার ডিউটি–তার কাজ।

সমস্ত আস্তানা ঝিমিয়ে পড়েছে।

রহমান ঘুরে বেড়াচ্ছে, সজাগ প্রহরীর মত।

হঠাৎ চমকে উঠে রহমান অদূরে একটা, জমকালো ছায়ামূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনের মত। রাইফেল উদ্যত করতেই কানের কাছে ভেসে উঠলো সর্দারের কণ্ঠস্বর–ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে কখনও গুলী ছুঁড়বে না। রহমান উদ্যত রাইফেল নামিয়ে নিলো।

ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলেছে।

রহমান আজ গুলী না ছুঁড়ে অনুসরণ করলো ছায়ামূর্তিটিকে। অতি সন্তর্পণে সাবধানে এগুতে লাগলো সে। থামের আড়ালে, দেয়ালের আড়ালে গোপনে গা ঢাকা দিয়ে ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করলো রহমান।

রহমান যখন ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে, ঠিক তখন বিপরীত দিক থেকে অন্ধকারে আত্নগোপন করে উদ্যত রিভলভার হস্তে অগ্রসর হচ্ছিলো বনহুর। উভয়েরই লক্ষ্য সেই জমকালো ছায়ামূর্তি।

ছায়ামূর্তি অতি লঘু পদক্ষেপে এগুচ্ছে।

কোথায় চলেছে আজ দেখবে রহমান।

বনহুর জানতে চায় জোবাইদার প্রেত আত্না কেমন, কি তার অভিসন্ধি। মানুষ না সে অস্পৃশ্য ছায়া।

দু’জনার লক্ষ্য একই বস্তু।

 দু’জনার মনেই একই জানার বাসনা।

 অন্ধকারে এগুচ্ছে জমকালো ছায়ামূর্তি।

রহমান এগুচ্ছে, বিপরীত দিক থেকে এগুচ্ছে বনহুর।

 হঠাৎ বনহুরের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যায় রহমানের।

 বনহুর ঠোঁটে আংগুল চাপা দেয়।

রহমান চাপা কণ্ঠে বলে উঠে–সর্দার, ওটা জোবাইদার প্রেত আত্না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *