ছয়
ট্রাকটার নাকের পাশে পৌছে গেছে পিকআপ, দেখতে পেল সিসকো। পেছনের কাঁচ ভেদ করে ফুটে উঠেছে রানা আর মেয়েটার অবয়ব।
‘ওরা ডানের লেইনে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব, সঙ্গীদের বলল সে। ‘এরপর বামের লেইন ধরে ওদের পাশে হাজির হব আমরা। বলামাত্র গুলি করবে।’
মাঝখানের সিটে বসা তিন খুনি ডানে ঘুরে গেল। পেছনের সিটে বসা একজন ধরল স্লাইড ডোরের হাতল, সঙ্কেত পেলেই ঝটকা দিয়ে খুলে দেবে দরজা।
সিসকোর সেলফোন বাজতে শুরু করেছে। লিয়ারির কল। ধরতে গিয়েও ধরল না সিসকো। কথা বলার সময় নেই এখন, মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। সামনে, রানাকে ডানের লেইনে চলে যেতে দেখল সে; পিকআপটা ঢাকা পড়ে গেল ট্রাকের আড়ালে। অ্যাকসেলারেটর চেপে ধরল সিসকো, তুমুল বেগে পেরোতে শুরু করল ট্রাকটাকে। পিকআপের পাশে পৌঁছুতে দশ সেকেণ্ডও লাগবে না। হাত তুলে ইশারা দিল, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল স্লাইড ডোর। উদ্দাম বাতাস ঢুকে পড়ল ভ্যানের ভেতরে। খুনিরা তাদের এমপি-ফাইভ সাবমেশিনগান উঁচু করল, সঙ্কেত পেলেই ট্রিগার চাপবে।
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল সিসকোর। ব্যাপারটা ছেলেখেলা হতে চলেছে। বেচারা মাসুদ রানা, কোত্থেকে কী হলো বোঝার সময়ই পাবে না। তার আগেই রওনা দেবে পরপারে। এই তো, তাকে ধরে ফেলেছে প্রায়। ট্রাকের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পিকআপটাকে।
হঠাৎ ভুরু কুঁচকে গেল তার। ইণ্ডিকেটর জ্বেলেছে রানা। আস্তে করে চলে এল বামের লেইনে… একেবারে ভ্যানের সামনে। কারণটা কী? সামনে আর কোনও গাড়ি নেই যে, ওভারটেক করবে। তা হলে?
‘ব্যাটা করছেটা কী!’, নিচু গলায় গাল দিয়ে উঠল সিসকো।
.
আয়নায় ভ্যান আর ট্রাকের পজিশন দেখে নিল রানা। পিকআপের ঠিক পেছনে রয়েছে ভ্যান। টেইলগেট থেকে ভ্যানের নাকের দূরত্ব মোটামুটি দশ ফুট। ট্রাকটা বামের লেইনে, আরও দশ গজ পেছনে। ঠিক এমনটাই চেয়েছিল ও। এখন টাইমিংই সব। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের ভেতর চাল দিতে হবে ওকে। তারপর যা ঘটবে, তা আর ভাবতে চাইল না।
পাশ থেকে বিড়বিড় করে কী যেন বলল অ্যালি। সিটবেল্ট টেনে শক্ত করে বাঁধল।
‘রেডি?’ ওকে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘তা হলে শুরু করা যাক।’
সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক চাপল ও—হার্ড ব্রেক। শরীরের পুরো ওজন চাপিয়ে দিল ব্রেক প্যাডালের ওপর। বিশ্রী একটা শব্দ ভেসে এল বাইরে থেকে, রাস্তার পেভমেন্টে ঘষা খাচ্ছে টায়ার। দেখা দিল ধোঁয়া। ড্যাশবোর্ডের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রানা আর অ্যালি, সিটবেল্ট বাঁধা না থাকলে নাক-মুখ ঠুকে যেত।
ভ্যানের আরোহীদের জন্যে ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিল। সামনের গাড়িটাকে থমকে যেতে দেখে আঁতকে উঠল তারা—এখুনি পিকআপের পেছনে গিয়ে বাড়ি খাবে ভ্যান। ডানে গার্ডরেইল, কিন্তু ওদিক ছাড়া আর কোনও দিকে যাবার উপায় নেই। বনবন করে ওদিকে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল সিসকো, কোনোমতে এড়াল সংঘর্ষ। আধ ইঞ্চির জন্যে ঘষা লাগল না পিকআপের গায়ে, কোনাকুনিভাবে ডানের লেইনে ঢুকে পড়ল ভ্যান। ওটার নাক নিজের জানালা বরাবর আসতে দিল রানা, পরক্ষণে ব্রেক ছেড়ে অ্যাকসেলারেটর চাপল, একই সঙ্গে ডানে ঘোরাল হুইল। ধাম করে ভ্যানের সামনের অংশে ধাক্কা দিল পিকআপ।
ব্যস, যা হবার ওতেই হয়ে গেল। সত্তর মাইল স্পিডে ছুটছিল ভ্যান, ওই অবস্থায় ধাক্কা খেয়ে বেসামাল হয়ে গেল। গিয়ে আছড়ে পড়ল ডানের গার্ডরেইলে। নাক তুবড়ে গেল, পেছনটা উঁচু হয়ে গেল, কিন্তু থামল না। প্রবল গতিবেগের কারণে কাত হয়ে গড়ান দিল কয়েকটা। ঘাড় ফিরিয়ে দুটো দেহকে বাইরে উড়ে যেতে দেখল রানা… খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়েছে—কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ল, কে জানে।
সর্বনাশের তখনও বাকি ছিল। দুর্ঘটনা দেখেই, ‘ব্রেক কষেছে ট্রাকের ড্রাইভার, কিন্তু বিশাল যন্ত্রদানব ওই অল্পখানি দূরত্বে থামতে পারল না। চাকা ঘষটাতে ঘষটাতে ক্রুদ্ধ পশুর মত ঢুস মারল গড়াতে থাকা ভ্যানের গায়ে। ফুটবলের মত ছিটকে গেল ভ্যানের পুরো কাঠামো, কয়েক গজ উড়ে গিয়ে পেভমেন্টের ওপর পড়ল, এরপর গড়াতে শুরু করল নতুন উদ্যমে। শেষে যখন থামল, গাড়ি বলে চেনা যায় না আর। লোহার একটা তালে যেন পরিণত হয়েছে। ভেতরে আটকা পড়েছে সিসকো ও তার বাকি সঙ্গীরা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ফেটে গেছে ফিউয়েল ট্যাঙ্ক… গড়ান খাবার সময় ফুলকি তুলেছিল ভ্যান, সেই ফুলকি থেকে আগুন লেগে গেছে তেলে। ধীরে ধীরে লেলিহান শিখা গ্রাস করছে ভ্যানের ধ্বংসস্তূপকে।
পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গাড়ি থামাল রানা। দরজা খুলে নেমে এল পিকআপ থেকে। উল্টো ঘুরে ভালমত দেখল দৃশ্যটা। চেসিসের ভেতরে আটকা পড়া খুনিরা জ্যান্ত কাবাব হতে শুরু করেছে। আবছা একটা আর্তনাদ ভেসে এল, তারপর সব চুপ। ট্রাক ড্রাইভারকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখল। বেচারা হয়তো ভাবছে, দুর্ঘটনার জন্যে পুলিশ তাকেই দায়ী করবে। ভ্যান থেকে ছিটকে বেরুনো মানুষদুটোকেও দেখতে পেল রানা, অ্যাসফল্টের ওপর মুখ থুবড়ে নিশ্চল পড়ে আছে। মারা গেছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। তবে বেঁচে থাকলেও লিয়ারির কাজে আসবে না আর কোনোদিন।
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে পিকআপে আবার উঠে বসল রানা। চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালি।
‘সরি,’ ওকে বলল রানা। ‘ওদেরকে ঠেকাবার আর কোনও উপায় ছিল না।
আরও কিছু বলবে ভেবেছিল, কিন্তু বলল না। ওর মনের কোনও কথাই অজানা নেই মেয়েটার। তা ছাড়া সময়ও নেই হাতে। স্যাটেলাইটের ক্যামেরায় গ্রাউণ্ড টিমের পরিণতি দেখতে পেয়েছে লিয়ারি, খুব শীঘ্রি নতুন টিম পাঠাবে… আর সেটা আকাশপথে। বাঁচতে চাইলে স্যাটেলাইটের চোখকে ফাঁকি দিতে হবে, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব, এখনও জানে না রানা। কিছু কৌশল জানা আছে ওর, সেগুলো সবই সময়সাপেক্ষ। অত সময় পাবে কি না, বলা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি গিয়ার দিয়ে পিকআপকে ছোটাতে শুরু করল। স্পিড লিমিটের পরোয়া করছে না আর।
খানিক পর ঘাড় ফেরাতেই অ্যালির চোখ ছলছল করতে দেখল ও।
‘কী হয়েছে, অ্যালি?’
তাড়াতাড়ি চোখ মুছল মেয়েটা। বলল, ‘কিছু না।’
‘তা হলে কাঁদছ কেন? আমি তো…’
‘জানি। যা করেছ, তা আমাকে বাঁচাবার জন্যে করেছ। আর কোনও বিকল্প ছিল না। কাঁদছি নিজের কারণে।’
‘চাইলে আমাকে খুলে বলতে পারো। কথা বললে মন হালকা হবে।’
একটু অপেক্ষা করল অ্যালি। তারপর বলল, ‘তুমি যখন ওদেরকে ধাক্কা দিলে, আর ওরা গিয়ে ডিভাইডারে বাড়ি খেল… ভ্যানটা তখন একদম কাছে ছিল। এত কাছে যে, আমি ওদের সবার মনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। অ্যাকসিডেন্ট হতে দেখেই ওরা বুঝে ফেলেছিল, মারা যেতে বসেছে। আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল ওদের। সাহস, শক্তি, পৌরুষ, ট্রেইনিং… ভুলে গিয়েছিল সব। মৃত্যুভয় ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না ওদের মাঝে।’
রানার দিকে ঘুরে বসল মেয়েটা।
‘জানো,’ বলল ও, ‘ওদের অবস্থা দেখে একটুও খারাপ লাগেনি আমার, বরং আনন্দ হয়েছে। মনে মনে বলেছি, মর, শয়তানেরা! এটাই তোদের প্রাপ্য! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওভাবে ভাবা ঠিক হয়নি। কেন ওদের মৃত্যু কামনা করলাম? কেন ওদেরকে মরতে দেখে আনন্দ পেলাম? কেন যেন খুব খারাপ লাগছে এখন।’
আবার চোখ মুছল অ্যালি।
‘মন খারাপ কোরো না,’ নরম গলায় বলল রানা। ‘আক্রোশের কারণে ওভাবে ভেবেছ। এর মানে এই নয় যে, তুমি মানুষটাই অমন নিষ্ঠুর। তা ছাড়া… ওদের প্রতি ঘৃণা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। ওরা তোমাকে খুন করতে চাইছিল!’
‘তাও… নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার।’ আবার সিটে পা তুলে হাঁটুতে থুতনি রাখল অ্যালি। ‘দুঃখিত, এবার বোধহয় আমার বকবকানি থামানো উচিত। চিন্তা-ভাবনার জন্যে সময় দরকার তোমার।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ,’ ড্রাইভিঙে মনোযোগ দিল রানা।