।।অন্ধকারের পরে।।
.
বাড়িটার নাম্বার দেখে যখন দরজায় নক করলেন উপমন্যু তখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে। কন্ট্রোল রুমে ফোন করে অতনুর ফোন নাম্বার থেকে বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সরাসরি চলে এসেছেন। আগে থেকে ফোন করলে সতর্ক হয়ে যেতে পারে ভেবে উপমন্যু ফোনও করেন নি।
পাড়ার লোককে বাড়ির নাম্বার আর অতনুর নাম বলতেই বাড়িটা দেখিয়ে দিল। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পর এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
উপমন্যু হাত জোড় করে বললেন “নমস্কার বউদি আমি অতনুর অফিস থেকে আসছি, উনি বাড়িতে আছেন?”
ভদ্রমহিলা খানিকটা হতচকিত হয়ে বললেন “এই মাত্র ফিরেছেন। আপনি আসুন। আমি ওকে ডাকছি”।
একটা ছোট ড্রয়িংরুম। ভদ্রমহিলা উপমন্যুকে বসিয়ে ঘরের ভিতর যাওয়ার প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে এসে উপমন্যুকে নিবিষ্ট মনে দেখতে লাগল। উপমন্যু বললেন “তোমার নাম কী?”
ছেলেটা বলল “দেবতনু ভট্টাচাজ্জ। তোমার কী নাম?”
উপমন্যু নাম বলার আগেই পরদা ঠেলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন অতনু ভট্টাচার্য। উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন “কে আপনি? অফিস থেকে এসেছেন বলল রীমা!”
উপমন্যু পকেট থেকে তার আই কার্ডটা বের করে অতনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন “ওই পি এফ সংক্রান্ত ব্যাপার আর কী। এখানেই বলবেন না রাস্তায় যাবেন?”
অতনু বিস্ফারিত চোখে তার কার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন “এক মিনিট। আমি জামা পালটে আসছি”।
উপমন্যু অতনুর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি স্কুলে যাও তো?”
দেবতনু মাথা একপাশে হেলিয়ে দিয়ে বলল “হ্যাঁ। তুমি স্কুলে যাও?”
উপমন্যুও দেবতনুর মাথা একপাশে হেলিয়ে দিয়ে বললেন “হ্যাঁ। আমিও যাই”।
দেবতনু উপমন্যুর সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় অতনু ঘর থেকে তৈরী হয়ে বেরিয়ে বললেন “চলুন। বাইরে গিয়ে কথা বলি”। ঘরের ভেতরে গলা তুলে বললেন “বাবুকে নাও তো”।
অতনুর স্ত্রী এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে অতনুকে বললেন “কোথায় যাচ্ছ? চা করব?”
অতনু চোরাচোখে উপমন্যুর দিকে একবার তাকিয়েই স্ত্রীর দিকে তাকালেন “না, আমি আসছি এখনই। দরজাটা বন্ধ করে দাও। আসুন”।
অতনুর স্ত্রীর বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে দুজনে বেরিয়ে রাস্তায় আসলেন। উপমন্যু বললেন “চলুন, আমার গাড়িতেই বসি”।
অতনু বললেন “চলুন”।
দেবু গাড়িটা কাছাকাছিই রেখেছিল। উপমন্যু পেছনের সিটে অতনুকে বসতে বলে অতনুর পাশে বসলেন।
উপমন্যু বললেন “বলুন অতনুবাবু, নাম্বারটা অফ করে রেখেছেন কেন?”
অতনু বললেন “মানে?”
উপমন্যু বললেন “দেখুন অতনুবাবু, বুঝতেই পারছেন, পুলিশ মনে করলে ঠিক কী কী করতে পারে। আপনি এবার নিজেই ঠিক করুন কোন পথে চলবেন”।
অতনু বললেন “আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন”।
উপমন্যু ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন “এই নাম্বারটা আপনি ইউজ করছিলেন তো?”
অতনু সেটা দেখে বললেন “নাহ। আমি ইউজ করি নি”।
উপমন্যু বললেন “ওকে। নো প্রবলেম। আপনি ইউজ করেন নি। আচ্ছা, একে চেনেন?”
উপমন্যু জয়িতার ছবি বের করে অতনুকে দেখালেন।
অতনু বললেন “না। কে ইনি?”
উপমন্যু বললেন “এর নাম জয়িতা। কোন এক বরাহ নন্দন একে খুন করেছে। সেই খুনীর খোজেই তল্লাশি চলছে বলতে পারেন”।
অতনু বললেন “ওহ। বেস্ট অফ লাক স্যার। কিন্তু আপনি আমার বাড়ি এলেন কেন বা আমাকে খুঁজতে এলেন কেন এখনও বুঝলাম না বিশ্বাস করুন”।
উপমন্যু একটু চুপ থেকে গাড়ি থেকে গলা বাড়িয়ে দেবুকে বললেন “থানার গাড়িটা কতদূর খবর নে তো”।
দেবুকে আগে থেকেই বলা ছিল উপমন্যু এই কথাটা বললে তাকে কী করতে হবে। সে গাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গেল।
অতনু বললেন “মানে? থানার গাড়ি মানে?”
উপমন্যু বললেন “কী করব বলুন অতনুবাবু? আপনি তো আমার ভাল কথায় বুঝছেন না। এবার থানায় নিয়ে গিয়ে একটু ইন্টারোগেশন করতেই হবে আপনাকে”।
অতনু গাড়ি থেকে নেমে পালাতে যাচ্ছিলেন উপমন্যু বজ্রমুষ্টিতে অতনুর হাত ধরে বললেন “পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই অতনুবাবু। আমার হাত থেকে পালানো একটু সমস্যা আছে”।
অতনু অস্ফূটে চেচিয়ে উঠলেন “আমাকে ছেড়ে দিন স্যার্ আমি কিছু করি নি”।
.
।।অন্ধকারের পরে।।
.
দরজা খুলল তাতান। উপমন্যু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন “জলদি গীজারটা চালা”।
তাতান বলল “বাবা, আজই তোমাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিলাম। বারোটা বাজালে আজ?”
উপমন্যু টুলের উপর বসে জুতো খুলছিলেন। বললেন “আর কী করবি? চাকরিটাই এমন”।
তাতান গীজার চালিয়ে বলল “খাবার গরম করে দি? মা ঘুমিয়ে পড়েছে”।
উপমন্যু বললেন “কর। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি”।
বাথরুমে ঢুকে পড়লেন উপমন্যু। মিনিট দশেক পর চেঞ্জ করে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। তাতান ভাত বেড়ে রেখেছিল। উপমন্যু খেতে শুরু করলে বলল “মা তোমাকে বলেছে তো কলেজ এক্সকারসানের ব্যাপারটা?”
উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ। যাবি। নো ইস্যু”।
তাতান খুশিতে উজ্জ্বল হল একটু।
উপমন্যু হালকা গলায় বললেন “বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছিস নাকি?”
তাতান থতমত খেল। পরক্ষণেই রেগে গেল “এ কেমন প্রশ্ন বাবা?”
উপমন্যু বললেন “এমনি জানতে চাইছি। তোদের বয়সে তো এগুলো স্বাভাবিক”।
তাতান বলল “না। আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। কোন ইচ্ছা নেই লাইফটা এত তাড়াতাড়ি বরবাদ করার”।
উপমন্যু মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
তাতান বলল “কী ব্যাপার বল তো? কী হয়েছে?”
উপমন্যু বললেন “অকুপেশনাল হ্যাজার্ড”।
তাতান বলল “মানে?”
উপমন্যু বললেন “একটা মানুষকেও বিশ্বাস হচ্ছে না আজকাল। ঘরে এসেও তার রেশ থেকে যাচ্ছে আর কী। এটাকেই বলে অকুপেশনাল হ্যাজার্ড। আমার ক্ষেত্রে এটা সাইকোলজিকাল হচ্ছে”।
তাতান বলল “ওহ। তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না, তাই তো?”
উপমন্যু বললেন “অবচেতন মনে নাও করতে পারি। এমনি করছি এখন”।
তাতান চোখ মুখ শক্ত করে বলল “কেন বিশ্বাস না করার কী আছে? তোমার মাঝে মাঝে কী হয় বল তো বাবা? এরকম ডিপার্টমেন্টে আছো কেন যেখানে মানুষকে বিশ্বাস করতে পারো না?”
উপমন্যু মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে হাসলেন “তুই কিন্তু একদম তোর মার মত কথা বলছিস তাতান”।
তাতান বলল “কেন বলব না বাবা? আমি সব সময় তোমার পক্ষ নিয়ে কথা বলি। সেই তুমিও যদি আমাকে বিশ্বাস না কর তাহলে কী করে হবে?”
উপমন্যু খাওয়া থামিয়ে তাতানের দিকে তাকিয়ে বললেন “কী জানিস তো, এই পৃথিবীটা আর আগের মত নেই। মানুষ হয়ত রক্ত মাংসের আছে, কিন্তু তবু বহু চেঞ্জ হয়ে গেছে। বহু। এখন আর সব কিছু সেই সরলরেখায় চলছে, এটা ভাবতে পারা যাচ্ছে না”।
তাতান বলল “কী হয়েছে বল। খুব কমপ্লিকেটেড কেস?”
উপমন্যু বললেন “আমরা যারা এই সব লাইনে আছি, আসলে আমাদের সোজা চিন্তা ভাবনাটাই নষ্ট হয়ে যায়। কিছু করার নেই আসলে”।
তাতান বলল “আহ, কী হয়েছে বল না?”
উপমন্যুর ভাতটুকু খেয়ে উঠে পড়ে থালাটা রান্নাঘরের সিংকে রেখে বললেন “সেসব তোর জেনে কাজ নেই। তুই ঘুমিয়ে পড়। এত রাত অবধি জাগতে হবে না”।
তাতান বলল “তাহলে এরকম বিপিতৃসুলভ কথা বলবে না বল কোন দিন”?
উপমন্যু হেসে ফেললেন “এসব ভাষা কোত্থেকে শিখছিস?”
তাতান বলল “বিমাতৃসুলভ হলে বিপিতৃও হতে পারে। শেখার কিছু নেই। তুমি যা শুরু করছ তাতে এসব ভাষা স্পন্টেনিয়াসলি বেরোয়। মা গজগজ করতে করতে ঘুমিয়েই পড়ল। বলে কাশীবাসী হবে”।
উপমন্যু বলল “ভাল তো। মাকে নিয়ে কাশী ঘুরে আয় বরং”।
তাতান বলল “হ্যাঁ, ওই করি। আচ্ছা। আমি ঘুমাতে গেলাম। তুমি আবার রাত জেগো না”।
উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ। যা”।
উপমন্যু ঘরে ঢুকে রঙ্গনকে ফোন করলেন। একবার রিং হতেই ফোন ধরলেন রঙ্গন “বল”।
উপমন্যু বললেন “অতনু কী করছে?”
রঙ্গন বললেন “কান্নাকাটি করছে। সংসার আছে, সম্মান আছে এসব করছে”।
উপমন্যু বললেন “বাড়িতে ফোন করিয়েছ?”
রঙ্গন বললেন “হ্যাঁ। কথা বলেছে”।
উপমন্যু বললেন “ওকে। কথা বলেছে যখন তখন ঘরে আটকে রেখে দাও। ফালতু ফুটেজ দিও না। তোমরা রেস্ট নিয়ে নাও। বসের সামনে যখন ব্রিফিংটা দেব তখন অতনুকে দরকার হবে”।
রঙ্গন বললেন “সারটেনলি। কেসটার কিনারা করতে পেরেছ তার মানে?”
উপমন্যু হাসলেন “হোপ সো”।
.
।।বাঁশি শুনে আর।।
উপমন্যু দেরী করে ঘুম থেকে উঠলেন। প্রায় সাড়ে আটটায়। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলেন তাতান ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে। পিয়ালী কাগজ পড়ছিলেন। তাকে দেখে বললেন “কী ব্যাপার? আজ ছুটি নাকি?”
উপমন্যু বললেন “খেপেছ? এখন ছুটি? কেস এখন ক্লাইম্যাক্স ছোঁয় ছোঁয়”।
পিয়ালী বললেন “হ্যাঁগো, তোমাদের মাইনে বাড়বে না? ডি এ পাবে না?”
উপমন্যু কাঁধ ঝাঁকালেন “গড নোজ”।
পিয়ালী বললেন “চালাব কী করে বল তো? এরা কি ধরেই নেয়, পুলিশ ঘুষ খেয়ে সংসার চালাবে?”
উপমন্যু ঠোঁটে আঙুল তুলে বললেন “একদম এসব কথা নয়। এভাবেই চলবে। তুমি কি চাও চাকরিটাও যাক?”
পিয়ালী রেগে গিয়ে বললেন “ঢং! ঘরের ভেতরও বলা যাবে না নাকি? এখানে কে আছে?”
উপমন্যু বললেন “ঘর থেকেই তো অভ্যাসটা তৈরি হয়। ধর, এখানে বলতে বলতেই তুমি বাইরে বললে। এমন কারো কাছে বলে ফেললে যার কানে গেলে আমায় পাঠিয়ে দিল ট্রান্সফার করে সুন্দরবনে। তখন দেখা গেল তুমি ডিঙি নৌকা করে বাজার করতে যাচ্ছো। ভাল লাগবে তখন?”
তাতান হাসতে লাগল। পিয়ালী বললেন “উফ। একটা কথা যদি বলতে দাও”।
উপমন্যুর ফোন বেজে উঠল। পিয়ালী বললেন “ওই দেখো, শ্যামের বাশি বেজে উঠেছে। দেখো আবার কী হল”।
উপমন্যু দেখলেন রঙ্গন ফোন করছেন। ধরলেন “বল রঙ্গন”।
রঙ্গন বললেন “তুমি যাদের কথা বলেছিলে তাদের সবাইকেই পেয়েছি”।
উপমন্যু বললেন “গ্রেট। বরাট সাহেবের চেম্বার। সাড়ে দশটা”।
রঙ্গন বললেন “রাইট”।
ফোনটা কেটে উপমন্যু পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে বললেন “ডাক পড়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট দিয়ে দাও। কেটে পড়ি”।
পিয়ালী উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
তাতান বলল “বাবা, আজ কি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?”
উপমন্যু হেসে ফেললেন।
#
অফিসে ঢুকে উপমন্যু সরাসরি বসের চেম্বারে নক করলেন। বরাট রুমেই ছিলেন। উপমন্যু পারমিশন নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলেন।
বরাট বললেন “বোস বোস উপমন্যু। আই অ্যাম ইগার টু নো অ্যাবাউট এভ্রি ডিটেলস অফ ইওর কেস”।
উপমন্যু বললেন “শিওর স্যার। রায় এবং রঙ্গনকে ডেকে নি”।
উপমন্যু ফোন করতেই ইন্সপেক্টর রায় এবং রঙ্গন বরাট সাহেবের ঘরে প্রবেশ করলেন।
উপমন্যু বরাটকে বললেন “স্যার, আপনি খানিকটা জানেন কেসের ব্যাপারে। আমি তবু ব্রিফিং দিচ্ছি আবার। শিলিগুড়ির মেয়ে জয়িতা। কলকাতায় ঢাকুরিয়ায় পিজিতে থাকত। কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ত, একই সঙ্গে চাকরি করত এস আর জি ইনফোটেক কল সেন্টারে। মেয়েটি যেদিন খুন হয়, আমাদের ফরেন্সিক টিম ঘটনাস্থলে কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পায় নি। পাথর জাতীয় কিছু দিয়ে মাথায় মেরে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়। যে মোবাইলটা পাওয়া গেছিল সেটাও রিসেট করা ছিল। অত্যন্ত প্রফেশনালি খুনটা করা হয়েছিল স্যার”।
বরাট চোখ ছোট করলেন “তুমি মিন করছ কোন এজেন্সী বা ভাড়াটে খুনী খুনটা করেছিল?”
উপমন্যু বললেন “একজ্যাক্টলি”।
বরাট বললেন “ওকে। গো অন”।
উপমন্যু বললেন “ঘটনার তদন্তে নেমে দেখা গেল জয়িতার বাবা মা নিডি ছিলেন। মেয়ের চাকরিটা তাদের দরকার ছিল। অপর দিকে জয়িতাকে চাকরিটা পেতে সাহায্য করেছিল বিজনেস টাইকুন শঙ্কর মুখার্জির বখে যাওয়া ছেলে অনীশ মুখার্জী”।
বরাট বললেন “গিভ এন্ড টেক পলিসি, তাই তো?”
উপমন্যু বললেন “একদম। অনীশ বড় লোকের একেবারে বখে যাওয়া ছেলে। আমাদের সাসপেক্ট নাম্বার ওয়ান”।
বরাট বললেন “সাসপেক্ট কখন হল? মানে জয়িতা চাকরিটা নিয়েছিল কিন্তু তার পরিবর্তে যেটা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল সেটা দেয় নি?”
উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ স্যার। তারা গড়পঞ্চকোটে যায়, এবং সেখানে অনীশ জানতে পারে দ্য গার্ল ওয়াজ অলরেডি প্রেগন্যান্ট”।
বরাট চোখ বড় করলেন “ইন্টারেস্টিং। তারপর?”
উপমন্যু বললেন “সে রাতে শুধু অনীশ এবং জয়িতা গড়পঞ্চকোটে যায় নি। নীলম, মানে জয়িতার পিজি পার্টনার, সেও বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গড়পঞ্চকোটে গেছিল। নীলমের ভারসান আর অনীশের ভারসান মিলিয়ে দেখেছি, সে রাতে অনীশ এবং জয়িতার মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি হয়।অনীশের বক্তব্য ছিল জয়িতা তাকে ঠকিয়েছে। জয়িতা সে ঘর ছেড়ে নীলমের ঘরে আশ্রয় নেয়”।
বরাট বললেন “এই জেনারেশন প্রি ম্যারিট্যাল সেক্সে একটু বেশিই অভ্যস্ত। যাই হোক, আমরা টিকটিকি। আমাদের এসব না ভাবলেও চলবে। বল এরপরের ঘটনা”।
উপমন্যু বললেন “জয়িতার সঙ্গে এস আর জি ইনফোটেকে কাজ করত রুহি এবং আসিফ বলে এক কাপল। রুহি আসিফ পরস্পর অঙ্গীকারবদ্ধ, এদিকে জয়িতা কারণে অকারণে আসিফকে জড়িয়ে ধরত বলে রুহি জয়িতাকে সহ্য করতে পারত না। এই জড়িয়ে ধরা নিয়েই দীপাবলির রাত্রে আসিফ এবং জয়িতার কথা কাটাকাটি হয় যেটা পাড়ার মোড়ের দোকানদার দেখে। কিন্তু আসিফ এবং রুহির ডিটেলস যাচাই করে বোঝা যায় এদের মোটিভ স্ট্রং নয়। অন্তত জয়িতাকে খুন করার মত তো একেবারেই নয়”।
বরাট বললেন “বেশ। তবে? মেয়েটি যে বাড়িতে পিজি ছিল সে বাড়ির বাকিরা?”
উপমন্যু বললেন “ঢাকুরিয়ার হালদার বাড়িতে এখন থাকেন বাড়ির মালিক বৃদ্ধ সুশান্ত হালদার। প্রাথমিক কথোপকথনের পরে কোনভাবেই তাকে সন্দেহতালিকায় রাখা যায় না। বেঁচে থাকেন তার পুত্র বিশ্বজিৎ হালদার এবং তমালিকা হালদার”।
বরাট বললেন “এবং তাদের দুজনকে সন্দেহ করার কোন কারণ?”
উপমন্যু রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন “অনীশ, বিশ্বজিৎবাবু এবং তমালিকাদেবীকে এ ঘরে আনো এবার”।
রঙ্গন ঘরের বাইরে গেলেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে তিনজন ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। ঘরে ঢুকেই বিশ্বজিৎবাবু উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন “এ কেমন অসভ্যতা অফিসার? আগে বলতে পারতেন, তাহলে অন্তত অফিসে ইনফরম করা যেত”।
উপমন্যু বললেন “তিনজনই বসুন”।
অনীশের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সে চুপচাপ বসল। বিশ্বজিৎ এবং তমালিকা বসলেন।
উপমন্যু বরাটের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন “স্যার, আপনাকে প্রথমে বলেছিলাম, ঘটনাস্থলে একটি মোবাইল পাওয়া যায়, যেটা সম্পূর্ণভাবে ফরম্যাট করা হয়েছিল”।
বরাট বললেন “হ্যাঁ”।
উপমন্যু পকেট প্লাস্টিকে মোড়ানো একটা মোবাইল ফোন বের করে টেবিলে রেখে বললেন “এটি জয়িতার দ্বিতীয় ফোন। যেটা ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং এই ফোনটির সিম জয়িতার নামে ছিল না”।
বরাট মাথা নাড়িয়ে বললেন “দ্যাটস দ্য সারপ্রাইজ। নাও আই আন্ডারস্ট্যান্ড”।
উপমন্যু হাসলেন।
.
।।আলোকের ঝর্ণাধারায়।।
উপমন্যু ফোনটা হাতে নিয়ে বললেন “এই ফোনটা না পেলে আমাদের ইনভেস্টিগেশনই শেষ হত না স্যার। বলা ভাল, এই ইনভেস্টিগেশনের কোন মূল্যই থাকত না। মানুষের রিপু, যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, সে রিপু যে মানুষকে ঠিক কতটা দূরে নিয়ে যেতে পারে, তা হয়ত, এই মোবাইলখানা হাতে না পেলে জানাই যেত না। মোবাইলটা নষ্ট করার ইন্সট্রাকশন ছিল কিন্তু অত্যন্ত সৌভাগ্যবশত যার কাছে এই ইন্সট্রাকশনটা এসেছিল, সে তার লোভের বশেই, এত দামী ফোন ফেলে দেয় নি। সে ফোনটাকে তার কাছে অতি যত্নে রেখে দিয়েছিল। ভেবেছিল সব কিছু মিটে গেলে সে ফোনখানি ব্যবহার করা শুরু করবে। আমাদের জেরার শুরুতেই সে বেচারা ভেঙে পড়ে এবং কাল রাতের শুরুতেই এই মোবাইলটি আমাদের হস্তগত হয়। অতনু ভট্টাচার্য, রাজ্যসরকারী কর্মচারী, এবং একজন একজন অত্যন্ত সুদক্ষ প্রফেশনাল কিলার”।
বরাট উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন “রিয়াল লাইফ বব বিশ্বাস? কোই দেখাও ভদ্রলোককে?”
উপমন্যু রঙ্গনের দিকে ইশারা করে বরাটের দিকে তাকিয়ে বললেন “বব বিশ্বাস এবং অতনু ভট্টাচার্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। বব বিশ্বাস প্রফেশনাল কিলার ছিল এবং বরাবর ভদ্রতার মুখোশ পরে ঘুরত। অতনু এককালে রাজনৈতিক গুন্ডা ছিল। পরে পার্টি করার সুবাদে তার পুনর্বাসন ইত্যাদি হয়, সে তার জন্মভূমি বদল করে শিবপুরে চলে আসে এবং বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করে। বাইরের চেহারা ভদ্র। যদিও বদ দোষ তার এখানে এসেও যায় নি, বিভিন্ন যৌনপল্লী ঘুরে বেড়াত এবং সে দোষ অফিসের কারো কাছ থেকে সে লুকোতেও পারে নি কোন দিন। কথায় আছে গুন্ডাদের কোন দিন চুল পাকে না কিন্তু অতনুর চুল পেকেছিল। তার অত্যন্ত ধূর্ত স্বভাব তাকে আর সব কিছুর থেকে আলাদা করে দিয়েছিল”।
রঙ্গন অতনুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অতনুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এক রাতে তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। বরাট অতনুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন “মুখটা চেনা লাগছে। ভাঙরে ৯০ এর দশকে গণধর্ষণ এবং খুনের মামলায় ছিলি না তুই?”
অতনু মরা মাছের চোখ নিয়ে বরাটের দিকে তাকাল।
উপমন্যু বললেন “ঠিক ধরেছেন স্যার। হি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট। এবং এখনও টাকার বিনিময়ে অপারেশন চালাত যদিও কাকপক্ষীতে সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের কারো হয় নি”।
বরাট অনীশ, বিশ্বজিৎ এবং তমালিকার দিকে তাকিয়ে বললেন “এদের কেন এখানে আনা হয়েছে? এদের মধ্যেই কি কেউ খুনী?”
উপমন্যু বরাটের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন “উদ্ধার হওয়া মোবাইলের ডেটা উদ্ধার করে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং তথ্য পাওয়া গেছে স্যার। পুজোর পরে বিশ্বজিৎবাবু জয়িতার ঘরে গিয়ে জয়িতাকে মলেস্ট করার চেষ্টা করেন”।
তমালিকা চমকে বিশ্বজিতের দিকে তাকাল। বিশ্বজিৎবাবুর মুখ নিমেষে ছাইবর্ণ ধারণ করল। তমালিকা উপমন্যুকে বললেন “আপনার কাছে এর কোন প্রমাণ আছে অফিসার?”
উপমন্যু বললেন “আছে। আপনি এই মুহূর্তে আপনার স্বামীকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন, আশা করি উনি আপনাকে হতাশ করবেন না। কী বিশ্বজিৎবাবু? করবেন?”
বিশ্বজিৎবাবু তমালিকাদেবীর দিকে তাকাতে পারলেন না।
বরাট অস্ফূটে বললেন “অথচ এদের দেখলে ভদ্রলোক বলেই মনে হয়”।
উপমন্যু বললেন “একেবারেই। এই তথাকথিত ভদ্রলোকের মুখোশেই থাকে মলেস্টাররা আর তাদের জন্য আমাদের চারপাশটা প্রতিদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বিশ্বজিৎবাবু জয়িতার ঘরে গিয়ে জয়িতাকে ওপেন অফার দেন। প্রথমে পাঁচ হাজার, এবং পরে দশ হাজার অবধি ওঠেন। শেষ পর্যন্ত জয়িতা তাকেও জানান যে সে প্রেগন্যান্ট। বিশ্বজিৎবাবু জয়িতাকে নষ্ট মেয়েছেলে ইত্যাদি বলে ঘরে ফিরে আসেন এবং এই পিজি ছাড়ার হুমকি দেন। এই পিজি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন ভাগ্যিস, নইলে খুঁজে পাওয়া ফোনের মেসেজ বক্স থেকে এই ঘটনাটা আমরা জানতেও পারতাম না”।
তমালিকার দু চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছিল। উপমন্যু রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন “ওকে মালবিকা ম্যাডামের রুমে নিয়ে গিয়ে বসাও। ওকে আপাতত আর এখানে রাখার দরকার নেই”।
বিশ্বজিৎ খানিকটা সামলে নিয়ে চেচিয়ে উঠলেন “কিন্তু আমি খুন করি নি। বিশ্বাস কর তমালি, আমি খুনটা করি নি”।
উপমন্যু রঙ্গনকে ইশারা করলেন। রঙ্গন ঘর থেকে বেরিয়ে একজন মহিলা কন্সটেবল নিয়ে এসে তমালিকাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেলেন।
উপমন্যু অনীশের দিকে তাকিয়ে বললেন “তোমার কিছু বলার আছে অনীশ?”
অনীশ ফ্যাকাশে মুখে বলল “আমি কিছু জানি না। আমি… বিশ্বাস করুন”।
উপমন্যু হাসলেন।
বরাট কৌতূহলী মুখে বললেন “এদের মধ্যে কে খুনটা করল উপমন্যু?”
।।দিনের শেষে।।
উপমন্যু বললেন “ আবারও বলছি অপরাধী মনস্তত্ত্ব যে কতদূর যেতে পারে তা বোধ হয় এই কেসটা স্টাডি না করলে জানতে পারতাম না স্যার। কলকাতায় একা থাকা একটা মেয়েকে যখন বাড়িতে টাকা পাঠাতে হচ্ছে, নিজের লাইফস্টাইল ঠিক রাখতে হচ্ছে, তখন যে প্রলোভনগুলো তার সামনে আসছে, সে সবকে সামলানো যে কতটা কঠিন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে জয়িতার বয়সী মেয়েদের। এ প্রজন্মে মোবাইল আছে, তার সঙ্গে আছে প্রতিদিন নিজেকে আধুনিক প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা। এই জালে যে জড়িয়েছে, সে বেরোতে পারে নি কখনই। কেসটার নিস্পত্তি কিছুতেই হত না, যদি না জয়িতার ঘরে দ্বিতীয়বার ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে আমরা এক্সাম প্রিপারেশন বইটা না পেতাম, আর সেখান থেকে এই অতনুর নাম্বার না পেতাম”।
বরাট বললেন “বুঝলাম না। আরেকটু খুলে বল”।
উপমন্যু বললেন “কোথাও কোন স্ট্রং ক্লু না পেয়ে হতাশ হয়ে আমি দ্বিতীয়বার জয়িতার ঘর সার্চ করার সিদ্ধান্ত নি। জয়িতার খাটের ওপর ছিল এক্সাম প্রিপারেশন বইটি। জয়িতা হয়ত কোন পরীক্ষা দেওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছিল। শুরু থেকে প্রতিটা পাতার প্রতিটা প্রবলেমই সে অ্যাটেম্পট করতে করতে যাচ্ছিল। একটা পাতা এল যেখানে জয়িতা আর কোন প্রশ্ন অ্যাটেম্পট করে নি কিন্তু সে পাতায় একটা ফোন নাম্বার খুঁজে পাওয়া গেল। সে নাম্বারের ডিটেলস বের করলে দেখা গেল নাম্বারটি দমদমের তন্ময় ভৌমিকের। তন্ময়বাবুকে জেরা করে নিশ্চিত হওয়া গেল নাম্বারটি বর্তমানে ব্যবহার করছেন অতনুবাবু। অতঃপর কাল রাতে অতনুকে আটক করা। ওঁর থেকে জয়িতার দ্বিতীয়ফোনটা উদ্ধার করা এবং সেখান থেকে জানতে পারা জয়িতাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অতনুকে কে নিয়োগ করেছিল”।
বরাট অধৈর্য হয়ে বললেন “আরে তুমি তো ইন্ডিয়ান আইডল ঘোষণার মত সাসপেন্স রাখছ। কে অ্যাপয়েন্ট করেছিল?”
উপমন্যু হেসে বললেন “দ্য গ্রেট শঙ্কর মুখোপাধ্যায়”।
উপমন্যু কথাটা বলেই অনীশের দিকে তাকালেন। নামটা শুনে অনীশও যে চমকে উঠেছে সেটা উপমন্যু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।
বরাট অবাক হয়ে বললেন “মানে? মাঝবয়সে এসে?”
উপমন্যু বললেন “অনীশের জন্মের প্রায় সাথে সাথেই শঙ্করবাবুর স্ত্রী রমলা মুখোপাধ্যায় মারা যান। রমলাদেবীর বাড়ির লোকের অনেকেরই মতে স্ত্রী হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই শঙ্কর স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন টাকা দিয়ে। শ্বশুরবাড়ির লোকের সঙ্গে তার ইগো ক্ল্যাশ ছিল। শঙ্করের নামে চার্জ শিট আনার সঙ্গে হয়ত সেই কেসটাও পৃথিবীর আলো দেখতে পারে। যাই হোক, আমি ইতিহাস না ঘেঁটে বর্তমানে আসি। এই অনীশ মুখার্জি চারিত্রিকভাবে অত্যন্ত দুর্বিনীত একটি ছেলে। কলেজে জয়িতাকে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করেছে, কুপ্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু জয়িতার দিক থেকে সে সময়ে কোন রকম সাড়া পায় নি। যখন সে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল তখন অনীশ কোনভাবে জানতে পারে জয়িতা চাকরি খুঁজছে। সে সরাসরি জয়িতাকে সেই প্রস্তাবটা দেয়। জয়িতা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে অনীশের প্রস্তাবে রাজি হয়। অফিস জয়েন করে।
জয়িতার ধারণা হয়েছিল শঙ্করবাবুকে অনীশের সম্পর্কে জানালে হয়ত কোন সুরাহা হতে পারে, সে সুযোগ খুঁজতে পারে এবং পেয়েও যায়। এখান থেকে এক অন্য গল্পের শুরু হয় যেটা আমরা এই মোবাইলটা উদ্ধার না করতে পারলে জানতেই পারতাম না”।
অনীশ চুপ করে উপমন্যুর কথা শুনছিল। বিশ্বজিৎও।
বরাট বললেন “কী প্রমাণ পেলে তুমি এই মোবাইলে”?
উপমন্যু বললেন “বিজনেস টাইকুন শঙ্কর মুখোপাধ্যায় অসম্ভব সংযমী জীবনযাপন করতেন। ব্যাপারটা এরকম ছিল না যে তার জীবনে প্রলোভন আসে নি। কিন্তু রমলাদেবীর মৃত্যুর পর সেসব প্রলোভনকে তিনি মাথায় চড়তে দেন নি। সমস্যা হল অনীশের বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে। শঙ্করবাবু বুঝতে পারলেন ‘নরানাং মাতুলাকৃতি’ কথাটির সারমর্ম। আমরা কেউই জানতাম না, শঙ্করবাবুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সুবিধের ছিল না। খানিকটা ট্র্যাপে ফেলেই রমলার সঙ্গে শঙ্করের বিয়ে দেওয়া হয়। নিজের ব্যবসা দেখার সঙ্গে সঙ্গে অনীশের বড় হওয়াটা দেখতে দেখতে শঙ্কর একটা সময়ে এসে বুঝতে পারেন তার ছেলেকে তিনি যতই মামাবাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন, তার ছেলে আদতে ওই বাড়ির লোকেদের মতই ইতর এবং কুলাঙ্গার তৈরী হয়েছে”।
অনীশ চেচিয়ে উঠল “মুখ সামলে অফিসার। আপনি জানেন না আপনি কার সম্পর্কে কথা বলছেন”।
উপমন্যু অনীশের দিকে তাকিয়ে বললেন “দেশের সংবিধানে সবাইকে সমানভাবে ট্রিট করার কথা বলা হয়েছে বুঝলে? অসভ্যতা কোর না। পুলিশের রুলের গুতো সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই, যাক গে…”
উপমন্যু বরাটের দিকে ফিরলেন “এই হতাশা শঙ্করকে কুড়ে খাওয়া শুরু করল। যার জন্য এত কিছু ছাড়লেন, সেই ছেলে সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রিপোর্ট তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙে দিল এবং এই রকমই এক দিনে এস আর জি ইনফোটেকে অফিস ভিজিটে গেলে জয়িতা তাকে কোনভাবে একা পেয়ে তার ছেলে অনীশের কথা তাঁকে বলে। শঙ্করবাবু জয়িতায় জড়ানো শুরু করেন। যদিও অনীশ এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। শঙ্করবাবু মধ্যবয়স্ক হলেও তার অ্যাপিয়ারেন্স, ম্যাগনেটিক পারসোনালিটি, সর্বোপরি প্রচুর সম্পদ জয়িতাকে মুগ্ধ করল অতি সহজে। এই দামী ফোনটি সম্ভবত শঙ্করবাবুই দিয়েছিলেন জয়িতাকে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। কলকাতায় এলে পাঁচতারা হোটেলে জয়িতাকে নিয়ে যাওয়া, ঘনিষ্ঠতা সবই হল এবং জয়িতা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ল”।
অনীশ দু হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরল।
উপমন্যু বললেন “এই ফোনের হোয়াটস অ্যাপ ব্যাক আপে রাখা মেসেজ দেখলে শঙ্করের সঙ্গে জয়িতার সম্পর্কের অনেকটাই বুঝতে পারবেন। মধ্যবয়স্ক শঙ্কর রীতিমত টিনেজদের মত জয়িতার সঙ্গে প্রেম করতেন। খেয়েছ নাকি, কিংবা তোমাকে রাণী করে রাখব টাইপ কথাবার্তাও খুঁজে পাওয়া যাবে এই কনভারসেশন থেকে। সেলফি এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে সবই হত”।
বরাট হেসে ফেললেন। উপমন্যু আড়চোখে অনীশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এদের সম্পর্কে সমস্যাটা শুরু জয়িতার প্রেগন্যান্সির পর থেকে। শঙ্কর বার বার জয়িতাকে অ্যাবর্ট করতে বলেন। জয়িতা ভেবেছিল শঙ্কর হয়ত তাকে বিয়ে করবে। অনীশের বাপের থেকে পজিটিভ রেসপন্স না পেয়ে জয়িতা বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। শঙ্কর সে সময়টা জোহানেসবারগ যান। জয়িতা ফোন করে করেও শঙ্করকে পায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জয়িতা ঠিক করে শঙ্করের সব কীর্তির কথা অনীশকে বলবে”।
বরাট বললেন “ওহ, রিভার্স সাইকোলজি?”
উপমন্যু বললেন “একজ্যাক্টলি স্যার। অনীশকে সব কিছু বলার জন্য জয়িতা গড়পঞ্চকোটে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় তার পিজিমেট নীলমকে, কিন্তু এ ছেলে ঘরে ঢোকার পর জয়িতার কথা শোনার আগেই শারীরিকভাবে জোরজারি শুরু করলে জয়িতা জানিয়ে দেয় সে প্রেগন্যান্ট এবং নীলমের ঘরে আশ্রয় নেয়। অনীশের ওপর সে এতটাই বিরক্ত হয়ে গেছিল যে অনীশকে আর কিছু বলতে পারে নি। যাই হোক, এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, আসিফ এবং রুহির সঙ্গে গিয়ে জয়িতা বাচ্চা নষ্ট করে। কিন্তু শঙ্করকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে। শঙ্কর মুখোপাধ্যায় ব্যবসার ব্যাপারে এত জবরদস্ত হলেও সম্পর্কের এই কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। ঠিক করেন জয়িতাকে সরিয়ে দিতে হবে। অতনুকে অ্যাপয়েন্ট করেন। শঙ্কর দেশের বাইরে ছিলেন। ওখান থেকেই জয়িতাকে ফোন করে অতনুর নাম্বার দেন। তাড়াহুড়োয় দেওয়া নাম্বার জয়িতা এক্সাম প্রিপারেশন বইতে লিখে রাখে। শঙ্কর জয়িতাকে জানান সায়েন্স সিটির কাছে অতনুর সঙ্গে দেখা করতে। অ্যাবরশনের ক্ষতিপূরণ বাবদ বেশ কিছু টাকা তিনি অতনুর হাত দিয়ে পাঠাবেন। সে টাকা নেওয়ার জন্য জয়িতা অতনুর সঙ্গে দেখা করতে যায় অফিস না গিয়ে এবং অতনু এরপরে যা করার করে। তবে যাই বলুন স্যার, কে যে বলে মেয়েদের পেটে কথা থাকে না, এই ফোন নাম্বার এবং অতনুর কাছ থেকে ফোনটা উদ্ধার না হলে কার সাধ্যি ছিল জানার যে শংকরের সঙ্গে জয়িতার আদৌ কিছু ছিল। জয়িতার কোন বন্ধু, অফিসের কেউ, কিচ্ছু জানে না। শি ওয়াজ আ পারফেক্ট সিক্রেট কিপার”।
বরাট চোখ ছোট ছোট করে অতনুর দিকে তাকিয়ে বললেন “শঙ্কর মুখার্জির সঙ্গে এর আগে তোর কতবার ট্রানজাকশন হয়েছে?”
অতনু উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে নখের দিকে তাকিয়ে রইল।
উপমন্যু বললেন “সেসব বের করার দায়িত্ব আমরা রঙ্গনের ওপর ছেড়ে দিতে পারি স্যার”।
বরাট বললেন “তা বটে। কেসটা স্ট্রং বানাতে হবে বুঝতেই পারছো। শঙ্কর মুখোপাধ্যায় দেশের সেরা ল ইয়ার নিয়োগ করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি আছেন কোথায় এখন?”
উপমন্যু বললেন “প্যারিসে। দেশে ফেরামাত্রই গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোরাল অফ দ্য স্টোরি কী জানেন স্যার, মেয়েটার শরীরটা স্বাদু ছিল প্রথমে, মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হতেই সেটা বিস্বাদ হয়ে গেল। জাস্ট ভাবুন, এই অনীশ কিংবা বিশ্বজিৎবাবুদের মত লোকেরাও যখন জানতে পারল মেয়েটা প্রেগন্যান্ট, তখন বিকর্ষণ বোধ করল”।
বরাট চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন “তা নয় উপমন্যু, বরং বলতে পারো সেক্সুয়ালি এরা অতটাও পারভারট নয়। প্রেগন্যান্ট মেয়ে কি রেপ হয় না? হয়। তবে এটা বলতে পারো, শঙ্করের মত লোকের কাছে জয়িতার শরীরটা বিস্বাদ হয়ে গেছিল। সাচ আ স্ট্রেঞ্জ ক্যারেক্টার হি ইজ। ওঁর মত লোক এসকরট… থাক…”।
উপমন্যু অনীশের দিকে ফিরে বললেন “বাবাকে ফোন কর। খবর নাও কবে ফিরবেন। আর কিচ্ছু বলবে না”।
অনীশ মুখ শক্ত করে বলল “আমি পারব না”।
বরাট জোরে ধমক দিলেন “উপমন্যু যা বলছেন তাই করুন। নইলে এমন অবস্থা করা হবে বুঝতে পারবেন কলকাতা পুলিশ কী জিনিস”।
অনীশ থতমত খেয়ে বলল “আমার ফোন জমা নেওয়া হয়েছে”।
উপমন্যু রঙ্গনের দিকে তাকালেন। রঙ্গন বেরিয়ে গেলেন বরাটের চেম্বার থেকে। কয়েক মিনিট পরে অনীশের ফোন নিয়ে হাজির হলেন।
অনীশ বলল “বাবা এখন ওঠে নি”।
উপমন্যু বললেন “ফোন কর। ওঠাও”।
অনীশ কাঁপা কাঁপা হাতে শঙ্করের নাম্বার ডায়াল করল। কিছুক্ষণ পর বলল “ধরছে না ফোন”।
উপমন্যু বললেন “সঙ্গে কে যায়? জানো? তাকে ফোন কর”।
অনীশ উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে আবার কারো একটা নাম্বার ডায়াল করল। এবারে ওপাশ থেকে ফোন ধরল, অনীশ বলল “বাবাকে দাও তো। বাবা ফোন ধরছে না”। ওপাশ থেকে কোন একটা উত্তর এল। অনীশের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।
রঙ্গন এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে উপমন্যুর হাতে দিলেন।
উপমন্যু ওপ্রান্তের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বরাটের দিকে তাকিয়ে বললেন “শঙ্কর মুখোপাধ্যায় খানিকক্ষণ আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন স্যার”।
বরাট উপমন্যুর দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন “অপরাধবোধ? নাকি অবচেতনে ভয়”।
উপমন্যু অনীশের দিকে তাকিয়ে বললেন “সে যাই হোক, এখন একটা কথাই মনে পড়ছে। কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। মুখার্জি ইন্টারন্যাশনালের সর্বেসর্বা এখন এই রাস্কেলটি”।
অনীশ দু হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকল।
#
দরজা খুলে পিয়ালী উপমন্যুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। বললেন “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
উপমন্যু ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন “তাতান আছে?”
পিয়ালী বললেন “এই এল”।
উপমন্যু বললেন “চল। কোথাও খেয়ে আসি। অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয় না”।
পিয়ালী বললেন “চিমটি কাটো দেখি। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। তুমি সত্যিই তো? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি”।
উপমন্যু বললেন “চল চল। দেবু বসে আছে। ও ব্যাটাও রোজ রোজ পেটচুক্তি ভাত আর ব্লেড দিয়ে কাটা মাছ খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত। চল খেয়ে আসি”।
পিয়ালী উপমন্যুর দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে তাতানকে ডাকতে ঘরের ভেতর গেলেন।
উপমন্যু হাসতে হাসতে সিগারেট ধরিয়ে বললেন “কারো পৌষ মাস… কারো সর্বনাশ… কারো পৌষ মাস… কারো…”
(শেষ)