অন্তর্লোকের বাদশা – তৃষিত বর্মন
তথাগত মিত্র আপাদমস্তক সাহিত্যের মানুষ, ছেলে রাহুল ভারতের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছে৷ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বিষয় হলেও সাহিত্য ইতিহাসের মধ্যে কোথাও যেন সূক্ষ্ম একটা যোগসূত্র আছে৷ ইতিহাসের উপাদান নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস৷
রাহুলের গবেষণার বিষয়-‘মোগল শাসনের পূর্ববর্তী ভারতবর্ষ৷’ অভিভাবক হিসেবে তথাগত বলেছিলেন, ‘ইতিহাস গবেষণায় পড়াশোনার পাশাপাশি ফিল্ড ওয়ার্কটা খুব জরুরি৷ ইতিহাসের মুখোমুখি না দাঁড়ালে, তাকে স্পর্শ না করলে, তার প্রাচীন নাড়ির স্পন্দন টের পাবি কী করে?’
সেই সূত্রেই গ্রীষ্মের ছুটিতে পিতা-পুত্রের এই সাসারাম অভিযান৷ রাহুল বাবাকে বুঝিয়েছিল, ‘মোগল পূর্ববর্তী ভারতে দিল্লির তৎকালীন সুলতান ইব্রাহিম লোদির পর যদি কারও নাম নিতে হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি ‘সুরি বংশের’ ‘সিংহপুরুষ’ ‘শেরশাহ সুরি’ … যিনি নিজের বুদ্ধি, রণকৌশল আর অসীম সাহসে ভর করে একদিন দিল্লির মসনদে বসেছিলেন৷ আমার মনে হয়, সেখান থেকেই আমাদের অনুসন্ধান শুরু করা উচিত৷’
সময় থেমে থাকে না৷ ফলে প্রাচীন ইতিহাসের চামসা গন্ধ প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায় অগ্রগতির রথের চাকায়৷ আধুনিক সাসারামের যা চেহারা, তার মধ্যে পাঁচ-শো তিরিশ বছরের প্রাচীন গণ্ডগ্রামটাকে খুঁজে বের করা শুধু কঠিনই নয়, রীতিমতো দুঃসাধ্য৷
স্টেশনের কাছেই টুরিস্ট অফিস৷ সেখানে যারা গাইডের কাজ করে তাদের সঙ্গে কথা বলে মন ভরল না রাহুলের৷ তথাগতকে বলল, ‘এরা পয়সা নিয়ে গাইডের কাজ করে, অথচ এখানকার প্রাচীন ইতিহাসটাই ভালো করে জানে না৷’
উলটোদিকের দোকানটায় মাটির ভাঁড়ে আখের রস বিক্রি হচ্ছিল৷ হতাশ রাহুল বাবাকে বলল, ‘এই গরমে চা খেয়ে কাজ নেই . . . চলো, আখের রসে বরং গলা ভেজানো যাক৷’
দাম খুব একটা কম নয়৷ এক ভাঁড় রসের দাম বিশ রুপিয়া৷ তথাগত সাহিত্যের মানুষ, ফলে মানুষকে নাড়াচাড়া করে দেখতে তাঁর ক্লান্তি নেই৷ রসে চুমুক দিয়ে লোকটাকে কোলকাত্তাইয়া হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, তুমি কি এখানেই থাকো?’
-‘জি হাঁ৷’ বলে সে পালটা প্রশ্ন করল, ‘কিঁউ?’
-‘আসলে আমরা একজন ভালো গাইডের খোঁজ করছিলাম,’ তথাগত ব্যাখ্যা করলেন, যে আমাদের গোটা সাসারাম, এখানকার পুরোনো হাভেলি, কেল্লা সব ঘুরিয়ে দেখাবে . . . আমরা ভালো বকশিস দেব৷’
-‘তব তো এক হি আদমি হ্যায়, সফেদ খান . . . বহুত কুছ জানতা হ্যায় . . . উনকো সাথ মে লে লিজিয়ে সাব . . . আপকা কাম হো যায়গা৷’
ভাগ্য ভালো, বৃদ্ধ সফেদ খানকে বাড়িতেই পাওয়া গেল৷ সফেদ খান সত্যিই সফেদ খান৷ একমুখ সাদা দাড়ি, পরনের আলখাল্লাখানাও যে একসময় সাদা ছিল, এখনও সেটা বোঝা যায়৷ কোটরগত চোখের কোলে সুর্মার টান৷
তথাগতদের প্রস্তাব শুনে নাকি ইতিহাসের টানে কে জানে, সফেদখানের ন্যুব্জ শরীর টান টান হয়ে উঠল৷ তারপর চোস্ত উর্দুতে বলে উঠল, ‘বহুত সাল বাদ কিসিনে শের কো ইয়াদ কিয়া. . . উয়ো আভি ভি জিন্দা হ্যায়, এ হি সাসারাম কা দিল মে৷’
রাহুল অনুমান করল, ওরা ঠিক লোকের কাছেই এসেছে৷
সফেদ খানের চাহিদা খুবই কম৷ টাকাপয়সা সংক্রান্ত কথাবার্তা সহজেই মিটে গেল৷ স্টেশন চত্বরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাড়ার গাড়ি৷ তারই একটার সঙ্গে দরদাম করে নিলেন তথাগত৷ একে গরম, তার ওপর সারাদিনের প্রোগ্রাম . . . বেশ কিছু শুকনো খাবার আর জলের বোতল গাড়িতে তোলা হল৷
তথাগত বসলেন সামনের সিটে, পেছনের সিটে সফেদ খান আর রাহুল৷ রাহুলের কোলে ল্যাপটপ৷ একটা একটা করে সাসারামের বন্ধ পড়ে থাকা ইতিহাসের পাতা খুলছিলেন সফেদ খান . . . অনুগত ছাত্রের মতো সেসব মূল্যবান তথ্য ল্যাপটপে ধরে রাখছিল রাহুল৷
আধুনিক সাসারামের পথঘাটে এখন পিচের সস্নেহ প্রলেপ৷ বিহারে খরার প্রকৃতি বড়ো ভয়ংকর . . . তারই মধ্যে গরম হলকাকে অগ্রাহ্য করে তিন-তিনটে মানুষ ছুটে চলেছে ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাসকে জাগিয়ে তুলতে৷
রাস্তার দু-পাশে বিস্তীর্ণ শস্যখেত৷ কোথাও জোয়ার-বাজরা, কোথাও ভুট্টা, আবার কোথাও আখের খেত৷ তথাগত চারপাশে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খানসাব, সাসারামে চাষবাসটাই কি প্রধান জীবিকা? এখানে জলের অভাব হয় না?’
-‘বহোত হয় . . . এখানে চার-পাঁচ মাস তো খরা মরশুম৷ পানি মিলনেমে দিককত হোতা হ্যায়৷’ সফেদখানের গলায় তৃষ্ণার আকুতি৷ এগ্রিকালচার ডিপার্ট কুছ স্যালো বানিয়েছে . . . মগর জমিনের নীচে পানি কাঁহা, যো মিলবে?’
বেলা দশটা বাজতে না বাজতেই প্রকৃতির চোখে চোখ মেলানো দায় হয়ে উঠেছে৷ রাস্তার ধারে নিঃসঙ্গ একটা পিপুল দাঁড়িয়ে৷ তারই ছায়ায় ড্রাইভারকে গাড়িটা দাঁড় করাতে বলল সফেদ খান৷
তারপর কিছুটা দূরে একটা বড়োসড়ো বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘একসময় ওখানেই ছিল ইব্রাহিম খানের হাভেলি . . . এখন সরকারি দপ্তরখানা হয়ে গেছে৷’
-‘ইব্রাহিম খান কে?’ তথাগত জিজ্ঞেস করলেন৷
রাহুল নেট সার্চ করে কিছুটা হোমওয়ার্ক করে এসেছে৷ সফেদ খানের বদলে সেই জবাব দিল, ‘শেরশাহের ঠাকুর্দা . . . খুব ধর্মপরায়ন মানুষ ছিলেন৷’
রাহুল বাংলায় বললেও সবটাই বুঝতে পারল গাইড সফেদ খান৷ স্মিত হেসে সে রাহুলের দিকে চেয়ে উঠল, ‘বিলকুল ঠিক বোলা সাব! লেকিন ফরিদের পিতাজি কুছ উলটা আদমি ছিল৷’
শেরশাহর আসল নাম যে ফরিদ খান, সে তথ্যটা দু-জনেরই জানা . . . ‘কিন্তু তাঁর বাবা হাসান খান সুরি উলটা আদমি ছিল, মানে কী?’
রাহুলের প্রশ্নের উত্তরে সফেদ খান সাদা দাড়ির ফাঁকে মুচকি হাসছেন৷ বললেন, ‘এক কহাবত হ্যায় জানেন তো বাবু সাব? বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া . . . কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া৷ লেকিন এই কহাবত ফরিদ খানের সাথ খাটে না৷ হাসান খান বহোত নিকম্মা আদমি থে . . . বেটা ফরিদ খান বচপন সে সিধা বাত বোলতো, বহোত হিম্মত ভি ছিল৷’
ল্যাপটপের বোতামের ওপর দ্রুত হাত চলছিল রাহুলের৷ জিজ্ঞেস করল, ‘সফেদ চাচা, শুনেছি মাত্র বারো বছর বয়েসে ফরিদ খান তাঁর হাভেলি ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েন . . . এর কারণ কী’?
বৃদ্ধ সফেদ খানের কোটরাগত চোখ দুটোতে জল চিকচিক করে উঠল৷ রাহুলের দিকে চেয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘বেটা, তুমি আমাকে চাচা বলে ইজ্জত দিলে, খোদা তোমাকে বহোত মেহেরবানি কোরবেন . . . তুমহারা ইয়ে কাম জরুর কাম ইয়াব হোগা বেটা৷’
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ফের বলতে শুরু করল, ‘বচপন থেকেই ফরিদ খানের দেখাশোনার আন্দাজটা ওর বাবার থেকে একেবারে আলাদা ছিল৷ সেই বয়সেই সাসারামের কিছু সমবয়সি, হিম্মতদার ছেলেদের নিয়ে সে একটা দল গড়ে তোলে৷ তাদের কাজ ছিল এলাকার গরিব দুখী মানুষজনকে সাহারা দেওয়া৷’
সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তথাগত জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর ওইসব করতে গিয়েই বুঝি বাপের সঙ্গে ছেলের সংঘাত বাধল?’
-‘আপ নে বিলকুল সহি বোলেছেন৷ ফরিদদের পিতাজি হাসান খান ছিলেন সুরি বংশের কলঙ্ক৷’ সফেদ খান ফের অতীতচারী, ‘আরাম-বিলাসে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতেন৷ ফরিদ খান শোচলো কি, হাভেলিতে থেকে ভালো কাম কিছু করা যাবে না৷ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সে আরামের জীবন ছেড়ে সিধা চলে গেল উত্তর প্রদেশে, জামাল খান শেরওয়ানির দলে৷’
গাড়ির ড্রাইভারের নাম মুন্না৷ সফেদ খানের চেনা লোক৷ তাকে বলল, ‘সামনে বাঁয়া রাস্তা পাকাড়না মুন্না, হামলোগোকো কিল্লা হাউস যানা হ্যায়৷’
কিল্লার বিশাল আয়তন দেখে নামতে চাইছিলেন না তথাগত৷ সফেদ খানের কাছ থেকে সংক্ষেপে কেবল ইতিহাসটুকু জেনে নোট করে রাখল রাহুল . . . দু-চারখানা ছবিও তুলল৷
সাসারামের পিচ রাস্তা চিরে ফের ছুটে চলল মুন্নার গাড়ি . . . এবারের গন্তব্য শেরশাহর সমাধি৷ সফেদ খান গর্বের সঙ্গে জানাল, ‘পুরা দুনিয়াতে যে সাতটা আশ্চর্য জিনিস আছে, এই মসজিদ তার মধ্যে একটা৷’
শেরশাহর সমাধি নিয়ে একটা অন্যরকম কল্পনা ছিল রাহুলের মনে৷ দেখে দু-জনেরই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠল৷ মনে হল, ইতিহাসের একটা উজ্জ্বল নিদর্শনকে ধরে রাখতে আমাদের ভূমিকা যে কতটা লজ্জাজনক, তা বলে শেষ করা যাবে না৷
তথাগত থাকতে না পেরে সফেদ খানকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ‘ভাই সাব, এই সমাধি দেখভাল করার কেউ নেই? নদীর জলে দেখছি, আমাদের কলকাতার গঙ্গার থেকেও বেশি আবর্জনা? এখানে-ওখানে গোরু চরে বেড়াচ্ছে?’
মসজিদের চাতালে খানিক দুষ্প্রাপ্য ছায়া৷ তার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে সফেদখান যেন কিছুটা সাফাই দিল-‘করিব চার-শো সত্তর সাল আগে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল . . . তারপর কত পানি এই গুমল নদী দিয়ে বয়ে গেছে৷ মানুষ যদি তার দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে না পারে, আমরা কাকে দোষ দেব ভাই সাব?’
গম্বুজের ছায়া ক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছিল সামনের মাঠে৷ এরই ফাঁকে মসজিদের চাতালে বসে নামাজটি সেরে নিল সফেদ খান৷ ইতিহাস ভালোবাসে বলে কি না কে জানে, রাহুলের বুকের মধ্যে এক আশ্চর্য অনুরণন৷ এই মসজিদেরই কোথাও মাটির নীচে শুয়ে আছেন সেই সিংহ হৃদয় আফগান যোদ্ধা-যিনি আরও দশ-পনেরো বছর বেশি বাঁচলে, সম্ভবত ভারতের ইতিহাসটা অন্যরকম লেখা হত৷
অন্যমনস্ক ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন তথাগত-‘আমি যা ভাবছি, তুইও কি তাই ভাবছিস?’
আত্মিক সমর্থন পেয়ে রাহুল তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘সমস্ত ছবিটা একবার ওয়ার্ক-আউট যদি কর, দেখবে একটা মানুষ মাত্র উনষাট বছর বেঁচেছিলেন৷ তার বেশির ভাগ অংশটাই কেটেছিল যুদ্ধবিগ্রহে৷ দিল্লির মসনদে বসে শাসন করেছিলেন মাত্র পাঁচ বছর . . . আর এই সামান্য সময়ে কী অসাধ্য সাধনটাই না করেছিলেন শেরশাহ সুরি৷ তাঁর সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমরা সেইসব অসামান্য কীর্তির কথা ভাবছি, তুমি দেখো বাবা, আমার রোমকূপগুলো সব খাড়া হয়ে উঠছে!’
সফেদ খানের নামাজ পড়া হয়ে গিয়েছিল৷ ভেতর থেকে এসে আলোচনায় যোগ দিয়ে বলল, ‘তুমি বিলকুল ঠিক বাত বলেছ বেটা . . . শের খানকা দিমাক, উসকা শোচনে কা ঢং, একদম আলাদা ছিল৷ আল্লার বহোত মেহেরবানি ছিল ওঁর ওপর৷ মতলব ইসস্পেশাল দোয়া . . . এসব মানুষ বেশিদিন বাঁচে না বেটা৷’
তথাগত ভাবলেন, সফেদ খানের কথাটা মিথ্যে নয়৷ যাঁরা ক্ষণজন্মা হয়ে জন্মান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বল্পায়ু হন . . . স্বামী বিবেকানন্দই তার জ্বলন্ত প্রমাণ৷ কিন্তু হাসান খানের মতো একজন ভোগী, অলস জায়গিরদারের ঘরে শেরশাহর মতো পবিত্র, উদ্যোমী, সাহসী এক আত্মা জন্মাল কী করে?
কালের কী বিচিত্র গতি! যে মহান আফগান সম্রাট আরত্ত কিছু বছর দিল্লির মসনদে থাকলে, ভারতের ইতিহাসটাই বদলে যেত-গ্রীষ্মের এক অপদগ্ধ অপরাহ্নে, তাঁরই সমাধিস্থলে ল্যাপটপ কোলে বসে এইমুহূর্তে এক ইতিহাস ভিক্ষু তরুণ তাঁর মহান কীর্তির সামনে নতজানু৷
রাহুল বলল, ‘সফেদ চাচা, আমার আরও কতকগুলো প্রশ্ন ছিল, যার উত্তর আমি পাইনি আজও৷’
সফেদ খান হাসল৷ বলল, ‘বেটা, আমার কাজই তো হল, তোমাদের সওয়ালের জবাব দেওয়া . . . জানা থাকলে নিশ্চয়ই বলব৷’
রাহুল ল্যাপটপ দেখে বলল, ‘সফেদ চাচা, এই মেশিনের হিসেব বলছে, শেরশাহ জন্মেছিলেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের এর ২২ মে . . . আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে৷ আর এই মসজিদ তৈরি শেষ হয়েছিল ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের এর ১৬ আগস্ট৷ তাহলে মাত্র তিন মাসে এই এতবড়ো মসজিদ তৈরি সম্ভব? এই জায়গাটাতে এসে হিসেবটা ঠিকঠিক মিলছে না চাচা?’
সফেদ খানের লম্বা সাদা দাড়ি প্রায় হাঁটু ছুঁয়েছে৷ ঘাড় হেঁট করে তার মরচে পড়া স্মৃতিকে আপ্রাণ সজীব করার চেষ্টা করছিল সে৷ বিকেলের শেষ রোদ্দুর ছড়িয়ে ছিল তার পশমের মতো চুল দাড়িতে৷
কিছু পরে মাথা তুলে বলল, ‘ইয়াদ আয়া৷ এই পবিত্র মসজিদ তৈরির কাজ শেরশাহ নিজেই শুরু করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর দু-এক বছর আগে . . . মসজিদের ডিজাইন করেছিলেন আলিওয়াল খান নামে এক পেশোয়ারি মুসলিম . . . এর হাইট ১২২ ফুট৷ কিন্তু আকস্মিক দুর্ঘটনায় শেরশাহ মারা যাওয়ার পর তাঁর পুত্র ইসলামশাহ সুরি এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করেন৷ এই জন্যেই বেটা, তোমার হিসাব মিলছিল না৷’
তথাগত বলে উঠলেন, ‘এই কারণেই পণ্ডিতরা বলে গেছেন, জানার কোনো শেষ নেই৷’
বিস্মিত রাহুল আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করল৷ বলল, ‘সফেদ চাচা, এই বয়সেও এত সাল, তারিখ আপনার মনে আছে? আপনার মতো স্মরণশক্তি পেলে আমার তো ল্যাপটপের দরকারই হত না৷’
শুনে হো-হো করে হেসে উঠল সফেদ খান৷ সে বাদশাহি হাসির দমক এতটাই যে মসজিদের গম্বুজে বসা একঝাঁক পায়রা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল পশ্চিম আকাশে৷
হাসি থামলে বলল, ‘কী করব বেটা, পাপী পেট কা সওয়াল, ইয়াদ রাখতে হয়৷ আমি তো দুসরা কোনো কাজকাম জানি না৷ কখনো কখনো তোমাদের মতো পড়ালিখা আদমি এলে আমার ডাক পড়ে৷ যিতনা থোড়া বহোত জানি, ট্যুরিস্টদের বলবার চেষ্টা করি৷’
তথাগতর যা কাজ, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বৃদ্ধ মানুষটাকে মাপবার চেষ্টা করছিলেন৷ বারবার তাঁর মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন সূক্ষ্ম একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তিনি ধরতে পারছেন না৷
অবশেষে আলগোছে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন সফেদ খানের দিকে, ‘সারা সাসারাম জুড়ে তো শেরশাহর কীর্তি ছড়িয়ে আছে, আপনি এই মসজিদে এসে থমকে গেলেন কেন?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সফেদ খান৷ তারপর পরিষ্কার উচ্চারণে বলে উঠল, ‘পাঁচ বছর দিল্লির মসনদে বসে শেরখান যা যা মহৎ কাজ করেছিলেন, তার সব কিছুই আপনার বেটার মেশিন খুললে পেয়ে যাবেন ভাইসাব৷ কিন্তু এই মসজিদে আমি যেটা আপনাকে শোনাব, সেটা আপনি কোনো মেশিনে কিংবা ইতিহাসের পাতায় পাবেন না৷’
শুনে তথাগত তো বটেই, রাহুলও চমকে উঠল৷ সফেদ চাচার কথাটা মিথ্যে নয়৷ শেরশাহ তাঁর মাত্র পাঁচ বছরের শাসনকালে (১৫৪০-১৫৪৫) যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম বাঙ্কার তৈরি, শুল্ক করের প্রবর্তন, অশ্বপৃষ্ঠে ডাক-পিয়নের প্রথা, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড সম্প্রসারণ, প্রথম রুপিয়ার প্রবর্তন-এ সবারই জানা৷ কিন্তু এর বাইরে কী শোনতে চাইছে সফেদ চাচা?
ঢোলা আলখাল্লা সামলে উঠে দাঁড়াল সফেদ খান৷ দুটো হাত অঞ্জলি দেওয়ার ভঙ্গিতে বুকের ওপর জড়ো করে সম্ভবত আল্লার মেহেরবানি চাইল৷ তারপর অমোঘ মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘চুপচাপ আমার সঙ্গে চলে আসুন৷’
মসজিদের গর্ভগৃহে তখনও আলো জ্বলেনি৷ পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি রঙিন শার্সি ভেদ করে যেটুকু ভেতরে এসে পড়েছে, সেখানে আলো ছায়ার এক মায়াবি খেলা৷
জরির চুমকি বসানো সমাধির লাল মখমলের কাপড়টা যেন শেরশাহর শৌর্যের প্রতীক বলে রাহুলের মনে হল৷ সফেদ খান গর্ভগৃহের বাঁ-দিকের দেওয়ালের কোণে, শ্বেতপাথরের মেঝেতে হেঁট হয়ে বসে কান পাতলেন৷ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তথাগত আর রাহুলকে ফিসফিস করে বললেন, ‘দেখুন তো, কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কি না?’
তথাগত আর রাহুল যারপরনাই বিস্মিত৷ সফেদ খানের এই মুহূর্তের আচরণটা দু-জনেরই কেমন অদ্ভুত লাগছে৷ তবু দু-জনেই কান পাততে শুনল, অনেক নীচ থেকে কীসের যেন মিলিত একটা শব্দ, কোলাহল স্পষ্ট ভেসে আসছে৷ বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর দু-জনেই উঠে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় সফেদ খানকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওঠা কীসের শব্দ?’
অকপট প্রত্যয়ে সফেদ খান জবাব দিল ‘শেরশাহ বিশ হাজার ঘোড়সওয়ার আর বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চলেছেন . . . এটা তারই শব্দ৷’
শুনে রাহুলের মনে হল, প্রায় সাড়ে-চার-শো বছরের প্রাচীন ভারতবর্ষ আর আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ভারত কোথায় যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে৷ চোখে-মুখে সংশয় ফুটিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী করে সম্ভব সফেদ চাচা?’
-‘এ আওয়াজ সবাই শুনতে পায় না বেটা৷ যারা শেরখানকে সাচ্চা ভালোবাসে, ইজ্জত করে, তারাই কেবল ওঁর ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়৷’
হাঁটতে হাঁটতে ফের তিনজন বাইরের চাতালে৷ বহু পঠিত ইংরেজি প্রবাদটা রাহুলের মনে পড়ল-‘There are more things in heaven and earth, which is beyond our imagination.’ তথাগতর অভিজ্ঞ মনে সংশয়৷
সফেদ খান এবার রাহুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আরও একটা জরুরি কথা তোমার জানা দরকার বেটা৷ প্রথম মোগল সম্রাট বাবর আর পরে আকবর যে সুশাসনের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার পুরা নকশা শেরখানের পাঁচ সালের শাসন থেকে কর্জ করা৷ ইয়ে বাত তুম জরুর লিখনা বেটা, তুমহারা পেপার মে . . . মেরা দিল মে বহোত শান্তি মিলেগা৷’
সম্রাট আকবরের সুশাসনের পুরো নকশা, শেরশাহর শাসনব্যবস্থা থেকে ধার করা-এ কথা তার রিসার্চ পেপারে উল্লেখ করলে, অশীতিপর সফেদ চাচার কেন শান্তি লাগবে, একথা অবশ্য রাহুলের জানা হয়ে উঠল না৷
বিশাল সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে তিন ইতিহাস-ভিক্ষু মানুষ নেমে এল সামনের মাঠে৷ অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মি তখন গুমল নদীর ঘোলা জলে মিলে মিশে একাকার৷