অনুলোম বিলোম
শতমুখে তাঁর শত গুণগান। তিনি এই করেছেন, সেই করেছেন, পাহাড়, নদী, ঝরনা…। মাটির তলায় সোনা পুঁতেছেন, গিরিকন্দরে ডায়মন্ড! বাঘ! তার ছালের কী বাহার! কড়মড়িয়ে তোমাকে ডাঁটার মতো চিবোবে, কিন্তু কী সুন্দর ঘাতক! আবার প্রজাপতি! এক টুকরো নকশি কাগজ, ফুরফুরে আনন্দ যেন!
তাতে তোমার কি হলো! গোটা দুনিয়াটা তাঁর খাস তালুক! বড় মানুষের ঐশ্বর্য বর্ণনায় নিজের ঐশ্বর্য বাড়বে? ব্রাহ্মভক্তদের বিরক্ত হয়ে ঠাকুর বলছেন : “তোমরা কী গো! খালি তাঁর ঐশ্বর্য আর গুণ বর্ণনা! তোমার সূর্য, তোমার চন্দ্র, তুমি কন্দর্প, তুমি স্বরাট, বিরাট!”
আমি তাঁকে চাই। মা, আমি তোমার কোলে বসে ভাত খাব। একটু একটু আমি খাব, একটু একটু তুমি খাবে। আমার পূজা মানে নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ খেলা! তোমার আনন্দে আমার অবস্থান! তুমি ঘটি নও বাটি নও, সোনা নও হীরে নও। তুমি প্রেমিক, আমিও প্রেমিক। কখনো আমি বাঁশি তুমি ফুঁ, কখনো তুমি বাঁশি আমি ফুঁ।
তুমি কে?
শাস্ত্রমন্থনকারী মহাপণ্ডিতদের অনেক ব্যাখ্যা। সেসবে আমার প্রয়োজন নেই। যে-দরজা খোলাই আছে, সে-দরজায় পুটুরপুটুর করে শাস্ত্রের টোকা মারেন কারা? যাঁরা বোকা! জগতের চোখে তাঁরা সুপণ্ডিত, বিদ্যায় দিগ্গজ; কিন্তু সে পাণ্ডিত্য কেমন! না, লণ্ঠন-হাতে সূর্যের অন্বেষণ! বিচারের মানে জান? জান না! অহঙ্কার! আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। আমি বিরাট, একজন কেউকেটা! আমার বিচারে, তুমি আছ না নেই! আগে আমি, তারপর তুমি! ইন্দ্রিয়ের রঙধরা চশমা পরে খুঁজছ কাকে? ইন্দ্রিয়াতীতকে! আনারস গাছের ফল ছেড়ে খাচ্ছ তুমি পাতা! আধপোয়া খোলে ধরাতে চাইছ এক সেরকে!
দর্শন কাকে বলে? জ্ঞান, বিচার! সে-দর্শন হলো একদল অন্ধের হস্তিদর্শন। একেবারে সবটা দেখতে হবে। সে-দর্শন তোমার বিচারকের দর্শন নয়। ভক্তের দর্শন। অজ্ঞের বিপরীত প্রাজ্ঞ। দুটোতেই ‘জ্ঞান’ শব্দটি রয়েছে। তোমার জ্ঞান, তোমার অজ্ঞান, তোমার খণ্ডজ্ঞান! জ্ঞানাতীতকে জানতে চাও জ্ঞান দিয়ে! দুধ শুনেছি, দুধ দেখেছি, দুধ খেয়েছি। পরোক্ষ জ্ঞান থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সেখান থেকে অভিজ্ঞতায়। ‘আমি’ থাকলে বিচার আসবেই। আমি, তুমি। অধিকার আসবে। আমার, তোমার। তুল্যমূল্য বোধ আসবে। আর আশপাশে মৃত্যু এলে ক্ষণিকের ঝটকাদর্শন—তুমি কে, কে তোমার! আবার তেল মাখবে, চুল বাঁধবে, পাতা কাটবে, পান খাবে। তোমার জগৎ তোমাতেই ফিরে আসবে। অনন্তের চৌকাঠে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসবে সীমায়। অসীমের জানালায় অহং-এর পর্দা!
আমি বিচারের কথা বলেছি। ‘নেতি নেতি’ বিচার।
ছাড়তে ছাড়তে ওঠ। তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন। সব অনিত্য। যেই নিত্যে পৌঁছলে, যদি পৌঁছাতে পার, তাহলে দেখবে নিচেও নেই, ওপরেও নেই। আবার সবই আছে—তিনিই এইসব হয়েছেন—জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব। দুধ শোনা, দুধ দেখা, দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। দুধকে দই পেতে মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। কিন্তু মাখন তোলা হলে দেখে যে, ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। খোলেরই মাঝ, মাঝেরই খোল। মাখন হয়েছে তো ঘোলও হয়েছে। মাখনকে ভাবতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে ঘোলকেও ভাবতে হয়, কেননা, ঘোল না থাকলে মাখন হয় না। তাই নিত্যকে মানতে গেলেই লীলাকেও মানতে হয়। অনুলোম ও বিলোম। এ অবস্থা কখন? তখন।
সেই তখনে খণ্ডদর্শনের অবসান। সেই তখনে একেবারে সবটা দেখে। সবটা মানে—ঈশ্বর, মায়া, জীব, জগৎ। তখন সে কি দেখে!
সে দেখে যে, মায়া, বিদ্যা এবং অবিদ্যা দুইই, জীব ও জগৎ আছে অথচ নেই। শোন, যতক্ষণ নিজের ‘আমি’ আছে ততক্ষণ ওরাও আছে। “জ্ঞান অসির দ্বারা কাটলে পরে আর কিছুই নাই! তখন নিজের ‘আমি’ পর্যন্ত বাজিকরের বাজি হয়ে পড়ে। কিরকম জান? যেমন পঁচিশ থাক পাপড়িওয়ালা ফুল। এক চোপে কাটা!”
শোন বাছা, নেচেকুঁদে লাভ নেই কিছু। সাত হাত গীতা পড়েছি, দশ গজ চণ্ডী! স্বভাবের বাঁকা লেজ সোজা হবে না তাতে। মালাও ঘোরাবে আর ছেলের বউকে কুটুসকুটুস কামড়াবে তাতে হবেটা কি! সারাটা রাত দাঁড় বেয়ে দেখলে, যে-ঘাটে ছিলে সেই ঘাটেই রইলে। নৌকার দড়িটাই খোলা হয়নি!
আমি কে? সবার আগে এই বোধটা আসুক না—আমি কেউ না, তুমিই সব ঠেকে শিখবে সবাই, ততদিনে মরণকালে এসে যাবে। লাভ হবে না কিছু। আমি বলছি, এই বিশ্বাসে আগেই সেটা ধরে ফেল! বিদ্যার ‘আমি’ থাকে থাক। তাতে বোধ হবে, আমার ভিতর দিয়েই তাঁর প্রকাশ। তিনি প্রেম দিলে প্রেমিক আমি। তিনি দয়া দিলে তবেই আমি দয়ালু। তিনি দাতা হলে তবেই আমি দান করি। তিনি জ্ঞান হয়ে প্রকাশিত হতে চাইলে তবেই আমি জ্ঞানী। আমি বাঁশি, তিনি ফুঁ। ‘আমি’র লম্ফঝম্প তারপরেও থাকবে। একেবারে শান্ত তখনই হবে যদি সেই আদ্যাশক্তি কৃপা করে তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞান দেন। আমরা তাঁর ‘আন্ডারে’! তাঁকে ছাড়িয়ে থাকার জো নেই।
তা এত কথার পর হলোটা কি! সেই রসুনের গন্ধ। কারণ, বাটিটা যে রসুনের। গিরিশকে বলেছিলেন, তা হোক না, পুড়িয়ে নিলে গন্ধ থাকবে না। পোড়াও জ্ঞানের আগুনে, বিচারের শিখায়। বাজিকরের বাজি, তার মধ্যে আমি তুমি, জগৎ সংসার। এটি বুঝতে গেলে যে ব্রহ্মজ্ঞান চাই, বাবা। বই কপচানো জ্ঞান নয়, বোধে বোধ চাই। বুড়ি ছুঁয়ে খেলা।
জ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে যেতে হবে। জ্ঞানী আর বিজ্ঞানীর পার্থক্য! অনেক। দুই বিপরীত মেরুতে উভয়ের অবস্থান! জ্ঞানী বলবে : “এ-সংসার ধোঁকার টাটি।” বিজ্ঞানী বলবে : “এ-সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি!”
আমি কি বলি জান? আমার কাজ নেই মা জ্ঞান-বিচারে। আমি ছুটে ছুটে মায়ের কাছে যাই। যে যা বলে ‘ভেরিফাই’ করে আসি। মা, তুমি বলে দাও, তুমি আমাকে বোঝাও। আমি শিশুর মতো পড়ে থাকি আমার মায়ের রাঙা পদতলে।
যদি প্রশ্ন কর—মা কে? মন্দিরের মূর্তি?
তাহলে বলি, তিনি আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস!