অন্ধবিন্দু
সৃষ্টির শুরু থেকে যে ঘটনাগুলোকে মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারেনি সেগুলোকে বিভিন্নরকম নাম দিয়ে এসেছে৷ কোনওটা চোখের ভুল, কোনওটা বিজ্ঞানের কারসাজি, আবার কোনওটা অলৌকিক৷ আর এই তিনটে ব্যাখ্যাকে একত্র করেই তৈরি হয়েছে ম্যাজিক—যেখানে মানুষ চোখের ভুল, বিজ্ঞান আর অলৌকিককে কাজে লাগিয়ে অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে৷
এখন প্রশ্ন হল অলৌকিককে কীভাবে কাজে লাগানো যায়? আসলে অলৌকিকের অ্যাপ্লিকেশনটা মনস্তাত্ত্বিক৷ ভয় পেলে আমাদের মানসিক স্থিরতা বিঘ্নিত হয়; ফলে চোখের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷ আমরা ভূত দেখে যতটা না ভয় পাই, তার থেকে ভয় পেয়ে ভূত বেশি দেখি৷ যাই হোক, ম্যাজিক নিয়ে আজ আমাদের গল্প, যার বেশিরভাগটাই একটা চিঠি৷ কুড়ি বছর আগের এক ধুলোমাখা সিমেন্ট চাপা পড়া অতীতের কাহিনি৷
ঘরে ঢুকেই জানলাটা খুলে দিলাম, খানিকটা আলো দরকার ভিতরে, কিছু পড়াশোনার কাজ করতে হবে৷ তাছাড়া দু-দিন হল কিছু চিঠি পড়ে আছে, পড়া হয়নি৷ সেগুলোই আগে তুলে নিলাম৷ মোট তিনটে, তার মধ্যে দুটো ব্যাঙ্কের, একটা আমার ছোটমামার চিঠি৷ একটু হাসলাম৷ ভদ্রলোকের মাথায় যে কিছু ছিট আছে তা ছোট থেকেই শুনে আসছি৷ বছরখানেক হল সেটা এমন বিশ্রী বেড়ে উঠেছে যে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে৷ অবশ্য তার ছিটের ব্যাপারটা এমন কিছু ভয়ংকর নয়, মনবিজ্ঞানে স্রিতজোফেনিয়া নামে এক ধরনের রোগ আছে৷ মানে হঠাৎ-হঠাৎ তাদের মনে হবে কেউ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ তাদের উপর নজর রাখছে, এইসব অদ্ভুতুড়ে খেয়াল৷ যাই হোক এত কিছু সত্ত্বেও মাথা ঠিক থাকলে মানুষটা অমায়িক৷ ব্যাঙ্কের চিঠিগুলো নামিয়ে রেখে সেটাই খুলে ফেললাম৷ চিঠির আকার বেশ বড়৷ এও জানি যে এরকম হৃষ্টপুষ্ট চিঠিতে দরকারি কথা প্রায় কিছুই থাকবে না৷ তাও আজ সকালে খানিকটা সময় আছে হাতে৷ চিঠির প্রথম পাতাটা আলোয় মেলে ধরলাম আমি৷
প্রিয় সুবীর,
আমার এ চিঠির বয়ান তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, কিন্তু এই মুহূর্তে চিঠি লেখার মতো তোমাকে ছাড়া আর কারও কথা মনে পড়ছে না৷ আমার কথা বিশ্বাস করা বা না করা তোমার ব্যাপার, শুধু একটাই অনুরোধ৷ যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে এ চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলো, অন্য কারও হাতে যদি পড়ে তাহলে পাগলাগারদে আমার পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা হবে হয়তো৷ চাইলে আমি তোমাকে ফোনও করতে পারতাম কিন্তু জানোই তো, মুখের কথায় কিছু গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর৷ বিশেষ করে এই ক-দিনে যে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা আমার চারপাশে ঘটে চলেছে তারপর সমস্ত কিছু আমার নিজের কাছেই গুলিয়ে গেছে৷ সাথে বেশ ভয় হচ্ছে, জানো? আর বেশিদিন এখানে থাকলে হয়তো ধড় থেকে আত্মাটাও আলাদা হয়ে যাবে৷ এ চিঠির উত্তর দেবার দরকার নেই৷ কারণ চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছাবে ততক্ষণে আমি ট্রেনে চেপে পড়েছি৷ হয়তো বা তোমার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছি৷ না বলে হুট করে এমন এসে পড়াতে তোমার অসুবিধা হবে না বলেই ধরে নিচ্ছি৷ অবিবাহিত আত্মীয় থাকার এই এক সুবিধা, বুঝলে?
যাই হোক৷ যে ঘটনাগুলো জানানোর জন্য তোমাকে এই চিঠি লেখা সেগুলোই বলা যাক৷ আসলে ঘটনাগুলোর শুরু যে ঠিক কোথা থেকে তা আমি নিজেই জানি না, দিন পনেরো আগে আমার আসামের বাড়িটা বিক্রি করে কলকাতায় এসে পাকাপাকি থাকব বলে ঠিক করেছিলাম৷ বেশ কয়েকজন এসে দেখে গেল বাড়িটা৷ ভালো দাম পেতে বিক্রি করেও দিলাম৷ কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে মুনিখাল বলে একটা জায়গায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে, জায়গাটা প্রায় গ্রাম, বাড়িতে লোকজনও কেউ থাকে না আপাতত৷ মাসখানেকের জন্য সেই পরিত্যক্ত বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলাম৷ তুমি মনে করতে পার যে এত বাড়ি থাকতে আমি একখানা ভাঙা জরাজীর্ণ বাড়িতেই কেন এসে উঠলাম৷ ব্যাপারটা আমারই একটা ছেলেমানুষি খেয়াল বলতে পার৷ কলকাতা এনতার মানুষ আর গাড়ি ঘোড়ার ধোঁয়ায় ভরা ঘিঞ্জি শহর৷ এবার থেকে সেখানেই যখন পাকাপাকি থাকব এই শেষ ক-টা দিন নিরিবিলিতে কাটিয়ে যেতে মন উসখুস করছিল৷
বাড়িটা দোতলা৷ একতলাটা থাকার মতো নয়, সারাক্ষণই মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ার ভয়৷ আমার জিনিসপত্র সামান্যই৷ সেসব সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে গিয়ে তুলতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি৷ শুধু সমস্যা হল ছাদের দরজাটা খুলতে৷ বহুদিনের জং পড়ে তালাটা এমন শক্ত করে আটকে গেছে যে অনেক চাপাচাপির পরেও সেটা খোলা গেল না৷ আমার সাথে যে দু-তিনজন লোক ছিল তারাও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল৷ ছাদটা খুলতে না পেরে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছিল৷ এমন সবুজ জঙ্গলে ভরা চারিদিক, তার মাঝে বাড়িটা৷ ছাদে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালে খোলা হাওয়ায় কতরকম পাখি চোখে পড়ত৷ জায়গাটায় বাড়ি-ঘর বেশি নেই বলে ছাদে দাঁড়ালে অনেকটা দূর দেখা যায়৷ জানলা দিয়ে দেখি, সামনের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা স্থানীয় ছেলেপিলে দৌড়ে মাঠ পার হয়, মাঠ পেরিয়ে নদী পার হয়৷ ওহো, বলাই তো হয়নি, আমার বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা সরু নদী আছে৷ সেটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন নেশা লাগে৷ সকালবেলা ঘন কুয়াশা জমে থাকে নদীটার উপরে, তার ফাঁক দিয়ে টলটলে জলের বয়ে যাওয়া চোখে পড়ে৷ এমনি করেই বেশ দিন কাটছিল, কিন্তু মুশকিল হল ওই ছাদটা নিয়ে৷ সারা রাত ঘুম আসে না৷ মনে হয় ছাদের উপর থেকে কেমন যেন ঠংঠং আওয়াজ আসছে৷ ঘুমে চোখ ঢুলে আসে, সাথে-সাথে বেড়ে ওঠে শব্দটা৷ আমারও ঘুমটা ভেঙে যায়৷ আশ্চর্য! যে ছাদের তালা আজ বহুবছর হল কেউ খোলেনি সেখানে আওয়াজ হয় কী করে! দিন তিনেক এমন চলার পর আর সহ্য হল না৷ প্রথমবার আওয়াজ শুনেই উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে; এখনও মনে আছে রাত তখন আড়াইটের কাছাকাছি৷ ঠিক এই সময়েই শুরু হয় শব্দটা৷ টর্চটা বিছানার কাছেই রাখা থাকে৷ সেটা হাতে নিয়ে উঠতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে৷ আওয়াজটা এখনও হয়েই চলেছে৷ তবে কি চোর ডাকাতের কিছু? দেওয়ালে কান রেখে শোনার চেষ্টা করলাম৷ নাঃ, কিছু বোঝার উপায় নেই৷ শব্দটা আর যাই হোক মানুষের গলার আওয়াজ নেই তার সাথে৷ কী যেন ভেবে আমি এগিয়ে গেলাম তালাটার দিকে৷ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে তার ধাতব শরীর৷ তুমি বিশ্বাস করবে না সুবীর আমার মাথার ভিতর কে যেন বলে দিল, তালাটা আলগা হয়ে আছে, চাপ দিলেই খুলে যাবে সেটা৷ আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো চাপ দিলাম তালাতে৷ একটা আচমকা যান্ত্রিক শব্দ করে খুলে গেল সেটা, মনে হল আমার খোলার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল৷ আমার কিন্তু তখন বিন্দুমাত্র অবাক লাগেনি৷ অথচ এখন লিখতে-লিখতে কপাল ভিজে উঠছে ঘামে৷ দরজা খুলে আমি ছাদের ভিতর ঢুকে এলাম৷ নাঃ৷ অস্বাভাবিক কিচ্ছু নেই, একটা মানুষ এমনকি একটা বিড়াল পর্যন্ত দেখতে পেলাম না৷ নিশ্চিন্ত হয়ে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস নিলাম৷ আর তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা৷ ছাদের একপাশে একটা ছোট এক কামরার ঘর মতো করা আছে, অবশ্য তার একদিকের দেওয়ালটা নেই, দেখে মনে হয় বহুদিন আগেই ভেঙে পড়েছে সেটা৷ সেদিকে টর্চের আলো ফেললাম, সাথে-সাথে চোখে পড়ল ঘরটার ভাঙা দেওয়াল থেকে একটা ভারী লোহার চেন ঝুলছে৷ সেটার দিকে ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এতক্ষণে শব্দ হওয়ার কারণটা৷ চেনটার নীচের দিকে একটা ছোটখাটো লোহার টুকরো জড়ানো আছে৷ জোরে হাওয়া দিলে সেটাই এসে ধাক্কা খাচ্ছে ছাদের পাঁচিলের একদিকে৷ এতদিন ধাক্কা খাওয়ার ফলে পাঁচিলের বেশ খানিকটা জায়গা খসে পড়েছে৷ কেউ কি থাকত এখানে? এভাবে লোহা বেঁধে রাখার কারণই বা কী? আমি ভেবে কূল পেলাম না৷ নীচে ফিরে-ফিরে যাব কি না ভাবছি, এমন সময় একটা কথা মনে পড়তেই আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ ক-দিন আগে যে তালাটা তিনজন মানুষ মিলে টেনে খুলতে পারেনি আজ সেটা আমি একটু চাপ দিতেই খুলে গেল? আকাশের দিকে ভালো করে তাকালাম, চিমটি কাটলাম নিজের গায়ে; নাঃ, স্বপ্ন দেখছি না৷ হাওয়ার তেজ একটু কমেছে, সাথে আওয়াজটাও৷ মনে হল, এতক্ষণ একটানা আমাকে উপরে ডাকার পর ক্লান্ত সেটা৷ এগিয়ে গেলাম সেদিকে, একবার হাত ছোঁয়ালাম লোহার রডটায়; পরিচিত পশুর মতো যেন সেটা আরও বেশি করে সরে এল আমার দিকে৷ আমি ঘরের ভিতরের দিকে পা বাড়ালাম৷ আমি ঘরে ঢুকতেই একঝাঁক জমে থাকা ঠান্ডা হাওয়া রাতের ঘুম ভেঙে বিরক্ত হয়ে ছুটে বেরল ঘর থেকে৷ ঠংঠং আওয়াজ ভেসে এল পিছন থেকে৷ ঘরের মেঝেতে ধুলোর চাদর ছড়িয়ে আছে৷ একপাশে জানলা, তার নীচেই একটা ভাঙা কাঠের বিছানা, অর্থাৎ আগেও কেউ থাকত এখানে, এবং সে চলে যাওয়ার পর থেকেই এভাবে পড়ে আছে ঘরটা৷ আমার আর নীচে ফিরে যেতে ইচ্ছা করল না৷ ভাঙা বিছানাটার পাশেই বসে পড়লাম৷ ঘরের জানলা দিয়ে আকাশের বেশ খানিকটা চোখে পড়ছে৷ একটা মাত্র উজ্জ্বল তারা৷ একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল হল আমার, জানলা দিয়ে যে তারাটাকে দেখতে পাচ্ছি আমি, সেটা হয়তো বহু কোটি বছর আগে নিভে গেছে; পরিণত হয়েছে ব্ল্যাক হোলে৷ অথচ তার আলো এখনও এসে পৌঁছায় পৃথিবীতে, আমার চোখে৷ আবার সেই পরিচিত গলাটা আমার কানের কাছে বলে দিল, সত্যি মারা গেছে তারাটা, পৃথিবীতেতে মানুষ আসার বহু আগে৷ সেই ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ঘুম পেল আমার, অজান্তেই চোখ বন্ধ হয়ে এল৷
পরদিন সকাল হতেই গুরুসদয় এসে উপস্থিত হল৷ লোকটা এক নম্বরের চামার, এবং পয়সাখোর৷ এখানে আসার পর থেকে দোকানবাজার করে দেওয়ার জন্য রেখেছিলাম তাকে, সেসব কাজে দরকার পড়লে তাকে পাওয়া যায় না, এদিকে কিছু কাঁচা টাকার দরকার পড়লেই মুখে করুণ হাসি ঝুলিয়ে এসে হাজির হয়৷ রাত্রিবেলা সম্ভবত নেশা-ভাং করে; আজ সকালেও তার মুখ থেকে দিশি মদের গন্ধ পেলাম৷ অবশ্য এসব বেয়াড়াপনা দেখেও আমি তেমন কিছু বলি না তাকে; হাজার হোক লোকটা স্থানীয়, হাতে রেখেই চলা উচিত৷ সকালবেলা কিছু বাজার করে এনেছিল গুরুসদয়, দেখে মনে হয় সব্জিপাতির বেশিরভাগই খেত থেকে তুলে আনা৷ তাও খানিকটা বেশি টাকাই তুলে দিলাম তার হাতে; তাতে কাজ হল, একটা ধন্যবাদসুলভ হাসি হেসে সে বলল, ‘কাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল স্যার?’
আমি মাথা দোলাতে গিয়েও থেমে গেলাম৷ কাল রাতের কথাগুলো আর একবার মনে পড়ে গেল৷ বললাম, ‘তোমরা তিনটে পালোয়ান মিলে তালা খুলতে পারলে না আর কাল রাতে আমি খুলে ফেললাম সেটাকে!’
‘কোন তালা?’
‘ছাদের৷’
গুরুসদয় প্রথমে অবাক হয়ে গেল, তারপর কী যেন ভেবে বলল, ‘ও তালা তো খোলে না স্যার, আজ বহুবছর হয়ে গেল খোলেনি৷’
আমি হাসলাম, কাল রাতের ঘটনাগুলো খানিকটা অস্বাভাবিক বটে, বিশেষ করে তালাটার আচমকা খুলে যাওয়া৷ কিন্তু তার থেকেও বেশি অদ্ভুত হল ছাদের সেই ভাঙা ঘরটা৷ সেটার কথা ভাবতেই আমার আর তাকে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করল না; এদিকে সেও তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছাদে গেছো আগে?’
সে মাথা নাড়াল৷ হাতের টাকা ক-টাকে থুতু দিয়ে আর একবার গুনে নিল৷ তারপর সেগুলো পকেটে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরনোর উপক্রম করেছে এমন সময় একটা প্রশ্ন ধাঁ করে আমার মাথায় আসতেই তাকে থামিয়ে দিলাম আমি, ‘ছাদে একটা ভাঙা ঘর আছে, সেখানে আগে কে থাকত জানো?’
গুরুসদয়ের চোখদুটো এক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার নিভে গেল, ‘ঘরখানা আছে এখনও?’
‘এতবছর খোলেনি যখন থাকাটাই তো স্বাভাবিক৷’
না আমি ভেবেছিলাম শেষবার তালা বন্ধ করার আগেই সেটা ভাঙা পড়েছে৷’
আমি এবার একটু অবাক হলাম, খামোখা একটা ঘর ভাঙা পড়বে কেন? আমি আর কিছু বললাম না, কেন জানি না মনে হচ্ছিল আরও কিছু বলতে চলেছে সদয়৷ কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে একটা প্রশ্ন করল সে, ‘তা কী দেখলেন ওখানে?’
‘তেমন কিছু না, একটা ভাঙা খাট, একটা পাল্লাহীন জানলা আর সবই ধুলোয় ঢাকা পড়েছে৷’
‘আর কিছু দেখেননি?’ প্রশ্নটা শুনেই কেমন যেন সন্দেহ জাগল আমার মনে৷ একটু আগেই তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এই প্রশ্নগুলো করা উচিত হবে কি না সেটাই ভাবছিল সে৷
‘বিশেষ কোনও কিছুর কথা বলছ কী?’
‘নাঃ, তেমন কিছু নয়, আমরা ছোটবেলা থেকে ছাদটা নিয়ে নানারকম গালগল্প শুনে এসেছি, তাই একটু কৌতূহল আছে আর কী…’ একটা বেমানান হাসির আড়ালে সে কথাগুলোকে সহজ করতে চাইল৷
‘কীরকম গালগল্প৷’
একটু গলাখাঁকারি দিল গুরুসদয়, ‘আরে… সে অন্য একদিন হবে না হয়, আজ বেলা হয়ে এল… রান্নাবান্না…’
‘রান্নাবান্না আমি করে নেব, ঘটনাটা বলো তুমি৷’
উৎসাহের বশে আমার গলাটা একটু বেশি চড়ে গেছিল, সেটা লক্ষ করেই একটু বাঁকা হাসি হাসল সদয়৷ তারপর চেয়ারে জাঁকিয়ে বসে বলল, ‘আমরা ছোটবেলায় শুনেছিলাম ওই ঘরটায় এক ম্যাজিশিয়ান থাকত৷’
‘ম্যাজিশিয়ান!’ কথাটা নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করলাম আমি, ‘মানে স্টেজে ম্যাজিক দেখাত?’
‘সে একসময় দেখাত বটে, কিন্তু এ বাড়িতে এসে আস্তানা করার পরে স্টেজ শো সে আর করেনি৷’
‘বেশ, তো তারপর?’
‘স্টেজ শো যতদিন করত ততদিন নানারকম ম্যাজিক দেখাত সে; খানিকটা নামও হয়েছিল৷ তবে আসল খেলাটা ছিল ইলিউশন৷ মানে ধরুন আলো, আয়না কি স্রেফ বিজ্ঞানের কারসাজিতে মানুষের চোখকে বোকা বানানো৷ দূরদূরান্ত থেকে আগাম টিকিট কেটে লোকে তার খেলা দেখতে আসত, অথচ এত পসার সত্ত্বেও মাঝবয়সে সে ম্যাজিক দেখানো ছেড়ে দিল৷ অনেক চেষ্টা করেও তার অকাল অবসরের কারণটা কেউ জানতে পারল না৷ কলকাতার বাড়ি ছেড়ে এই পাড়াগাঁয়ের বাড়িতে ছাদে একটা ঘর ভাড়া করে থাকত সে৷ আর তার এখানে আসার সাথে-সাথেই গ্রামে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে লাগল৷’
‘অদ্ভুত মানে? কীরকম?’
সদয় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, এই প্রথম চিন্তান্বিত দেখাল তাকে, কথাগুলো ভালো করে মনে করার চেষ্টা করতে-করতে বলল, ‘তখন আমার বয়স বেশ কম৷ একদিন সন্ধের দিকে শুনলাম নদীর ধারের গাছগুলোতে আগুন লেগেছে৷ পড়ি কি মরি করে ছুটলাম জলের বালতি নিয়ে, এখানে এত গাছপালা আগুন ছড়াতে বেশি সময় নেয় না৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে পৌঁছাতেই অবাক হয়ে গেলাম৷ আগুন তো দূরের কথা, খানিকটা ধোঁয়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! লম্বা গাছপালার সার আগের মতোই হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে৷ আমার মতো অনেকেই ততক্ষণে জলের বালতি নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, তাদেরও মুখ হাঁ৷ একটু আগেই নাকি জঙ্গল থেকে আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়া লকলক করে জ্বলছিল! এতগুলো মানুষ কি তবে একসাথে ভুল দেখল? সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, ঘটনাগুলো কিন্তু সেখানেই থেমে থাকল না৷ একদিন লোকে দেখল ওই ছোট্ট নদীর জলে পাহাড়ের সমান ঢেউ উঠেছে, কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার সব শান্ত; এই আকাশ মেঘে কালো করে আসছে পরক্ষণেই সিনেমার পর্দার মতো মেঘ সরে গিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে৷ গ্রামেরই কয়েকজনের সন্দেহ হল, এসব ওই ম্যাজিশিয়ানের কীর্তি; তার সব ম্যাজিকের মধ্যে মায়াজালটাই ছিল সেরা৷’
কথাগুলো বলতে-বলতে তার চোখ প্রায় নিভে এসেছিল, হঠাৎ করে কথা থামিয়ে উঠে পড়ল সদয়৷ তাড়াহুড়ো করে জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন দেখি, এইসব কথা বলতে বসলেই আর সময়ের জ্ঞান থাকে না৷ রোদ উঠে গেল এদিকে বাড়ি ফেরা হল না৷ চলি স্যার, কাল আসব আবার৷’
অন্যদিন হলে তাকে কাল আসতে বারণ করতাম৷ আসলেই কোনও না কোনও কারণে আবার টাকা চাইবে৷ আজ কিন্তু কথাটা শুনে খুশি হয়ে গেল মনটা, ম্যাজিশিয়ানের বাকি গল্পটা শুনতে ইচ্ছা করছে৷ স্টেজে ইচ্ছামতো৷ আলো আর যন্ত্রপাতির কারিগরিতে ইলিউশানের খেলা দেখিয়ে হাততালি৷ কুড়ানো যায় কিন্তু খোলা মাঠে একঝাঁক পথচলতি মানুষের চোখকে বোকা বানাতে গেলে সাধারণ ম্যাজিকের থেকে বেশি কিছু লাগে৷ সকালের আলোতে একবার ছাদে যেতে ইচ্ছা করল৷ ম্যাজিশিয়ান সম্পর্কে সেখান থেকে অজানা কিছু যদি জানতে পারা যায়; অবশ্য ধুলো, ভাঙা কাঠ আর পুরনো ইটের টুকরো ছাড়া কিছুই নেই সেখানে৷ যাই হোক সেসব চিন্তা সরিয়ে রেখে আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম৷ সকালের রোদ এসে পড়েছে ছাদের মেঝেতে, ভাঙা ঘরটা কাল রাতের মতোই চুপচাপ শান্ত হয়ে রোদ পোহাচ্ছে৷ আমি ছাদের পাঁচিলের দিকে সরে এলাম৷ একটু দূরেই লম্বা গাছের রেখা দেখা যাচ্ছে, তার নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীটা৷ সকালের রোদ গায়ে মেখে গ্রামের ছোট বাড়ি, রাস্তা আর বিরাট খেলার মাঠটা ঝিমিয়ে আছে৷ পিছন ফিরে দাঁড়ালাম, ভালো করে দেখতে লাগলাম ঘরটা৷ শহরের ব্যস্ত একঘেয়ে জীবন ছেড়ে এখানে এসে থাকার কারণটা বেশ বোঝা যায়, কিন্তু শুধুই কি তাই? ছাদের এই পুরনো ঘরটার মধ্যে কেমন যেন একাকিত্ব রয়েছে, যেন বাকি সমস্ত পৃথিবীর থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে ঘরটা৷ মৃদু হাওয়ায় লোহার চেনটা দুলছিল, সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম৷ হঠাৎ কীরকম যেন একটা আওয়াজ এল পিছন থেকে৷ আমার বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল৷ মাথা না ঘুরিয়েও মনে হল পিছনের সমস্ত গাছ যেন একসাথে জ্বলছে, দাউদাউ করে আগুনের শিখা উঠে আসছে তার শাখাপ্রশাখা বেয়ে, নীচে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ৷ পিঠে যেন আগুনের হলকা অনুভব করতে পারলাম আমি৷ মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকালাম, নাঃ, সমস্ত গ্রামটাই দুপুরের আদরে ভাতঘুম দিচ্ছে, কোথাও কিচ্ছু নেই৷ গরম রোদ এসে পড়েছে আমার পিঠে৷ একটু থতমত খেলাম আমি, আমারও কি ভুল দেখা শুরু হল? একটু আগে গুরুসদয় গাছে আগুন লাগার কথাই তো বলছিল৷ ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়িয়ে আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম৷ কৌতূহলটা এতটা বেড়ে গেছিল যে কানে শোনা ঘটনাগুলো চোখেও দেখতে পাচ্ছি৷ ঘরটার দিকে এগিয়ে এলাম৷ ভিতরের দিকটায় এখনও অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে৷ জানলার গ্রিলগুলো এত আলগা হয়ে আটকে আছে যে মনে হয় আঙুল দিয়ে টোকা দিলেই খুলে পড়ে যাবে৷ কাল রাতে যেখানে শুয়ে ঘুমিয়েছিলাম সেখানে খানিকটা ধুলো সরে গেছে, ভাঙা বিছানাটার একপ্রান্তে বসে পড়লাম আমি৷ খাটটা মচমচ করে উঠল৷ কিসের যেন একটা গন্ধ আসছে, মাথার ভিতরটা কেমন গুলিয়ে উঠল৷ সাথে-সাথে অদ্ভুত কিছু চিন্তা এসে চেপে ধরল আমায়৷ মনে হল, এই ঘরের মধ্যেই কিছু একটা আছে৷ এমন একটা কিছু যেটা এই কুড়ি বছরে কোনো মানুষের হাতে আসেনি৷ হঠাৎ চোখে পড়ল সমস্ত ঘরের মেঝেতে সিমেন্ট চেরা দাগ৷ যেন কেউ ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ঠুকেছে মেঝেতে৷ ব্যাপারটা কেমন যেন আশ্চর্য লাগল আমার৷ দাগগুলো এখনকার যে নয় তা বেশ বোঝা যায়৷ ধুলো পড়ে ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো৷ কে করেছে দাগগুলো? সেই ম্যাজিশিয়ান? কিন্তু সে অকারণে নিজের ঘর খুঁজবে কেন? আমি উঠে পড়লাম৷ একটু আগে গুরুসদয় একটা প্রশ্ন করেছিল ‘তা কী দেখলেন ওখানে?’
এই ‘কী’ শব্দটাই মনে পড়ল এখন৷ হয়তো এমন কিছু এ ঘরে লুকানো আছে যা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ সেটা খোঁজার জন্যই হয়তো সিমেন্টের মেঝে খুঁড়ে দেখা হয়েছিল৷ ঘরের উপরের দিকে একটা বাঙ্কারও আগে ছিল, সেটা ভেঙে নেওয়া হয়েছে৷ উঠে পড়লাম৷ বহুবছরের হাওয়া এখানে জমাট বেঁধে আছে, আমি হুট করে এসে পড়ায় তারা খুশি হয়নি৷ সেই গন্ধটা এখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে৷ চেন থেকে ঝোলানো দড়িটা এখন আবার আগের মতো নড়ছে৷ সেদিকে এগিয়ে গিয়ে চেনটা ধরলাম আমি আর সাথে-সাথে পিঠে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শে বুক কেঁপে উঠল৷ কেউ আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তার ঠান্ডা ভরাট চোখের দৃষ্টি আমার ঘাড়ে অনুভব করতে পারছি৷ চমকে, পিছনে ফিরে তাকালাম৷ নাঃ, কেউ নেই! আবার, আবার হল ব্যাপারটা৷ তবে কি এই ছাদটা ভূতুড়ে? এই কারনেই এতদিন তালা দিয়ে বন্ধ করা ছিল? ফিরে আসতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা জিনিস চোখে পড়তেই থমকে গেলাম আমি৷ চেনের নীচের দিকে যে লোহার টুকরোটা বাঁধা আছে সেটা দুলে-দুলে ধাক্কা দিচ্ছে ছাদের পাঁচিলে; দীর্ঘদিন একই ভাবে ধাক্কা দেওয়ার ফলে ছাদের সেই জায়গাটায় অনেকটা সিমেন্ট খয়ে গেছে৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সেই খয়ে যাওয়া সিমেন্টের ফাঁক থেকে খয়েরি কিছু একটা চোখে পড়ছে৷ সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি৷ চেনের দোলন থেমে গেছে, গর্তটার সামনের মেঝেতে বসে পড়লাম৷ জায়গাটায় হাত রাখতেই বুঝলাম সেটা কাঠ৷ সিমেন্টের পাঁচিলের ভিতর কাঠ থাকবে কেন? আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ মনে হল কাঠের টুকরোটা ছোট নয়, যেন অনেকটা জুড়ে ছড়ানো৷ হাতের ধাক্কায় আশপাশ থেকে সিমেন্ট সরিয়ে দিলাম আমি৷ হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই৷ একটা কাঠের বাক্স৷ সিমেন্টের আড়ালে এতদিন কেউ লুকিয়ে রেখেছিল সেটাকে৷ বাক্সটা বের করা উচিত হবে কি না ভাবলাম৷ জিনিসটা যে লুকিয়েছিল সে আর কোনওদিন এখানে ফিরে আসবে বলে তো মনে হয় না৷ কেন জানি না মনে হল, বহু বছর পর যাতে কেউ বাক্সটা খুঁজে পায় সেই জন্যই এইভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সেটাকে৷ যত হাওয়া দেবে তত চেনটা দুলবে, অল্প-অল্প করে সিমেন্ট খসবে৷ লুকানোর অন্তত কুড়ি বছর পর নিজে থেকেই বেরিয়ে পড়বে বাক্সটা৷ প্রায় আড়াই ঘণ্টার কসরতে দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে এল বাক্সটা৷ তেমন কিছু ভারী নয়, তবে কাঠটা বেশ শক্তপোক্ত৷ এটার জন্যই ঘরের ভিতর এত খোঁজাখুঁজি? অথচ সেটা ঘরের ভিতর ছিলই না!
নীচে নেমে এলাম আমি৷ হাতের কয়েক জায়গায় বিশ্রী ভাবে ছড়ে গেছে৷ রক্ত বের হচ্ছে সেখান দিয়ে৷ সাথে কিছু ওষুধ ছিল, লাগিয়ে দিলাম, তারপর ব্যান্ডেড৷ ভেবেছিলাম বাক্সটা ধীরে-সুস্থে দুপুরে খুলব৷ কিন্তু আমার ধৈর্যে কুলাল না৷ কীরকম যেন টানছে সেটা আমায়৷ চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি৷ একটা ফুটখানেক লম্বা কাঠের বাক্স৷ উপরটা নিরেট, বুঝলাম সেটা কারখানায় তৈরি নয়৷ নিজে হাতে তাড়াহুড়ো করে বানিয়েছিল কেউ৷ সম্ভবত ভিতরে যেটা আছে সেটাকে রক্ষা করতেই৷ চারপাশে খোলার মতো কোনো হুক নেই৷ উপরের কাঠটা সম্ভবত পেরেক দিয়ে আটকানো৷ অর্থাৎ চাড় দিয়ে খোলা ছাড়া উপায় নেই৷ একদিকের কাঠ একটু বেশি বের হয়ে ছিল, সেটা ধরে টান দিলাম আমি৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হল আমার কাঁধের ঠিক পাশ দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে বাক্সটার দিকে৷ তার ঠান্ডা মৃত নিঃশ্বাস পড়ছে আমার ঘাড়ে৷ ভয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার, পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি৷ মনে হল ধীরে-ধীরে মাটিতে শুয়ে পড়ছি আমি৷ চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসছে৷
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম এখনও আগের জায়গাতেই শুয়ে আছি, শুধু সন্ধে হয়ে এসেছে৷ বাক্সটা খুলতেই কী যে হল ঠিক বুঝলাম না৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে এল৷ তারপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ আবার উঠে দাঁড়ালাম আমি, এখন মাথার ব্যথাটা অনেকটা কমেছে৷ বোধহয় ঘুমটা দরকারি ছিল৷ উঠেই কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম৷ বাক্সটা আগের মতোই পড়ে আছে বটে, কিন্তু তার ডালাটা খোলা৷ যতদূর মনে পড়ছে সেটা আমি খুলিনি, তবে কি অন্য কেউ এসেছিল ঘরে? সেই খুলেছে ডালাটা? যাই হোক আমি তাকিয়ে দেখলাম ভিতরে তুলো ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না, কয়েক জায়গায় তুলো জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে, বাকিটা খয়েরি৷ তবে বাক্সে শুধু তুলো আছে বিশ্বাস করা যায় না৷ সম্ভবত ভিতরে যেটা আছে সেটাকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে তুলোটা৷ এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাখা রয়েছে ভিতরে? আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ উপরের দিকে তুলো খানিকটা সরিয়ে ফেললাম৷ নাঃ, কিচ্ছু নেই৷ পুরো বাক্সটায় তুলো ছাড়া আর কিচ্ছু নেই৷ হতাশ হয়ে সেদিক থেকে সরে এলাম আমি, ডালাটা দিয়ে আবার চাপা দিয়ে দিলাম বাক্সটা৷ এত কিছু করে শেষপর্যন্ত এই! খানিকটা পুরনো তুলো? সারা সকালের পরিশ্রমটা মাঠে মারা গেল৷
যাই হোক ব্যাপারটা আমি মাথা থেকে সরানোর চেষ্টা করলাম৷ দুপুরের খাওয়াটা হয়নি৷ একতলার টেবিলের উপরে এখনও পড়ে আছে খাবারটা৷ এখন আর খেতে ইচ্ছা করল না আমার, জামাটা গায়ে গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ এদিকটা সন্ধের দিকে লোকজন কম যাওয়া-আসা করে৷ নদীটার ধারে গিয়ে দাঁড়ালে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগে৷ সেদিকটাতেই এগিয়ে গেলাম আমি৷ পাখিরা এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে, ঝোপঝাড় থেকে পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে৷ মনটা হালকা হয়ে গেল; পাশেই জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ৷ মিনিট কুড়ি এভাবেই হাঁটলাম৷ হঠাৎ মনে হল, এখানে এসে থেকে একবারও বাড়িটার দিকে ভালো করে তাকাইনি৷ এখন সূর্যটা আর আকাশে নেই বটে, কিন্তু শেষ আলোটুকু এখনও উঁকি দিচ্ছে দিগন্তের একপ্রান্তে৷ আমি বাড়িটার দিকে তাকালাম, আর তাকাতেই ভয়ে শরীরটা হিম হয়ে গেল আমার৷ বাড়ির ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে আমি যেভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক সেইভাবে, পাঁচিলের উপর হাত দুটো রেখে৷ এত দূর থেকে মুখটা ভালো করে দেখতে পেলাম না, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে এসেছি আমি৷ তখন কেউ ছিল না ভিতরে৷ ভয়টা কাটিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম৷ আমাকে এখনও দেখতে পেয়েছে কি না জানি না তবে তার হাবেভাবে বিশেষ পরিবর্তন এল না৷ শুধু আমি বাড়ির কাছে এগিয়ে আসতে ছায়ামূর্তিটা ধীরে-ধীরে পাঁচিলের নীচে নেমে গেল, ঠিক সন্ধের শেষে সূর্যটা যেভাবে ডুবে যায়, সেইভাবে৷
আমার আর বাইরে বেড়াতে ভালো লাগল না৷ কিছু একটা আছে বাড়িটায়, ভূত, অলৌকিক অথবা রহস্য, যাই বলি না কেন, সব কিছু যেন একসুতোয় বাঁধা—সেই ম্যাজিশিয়ান, এই বাড়ি, ওই লোহার চেন আর ওই বাক্সটা৷ কিন্তু বাক্সটার মধ্যে আছে তো শুধু তুলো৷ আর তুলো দিয়ে তো অন্য কিছু… কথাটা মাথায় আসতেই আমি থমকে গেলাম৷ একটা সহজ ব্যাপার এতক্ষণ মাথায় আসেনি৷ তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভিতর ঢুকে সদর দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম আমি৷
পরদিন সকালে অপেক্ষা করেছিলাম গুরুসদয়ের জন্য৷ এ বাড়ি আর বাড়ির পুরনো বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানার আছে৷ সেটা গুরুসদয়কে ছাড়া সম্ভব না৷ সে ঘরের ভিতর এসে দাঁড়াতেই আমার হাতের দিকে চোখ পড়ল তার৷ সেদিকে দেখিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কেটে ফেলেছেন নাকি?’
‘তেমন কিছু না৷’ আমি আশ্বাস দিলাম তাকে, ‘একটা কাপবোর্ড খুলছিল না, টানাটানি করতে গিয়ে…’
সে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘নিজে-নিজে কিছু খুলতে যাবেন না, পুরনো বাড়ি৷ বুঝতেই পারছেন কোথায় কী থাকে?’
আমি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম; একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম, ‘একটা কথা বলো দেখি৷’
‘কী কথা?’
‘এত বড় একখানা বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে, তাও তোমরা এখানে থাক না কেন? ভূত-টুত আছে নাকি? সত্যি করে বলো তো৷’
আমার প্রশ্ন শুনে বেশ জোরে-জোরে হেসে উঠল গুরুসদয়৷ বলল, ‘গ্রামের লোক এ-বাড়িতে থাকতে চায় না বটে, কিন্তু তার কারণ অন্য, ভূত এখানে দেখেনি কেউ৷’
‘কী কারণ?’ আমি সিগারেটটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম৷
‘এ বাড়ির একটা ইতিহাস আছে৷ সেটা তেমন সুবিধার নয়৷’
‘মানে কাল যেটা বলছিলে, অবশ্য পুরোটা বলোনি৷’
‘পুরোটা বলতে, আমি যতটা জানি তার বেশিরভাগটাই শোনা ঘটনা৷ একে গ্রামের দিক তার পরে আবার এ ধরনের ঘটনা, ফলে কতটা সত্যি আর কতটা গুজব তা আর বলা যায় না৷’
‘বেশ যা জানো, তাই বলো৷’
গুরুসদয় হাসল৷ চেয়ার থেকে পিঠ তুলে আমার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘তাহলে বাইরে চলুন, ভোরের হাওয়া খেতে-খেতে শুনবেন, বাড়িতেই বসে বাড়ির ভয়ানক ইতিহাস বলাটা কি ঠিক হবে?’
প্রস্তাবটা আমারও ভালো লাগল৷ গ্রামের দিকের সকালটা দেখবার মতো৷ কাল থেকে যে অন্ধকারটা মনে জমে আছে সেটা খানিকটা কমবে৷ গায়ে শাল জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম দু-জনে৷
‘কাল কি আপনাকে ম্যাজিশিয়ানের কথা বলেছিলাম?’
‘হ্যাঁ, সেইটুকুই বলেছিলে৷’
‘তার নাম সম্ভবত ছিল শতদল, পদবিটা জানতাম না৷’
‘বেশ, তারপর?’
‘এমনিই খুব একটা বাইরে বেরত না সে, মাঝে-মধ্যে বাইরের কিছু লোক দেখা করতে আসত৷ তার নাকি ছিল তার বন্ধুবান্ধব, কাউকে কিছু না বলে সোজা ছাদে উঠে যেত তারা৷ তেমনটাই ছিল নিয়ম৷ তো একদিন তারা ছাদে উঠে দেখল যে ম্যাজিশিয়ান আত্মহত্যা করেছে৷’
‘সুইসাইড!’ আমার শিকদাড়া আচমকা ঠান্ডা হয়ে গেল৷
‘হুম, ওই ছাদেই একটা লোহার চেন ঝোলানো ছিল, সেখান থেকেই ঝুলছিল তার দেহটা, কাছে পিঠে কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি৷’ গুরুসদয় থামল৷ আমি নিজে থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না তাকে৷ সিগারেটে জোরে কয়েকটা টান দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, ‘আপনার কি মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক?’
‘একটা মানুষ আত্মহত্যা করলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হবে কী করে?’
‘হুম, যাই হোক সে মারা যাওয়ার পর থেকে অদ্ভুত ঘটনাগুলোও বন্ধ হয়ে গেল৷ তবে তার বন্ধুদের মধ্যে দু-জন ভাড়া নিল ঘরটা৷ রাতবিরেতে কী যেন খুঁজত তারা৷ ছাদ থেকে ঠোকাঠুকির আওয়াজ আসত৷ তারা মাসখানেক কাটানোর পরে ঘরখানা ছেড়ে দিল৷ লোকে বলে ম্যাজিকের ব্যাপারে কিছু একটা আবিষ্কার করেছিল শতদল৷ সেখানাকে অন্যলোকের হাতে পড়া থেকে বাঁচাতেই আত্মহত্যা করে সে৷ অবশ্য জিনিসটা যে ঠিক কী, তা কেউ জানতে পারেনি৷ গ্রামের লোক এমনিতেই একটু বিশ্বাসী, এতসব গুজব ছড়ানোর জন্য আর কেউ থাকতে চায় না ওতে৷’
নদীর পাড়ে বসে পড়েছিলাম আমরা৷ এতক্ষণে সময়টা কোথা দিয়ে কেটে গেছিল বুঝতেই পারিনি৷ আমার কৌতূহল নিয়ে এতক্ষণ কিছু জিজ্ঞেস করেনি গুরুসদয়, এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জমাট আশঙ্কা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কী বলুন তো? কিছু দেখলেন নাকি ওখানে?’
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ‘ভূতের কথা বলছ? না, ভূত দেখিনি৷’
‘তবে?’
‘সব ভূতই আসলে চোখের ভুল৷ চশমা পরেছ কখনও?’
আমার বেখাপ্পা প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেল সদয়; তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘এমনিতে দরকার হয় না, ওই পড়াশোনার ব্যাপার থাকলে…’ ‘চশমার কাচে যদি কখনও দাগ পড়ে যায় তবে প্রথম কয়েকদিন সেটা দিয়ে দেখতে অসুবিধা হয়, তারপরে আর হয় না, কেন জানো?’
গুরুসদয় মাথা নাড়ল৷ ব্যাপারটাকে সে আর আমল দিচ্ছে না৷ ভেবেছে আমি প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি৷
কারণ চোখ নিজে থেকেই ওখানে আর তাকায় না, মানে তাকালেও ওখান থেকে যে আলোটা আসছে সেটাকে আর ব্রেনে পাঠায় না; তার বদলে চারপাশের ছবির সাথে খাপ খাইয়ে এবং কমন সেন্স কাজে লাগিয়ে সেখানটা ভরাট করে নেয়৷ মানে ধর তুমি ক্যামেরায় একটা ছবি তুললে, দেখলে ছবিটার একটা জায়গায় কালো একটা দাগ এসেছে৷ সেটা হটানোর জন্য তুমি দক্ষ কোনও আর্টিস্টকে দিয়ে সেখানটা খাপ খাইয়ে আঁকিয়ে নিলে৷ আমাদের চোখও সেইভাবে ওখানে কিছু একটা বসিয়ে নেয়, ওই জায়গাটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ব্লাইন্ড স্পট বা অন্ধবিন্দু৷’
গুরুসদয় আগের মতোই মাথা দোলাল৷ একটু আগের আগ্রহের লেশমাত্র নেই তার মুখে৷ আমি বুঝলাম একে আর বেশি বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই, ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না৷ তাও কাল সারারাতে যেটুকু জানতে পেরেছি সেটার খানিকটা অন্তত কাউকে না জানাতে পারলে মনটা খচখচ করছে৷ কুড়িবছর আগের সেই ম্যাজিশিয়ান মানুষের চোখের এই অন্ধবিন্দুকে কাজে লাগিয়েই ইলিউশনের খেলা দেখাত৷ এমন একধরনের যৌগ সে আবিষ্কার করেছিল যাতে অন্ধবিন্দুর ফাঁকা জায়গায় ব্রেন নিজের মতো বীভৎস ভয়ংকর ছবি আঁকতে পারে৷ গ্রামবাসীদের চোখে সেটাই কখনও আগুন আবার কখনও নদীর জলের পর্বতপ্রমাণ ঢেউ-এর আকার নিত৷ এখন প্রশ্ন হল, কাজটা করার জন্য আগে যৌগটা মানুষের শরীরে ঢুকতে হবে! এই কাজটা যে সে কীভাবে করত সেটাই জানতে পারিনি আমি৷ সম্ভবত বিশেষ একধরনের ধোঁয়াকে কাজে লাগিয়ে কাজটা করত সে, তবে সে ধোঁয়াখানা যে ঠিক কী থেকে তৈরি হত তার হদিশ পাইনি আমি৷ গুরুসদয়কে বিদায় জানিয়ে নদীর পাড় থেকে উঠে এলাম৷ দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম৷ আজকাল আর দরজা খুলে রাখতে ভালো লাগে না আমার৷ টেবিলের উপর সেই বাক্সটা এখনও রাখা আছে৷ অবশ্য এখন আর তুলো নেই তাতে৷ বাক্সের ভিতরে রাখা আছে ছ-ইঞ্চি লম্বা দুটো কাগজের পাতা৷ যেগুলো তৈরি হয়েছে তুলো দিয়ে৷ হ্যাঁ, তুলো, কোনও রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই তুলো থেকে কাগজ তৈরি হয়, এটা জানা ছিল৷ শুধু অবাক হয়ে গেছিলাম যখন তৈরি হওয়া কাগজের উপর ধীরে-ধীরে লেখা ফুটে উঠল৷ লেখা কাগজদুটো হাতে তুলে নিলাম আমি৷ আজ থেকে কুড়ি বছর আগে মৃত ম্যাজিশিয়ানের সুইসাইড নোট৷
এ চিঠির সাথে সেই কাগজদু-খানাকেও জুড়ে দিলাম৷ একবার পড়ে দেখে নিও৷ সে লেখা যত পড়ছি মনে হচ্ছে যে একটা সময়ের পরে সে ধীরে-ধীরে ম্যাজিকে আগ্রহ হারাচ্ছিল৷ জাদুবিদ্যার পাশাপাশি অতিপ্রাকৃত নিয়ে গবেষণা করত বলে শহরের ম্যাজিশিয়ানরা ঠাঁই দেয়নি তাকে৷ যে ম্যাজিকই সে দেখাত লোকে বলত সে সবই গোপন যন্ত্রপাতির খেলা; যন্ত্রপাতি যে ব্যবহার হয় না সেকথা প্রমাণ করতে গেলে আবার ম্যাজিক দেখানোর কৌশলটাও বলে দিতে হয়৷ সেইটাই সে চায়নি৷ এদিকে ক্রমশ গ্রামের লোকেরও সন্দেহের পাত্র হয়ে উঠছিল সে৷ বেশ বুঝতে পারছিল এ ম্যাজিক দেখানোর কৌশল অন্য কারও হাতে পড়লে সর্বনাশ হবে৷ একসাথে এত মানুষকে এত সহজে বোকা বানানোর সর্বনেশে কৌশল প্রলয় ডেকে আনবে৷ তাও আত্মহত্যা করার আগে একটাই ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছে সে৷ অন্তত একজন হলেও কেউ বিশ্বাস করুক তার ম্যাজিকে, কোনও যন্ত্রপাতি, আলো বা স্টেজ ছাড়াই শুধু চোখের অন্ধবিন্দু আর ধোঁয়ার সাহায্য নিয়ে ভয়ংকর ম্যাজিক দেখাতে পারে৷ সেই জন্যই বোধহয় আমাকে এ ছাদে ডেকে এনেছে সে৷ এখনও রোজ রাতে ঘুমালে মনে হয় অস্থির পায়ে ছাদে সে পায়চারি করছে৷ লোহার চেনের সেই ঠংঠং শব্দ সারারাত শোনা যায়৷ বেশ বুঝতে পারছি এ বাড়িতে বেশিদিন থাকলে আমার মানসিক অবস্থা খারাপ বই ভালোর দিকে যাবে না৷ বেশ কিছু অজানা ভয় একনাগাড়ে চেপে বসছে আমার মনে৷ সেখান থেকে পালানোর একমাত্র উপায় হল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া৷ অথচ ম্যাজিশিয়ানের সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু জানা বাকি আমার৷ যাই হোক, তোমাকে এ চিঠি লেখার পরের দিনই ট্রেন ধরে তোমার ওখানে গিয়ে উঠছি৷ অতএব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে৷ ভালো থেকো, আর চিঠিটা অবশ্যই নষ্ট করে ফেলো৷
ইতি তোমার ছোটমামা৷
চিঠিটা পড়া শেষ করে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস ফেললাম আমি৷ এমন একখানা চিঠি লিখতে গেলে ধৈর্য লাগে বটে৷ ম্যাজিশিয়ানের হাতের লেখা কাগজ দুটোকেও দেখলাম ভালো করে৷ পুরনো বলেই তো মনে হচ্ছে৷ ছোটমামা কোথা থেকে পেলেন কে জানে৷ যাই হোক, এ চিঠি সত্যি অন্য কারও হাতে পড়া ঠিক নয়; লোকটাকে বাকি জীবনের জন্য আবার অ্যাসাইলামে ফিরে যেতে হোক তা আমি চাই না৷ পকেট থেকে দেশলাই বের করে চিঠিটার এককোণে আগুন লাগিয়ে ফেলে দিলাম৷ আর সাথে-সাথে দরজায় টোকা পড়ল৷ ছোটমামাই হয়তো এসে পড়েছেন৷ আমি চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম৷ নাঃ, ছোটমামা নয়, অন্য একটা লোক৷ অচেনা, আমি একটু সরে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকে খুঁজছেন?’
লোকটার মুখে কিন্তু ভাব মাত্র দেখা গেল না৷ আমাকে যেন দেখতেই পায়নি, এইভাবে ঘরের ভিতর ঢুকে এল সে৷ আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম, পরক্ষণেই বাধা দিয়ে উঠলাম, ‘একী! একী! ঘরে ঢুকে পড়ছেন কেন?’ আমি প্রশ্নটা শেষ করতে পারলাম না৷ মনে হল শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি৷ আমার ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে একটা লোহার চেন, লোকটা ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল সেটার দিকে৷ পরম মমতায় হাত বোলাল শক্ত আংটাগুলোতে৷ হঠাৎ কীভাবে যেন জড়িয়ে গেল সেটা তার গলায়৷ যেন মানুষটার গলার জন্যই অপেক্ষা করছিল চেনটা৷ এসব কী দেখছি আমি! গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না৷ তবে কি আমিও হ্যালুসিনেট করছি? আমার উপরেই কাজ করছে ম্যাজিক? কিন্তু কীভাবে? এখানে তো ধোঁয়া… আমার চোখ গিয়ে পড়ল ঘরের মেঝের উপর৷ সেখানে এখনও ঢিমে তালে জ্বলছে ম্যাজিশিয়ানের লেখা কাগজ দুটো৷ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সাদা ধোঁয়া৷ ক্রমশ সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে সেটা৷ আমি উপরে তাকালাম, আমার ঘরের ছাদ থেকে লোহার চেনে ঝুলছে একটা মানুষ৷ তার জিভ মুখের বাইরে বেরিয়ে এসেছে, গলার কাছ থেকে যেন এইমাত্র রক্ত বেরিয়ে আসবে৷ আমি জানি এই সমস্ত সত্যি নয়, ম্যাজিক৷ মৃত্যুর কুড়ি বছর পর শেষবারের জন্য তার শ্রেষ্ঠ ইলিউশনের খেলা দেখাচ্ছে ম্যাজিশিয়ান৷
ঘরের ধোঁয়া বেড়ে উঠেছে, মৃতদেহ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত চুইয়ে পড়ছে আমার গায়ে৷ পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল শরীরটা৷ তার ঝুলন্ত শবদেহ যেন সময়ের মতোই গতিশীল, অথচ শান্ত, তৃপ্তির আমেজে যেন সময়ের সাথেই মিশে গেছে সে৷
দরজায় জোরে-জোরে টোকা পড়তে জ্ঞান ফিরল আমার৷ ভাগ্যিস চিঠি পড়ার আগে জানলাটা খুলে দিয়েছিলাম, এতক্ষণে সব ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে গেছে৷ আবার জোরে-জোরে টোকা পড়ল, মাটি থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম আমি৷ ছোটমামা এসেছে…