রাজেন্দ্র যাদব নেই। ভাবতে কেমন অবাক লাগছে তিনি নেই। মানুষটা এই কদিন আগেও ছিলেন। কদিন আগেও আমার বাড়িতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিলেন। একটা মেরুন রংএর পাঞ্জাবি আর ফিনফিনে সাদা ধুতি পরে এসেছিলেন। লোকে বয়স বাড়লে রং চঙে পোশাক পরা বন্ধ করা দেয়, রাজেন্দ্রজি কিন্তু এই সংস্কার মানেননি। তিনি হামেশাই কড়া সবুজ, লাল, নীল, বেগুনি রঙের কাপড় পরতেন। আমার বাড়িতে মদ্যপান করলেন, খেলেন, সবার সঙ্গে গল্প করলেন। অনেকে বলে ভীষণ অসুখে ভুগছিলেন। আমি কিন্তু কোনও অসুখ দেখিনি। ডায়বেটিস ছিল, হাজার লোকের থাকে। কিন্তু তার ডায়বেটিস লাগামছাড়া ছিল না। ভালো মদ আর ভালো খাবার পেলেই হাভাতেদের মতো গোগ্রাসে গিলতেন না, অসাধারণ পরিমিতি বোধ ছিল। যেখানেই থাকুন, নিজের বাড়িতে বা অন্যের বাড়িতে, কতটুকু মদ খাবেন, কতটুকু খাবার, কখন ইনসুলিন নেবেন, সিগারেটে ক’টা টান দেবেন, কখন ঘুমোতে যাবেন— সবই একেবারে ঘড়ির কাঁটায় মেনে চলতেন। একটু এদিক ওদিক হওয়ার জো ছিল না। দেখে খুব অবাক হতাম, খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল এত নিয়ম মানা। ছোট একটা কাঁচি সঙ্গে রাখতেন। একটা সিগারেট দু’ভাগ করে তবেই অর্ধেকটা খেতেন। অনেকবার বলেছি, পুরোটা খেতে, বলেছি এতে এমন কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু ওই অর্ধেকের বেশি তিনি কখনও খাননি। তাঁর ফুসফুস নিয়ে সবাই খুব দুশ্চিন্তা করতো, কিন্তু তাঁর ফুসফুস কি অতটাই খারাপ ছিল, যতটা খারাপ বলে ভাবা হতো? যখনই জিজ্ঞেস করতাম, শরীর কেমন আছে, বলতেন, চমৎকার। শরীর খারাপ বা অসুখে ভুগছেন, এমন কথা কখনও মুখে আনতেন না। একবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর ময়ুরবিহারের বাড়িতে। দেখি হার্নিয়া হয়েছে, শুয়ে আছেন। শুয়ে থেকেই গল্প করলেন। সবই প্রচণ্ড জীবনের গল্প। অসুখ বিসুখ নিয়ে হাহাকার করা, বিষন্নতায় বুঁদ হয়ে থাকা –এসব রাজেন্দ্রজির মধ্যে ছিল না। ছিলেন সদা উচ্ছল, প্রাণবন্ত। বেঁচে থাকায় তিনি কোনও কার্পণ্য করেননি। চুরাশি বছর বয়স, মরে যাওয়ার মতো বয়স নয়। কিন্তু ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলে কী আর করার থাকে! ওতে যে কেউ চলে যায়, আজকাল হার্ট অ্যাটাক তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সের ছেলেদেরও হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো যে, রাজেন্দ্রজিকে ভুগতে হয়নি, বিছানায় অচল অবস্থায় শুয়ে থেকে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর কাতরাতে হয়নি। ওই দুঃসহ জীবন রাজেন্দ্রজির প্রাপ্য ছিল না।
যে রাতে মারা গেছেন, সে রাতে রাত সাড়ে তিনটেয় যখন তাঁর বাড়িতে গেলাম, দেখলাম তিনি শুয়ে আছেন একটা অদ্ভুত ইস্পাতের টেবিলে। বসার ঘরে যেখানে সোফা ছিল, সেখানটায়। তাঁর মেয়ে রচনা কাঁদছিল পাশের চেয়ারে বসে। আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ দাড়িয়ে দেখছিলাম রাজেন্দ্রজির নিস্পন্দ শরীরখানা। রাজেন্দ্রজিকে কখনও ঘুমিয়ে থাকতে দেখিনি। মনে হচ্ছিল ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হল যেন শ্বাসও নিচ্ছেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম শ্বাস নেওয়ার যদি কোনও আভাস দেখা যায়! এত বাস্তববাদী মানুষ হয়েও আজও মৃত্যুটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। আমার মা মারা গেছেন আমার সামনে। আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমি ছিলাম না। দেশের সরকার আমাকে যেতে দেয়নি বাবাকে একবার শেষবারের মতো দেখতে। রাজেন্দ্রজি যেভাবে শুয়ে ছিলেন, সেভাবে হয়তো আমার বাবাও শুয়ে ছিলেন। দেখলে আমিও হয়তো ভাবতাম বাবা ঘুমিয়ে আছেন, যেরকম রাজেন্দ্রজিকে দেখে মনে হল তিনি ঘুমিয়ে আছেন। হঠাৎ হয়তো জেগে উঠবেন হট্টগোলে।
আমার বাবা জাগেননি। রাজেন্দ্রজিও জাগেননি। আমরা যাঁরা বেঁচে আছি, যাঁরা এখন রাজেন্দ্রজির জন্য দুঃখ করছি, একদিন এভাবে তারাও মারা যাবো। কিন্তু ক’জন আমরা যাপন করতে পারবো রাজেন্দ্রজির মতো বর্ণময় জীবন?
বিদ্বৎজন নিয়ে নিয়মিত আলোচনার আসর বসাতেন বাড়িতে, সে আসরে নানা বয়সের স্ত্রী-পুরুষ থাকতেন। প্রতিভাবান তরুণ তরুণীদের সঙ্গে বিস্তর সময় কাটাতেন, তাদের সঙ্গে মত বিনিময় করতেন, তাদের উৎসাহ দিতেন লিখতে। গুরুত্ব দিতেন মেয়েদের জীবনের অভিজ্ঞতাকে, তাদের প্রতিবাদকে, তাদের দেখার চোখকে, তাদের ভাষাকে। অন্ধকারে ঠিক ঠিক দেখতে পেতেন হিরের দ্যূতি।
বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন দিল্লিতে পাকাপাকিভাবে বাস করতে শুরু করেছি, যখন বাংলা পত্রপত্রিকা ভয়ে গুটিয়ে রেখেছে নিজেদের, আর যে কারও অধিকার থাকলেও সেসবে আমার লেখার অধিকার নেই, এমনকী জনসত্তা পত্রিকাও আমার নিয়মিত কলামকে অতি ধারালো বলে বাদ দিয়ে দিল, তখন রাজেন্দ্রজি আমাকে বললেন তাঁর হান্স পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখতে। তিনি আমাকে অন্য সম্পাদকদের মতো আমাকে বলেননি, ধর্মের নিন্দা করা যাবে না, সরকারের দুর্নাম করা যাবে না, ভারতীয় ঐতিহ্যকে হেয় করা চলবে না, ধমর্ব্যবসায়ী বাবাদের নিয়ে কটুকথা বলা চলবে না। যে কোনও বিষয় নিয়ে যা কিছু লেখার স্বাধীনতা আমাকে দিলেন রাজেন্দ্রজি। অন্য পত্রিকার সম্পাদকরা রে রে করে ছুটে আসে, ধর্মের কোনও সমালোচনা কেউই বরদাস্ত করে না, লেখা বাদ দিয়ে দেয়, নয়তো সেন্সরের কাঁচি চালিয়ে লেখার সর্বনাশ করে, রাজেন্দ্রজি আমার কোনও লেখায় অপ্রিয় সত্য কথা থাকার অপরাধে বাদ দেননি, কোনও লেখায় কাঁচি চালাননি। তিনি বাক স্বাধীনতায় একশ ভাগ বিশ্বাস করতেন। ঠিক আমার মতো। মানবতাবাদে, ধর্মনিরপেক্ষতায়, জাতপাতহীনতায়, শ্রেণীহীনতায় আমাদের দু’জনেরই বিশ্বাস ছিল। বয়স হয়েছিল রাজেন্দ্রজির, হলে কী হবে, তিনি খুব আধুনিক মানুষ ছিলেন। তাঁকে ঘিরে থাকতো যে তরুণ তরুণীরা, তাদের সবার চেয়েও বেশি আধুনিক, সবার চেয়ে বেশি মুক্ত মনের।
‘বাক স্বাধীনতা’ নিয়ে গালিব অডিটোরিয়ামে তিনি একটা বড় অনুষ্ঠান করেছিলেন কিছুদিন আগে। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা হান্সের বার্ষিক উৎসব। ওতে কথা ছিল আমি বক্তৃতা দেব। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ অবধি যেতে পারিনি। রাজেন্দ্রজি অনেকবার অনুষ্ঠান থেকে ফোন করেছেন আমাকে, অনেক অনুরোধ করেছেন অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। এখনও তাঁর সেই কাতর অনুরোধগুলো কানে বাজে। মুসলিম মৌলবাদীরা চারদিকে ওত পেতে আছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। আমিও করি না, কিন্তু এখনও জনতার ভিড় দেখলে এক ঝাঁক বিভৎস স্মৃতি আমাকে জাপটে ধরে। যে কোনও সময় যে কোনও মৌলবাদী কোনও একটা অনিষ্ট করে বসবে, মেরে না ফেললেও, চেঁচালেও তো খবর হবে। আর সেই খবরের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সরকার যদি বলে বসে, দেশ ছাড়ো! এরকম তো বলেছে অনেক। বাংলা হারিয়েছি। ভারত হারানোর বেদনা আমি সইতে পারবো না। নিরাপত্তা রক্ষীরা এদিকে আবার সাবধানও করে দিয়েছেন, ভিড়ের মধ্যে কোনও মঞ্চে ওঠা চলবে না। রাজেন্দ্রজি আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর পর কথা দিয়েছিলাম, অনুষ্ঠানে যাবো। কথা রাখতে পারিনি। খুব দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্রে আমার নাম দিতে চেয়েছিলেন, নাম না দিতে অনুরোধ করেছিলাম, বলেছিলাম, হঠাৎ করেই উপস্থিত হবো অনুষ্ঠানে। তিনি কথা রেখেছিলেন, আমার নামটা উল্লেখ করেননি, কিন্তু অপেক্ষা করছিলেন আমার উপস্থিতির। বাক স্বাধীনতা বিষয়ে আমার বক্তব্য, উনি বিশ্বাস করতেন, খুব মূল্যবান। লেখালেখির কারণে পূর্ব আর পশ্চিম, দুই বাংলা থেকেই আমার নির্বাসন হয়েছে, বাংলার পত্র পত্রিকায়ও আমি নিষিদ্ধ, অনেকগুলো বই নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার বই নিষিদ্ধ করার আর আমার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে শহরে লক্ষ লোকের মিছিল হয়েছে। এই নিষিদ্ধ মানুষটিকেই রাজেন্দ্রজি শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ অনুষ্ঠানটিতে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সম্মানিত করতে পারলেন না, তা রাজেন্দ্রজির জন্য যতটুকু কষ্টের ছিল, তার চেয়ে বেশি আমার জন্য এটি কষ্টের যে আমি রাজেন্দ্রজি দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত হতে পারলাম না। নিষিদ্ধ লেখককে দেখে লেখক বুদ্ধিজীবিদেরও ভয়ে দূরে সরে যেতে দেখেছি, রাজেন্দ্রজি ফুলের মালা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন সামনে। রাজেন্দ্রজি আর সবার চেয়ে নিশ্চয়ই আলাদা ছিলেন।
রাজেন্দ্রজিকে নিয়ে শেষ দিকে নানা কথা শুনতাম। বিহার থেকে আসা জ্যোতিকুমারী নামের এক মেয়েকে চাকরি দিয়েছিলেন, লেখালেখির– এমনকী বই বের করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, আসকারা দিয়ে মাথায় তুলেছিলেন। জ্যোতিকুমারী আর রাজেন্দ্রজির সম্পর্ক নিয়ে লোকে অশোভন সব কথাও বলেছে। এক পক্ষ বলেছে, ‘রাজেন্দ্রজি চিরকাল মেয়েমানুষ নিয়ে মোচ্ছব করেছে, জ্যোতিকেও ছাড়েনি’। অপরপক্ষ বলেছে, ‘জ্যোতি খুব খারাপ মেয়ে। ও রাজেন্দ্রজিকে নিজের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যাবহার করছে’। মাথা উঁচু করে চলা আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের এই সমাজে মন্দ বলার লোকের অভাব নেই। স্নেহ অনেক মেয়েকেই করেছেন রাজেন্দ্রজি। ভালোও বেসেছেন অনেককে। কিন্তু কারও অনুমতি ছাড়া তিনি কাউকে স্পর্শ করেছেন এ তাঁর শত্রুরাও বলে না। শেষদিন যেদিন দেখা হয়েছিল রাজেন্দ্রজির সঙ্গে আমার বাড়ির আড্ডায়, আমাকে হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগের কারণ কী ছিল। আমি বললাম, ‘সুনীলকে খুব শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু হঠাৎ তিনি একদিন আমার শরীরে আমার অনুমতি না নিয়ে স্পর্শ করেছিলেন। প্রতিবাদ করা উচিত বলেই প্রতিবাদ করেছিলাম। অন্য মেয়েদের জীবনে যৌন হেনস্থা ঘটলে প্রতিবাদ করি, নিজের জীবনে ঘটলে মুখ বুজে থাকবো কেন?’ রাজেন্দ্রজি আমার সঙ্গে একমত হলেন, একবারও বলেননি সুনীলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা আমার উচিত হয়নি।
রাজেন্দ্রজিকে তরুণরা খুব ঘিরে ছিল। তারা খুব শ্রদ্ধা করতো তাঁকে। তাদের বলতে শুনেছি, আমরা পিতৃহারা হলাম। রাজেন্দ্রজির স্নেহধন্য কবি-লেখকরা যেন রাজেন্দ্রজির মতো মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী হয়, সাহসী হয়, যেন কোনও অপ্রিয় সত্য কথা বলতে তাদের কোনও দ্বিধা না থাকে। হবে কি কেউ এমন? আমি যেমন আমার আত্মজীবনীতে কোনও কিছু লুকোইনি, সম্প্রতি লেখা ‘সুস্থ ব্যাক্তিকো বিমার বিচার’ নামে লেখা তাঁর বইতে রাজেন্দ্রজি নিজের কিছুই লুকোননি। জীবনের সব সম্পর্কের কথা লিখেছেন. সমাজের চোখে যা বৈধ , যা অবৈধ, সব। লোকে কী বলবে তা নিয়ে ভাবেননা। তাঁর মতো এরকম অকপট কি হতে পারবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কি রাজেন্দ্রজির মতো তরুণেরা বিশ্বাস করে, যাদের তিনি রেখে গেলেন?