অনেক প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন – মানস চক্রবর্তী

অনেক প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন – মানস চক্রবর্তী

গভীর শোকের জন্য মানসিক প্রস্তুতিটা ছিলই৷ জুন মাসের মাঝামাঝি তিনি যখন ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তখন থেকেই আশঙ্কাটা দানা বাঁধছিল মনে৷ তবে কি এবার…? মাঝে তো রটেই গেল যে তিনি নেই৷ কিন্তু বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদয়ালয়ের ডাক্তারদের ঐকান্তিক চেষ্টায় আশঙ্কার কালো মেঘটা আস্তে আস্তে সরে গেল৷ তিনি সুস্থ হওয়ার পথে৷ আবার খাচ্ছেন৷ লিকুইড৷ একটু-আধটু কথাও বলছেন৷ নিজের গানের ক্যাসেট শুনছেন৷ চোখ দিয়ে নেমে আসছে জলের ধারা৷ ছোট মেয়ে সুমিতা এবং ছোট জামাই জ্ঞানরঞ্জন হাসপাতালকে বলে রেখেছেন তাঁদের অনুমতি ছাড়া কাউকে যেন তাঁর ঘরে ঢুকতে না দেওয়া হয়৷ কলকাতা থেকে জনা দশেক ভক্ত এবং অনুরাগী তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন৷ হাসপাতাল চত্বর থেকেই ফিরে এলেন তাঁরা৷ শুধু দেখা করার অনুমতি পেলেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি৷ বড় মেয়ে সুরমার বন্ধু৷ কন্যাসমা কবিতার সঙ্গে কথাও হল কিছুক্ষণ৷

মান্না দে তা হলে এবারের মতো বিপদটা কাটিয়ে উঠলেন৷ কোনও খবর নেই তাঁর৷ কোনও খবর না থাকা মানে খারাপ আর নেই৷ কিন্তু তিনি তো এখনও হাসপাতালে৷ বাড়ি ফিরবেন কবে? এই প্রশ্নের জবাব কেউই দিতে পারছেন না৷ শেষ পর্যন্ত এই উত্তরটা আর দিতে হল না৷ মান্না দে আর বাড়ি ফিরলেন না৷ ২৪ অক্টোবর, ২০১৩৷ ভোর রাতেই চিরবিদায় সুরসম্রাটের৷

>> মনটা তৈরিই ছিল৷ তবু শেষ সংবাদটা মানতে কষ্টই হচ্ছিল৷ বয়স ৯৪+৷ অনুতাপ থাকার কথা নয়৷ তবু ছিলেন তো৷ ইদানীং ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ তাঁর ল্যান্ডলাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল৷ যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে মোবাইল টাওয়ার মাঝে মাঝেই সমস্যা করত৷ তাই কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে উঠতেন৷ লাইন কেটে যেত৷

>> স্ত্রী সুলোচনা চলে যাওয়ার পর (১৯ জানুয়ারি, ২০১২) থেকে মান্না দে বড্ড একা হয়ে যান৷ বাড়িতে গৃহবন্দীই বলা যায়৷ মেয়ে-জামাইরা তাঁদের কাজে ব্যস্ত৷ তাই তালা দিয়ে রেখে দেওয়া হত তাঁকে৷ ফোন প্রায় নেই৷ বহির্জগতের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই৷ এ যেন শেষ জীবনে ফতেপুর সিক্রিতে বন্দী সম্রাট সাজাহান৷ নিজের এই বন্দী জীবন নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে খুব নিকটজনের কাছে চোখে জল নিয়ে বলতেন, ‘কেন যে মরছি না! আর ভাল লাগছে না৷’

>> দুঃসংবাদটা সয়ে যাওয়ার পর এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল৷ শেষ জীবনটা এরকম কষ্টের মধ্যে না কাটলেই ভাল হত৷

শেষ দেখা

২০১১-র পয়লা মে৷ বেঙ্গালুরুর ইন্দিরা নগরের বাড়িতে আমরা হাজির৷ একটু বেলাই হয়ে গিয়েছিল৷ বারোটা বেজে গেছে৷ আসলে আমাদের এক বন্ধুর স্ত্রী পায়েস রাঁধতে বসল৷ পায়েস তৈরি করতে একটু সময় তো লাগবেই৷ তা ছাড়া মান্নাদার বাড়িটাও শহর থেকে বেশ দূরে৷ আমরা পৌঁছবার আগেই প্রচুর ফোন এসেছে৷ আর সে-সব ধরতে ধরতে তিনি ক্লান্ত৷ আমরা গিয়ে বসতে না বসতেই আবার ফোন৷ উনি বললেন, ‘ফোনটা ধর৷ যা উত্তর দেওয়ার তুমিই দিয়ে দাও৷’ ফোনটা ধরলাম৷ বলাই বাহুল্য, তাঁকে চেয়েই ফোন৷ আমিই অনুরোধ করলাম৷ না বললেন না৷ শরীর যে তখন খুব ভাল ছিল তা নয়৷ কিন্তু মনটা ছিল ফুরফুরে৷ চেয়ারেই বসতেন৷ সামনে থাকত ওয়াকার৷ শেষ তিন বছর বাড়িতে ওয়াকার নিয়েই থাকতেন৷ তা গান হচ্ছে একটার পর একটা৷ বাজছে হারমোনিয়াম৷ হঠাৎ গান থামিয়ে প্রশ্ন, আচ্ছা আমার গান এত জনপ্রিয় কেন বলত? কঠিন প্রশ্ন? একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না৷ আমতা আমতা করে বললাম, আপনার গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই বাণীপ্রধান গান৷ কথার সেখানে বিরাট ভূমিকা…৷

আমাকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই বললেন, ‘কথা পছন্দ না হলে আমি গাইবই না৷ কতবার যে পুলক-গৌরীকে আমি কথা পাল্টাতে বলেছি৷ এবং একটু-আধটু পাল্টানোর পর গানটা অন্য চেহারা নিয়ে নিয়েছে৷ আগে কথা তার পর তো সুর৷’ বলেই ধরলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই গানটা—

লাল মেহেন্দির নকশা হাতে/ তুললে যখন গোলাপ কুঁড়ি/ বেশ মিষ্টি একটা আওয়াজ হল/ বাজল কটা কাচের চুড়ি/ তোমার নামটা কী গো বল সখী৷

এরপর কেটে কেটে কথাগুলো বললেন অনেকটা আবৃত্তির মতো৷ তার পর আবার গানে ফিরলেন?

কথায় কথায় উঠল রবীন্দ্রনাথের কথা৷ মান্না দে-র হৃদয়ের মানুষ৷ মান্না দে যে কত বড় রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন তা তাঁর কাছের মানুষরা জানেন৷ বড় দুঃখ ছিল তাঁর৷ যে হেমন্ত, দেবব্রতর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেননি৷ গেয়েছেন গোটা কুড়ি মতো গান৷ কিন্তু তাতে মন ভরেনি৷ ‘আরও অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার৷ কিন্তু সেভাবে সুযোগ আসেনি৷ ভাবছি আবার যদি রেকর্ড করার সুযোগ থাকে তা হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইব৷’ এবং শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাও হয়েছিল৷ স্ত্রী বিয়োগের পর স্ত্রীকে উৎসর্গ করে চারটি আর দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা অ্যালবাম বেরোবার প্রস্তুতিও ছিল সারা৷ ট্র্যাকও হয়ে গিয়েছিল৷ দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা গান৷ সুর নিজের৷ মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট শান্তনু বসুর৷ বেঙ্গালুরু থেকে রাতে টেলিফোনে সুর বার বার বদলাতেনও৷ রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল বেঙ্গালুরুর বাড়িতেই৷ শেষ পর্যন্ত তা অবশ্য হল না৷ কোলন ক্যান্সারে ভোগা বড় মেয়ে সুরমাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বলে যে আর চিকিৎসা করে লাভ নেই৷ এই খবরটা পেয়ে এতই ভেঙে পড়লেন যে রেকর্ডটা আর করা হল না৷

সেদিনের সেই দুপুরে অনেকক্ষণ আড্ডা হওয়ার পর মান্নাদা বলেছিলেন, ‘আমি আবার গান করব৷ কলকাতায় যাব৷ তবে এবার এমন একটা অনুষ্ঠান করব যে শুধু হিন্দি গান গাইব৷ কলকাতার মানুষ আমার গোটা দশেক হিন্দি গানের অনুরোধ করে শুধু৷ কিন্তু আমার যে কত প্রিয় হিন্দি সিনেমায় গান আছে! এক একটা গান যেন এক একটা ইতিহাস৷ একটা গান তৈরির পিছনে কত যে গল্প৷ সেই গানগুলো নিয়েই একটা সন্ধে ভাল চলে যাবে৷’ দুঃখের কথা মান্না দে-র সেই আশাও পূর্ণ হয়নি৷ ২০১০-এর পয়লা মে মহাজাতি সদনে শেষ বারের মতো গান গেয়েছিলেন তিনি৷ প্রায় আড়াই ঘণ্টা, তারপর অনেকবার সম্মতি দিলেও শেষমুহূর্তে শারীরিক অক্ষমতার জন্য বাতিল হয়েছে৷

পুলক-গৌরীপ্রসন্ন

সেই ১৯৪৩ থেকে ২০০৯৷ মান্না দে গান গেয়েছেন৷ হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, মালয়ালি, মারাঠি, অসমিয়া, ভোজপুরী…৷ হিন্দি ফিল্মের গান দিয়ে শুরু৷ বাংলা গানে আসা দশ বছর পরে৷ এ ব্যাপারে তিনি ব্যতিক্রম৷ বঙ্গদেশ থেকে যাঁরাই মুম্বই গেছেন তাঁরা বাংলা দিয়েই শুরু করে পাড়ি দিয়েছেন মুম্বই৷ মান্না দে কাকার হাত ধরে শুরু থেকেই মুম্বই৷ বাবার ইচ্ছে ছিল সেজো ছেলে প্রবোধচন্দ্রকে উকিল বানাবেন৷ কিন্তু কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র উৎসাহে এবং মায়ের অনুমতি নিয়ে সুবোধচন্দ্র পাড়ি জমালেন বলিউডের উদ্দেশে৷ অবিভক্ত ভারত৷ সারা ভারতের শিল্পীদের মিলন মেলা তখন বোম্বে৷ কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা৷ তবু ওরই মধ্যে গুটিকয়েক বঙ্গসন্তান লড়ছেন৷ কৃষ্ণচন্দ্র দে, অনিল বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মণ…৷ ওঁদেরই সঙ্গে তরুণ প্রবোধচন্দ্র৷ ডাক নাম মানা৷ আর ওই মানা থেকেই মান্না৷ মান্না দে৷ বলতেন, ‘আমার জন্ম পয়লা মে৷ যাকে বলে মে ডে৷ ও দিনটা আবার মহারাষ্ট্র দিবস৷ তার মানে মে মাসের প্রথম দিনটা হল মে ডে, মহারাষ্ট্র ডে এবং মান্না ডে৷

১৯৪৩-এ কাকার সুরে তমান্না ছবিতে একটা গান৷ আর একটু পরে রামরাজ্য ছবিতেও একটি৷ সুরকার শঙ্কর রাও ব্যস৷ তারপর দীর্ঘ সাত বছর বসে থাকা৷ ১৯৫০-এ মশাল ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানের পর পায়ের তলায় একটু মাটি পাওয়া৷ সুর শঙ্কর জয়কিষান৷ তার পরেও লড়াই৷ লড়াই৷ আর লড়াই৷ সারা বছরে একটা কি দুটো গান৷

এরই মধ্যে বাংলা বেসিক গানের ডাক এল৷ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা৷ নিজেই সুর করলেন৷ ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো’৷ আর ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’৷ সুর নিজেরই৷ বাঙালি তখন নতুন এক গায়ককে চিনল৷ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন আরও সাত বছর পরে৷ ‘আমার না থাকে যদি সুর’ এবং ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’৷ ‘গৌরী আর পুলক৷ আমার গান জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে ওদের অনেক ভূমিকা আছে৷ পরের দিকে একটা demarcation হয়ে গিয়েছিল ওদের৷ পুলক বেসিক গানে দুর্দান্ত৷ গৌরী আবার স্বচ্ছন্দ ফিল্মের গানে৷ ও ফিল্মের জন্য কী সব গান লিখেছে গৌরী৷ ওর গানের মধ্যে একটা নাটকীয়তা ছিল যেটা সিনেমার গানে খুব দরকার৷’

মান্না দে নিজে মনে করতেন বাংলা গানে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭) এবং এই ফিল্মের সব গানই গৌরীপ্রসন্নের৷ সুর করেছিলেন অনিল বাগচী৷ কঠিন রাগাশ্রিত সুর করতেন অনিলবাবু৷ কথা হচ্ছিল তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুরকার-শিল্পী অধীর বাগচীর সঙ্গে৷ অধীরদা বলছিলেন, ‘মান্নাদা তো নোটেশন লিখে গান তুলতেন৷ ওই সময়ে পনেরো দিন টানা রিহার্সাল হয়েছিল৷ তা একদিন বাবাকে বললেন মান্নাদা, আপনি এত রাগ লাগিয়েছেন যে উত্তমকুমার লিপ দিতে গিয়ে মুশকিলে পড়বেন৷ আমি একটু রাগ কম লাগাচ্ছি৷’ আসলে ততদিনে মান্না দে রাজ কাপুরের লিপে অনেক গান গেয়ে ফেলেছেন যেগুলো সুপার-ডুপার হিট৷ তাই তিনি জানতেন বেসিক গান আর সিনেমার গানে কত তফাত৷ এবং পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমায় এক নম্বর গায়ক হয়েছেন মান্না দে৷ সেই ১৯৬৭ থেকে টানা এক দশক৷ এবং এই সময়ে বেশিরভাগ হিট গানই গৌরীপ্রসন্নের লেখা৷ যেমন চিরদিনের, নিশিপদ্ম, স্ত্রী, মৌচাক, সন্ন্যাসী রাজা৷ এক একটা মাইল স্টোন৷

পিছিয়ে কি ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ একেবারেই নয়৷ বাংলা সিনেমায় চিরকালীন রোমান্টিক গানের যদি র্যাঙ্কিং করতে হয়, তা হলে ১) এই পথ যদি না শেষ হয়, ২) কে প্রথম কাছে এসেছি এবং ৩) হয়ত তোমারই জন্য৷ প্রথমটি সপ্তপদীর৷ ডুয়েট গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়৷ দ্বিতীয়টি শঙ্খবেলার৷ গেয়েছিলেন মান্না দে ও লতা মঙ্গেশকর৷ এবং তৃতীয়টি মান্না দে-র একক৷ ছবি তিন ভুবনের পারে৷ শঙ্খবেলার গানটি পুলকের লেখা৷ তিন ভুবনের পারের কথা ও সুর দুটোই সুধীন দাশগুপ্তের৷

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এবং শঙ্খবেলা (১৯৬৮), মান্না দে-কে বাংলা ফিল্মে শক্ত মাটির ওপর দাঁড় করাল৷ শঙ্খবেলায় আরেকটি গান ছিল মান্নার৷ সেটিও পুলকের৷ আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম৷

‘একদিন মুম্বইয়ে একটা ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়েছে৷ হঠাৎ দেখি জানালার কাচ নামিয়ে উত্তম বলছে, আরে মান্নাদা কী কঠিন গান গেয়েছেন বলুন তো? এই দেখুন আমি টেপ রেকর্ডারে গানটা শুনতে শুনতে যাচ্ছি৷ এই গানে লিপ দেওয়া খুব কঠিন কাজ৷’ স্মৃতিচারণ করেছিলেন মান্না৷ উত্তম এবং সৌমিত্র— দুই কিংবদন্তির লিপে গান গেয়েছেন মান্না৷ উত্তমের লিপে তাঁর গান বিশাল জনপ্রিয় হয়েছে৷ তবু মান্নার পছন্দের মানুষ হলেন সৌমিত্র৷ ‘উত্তম খুবই দরদ দিয়ে গাইত৷ স্ত্রী, সন্ন্যাসী রাজা দুর্দান্ত৷ দারুণ আটিস্ট৷ দর্শকদের পালস বুঝত৷ আর সৌমিত্র হচ্ছে সফিসটিকেটেড৷ ওর সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় ভীষণ শিক্ষিত৷ সৌমিত্রের মধ্যে একটি অন্যরকম ব্যাপার আছে৷ আমার খুব ভাল লাগে৷’ বলতেন মান্না দে৷ পুলকের কথায় ফিরি৷ পুলক আর মান্না যেন made for each other৷ মান্না দে-র জন্ম পয়লা মে, পুলকের জন্ম দোসরা মে৷ মান্না দে অনেক ফরমায়েশ করেছেন৷ ‘এরকম থিমে একটা গান লিখুন তো৷ আরে আমার বউ একবার ঝগড়া করে চলে গেল বাপের বাড়ি৷ আমি বললাম, পুলকবাবু এমন একটা গান লিখুন যে সুলোচনা যেন ফিরে আসে৷ তো উনি লিখলেন৷ সেই তো আবার কাছে এলে৷ তো সেই রেকর্ড পাঠালাম সুলোচনার কাছে৷ ফিরে এল ক’দিনের মধ্যে৷’

একবার মান্না আর পুলক এক ভদ্রলোকের বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে ভুল করে অন্য একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লেন৷ দরজা খুললেন এক সিন্ধ্রি মহিলা৷ অপরূপ সুন্দরী৷ দু’জনেই দুঃখ প্রকাশ করে ফিরে এলেন৷ মান্না দে বললেন, ‘এই মহিলাকে নিয়ে একটা গান হবে না কি?’ পুলক লিখলেন, ‘ও কেন অতো সুন্দরী হল/ অমনি করে ফিরে তাকাল/ দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই৷’

আরও এক দিন৷ বিমানে পাশাপাশি সিটে বসে আসছেন দু’জনে৷ একজন বিমান সেবিকাকে দেখে খুব ভাল লাগল মান্না দে-র৷ পাশে বসা পুলককে বললেন, ‘দেখছেন তো৷ কেমন লাগছে৷’ পুলক হাসি চেপে বললেন, ‘খুব সুন্দরী৷’ মান্না দে বললেন, ‘গান হবে নাকি?’ পুলক বললেন দেখি৷ ক’দিনের মধ্যেই গান লেখা হয়ে গেল৷ সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান কোর না/ আজ নিশীথে কাছে থাক/ না বোলো না৷

শুধু একবারই পুলকের লেখা গান গাইতে পারেননি মান্না৷ সালটা ১৯৮৬৷ পুজোর গান নিয়ে পুলক হাজির মুম্বই৷ গানটা খুবই ভাল লাগল মান্নার৷ সুর করতে বসলেন৷ পুলক আসেন সকালে৷ দু’জনে বসে যান গান নিয়ে৷ তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে/ আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে/ তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বারান্দাতে/ শেষ দেখাটা দেখতে পাবে৷ সুর করছেন মান্না দে৷ ঘর-গেরস্থালির কাজের মধ্যে সুলোচনা শুনছেন গানটা৷ কথাগুলো শুনছেন৷ মনে গেঁথে যায়৷ একদিন বলেই ফেললেন, ‘মানা, এই গানটা গেও না৷ গানটার মধ্যে একটা কু ডাক আছে৷’ কী আর করা? গানটা পুলককে ফেরতই দিয়ে দেন মান্না৷ পুলক গানটা নিয়ে যান কিশোরকুমারের কাছে৷ গানটা পছন্দ হয় কিশোরের৷ তখন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় সুর করছেন ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবির৷ পুলকের গান মৃণালের পছন্দ৷ গান তৈরি হল৷ হিটও হল৷

পরের বছর পুজোর আগেই অকালে চলে গেলেন কিশোরকুমার৷ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে৷

কেউ কথা রাখেনি

বাংলা বেসিক গান কিংবা ফিল্মি গান দিয়ে মান্না দে-কে মাপতে যাওয়া মূর্খামি৷ ওটা সমগ্র মান্না দে-র একটা অংশ মাত্র৷ মান্না দে-র আসল জায়গা হল বলিউড৷ সেই ১৯৪৩ থেকে ২০০২— টানা ছয় দশক তিনি বলিউডের বাসিন্দা৷ এবং এক বারের জন্যেও মুম্বই ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য স্ত্রী এবং ছোট মেয়ের চাপে তাঁকে যেতে হল বেঙ্গালুরু৷ তবে মুম্বইয়ের পাট চুকিয়ে যেতে তাঁর একেবারেই ভাল লাগেনি৷ অন্ধ কাকার হাত ধরে মুম্বই এসেছিলেন৷ প্রথম দিকে ঠাকুর-দেবতার ছবিতে গান করতে হত৷ পৌরাণিক ছবিতে নারদ, রাম, শ্রীকৃষ্ণ কিংবা কোনও রাজা-রাজড়ার লিপে গান গাইতে গাইতেই প্রতিষ্ঠা৷ কিন্তু নায়কের লিপে গান কোথায়? সেই পঞ্চাশ দশকের শুরুতে নায়ক তো তিনজন৷ দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কাপুর৷ প্রথম জনের লিপে কোনও দিনই গান গাইবার সুযোগ হয়নি৷ দ্বিতীয় জনের লিপে এক আধটা৷ তবে রাজ কাপুরের লিপে বেশ কয়েকটি গান আছে যেগুলো কালের নিয়ম পেরিয়ে চিরদিনের হয়ে গেছে৷

রাজ কাপুরের কথা উঠলে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হতেন মান্না৷ বলতেন, ‘অসম্ভব sense of music ছিল রাজ সাবের৷ উনি নিজেই নায়ক, পরিচালক এবং প্রযোজক৷ আর গানের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে৷ যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজে সন্তুষ্ট হচ্ছেন ততক্ষণ মিউজিসিয়ানদের রেহাই নেই৷

শ্রী ৪২০ ছবির রেকর্ডিং হচ্ছে৷ পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া৷ গীতিকার প্রদীপ৷ সুর শঙ্কর জয়কিষানের৷ ফ্লোরে হাজির রাজ কাপুর নিজে৷ সঙ্গে বেবি (নার্গিস)৷ আমার আর লতার ডুয়েট৷ কিন্তু অন্তরা আর সঞ্চারীর পর একটা হামিং আছে৷ কিন্তু কিছুতেই সেটা রাজ সাবের পছন্দ হচ্ছে না৷ সকাল দশটায় শুরু হয়েছে রেকর্ডিং৷ সন্ধে ছ’টা বাজে, তবু গান তৈরি হল না৷ সবাই ক্লান্ত, আমরা সন্ত্রস্ত৷ রাজ সাব কী করবেন কেউ জানে না৷ তখন আমি সাহস করে হামিংটা দিলাম৷ লা লা লা, লা লা…৷ পছন্দ হল রাজ সাবের৷ জড়িয়ে ধরলেন বেবিকে৷ গোটা ফ্লোরে স্বস্তি৷ ওই দিনই রেকর্ড করা হল৷ সবকিছু মিটতে রাত ন’টা৷

বুট পালিশ ছবির রেকর্ডিং হচ্ছে৷ দিল কা হাল শুনে দিলওয়ালা৷ এই বার গানের মাঝে একটা হামিং ছিল… চু চু ক, চু চুক৷ রাজ সাবের নিজের দেওয়ার কথা৷ তিনি চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু ঠিক হচ্ছে না৷ নিজেই বুঝতে পারছেন৷ অগতির গতি মান্না দে৷ ‘মান্নাদা৷ আপনি একটু চেষ্টা করুন৷’ মান্না চেষ্টা করলেন এবং পারলেন৷ রাজ কাপুর জড়িয়ে ধরলেন মান্না দে-কে৷ দু’গালে দুটো চুমু খেলেন টপাটপ৷ এবং বললেন, ‘আমি যত দিন সিনেমা করব, আপনার গান বাঁধা৷’ কথা রাখেননি রাজ৷ তাঁর ‘সঙ্গম’ ছবিতে গান গাইবার সুযোগ পাননি৷ এ নিয়ে বিস্তর দুঃখ ছিল মান্না দে-র৷ আবার ‘মেরা নাম জোকার’-এ মান্নার ভাগ্যে জুটল একটা গান৷ ‘এ ভাই জরা দেখখে চলো’৷ ওই ছবিতেই মুকেশের গলায় ‘জানে কাঁহা গয়ে ও দিন’ গানটাও সুপার হিট৷ কিন্তু সারা ভারত গাইল মান্না দে-র গানটাই৷ জুটল ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারও৷

রাজ কাপুরের মতোই মান্না দে-র শ্রদ্ধা শচীনকর্তার ওপর৷ সেই শুরুর দিন থেকে মান্নাকে ভ্রাতৃস্নেহে পালন করেছেন শচীন দেব বর্মণ৷ প্রবাসে দুই বাঙালি অনেক সংগ্রাম করেছেন৷ দু’জনেই ছিলেন ফুটবল পাগল৷ কর্তা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক, মান্না মোহনবাগানের৷ রোভার্স খেলতে দুই প্রধান মুম্বই গেলে দু’জনেই মাঠে যেতেন৷ এই ক্লাব ওই ক্লাবকে হারালে হাসিঠাট্টা, টিটকিরি চলত৷ একবার তো শচীনকর্তা রেগে গিয়ে বললেন, ‘মর তোরা, মোহনবাগান মোহনবাগান কইর্যা মর৷ গান বাজনা আর করতে হইব না৷’

এক সময় দু’জনেই থাকতেন হোটেলের ভাড়া ঘরে৷ তো একদিন হোটেলের ঘরেই দুপুরের খাওয়া খেতে বসেছেন দু’জনে৷ হোটেল থেকে খাবার দিয়ে গেছে৷ শচীনকর্তা বললেন, মানা৷ ওই আলমারি থিকা ঘিয়ের শিশিটা লইয়্যা আয়৷ তোর বৌদি ঘি পাঠাইছে৷ এরপর মান্না বললেন, ‘তো আমি ঘিয়ের শিশিটা নিয়ে এলাম৷ শচীনদা নিজে একটু ঘি নিলেন চামচে করে৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু ঘি নিবি নাকি? থাক দরকার নেই৷ তুই এমনিই খা৷’

এই ঘটনার অনেক পরে তখন দু’জনেই প্রতিষ্ঠিত৷ নিজেদের বাড়িঘর হয়ে গেছে৷ ভিলে পালেতে মান্না দে-র বাড়ির নাম আনন্দন৷ সন্ধ্যায় ফোন এল কর্তার৷ ‘তুই বাড়িতে আছিস তো৷ আমি আইত্যাছি৷’ তো আধ ঘণ্টার মধ্যে কর্তা এলেন৷ বললেন, ‘আমাকে একটা হুইস্কির বোতল আর জল দে৷ বউমাকে বল পাঁপড় ভাজতে৷’ এরপর এক চামচ হুইস্কিতে এক গ্লাস জল ঢেলে আর একটা সেঁকা পাঁপড়ে আঙুল নাড়তে নাড়তে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন৷ আসলে দক্ষিণ ভারতের এক প্রযোজক নাছোড়বান্দা৷ তাঁর মালয়ালি ভাষায় ছবির সুর করে দিতে হবে৷ এক লক্ষ টাকা দেবে৷ কিন্তু ভাষার ওপর দখল নেই বলে সুর করতে রাজি হননি৷ কিন্তু সন্ধেয় সেই প্রযোজক আবার আসবেন বলে সকালে চলে গেছেন৷ তাকে এড়াতেই মান্নার বাড়িতে কর্তার অজ্ঞাতবাস৷ এহেন শচীনকর্তার কাছ থেকেও ‘ব্যথা’ পেতে হয়েছে মান্না দে-কে৷ ‘একদিন সাতসকালে শচীনদার ফোন৷ মানা, একবার আমায় বাসায় আয় তো৷ একটা ভাল সুর করছি৷ তোরে গানটা তোলাব৷ তড়িঘড়ি গেলাম৷ কর্তা সুর করলেন৷ আমি নোটেশন নিয়ে গানটা তুললাম৷ কর্তা বললেন, যা বাড়ি গিয়া প্র্যাকিটস কর৷ সুরটা খাসা হইবো৷ তুই গাইসিসও ভাল৷

সন্ধ্যায় আবার কর্তার ফোন৷ ‘শোন, গানটা শেষ পর্যন্ত রফিকে দিয়াই গাওয়াইলাম৷ ভালই গাইসে রফি৷’ গানটা ছিল নাচে মন মেরা৷ ছবির নাম তেরি সুরত মেরে আঁখে৷ এই ছবিতেই মান্নার অবশ্য একটা গান ছিল৷ সেটাও সুপার হিট৷ পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে৷

রফি-কিশোর-আশা-লতা

মান্না দে বলতেন, ‘মহম্মদ রফি হচ্ছে ভারতের অল টাইম গ্রেট৷ ওইরকম সিঙ্গার আর ভারতে জন্মাবে না৷ অসাধারণ ক্ল্যাসিকাল গলা৷ পরের দিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফাস্ট সং-ও গাইত৷ আর ছিল অসম্ভব সিরিয়াস৷ গান ছাড়া আর কিছু বুঝত না৷ কোনও রকম নেশা ছিল না৷ তবে খেতে খুব ভালবাসত৷ আমরা একবার শোলাপুর যাচ্ছি গান গাইতে৷ ফার্স্ট ক্লাসে আমি আর রফি৷ স্টেশন এলেই জানালা একটু তুলে যা-ই পাচ্ছে কিনে নিচ্ছে৷ আলুর দম, আলুকাবলি, ঝালমুড়ি, পাওভাজি৷ আমি বললাম, এত খাচ্ছ, গান গাইবে কী করে? বলল, হো জায়গা৷ আসলে ঈশ্বর দত্ত গলা৷ যা ইচ্ছে করতে পারত৷

এই রফিই শেষদিকে গুমরে গুমরে মরে গেল৷ আরাধনার পর থেকে গোটা বলিউড ঝাঁপিয়ে পড়ল কিশোরের পিছনে৷ রফির গানের সংখ্যা কমতে লাগল৷ যে লোকটা দিনে দশ বারো খানা করে গান রেকর্ড করত, তার মাসেই দশটা গান নেই৷ আমাকে একদিন বলল, আরে মান্নাদা এসব ক্যায়া গানা হোতা হ্যায়? গাতা রহে মেরা দিল৷ ইতনা শোর মাচাতা হ্যায়৷ আমি বললাম, কী আর করবেন, মানিয়ে নিন৷ চলতি কী নাম গাড়ি৷ কিন্তু ওটা বলা সহজ৷ মেনে নেওয়া কঠিন৷ গোটা সত্তর দশকটা গুমরে গুমরে রফি আশি সালে মারাই গেল৷ অত কম বয়সে মৃত্যু ভাবাই যায় না৷’

আর কিশোর কুমার? মান্না দে বলতেন, ‘ভার্সেটাইল জিনিয়াস৷ সব ধরনের গানেই স্বচ্ছন্দ৷ এক সময় ওরও খারাপ সময় গেছে৷ তখন সিনেমা প্রাোডিউস করেছে৷ তেমন গান ছিল না৷ সব রফিই গাইত৷ কিন্তু আরাধনার পর অন্য চিত্র৷ হিন্দি সিনেমায় তো দুটো যুগ৷ পঞ্চাশ থেকে সত্তরের কয়েক বছর আগে রফি৷ আর তারপর কিশোর৷’

আর আপনি? ‘আমি হলাম ইটারনাল স্ট্রাগলার৷ আমার যুগ হবে কী করে? গানই তো নেই৷ একটা ছবিতে রফির গান আটটা৷ একটা আমার৷ একটা ছবিতে কিশোরের গান সাতটা৷ আমার সেই একটা৷ এমনকি রাজ সাহেবের ছবিতে মুকেশ সাত-আটটা গান গেয়েছে৷ আমার ভাগ্যে একটা৷ খুব বেশি গান আমি করার সুযোগ পাইনি৷ কিন্তু যা পেয়েছি তাতে ভারতবর্ষে যতদিন গানবাজনা থাকবে ততদিন মানুষকে আমার গান শুনতে হবে৷’

কথার মাঝখানেই উঠত লতা-আশার প্রসঙ্গ৷ এই দুই কিংবদন্তি বোনের সঙ্গে মান্না দে-র দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক৷ তবে মান্নার দুর্বলতা একটু বেশি আশার ওপর৷ ‘লতা হচ্ছে নাইটিঙ্গল অফ ইন্ডিয়া৷ ওর গলায় সরস্বতী৷ ওর গলার মেলোডি অসাধারণ৷ পঁচিশ হাজার গান গেয়েছে এক জীবনে৷ সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে সত্তর-পঁচাত্তর পর্যন্ত৷ ও যে সব নায়িকার লিপে গান গাইত, তাদের নাতনির বয়সী মেয়েদের লিপেও গান গেয়েছে৷ ভাবাই যায় না৷ তবে আশার ভার্সেটিলিটি অনেক বেশি৷ এক সময় ওকেও প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে হয়েছে৷ ওই মঙ্গেশকর পরিবার থেকে তেরো বছর বয়সে ভোসলের হাত ধরে বেরিয়ে না গেলে ও আশা ভোসলে হতে পারত না৷ সেই বোরিভেলি থেকে ট্রেনে করে আসত বাড়িতে দুই ছেলেমেয়েকে রেখে৷ প্রথম দিকে ওকে তো গানই দিত না৷ ও পি নৈয়ারই ওর কদর বুঝেছিল৷ তার পর পঞ্চম৷ পঞ্চমই আশাকে আশা করল৷’

পঞ্চম আর আশার বিয়ের সময়েও মান্নার ভূমিকা ছিল৷ মান্না দে বলতেন, ‘ভূমিকা নয়৷ আশা আমাকে একটু মান্যিকরত৷ তা একদিন আমি স্টুডিওতে গেছি গান গাইতে৷ আশা ছিল তখন ওখানে৷ আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, আপনি কি গান হয়ে গেলে বাড়ি চলে যাবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ৷ ওরা সবাই জানত যে স্টুডিও থেকে সবসময় বাড়ি চলে যাই৷ তা আশা বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে৷ একটু থাকবেন৷

রেকর্ডিং-এর পর আশা এল৷ বলল, ‘আপনি তো জানেন, পঞ্চমের সঙ্গে আমার একটা চক্কর চলছে৷ আমি বললাম, সে তো সারা ভারতবর্ষ জানে৷ আশা বলল, আমরা বিয়ে করছি৷ আপনার আশীর্বাদ চাই৷ আমি বললাম, আঈ (মা) জানে? ও বলল হ্যাঁ৷ আমি বললাম দিদি জানে? আশা বলল, ‘ও চুরাইল কো কিঁউ বোলেগা?’ চুরাইল মানে হল ডাইনি৷ আমি বললাম না, না৷ তা হয় না৷ লতাকে অবশ্যই বল৷ ও তোমার দিদি৷ তা আমার কথায় আশা বিয়েতে বলেছিল লতাকে৷ আমার ভূমিকা ওইটুকুই৷’

আশার মতো পঞ্চম মানে রাহুল দেব বর্মনও ছিলেন মান্নার খুবই স্নেহের৷ ‘আরে পঞ্চম তো বর্ন আর্টিস্ট৷ ওর বাবার চেয়েও বড় সুরকার৷ এ দেশের সর্বকালের সেরা সুরকারও বলা যায়৷ জন্মাবার পর খুব কাঁদত৷ ওর কাঁদার মধ্যেই শচীনদা একটা রাগের আওয়াজ পেতেন৷ একদিন বলেই ফেলেছিলেন, আরে এ তো পঞ্চম রাগে কাঁদছে৷ যা তোর নাম দিলাম পঞ্চম৷

ভীষণ দুষ্টু ছিল পঞ্চম৷ আমাকে একদিন বলল, আমি তোমাকে আঙ্কল-টাঙ্কল বলতে পারব না৷ আমি মান্নাদাই বলব৷ ওর প্রথম ছবিতেই গাইয়েছিল আমাকে৷ তারপর পড়োশন তো ইতিহাস৷ অসম্ভব বৈচিত্র ছিল সুরের মধ্যে৷ ইন্ডিয়ান মিউজিকের ভাবটা অক্ষুণ্ণ রেখেও ওয়েস্টার্ন মিউজিককে মেশাত দুর্দান্তভাবে৷ সত্যিকারের জিনিয়াস ছিল ও৷ শেষ দিকটা মানসিক কষ্টে ছিল৷ চলেও গেল অকালে৷’

সেই সব পুত্র কন্যারা

একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই যে টিভি-তে এত রিয়্যালিটি শো হয়৷ তাতে শ্রদ্ধেয় শিল্পীরা বিচারক হয়ে বসেন৷ আপনাকে তো কোনও দিন বসতে দেখলাম না৷ মান্না দে বলতেন, ‘আমার কাছে প্রচুর অনুরোধ এসেছে৷ আমি কাউকেই হ্যাঁ বলিনি৷ তবে হ্যাঁ, বিচারকদের নিয়ে যদি কোনও রিয়্যালিটি শো হয়, তবে আমি বিচারক হতে রাজি আছি৷’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘একবার অবশ্য আমি একটা কম্পিটিশনে বিচারক হয়েছিলাম৷ কেরলে একটা কলেজের ছেলেমেয়েদের কম্পিটিশন৷ আমার সঙ্গে আরেকজন বিচারক ছিল দেব আনন্দ৷ একটা ছেলের গান শুনে দেব সাহেবের খুব ভাল লাগল৷ আমাকে বলল, লড়কা আচ্ছা গাতা হ্যায় মান্না দা৷ আমি বললাম হ্যাঁ৷ লেকিন থোড়া টিউনিং লাগে গা৷ দেব বলল, উসি লিয়ে তো আপ হ্যায়৷ শেষ পর্যন্ত ওই ছেলেটাই ফার্স্ট হল৷ ওর সঙ্গে কথা বললাম৷ কিছু পরামর্শও দিলাম৷ ছেলেটার নাম হরিহরণ৷

পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি ছিল মান্না দে-র অগাধ স্নেহ৷ প্রশংসায় তিনি ছিলেন অকৃপণ৷ সব সময় বলতেন, ‘এই ছেলেমেয়েগুলো আরও জনপ্রিয় হত, যদি আমাদের সময়কার গীতিকার আর সুরকার পেত৷’ কলকাতার হৈমন্তী শুক্লাকে ভীষণ ভালবাসতেন৷ রাতে ফোন করে অনেকক্ষণ গল্প করতেন৷ স্নেহ করতেন অজয় চক্রবর্তীকেও৷ বলতেন, ‘অজয় আমার চেয়ে অনেক বড় গায়ক৷’ মুম্বইয়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ভালবাসতেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে৷ বড় মেয়ে সুরমার বন্ধু ছিল কবিতা৷ সেই সূত্রে আলাপ৷ খুব ছোট বয়স থেকেই মান্না দে-র সঙ্গে বিদেশে গান গাইছেন৷ মেয়ের মতোই দেখেছেন সারা জীবন৷ সেই কবিতাকেই একদিন প্রচণ্ড বকলেন মান্না৷ দেওয়ালির সময় মিষ্টি নিয়ে ‘আঙ্কল’-কে প্রণাম করতে এসেছেন কবিতা৷ আর তাঁকে দেখেই ঝেঁঝে উঠলেন মান্না৷ ‘আরে তুমি ওই গানটা গাইলে কী করে? মেয়ে হয়ে ওই গানটা গাইতে তোমার লজ্জা করল না? কোনও মেয়ের কি গাওয়া উচিত ম্যায় চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত৷ খুবই খারাপ কাজ করেছ৷ কবিতা তখনও হাত থেকে মিষ্টির বাক্স রাখেননি৷ চোখে জল এসে গেল তাঁর৷ বাঁচালেন সুলোচনা৷ কোনও রকমে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতর৷ আবার এই কবিতা যখন কিংবদন্তি শিল্পী এল সুব্রহ্মনিয়ামকে বিয়ে করলেন খুব খুশি হয়েছিলেন মান্না৷ সপরিবারে উপস্থিত থেকে আশীর্বাদ করেছিলেন৷

খুব ভাল লাগত সোনু নিগমের গান৷ বলতেন, ‘বয়সটা কম থাকলে ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়তে ভাল লাগত৷ এ রকম ক্ল্যাসিকাল বেস আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না৷’ আর এ আর রহমান? ‘আরে ওই রকম বন্দে বলে টান দিলে মা তো পালিয়ে যাবে৷ তবে ওর প্রথম দিককার সুরগুলো খুবই ভাল৷ জয় হে অস্কার পেলেও ওই সুর আমার ভাল লাগেনি৷’ বর্তমানে মুম্বইয়ে প্রতিষ্ঠিত সুরকার বঙ্গসন্তান শান্তনু মৈত্রের খুব অনুরাগী ছিলেন মান্না দে৷ ‘বড় মিষ্টি সুর করে৷ অন্ত্যহীনের সুর খুব ভাল৷ কিন্তু দ্যাখো ওই ছবির জন্য সবাই ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেল৷ ও-ই পেল না৷ ওই ছবিতে শ্রেয়া ঘোষাল খুবই ভাল গেয়েছে৷ ওর গান শুনে আমার যৌবনের লতা মঙ্গেশকরের মতো মনে হয়৷ মেয়েটা অনেক দূর যাবে৷’

নতুন পরিচালকদের মধ্যে আদিত্য চোপড়াকে ভাল লাগত তাঁর৷ ‘যশ চোপড়ার ছেলে৷ বিখ্যাত বাবার ছেলে হলে তুলনা আসবেই৷ আদিত্য কিন্তু ওর বাবার মান রেখেছে৷ প্রথম ছবি থেকেই স্মার্ট৷’ আদিত্যর ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-তে ওয়াক্ত-এর ‘অ্যা মেরি জোহরা জোবি’-কে ব্যবহার করা হয়েছিল৷ ‘আরে আমি তখন কলকাতায়৷ যশ চোপড়া ফোন করল৷ মান্নাদা ওই গানটা আরেকবার রেকর্ড করতে হবে৷ আমি বললাম আমার লিপে কে গাইবে? যশ বলল অমরীশ পুরী৷ আমি বললাম অমরীশ পুরীর লিপে আমি গাইব না৷ ওরা পুরনোটাই ব্যবহার করেছিল৷’ তবে এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে মান্না দে-র সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ৷ সুপর্ণ-র ডাক নাম খোকা৷ মান্না বরাবর খোকা বলেই ডাকতেন সুপর্ণকে৷ বলতেন, ‘ও তো আমার ছেলে৷’ ডাঃ নচিকেতা ঘোষের সুরে মান্না দে প্রচুর গান গেয়েছেন এবং এঁদের বেশিরভাগ গানই হিট৷ গৌরীপ্রসন্ন-পুলকের মতো নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে-র এত হিট গান আছে যে ওঁদের মধ্যে কে বড় সুরকার তা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন৷ নচিকেতা যখন অকালে চলে যান তখন সুপর্ণর বয়স মাত্র সতেরো৷ তখনও তাঁর কলেজের পাঠ সাঙ্গ হয়নি৷ তবু ওই সুপর্ণকেই মান্না বেছে নিলেন তাঁর গানের সুরকার হিসেবে৷ ব্যালাডধর্মী সব গানগুলোই সুপর্ণর সুরে৷ ‘সে আমার ছোট বোন’, মা মা-গো মা, খেলা ফুটবল খেলা কিংবা কফি হাউসের সেই আড্ডাটা— মান্না-সুপর্ণ জুটির কালজয়ী গান৷ মান্নার প্রয়াণের পর সুপর্ণ যখন বলেন, ‘দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হলাম’ তখন তা এক শতাংশও অতিশয়োক্তি মনে হয় না৷ শচীনদেব-রাহুলদের মতো পিতাপুত্রের সঙ্গে কাজ করেছেন৷ আবার সেরকমই নচিকেতা-সুপর্ণকান্তির সঙ্গে৷ এ ব্যাপারে মান্না মনে হয় ভূভারতে একম অদ্বিতীয়ম৷

শেষ বিচারটা ঠিক হল না

যৌবনে গেয়েছিলেন ‘প্রভু তোমার শেষ বিচারের আশায় বসে আছি’৷ ঠাকুরদেবতা মানতেন না৷ তাঁর কাছে সব দেবতাই ছিলেন তাঁর মা মহামায়া দে৷ প্রেমিকা সুলোচনা কুমারনকে যখন বিবাহ করবেন মনস্থ করেন তখন গোটা পরিবার বিরুদ্ধে ছিল৷ শুধু মা-র অনুমতি পেয়েছিলেন৷ আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷ সুলোচনা ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড৷ ফুসফুসের সংক্রমণে যখন সুলোচনা শয্যাশায়ী তখন মান্না দে-কে দেখেছি তাঁর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে৷ চোখভরা জল৷ পারলে স্ত্রীর ব্যথাটাও যেন নিজের বুকে নিয়ে নেন৷ ওই দৃশ্য দেখে চোখে জল নেমে আসে এমনিতেই৷ আর মনের মধ্যে গুনগুন করে ‘এরই নাম প্রেম’৷

সুলোচনা চলে গেলেন ১৯ জানুয়ারি, ২০১২৷ দু’বছর পেরোবার আগেই অন্তর্ধান মান্নার৷ বেশিদিন দু’জনের বিচ্ছেদ হয়নি৷ তবে মান্নার শেষ জীবনটা, মনে হয়, ওভাবে অতিবাহিত হওয়া উচিত ছিল না৷ মেয়ে-জামাই তাঁকে তালা বন্ধ করে রেখে যেতেন৷ নিজেদের সময় মতো আসতেন তাঁরা৷ একদিন দুপুর একটা পর্যন্ত ব্রেকফাস্ট খেতে পাননি৷ নিজের মনের দুঃখের কথা টেলিফোনে জানিয়েছেন কলকাতার কাছের মানুষদের৷ ২০১৩-র পয়লা মে সুপর্ণ যেতে চেয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে৷ মান্না তাঁকে বারণ করেন, ‘খোকা, ডোন্ট কাম৷’ তখন থেকেই শরীর ভাঙতে শুরু করেছে৷ এর কিছুদিন পরেই হাসপাতালে৷ আর বাড়ি ফেরেননি৷ টিভি-তে দেখলাম শেষ যাত্রায় পঞ্চাশটা লোকও নেই৷ মাথায় কোথায় সেই টুপি? কোথায় তাঁর চশমা? ওগুলোই তো ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক৷ ভি আই পি দূরের কথা, বেঙ্গালুরুর সাধারণ মানুষও তো নেই৷ আসলে বেঙ্গালুরু তো তাঁর জায়গা ছিল না৷ মুম্বই অথবা কলকাতা ছিল তাঁর জায়গা৷ তাই যেভাবে মান্না দে-র শেষ যাত্রা হওয়া উচিত ছিল তা হল না৷

সারা জীবন নিজেকে যিনি বলেছেন ‘ইটারনাল স্ট্রাগলার’, বঞ্চিত হয়েছেন অনেক প্রাপ্য সম্মান থেকে, মরণের পরেও তাঁর গা থেকে সেই ট্যাগলাইনটা খোলা গেল না৷

এই মৃত্যু উপত্যকা, মনে হয়, তাঁর দেশ ছিল না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *