অন্দর মহলে
রসিকতা, তা সে মুখে বলি কিংবা লিখিতভাবেই করি, তার একটা প্রধান অসুবিধে এই যে জের টানতে হয়।
এক রসিকতা আর এক রসিকতাকে ডেকে আনে। সময় বা সুযোগ বুঝে কাজে লাগানোর জন্যে তুলে রাখা সম্ভব নয়, হয় ছেড়ে দিতে হয়, অথবা ব্যবহার করতে হয়।
শাশুড়ি বউমার কাহিনী অনেক লিখেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি কিছু খুঁটিনাটি বাদ রয়ে গেছে।
মাতৃসমা শাশুড়ি ঠাকুরানিকে এতটা বঞ্চিত করা উচিত হবে না তাই পুনরায় অন্দরমহলে প্রবেশ করছি।
প্রথমে শাশুড়ি ঠাকুরানির সম্পর্কে একটি কাহিনী স্মরণ করি।
প্রবল দাম্পত্য কলহ চলছে। যথারীতি স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে সেই পুরনো অভিযোগ আনয়ন করলেন, ‘তুমি আমাকে শুধু নয়, আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে অপছন্দ করো, ঘেন্না করো।’
স্বামী উত্তর দিল, ‘একথা ঠিক নয়, আমি অন্তত একজন তোমার আত্মীয়কে আমার যে কোনও আত্মীয়ের চেয়ে বেশি পছন্দ করি।’
বউ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সেই আত্মীয়টি কে, শুনি।’
বর বলল, ‘তোমার শাশুড়ি।’
বর-বউ থেকে শাশুড়ি-বউমার আসল গল্পে যাই।
তার আগে বলে নিই, শুধু একালে নয়, কোনও কালেই শাশুড়ি-বউমার সম্পর্ক সব সময়ে খুব মধুর ছিল না।
আমরা ছোটবেলায় শাশুড়ি ঠাকরুনের ছড়া শুনেছি, সেটি বধূমাতার উদ্দেশে শাশুড়ির উক্তি,
‘শীতকালে জার গোটা
গরম কালে ঘামাচি,
কোন কালে আছিলা বউ
সর্বাঙ্গে রূপসী?’
না। সেকাল থেকে একাল, শাশুড়ির চোখে বউ কোনওকালেই সর্বাঙ্গে রূপসী নয়।
একালের একটি কাহিনী বলি। খুব আধুনিক কাহিনী।
এ গল্পের বধূমাতা নিতান্তই নব বধূ, সদ্য বিয়ের পালা মিটেছে।
বাঙালি গৃহস্থবাড়ির বিয়ের পালা তো কম লম্বা নয়। সেই কনে দেখা, গায়ে হলুদ, আশীর্বাদ থেকে বিয়ে—বাসি বিয়ে, ফুলশয্যা, বউ-ভাত, দ্বিরাগমন, অষ্টমঙ্গল, অবশেষে স্বপ্নের মধুচন্দ্রিমা।
অবশেষে সেই মধুচন্দ্রিমা পালাও শেষ হয়েছে। এখন নববধূ পারিবারিক সাদামাটা জীবনে প্রবেশ করেছে। সে নিজে আজ একটা রান্না করেছে।
শাশুড়ি ঠাকরুন টেবিলে খেতে বসেছেন। ভদ্রমহিলার পিত্রালয় ছিল উত্তরবঙ্গের এমন এক জেলায় যেখানে ঔ-কার উচ্চারণ নেই, নৌকাকে বলে নোকা, কৌতূহলকে বলে কতূহল, তিনি বউমাকে বলেন বোমা।
তা শাশুড়িকে বউ তার রান্নার পদ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাপের বাড়িতে সবাই বলে, আমি বেগুন ভর্তা আর পায়েসটা খুব ভাল করতে পারি।’
ব্যাজার মুখে প্লেট থেকে বউমার বানানো প্রথম খাদ্যদ্রব্য এক চামচে তুলে নিলেন। তারপর সেটা মুখে ঢেলে কোনও রকমে গলাধঃকরণ করে, শাশুড়ি প্রশ্ন করলেন, ‘তা বোমা, আজ এটা কী বানালে, বেগুন ভর্তা না পায়েস?’
শাশুড়ি সংক্রান্ত একটি করুণ কাহিনী কিছুদিন আগে আমার বয়স্য গঙ্গারাম আমাকে বলেছিল। অধিকাংশ গঙ্গারাম কাহিনীর মতো এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা পাঠক-পাঠিকারা বিবেচনা করবেন।
গঙ্গারাম সকালবেলা বাজার করতে যাচ্ছিল, রাস্তায় দেখে সামনে একটি লোক খই ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে, পিছনে একটি শবযাত্রা।
প্রথমে শববাহকেরা শব বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। তার এক পাশে এক ভদ্রলোক, তার সঙ্গে একটি কুকুর। পিছনে শবানুগামীদের দীর্ঘ মিছিল।
যে ভদ্রলোক কুকুর নিয়ে মৃতদেহের পাশে হাঁটছিলেন, তাঁকে খুব শোকাভিভূত মনে হচ্ছিল না, বরং মুখের মধ্যে যেন একটা চাপা উৎফুল্ল ভাব।
গঙ্গারাম ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, এত বড় শোক মিছিল, কে মারা গেছেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার শাশুড়ি ঠাকরুন। হঠাৎই মারা গেলেন।’
গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন, কী হয়েছিল তাঁর?’
ভদ্রলোক তাঁর পাশের কুকুরটাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আর বলবেন না, আমার এই কুকুরটা তাঁকে কামড়ে দিয়েছিল।’
হারামের মনে সব সময়েই নানা বদবুদ্ধি থাকে। সে অনুরোধ করল, ‘দাদা, আপনার কুকুরটাকে দু’-এক দিনের জন্যে ধার নিতে পারি।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘লাইনে আসতে হবে। এই মিছিলের পিছে দাঁড়িয়ে যান। শ্মশানে গিয়ে লিস্টি করব। আপনার পালা যখন আসবে, খবর পাঠাব।’