অন্তর্যামী – ১

এক

মাঝে মাঝে অদ্ভুত এক বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয় মাসুদ রানা। কোনও অ্যাসাইনমেণ্ট শেষ হলে যখন ক’টা দিন ছুটি পেয়ে অলস সময় কাটায়, কিংবা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়; মাথায় তখন ভিড় করে আসে কত কথা, কত স্মৃতি। চুলচেরা হিসেব করতে গিয়ে হতাশায় ভারাক্রান্ত হয় ও, কোনও কিছুরই অর্থ বোঝা যায় না—কী পেল, কী হারাল সবই ঘোলাটে লাগে। আর দশজন মানুষের মত নিরুপদ্রব একটা জীবন, আর সাজানো-গোছানো ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন তো ও-ও দেখেছে। কিন্তু তা আর হলো কই? দেশ সেবার নেশায় কোথায় ভেসে গেছে সব স্বপ্ন! কত কিছু যে বিসর্জন দিতে হয়েছে ওকে, হারাতে হয়েছে কত শত প্রিয় বন্ধু, আপনজনকে। সে সব মনে হলে অসহ্য বেদনায় দিশেহারা বোধ করে ও।

এখন তেমনই একটা পর্ব চলছে।

শেষ মিশনটায় মরতে বসেছিল ও, দীর্ঘদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয়েছে। অবশেষে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও ডাক্তার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, মানসিক ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্যে হাওয়া বদল করতে হবে। সব ধরনের কাজকর্মে বিরতি দিয়ে অন্তত মাসদুয়েক নির্জন, নির্মল, শান্ত পরিবেশে নিতে হবে পূর্ণ বিশ্রাম। এড়িয়ে চলতে হবে অন্তর্যামী পরিচিত মানুষের সঙ্গ। অগত্যা প্রশান্ত মহাসাগরের পারে, ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট শহর এল সেডেরো-র এক হলিডে রিসোর্টে এসে উঠেছে ও। লস অ্যাঞ্জেলেসের এক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল ওর, ছাড়া পাবার পর দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে হয়নি। তা ছাড়া মেডিকেল চেকআপের জন্যে প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দূর থেকে বার বার আসা-যাওয়া কঠিন। অগত্যা এল সেডেরোই ভরসা।

রিসোর্টে আজ রানার সতেরোতম দিন। রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে। শরীর পুরোপুরি সুস্থ, এ-অবস্থায় কাঁহাতক আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়? দিনভর বইপত্র পড়া, ঘুরে বেড়ানো আর অল্প-স্বল্প ইনডোর গেমস্ ছাড়া করবার কিছু নেই। ফলে, হাতে অফুরান অলস সময়। যথারীতি মাথায় ভিড় জমাচ্ছে নানান রকম চিন্তা। আরও বিষণ্ন হয়ে পড়ছে ও।

রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। ঘড়ি যখন তিনটে বাজার সঙ্কেত দিল, দুত্তোর বলে উঠে পড়ল ও। অযথা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করার কোনও মানে হয় না। জামাকাপড় পরে বেরিয়ে পড়ল রানা কটেজ থেকে। জগিং করতে শুরু করল সাগরপারের বোর্ডওয়াকে, খোলা বাতাসে মাথাটা পরিষ্কার করে নেবার ইচ্ছে।

হিম হিম কুয়াশা জড়িয়ে ধরল রানাকে, বামে ঘোলাটে দেখাচ্ছে শহরের আলো, ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে—যেন কুয়াশা কেটে ভেসে চলেছে একটা জাহাজ। ডানে প্রশান্ত মহাসাগর—কালচে দেখাচ্ছে পানি, ঢেউ আছড়ে পড়ছে বিরান সৈকতে। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই কোথাও, নিথর হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। বোর্ডওয়াকের পুরনো কাঠের পাটাতন মচমচ করছে রানার প্রতিটি পদক্ষেপে, এ ছাড়া কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।

দৌড়াতে দৌড়াতে বোর্ডওয়াকের একটা ইন্টারসেকশনে পৌছুল ও। সৈকত ঘেঁষে এগিয়েছে একটা শাখা, অন্যটা চলে গেছে মেইন রোডের দিকে। এখান থেকে রাস্তাটা মাইলখানেক দূরে। গতি কমাতে কমাতে থেমে গেল রানা। জায়গাটায় পৌঁছুলে প্রতিবারই থামে। কেন, তা বলতে পারবে না। ইন্টারসেকশনটা একেবারে নির্জন, একটু বেশিই ছায়ায় ঢাকা। হয়তো বা সেই শূন্যতাই আকৃষ্ট করে ওকে।

কাঠের রেলিঙে কনুই রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল রানা, সাগরের দিকে মুখ। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলে শুনতে পেল নানা ধরনের চাপা শব্দ—বালিয়াড়ির ওপারে রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণ, ঝোপঝাড়ে সরীসৃপের নড়াচড়া, ঢেউয়ের চাপা গর্জন। কয়েক মিনিট পেরোলে নতুন আরেকটা আওয়াজ এল কানে। পায়ের শব্দ… বোর্ডওয়াকের ওপর দিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে কেউ।

আরেকজন জগার? এক মুহূর্তের মাথায় বুঝল, না, তা নয়। বড় দ্রুত ফেলছে পা, যেন প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে মানুষটা। কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা সংকুচিত, ভারী বাতাসে পদশব্দও ভোঁতা শোনাচ্ছে। বোঝা মুশকিল, কোন্‌দিক থেকে আসছে শব্দটা। ডানে-বাঁয়ে ইতি-উতি তাকাল রানা, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। উল্টো ঘুরতেই ইনল্যাণ্ডের দিকে চলে যাওয়া শাখাটা ধরে একটা ছায়ামূর্তি উড়ে চলে এল ওর দিকে, আছড়ে পড়ল বুকে।

আঁতকে ওঠার আওয়াজ শুনল রানা—অল্পবয়েসী মেয়ের কণ্ঠ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল রানা। পরক্ষণে টের পেল, ওর আলিঙ্গনের ভেতর যুদ্ধ করছে মেয়েটা। মোচড়ামুচড়ি করে ছাড়া পেতে চাইছে। ফাঁদে পড়া প্রাণীর মত আচরণ।

‘শান্ত হও,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। কী হয়েছে?’

লড়াই থামাল মেয়েটা। মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। আতঙ্কে সাদা হয়ে আছে চেহারা। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেল রানার। মেয়েটার সঙ্গে লুবনার চেহারার অদ্ভুত মিল! লুবনা আভান্তি—ইটালিয়ান সেই মিষ্টি কিশোরী… রানাকে একটা গান উপহার দিয়েছিল, ওকে নতুন করে জীবনের অর্থ শিখিয়েছিল। ওকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল রানা, বাঁচাতে পারেনি মানুষরূপী একদল পশুর হাত থেকে। এখনও সে-ব্যর্থতার কষ্টে ক্ষত-বিক্ষত হয় ও। কয়েক ঘণ্টা আগেও বিছানায় নির্ঘুম শুয়ে লুবনার কথা ভাবছিল রানা… এটা কি তবে ভাগ্যের পরিহাস, নাকি নিছক কাকতালীয় ঘটনা যে, লুবনার মত দেখতে একটি মেয়ে ওর সামনে এসে হাজির হয়েছে?

মেয়েটাকে খুঁটিয়ে দেখল রানা। বয়স বারো-তেরোর বেশি হবে না। পরনে জিন্স আর টি-শার্ট। গোলগাল মুখ, চেহারায় রাজ্যের সরলতা। মাথার ঘন কালো কেশ এলোমেলো হয়ে আছে, আয়তাকার চোখদুটোয় বাসা বেঁধেছে ভয়। দৃষ্টি দিয়ে মাপল রানাকে, তারপরেই তার আড়ষ্ট ভঙ্গিটা শিথিল হলো। এখনও আতঙ্কিত, তবে রানার কারণে নয়। ছাড়া পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পেছনে। রানাও তাকাল, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু দেখল না। বোর্ডওয়াক ওদিকে হারবার রোডে গিয়ে মিশেছে, দু’পাশে উঁচু বালিয়াড়ি আর ঝোপঝাড়—কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে রয়েছে। সব শান্ত, চুপচাপ।

‘তুমি এদিকেই থাকো?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।

জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল রানা, ‘কে ধাওয়া করছে তোমাকে?’

‘সব বলব, তবে এখন না।’ আকুতি ফুটল মেয়েটির কণ্ঠে। ‘প্লিজ, আমাকে নিয়ে চলো এখান থেকে। কোথাও লুকাতে হবে আমাকে!’

‘তোমাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু…’

‘না-আ!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটি। ‘পুলিশের কাছে না।’

ভ্রূকুটি করল রানা। বুঝতে পারছে, বাজে ধরনের একটা ঝামেলা উদয় হয়েছে সামনে। ঝামেলাটা এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু মনের সায় পেল না।

রানাকে দ্বিধা করতে দেখে এগিয়ে এল মেয়েটি, চেপে ধরল ওর হাত। দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে অনুনয়। ‘ আমি পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে আসিনি। বিশ্বাস করো, ব্যাপারটা সে-রকম নয়।’

ঝট করে আবার পেছনে তাকাল সে। রানা চোখের কোণেও ধরা পড়েছে কীসের যেন আভাস। ও-ও তাকাল। এতক্ষণ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে ছিল বালিয়াড়ির সারি, কিন্তু এখন ওগুলোর পেছন থেকে ভেসে আসছে আবছা আলোর আভা।

কেঁপে উঠল মেয়েটা। বলল, ‘কী করবে, বলো। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’

ওর কণ্ঠে মেশা আতঙ্কটা পরিষ্কার টের পেল রানা। ছোটখাট বিপদ নয়, এই মেয়ে প্রাণভয়ে ভীত।

আবারও বালিয়াড়ির দিকে তাকাল রানা। আলোর আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো! বালিয়াড়ির ওপাশ থেকে উঠে আসছে কারা যেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল… রানা বুঝল, মিথ্যে বলছে না এই মেয়ে, সত্যিই বড় ধরনের বিপদে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত লাগল না, কারণ অসহায় একটা মেয়েকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। নাক গলাতেই হচ্ছে।

মেয়েটির হাত ধরল রানা। বলল, ‘এসো।’

বোর্ডওয়াক ধরে ছুটতে শুরু করল দু’জনে, রিসোর্টের দিকে চলেছে। দৌড়াবার গতি সামান্য কমাতে হলো রানাকে, মেয়েটা যেন ওর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। দৌড়ের ফাঁকে বালিয়াড়ির দিকে একটা চোখ রাখল ও। পঞ্চাশ গজ যেতে না যেতেই ফ্ল্যাশলাইটের তীক্ষ্ণ এক শিখা দেখতে পেল, রিজের ওপরে উঠে এসেছে। কয়েক সেকেণ্ডের মাঝে ওটার সঙ্গে যোগ দিল আরও তিনটে। খুব বেশি দূরে নয় লোকগুলো।

ঠিক সামনেই একটা ওভারহেড মারকারি লাইট। থেমে গেল রানা, টান দিয়ে থামাল সঙ্গিনীকে।

‘কী হলো, থামলে কেন?’ ভয়ার্ত গলায় বলল মেয়েটা। লাইটটার দিকে ইশারা করল রানা। ‘বাতির তলা দিয়ে গেলে ওরা আমাদেরকে দেখে ফেলবে।’

‘তাই বলে এখানে দাঁড়িয়েও তো থাকা যায় না।’

পেছনটা দেখল রানা। দলে আরও ভারী হয়েছে ধাওয়াকারীরা। মোট ছ’টা ফ্ল্যাশলাইটের আলো নাচানাচি করে নেমে আসছে ঢাল বেয়ে। মাথা ঘুরিয়ে রেলিঙের ওপর দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল এবার। কয়েক ফুট নিচে সৈকত—যাবার মত জায়গা এখন ওই একটাই।

নিজের অজান্তে ইশারা দিয়েছে কি না জানে না, মেয়েটাকে রেলিঙের তলা গলে নেমে যেতে দেখল রানা। নিজেও পিছু নিল। নিচে বিছিয়ে রাখা পাথরসারির ওপর নেমে এল দু’জনে। সামনে বালিময় সৈকত, ত্রিশ গজ দূরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। সৈকতের বালি ভেজা, মসৃণ। নামলেই পায়ের ছাপ পড়বে, ধাওয়াকারীরা অনুসরণ করতে পারবে ওদেরকে।

কজওয়ের নিচে বিছানো পাথরগুলোর দিকে নজর দিল রানা, কিন্তু ভরসা রাখতে পারল না। সমান করে বিছানো হয়নি পাথর—উঁচু-নিচু, নড়বড়ে… ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে বলে ঠিকমত দেখাও যাচ্ছে না। বেকায়দা পা পড়লে গোড়ালি মচকে যাবে নির্ঘাত। বাধা হিসেবে আরও আছে একের পর এক সাপোর্ট বিম। দশ ফুট অন্তর অন্তর কজওয়ের পিলারগুলোর মাঝে ক্রসের মত করে বসানো হয়েছে ওগুলো, পুরো কাঠামোকে মজবুত করার জন্যে। বোঝা যাচ্ছে, পাথরের ওপর দিয়ে, সাপোর্ট বিম টপকে এগোনোর চেষ্টা বৃথা। দশ গজ যাবার আগেই ওদের ঘাড়ের ওপর এসে যাবে শত্রুরা।

মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিল রানা। বালিয়াড়ি থেকে নেমে এসেছে লোকগুলো, বোর্ডওয়াকে উঠবে এক্ষুনি। হাতে সময় আছে বড়জোর ত্রিশ সেকেণ্ড। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে কজওয়ের তলায় নজর বোলাল। মোটা মোটা কাঠের পিলারের ওপর বসানো হয়েছে পুরো কাঠামো। সেটা দেখতে অনেকটা শুইয়ে রাখা একটা মইয়ের মত-দু’পাশে লম্বা লম্বা বিম, মাঝে মইয়ের ধাপের মত আড়াআড়ি ছোট বিম। কাঠের পাটাতন বসানো হয়েছে লম্বা বিমগুলোর ওপর। ছোট বিম আর পাটাতনের মাঝে কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা রয়েছে—কোনও মানুষের জায়গা হবে না, তবে হাত-পা ঢোকানো যাবে।

মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল ও। বলল, ‘শক্ত করে ধরো।’

মাথা ঝাঁকিয়ে দু’পায়ে রানার কোমর জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরল গলা। ওকে নিয়ে কজওয়ের তলায় ঢুকে গেল রানা, লাফ দিয়ে একটা ছোট বিম ধরল, এরপর কসরৎ করে পা-দুটো তুলে গুঁজল আরেকটা বিমের ফাঁকে। হ্যামকের মত একটা আকৃতি পেল ওর দেহ—দুটো বিমের মাঝে ধনুকের মত ঝুলছে, তার ওপর উপুড় হয়ে আছে মেয়েটা।

কয়েক মুহূর্ত যেতেই রানা টের পেল, পজিশনটা মোটেই জুৎসই হয়নি। মোটা বিমটা মুঠো করে ধরা যাচ্ছে না, পুরো ভার পড়েছে আঙুলের ওপর। হাতের পেশিতে যেন আগুন ধরে গেছে। শরীর সোজা রাখতেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। দ্রুততর হয়ে গেল শ্বাস-প্রশ্বাস।

ওর কানের কাছে মুখ নিল মেয়েটা। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শব্দ কোরো না। ওদের কাছে বন্দুক আছে… আমাদেরকে খুন করে ফেলবে।’

ক্ষণকাল পরেই পাটাতনের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা গেল ফ্ল্যাশলাইটের আলো। বোর্ডওয়াকে উঠে এসেছে লোকগুলো, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করছে। কানে ভেসে এল তাদের পায়ের আওয়াজ।

একটা কণ্ঠ শোনা গেল। রুক্ষ, ভারী কণ্ঠ—আদেশ দিতে অভ্যস্ত।

‘সৈকতে সার্চ করো। কজওয়ের নিচেও দেখবে।’

ধুপধাপ শব্দ তুলে কয়েকজন নেমে এল নিচে। চোখের কোণে ফ্ল্যাশলাইটের আভা দেখল রানা, সার্চলাইটের মত সৈকতের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল মেয়েটা, মুখ গুঁজল বুকে। হাতের পেশির জ্বালাপোড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুণ, তবে সেটা মূল সমস্যা নয়। শারীরিক যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করবার অসংখ্য কায়দা জানা আছে রানার, সবক’টাই খাটাচ্ছে এখন। কিন্তু এভাবে অনন্তকাল চলতে পারে না। খুব শীঘ্রি হার মানবে ওর দেহ, মনের জোর দিয়ে হাতের মুঠো আটকে রাখা যায় না।

ঝুঁকি নিয়ে মাথা একটু কাত করল রানা। সৈকত দেখা শেষ হয়েছে লোকগুলোর। ফ্ল্যাশলাইটের আলো এবার ঘুরে যাচ্ছে এদিকে। আলো ফেলে কজওয়ের তলা দেখতে শুরু করল ওরা। মাথা সোজা করে ফেলল ও, যাতে আলোর আভায় চোখের মণি চকচক করে না ওঠে। ওদের ঠিক তলা দিয়ে ঘুরে গেল আলোকরশ্মি… কপাল ভাল যে, তলার পাথরের ওপর ফেলা হয়েছে আলো, দু-তিন ফুট উঁচু করলেই দেখে ফেলত ওদেরকে। এখনও সে-ভয় কাটেনি, দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকল রানা, এই বুঝি কেউ চেঁচিয়ে ওঠে ওদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে।

চেঁচাল না কেউ।

তার বদলে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল ফ্ল্যাশলাইটের আলো। অন্ধকার আবার গ্রাস করল ওদেরকে। মাথা ঘুরিয়ে শত্রুদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল রানা। উত্তরদিকে সরে গেছে লোকগুলো—বোর্ডওয়াকের উপর-নিচ দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। আর অপেক্ষা করা চলে না, এখুনি নেমে পড়ে অন্যদিকে পালানোর চেষ্টা করা উচিত। যত দেরি করবে, ততই বাড়বে হাত-পায়ের বাঁধন খসে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা। শব্দ শুনে ছুটে আসবে লোকগুলো।

ধীরে ধীরে বিমের ফাঁক থেকে একটা পা বের করতে শুরু করল রানা, কিন্তু পরমুহূর্তে একটা শব্দ শুনে স্থির হয়ে গেল। পদশব্দ… দক্ষিণ দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একজন মানুষ। একেবারে রানার মাথার ওপরে এসে থামল। পাটাতনের ফাঁক দিয়ে ঝুর ঝুর করে ওর মুখে খসে পড়ল কিছু বালি।

‘শ্যাভেজ! শুনে যাও!’ ডাকল লোকটা। ভারী কণ্ঠ—এ-ই লোকগুলোর লিডার। বাকিদের তল্লাশিতে পাঠিয়ে নিজে রয়ে গেছে বোর্ডওয়াকে।

সৈকত থেকে একজন উল্টো ঘুরল। ছুটে এল লিডারের কাছে। বালির ওপর নাচানাচি করছে তার ফ্ল্যাশলাইটের আলো। কজওয়ের কিনারে এসে থামল সে, মাথা উঁচু করে তাকাল লিডারের দিকে। দম বন্ধ হয়ে এল রানার, একটু নিচু হলেই ওদেরকে দেখে ফেলবে লোকটা। লিডারের চোখ যেন ধাঁধিয়ে না যায়, সেজন্যে ফ্ল্যাশলাইট নিভিয়ে দিয়েছে, নইলে সত্যি সত্যি দেখে ফেলত।

দেহের অবয়ব ছাড়া শ্যাভেজ নামের লোকটার চেহারার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না রানা। সাগর আর আকাশের পটভূমিতে সে স্রেফ একটা ছায়ামূর্তি। ছিপছিপে দেহ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পরনে গাঢ় রঙের পোশাক। কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপে একটা আগ্নেয়াস্ত্র ঝুলছে—আকৃতি দেখে আন্দাজ করল রানা, এমপি-ফাইভ সাবমেশিনগান… ব্যারেলের ডগায় লাগানো হয়েছে হেভি সাউণ্ড সাপ্রেসর।

ওপরে, বোর্ডওয়াক থেকে কথা বলল লিডার। ‘ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভ্যানে ফিরে যাও, বিশ মাইল রেডিয়াসে সব ধরনের পুলিশ চ্যানেল মনিটর করতে শুরু করো। ড্যানবারকে বলবে, এলাকায় যত পুলিশ অফিসার আর ফেডারেল এজেন্ট আছে, সবার পার্সোনাল ফোনে আড়ি পাততে। ওদের কথাবার্তার মাঝে যদি অল্পবয়েসী মেয়ে, কিডন্যাপিং বা সাইক ওয়ার্ড জাতীয় কোনও কথা শোনা যায়, তা হলে ডিটেইলস্ সংগ্রহ করতে হবে।’

‘সাইক ওয়ার্ড?’ দ্বিধা করল শ্যাভেজ। ‘তোমার কি ধারণা, মেয়েটার কথা শুনে ওকে মানসিক রোগী মনে হতে পারে?’

হঠাৎ আঁতকে উঠল রানা, হাতের আঙুলগুলো পিছলাতে শুরু করেছে… বিমটা ধরে থাকতে পারছে না ও!

‘সম্ভাবনা আছে,’ বলল লিডার।

মরিয়া হয়ে উঠল রানা, আঙুল দিয়ে খামচাতে চাইল কাঠের বিম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

‘আর আমরা যদি ওকে খুঁজে না পাই?’ জিজ্ঞেস করল শ্যাভেজ।

এক সেকেণ্ড চুপ করে রইল লিডার। তারপর বলল, ‘তা হলে ওর বদলে আমাদেরকেই কবরে যেতে হবে।’

হাল ছেড়ে দিল রানা। পড়ে যাচ্ছে, ঠেকাবার উপায় নেই। পড়ার পর এক লাফে উঠে দাঁড়াতে পারবে কি না, সেটা ভাবছে এখন। চমক সামলে ওঠার আগেই শ্যাভেজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে হয়তো কিছু করা সম্ভব। নাহ্, তাও লাভ নেই। বোর্ডওয়াকের ওপর লিডার দাঁড়িয়ে আছে, সে-ও নির্ঘাত সশস্ত্র। অথচ রানার কাছে কিচ্ছু নেই। অসহায়ভাবে গুলি খেয়ে মরতে হবে ওকে।

আচমকা নড়ে উঠল মেয়েটা। ওর শরীরের ওপর উঁচু হলো, তারপর হাত বাড়িয়ে বিমের ওপর দিয়ে চেপে ধরল রানার হাত। সামান্য ওটুকু চাপেই কাজ হয়ে গেল, পিছলানো বন্ধ হয়ে গেল আঙুলগুলোর। বিস্মিত হলো রানা—মেয়েটা বুঝল কী করে?

কথা শেষ হয়েছে শ্যাভেজের। ফ্ল্যাশলাইট কোমরে গুঁজে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল বোর্ডওয়াকে। যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে তার চলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নড়ল না লিডার। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়, তীক্ষ্ণ চোখে দৃষ্টি বোলাল পুরো সৈকতে। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরল সে। হাঁটতে শুরু করল উত্তর দিকে। তল্লাশিরত সঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দেবে।

লোকটার পদশব্দ ক্ষীণ হয়ে এলে নিচে নামল রানা। মেয়েটাকে কোল থেকে নামিয়ে পিলারে ঠেস দিল। হাঁপাচ্ছে, কাঁপছে সারা শরীর। আড়ষ্ট পেশিগুলোয় যেন আগুন ধরে গেছে, ধীরে ধীরে সাড়া ফিরছে হাতে-পায়ে। মেয়েটাকে উঁকি-ঝুঁকি দিতে দেখে নিজেও তাকাল। শত্রুরা একশো গজ দূরে সরে গেছে।

‘ধন্যবাদ,’ ভাঙা গলায় বলল মেয়েটা। গলার আওয়াজ শুনে মনে হলো, কাঁদছে। ‘অনেক উপকার করলে তুমি আমার।’

এক গাদা প্রশ্ন জমা হয়েছে রানার মনে, তবে সেগুলো পরে জিজ্ঞেস করা যাবে। ঘুরে সৈকতের উল্টো পাশটায় নজর বোলাল—নিরাপদে সরে যাবার পথ খুঁজছে। বোর্ডওয়াক আর হারবার রোডের মাঝখানটা যথেষ্ট অন্ধকার, গা-ঢাকা দিয়ে উঠে পড়তে পারবে রাস্তায়। এরপর ঘুরপথে রিসোর্টে ফিরতে খুব একটা অসুবিধে হবার কথা নয়। ওর কটেজটা এখান থেকে মাত্র আধমাইল দূরে।

‘এসো আমার সঙ্গে, মেয়েটাকে বলল ও। এরপর দু’জনে এক ছুটে ঢুকে পড়ল বালিয়াড়ির গোড়ার ঘাস আর ঝোপঝাড়ের মাঝে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *