অন্তরালের নায়ক
গ্রামের যে স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি, সে স্কুলে গেলাম। ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করলাম, তোমরা কি ফজলুর রহমান খানের নাম শুনেছ? ছেলেমেয়েরা শোনেনি। ফজলুর রহমানের নাম। কেউই শোনেনি। বিষয়টা আমাকে বিস্মিত করেছে। কষ্ট পেয়েছি। আমি জানি না, আমাদের শিক্ষকেরা ক্লাসে গিয়ে কী গল্প করেন! কিশোর-কিশোরীদের কাছে কাদের গল্প শোনান? জাতীয় পাঠ্যবইয়ে যে ফজলুর রহমানের নাম নেই, সেটাও বিস্ময়ের। অসম্ভব দুঃখজনক +
কিশোর-যুবকেরা যদি নায়ক চিনতে ভুল করে, তারা বহু দূর যেতে পারে না। স্বপ্নের নায়ক হতে হয় অনেক বড়। ফজলুর। রহমান খান হলেন তেমন মানুষ, যিনি নায়ক! অনেক বড় নায়ক! এই খানের কাজ দেখার জন্য আমি শিকাগো শহরে গিয়েছিলাম। যে কয়দিন ছিলাম, শুধু খানের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে বেরিয়েছি। দুনিয়ায় কিছু মানুষ থাকেন যারা জন্ম, জাতীয়তা, ধর্ম সবকিছু ছাপিয়ে পৃথিবীর সন্তান হয়ে যান। ফজলুর রহমান খান ছিলেন তেমন একজন। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে, কুড়ি শতকে তার মতো এত বড় হতে পেরেছেন, তেমন মানুষ খুব বেশি নেই আমাদের। ফজলুর রহমান ছিলেন আধুনিক শিকাগো শহরের রূপকার। স্কাইস্ক্রেপারের (গগনচুম্বী ভবনের) জনক, দুনিয়া কাঁপানো এক স্থপতি। তার মতো মানুষের কথা পাঠ্যবইয়ে নেই! আফসোস!
সারা দুনিয়ায় আমাদের অনেক মানুষ আছেন, যারা জ্ঞান বেষণা ও বিজ্ঞানে অবদান রাখছেন। তবে কিছু কিছু মানুষের। অবদান অনেক বড়। আমাদের সময়ের তেমন এক নায়কের নাম। এতদ হাসান। জাহিদ হাসানের মতো বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত বড় সজনী খুব বেশি নেই। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হওয়া কত কঠিন, সেটা আমাদের। তরুণদের তেমন একটা ধারণা নেই। তার চেয়েও অনেক কঠিন। হলো, সেখানে প্রফেসরশিপ ধরে রাখা। এসব ইউনিভার্সিটিতে সাফল্য ধরে রাখতে না পারলে, বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে কিক-আউট করতে দ্বিধাবোধ করে না। আমাদের দেশের মতো লাইফ গ্যারান্টেড ইউনিভার্সিটির চাকরি সেসব দেশে নেই।
বিজ্ঞানে ব্রেক থ্রু ডিসকভারি (Breakthrough Discovary) বলে কিছু বিষয় থাকে। যে আবিষ্কার যুগান্তকারী, যে আবিষ্কার বহু বছরের আনসলভড প্রশ্নের (unsolved question) উত্তর দেয়। জাহিদ হাসান পার্টিকেল ফিজিকস ও কোয়ান্টাম ফিজিকসে। তেমন অবদান রাখছেন। তার কাজ প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানের দুনিয়াখ্যাত জার্নালে। তাই তাকে সংবাদপত্রের অফিসে গিয়ে বিজ্ঞান আবিষ্কারের ঘোষণা দিতে হয় না। প্রিন্সটন ছাড়াও আমেরিকার বিখ্যাত লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির (LBNL) সঙ্গে তাকে যুক্ত করা হয়েছে। শুধু তার মেধা ও কাজের জন্য?। বাংলাদেশের ছেলে রুবাব খানের কথা তরুণদের জানতে হবে। নাসায় কাজ করা এই যুবক খুব অল্প বয়সে অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। রুবাব খান তার পিএইচডি থিসিস। কাকে উৎসর্গ করেছে, জানেন? বাংলাদেশকে! সারা দুনিয়ায় ৯০ শতাংশ পিএইচডি থিসিস যখন সবাই পরিবারের সদস্যদের। উৎসর্গ করেন, রুবাব তখন সেটা করেছে নিজের জন্মস্থানকে! অথচ রুবাব খানকেই আমাদের তরুণেরা চেনেন না! প্রয়াত আব্দুস সাত্তার খান ছিলেন আমাদের দেশের আরেক মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেমেস্টির ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের অতিসামান্য কিছু বাঘা বিজ্ঞানীর একজন ছিলেন এই আব্দুস সাত্তার। নাসায় কাজ করেছেন। তার উদ্ভাবিত সংকর। ধাতু (Alloy) ব্যবহার করা হয়েছে নাসার স্পেইস শাটলে। তারাই হলেন নায়ক! সত্যিকারের নায়ক! এসব অন্তরালের। নায়কদের চিনতে হবে। তাদের কর্ম সম্পর্কে জেনে তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতে হবে।
আমাদের সময়ের এমন আরও কিছু নায়কদের একজন। প্রফেসর সাইফ ইসলাম। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের (UC-Davis) প্রফেসর। সম্প্রতি তিনি ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর। অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স (AAAS) নামের সংগঠনের। এমন। সব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শুধু তাদেরই ফেলো নির্বাচিত করে, যারা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। আমাদের দেশের মতো মন্ত্রী আর সচিবদের দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান চালায় না ওরা।
আমাদের তরুণেরা যেন ভুলে না যান, অলীক জগতের বাইরে একটা সত্যিকারের জগৎ আছে। একটা পৃথিবী আছে। অন্তরালের অনেক নায়ক আছেন যাদের চিনতে হবে। জানতে হবে। তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। এসব নায়ককে চিনতে না পারলে, জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার তিয়াস জাগবে না। এসব নায়ককে চিনতে না পারলে, জগতের এই বিশালতার সৌন্দর্য অনুধাবন করা যাবে না। এসব নায়ককে চিনতে না পারলে, নিজের ক্ষুদ্রতাকে কখনোই পরিমাপ করা যাবে না। মানুষ যদি নিজের ক্ষুদ্রতাই পরিমাপ করতে না পারে, সে কখনো বড় হতে পারে না। পরিপূর্ণতার অতৃপ্তি তাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তোলে।
বড় হতে হলে বড় নায়ক চিনতে হয়। বড় মানুষদের জানতে হয়। তাদের কর্ম জানতে হয়। বড় হতে হলে বড় মানুষদের কথা অকৃপণভাবে তুলে ধরতে হয়। বড় হতে হলে, নায়ক চেনো। জাহিদ হাসান, সাইফ সালাউদ্দিন, সাইফ ইসলাম, ফজলুর রহমান খান–এঁদের মতো নায়ক। যারা জন্মান ছোট্ট এক ঘরে-হয়ে যান সারা দুনিয়ার!