1 of 2

অন্তরাল – কালীকিঙ্কর কর্মকার

অন্তরাল – কালীকিঙ্কর কর্মকার

কল্পনা করুন একটি যুবককে। বয়েস ছাব্বিশ কি সাতাশ। লম্বায় পাঁচ ফুট দশ-এগারো ইঞ্চি। মুখটা গোলগাল নয়, অনেকটা নিরাশ রাজনীতিবিদদের মতো, কাঠখোট্টা, গালের চোয়ালগুলো উঁচু। মাঝারি সাইজের নাকের নীচে মাঝারি সাইজের টুথব্রাশের মতো একজোড়া গোঁফ। ওই বয়েসের মানুষের যে-পরিমাণ দাড়ি থাকা উচিত, তার তুলনায় অনেক কম দাড়ি—বেশিরভাগই সীমিত কানের পাশে আর থুতনিতে। চেহারাটা তার কোনও চিত্রতারকার মতো নয়, অথচ তার স্বাস্থ্যটা যে একেবারেই একটা তাচ্ছিল্যের তা-ও বলতে পারি না।

তাকে সবরকম পোশাকেই মানায়। কখনও সে যদি চোস্ত ড্রেন-পাইপ প্যান্ট আর চকরাবকরা হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে, সাদা নাগরাই পায়ে, চোখে গগলস লাগিয়ে, হাতে লোহার বালা পরে, ঠোঁটে চার্মিনার ঝুলিয়ে কোনও সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আর, সেদিনটা যদি শনিবার হয় এবং আপনার যদি ওই সিনেমাটা দেখার খুব ইচ্ছে থাকে, কিন্তু আপনি যদি দেখেন যে, সামনের কাউন্টারে কোনও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আপনি হয়তো ওরই কাছে এগিয়ে যাবেন। আর, গলার স্বরটা যতটা সম্ভব নিচু করে জিগ্যেস করবেন, ‘দাদা, টিকিট আছে?’

আবার কখনও আপনি যদি অফিস-ফেরতা ধর্মতলা স্ট্রিটের ‘অন্নপূর্ণা’তে যান এককাপ চা খাওয়ার জন্যে এবং সেখানে যদি তাকে দেখেন আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, সাদা পাজামা পরে, পায়ে কোলাপুরী চটি লাগিয়ে, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল শোভিত বেশে মনোযোগ সহকারে কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ছে এককাপ ঠান্ডা চা সামনে রেখে, তাহলে আপনি ধারণা করবেন যে, সে একজন আধুনিক উঠতি কবি। আপনি হয়তো মনে করবেন, তাকে ভবিষ্যতে আপনার পাড়ার সংস্কৃতি সম্মেলনে আনতে পারলে আপনার সম্পাদকের পদটি আরও কিছুদিন টিঁকে থাকবে। তাই তার আঙুলের ফাঁকে-রাখা সিগারেটের মাথায় কোনওরকমে লেগে-থাকা ইঞ্চিখানেক ছাইয়ের ডগাটা দেখে আপনি হয়তো এগিয়ে গিয়ে তার টেবিলে বসবেন, আর, একটা সিগারেট বের করে তাকে জিগ্যেস করবেন, ‘দাদা, একটু আগুনটা দেবেন?’

আবার এমনও হতে পারে যে, ও হয়তো সকালে একটি ধুতি পরে, গলায় পৈতে লাগিয়ে, খালি গায়ে, খালি পায়ে, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে, হাতে একসাজি ফুল নিয়ে শ্যামবাজার কালীবাড়ির দিক দিয়ে আসছে। আর, আপনি তখন আপনার গিন্নির তাগিদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরোহিত ধরার জন্যে—বাড়িতে বারের পুজোর জন্যে। তাকে আসতে দেখে আপনি সসম্ভ্রমে মুখের বিড়িটা ফেলে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ঠাকুরমশাই, আমাদের বাড়িতে আজ বারের পুজো। আপনি কি আসতে পারবেন?’

অনেক তো শুনলেন যুবকটির কথা। এবার আমার বর্ণিত কাঠামোর ওপর আপনার কল্পনার তুলিতে রঞ্জিত এই মানুষটির একটি ভালো মানানসই নাম দেওয়া যাক—যেমন ধরুন, নৃপতি নারায়ণ নস্কর।

নৃপতির নিবাস বেলগাছিয়ার ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে। আমার সঙ্গে তার আলাপ ছিল বহু বছর আগে। কিন্তু আলাপটা কেমন করে হয়েছিল সেইটা আগে বলা উচিত। কী একটা সিনেমা দেখার জন্যে আমি প্রাচীতে লাইন দিয়েছিলাম, বেলা তখন প্রায় সওয়া দুটো। শো তিনটেয়। বইটা খুব ভালো শুনেছিলাম।

লাইনে আমার আগে আরও প্রায় জনাতিনেক ছিলেন, আমার পিছনে প্রায় জনাতিরিশেক। হঠাৎ কে যেন এসে আমার হাত ধরে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ‘এই যে! এতক্ষণে ব্যাটার আসা হল! কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্যে! নে, টাকাটা ধর, টিকিটটা কাটতে থাক, আমি একটা পান খেয়ে আসছি।’

তারপর সে হুট করে চলে গেল। আমি দেখলাম, আমার হাতের মুঠোয় একটা দু-টাকার নোট আর দুটো দশ পয়সা। ওদিকে কাউন্টারে ততক্ষণ পৌঁছে গেছি। তাই কিছু ভেবে উঠে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগেই দুটো টিকিট কেটে নিয়ে গেটের কাছে এলাম। দেখি, মক্কেল দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পান চিবোচ্ছে আর তার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।

‘দাদা, আপনাকে মিছিমিছি কষ্ট দিলাম বলে কিছু মনে করবেন না। আমার প্রেজেন্স অফ মাইন্ড-এর জন্যে টিকিটটা পেলাম। আসলে আমার আরও আগে আসবার কথা ছিল, কিন্তু ট্রামের জন্যে দেরি হয়ে গেল।’

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আমার আরও একটু কাছে এসে হাতটা ধরে বলল, ‘চলুন, চা খেয়ে আসি।’

‘মাফ করবেন, বড্ড গরম।’ আমি বললাম।

‘তাহলে ঠান্ডা কিছু?’ সে নাছোড়বান্দা।

আমার ওজর-আপত্তি না শুনে সে নিয়ে গেল আমাকে পাশের রেস্টুরেন্টটায়। দুটো লস্যির অর্ডার দিয়ে সে আমাকে সিগারেট অফার করল।

‘আমি পানামা ভক্ত।’ বলে আমি নিজের প্যাকেটটা বের করলাম।

‘আমার নাম নৃপতি নারায়ণ নস্কর।’ সে সিগারেট ধরিয়ে আগুনটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।

‘আমি সন্তোষ মিত্র। বাগবাজারে থাকি।’ আমি সিগারেটটা ধরিয়ে বললাম।

‘আরে, আপনি তো আমার প্রতিবেশী মশাই, আমি বেলগাছিয়ায় থাকি।’ নৃপতি বলল, ‘তা কোথায় চাকরি করেন?’

‘এক মাড়োয়ারি অফিসে।’ আমি একটু অনিচ্ছাসত্ত্বেই মিথ্যা করে বললাম। কারণ, কেউ আমাকে ওই প্রশ্ন করলেই আমি খেপে যাই।

‘ভালো।’ আমার সঙ্গী বলল, ‘আপনাদের বাঁধাধরা সময়ের কাজ, আমাদের মতো না।

তাইতেই আপনি আজ মেজাজে এসে সিনেমায় লাইন দিতে পারলেন, আর আমাকে হুটপাট করে এসে সিনেমা দেখে আবার ছুট লাগাতে হবে।’

‘কীরকম! আপনি করেন কী?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘সেটা বলা ঠিক হবে না। কারণ, আমি কী করি, সেটা আমি কাউকে বলতে চাই না।’

‘ওঃ!’ আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলাম।

কিছুক্ষণ আমরা দুজনে চুপচাপ। লস্যিও অনেকক্ষণ এসে গিয়েছিল, আমরা তা খাচ্ছিলাম।

‘কিছু মনে করবেন না।’ নৃপতি হঠাৎ বলে উঠল, ‘আপনাকে দেখতে অবিকল আমার এক বন্ধুর মতো।’

আমি একটু আশ্চর্য হয়ে যাই।

‘তার গল্প শুনবেন?’ সে জানতে চাইল।

‘বলুন।’ আমি একটু আনন্দপ্রকাশ করলাম। সামনেই নববর্ষ আসছে, আর, আমার গল্পের স্টকও প্রায় শেষ, তাই নতুনের খোঁজে আমি উৎফুল্ল।

‘তার নাম ছিল বেণীমাধব মুখার্জি।’ নৃপতি বলা শুরু করল, ‘আমাদের বাড়ির দোতলায় থাকত। ছেলেবেলা থেকেই তার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব। বেণুর মা ওকে পার্কে নিয়ে যেতেন, আমিও যেতাম তাদের সঙ্গে। বুঝলেন, ছোটবেলায় আমি মেয়েদের পোশাক পরতাম। আমার মায়ের ইচ্ছে ছিল যে, তাঁর একটি কন্যা যেন হয়। কিন্তু ভগবান তা চাননি। তাই আমার মায়ের গর্ভে পরপর চারটি ছেলে আসে। আমি ছিলাম সবার ছোট। সুতরাং মা আমাকে মেয়ের পোশাক পরিয়ে মেয়ের অভাব ভুলতে চেষ্টা করতেন। আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার।

‘যাই হোক, সেসব কথা থাক। পাশাপাশি বেণু আর আমি বড় হতে লাগলাম। কিন্তু একদিন বাবা অ্যাকসিডেন্টে তাঁর একটা চোখ হারালেন। তারপর আস্তে-আস্তে আমাদের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আর ওদিকে যত আমরা বড় হতে লাগলাম, তত আমাদের মধ্যে দূরত্বটা বাড়তে লাগল—বেণুর আর আমার মধ্যে।

‘ইতিমধ্যে বাবা মারা গেলেন। দাদা তখন সবে ইন্টার পাশ করেছে। তাই কোনওরকমে চেষ্টা করে দাদা একটা ব্যবসাদারের গদিতে কেরানির চাকরি পেয়ে গেল। কিন্তু ওই ক’টি টাকায় আর কী হয়? তাই মা-ও সাহায্য করতে লাগলেন। জামা-কাপড় বাড়িতে সেলাই করে সেগুলি নিয়ে গিয়ে শ্যামবাজার-হাতিবাগানের বড়-বড় দোকানে বিক্রি করে। ওইভাবে আমাদের সংসারটা বেঁচে গেল।

‘আমার অন্য দুই দাদা লেখাপড়া কিছু-কিছু শিখল। কিন্তু সেজদাকে আর সোজাপথে রাখা গেল না। খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে সে উচ্ছন্নে গেল। দু’বার পুলিশের হাতে প্রায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু তারপরে আর পারল না। বাগবাজারে পুজোর ভিড়ের মধ্যে একজনের পকেট কাটতে গিয়ে আর পালাবার পথ পেল না।

‘ওদিকে আমি একটু লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, তাই কোনওরকমে স্কুল পাশ করে কলেজে ঢুকলাম। ইন্টারটাও পাশ করলাম বিদ্যাসাগর থেকে, কিন্তু তারপরেই হল গণ্ডগোল। ওই কলেজেরই একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম—সে তখন ইন্টারে ঢুকেছে।

‘হাতে পয়সা নেই, অথচ প্রেম করছি। পরিস্থিতিটা যে কত হাস্যকর, তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু তবুও আমাদের প্রেমটা টিঁকে রইল। প্রায় বছরতিনেক। তারপরেই এল ধ্বংস—বেণুর রূপে। সেদিন সন্ধ্যা আর আমি দুজনে বহুদিন পরে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। আর, সেখানে বেণুর সঙ্গে দেখা। বাধ্য হয়েই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হল ওকে সন্ধ্যার সঙ্গে। আমার নিজেরই কেমন অস্বস্তি লাগছিল। বেণুর দামি পোশাক আর ফিটফাট চেহারা দেখে সন্ধ্যা প্রায় সম্মোহিত হল। সিনেমার শেষে বেণু জোর করে আমাদের নিয়ে গেল রেস্টুরেন্টে। সেখানে রকমারি খাবার-দাবার খাওয়াল আমাদের। বিল হল প্রায় সাড়ে বারো টাকা। যেন বলির পাঁঠার গলায় খাঁড়া পড়ার আগে তার অতৃপ্ত বাসনা পূর্ণ করা। অবশেষে তার গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেল বাড়ির দোরগোড়ায়। খাঁড়াটা পড়ল।

‘এই ঘটনার কিছুদিন পরে টের পেলাম যে সন্ধ্যাও আস্তে-আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আগে

গঙ্গার ধারে যাওয়ার কথা বললেই সে আনন্দিত হত। কিন্তু গঙ্গার হাওয়া তার আর ভালো লাগত না। একদিন সে বলেই ফেলল : ”আচ্ছা, তুমি ডিগ্রি পাশ করে কী করবে ঠিক করেছ?”

”অনার্স যখন নেই, তখন আর পড়ব না। কোনও চাকরি-বাকরি জোগাড় করে নেব।” আমি জবাব দিলাম।

”কিন্তু চাকরির বাজার যা, তাতে টাকা খুব একটা আসবে কি?”

”না এলেও উপায় কী? ব্যবসা করবার মতো ক্যাপিটাল আমার নেই, আর বেকারও থাকা যায় না। তাই ওনলি সলিউশন হল চাকরি।”

”কত মাইনে পাবে আশা রাখো?” আবার ও প্রশ্ন করল।

”দেড়শো-দুশো টাকা নিশ্চয় পাব,” আমি বাদামের ঠোঙাটা মুড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ”তাতে আমাদের দুজনের চলে যাবে।”

”জিনিসপত্তরের যে-রেটে দাম বাড়ছে, তাতে ওই ক’টা টাকায় কিছু হবে না।” সন্ধ্যা একটু বিজ্ঞের মতো বলল, ”তা ছাড়া, তখন সংসার চালাতে গেলে আমোদ-আহ্লাদ সব ত্যাগ করতে হবে তার খেয়াল রাখো? তখন সিনেমা দেখতে হলে একবেলা না খেয়ে থাকতে হবে। আর গঙ্গার পাড়ে বসে জলের ওপর সূর্যডোবা দেখতে হলে তোমাকে সপ্তাহে দু-চারদিন হেঁটে অফিস যেতে হবে।”

‘আমি একটু আশ্চর্য হলাম ওর কথা শুনে।

”সন্ধ্যা, তুমি আজ হঠাৎ এরকম কথা কেন বলছ? তোমার সঙ্গে এতদিন ঘুরলাম… কিন্তু কই, এ সমস্ত প্রশ্ন তো আগে আসেনি! এখন এসব আসে কী করে?”

‘ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর যা উত্তর দিল তাতে আমার মনে হল, কে যেন আমাকে প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় মারল।

”এবার তাহলে তোমাকে বলছি, শোনো। আগামী বারো তারিখে আমার বিয়ে—বেণীমাধব মুখার্জির সঙ্গে। আমি তোমাকে কখনও যদি কোনও আশা দিয়ে থাকি, তাহলে তার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত। কিন্তু আমি পারতাম না তোমার সংসার করতে। মিছিমিছি আমাদের দুটো জীবন নষ্ট হয়ে যেত। তুমি যেভাবে বেঁচে থাকবার ছবি এঁকেছ, সেটা আমার বরদাস্ত হত না। জল আর হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকার কথা গড়ের মাঠে বসে প্রেমের গল্প করার সময় বলতে খুব ভালো লাগে, শুনতেও চমৎকার মনে হয়। কিন্তু কার্যকরী করা যায় না। আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ করলাম। তবে তোমাকে একটা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি—অযাচিত মনে কোরো না। তুমি ওই দেড়শো টাকার চাকরি পেয়েই বিয়ে কোরো না। আর-একটা জীবন নষ্ট করবার অধিকার তোমার নেই।”

‘এই বলে সন্ধ্যা উঠে চলে গেল। দেখলাম দূরে রাস্তার ওপর বেণুর কালো মরিসটা দাঁড়িয়ে আছে। বেণু কিন্তু লেখাপড়া কিছুই করেনি। খেত-দেত বাপের হোটেলে, থাকত নিজের বাড়িতে, চলাফেরা করত সমাজের উঁচু স্তরে। তাই তার সামনে আমার ডিগ্রি, আমার পিতৃপরিচয় সবই নগণ্য। আমি পারব কেন তার সঙ্গে প্রেমের প্রতিযোগিতায়? সে তার বউকে দিতে পারবে টাকা-পয়সা, সমাজের অহঙ্কার, গাড়ি-বাড়ি আর অফুরন্ত আনন্দ। কিন্তু আমি দিতে পারব শুধু একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা। তাতে লেখাপড়া-জানা মেয়েকে বশ করা যায় না। তাই ভেবে দেখলাম যে, আমার মতন ছেলেদের প্রেমে পড়া উচিত নয়, বিশেষ করে শিক্ষিতার সঙ্গে।

‘যাই হোক, বেণু সন্ধ্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। সেই বেণুর সঙ্গে আপনার চেহারার দারুণ মিল আছে।’ বলে নৃপতি থামল।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঘড়িটা দেখলাম, তিনটে বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে।

‘ওঠা যাক।’ আমি বললাম।

‘চলুন, সময় হয়ে এল।’ নৃপতিও উঠল। তারপর এগিয়ে গেল কাউন্টারে, সেখান থেকে দুটো মৌরী মুখে দিয়ে ও আমাকে বলল, ‘আমি আসছি এক্ষুনি সিগারেট কিনে, প্যাকেট শেষ।’

অগত্যা আমাকেই লস্যির বিলটা মেটাতে হল।

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ভাবলাম, কলেজ স্ট্রিটে পাবলিশারের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরব। কিন্তু নৃপতি বাদ সাধল। আমাকে জোর করে নিয়ে গেল ছোট একটা চায়ের দোকানে। সেখানে চা আর বেগুনি খাওয়াল, তার সঙ্গে-সঙ্গে সিনেমার সমালোচনা করতে-করতে যখন আমরা শেষ পর্যন্ত উঠলাম, তখন প্রায় ছ’টা বাজে। হিসেব করে দেখলাম যে, পাবলিশারের কাছে গিয়ে আর কোনও লাভ হবে না, কারণ তিনি এতক্ষণে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন। তাই আমিও বাড়ি ফেরা স্থির করলাম। নৃপতিও আমার সঙ্গে যাবে বলল।

দু-তিনটে বাস ছেড়ে দিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বাসে উঠলাম। সোজা দোতলায় চলে গেলাম। সামনেই কন্ডাক্টর দাঁড়িয়ে। সে টিকিট চাইল। নৃপতি নির্বিকার চিত্তে একটা পাঁচটাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দুটো, শ্যামবাজার।’

‘খুচরো নেই দাদা?’ কন্ডাক্টর জানতে চাইল।

‘যা আছে তাতে কুলোবে না।’

‘আপনার বন্ধুর কাছে নেই?’

‘আপনি চেঞ্জটা আমায় শ্যামবাজারে নেমেই না হয় দেবেন,’ নৃপতি কন্ডাক্টরকে বলল, ‘আমি একেবারে টার্মিনাসে নামব।’

‘টিকিটটা আমিই দিচ্ছি,’ আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম নৃপতিকে, ‘কেন আপনি আবার এই ক’টা পয়সার জন্যে নোটটা ভাঙাবেন!’ বলে আমি কন্ডাক্টরকে একটা আধুলি দিলাম।

কন্ডাক্টর নোটটা ফেরত দিয়ে দিল।

শ্যামবাজারে নেমে নৃপতি আমার সঙ্গে-সঙ্গেই আসতে লাগল। সমানে এটা-সেটা নিয়ে বকর-বকর করতে-করতে। আমি বাড়ি পৌঁছে তবে রেহাই পেলাম। যাওয়ার সময় নৃপতি ঘোষণা করে গেল : ‘আবার দেখা হবে আশা করি। বেলগাছিয়া থেকে মাঝে-সাঝে আসব।’

এই ঘটনার দিনসাতেক পরে আমি অফিস যাব বলে টামে উঠেছি। টামে বরাবর যেমন ভিড় থাকে, সেরকমই ছিল। কোনওরকমে ঠেলে-ঠুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চোখ পড়ল সাদা টেরিলিনের শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোকের দিকে। দেখেই চিনলাম নৃপতিকে, তাই এগিয়ে গেলাম।

‘কেমন আছেন?’ তাকে জিগ্যেস করলাম।

সে আমার কথা শুনলই না। তার ঘাড়ে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘চিনতে পারছেন না?’

নৃপতি আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘মাফ করবেন, আপনি বোধহয় ভুল করেছেন। আপনাকে তো আমি চিনি বলে মনে পড়ছে না!’

‘সরি,’ আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘আপনাকে দেখতে অবিকল আমার এক বন্ধুর মতো। এমনকী আপনার গলার আওয়াজ পর্যন্ত। তাই ভাবলাম…।’

‘টিকিটটা নেবেন—।’ কন্ডাক্টর হাত বাড়াল।

নৃপতি নেমে গেল লালবাজারের সামনে। দেখলাম, সে পুলিশ হেড-কোয়ার্টার্সে ঢুকল।

সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে অবাক। দেখি, নৃপতি বাইরের ঘরে বসে আমার গিন্নির সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। তার সামনে ছোট্ট টেবিলটাতে চা, মিষ্টি, সিঙাড়া।

‘দাদা, কেমন আছেন বলুন?’ সে জিগ্যেস করল।

আমার সকালের দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। নৃপতির অম্লান বদনের স্বীকারোক্তি—সে আমাকে চেনে না। ভাবলাম, কেন ও আমাকে মিথ্যে কথা বলল, কিন্তু নৃপতি নিজেই আমার কষ্ট লাঘব করল।

‘আমি এসেছি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে।’

‘কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘সকালের ঘটনাটার জন্যে।’

‘ও,’ আমি বললাম, ‘তাহলে আমি ঠিকই ধরেছিলাম।’

গিন্নি ইতিমধ্যে আমার জন্যে এককাপ চা নিয়ে এল। আমি জামাকাপড় ছাড়তে-ছাড়তে চায়ে চুমুক দিয়ে শুনলাম নৃপতির ব্যাখ্যা।

‘কিন্তু কেন যে ওরকম করলাম তার উত্তর দিতেই আজকে এলাম আপনার কাছে। তা ছাড়া, আমার একটা অনুরোধও আছে।’

‘কী সেটা?’

‘খুবই সামান্য অনুরোধ। যদি আমাকে কখনও রাস্তায় দেখেন তো আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আপনি যদি আমাকে দেখেন, তাহলে আমিও আপনাকে দেখব আর প্রয়োজন হলে আমি নিজে যেচে আপনার সঙ্গে কথা বলব। বুঝলেন?’

‘কেন সেটা জিগ্যেস করতে পারি?’

‘নিশ্চয়, আপনাকে যখন দাদা বলে ডেকেছি, তখন আপনার কাছে লুকোবার আমার কিছুই নেই।’ নৃপতি একটু থামল। একটা সিগারেট ধরাল। আমিও সেই অবসরে চায়ের কাপটা খালি করে ফেললাম।

‘আমি ক্যালকাটা পুলিশের প্লেন ক্লোদস বিভাগের একজন ইন্সপেক্টর,’ নৃপতি বলে চলল, ‘আমাদের কাজ দুর্নীতি দমন করা এবং যখন-তখন বিভিন্ন বেশভূষায় অপরাধীদের অনুসরণ করতে হয় আমাদের। সুতরাং, আপনি যদি কখনও আমাকে দেখে আমার নাম ধরে ডাকেন, তখন আমার অবস্থাটা কী হবে বুঝতেই পারছেন। তাই আমার এই অনুরোধ।’

আমি অবাক হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম নৃপতির মুখের দিকে। শরীরের মধ্যে দিয়ে শিহরন বয়ে গেল। এত অল্প বয়েসে অত বড় দায়িত্ব নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। নৃপতি নারায়ণ নস্করের জন্যে আমার শ্রদ্ধা হল। গিন্নিকে আর-একবার চা করতে বললাম। তারপর নৃপতিকে জিগ্যেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনার বয়েস তো বেশি নয়। এর মধ্যেই ইন্সপেক্টর হয়ে গেছেন! আপনার ওপর ভাগ্যদেবী খুব সুপ্রসন্ন বলতে হবে!’

‘হয়তো হবে।’ নৃপতি উত্তর দিল, ‘কিন্তু নট ইন লাভ—সেখানে চলতি ভাষায় বলতে গেলে ”ল্যাং” খেলাম!’ বলে ও একটু হাসল, পরাজিতের হাসি।

‘আপনার জীবনের গল্প বলুন দেখি?’ আমি কথাপ্রসঙ্গ ঘোরালাম।

‘কিছু-কিছু তো আপনাকে সেদিন বলেছি। তার ওপর বলার আর বিশেষ কিছু নেই। ডিগ্রি পাশ করে মেসোর কাছে বেড়াতে গেলাম। তিনি কালীঘাট থানার একজন সিনিয়র কর্মচারী। তাঁর চেষ্টাতেই চান্স এল পুলিশে ঢোকার। স্বাস্থ্য খুব ভালো না হলেও হাইটে হয়ে গেল। তা ছাড়া, আমার একটা বিশেষ গুণ আছে, যেটা হল এই যে, আমি খুব ভালো ডিসগাইজ করতে পারি। কলেজে থাকাকালীন একদিন তো আমি মেয়ে সেজে ক্লাসে হাজির। কী অবস্থা হয়েছিল সেদিন কী বলব! আমার সব বন্ধুরা আমাকে সিনেমায় নিয়ে যেতে চায়—আর মেয়েগুলো হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছিল, এসপেশিয়ালি সন্ধ্যা!

‘যাই হোক, সিলেকশান হয়ে গেলে পাঠিয়ে দিল ব্যারাকপুর পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে। সেখানে অনেক কিছু শেখাল, যেমন—অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা, অপরাধীকে অনুসরণ করা, অপরাধীর মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে সাব-ইন্সপেক্টর হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কয়েকটা কেস সলভ করলাম। আমার নাম হয়ে গেল। অবশেষে এক স্মাগলার দলের পিছনে-পিছনে গেলাম বম্বে পর্যন্ত। সেখানে তাদের মালসমেত হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়ে কলকাতায় এসে জানতে পারলাম যে, আমার প্রমোশন হয়েছে।’

‘তা এই পোস্টে কতদিন আছেন?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘মাসছয়েক হল।’ নৃপতি বলল, ‘পুলিশে ঢুকেছি পাক্কা আড়াই বছর।’

সেদিন নৃপতিকে আমার গিন্নি রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়ল না। ও চলে যাওয়ার পর সহধর্মিণীকে বললাম, ‘ওই লোকটাকে চিনে রাখলে তো! পুলিশে চাকরি করে!’

‘আমাকে বলতে হবে না, আমি পাশের ঘর থেকে সব শুনছিলাম।’ অণিমা বলল। অণিমা আমার বউ।

রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে। আমি গা-হাত-পা ধুয়ে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়লাম। অণিমাও কিছুক্ষণের মধ্যে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুতে এল। তখনও ন’টা বাজেনি। আমাদের বিয়ে হয়েছিল বছরপাঁচেক আগে।

পরের রোববার বেলা দশটা নাগাদ আমি বেরোচ্ছিলাম বিকালের জন্যে সিনেমার টিকিট কাটতে। নৃপতি এসে হাজির। হাতে দ্বারিক ঘোষের একবাক্স মিষ্টি।

‘বউদি, মিষ্টি নিয়ে এলাম, আরেকটা কেস সলভ করেছি!’ বলে সে অণিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। তারপর বলল, ‘এবার আশীর্বাদ করুন, যেন আরও ওপরে উঠতে পারি।’

গিন্নি আর আমি তাকে আশীর্বাদ করলাম। তারপর চা-মিষ্টি খাওয়ার পর্ব শেষ হলে নৃপতি আর আমি গ্যাঁজানো শুরু করলাম। হঠাৎ অণিমার আবির্ভাব।

‘টিকিট কাটতে গেলে না এখনও?’

‘সিনেমায় সত্যিই যাবে?’ আমি একটু আশ্চর্যভাবে জিগ্যেস করলাম।

‘নিশ্চয়! আর টিকিট কিন্তু তিনটে কেটো। নৃপতিবাবুকেও যেতে হবে।’

নৃপতি আপত্তি করল। কিন্তু অণিমা কারুর আপত্তি কখনও মানে না। আমারও না। তাই সে আরও ঘোষণা করল, ‘আপনি আমাদের এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে, সিনেমা দেখে আবার এখানে ফিরবেন। তারপর রাত্রে খেয়েদেয়ে একেবারে বাড়ি যাবেন।’

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। অণিমাকে বলেছিলাম যে, নৃপতি পুলিশের লোক বলে ওকে একটু তোয়াজ করতে। তাই বলে একেবারে জামাইয়ের আদর! এরকম করলে তো আমাকে লোকের পকেট-কাটা ধরতে হবে। ঠিক করলাম, রাতে ওকে একটু বোঝাতে হবে—স্বামীর কথা অত অক্ষরে-অক্ষরে পালন করলে ভবিষ্যতে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

যাই হোক, দিনটা কোনওরকমে কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে অণিমার পাশে শুয়ে সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে সেটাকে ছাইদানিতে ফেলে ওকে বললাম, ‘নৃপতিকে অত তোয়াজ করতে হবে না।’

‘কেন?’ তার পালটা প্রশ্ন হল, ‘তুমিই তো সেদিন বললে…।’

‘মানছি।’ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কিন্তু অত না।’

‘আমি তো ভাবলাম, তুমি টাকার স্বার্থে বলেছ।’

‘মানে?’

‘তোমার ভাইয়ের চাকরির জন্যে।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এত ভালো আইডিয়াটা আমার মাথায় এল না! প্রিয়তোষটা সেই কবে বি. এ. পাশ করে রাস্তায়-রাস্তায় আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছে। নৃপতিকে বলা যেতে পারে, ওকে পুলিশে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে।

‘অণিমা, ইউ আর এ ডার্লিং!’ গিন্নিকে জড়িয়ে ধরে বললাম।

‘ও মাগো, খাটের ওপর কী একটা উঠেছে গো!’ বলে সে হঠাৎ আঁতকে উঠল!

‘ওটা আমি।’ তাকে বললাম।

‘কী অসভ্য!’ অণিমা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

আরও কিছুদিন পরের ঘটনা। অফিসফেরতা ট্রামে দেখা। আগেরবারের মতো এবারেও আমাকে চিনল না। তবে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ট্রামটা যখন কলেজ স্ট্রিট ক্রসিংয়ে এল, তখন সে হঠাৎ আমার হাতে কী একটা গুঁজে দিয়ে কানে-কানে বলল, ‘এটা পকেটে রাখুন, আর ঠনঠনিয়া স্টপেজে নেমে যান। আমিও নামছি।’

আমি কিছু বলবার বা ভাববার সময় পেলাম না। তার নির্দেশ মতো ট্রাম থেকে নেমে সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনলাম।

‘আমার কথা ভুলে গেলেন নাকি?’ বলে নৃপতি এসে হাজির আমার পাশে।

অগত্যা আরেকটা সিগারেট দিতে বললাম দোকানিকে।

সিগারেট ধরিয়ে আমরা সামনের পাঞ্জাবি হোটেলে গেলাম।

‘দিন দেখি মালটা।’ বলে নৃপতি হাত বাড়াল।

আমি পকেট থেকে বের করলাম তার দেওয়া জিনিসটা। অবাক হয়ে দেখলাম যে, সেটা কার যেন মানিব্যাগ।

‘ভয় নেই,’ নৃপতি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘আমার কাজ জানেনই তো। লোকের পকেট থেকে জিনিসপত্র তোলাও মাঝে-মাঝে দরকারে লাগে। আমাদের কাজে জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব জানা প্রয়োজন।’

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। কর্তব্যরত গোয়েন্দাকে রক্তে-মাংসে দেখলে আমার মতো আপনিও বোকা বনে যেতেন। নৃপতি মানিব্যাগটা খুলে ভেতর থেকে টাকা-পয়সা বের করে টেবিলটার ওপরে রাখল। হঠাৎ একটা কাগজ বের করে সেটা ভালো করে দেখে বলল, ‘পেয়েছি, এতদিন পরে পেয়েছি!’

‘কী পেলেন?’ আমি জিগ্যেস না করে পারলাম না।

‘প্রুফ!’

‘ওঃ,’ আমি বললাম, ‘তা মানিব্যাগের বাকি জিনিসগুলোর কী হবে?’

‘সব হেডকোয়ার্টার্সে যাবে, ওগুলো এভিডেন্স।’ বলে সে দুটো লস্যির অর্ডার দিলে ‘লেট আস সেলিব্রেট!’

রাত প্রায় সাড়ে আটটার সময় হাঁটতে-হাঁটতে শ্যামবাজারের মোড়ে এলাম। ট্রামের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে নৃপতি হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওই যে লোকটাকে দেখছেন, ওই ফুটপাথে বইয়ের দোকানটার সামনে, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরে…।’

‘দেখলাম।’ আমি দেখে বললাম।

‘ভদ্রলোককে চিনে রাখুন।’

‘কেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘উনি আমার অফিসার, নাম সুশান্ত মুখার্জি।’

আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম যে, ভদ্রলোককে চিনে রাখব। তারপর দ্বিধা ত্যাগ করে তার কাছে প্রস্তাবটা উত্থাপন করলাম, ‘দেখুন, আপনাকে বহুদিন ধরে একটা কথা বলব-বলব করে আর বলা হয়ে উঠছে না।’

‘কী বলুন।’ নৃপতি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল।

‘ব্যাপারটা আমার ভাইকে নিয়ে।’ আমি দম নিয়ে প্রায় একনিশ্বাসে বলে ফেললাম।

‘একটু খুলে বললে ভালো হত বোধহয়।’ নৃপতিকে একটু যেন গম্ভীর শোনাল।

‘ওর একটা চাকরি করে দিতে হবে।’ আমি কোনওরকমে বললাম।

‘ওঃ!’ নৃপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি ভাবলাম, বুঝি কোনও সাংঘাতিক ব্যাপার-ট্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন আপনার ভাই।’

‘না, না,’ আমি অভয় দিলাম, ‘ভাইটা আমার একটু মস্তান গোছের হলেও আইনের গণ্ডির বাইরে পা বাড়ায় না, বুদ্ধি-শুদ্ধি একটু-আধটু রাখে।’

‘তা আপনার ভাইয়ের কোয়ালিফিকেশনটা কী?’

‘গতবার কোনওরকমে বি. এ.-টা পাশ করেছে।’

‘স্বাস্থ্য-টাস্থ কেমন? হাইটটা?’

‘আপনাদের মিনিমাম যোগ্যতা তার আছে, কিন্তু বোঝেনই তো, এইসব লাইনে একটু জানাশোনা থাকলে তবেই চান্স পাওয়া যায়…।’

‘তা অবশ্য ভুল বলেননি।’ সে একটু মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি আপনাকে কথা দিতে পারছি না, তবে চেষ্টা করে দেখব। কী করতে পারি, জানাব।’

‘আর যদি কোথাও দু-পাঁচটাকা দেওয়ার দরকার পড়ে তো তার ব্যবস্থাও না-হয় হয়ে যাবে।’

নৃপতি হাসল।

‘যদিও আমরা দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল করে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তবুও আপনাকে বলতে নিজেরই লজ্জা হচ্ছে যে, আমাদের ডিপার্টমেন্টটা সবচেয়ে কোরাপ্ট—ঘুষ বিনা একগ্লাস জল পাওয়া যায় না।’

‘শুধু আপনাদের কেন, দেশের সর্বত্র ওই একই পরিস্থিতি।’ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আমি বললাম।

নৃপতি সেটার কোনও জবাব দিল না।

একটা ট্রাম আসছিল। হাত তুলে সেটাকে থামাবার নির্দেশ দিয়ে সে আমাকে বলল, ‘তাহলে ওই কথাই রইল। আপনাকে খবর দেব।’

খবর সে দিল। তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি পাব, তা আমি আশা করিনি। আমি জানতাম যে, কলকাতায় চাকরির অভাব নেই। যারা বলে যে, চাকরি পাওয়া যায় না, তারা হয় চাকরির জন্যে চেষ্টা করেনি, নয়তো তাদের চাকরির দরকার পড়ে না। তাই যদি না হবে তাহলে বহুদিন আগে বাঙালিরা দলাদলি ত্যাগ করে নিজেদের মধ্যে সমস্ত বিভেদ ভুলে এক হয়ে উঠত, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিত আমাদের এই ভারতবর্ষটাকে।

যাই হোক, নৃপতি খবর দিল। আমার ভাই প্রিয়তোষের জন্যে চাকরির খবর। পরদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, মূর্তিমান আমার বাড়িতে হাজির।

‘আপনার বরাতটা খুব ভালো।’ সে আমাকে দেখে বলল।

‘কীরকম?’ জামাকাপড় ছাড়তে-ছাড়তে আমি জিগ্যেস করলাম।

‘আপনার ভাইয়ের চাকরিটা প্রায় বাউন্ডারি পৌঁছে গেছে বলতে পারেন।’

‘এত শিগগিরই!’ আমি আশ্চর্য হলাম।

‘পিয়োর লাক বললাম না!’

আমি লুঙ্গিটা পরছিলাম, কোনও কথা বললাম না।

‘আপনার ভাই আশেপাশে আছে?’

‘না। কেন?’

‘থাকলে এখনই একটা ”ব্যাক ডেটেড” অ্যাপ্লিকেশান লিখিয়ে নিতে পারলে ব্যাপারটা আরও এগিয়ে থাকত।’

‘বোঝেনই তো, সে এ-পাড়ার মস্তান। তাকে সন্ধের পরে বাড়িতে পেতে গেলে ধরনা দিয়ে বসে থাকতে হয়।’

‘সেটা তাহলে আপনি করিয়ে রাখবেন।’

‘টাকা-ফাকা কিছু লাগবে না?’

‘সে তো লাগবেই! তা না হলে যে-কেরানি আছে, সে দরখাস্তটা নেবে কেন?’

‘কত আন্দাজ?’ আমি ভয়ে-ভয়ে জিগ্যেস করলাম।

‘পুরো ব্যাপারটা আগে শুনুন, তারপর বিবেচনা করুন কত দেবেন।’

‘শোনা যাক।’ বলে আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। আমার কর্তব্য-পরায়ণা স্ত্রী ইতিমধ্যে আমাদের জন্য চা পাঠিয়েছিল।

‘আমাদের ডিপার্টমেন্টে লোক নেওয়ার লাস্ট নোটিস বেরোয় প্রায় মাসদেড়েক আগে। অনেকে অ্যাপ্লাই করেছিল, তা প্রায় আড়াই হাজার হবে। লোক নেবে মোট ছত্রিশজন। সুতরাং, অতগুলো দরখাস্ত থেকে খান পঞ্চাশেক বাছাই করা হয়। তার ভেতর থেকে ওই ছত্রিশজনকে নেওয়া হবে। এখনই ওই বাছাই করা অ্যাপ্লিক্যান্টদের থেকে একজন অন্য জায়গায় চাকরি পেয়ে চলে গেছে কলকাতা ছেড়ে, আর-একজন প্রেমে বিফল হয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই যে ভ্যাকান্সি দুটো হয়েছে, সে-খবর দু-একজন ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই তারা ওই ভ্যাকান্সি দুটোকে নিলাম করছে। একটির দাম একশো পঞ্চান্ন টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আর মাত্র দু-দিন সময় আছে, কারণ তারপরেই ওই বাছাই-করা পঞ্চাশজনকে রিটেন এগজামিনেশানে বসবার জন্যে ডাকা হবে। সুতরাং আপনিই বিবেচনা করুন কত দেবেন।’

আমাকে কিছুক্ষণ ভাবতে হল।

‘আচ্ছা,’ আমি নৃপতির কাছে জানতে চাইলাম, ‘আমি যদি একশো ষাট টাকা দিই, তাহলে আমার ভাইয়ের অ্যাপ্লিকেশানটা না হয় গেল, কিন্তু তারপরে যদি শেষরক্ষা না হয়?’

‘সেজন্যে ভাবছেন?’ নৃপতি যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘আমি আছি কী জন্যে? আপনাকে দাদা বলে ডেকেছি, আর আপনার জন্যে এটুকু করতে পারব না? তা ছাড়া, একবার রিটেন এগজামিনেশানটা হয়ে গেলে তারপর সবই আমার হাতের মুঠোয়, কারণ মুখার্জিদা—মানে, আমার বস ইজ দ্য রিক্রুটিং অফিসার!

‘তাহলে একশো ষাটই থাকুক।’

‘হ্যাঁ, ওতেই হয়ে যাবে।’ নৃপতি বলল।

‘টাকাটা কি এখন দেব?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘পরেও দিতে পারেন, তবে কালকের পরে দিলে কোনও কাজ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তা ছাড়া, যে নগদ টাকা আনবে, তাকেই কেরানিরা প্রেফারেন্স দেবে।’ নৃপতি বোঝাল।

‘তাহলে টাকাটা আপনি এখনই নিয়ে যান।’ বলে আমি ভেতরে গেলাম। সেখান থেকে অণিমার আলমারি খুলে টাকাটা নিয়ে আবার বাইরের ঘরে ফিরে এলাম। নৃপতিকে টাকাগুলো গুনে দিলাম। ষোলোটা দশ টাকার নোট।

‘আর প্রিয়তোষের—মানে, আমার ভাইয়ের অ্যাপ্লিকেশানটা ওকে দিয়ে লিখিয়ে রাখব। কাল তো রোববার আছে, সকালে ওটা আপনি এসে নিয়ে যাবেন।’

‘ঠিক আছে।’ নৃপতি টাকাটা পকেটে পুরে বলল, ‘ওই কথাই রইল। আপনার ভাইয়ের জন্যে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি তাহলে আজ উঠি।’

অণিমা ঘরে এসে হাজির।

‘সে কী কথা! আপনি আজ খেয়ে যাবেন না?’ আমার সহধর্মিণী অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।

‘আজকে পেটটা ঠিক সুবিধের নয়, বউদি।’ নৃপতি বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘আর-একদিন এসে খাব’খন।’

আমি একটু ওজর-আপত্তি করলাম, কিন্তু নৃপতি বিদায় নিল।

অন্য রোববারের মতো পরদিন সকালে বাজার-টাজার সেরে বেরিয়ে পড়লাম। নৃপতির জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু নৃপতি এল না। তাই আমি গেলাম শ্যামলের অফিসে। শ্যামল আমার বন্ধু…কিন্তু রোববারেও ওর ছুটি নেই।

‘কী খবর?’ শ্যামল আমাকে দেখে জানতে চাইল, ‘অণিমা কেমন আছে?’

‘ভালো।’ আমি বললাম, ‘মনোতোষ আসেনি?’

মনোতোষ আমার মেজ ভাই। আমরা তিন ভাই। প্রিয়তোষ সবার ছোট।

‘না। তবে আসবার সময় যায়নি।’ বলে শ্যামল তার বেয়ারাকে দুটো চা আনতে পয়সা দিল।

আমরা এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতে-করতে চা এসে হাজির—পিছু-পিছু মনোতোষও।

‘কেমন গেল?’ তাকে জিগ্যেস করলাম।

‘যেমন ভেবেছিলাম, ঠিক তেমন। ব্যাটা সোজা বাড়িতে গেল। সেখানে সমস্ত রাত্তির কাটিয়ে ভোর না হতেই ব্যাগ হাতে বাজারে। আলুর দোকানে প্রথম নোট, মাছের দোকানে দ্বিতীয় নোট, আর মিষ্টির দোকানে তৃতীয় নোট ভাঙাল। তারপরেই তাকে অ্যাপ্রিহেন্ড করলাম। পকেটে আরও দুটি নোট পেলাম। বাড়িতে তেওয়ারিকে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে বাকি নোটগুলো ছিল।’

‘মক্কেল কোথায়?’ মনোতোষকে আবার প্রশ্ন করলাম।

‘দ্বিবেদী নিয়ে আসছে।’ বলে আমার ভাই একটা সিগারেট ধরাল। আমরাও মুখাগ্নি করলাম।

‘আর দলের বাকি লোকগুলো?’ শ্যামল জিগ্যেস করল।

‘কান্ডারিবিহীন নৌকো হয় কি কখনও?’ মনোতোষের পালটা প্রশ্ন হল।

কিছুক্ষণ সকলে চুপ। ওয়েসলি হলের বোলিং শুরু হলে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যেরকম নিস্তব্ধতা ছেয়ে ফেলে—সাংঘাতিক কিছুর প্রতীক্ষায়, তেমনি নিস্তব্ধতা।

‘তোকে বলতে ভুলে গেছি,’ মনোতোষ জানাল হঠাৎ, ‘লোকটা কিন্তু সত্যিই ডিগ্রি পাশ করেছে।’

‘আমার ধারণাও তাই ছিল।’ শ্যামল সিগারেটটাকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে ফেলে বলল, ‘না হলে ওইরকমের একটা গল্প ফাঁদতে পারত না।’

‘আধুনিক শিক্ষার ফলাফল।’ আমি মন্তব্য করলাম, ‘দোষ্টা কার—সমাজের, না শিক্ষার?’

‘তোমার-আমার মুখে ওইসব কথা সাজে না।’ শ্যামল বলল।

‘তোর প্ল্যানটা কিন্তু অপূর্ব ছিল।’ মনোতোষ আমার তারিফ করল।

‘প্রশংসাটা আসলে তোর বউদির প্রাপ্য।’ আমি সত্যি কথা বললাম, ‘নিজের অজান্তে ও-ই আমাকে প্ল্যানটা বাতলায়।’

হঠাৎ বাইরে একটা আওয়াজ পেলাম, ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

‘এবার মুখোশ খোলার পালা।’ শ্যামল বলল।

‘আমি তাহলে চলি।’ বলে আমি উঠলাম।

দরজার আড়াল হতেই শুনলাম কে যেন বলছে, ‘স্যার, একে বুক করুন। এর কাছে চোরাই টাকা পাওয়া গেছে। তা ছাড়া, লোককে ঠকানোর জন্যে এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।’

‘মিথ্যে কথা!’ আর-একজন প্রতিবাদ করল, ‘আমি জানি না, আমার কাছে চোরাই টাকা কী করে এসেছে। আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি যে, আমি একজনের কাছে টাকা পেতাম, সে আমাকে কাল রাতে ধারটা শোধ করে দিয়েছে। এখন সে যদি চোরাই টাকা দিয়ে থাকে তো আমি তার কী জানি?’

‘কত টাকা পেতে?’ শ্যামল জানতে চাইল।

‘প্রায় শ’দুয়েক টাকা।’ জবাব এল।

‘লোকটার সঙ্গে তোমার কতদিনের আলাপ?’

‘বছরচারেক তো হবেই!’

‘সে তোমার কাছে টাকা ধার নিয়েছিল কেন?’

‘পুরো ব্যাপারটা বলতে আমার অসুবিধে আছে।’

‘বেশ, যতটা বলতে পারা যায়, ততটা বলো।’

‘আমার বন্ধুটি ভীষণ জুয়া খেলত।’

‘লোকটা কি বিবাহিত?’

‘হ্যাঁ, তবে বউটা বড্ড খিটখিটে। বাড়িতে একদঙ্গল ছেলেপুলে।’

‘কী কাজ করে?’

‘কোন এক ব্যবসাদারের গদিতে খাতা লেখার কাজ করে।’

‘যেমন তোমার দাদা করত?’

‘আমার কোনও দাদা নেই।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমার কানে একটা দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ এল। আমার ভাই মনোতোষ খুশি হলে চুরুট ধরায়। চুরুটের গন্ধ পেলাম। বুঝলাম যে, মনোতোষ খুশি হয়েছে। মনোতোষ পুলিশে কাজ করে। শ্যামলও।

হঠাৎ মনোতোষের গলা আবার শুনতে পেলাম।

‘আচ্ছা, ওই লোকটির নাম-ধাম কিছু জানো?’

‘নিশ্চয়!’ উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর এল।

‘যদি তাকে এখানে হাজির করানো হয়, তাহলে তাকে বলতে পারবে এই কথাগুলো?’

‘আলবাত! সত্যের জয় সব জায়গায়!’

‘তাই নাকি?’ বলে আমি ঘরে ঢুকলাম।

দেখলাম, আমার সামনে একজন পুলিশের হাতে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা নৃপতি নারায়ণ নস্কর।

আমরা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমি বাগবাজার থানার ও. সি.।

মাসিক রোমাঞ্চ

অক্টোবর, ১৯৬৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *