অন্ধকার সিঁড়ি

অন্ধকার সিঁড়ি

ম্যানেজারের ছেলের জন্মদিনের পার্টি ছিল। বিরাট ধুমধাম। প্রত্যেকবার এসব পার্টিতে শুধু বাচ্চাদেরই ডাকেন রায়-দম্পতি। সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ দু চারটি পরিবার। এবারের জাঁকজমক একটু চোখে পড়ার মতো। দুই মালিক পরিবার পর্যন্ত উপস্থিত। নরম পানীয়ের পাত্র হাতে করে প্রত্যেক অতিথিকে আলাদা করে আপ্যায়ন করছেন পরমার্থ রায়। মাঝে মাঝে ছোটখাটো বক্তৃতাই দিয়ে ফেলছেন— ‘এমনি করে আমরা যখন মাঝে মাঝে মিলিত হবো বুঝলেন, তখন ভুলে যাবার চেষ্টা করব আমাদের সম্পর্কটা কর্মক্ষেত্রের। আসল কথা কর্মক্ষেত্রকে উপলক্ষ্য করে আমরা তো এখানে একটা পরিবারই গড়ে তুলেছি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ব্যাপারেও কি আমরা পরস্পরের পরামর্শ নিতে পারি না? তাতেও কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’

বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই চোখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। রায় কি বলতে চাইছেন এবং হঠাৎ ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এত বয়স্কদের জড়ো করেছেন কেন বুঝতে অসুবিধে হয় না। সেনগুপ্তর আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় ফ্যাক্টরির শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রায় একটা মস্ত ঢিল পড়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এখন সমান হয়ে গেছে সব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি, প্রশ্ন, বিস্ময়, ভয় এখনও কাজ করে যাচ্ছে। পরমার্থ বুঝি সবাইকে বলতে চাইছেন ব্যক্তিগত দুঃখ যত বড়ই হোক না কেন, তাকে গোপন রেখে এ রকম একটা অশুভ কাণ্ড ঘটানোর আগে এ কলোনির বাসিন্দারা যেন বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শ নেয়। আর কেউ না হোক পরমার্থ নিজে আছেন। তিনিই তো এ-কলোনির সবাইকার ভালোমন্দ শুভাশুভের জন্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তবে ওসব ঝামেলায় দরকার কি? হিন্দু শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ হয় নিয়মভঙ্গ নামে আচার দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী শোকপালনের পর উৎসব। নতুন জামা-কাপড়, লোভনীয় খাদ্যবস্তু, আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন। এইভাবেই ভুলতে হয় মৃত্যুশোক। পরমার্থ যেন সে কথা মনে রেখেই আজকের এই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের আয়োজন করেছেন। মুছে ফেলতে চাইছেন ভয়ানক এক অমঙ্গলের স্মৃতি।

জয়ন্তী রায় মভ রঙের একটা দারুণ জমকালো তানচোই পরে একবার ভেতরে একবার বাইরে যাওয়া-আসা করছেন। ভেতরের ঘরে বাচ্চাদের হুল্লোড়ের ব্যবস্থা হয়েছে। বেলুন, পুতুল, বল, খেলা এইসব নিয়ে জমেছে সেখানে মিমি আর মিন্টুদের আসর। চিৎকারে কান পাতা যায় না। বাইরে বাগানে গাছের মধ্যে আলো জ্বেলে বড়দের পার্টি। পরমার্থ বললেন, ‘জয়ন্তী তুমি একটু এদিকে এসো।’ ঘোষাল গিন্নি আর মিসেস মহাপাত্র, রায়চৌধুরী আর মিসেস সিং, অরোরা এবং মিসেস চ্যাটার্জি, জয়ন্তী হাসিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, আধো-অন্ধকার ঝাউতলা থেকে উচ্চারিত হল— ‘মিসেস রায়, আমরা অধমরাও আছি কিন্তু এদিকে!’ সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা দোহারা ভদ্রলোককে চিনতে পারলেন না জয়ন্তী রায়। তাঁর পাশের নেভি-ব্লু স্যুট পরা বেঁটেমতো ভদ্রলোকটিকেও না। পরমার্থ তাড়াতাড়ি এসে আলাপ করিয়ে দিলেন— ‘এখানকার থানার ও· সি· দ্বারিকা মৈত্র, ইনি ইন্সপেক্টর ঘোষদস্তিদার।’

জয়ন্তী এগিয়ে যেতে গিয়ে বাগানের মাটিতে একটা আধলা ইটে হোঁচট খেলেন। পরমার্থ বললেন— ‘আহা, দেখে চলবে তো!’ যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে জয়ন্তী বললেন— ‘ঠিক আছে, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে, ব্যস্ত হবার দরকার নেই।’

ইন্সপেক্টর ঘোষদস্তিদার দৌড়ে গেলেন বরফ আনতে।

দ্বারিকা মৈত্র বললেন— ‘পুলিশের এই মুশকিল, বুঝলেন মিঃ রায়, কেউ-ই তাদের দেখে খুশি হতে পারে না। পুলিশি খোলস ছেড়ে ফেললেও না। কেমন সুন্দর জমেছিল আপনাদের পার্টি। খামোখা মিসেস রায় হোঁচট খেলেন। যাই হোক, আমার কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার লোভ ছিল খুব।’

ঘোষদস্তিদারের আনা বরফের টুকরোটা পরমার্থ রুমালে করে জয়ন্তীর পায়ে চেপে ধরেছেন ততক্ষণে, জয়ন্তী ঈষৎ রুক্ষ স্বরে বললেন, ‘আমার সঙ্গে পরিচিত হবার লোভ? কেন বলুন তো?’

—‘বাঃ, আপনার কত রকম সমাজসেবামূলক অ্যাক্টিভিটি, লোকমুখে শুনি কান্তিভাই ভুলাভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার নাকি আপনিই!’

কি মশাই রাগ করলেন না তো?’ পরমার্থর দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন দ্বারিকা মৈত্র।

পরমার্থ হাসলেন। মনে মনে বললেন— ‘যতই পুলিশি খোলস ছেড়ে আসো। যে চোয়াড়ে ছিলে সেই চোয়াড়েই আছো।’

জয়ন্তী বললেন— ‘মাপ করবেন, আমি একটু ওদিকে যাই।’

—‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনি অন্য অতিথিদের দেখুন!’

পরমার্থ বললেন—‘তুমি চলতে পারবে তো?’

—‘একটু ধরো আমাকে। ভেতরে গিয়ে আরেকটু বরফ দিই। ঠিক হয়ে যাবে।’

রায় ধরে ধরে জয়ন্তীকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন পেছনের দরজা দিয়ে। দুজনে একা হওয়া মাত্র জয়ন্তী ফিরে দাঁড়ালেন, ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন— ‘ও লোকদুটোকে নেমন্তন্ন করতে তোমায় কে বলেছিল?’

—‘ওরা নিজেরাই বলেছিল। কাউকে জানাতেও বারণ করেছিল, পরমার্থ ভাবিত গলায় বললেন।

—‘তাই বলে আমাকেও জানাবে না!’

—‘তোমাকে জানাতে বিশেষ করে বারণ করে দিয়েছিল যে, তুমি জানলে নাকি আরও অনেকে জেনে যাবেই····’

—‘কি চায় ওরা?’

—‘বুঝতে পারছি না ঠিক। সেনগুপ্তর মৃত্যুর ব্যাপারটাতে ওদের মনে একটা খটকা লেগে আছে। আজ দেড় মাস ধরে আমাকে ক্রমাগত ফোন করে পার্টি থ্রো করতে বলছে। খুব সন্দেহজনক ওদের হাবভাব। কিছুই বুঝতে পারছি না।’

জয়ন্তী নিচু গলায় বললেন— ‘টাকা-কড়ি কিছু যদি চায়, দিয়ে বিদায় করো!’

—‘খেপেছো? কি কারণে, কার ওপর সন্দেহের বশে এভাবে ঘোরাঘুরি করছে কিছুই জানি না, মাঝখান থেকে আমি টাকা-কড়ি অফার করে বিপদে পড়ি আর কি।’

রাত প্রায় দশটা হল অরণ্যদের বাড়ি ফিরতে। মৃদু আলো-জ্বলা স্নিগ্ধ রাতের রাস্তা বেয়ে, শিশির মাড়িয়ে বাড়ি ফেরা। দূর থেকে দেখা যায় ভূতের মতো অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়িটা। চুড়োর ওপর একটুখানি আলো। বেশ চাঁদের রাত। সেই আলোই পড়েছে বাড়ির মাথায়। বাকিটুকু গাছপালার ঝুপসি অন্ধকারে কালো হয়ে আছে। ওপরের ফ্ল্যাটটা এখনও ফাঁকাই আছে। নতুন এঞ্জিনিয়ার নিয়োগ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি ওখানে থাকতে রাজি হননি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। ব্রততী জানালা খুলল। অরণ্য চমকে বলল— ‘কেউ কি ওপরে জানলা খুলল?’

ব্রততী বলল—‘না গো। আমাদের জানালা খোলার শব্দেরই কেমন একটা প্রতিধ্বনি হয়। অন্য সময়েও আমি দেখেছি, হয়ত জানলা বন্ধ করলুম একটু পরে মনে হল ওপরেও কে খোলা জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে।’

ঠাণ্ডা জলের একটা বোতল বার করল ব্রততী। অরণ্য বলল

—‘আবার বেশ করে পান খেয়েছো তো? নাও, এবার সারা রাত ধরে জল খেতে থাকো।’

—‘কি করব, রিচ ফুড খেলেই আপনা থেকেই পানের দিকে হাত চলে যায়’— গ্লাসে জল গড়িয়ে অরণ্যর দিকে এগিয়ে দিল ব্রততী। নিজের গ্লাসটা নিয়ে উল্টোদিকের সোফাটায় গিয়ে বসলো।

হঠাৎ বলল— ‘জানো, ব্যাপারটা খুব সম্ভব জয়ন্তীদি যা অনুমান করেছেন তাই।’

—‘কিসের ব্যাপার?’

—‘ওই ওদের’, ব্রততী ওপর দিকে ইঙ্গিত করল।

—‘অনুমানটা কি?’

—‘ওদের সম্পর্ক ভালো ছিল না।’

—‘এরই মধ্যে বুঝি তোমার জয়ন্তীদির সঙ্গে এক পক্কড় হয়ে গেছে।’

—‘আজ নয়।’

—‘কবে আবার গিয়েছিলে?’

‘আমি যাইনি, জয়ন্তীদিই এসেছিল।’

এই আরেকটি ভদ্রমহিলা, অরণ্যর খুব কম অপছন্দের মানুষদের মধ্যে যিনি অন্যতম। যদিও ওঁর সুবাদেই অরণ্যর এখানকার চাকরি, এবং সে হিসেবে ওঁর প্রতি কৃতজ্ঞই থাকা উচিত ছিল অরণ্যর। ও তখন ম্যানিলায়। রোজগারপাতি করছে ভালোই। কিন্তু ব্রততী কাছে নেই। তখন ব্রততীর মা বেঁচে। দু ভাইয়ের সংসার, তার মধ্যে একজন ওই রকম অচল। কে দেখবে অসুস্থ ভদ্রমহিলাকে? ব্রততী-ই, সেই দেখাশোনার ভারটা মূলত বহন করত। ও ম্যানিলা যায়নি। অরণ্যের জোর করবার অধিকার ছিল না। সে অধিকার খাটানো চলবে না এই শর্তেই বিয়ে। ব্রততী তো বিয়ে করতেই চায়নি। সৌম্যর জন্যই ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

ম্যানিলাতেই রায়ের সঙ্গে আলাপ। ব্রততী একবার বেড়াতে গেল তখনই জানা গেল জয়ন্তী রায় অর্থাৎ পরমার্থ রায়ের স্ত্রী ব্রততীর পরিচিত। সেই সূত্রেই এখানকার চাকরি।

ব্রততী বেশি যায় না। কিন্তু মিসেস রায় প্রায়ই ওদের বাড়ি আসেন। ব্রততীর চাকরিটা ওর মেলামেশা না করার একটা কৈফিয়ত হিসেবে খাড়া করা যায়। কিন্তু অরণ্য মনে মনে একেবারেই চায় না ব্রততী ম্যানেজারের বাড়ি বেশি যাক। প্রথমত বেশি গেলে অফিসার মহলে কানাকানি হবে। মার্কেটিং ম্যানেজার তো প্রকাশ্যেই হাসি-ঠাট্টা করে এ নিয়ে। দ্বিতীয়ত অরণ্য জানে, ব্রততী জানে না জয়ন্তী রায় ওপর ওপর খুব আদিখ্যেতা করলেও মনে মনে ব্রততীকে দারুণ হিংসে করেন। খুব সূক্ষ্ম কিন্তু নির্ভুল ভদ্রমহিলার এই হিংসার ব্যাপারটা। অনেকের মাঝখানে হঠাৎ ব্রততীকে অপদস্থ করে উনি ওঁর এই প্রবৃত্তিটা চরিতার্থ করেন। ব্রততী খুব সাদাসিধে সাজগোজ করতে ভালোবাসে। তাতে ওকে দেখায়ও ভালো। জয়ন্তী আবার অত্যন্ত উগ্র। হাল্কা চাঁপা রঙের চান্দেরি শাড়ি, এলোখোঁপা আর সামান্য একটা টিপেই ব্রততীকে অসাধারণ দেখায়, যাদের দেখবার চোখ আছে, তাদের কাছে অবশ্য। পাশে ঝকমকে ব্রোকেড বা সিল্ক শাড়ি, চোখে আই শ্যাডো, ঠোঁটে গালে গাঢ় মেক-আপ জয়ন্তী যেন বিপরীত মেরু। হঠাৎ জয়ন্তী উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন— ‘আরে ব্রততী, তুই কি স্কুল থেকে সোজা এলি? নাঃ, মুখার্জি তোকে আর হাত খরচটা কিছুতেই দিল না।’

ব্রততী নিজের ভাবে এমনই মগ্ন যে এইসব কথার ইঙ্গিত, অপমান ও বোঝেও না, খেয়ালও করে না। স্নিগ্ধ হেসে বলে— ‘কই না তো জয়ন্তীদি, রীতিমতো ঘণ্টাখানেক বিউটি-স্লিপ দিয়েছি। তাতেও হয়নি?’ এটা তো কিছুই না। এর চেয়েও মারাত্মকভাবে ব্রততীকে অনেক সময় আক্রমণ করেন ম্যানেজার-গিন্নি।

—‘তুই আর কি বুঝবি ব্রততী, বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে থাকার যা জ্বালা!’

কিংবা—‘তুই টিপটপ থাকবি না কেন? আমাদের মতো কি? মিন্টু এসেই গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হাউস-কোট কি আর সাধে পরি! নইলে ও সব নকল মেমসাহেবিতে আমার বিন্দুমাত্রও মোহ নেই।’

এসব সময়ে ব্রততী সাদা হয়ে যায় একেবারে। অরণ্য ওকে রক্ষা করতে চায়, যতটা পারে করেও। কিন্তু এইসব আঘাত অথবা সুরক্ষা কোনটাই ব্রততীকে শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করে কিনা সন্দেহ আছে। দু দিন পরই হয়ত দেখা যাবে জয়ন্তী রায় বিভোর হয়ে গল্প করছেন ব্রততীর সঙ্গে। ব্রততীর মুখে মেঘভাঙা রোদ্দুরের মতো হাসি। বিবাহপূর্ব দিনগুলোতে যেমন দেখা-না-দেখায় মেশা ছিল, আজও তেমনি আছে ও। রহস্যময়ী।

—‘কি বাণী দিলেন ম্যানেজার সাহেবা!’ জিজ্ঞেস করল ও।

ব্রততী সামান্য হাসল, বলল— ‘জয়ন্তীদি এমনিতে খারাপ মানুষ না। শুধু নারীসুলভ কৌতূহলটা বরাবরই একটু বেশি। একটু বেশি মেয়েলি মেয়ে। যাই হোক ওই একই কারণে জয়ন্তীদির ইন্সটিংটটা অনেক সময়ে ঠিক কথা বলে।’

—‘যেমন?’

—‘মনে আছে পারমিতা আসতে সেদিন আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরলুম!’

—‘হ্যাঁ। তোমার গায়ের ওপর টলে পড়ে গেল।

—‘সম্পূর্ণ ভান।’

—‘কোনটা?’

—‘ওই পড়ে যাওয়াটা। ইচ্ছে করেই সমস্ত ওয়েটটা আমার গায়ের ওপর ছেড়ে দিল। আসল আর নকলের তফাত ঠিকই বোঝা যায়। ও খুব সম্ভব ফেস করতে পারছিল না কাউকে।’

অরণ্য চিন্তিত গলায় বলল—‘সেটা কিন্তু স্বাভাবিকই। এরকম পরিস্থিতিতে লোকে সবচেয়ে আগে স্ত্রীকেই দোষ দেয়। ফেস করতে পারা কঠিন।

—‘কি যে বলো!’ অসহিষ্ণু গলায় ব্রততী বলল, — ‘স্বামী হঠাৎ মারা গেছে, এ অবস্থায় কোনও স্ত্রীর ওসব ভাববার সময় থাকে নাকি? দিশেহারা হয়ে যাবার অবস্থা তখন। আমি কিন্তু সেরকম কিছু দেখলুম না। অজ্ঞান হবার ভান করে ওর চোখে যে এতটুকু জল নেই, এটাই ও লুকোলো।’

—‘হঠাৎ মারা যাওয়া আর সুইসাইড কিন্তু এক নয় ব্রততী। চোখের জল এ অবস্থায় শুকিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আফটার অল যে মানুষটা আত্মঘাতী হচ্ছে সে তার সমস্ত প্রিয়জনকে রিজেক্ট করছে। তোমরা পারোনি, আমায় সুখী করতে পারোনি, তাই আমি বিনাশের পথ বেছে নিচ্ছি— এই ধরনের একটা মেসেজ আত্মঘাতের পেছনে থাকে।’

ব্রততী চুপ করে রইল। একটু পরে অরণ্য বলল— ‘শ্মশানে পারমিতার বাবা আর সুমন্তর দিদির কথাবার্তাও অবশ্য আমার ঠিক স্বাভাবিক লাগেনি।’

—‘কিছু বলোনি তো?’

—‘বলব আর কি! তুমি যেরকম আপসেট সেদিন!’

—‘আপসেট আবার কি? ওরকম ভয়াবহ দৃশ্য হঠাৎ দেখলে যে কেউ হার্টফেল করতে পারে।’

অরণ্য শ্মশানের ঘটনাটা বিশদ করে ব্রততীকে বলল।

—‘দেনা-পাওনা নিয়ে একটা মন কষাকষির ব্যাপার আছে, মনে হয়। কিন্তু সুমন্তর দিদিও কি সব দেওয়া-টেওয়ার কথা বলছিলেন বলে ব্যাপারটা কিরকম ধোঁয়াটে হয়ে গেল।’

ব্রততী বলল— ‘সেদিন ট্রেনে দুজন ভদ্রলোকের আলোচনা হঠাৎ কানে এলো।’

—‘কি আলোচনা?’

—ভুলাভাই কান্তিভাইয়ের চীফ এঞ্জিনিয়ারের ব্যাপারটা শুনেছেন? একজন বললেন, আর একজন বললেন— না তো! কি ব্যাপার? সুমন্ত সেনগুপ্ত ছিল না? —হ্যাঁ, সুইসাইড করেছে, একেবারে মাথা টিপ করে গুলি।

—হাউ স্যাড। দারুণ ব্রাইট চ্যাপ। বিয়েও তো করেছিল! বি.ই-তে আমার দু বছরের জুনিয়র ছিল, প্রচণ্ড র‍্যাগ করেছিলুম। সব অত্যাচার সইল। খালি গেঞ্জি খুলে ফেলতে বলতেই টপ টপ করে জল পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। বিদেশ গেল একেবারে হঠাৎ। ফিল্মস্টারের মতো বউ নাকি? —তা তো বলতে পারবো না। তবে ওই কোর্টেই গোলমাল।

—কি রকম? —স্ত্রীর সম্ভবত বিবাহ-পূর্ব কোনও ব্যাপার ছিল, দেশে ফিরে সেটাই কনটিনিউ করছিল···এরপর দুজনেরই গলার স্বর খুব খাদে নেমে গেল···’

অরণ্য বলল—‘পারমিতার ব্যবহারে এসব কোনদিন মনে হয়নি তো!

ব্রততী বলল—‘এসব কি ব্যবহারে মনে হওয়ার জিনিস! একটু আড়ো-আড়ো ছাড়ো-ছাড়ো ভাব কিন্তু আমি সেন্স করেছি।’

—‘অমনি তুমি সেন্স করে ফেললে? একটা বাজে গুজবের ওপর ভিত্তি করে। মাথার খুলি টিপ করে গুলি? হুঁঃ। মানুষ দেখো কেচ্ছার গন্ধ পেলে আর কিছু পায় না।’

—‘অত বাপের বাড়ি থাকত কেন?’

—‘অত আর কই? শনি-রবি তো? তার একটা কারণও তো ছিল। তোমরা মেয়েরা কোথায় মেয়েদের ডিফেন্ড করবে, তা···না···।’

ব্রততী বলল—‘বেশ তো, পারমিতাকে তুমি কখনও গান গাইতে শুনেছো?

—‘কি করে শুনবো? আমাদের এখানে তো এসে দশ মিনিটও বসত না। হয় চাবি রাখতে, নয় দিতে, আর নয় তো কিছুর জন্য থ্যাঙ্কস দিতে।’

—‘তা নয়। যারা গান-টান শেখে, তাদের অভ্যাসই হল যখন-তখন গুন গুন করা। এরকম গুন গুন বা রেওয়াজ মাঝে মাঝেই আমাদের কানে আসা উচিত ছিল কিনা বল। আমি কিন্তু কোনদিন শুনিনি।’

অরণ্য হেসে বলল— ‘এটা একটা কথা বটে। গুড গুড। তোমার তো দেখছি ক্রমেই একটা টিকটিকি-সদৃশ সিক্সথ-সেন্স গ্রো করছে। হেডলি চেজ-টেজ পড়ছ নাকি আজকাল? তুমি কি বলতে চাইছ গান শেখার ব্যাপারটা হোক্স? কিন্তু এরকম ধাপ্পা প্রতিবেশীকে দেওয়া গেলেও স্বামীকে কি দিনের পর দিন দেওয়া যায়?’

—‘যায় না-ই তো? তাই জন্যেই···’

—‘দুম করে একটা জ্বলজ্যান্ত যুবক আত্মঘাতী হয়ে গেল। ননসেন্স।’

ব্রততী বলল—‘সবার মেজাজ তো আর এক রকম হয় না!’

অরণ্য উঠে পড়ে বলল—‘তুমি যা-ই বলো, মেয়েটাকে আমার কোনদিনই এমন ক্যাড মনে হয়নি। বরং মনে হত খুব প্র্যাক্টিকাল, জীবন সম্পর্কে একটা ডেফিনিট কনসেপশন নিয়ে কাজ করে। তুমি কি জানো, ও অ্যাকাডেমিতে একটা কিসের এগজিবিশন করেছিল!’

—‘কই শুনিনি তো! বলোনি তো আমাকে?’

—‘আমার মনে ছিল না। সেনগুপ্ত কার্ড দিয়ে গেল অফিসে, যাবার জন্য রিকোয়েস্ট করে। কিন্তু সেইদিনই তোমার পিসতুত বোনের বিয়ে ছিল। যাওয়াও হয়নি। তোমায় বলাও হয়নি। তারপর তো বেমালুম ভুলে গেছি। অনেক গুণ মেয়েটির। ব্যস্ত থাকত খুব।’

দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। শেষে অরণ্য বলল— ‘ভালো কথা। দ্বারিকা মৈত্রকে দেখেছিলে?’

—‘কে দ্বারিকা মৈত্র?’

—‘এখানকার ও.সি. গো? যে ভদ্রলোক সেদিন এসেছিল। আজ তুলসী বনের বাঘের মতো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ঘাপটি মেরে বসেছিল।’

ব্রততীর চোখ দুটো সতর্ক হয়ে উঠল। বলল—‘কেন’?

অরণ্য বলল—‘পরমার্থদার খেয়াল! আলাপ-সালাপ হয়েছে, হাতে রাখতে চাইছেন হয়ত!’

ব্রততী বলল—‘আমি শুতে চললুম। তুমি কি আরও বসবে?’

—‘বসি আরেকটু!’

ব্রততী চলে গেলে, একটা সিগারেট ধরিয়ে অরণ্য দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। মৃদু একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। দূরে কোথাও জীপের গর্জন শোনা গেল। মোপেডের বিকট আওয়াজ। তারপর সব চুপচাপ। চাঁদটা বাড়ির পেছনে চলে গেছে এখন, অস্ত যাচ্ছে। এদিকটা একেবারেই অন্ধকার, রাস্তার আলোগুলো ছাড়া। ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা আলো আবার জ্বলছে না। হঠাৎ অরণ্যর মনে হল পাশ দিয়ে হাল্কা পায়ে কে চলে গেল, মৃদু একটা গন্ধ আফটার-শেভ লোশনের— ভাসছে হাওয়ায়। সাদা রুমাল একটা আটকে আছে কি বাঁ দিকের ঝোপে! ফিসফিস করে কে যেন বলল

—‘হ্যাল্লো মুখার্জি? এখনও জেগে? ‘ঘুমোতে যান। গুড নাইট।

গুড নাইট। গুড না···ই···ট।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *