বারো
টিফানি ক্যানট্রেল যখন অ্যামারিলোর চিলড্রেন’স্ মেডিক্যাল সেন্টারে পৌছুল, তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। এন্ট্রান্সের চওড়া পোর্চের তলায় গাড়ি থামতেই ঝটপট নেমে গেল ওর দুই সঙ্গী, পজিশন নিল সামনে ও পেছনে। গাড়ির ভেতর থেকে ভালমত দেখা যাচ্ছে না লোকদুটোকে, তবে টিফানি জানে ওরা কী করছে। সতর্ক চোখে নজর বুলাচ্ছে চারপাশে, হাত ঘোরাফেরা করছে কোটের তলার হোলস্টারে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের আশপাশে, যে-কোনও বিপদ মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। সশস্ত্র দুই দেহরক্ষীর আচরণ যেন ওর মনের ভেতরে দানা বাঁধা উদ্বেগের প্রতিমূর্তি।
খানিক পর গাড়ির ছাদে আঙুলের টোকা দিল এক দেহরক্ষী। সঙ্কেত পেয়ে ইগনিশন বন্ধ করল ড্রাইভার। টিফানিকে বলল, ‘ক্লিয়ার।’
এ-ই হয়ে আসছে সবসময়—পুরোটাই যেন ছকে বাঁধা এক নাটক। দরজা খুলে ধরল এক দেহরক্ষী, গাড়ি থেকে নামল টিফানি। হাঁটতে শুরু করল ও, কয়েক কদম তফাতে ওকে অনুসরণ করল তারা। তবে ভেতরে ঢুকল না। টিফানি হাসপাতালে ঢুকে গেলে দরজার বাইরে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় টিফানি, দুই দেহরক্ষীর সঙ্গে সমস্ত উদ্বেগও রয়ে যাচ্ছে বাইরে। অনেকটা ওভারকোটের মত, বাড়িতে ঢোকার সময় যেন ঝুলিয়ে রাখছে দরজার পাশে, ফেরার আগে ও-নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে চিন্তাটা কাজে দেয় বেশ।
লিফটে চেপে ষাট সেকেণ্ডের মাথায় পাঁচতলায় উঠে এল ও। বড় বড় হরফে একটা সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে ওখানে অঙ্কোলজি।
সরাসরি নিজের অফিসে গেল না টিফানি, রিসেপশনে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত নার্সের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল, এরপর নর্থ উইঙের হলওয়ে পেরিয়ে ডানপাশের তৃতীয় দরজার সামনে পৌছুল। দরজার পাল্লা হাট করে খোলা। কামরার ভেতরটা কোমল আলোয় আলোকিত। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চৌকাঠে টোকা দিল ও।
দশ ফুট দূরে, ল্যাপটপ কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলছে লিলি মিলার। শব্দ শুনে মুখ তুলল মেয়েটা, ঝলমল করে উঠল চোখের তারা।
‘হাই, টিফানি!’
খসখসে, শিশুতোষ গলা। আনাড়ি কোনও মেয়ে সপ্তাহখানেক ধরে ক্রমাগত সঙ্গীতসাধনা করলে যেমনটা হয়। বাস্তবে অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। সত্যি বলতে কী, গান শেখার জন্যে যতটা বড় হতে হবে লিলিকে, ততদিন সে বাঁচবে কি না, তারই ঠিক নেই। চিন্তাটা তাড়াতাড়ি মাথা থেকে দূর করল টিফানি। এগিয়ে গেল বিছানার দিকে, ঝুঁকে চুমো খেল মেয়েটার কপালে। গোলাপি রঙের একটা মাঙ্কি ক্যাপ পরে আছে লিলি, চুলহীন মাথা গরম রাখার জন্যে।
‘আজ কেমন আছ?’ জিজ্ঞেস করল টিফানি।
জোর করে একটু হাসল লিলি। বলল, ‘আগের মতই। মনে হলো ওকে খুশি করার জন্যে বলল কথাটা। মেয়েটার কণ্ঠ আর চেহারায় মিশে আছে অব্যক্ত বেদনা। পাল্টা হাসল টিফানি। বলল, ‘আগের চেয়ে খারাপ নেই, এটাও কিন্তু কম না। কী বলো?’
মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর একবার বলেছিলেন, রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠিক নয়, ওটা নার্সদের কাজ। ইন্টার্নির সময় টিফানির সুপারভাইজারও একই উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গত সাত বছরের ডাক্তারি জীবনে একবারও সে-উপদেশ মানেনি ও।
ভিডিও গেম নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লিলি। গেমের নামটা মনে নেই টিফানির, তবে কীভাবে খেলতে হয়, তা জানে। থ্রি-ডি গেম… ওতে রয়েছে ঘাস, মাটি, বালি আর পাথরের অসংখ্য কিউব। খেলোয়াড়কে সেসব কিউব সাজিয়ে নির্দিষ্ট কোনও বস্তু বা স্থাপনা তৈরি করতে হয়। ক’দিন থেকে কিউব সাজিয়ে মিশরের গিযা মালভূমির একটা মডেল বানাচ্ছে লিলি। চেষ্টা করছে তিনটা বড় পিরামিড আর স্ফিংক্সের প্রতিকৃতি তৈরি করতে। কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ। একদিক থেকে ভাল সময় কাটছে ওর, ব্যস্তও থাকছে।
‘নিল ডি’গ্রাসি টাইসনের একটা নতুন ভিডিও পেয়েছি ইউটিউবে,’ স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বলল লিলি। ‘বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা-র ওপর একটা বক্তৃতা। ওটার পুরোটাই নাকি বরফে মোড়া, আবার বরফের নিচে বইছে তরল পানি। সেখানে প্রাণ থাকতে পারে।’
হাসপাতালে আসার আগে থেকেই অ্যাস্ট্রোনমির প্রতি ঝোঁক মেয়েটার, সিক্সথ গ্রেডে পড়ুয়া একটা বাচ্চার জন্যে সেটা বেশ অস্বাভাবিকই বলা চলে। ইন্টারনেটে নিজের একটা ব্লগ খুলেছে সে, ওখানে রয়েছে গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক নানা ধরনের তথ্য। নিউ ইয়র্কের হেইডেন প্ল্যানেটেরিয়ামে বেড়াতে গিয়েছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে—সেখানকার ছবি রয়েছে। রয়েছে অ্যারিজোনার কিট পিক অবজারভেটরিতে বেড়ানোর ছবি। বাড়ির ছাতে শুয়ে রাতের আকাশের তারা দেখতে পছন্দ করত ও, হাসপাতালে সে-সুযোগ নেই বলে মাঝে মাঝেই হতাশা প্রকাশ করে।
মৃদু শব্দ হলো টিফানির সেলফোনে এসএমএসের সঙ্কেত। ফোন তুলে চেক করল মেসেজটা। ক্যারেনের মেসেজ।
‘ল্যাব থেকে লিলির নতুন ডেটা পাঠিয়েছে। আমরা যা আশা করেছিলাম, তার সঙ্গে মিল নেই।’
চেহারায় দুশ্চিন্তা ফুটতে দিল না টিফানি, নির্বিকার রইল। লিলিকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হতেই চোখাচোখি হলো মেয়েটার সঙ্গে—একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অজান্তেই কেঁপে উঠল টিফানি। মনের কথা পড়ার ক্ষমতা নেই লিলির, তারপরেও ওর তাকানোর ভঙ্গিটা মনে করিয়ে দিয়েছে একটা পুরনো স্মৃতি।
‘কী হলো?’ উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল লিলি।
‘কিছু না,’ সংবিৎ ফিরে পেল টিফানি। ‘অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।’
হাসল লিলি। ‘ডাক্তারদের অন্যমনস্ক হয়ে পড়া ঠিক না। তোমাদের অনেক দায়িত্ব।’
‘সেজন্যেই তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘোরাফেরা করে।’
লিলির কপালে আরেকবার চুমো খেল টিফানি। তারপর বেরিয়ে এল ওখান থেকে।
দু’মিনিটের মাথায় নিজের অফিসে পৌঁছুল ও। কম্পিউটার অন করে ল্যাব থেকে পাঠানো রিপোর্টে চোখ বোলাল। তারপর উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। ওপাশে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে টেক্সাসের বিস্তীর্ণ সমভূমি। জানালার কাঁচে মাথা ঠেকাল ও। নিচে, দেহরক্ষীদের একজনকে পোর্চের তলা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। দু’পাশের রাস্তার ওপর সতর্ক নজর বোলাল, এরপর আবার ফিরে গেল পোর্চের তলায়। নিয়মিত টহল দিয়ে চলেছে সে ও তার সঙ্গী।
চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল টিফানি। চোখ মুদল। নৈঃশব্দ্য যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে আনছে সমস্ত পুরনো স্মৃতি। আজকাল এ-ই ঘটছে—সামান্যতম ফুরসৎ পেলেই ফিরে আসছে স্মৃতিগুলো। ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, কোথায় ভুল করেছিল… কোথায় সঠিক চাল দিলে সব এড়িয়ে যেতে পারত।
চোখের পাতাদুটো শক্ত করল ও। চাপ পড়ল মণিতে। দেখা দিল লাল-নীল ফুটকি। মনোযোগ ফেরানোর একটা পুরনো কৌশল। তাড়াতে চায় অনুশোচনা নামের দানবটাকে, যেটা সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে ওকে… যখন-তখন বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খামচে ধরছে হৃৎপিণ্ড।
‘অ্যালি!’ চেতনায় অনুরণন তোলা নামটা ফিসফিসিয়ে উঠল টিফানি। মুখ ঢাকল দু’হাতে।