আট
গোলাপি আকাশের নিচে নিথর হয়ে আছে মোহাভি মরুভূমি, অপেক্ষা করছে ভোরের আলোর জন্যে। আশপাশের যানবাহনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা চেরোকি জিপ চালাচ্ছে রানা, পামডেল থেকে বেরিয়ে উত্তরে মরু এলাকায় ঢুকেছে।
বোর্ডিং স্কুল থেকে মাইলখানেক দূরের একটা পার্কিং লট থেকে জিপটা চুরি করেছে ও। দশ মাইল দূরে গিয়ে আরেকটা লটে থেমে অন্য একটা গাড়ির সঙ্গে লাইসেন্স প্লেট বদলেছে। এরপর পুবে সিমি ভ্যালি আর স্যান ফার্নান্দোর উত্তরের অংশ পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে গিরিখাতে—লক্ষ্য: মোহাভি মরুভূমি। চলার জন্যে সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তা বেছে নিয়েছে ও, যাতে স্যাটেলাইট ইমেজে ওদেরকে আলাদা করা না যায়।
এক মুহূর্তের জন্যে সতর্কতায় ঢিল দেয়নি ও। স্যাটেলাইটের ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক জানা নেই, বোর্ডিং স্কুলের ধোঁকাটা কাজে লেগেছে কি না কে জানে। সামনে থেকে আসা প্রতিটা গাড়ির দিকে নজর রাখতে হয়েছে—এই বুঝি কোনোটা ঘুরে যায়… জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যারেল! চলার পথের পুরোটা সময় রেসপন্স সিনারিয়ো নিয়ে ভাবছে ও—হামলার সব রকম কায়দা, এবং সেগুলো প্রতিরোধের কৌশল সাজাচ্ছে। আশপাশের পরিবেশ বদলালে কৌশলও বদলে নিচ্ছে।
এতক্ষণে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করছে রানা। আক্রমণ করতে পারলে এর ভেতর করে ফেলত প্রতিপক্ষ। বোধহয় ওদেরকে খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা থেকে জটিল হিসেবগুলো কিছুক্ষণের জন্যে সরিয়ে রাখল ও।
মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল অ্যালি। সন্দেহ নেই, রানার প্রতিটা চিন্তা অনুসরণ করছিল সে। বলল, ‘অদ্ভুত মানুষ তুমি। এতসব দিকে নজর রাখো কী করে?’
‘অভ্যেস,’ সংক্ষেপে বলল রানা।
কয়েক মিনিট নীরবতায় কাটল। মরুভূমি ও তার মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে এখনও ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে, তবে দূরে… স্যান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালার গায়ে লেগেছে সূর্যোদয়ের ছটা। পাহাড়চূড়াগুলো আলোয় ঝিকমিক করছে।
একটু পর রানা জানতে চাইল, ‘তোমার ওপর ওরা যে- ড্রাগটা ব্যবহার করছিল, ওটার নাম জানো?
অ্যালি মাথা নাড়ল। ‘না। সোনালিচুলো ডাক্তার কখনও ওটার নাম নিয়ে ভাবেনি। নিশ্চয়ই ওষুধটা নিয়মিত ব্যবহার করে অভ্যস্ত, তাই নাম মনে করতে হতো না।’
‘একটা ওষুধই দিত?’
মাথা ঝাঁকাল অ্যালি।
‘ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিত, নাকি স্যালাইনের মাধ্যমে?’
‘স্যালাইন।’
‘ওষুধের রঙটা কেমন?’
একটু ভাবল অ্যালি। ‘স্বচ্ছই বলা যায়, একটু যেন
নীলচে। ভালমত না তাকালে বোঝা যায় না।’
‘ওটা দেবার দু-তিন মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে তুমি, রাইট?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘুমিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে হাত কাঁপত… মুখের ভেতর একটা তিতকুটে স্বাদ পেতে?’
‘ঠিকই বলেছ,’ একটু যেন অবাক হলো অ্যালি। ‘কী করে জানলে?’
‘স্লিপ ইন্টারোগেশনের জন্যে খুব বেশি ড্রাগ নেই, ওগুলোর ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা আছে আমার। তোমাকে সবচেয়ে কমনটা দেয়া হচ্ছিল।’ ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল রানা। ‘তোমার স্মৃতি ফিরে আসবে, তবে এখুনি নয়। অন্তত এক সপ্তাহ লাগবে।’
মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল অ্যালির মাঝে। প্রথমে স্বস্তি ফুটল চোখের তারায়, কিন্তু পরক্ষণে তা সরে গিয়ে ভর করল ভীতি আর দুশ্চিন্তা। কোনোকিছুর সঙ্কেত দিচ্ছে ওর অবচেতন মন। কী সেটা?
.
রোজামণ্ডের একটা ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে থামল ওরা। জিপের ড্যাশবোর্ড হাতড়ে বেশ কিছু ভাঙতি কয়েন পাওয়া গেল। পরিমাণটা অল্পই, তবে ওগুলোর বিনিময়ে দুটো বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর কোল্ড ড্রিঙ্কস কেনা গেল অনায়াসে। খাবারের ট্রে নিয়ে বাইরের সিটিং এরিয়ায় বসল দু’জনে।
দিনের আলোয় এই প্রথম অ্যালিকে দেখছে রানা। ভাল করে তাকাতেই বুঝল, রাতের আলো-আঁধারিতে যতটা মনে হয়েছিল, মেয়েটার সঙ্গে লুবনার মিল তারচেয়ে অনেক কম। চোখের মণি আর মাথার চুল… কোনোটাই পুরোপুরি কালো নয়, কালচে-বাদামি। চিবুক আর ঠোঁটের গড়নেও পার্থক্য রয়েছে। আরও কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ করল, যা আগে দেখেনি। মেয়েটা একেবারে হাড্ডিসার, চোখের তলায় কালি জমেছে। দু’হাতেই রয়েছে কালশিরে—স্ট্র্যাপে বন্দি থাকার লক্ষণ। সুঁই ফোটানোর দাগও রয়েছে হাতে।
গত রাতের কথা ভাবল রানা। বোর্ডওয়াকে ও যদি না থাকত, তা হলে কী ঘটত? অসহায়ভাবে দৌড়ে মরত বেচারি, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যেত। তারপর?
ট্রে-র দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালি। বাতাসে উড়ছে ওর চুল। নিচু গলায় বলল, ‘সরি, রানা।’
‘কীসের জন্যে?
‘সবকিছুর জন্যে। এই যে, তোমাকে একটা ঝামেলায় ফেলে দিলাম। অযথা আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেলে তুমি। দুঃখিত।’
‘কোনও ব্যাপার না। ইট’স ওকে।’
‘কীভাবে বলছ এ-কথা? বাড়ি ফিরতে পারছ না তুমি। যেখানেই যাবে, ওরা তোমাকে…
‘অ্যাই!’ ওকে থামিয়ে দিল রানা। ‘আমার দিকে তাকাও।’
মুখ তুলল অ্যালি।
‘আমার সব চিন্তাই তো তুমি পড়তে পারছ,’ বলল রানা। ‘নিজেই বলো, কী ভাবছি আমি? যদি কোনোভাবে গত রাতে ফিরে যেতে পারতাম, তা হলে কি তোমাকে এড়াবার চেষ্টা করতাম আমি?’
কপালে ভাঁজ পড়ল অ্যালির। আবার নিচু করল মাথা। ফিসফিস করে বলল, ‘ধন্যবাদ, রানা। ‘
রেস্টুরেন্টের ওপর ডানা ঝাপটে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু মরুভূমির পাখি। কয়েকটা নেমে এল ওদের টেবিল থেকে কয়েক গজ দূরে, লাফালাফি করছে। ওদের দিকে তাকাল অ্যালি। এই প্রথম মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটতে দেখল রানা। চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কয়েকটা ফ্রাইয়ের টুকরো ছুঁড়ে দিল পাখিগুলোর দিকে। তারপর দ্রুত শেষ করল খাবার। তৈলাক্ত ফাস্ট ফুড… তবে গত দু’মাসে যা খেয়েছে, তার চেয়ে ভাল।
খানিক পর উড়ে গেল পাখিগুলো। পার্কিং লটের ওপর দিয়ে বড় একটা বৃত্ত রচনা করে চলে গেল দূরের পাহাড়সারির দিকে। সেগুলোকে অনুসরণ করল অ্যালির চোখ। মন ভরে দেখছে চারপাশের বিস্তৃত, অবারিত প্রান্তর। দু’মাস একটা বিছানায় বন্দি থাকার পর এই মুক্ত পরিবেশ অভিভূত করছে ওকে।
‘তুমি পালালে কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
নিচের ঠোঁট কামড়াল অ্যালি। বলল, ‘খারাপ একটা কাজ করতে হয়েছে। আসলে… আর কোনও উপায় দেখছিলাম না। যদি বলি অনুতাপ হচ্ছে, মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু কাজটা মোটেই ভাল করিনি।’
অপেক্ষায় রইল রানা।
বড় করে শ্বাস ফেলল অ্যালি। ‘প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ওষুধ দেয়া হতো আমাকে, গতকালও দেয়া হয়েছিল। বরাবরের মত ভোর তিনটার দিকে জেগে উঠি আমি। কিন্তু গতকাল একটা ভিন্ন ব্যাপার ঘটল। ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, আরেকটা ব্যাগ নিয়ে ফিরে এসেছে সোনালিচুলো ডাক্তার—তাতে নতুন ওষুধ। ওটার কথা ভাবছিল সে। ওষুধটার নাম বাবিচুরেট। ব্যাগে যে-পরিমাণ ওষুধ ছিল, তাতে আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। মানে, আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
‘তারপর?’
‘মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ডাক্তারকে বললাম, ও কী করতে চলেছে, আমি জানি। সেই সঙ্গে মিথ্যে করে বললাম, আমার পরে ওর কপালে কী ঘটবে, তাও জানা আছে আমার—আগের সন্ধ্যায় গার্ডেরা যখন আমার কাছে এসেছিল, তাদের মাইণ্ডরিড করে জেনেছি। ওদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমার লাশের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ডাক্তারকেও একই ভ্যানে তুলতে হবে… তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে হবে, সবশেষে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে কবর দিতে হবে।’
‘বিশ্বাস করেছিল তোমার কথা?’
‘না করে উপায় আছে? যাদের হয়ে কাজ করছিল, তারা ও-রকম কাজ তো হরহামেশাই করে—বিশেষ করে যখন কারও মুখ বন্ধ করতে চায়।’
লোকটার মনের অবস্থা কল্পনা করল রানা। নিশ্চয়ই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। ‘হুম। এরপর কী ঘটল?’
‘আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, বিল্ডিঙের সিকিউরিটি সিস্টেম সম্পর্কে তার আইডিয়া আছে কি না। সে মাথা নাড়ল। তাকে বললাম, আমি কিছুটা জানি—গার্ডদের মাথা থেকে জেনেছি। আসলে কিছুটা না, পুরোটাই জানতাম। যা হোক, লোকটাকে প্রস্তাব দিলাম: ওকে আমি পালাতে সাহায্য করতে পারি, যদি ওখান থেকে বেরুবার পর ও আমাকে মুক্তি দেবে বলে কথা দেয়। সরলমনে রাজি হয়ে গেল ডাক্তার। অন্য কোনও ফন্দি মাথায় আসেনি তার, এলেও লাভ হতো না। আমি জেনে যেতাম।
‘আমার বাঁধন খুলে দিল সে। দু’জনে চলে গেলাম বিল্ডিঙের পেছনের দরজায়। ডোর-অ্যালার্ম অচল করার কোড আমি তাকে বলে দিলাম; কিন্তু এ-কথা বললাম না যে, দরজা পেরুলেই বাইরে মোশন ডিটেক্টর আছে… সেগুলোকে বন্ধ করার কোনও কায়দা নেই।’
পরের অংশটা আন্দাজ করতে পারছে রানা। হ্যাঁ, কাজটা খারাপই হয়েছে বটে… কিন্তু কিছু বলতে গেল না। চুপচাপ শুনে গেল অ্যালির কথা।
‘ওকে বলেছিলাম, আমাদেরকে দৌড়ে পালাতে হবে। তা-ই করল সে। দরজা খুলে নিঃশব্দে তিন পর্যন্ত গুনল, তারপরেই লাগাল ভোঁ দৌড়। বিশ গজও যেতে পারল না, বেজে উঠল অ্যালার্ম, ফ্লাডলাইটের আলোয় ভরে গেল বিল্ডিঙের চারপাশ। থমকে গিয়ে উল্টো ঘুরল ডাক্তার। আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝল কী ঘটেছে। ওকে টোপ বানিয়েছি আমি, ধোঁকা দিয়েছি… নিজে দৌড়াইনি। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। বেচারা বাধ্য হলো একাই দৌড়ে পালাতে। আমি গিয়ে লুকালাম আঙিনার একটা ঝোপের পেছনে। একটু পরেই গার্ডেরা বেরিয়ে এল, ধাওয়া করল ডাক্তারকে। ওরা চোখের আড়াল হতেই উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। খানিক পরেই দূর থেকে ভেসে এল গুলির আওয়াজ। নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে ডাক্তার। বেশিদূর যে এগোতে পারিনি, সেটা বুঝলাম একটু পরেই পেছনে ফ্ল্যাশলাইটের আলো দেখে। আমাকে ধাওয়া করছিল ওরা। ছুটতে ছুটতে চলে গেলাম সাগরের ধারে। ওখানেই দেখা হলো তোমার সঙ্গে।’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল অ্যালি। এরপর বলল, ‘জানি, ডাক্তারের ভাগ্যে যা ঘটেছে, সেটা ওর প্রাপ্য ছিল। ওকে এমনিতেও হয়তো মেরে ফেলত ওরা। তবু, একটা মানুষকে ধোঁকা দিলাম… তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলাম… ভাবলেই খারাপ লাগছে আমার।’
.
খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার রাস্তায় নামল ওরা। হাইওয়ে ফিফটি এইট ধরে পশ্চিমে ঘুরল-স্যান গ্যাব্রিয়েলস্ আর বেকারফিল্ডের দিকে চলেছে। ফেলে আসা মরুভূমির দিকে রিয়ারভিউ মিররে তাকাল রানা। দিগন্তবিস্তৃত বালি ঝিকমিক করছে সকালের রোদে।
প্যাসেঞ্জার সিটে বসা অ্যালি কেঁপে উঠল হঠাৎ। রানার দিকে তাকাল। বলল, ‘স্মৃতি ফিরে আসার জন্যে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে ভাবলেই কেমন যেন লাগছে। খারাপ কোনও খবর লুকানো আছে আমার মাথায়… ভয়ঙ্কর কোনও বিপদের পূর্বাভাস। যদি মনে করতে পারতাম, সবাইকে সাবধান করে দেয়া যেত।’
ওকে যে-ড্রাগটা দেয়া হয়েছে, সেটার কথা ভাবল রানা। যে-সব জায়গায় ওগুলোর ব্যবহার দেখেছে, মনে পড়ে গেল সেখানকার কথা। ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো, ওসব অন্য কারও জীবনে ঘটেছে। সত্যি, এই ছোট্ট জীবনে যত কিছু দেখেছে ও, তা অবিশ্বাস্য। তাড়াতাড়ি মাথা ঝেড়ে দূর করল আজেবাজে ভাবনা। ড্রাগটা সম্পর্কে যা যা জানে, তার ওপর মনোযোগ দিল।
‘আরও দ্রুত তোমার স্মৃতি ফেরানোর একটা কায়দা সম্ভবত আছে,’ খানিক পর বলল ও।