প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 6

অন্ধকার সাপ্লাই করপোরেশন

অন্ধকার সাপ্লাই করপোরেশন

বেয়ারা কাঁচুমাচু মুখে বললে—স্যার, আমার কী দোষ? সাহেব স্লিপে যা লিখলেন আমি সেইটাই আপনার টেবিলে রেখে গেছি। তিনি ভিজিটার্স রুমে বসে আছেন।

শাট আপ। তুমি কি আজকাল গাঁজা-টাঁজা খাচ্ছ? বেয়ারা স্মার্টলি বললে, না স্যার। গাঁজা সস্তা হলেও, দুধ সস্তা নয়। গাঁজার সঙ্গে দুধ টানতে হয়, তা না হলেই কলকের মতো ফটাস। খুব কথা শিখেছ? তোমার চাকরি আমি নট করে দেবো। পারবেন না স্যার। আমাদের ইউনিয়ান আছে। বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করলে নিজেই ট্রান্সফার হয়ে যাবেন ধাধধাড়া গোবিন্দপুরে। গেট আউট! যে আজ্ঞে। বেয়ারাকে বিদায় করে দিয়ে স্যার ইন্টারকমে পি এ-কে ডাকলেন, বিশ্বাস দ্যাখো তো স্লিপটায় কী লেখা আছে! বিশ্বাস চশমা খুলে কাগজের টুকরোটা চোখের খুব কাছে এনে বললেন—আজ্ঞে চার্চিল। দশ নম্বর ডাউনিং, স্ট্রিট, লন্ডন। স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, ইমপোস্টার? দেখে এসো তো ভিজিটার্স রুমটা। কী দেখলে। আজ্ঞে সেই মোটা চুরুট। সেই টুপি। সেই ছাতা। কী করে হয় বলো তো। মরা মানুষ জ্যান্ত হয়! আমার ইতিহাস তেমন পড়া নেই বলতে পারব না। চার্চিল কি মারা গেছেন? তুমি আর এক ইডিয়েট। ওয়ার মেময়ার্সটা কাল থেকে রোজ পাঁচ পাতা করে পড়ে অফিসে আসবে। বয়েস হয়েছে। একটু লেখাপড়া করো পাঁচু। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। যাও ডেকে আনো! স্যার! মিস্টার তুলপুলে এসে বসে আছেন অনেকক্ষণ! সে আবার কে? তুলতুলে? তুলতুলে নয়, তুলপুলে। আমাদের এজেনসি হাউসের কপিরাইটার। আই সি, আই সি। স্মৃতিশক্তিটা ক্রমশ কমে আসছে, বিশ্বাস। কাল থেকে সকালে আর একটা ডিম, আর একটা মাল্টি ভিটামিন ক্যাপসুল বাড়াতে হবে দেখছি। মেমারির কী দোষ বলো! দেশে দুধ নেই, ঘি নেই, গরু নেই, ছাগল নেই। থাকার মধ্যে গুচ্ছের অপদার্থ মানুষ! দুজনকেই ডাকো।

চার্চিল পরে, তুলপুলে আগে ঘরে ঢুকলেন। আপনি চার্চিল? ছবি দেখেছি। বেড়ে মেকআপ নিয়েছেন। অবিকল সেই রকম দেখাচ্ছে। মোটাসোটা, থলথলে থপথপে। বসুন। উঠে দাঁড়ালুম না। সাতচল্লিশে স্বাধীন হয়েছি। সাহেব দেখলে বোকার মতো উঠে দাঁড়াব না। প্রতিজ্ঞা করেছি। বসুন তুলপুলে। চার্চিল আপনি তো মারা গেছেন, যদদূর জানি। চার্চিল, চুরুট সরিয়ে বললেন, তাহলেও আসতে হল, রেসারেকসান। ইউ হ্যাভ আউটচার্চিলড চার্চিল। হ্যাভ এ সিগার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আমার কৃতিত্বকে তোমরা ম্লান করে দিয়েছ। হাও স্মুথ! হাও সাডেন! মানে? মানে, তোমাদের এই আলো থেকে অন্ধকারে চলে যাওয়া। এই আলো এই অন্ধকার! এই আছে এই নেই। চকিত চপলা সম চঞ্চল সতত মন। আরে ব্রাদার গ্রেট ওয়ারের সময় ওরকম একটা ডিসিপ্লিনড লন্ডন শহরকে নিমেষে অন্ধকার করতে আমার জান কয়লা হয়ে যেত! আমি ভাই স্টাডি ট্যুরে এসেছি। আমি তোমার কাছে তোমাদের এই আর্টটা শিখতে চাই।

হে হে বাবা! হোয়াট বেঙ্গল ডাজ টুডে ওয়ার্লড উইল ডু টুমরো। কিন্তু! এটা তো একার চেষ্টায় হবে না। এর জন্যে ভালো টিমওয়ার্ক চাই, শক্তিশালী প্রশাসন চাই। জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে, ভ্যাঁপ পোঁ পোঁ, ভ্যাঁ পোঁ পোঁ। চা না কফি! কফিই হোক, আমারটা ব্ল্যাক। বিশ্বাস, একটা ব্ল্যাক দুটো ব্লু ব্ল্যাক। হ্যাঁ যা বলছিলুম, ভালো অন্ধকারের জন্যে তোমার গোটাকতক জিনিস চাই—একটা হল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড, দুই বাঙালি কর্মী, তিন গোটাকতক ইউনিয়ন, চার মাশরুম পলিটিকস। ওই গোটাদুয়েক কী তিনেক পলিটিক্যাল পার্টিতে অন্ধকার হয় না, সাহেব, বড়জোর মৃদু আলো ডিম লাইট হয়। টোটাল ডার্কনেসের জন্যে সেই রকম জাতীয় প্রস্তুতি চাই। সেই রকম মেজাজ চাই। বঙ্গ আমার জননী আমার, যেখানে বাঙালি, সেখানেই অন্ধকার। গর্বে আমার গর্ভকেশর ফুলেছে। তুমি বসো। আমি ততক্ষণ মিস্টার তুলপুলের সঙ্গে একটু কাজের কথা সেরে নি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

মিস্টার ফুলফুলে! আই অ্যাম তুলপুলে স্যার। ইয়েস ইয়েস। কোথাকার লোক আপনি! বাঙালি স্যার। চাকরি হচ্ছিল না বলে টাইটল পালটে তুলপুলে। আমার একটা ডিসকোয়ালিফিকেসানও ছিল। দশ বছর সরকারি চাকরি করে ফেলেছিলুম। প্রাইভেট হাউসের ধারণা পাঁচ বছর সরকারি চাকরি করলে মানুষ খ হয়ে যায়। খ হয়ে যায়? আই সি, আই সি, মিউল হয়ে যায়। যাক, স্লোগানটা ভেবেছেন? দেখি। বা: নাইস। ‘আমরা ঘরে-ঘরে অন্ধকার বিলি করি।’ অ্যাপ্রাোপ্রিয়েট, ভেরি অ্যাপ্রাোপ্রিয়েট! কিন্তু এটা কি ঠিক হবে স্যার? একটু স্যাটায়ারি-ক্যাল শোনাচ্ছে না! কান্ট হেল্প! এখন আমাদের সত্যি কথা সোজা করে বলতে হবে। বিজ্ঞাপন মানে, সেলিং হোপস, টাকে চুল গজিয়ে দেব, এক বাড়িতে বুড়োর যৌবন ফিরিয়ে দেব, কেলেমানিককে ফরসা করে দেব। মিথ্যা ভাষণ আর চলবে না। বাজে প্রতিশ্রুতি নো মোর। এখন কোদাল ইজ এ কোদাল। তবে হ্যাঁ, এখনও মাঝে-মাঝে আলো জ্বলে। জ্বলে, অন্ধকারকে আরও অন্ধকার করার জন্য। রেটিনায় আলোর ধাক্কা মেরেই অন্ধকারে ভাসিয়ে দাও! তবে না, ভেসে যায় না ভাসিয়ে নে যায়।’ তবেই না বলতে পারছি আমরা অন্ধকার বিতরণ করি! সূর্য ডুবলেই তো অন্ধকার! আমাদের কেরামতিটা কোথায়! সেইখানে, অন্ধকারটা আমার ঘাড় ধরে উপভোগ করাই। নিন লিখুন—সাব হেডিং, ‘দুধ চাইলে দুধ দেব, টামাক চাইলে টামাক। ‘টামাক’ নট তামাক। স্বেচ্ছায় যাঁরা আমাদের অন্ধকার প্রকল্পে যোগ দেবেন, যেন ডি সি থেকে এ সি তে যাওয়ার সময় ঠিক করা হয়েছিল, ঠিক সেই ভাবে আমরা আপনাদের সাহায্য করব। কী সাহায্য করব! এক, পাখা বদল। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্ভাবিত, ঘোরালেই ঘোরে পাখা। কাঠের লম্বা-লম্বা গোল ডান্ডা। কাঠের ব্লেড। বলবেয়ারিং লাগানো। সিনথেটিক এনামেল রং মাখানো। বাহারি হালকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। ছুতোর মিস্ত্রির তুরপুন ঘোরাবার কায়দায় শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ইচ্ছামতো সারাদিন ঘোরাতে পারেন। ঘোরানোর একটা নেশা আছে। চাকা ঘোরানোর নেশার মতো! চাকা ঘুরিয়েই জুয়া খেলা হয়। জুয়ার নেশা ধরে গেলে সহজে ছাড়ে না। এই পাখা নাছোড়বান্দা। ঘোরানোর জায়গায় সিল্কের সুতোয় ফাঁস। দুটো প্রান্ত দুদিকে ঝুলছে। একবার এপ্রান্ত আর একবার ওপ্রান্ত ধরে টেনে ছেড়ে দিন। পাখা ঘোরে বনবন। ‘মোমেন্টাম’ বেশ কয়েক পাক ঘুরে যেই থামব থামব হচ্ছে, মারুন আবার টান। খিঁচো পাখা, পাখা খিঁচো। হাতে পায়ে চঞ্চল দুরন্ত শিশু সব সময় যে কিছু না কিছু অনিষ্ট করছে, লাগিয়ে দিন তাকে পাখা ঘোরানোর কাজে। পাখার নেশায় মশগুল থাকবে সারাদিন। অবসরভোগী খুঁতখুঁতে বৃদ্ধ সারারাত যাঁর চোখে ঘুম নেই, ফিট করে দিন পাখায়, নিদ্রাহীন রাত কোথা দিয়ে ভোর হয়ে যাবে টেরও পাবেন না। কত্তার পাখা চালানোর গতি প্রকৃতি দেখে বোঝা যাবে মেজাজ সপ্তমে না সুরে বাঁধা। ফুরফুর হাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজ। মেজাজ বুঝে পাছাপাড় শাড়ির বায়না, সিনেমার বায়না। মঞ্জুর। এই পাখা ঘরে ঘরে বেকারকে সাকার করবে। পাখা ঘুরিয়ে রোজগার করুন। রোজগার করে পাখা ঘোরান। অভ্যাস করলে সারারাত ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েও পা দিয়ে পাখা চালানো যাবে। দড়ির এক মাথা কত্তার পায়ে আর একমাথা গিন্নির পায়ে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা বাড়বে। ঝগড়া কমবে। নির্ভরতার ভাব আরও দৃঢ় হবে! বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা কমবে। সুস্থ সন্তান জন্মাবে। হাতের পায়ের পেটের মাংসপেশী দৃঢ় হবে।

এইবার সেকেন্ড আইটেম। দুই, রেফ্রিজারেটার। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে যে কোনও অফিসের দিনে সকাল এগারোটা থেকে চারটের মধ্যে রং করা বিচিলি বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রঙিন বিচিলির বেশ বড়সড় একটা টুপি পরিয়ে ফ্রিজটাকে মরাই বানিয়ে ফেলুন। তার ওপর বিছিয়ে দিন আমাদের দেওয়া খসখস। একটা ছোট বালতি, পিচকিরি আর একটা ঝালর লাগানো লাল পাখাও দেওয়া হবে। ফিচিক ফিচিক করে জল ছিটিয়ে সারাদিন হাওয়া করুন, পালা করে। খসের গন্ধ, ঠান্ডা বাতাবরণের তলায় ফ্রিজ। কলের মতো ঠান্ডা হয়তো হবে না। আইসক্রিম হয়তো জমবে না তবে তরিতরকারি শেষ মাঘের মতো শীত-শীত আবহাওয়ায় তাজা থাকবে। আইসক্রিম, ঠান্ডা জল শরীরের পক্ষে ভালো নয়। ল্যারেঞ্জাইটিস, ফ্যারেঞ্জাইটিস তৈরি করে। ফ্রিজে কারেন্টও বেশি পোড়ে। ফ্রোজেন ফুড সহজে হজম হয় না। আমাদের উদ্ভাবিত মরাই ফ্রিজে সব কিছু তরতাজা। রাতের শিশিরে মাঠে পড়ে থাকা তরিতরকারির মতো এই ফ্রিজে রাখা তরিতরকারি স্বাস্থ্যকর। নিখরচার ফ্রিজ—মরাই-ফ্রিজ। বসার ঘরে সাজিয়ে রাখুন, ফোক আর্ট। চালে বসিয়ে রাখুন লক্ষ্মী প্যাঁচা। গৃহস্থের কল্যাণ হবে। মরাই ফ্রিজের নমুনা আমাদের প্রদর্শনীতে ডিস প্লে করা হয়েছে। দেখে শিখুন। শিখে দেখান।

তিন, রুমকুলারে মুনিয়া পাখি। কুলারের ভেতরের আবর্জনা দূর করে ফেলে দিয়ে, পেছনের জালতি, সামনের শাটারটা রাখুন। এক জোড়া মুনিয়া দিচ্ছি, ছেড়ে দিন ওই রুম-খাঁচায়। সারাদিন চিড়িকপিড়িক, কিচির মিচির। অফিস নয় তো যেন বৃন্দাবন! বাড়ি নয় তো কদম্ব কানন! আমি ঘুমিয়ে পড়ি পাখির ডাকে, সেই ডাকেতেই জাগি। আহা, আহা।

চার, টিভিতে অ্যাকোরিয়াম। মাছের পিত্তি-টিত্তি যে ভাবে বের করতে হয় সেই ভাবে ভেতরের গার্দা ফেলে দিয়ে সামনের স্ক্রিনটা খালি রাখুন। ভেতরে জল ছাড়ুন। পেছনের ফুটো-ফাটায় তাপপি চড়ান। আমাদের দেওয়া রঙিন মাছ ছাড়ুন। টেলিভিশান যেমন দেখার জিনিস, অ্যাকোয়ারিয়ামও তেমনি দেখার জিনিস।

পাঁচ, ফ্লোরেসেন্ট ক্রিম। শীঘ্রই বাজারে ছাড়চি। অন্ধকার হলেই মুখে হাতে পায়ে মাখুন। অন্ধকারে ঠোকাঠুকি লাগবে না। কার পা কোথায় পড়ছে, কার হাত কোথায় যাচ্ছে সহজেই ধরা পড়বে। কালো কুকুরটাকে ধরে মাখিয়ে দিন।

ছয়, ফ্লোরেসেন্ট থালা বাটি গেলাস বাজারে আসছে। অন্ধকারে খেতে পারবেন। মহিলারা ঠোঁটে ফ্লোরেসেন্ট ক্রিম মাখুন। ঠোঁটও তো খাদ্য। লিখুন—প্রকৃতি দিনের শেষে অন্ধকারের ব্যবস্থাই রেখেছে। এতকাল আমরা যা করেছি ব্যতিক্রম। আলোর বিল যা ছিল অন্ধকারের বিল তারচে একটু বেশিই হবে কারণ অন্ধকার আলোর চে বেশি ঘন এবং তৃপ্তিদায়ক। অন্ধকার ফেল করলে বিরক্ত হবেন না। আমাদের ব্যবস্থায় এখনও একটু আলো লিক করছে।

।। দুই।।

মিস্টার তুলপুলে, ওই পাখার জায়গায় আমি আর একটু যোগ করতে চাই। লিখুন—প্রাচীনকালে, হাতপাখার যুগে, স্নেহ-ভালোবাসা, সম্মান, বশ্যতা, সখ্যতা প্রকাশের মাধ্যম ছিল, একটি হাতপাখা। গুরু এসেছেন, শিষ্য আসনে বসিয়ে পাখার বাতাস করছেন। জমিদার এসেছেন জমিদারি-তে নায়েব পাখার বাতাস করছেন। জামাই গেছে শ্বশুর বাড়ি শাশুড়ি চৌকিতে বসিয়ে হাওয়া করছেন। পাখার বাতাসে কতরকম ভাব মিশিয়ে দেওয়া যেত সে যুগে! বাতাস বলত, আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি তোমায় শ্রদ্ধা করি, হুজুর প্রাণে মেরো না, ঠাকুর দয়া করো নাথ! হৃদয়ে এসে লেপ্টে যাও। সেই কৃষ্ণের বাঁশি, যমুনা পুলিনে, সিক্ত-বসনা রাধা, রঙ্গরমণীর নিটোল হাতের চুড়ির রিনিঝিনির সঙ্গে কচি তালপাতার পাখা। এক হাতে পাখা, এক হাতে শ্বেতপাথরের গেলাসে মিছরির সরবত। অহো, অহো। লিখুন, বড়-বড় করে লিখুন, ফচকে বিদ্যুতের পাখা আমাদের সনাতন জীবনছন্দের সমস্ত গৌরব হরণ করে নিয়েছিল, আমাদের মেয়েদের হাতের তালপাখা কেড়ে নিয়ে তাদের নারীসুলভ মধুর বৃত্তি উপড়ে নিয়েছিল। ঘরে ঘরে, টঙে টঙে রংচটা, বীভৎস দর্শন কাঠ কিম্বা অ্যালুমিনিয়ামের ত্রিবক্র, ফ্যারফ্যারে পাখা, ফরফর করে রসকসবর্জিত, স্নেহহীন, বস্তুতান্ত্রিক হাওয়া ছিটিয়ে দাঁত বের করে ধনতন্ত্রের মহিমা প্রচার করছে। হাটাও পাখা। লাগাও হাতে ঘোরানো পাখা। সে পাখার হাওয়াতেই ভাই মধু আছে, মধুর রসের ত্যারছা পরশ, অথবা শান্ত, দাস্য, সখ্য মধুর ভাবের বৈষ্ণব পদাবলী আছে।

এবার সাবহেডিং দিন। পাখাতে চামচে ফিট। পাখাতে চামচে ফিটটা কী ব্যাপার! যা বলছি লিখে যান, মি: তুলতুলে। প্রশ্ন করে ভাব চটকে দেবেন না। এই দেশে ছোট-বড় সকলেরই কিছু না কিছু চামচে আছে। দাদা, দাদা করে পাশে ঘোরে। মালটি হাতিয়ে নিয়ে, আখেরটি গুছিয়ে নিয়ে দাদাকে লেঙি মেরে ড্রেনে ফেলে দিয়ে সরে পড়ে। চামচে মারা দাদার সংখ্যা খুবই কম, দাদা মারা চামচের সংখ্যাই বেশি। আমাদের এই অবিদ্যুৎচালিত কেঠোপাখা চামচেদের বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর। নেতাদের পাখা ঘোরাতে প্রথম-প্রথম অনেক চামচে জুটবে। নিজের চাকরি, বউয়ের মাস্টারি, ভায়ের বেকার ভাতা, রেশনের দোকান, সিমেন্টের পারমিট, বাপের বৃদ্ধবয়সের ভাতা, এটা ওটা সেটা কিন্তু! কিন্তু যে মাল শেষের সেদিন পর্যন্ত হাসিমুখে পাখা ঘুরিয়ে যাবে, বুঝে নিতে হবে সেই নিষ্ঠাবান, স্টেনলেস চামচ। নেতাগিরির সুপবোলে ভুল চামচে ডোবাতে গিয়ে অনেক নেতাই এক ঋতুতে কেতরে গেছে। এবার একটু ব্রতকথার ঢঙে দুটো লাইন লিখুন—দারুময় কীলক শাখার কত গুণ ভাই, মানুষের চরিত্র করে যাচাই, নারীর নারীত্ব বাড়ায়, প্রেম উড়োখই, তোমরা বাছা, থেকে থেকে, হাঁক মেরো না, শ্যালক বিদ্যুৎ কই! কীরকম হল মি: বুলবুলি! মাস্টারপিস, কোথায় লাগে—দান্তে, লোরকা, চসার, মুসুলিনি, এ যেন সিমলেপাড়ার হরগিরির ডালফুরুলি। ফুরুলি নয় স্যার ফুলুরি। ওই হল হে, ওই হল, যা বাতাসা, তাহাই বাসাতা, যাহা বকস তাহাই বাসক।

এইবার আমাদের পরের পয়েন্ট। লিখুন, সবচে বড় অভিযোগ, বিদ্যুতের সঙ্গে জলও চলে যায়।সহেলী, সহেলী, শহরবাসী, শোনেননি দাদা, জলেই যে বিদ্যুৎ থাকে। চক্ষুমুদ্রিত করে কল্পনা করুন, পদতলে পড়ে ভোলা, বুকে নাচে মহাশ্যামা। জলের বুকে বিদ্যুতের ঝিলিক রে ভাই! উপমাটা উপলব্ধি করুন। বিদ্যুৎও নেই, জলও নেই। জল যদি নাই থাকে ঘাবড়াও মাৎ। কবি ব্রাউনিংকে স্মরণ করুন—আমি দু:খে আছি, কিন্তু আমার চে দু:খে আছে আরও কত জন। রাজস্থানের কথা ভাবুন। সাহারা মরুভূমির কথা চিন্তা করুন। ফ্রানসে জলের বদলে ওয়াইন। তবে? তবে ভাই, জলের জন্যে কেন এত হাহুতাশ। লৌহমিশ্রিত কলকাতার পেঁকো জলে স্নান করলে, রেশম চিক্কণ চুলে আঠা হয়, পাক ধরে। ওই জল খেলে পরিপাক শক্তি নষ্ট হয়। জার্মানিতে জলের বদলে বিয়ার। জলকষ্টে মনোকষ্ট, প্রাণ আঁকুপাঁকু আর তখনই জাগবে পুরুষকার, আরও রোজগারের জন্যে হন্যে হবেন। উপার্জন বাড়িয়ে বোতল-বোতল বিয়ার খাবেন। নধরকান্তি, রমণীমোহন চেহারা হবে। বাথরুমে জল নিয়ে খাবলাখাবলি না করার ফলে বাত, সর্দি, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস সহজে হবে না। আর! তবু যদি মনে হয় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, তাহলে শিশুর আদর্শ অনুসরণ করুন। ভগবান দুহাতে দুটো বুড়ো আঙুল দিয়েছেন, সে কি কেবল বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাবার জন্যে! আজ্ঞে না। অন্ধকারে বসে চুকচুক করে শিশুর মতো বুড়ো আঙুল চুষুন। মনটি শিশু শিশু হয়ে উঠবে। মুখে সবসময় ভুবনভোলানো অমায়িক হাসি। জীবাণুযুক্ত জল সরবরাহ বন্ধ করে আমরা দেশের স্বাস্থ্য পরিকল্পনাকে জোরদার করে তুলছি। স্নানের বদলে শরীরের চামড়ায় সাদা জুতোর ক্রিম মাখুন। জুতোও চামড়া দেহও চামড়া। অসুবিধেটা তাহলে কোথায়!

এইবার সেই সুচিন্তিত মারাত্মক অনুচ্ছেদটি ”সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের প্রতি” আপনারা এইবার দিনের সাহিত্য করুন, আর রাতের সাহিত্য নয়, সারা সন্ধে স্পিরিটে স্পিরিটেড হয়ে মাঝরাতে চোরা আলোয়, তান্ত্রিক চোখে, কলমের ডগা দিয়ে যে বস্তু বেরোয়, তাতে খুন থাকে, ধর্ষণ থাকে, মদ থাকে, মেয়েছেলে থাকে, মনোবিকার থাকে। ওসব আর চলছেনি। চলছেনি লিখব স্যার! ইয়েস, ওসব আর চলছেনি, অপসংস্কৃতি। তামসী রাত্রি, মানুষের স্নায়ুর বাঁধন আলগা করে দেয়, দুর্বল করে দেয়। মনের দরজা খুলে, মেফিস্টোফিলিস সামনের চেয়ারে বসে কেবলি অসৎ পরামর্শ দিতে থাকে—গীতা পড়ে কী হবি, পর্নোগ্রাফি পড়, লেখাতে সেকস ঢোকা নইলে বাজার পাবি না। ইয়ারকি! অন্ধকারের দাসত্ব কেন করবেন। কেন ফাউস্টের মতো আত্মবিক্রয় করবেন। বরং সন্ধে হলেই শিশুর মতো দুধু ভাতু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। তারপর সেই ঊষালগ্নে, পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে উপনিষদের ঋষির মতো গেয়ে উঠুন, হিরণ্ময়েনপাত্রেন সত্যাস্যপি হিতং মুখং। আবার ফিরে আসুক বেদের কাল, ত্রিসন্ধ্যা কাল, পান্তাভাতের কাল, পাচনবাড়ির কাল, ভনভন মশা ও ম্যালেরিয়ার কাল। জাগো ভারত। জাগো বাঙালি। অনেক দিললাগী হয়েছে আর না, ভারত যাহা ছিল তাহাই হইবে।

এইবার তাঁহাদের উদ্দেশ্যে, ‘যাঁহারা উৎপাদন কমিয়া গেল বলিয়া চিৎকার করিতেছেন’ চিললাও মাৎ। যতই উৎপাদন বাড়ুক সব দই মেরে দিলে বড়লোক নেপোরা। দেশের মধ্যবিত্ত, দরিদ্র মানুষ বেদের কাল থেকেই নটেশাক, তেলাকুচা ও কদলিকাণ্ড খেয়ে এই সভ্যতাকে পুষ্পিত, পত্রোদগত করে এসেছে। মশাই! ওইসব লোহালককড়, গজাল মজাল, দৈত্যের মতো যন্ত্রপাতি, গাড়িঘোড়া, মানুষ মারা কল। বনস্পতি বোতলের জল না তৈরি করলেও চলে। কেন! চালাবাড়িতে মানুষ স্বচ্ছন্দে, মাটির থালে, পাথরের বাটিতে ডাঁটা চচ্চড়ি খেয়ে বেঁচে থাকেনি! ব্রিজ যখন ছিল না, বাঁশের সাঁকোয় ওপর দিয়ে লগবগ লগবগ করে মানুষ খরস্রোতা নদী পেরিয়ে যেত না! সাঁকোয় ওপর যুবতী রমণী আর ইয়া ইয়া কংক্রিট-ঢালা বল্টু-মারা ব্রিজের ওপর রমণী, কোনটা ভালো! যন্ত্রের শক্তিকে আমরা এতকাল অশ্বশক্তি হর্সপাওয়ারের দিয়ে বোঝাতে চেয়েছি। জীবজগতে শুধু অশ্বই আছে কেন, মানুষ কি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাণী নয়। মনুষ্য শক্তিতেই সব হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য। অন্ধকারে মনুষ্য উৎপাদন আশা করি ব্যাহত হবে না।

।। তিন ।।

ওই গন্ধমাদনটা আবার কী? ঘাড়ে করে নিয়ে এলে বিশ্বাস! তোমার কী কোনও সময় জ্ঞান নেই হে! দেখছ না, জনসংযোগ বিজ্ঞাপন লিখছি।

আজ্ঞে এটাও জনসংযোগ। জনসাধারণের অভিযোগ।

জনসাধারণের অভিযোগ! দপ্তর অধিকর্তা বিকৃত গলায় বললেন—দাও সব ফেলে দাও গঙ্গার জলে। এই কললোলিনী-তিলোত্তমা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিনী ভাগীরথী। সব ব্যাটাই তার অ্যাডভানটেজ নিচ্ছে, আমরা কেন নেব না বিশ্বাস! করপোরেশান সারা কলকাতার ময়লা ঢালছে। দুধারের কলকারখানা, তেল-কালি ভুসো ছাড়ছে। আকাশ-মানব-মানবীরা দেহনির্যাস ত্যাগ করছে। তুমি বিশ্বাস, এতই অপদার্থ, ওই রাবিশগুলিকে ‘গ্যাঞ্জেস ডিসপোজাল’ করে দিতে পারছ না! আমার মতো একটা সিনিয়ার অফিসারের কাছে বয়ে এনেছ ওই রাস্তার লোকগুলোর কিছু চোতা! জানো, আমি ‘ম্যান অব দি স্ট্রিটে’র চে কত ওপরে! জানো, আমি মাসে কত টাকা মাইনে পাই! পাঁচ হাজার মাত্র! আমি তোমার মতো বাংলা খাই না, আগে খাঁটি স্কচ খেতুম, এখন খাই দেশি বিলাইতি। আমার মিসেস, তোমার মিসেসের মতো হাত পুড়িয়ে রাঁধে না, ডাল পুড়িয়ে গালাগাল খায় না, বিছানা তোলে না, পাতেও না, মশারি খাটায় না। কেন খাটায় না বলো তো, দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি!

আজ্ঞে, হয় মশা নেই, না হয় মশারি নেই।

হো হো হো! কী বুদ্ধি, কী বুদ্ধি! তোমাদের মতো বুদ্ধুরা আছে বলেই আমাদের মতো ধূর্তদের রাজত্ব চলেছে। বুদ্ধু দেশ মে ধূর্তকা রাজ। জান না মূর্খ, কলকাতায় আর একটি করপোরেশান আছে—যাহার নাম মশা সাপ্লাই করপোরেশান। মনে পড়েছে! রাখুন, আবর্জনাগুলো ওই কোণে। এখুনি একটা ডিকটেশান নিন।

চেয়ারম্যান, মশা সাপ্লাই করপোরেশান, আমাদের অন্ধকার সাপ্লাই করপোরেশানের তরফ থেকে আপনার সুযোগ্য পরিচালনার, আপনাদের সহযোগিতার জন্যে ধইন্যবাদ। ধইন্যবাদই লিখবেন, কারণ চেয়ারম্যানের দেশের উচ্চারণে আমি যতটা সম্ভব কাছাকাছি যেতে চাই। নিন লিখুন। আমাদের অন্ধকার, আপনাদের মশা, কলকাতার জীবনকে স্কচ হুইসকির জ্বালা দিয়েছে। মশা ছাড়া অন্ধকার, অন্ধকার ছাড়া মশা মানায় না। হরের পাশে গৌরী, রাধার পাশে কৃষ্ণ। ঝাঁকেঝাঁকে মশা সাপ্লাই করে, ফাইলেরিয়া দিন, ম্যালেরিয়া দিন। কলকাতার মানুষ হাঁটতে চায় না। না হেঁটে মোটামোটা বাবুদের রোগা রোগা পা। একমাত্র গোদই কলকাতার টপ হেভি মানুষকে মেরামত করে দিতে পারে। কতদিন কেঁপেকেঁপে জ্বর আসেনি। কেঁপে জ্বর, তার ওপর কম্বল, তার ওপর স্ত্রী, তার ওপর কুইনিন, তার ওপর সকালের রোদ, তার ওপর পানসে বার্লি, সে যে জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বাদ! ম্যালেরিয়া না হলে লিভার খারাপ হবে না সহজে। লিভার খারাপ না হলে অনবরত খিদে পাবে। খিদে পেলে, খরচ হলে দেনা হবে। দেনা হলে, দুর্ভাবনা হবে। ভাবনা হলে শরীর যাবে। অতএব এদেশের সমাধান একটাই—অন্ধকার, মশা, মশাবাহিত পদ-গোদ আর ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়া হলে পিলে হবে, পিলে হলে ভুঁড়ি হবে, ভুঁড়ি হলে পেট আলগা হয়ে খসখস করে প্যান্ট খুলে পড়ে যাওয়ার অস্বস্তি থাকবে না। হাতে হাত মেলান দাদা। দেশের জন্যে আমরা কিছু করে যাই। স্বামীজি বলেছিলেন—দাগ রেখে যা। এসো দাদা—দাগ রেখে যাই। সব জায়গা দাগবাজি করে যাই। হুতোমের ক্যালক্যাটাকে ফিরিয়ে আনি—দিনে মশা, রেতে মাছি। ঝাঁকঝাঁক মাছিও বাজারে ছাড়ুন। ওলাওঠা ছিল বলেই না, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর ভালো-ভালো সাহিত্য, চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। সেই ওলাওঠা চাই, দোস্ত। ঘোর ঘন অন্ধকার কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় ওলাওঠা। অন্ধকারে হাহাকার। ফুলের মতো খই ছড়াতে-ছড়াতে, নেচে-নেচে, দেশহিতব্রতী যুবকেরা অনবরতই একের পর এক চলেছে—ব্যালো হরি, হরি বোল। লং লিভ আওয়ার কো-অপারেশান। ইতি, গুণমুগ্ধ।

কী একটা শব্দ হচ্ছে হে, নাকডাকার মতো। ওই যে স্যার সায়েব। বলো কী হে সায়েবেরও নাক ডাকে! তবে দাও। দাও তবে তোমার নস্যির ডিবে, সশব্দে এক টিপ নি। জাগিও না ওকে। আহা বুড়োকে ঘুমোতে দাও। স্বপন যদি মধুর এত! লে আও ওই রাবিশ আবর্জনা। ওই সবিনয় নিবেদনের কায়দায় সব উত্তর দেব। নাও, কলম ধরো।

কী লিখেছেন ভদ্রলোক। পরপর দুমাস একটাকা করে বিল পেয়েছি। বেশ! তৃতীয় মাসে চক্ষু ছানাবড়া। কেন বাবা। দুশো বারো টাকার পেললায় একটি বাঁশ মেরেছেন। লিখুন জবাব—বেশ করেছি। ট্যাঁকে পয়সা নেই, অত আলোর সখ কেন। বেশি তড়পালে মিটার খুলে নিয়ে আসা হবে। দ্বিতীয় অভিযোগ, গত চারমাস মিটার ঘরের চাবিই খুলতে হল না অথচ প্রতিমাসে বেশ কায়দার বিল আসছে, রিডিং ডেট সমেত। ব্যাপারটা ভৌতিক বলেই মনে হচ্ছে। লিখুন, ভগবানে যখন বিশ্বাস আছে, ভূতকেও বিশ্বাস করতে শিখুন। আপনার এলাকার মিটার ইনস্পেকটার, মাসছয়েক হল পটল তুলেছেন। পয়সার অভাবে গয়ায় পিণ্ড দেওয়া হয়নি। সেই ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ ভদ্রলোক এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কড়া নেড়ে আপনাকে বিরক্ত না করে সেই ইনস্পেকটার রিডিং নিচ্ছেন, আমাদের কমপিউটার বিলও করছে।

তৃতীয় অভিযোগ, আমার চোদ্দো থেকে ষোলো হচ্ছিল, ইদানিং চল্লিশে চলে গেছে। লিখুন, এই তো সংসারের নিয়ম রে ভাই। আপনার বয়সও তো এক সময় ষোলো ছিল, দেখতে-দেখতে চল্লিশ কি হল না! জীবনের ধর্মই বেড়ে চলা। চুল বাড়ে, দাড়ি বাড়ে, গাছ বাড়ে, ছেলে বাড়ে, বিলও বাড়ে।

নেকসট। সেদিন রাতে মাছের মুড়ো খাইতেছিলাম। ঝপ করিয়া লোডশেডিং হইয়া গেল। স্ত্রী মোমবাতি হাতে যখন আসিলেন তখন দেখিলাম পাতে মাছের মুড়ো নাই। কতদিন পরে একটি ঘৃতযুক্ত মুড়ো পাতে পড়িবার সৌভাগ্য হইল, আপনাদের হৃদয়হীনতার জন্য ভাগ্যে সহিল না। কেলে বেড়ালে মারিয়া দিল। ফরাসি দেশ হইলে ক্ষতি পূরণের মামলা করিতাম, বাংলা বলিয়া বাঁচিয়া গেলেন। লিখুন—যে দেশের মানুষ একবেলাও খাইতে পায় না, সেই দেশে রাতের বেলা মুড়ো বিলাস! লজ্জা করে না। বেড়াল, বুভুক্ষু জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে উচিত কাজ করিয়াছে। আপনার নাম ও ঠিকানা ইনকাম ট্যাকসে পাঠাইতেছি। এতকাল ঘুঘুই দেখিয়াছেন, এইবার ফাঁদ দেখিবেন, কেমন! মুড়োর পয়সা ডানহাতে আসছে, কি বাঁ-হাতে আসছে, এইবার পরিষ্কার হবে।

কি লিখেছেন! বউ বদল! সে আবার কী রে বাবা! আমাকে যে মেয়ে দেখানো হয়েছিল, বিয়ের সময় লোডশেডিং হওয়ায় আমার জোচ্চর শ্বশুর, অন্ধকারে, প্যান্তাখ্যাঁচা বড় মেয়েটাকে পিঁড়িতে বসিয়ে, কায়দা করে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে! দোষ কার! এখন আমি কী করব? সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা! চুল ছিঁড়ব!

লিখুন—দোষ কারও নয় গো মা। তুমি স্বখাত সলিলে পড়েছ মানিক। আজকাল বিয়ে দুপুরবেলা চেয়ারে বসেই করা উচিত। যা পেয়েছ চাঁদ তাঁর সঙ্গে মানিয়ে চল। বউ একটা হলেই হল। ব্যবহার তো এক।

এরপর! অন্ধকারে ঘর ভুল করে ভ্রাতৃবধূর ঘরে…। লিখুন, অসভ্যতা করলে লাইন কেটে ফাঁক করে দেব রাসকেল। বাকি। সব এক উত্তর—চিঠি পেয়েছি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। বিদ্যুৎ ঈশ্বরের দান। জবাবদিহি করতে হয়। তাঁর কাছে করো। ক্লিয়ার আউট।

সায়েব এ সায়েব। মিস্টার চার্চিল। চোখ চাইতেই তাঁর ঠোঁটে ধরা চুরুট থেকে অটোমেটিক আবার ধোঁয়া বেরোতে লাগল। চলুন আমাদের কন্ট্রোলরুমে। দেখাই কীভাবে আমরা অতি সহজে আলো থেকে অন্ধকারে চলে যাই। ওকাকুরার ছবির নিখুঁত ওয়াশের মতো। যেন গ্লাইডারে রাইডার!

এই আমাদের কন্ট্রোলরুম ডিরেকটার। মাসে কেটেকুটে হাজার পাঁচেক পান। সংসার চলে না সায়েব! এসব কাজে মাথা চাই। মাথায় চানকা চাবুক চাই। পেটে না ঢাললে, গ্যাঁজলা মাথায় গিয়ে ধাক্কা মারে না। ধাক্কা না মারলে এদেশে বড় আলস্য লাগে! হা, আ, আউ। দেখছেন হাই উঠছে কী রকম। যাকগে, বলুন, কী দেখাতে হবে! এঁকে অপারেশানটা দেখান তো!

তিনজন ঝকঝকে ল্যামিনেটেড মিটিং টেবিলে বসলেন। চার্টস, ম্যাপস, গ্রাফস। শুনুন, অন্ধকার এইভাবে হয়। পঁচিশ বছরের নিখুঁত একটা পরিকল্পনা চাই। আপনাদের সময় কিছু ডিফেকটিভ ব্যবস্থার ফলে কলকাতার লোক এখন আলোর উৎপাতে পীড়িত হচ্ছে। সে সব ত্রুটি এখন মেরামত করতে হচ্ছে। জেনারেটারের নাট-বল্টু আলগা করে, টিউবে ছেঁদা করে, বার্স্ট করিয়ে, নানাভাবে ওই যন্ত্রদের বিদ্যুৎ তৈরির একগুঁয়ে স্বভাবকে বাগে আনতে হচ্ছে। কী কল বসিয়ে গিয়েছিলেন মাইরি! ভেঙেও শা ভাঙে না।

এরপর পরিসংখ্যান চাই। প্রথমে একটা সমীক্ষা—৭০-এ এই চাই, ৮০-তে এই চাই, ৯০-তে এই চাই। সেসব এমন পণ্ডিতদের দিয়ে করাতে হবে যা হবে, ফার, ফার, ফার, ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড, অ্যাকচুয়াল ডিমান্ড। এইবার, লম্বাচৌড়া প্রতিশ্রুতি, শিল্প এসো, ঠেলে এসো, ঢেলে এসো, সব গ্রামে, জ্বালো জ্বালো আলো জ্বালো। তার মানে মইটি সাপ্লাই কর, ঠেলেঠুলে গাছে তোলো, তারপর হালে ‘নো পানি’, মইটি সরিয়ে নিয়ে হড়কে পড়ো।

এইবার কিছু নদী পরিকল্পনা বানাও। সব আধখ্যাঁচড়া। বিদেশ থেকে, বেশি দামে বাতিল করা জল বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র এনে ঢোলসহরত করে বসাও। এদিকে শিল্প বানাও। তাহলে কী হল সায়েব—পর্বতপ্রমাণ চাহিদা তৈরি করে মূষিক-প্রমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কর। প্রশাসনের মাথাটা হেভি করে দাও। তলার দিকটা বাঙালির পায়ের মতো লিকপিকে করে রাখো। ‘লেবার’রা কাজ করবে, লেংটি পরে ঝুপড়িতে থাকবে, আর আমরা থাকব সুশীতল থার্মসফ্লাস্কের মতো ঘরে, ববি মার্কা বউ, উডহাউসের ইংলন্ডের ফ্যাট পিগ মার্কা, একটি কী দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। শিক্ষাটা তোমাদের কাছেই পেয়েছি। আর সেইটাই হল সব শিক্ষার সেরা শিক্ষা। নিমেষে, অন্ধকারের উৎসাহটা ওইখানেই।

বসেছি, বসেছি মগডালে, ওরা সব উৎক্ষিপ্ত, অসন্তুষ্টের দল তলা থেকে চালায় করাত, ভারতের এই তো বরাত। করে নিয়েছি লাখ বেলাখ, আর আমাদের পায়টা কে! তোদের ল্যাঠা সামলা তোরা, আমাদের তো দিন শেষ।

কী বুঝলে সায়েব!

চুরুটটা ঠোঁটে রেখে, মোটাসোটা চার্চিল বললেন—সেই আদিসত্য ওরে আমার ‘নেটু’—লর্ড সেড—লেট দেয়ার বি লাইট, দেয়ার ওয়াজ লাইট, নাও হি সেজ, লেট দেয়ার বি ডার্কনেস, এন্ড ডার্কনেস ফর এভার। গুডবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *