অন্তরতর গবেষক – ভবেশ দাস
তিনি আরেকরকম করে দেশটাকে চিনতে চেয়েছিলেন। চেনাতে চেয়েছিলেন সকলকে। যেরকম করে দেশটাকে চিনলে, তার সঙ্গে একটা নাড়ির যোগ অনুভব করা যায়, ঠিক সেইরকম তন্নতন্ন করে চেনা।
এক জার্মান কবির একটা লাইন আছে, ‘শিকড়ের ডানা হোক, ডানার শিকড়।’ শিকড় থেকেই তো ডানা, অর্থাৎ ডালপালা ছড়ায়। সেই ডালপালা ফুলে ফলে ভরে উঠলে, তা থেকে নতুন শিকড় বা অঙ্কুরোদগম হতে পারে। জীবনের কাজটাই এইরকম। শুধু নিত্যদিন ফুল ফুটিয়ে যাওয়া। কিন্তু শিকড় থেকে এই ডালপালা ছড়িয়ে দেওয়া, এই ফুল ফোটানো—এটাও একটা সাধনা, এটাও মগ্নতা, একাগ্রতা।
যাঁর প্রসঙ্গে এই কথাগুলো মনে আসছে তিনি আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম পুরোধা-পুরুষ সুধীরকুমার মিত্র। আজ তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হল। আগামীকাল ৫ই জানুয়ারি সুধীরকুমারের ১০১তম জন্মদিন। অঞ্চলচর্চা এবং গ্রাম গবেষণার দিশারি এই মানুষটি তাঁর ৮৪ বছরের জীবন জুড়ে আমাদের কাছে যে সম্পদ রেখে গেছেন, তা আমাদের আজও বিস্মিত করে।
মহাত্মা গান্ধীর একটা চিঠিতে তার এমন একটা দোলা লেগেছিল যে, তিনি শিকড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। জীবনের উৎসমূলে ঘুরে বেড়ানো আর জ্ঞানচর্চাই হয়ে গেল তাঁর জীবনধর্ম। ওটাই তাঁর সাধনা। প্রথমে শুরু করেছিলেন নিজেদের গ্রাম আর নিজের বংশ পরিচয়ের সন্ধান। কালীপ্রসন্ন সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্র সুধীরকুমার ছিলেন হুগলির জেজুর গ্রামের মানুষ। লিখে ফেললেন জেজুরের মিত্র বংশ নামে একটি আকর ও মৌলিক গ্রন্থ।
লিখে ফেললেন—শব্দ দু-টি অনায়াসে ব্যবহার করলাম বটে, কিন্তু এর জন্য তাঁর অনেকটাই অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে। খুঁজে বের করেছেন, ‘কোথা এলেম আমি’—অর্থাৎ তার পরিচয়ের ইতিহাস, তাদের আগে মিত্র বংশের কারা ছিলেন, তারও আগে কারা, তারও তারও আগে কারা। এভাবেই তো উৎসমুখে যাওয়া, উৎসেরও উৎসে যাওয়া। এই যে একটা পরিবারের, অতীতে প্রবাহিত বিস্তৃত ছড়ানো জীবন, তার মধ্যে সমসাময়িক সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতির কত উপাদান মিশে থাকে, শিকড়ের সন্ধানে হাঁটলে তার তো হদিশ মেলে।
এ-রকম শিকড়সন্ধান করে কী লাভ? একই মাটিকে আঁকড়ে মাথা উঁচু করে আছে এত গাছ, কিন্তু কোনো একটা কারণে ছিন্নমূল হলে কী হবে? তাহলে কি আমাদের সকলেরই টুকরো টুকরো জন্ম-মৃত্যুর টুকরো টুকরো ইতিহাস। এই খন্ডিত ইতিহাস দিয়ে কী করব আমরা? অতীতের সন্ধান করলে দেখব, কোথাও আমরা পরস্পরের সাথে মিশে আছি।
১৯৩৩ সালে মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলেন সুধীরকুমার মিত্র। দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর ২ নম্বর কালী লেনের বাড়িতে এসেছিল এই চিঠি। তাতে লেখা ছিল ‘আজ দেশের যা অবস্থা এই মুহূর্তে হরিজনদের নিয়ে আন্দোলন না করাই ভালো। তাই ওই বিষয়ে প্রকাশিতব্য কোনো পত্রিকায় আমার লেখা সম্ভব নয়।’ এই চিঠি পড়েই তিনি প্রথম তাঁর পরিবারের বংশলতিকা রচনায় নেমে পড়লেন। এক বছরের মধ্যেই লিখেছিলেন জেজুরের মিত্র বংশ। রবীন্দ্রনাথ এই জেজুরের ইতিহাস পড়ে সুধীরকুমারের কাজের প্রশংসা করেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ কলকাতায় একটি কলেজ ও তিনটি বিদ্যালয় স্থাপনে মন দিয়েছিলেন।
আজ সকালে ২ নম্বর কালী লেনে সুধীরকুমারের বাড়ির গায়ে একটা অত্যন্ত সংকীর্ণ গলিতে তাঁর স্মৃতিফলক উন্মোচিত হল। তখন মনে হচ্ছিল, ১৯৪১ সালে এই বাড়িতে বঙ্গভাষা সংস্কৃতি সম্মেলন নামে সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন সুধীরকুমার। এই সংস্থাটির উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘জগতের মধ্যে যে ভাষা সর্বাপেক্ষা ঋদ্ধিমতী সে-ভাষাকে তদপেক্ষাও ঋদ্ধিমতী করিয়া তোলাই ইহার একমাত্র লক্ষ্য। এই যে লক্ষ্য ইহা বাঙালির পক্ষে দুরাশাও নহে, অসম্ভব নহে। যে জাতির মধ্যে জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ ও জ্ঞানচন্দ্রের ন্যায় বৈজ্ঞানিক এবং রবীন্দ্রনাথের ন্যায় কবির আবির্ভাব সম্ভব, সে-জাতির পক্ষে এই লক্ষ্যলাভের নিমিত্ত একমাত্র আবশ্যক বস্তু একাগ্রতা। … আমাদের চরিত্রে এবং ভাষায় হিমাদ্রির দৃঢ়তা এবং সাগরের গভীরতা সঞ্চারিত করো সর্বসাধনার ফুলদলে তোমারই উদ্দেশে অঞ্জলি রচনা করিবার অভিলাষ গঙ্গা প্রবাহের ন্যায় চিরদিন চিত্ততলে সঞ্চারণ করা হত।
প্রবীণ ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরি আজ এই দু-নম্বর কালী লেনের বাড়ির কাছেই সুধীরকুমার স্মৃতি ফলকটির উন্মোচন করলেন।
অনেক ইতিহাসবিদই বলেছেন, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ নামে তিন খন্ডে যে আকরগ্রন্থ সুধীরকুমার আমাদের দিয়েছেন, আর যদি কোনো কাজ তিনি না করতেন, তবুও আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকত। তবু তিনি লিখেছেন, হুগলী জেলার দেবদেউল, তারকেশ্বরের ইতিবৃত্ত, লিখেছেন দক্ষিণের দেবস্থান, দিব্যপথের দিশারী-র মতো ৪০টি গ্রন্থ। জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন অন্তত ৫০টি। প্রবন্ধ লিখেছেন ৬০০। ৬/৭টি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন।
সুধীরকুমারের এই যে অনুসন্ধান কাজ তার জন্য তিনি ১৮০০ গ্রাম ঘুরেছেন একাধিকবার, তথ্যের পরে তথ্য, আরও তথ্য জানার জন্য অনন্তকাল হেঁটেছেন। মানুষের মুখের কথা-কাহিনি মন দিয়ে শুনেছেন, কোনো একটি ছোট্ট নিদর্শন, দলিল, চিঠি, পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন। নির্বিচারে নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাচাই করে তবে তা গ্রহণ করেছেন। এভাবেই সুধীরকুমার এঁকেছেন প্রচলিত ইতিহাসের অন্তরতর ইতিহাস।
এত উত্তেজনা ও অস্থিরতার কালেও কালী লেনের ওই সংকীর্ণ গলিতে আজ কলকাতা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল সুধীরকুমারকে।
[আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের কথিকানুষ্ঠান ‘সমীক্ষা’য় প্রচারিত। তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০০৯]