অনুবাদ সাহিত্য
কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, অনুবাদ যে অনুবাদ সেটা স্বীকার করতে প্রকাশক, সম্পাদক, স্বয়ং লেখকেরও কেমন যেন একটা অনিচ্ছা। কেন, এ প্রশ্ন শুধাতে একজন প্রকাশক সোজাসুজি বললেন, ‘বাঙালি অনুবাদ পড়তে ভালোবাসেন না, তাই অসাধু না হয়ে যতক্ষণ পারি ততক্ষণ তথ্যটা চেপে রাখি।’ কিছুকাল পূর্বে আমিও একটি বড় গল্প অনুবাদ করি ও তার প্রথম বিজ্ঞাপনে সেটি যে অনুবাদ সে কথা প্রকাশিত হয়নি। আমি সেই সম্পাদককে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে মনকে সান্তনা দিচ্ছি এই বুঝিয়ে যে দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে এই গাফিলতি মেরামত করা হবে। ওই সময়ে আমারই সহকর্মী (কারণ দু জনাই দেশ-সেবক এবং তিনি অন্যার্থেও) শ্ৰীযুত বিদুর ওই নিয়ে কড়া মন্তব্য করে যা বলেন তার নির্যাস, যত বড় লেখকই হোন না কেন, তিনি যদি অনুবাদ-কর্ম করেন তবে সেটা যেন পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়। অতিশয় হক কথা। তবে এটা আমি গায়ে মাখছিনে, কারণ আমি ‘যত বড়’ কেন অ্যাটটুন বড় লেখকও নই। আমি বরঞ্চ গোড়াতেই চেয়েছিলুম যে ফলাও করে যেন বলা হয়, এটি অনুবাদ। এবং সেই মূল প্রখ্যাত লেখকের অনুবাদ প্রসাদাৎ তার সঙ্গ পেয়ে আমি কিছুটা খ্যাত হয়ে যাব—‘রাজেন্দ্র সঙ্গমে, দীন যথা যায় দূর তীর্থদরশনে।’(১) কিংবা কালিদাস রঘুবংশের অবতরণিকায় যে কথা বলেছেন–বজ্র কর্তৃক মণি সছিদ্র হওয়ার পর আমি সুতো সুরুৎ করে বেতলিফ উৎরে যাব।
এবং এ-স্থলে এটাও স্মরণ রাখা উচিত, কালিদাস বা মধুসূদন কেউই বাল্মীকির আক্ষরিক কেন, কোনও প্রকারেরই অনুবাদ করেননি। সম্পূর্ণ নিজস্ব মৌলিক কৃতিত্ব দেখিয়েও এরা অতখানি বিনয় দেখিয়েছেন। মডার্ন কবিতা যে আমার পিত্তি চটিয়ে দেয়, তার অন্যতম কারণ এঁদের অনেকেরই অভ্রংলিহ দম্ভ। ‘আধুনিক’ গাওয়াইদের কণ্ঠেও সেই সুর শুনতে পাই। আর মডার্ন পেন্টাররা কী করেন–অন্তত তাঁদের দু জনার ব্যবহার সম্বন্ধে তো অনেক কথাই বেরিয়েছে।
কিন্তু সেকথা থাক। আমার প্রশ্ন, অনুবাদ পড়তে বাঙালি ভালোবাসে না কেন?
আমার কিন্তু কথাটা কেন জানি বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে যায় না।
বাংলাভাষার কচিকাঁচা যুগে কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাভারতের অতি বিশুদ্ধ আক্ষরিক অনুবাদ করেন। আজ পর্যন্ত যে তার কত পুনর্মুদ্রণ হল তার হিসাব হয়তো আজ বসুমতীই দিতে পারবেন না। পাঠকদের শতকরা ক-জন নিছক পুণ্য-সঞ্চয়ার্থে এ অনুবাদ পড়েছে। এমনকি রাজশেখর বসুর অনুবাদও– যদিও একটি বারো বছরের ছেলেকে বলতে শুনেছি, ‘ওই বসুমতীরটাই ভালো। বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখা– ধীরেসুস্থে পড়া যায়। রাজশেখর বাবুরটায় বড় ঠাসাঠাসি।’ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ‘বত্রিশ সিংহাসন’ এ যুগের ছেলেমেয়েরাও তো গোগ্রাসে গেলে। (বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্রে’র আরবি অনুবাদ ইরাক থেকে মরক্কো পর্যন্ত আজও আরব্য রজনীর সঙ্গে পাল্লা দেয়।) ঈশান ঘোষের জাতক জনপ্রিয় হওয়ার পূর্বেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল– (পরম পরিতাপের বিষয় যে এখনও তার পুনর্মুদ্রণ হল না) অথচ তার থেকে নেওয়া বাচ্চাদের জাতক তাদের ভিতর খুব চলে। জ্যোতি ঠাকুরের সংস্কৃত নাটক ও ফরাসি কথাসাহিত্যের অনুবাদ এককালে বিদগ্ধ বাঙালিই পড়ত। ওদিকে এসবের বহু পূর্বে আলাওল অনুবাদ করলেন– যদিও আক্ষরিক নয়—জয়সী’র ‘পদুমাবৎ’। এবং তার পরপর বেরুল ‘ইউসুফ-জোলেখা’, ‘লায়লী-মজনু’ ইত্যাদি। মোল্লার বাড়িতে এবং পুব-বাংলার খেয়াঘাটে, বটতলায় এখনও তাদের রাজত্বের অবসান হয়নি; ওদিকে কাশীরাম, কৃত্তিবাস। ‘আরব্যোপন্যাস’, ‘হাতিমতাই’, ‘চহারদরবেশ’ ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা দেশে নাম করেছে। তার পর ‘রবিনসন ক্রুসো, ‘গালিভার্স ট্রেভল’ এবং ফরাসি থেকে ‘লে মিজেরাবল’ এদেশে কী তোলপাড়ই-না সৃষ্টি করল।
আমি অতি সংক্ষেপে সারছি। কিন্তু আমার বয়েসী কোনও পাঠক ‘তীর্থসলিল’ ‘তীর্থরেণু’র কথা ভুলতে পারবেন? সত্যেন দত্ত অনুবাদের যাদুকর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সত্যেন দত্তের শোকসভাতে বলেছিলেন, ‘যে-দিন দেখলুম সত্যেন আমার চেয়ে ঢের ভালো অনুবাদ করতে পারেন ও ছন্দের উপর তাঁর দখল আমার চেয়ে অনেক বেশি, সেই দিনই অনুবাদ-কর্ম থেকে অবসর নিলুম। তার পর ভালো কবিতা চোখে পড়লেই সত্যেনকে অনুবাদ করতে বলতুম।’ (এস্থলে যদিও অবান্তর তবু স্মরণে আনি, রবীন্দ্রনাথ নিজের মৌলিক রচনা কিছুক্ষণের জন্য ক্ষান্ত দিয়ে সত্যেন দত্তের ‘চম্পা’ কবিতাটি ইংরেজি
অনুবাদ করেন।)
আর বর্তমান যুগের হীরেন দত্ত মহাশয়ের ‘তিন সঙ্গী’ যাঁরাই পড়ছেন, তাঁরাই স্বীকার করবেন, এরকম অনবদ্য অনুবাদ হয় না।
এর একটু তথাকথিত ‘নিম্নপর্যায়ে’ নামলেই দীনেন্দ্রকুমারের ‘রহস্যলহরী’। বাংলা দেশের হাজার হাজার নারী-নরকে এর অনুবাদ আনন্দ দিয়েছে। দীনেন্দ্রকুমার লিখতেন অতি সরল, ছলছল-গতির বাংলা পাঠককে কোনও জায়গায় হোঁচট খেতে হত না। তার মৌলিক গ্রন্থ ‘পল্লীচিত্র’ নামটি আমার ঠিক মনে নেই– পড়লে তার বাংলা-শৈলী ও ভাষার সরলতা ও আপন বৈশিষ্ট্য পাঠককে আরাম ও চমক দুই-ই দেয়। (অরবিন্দ ঘোষ যখন বরোদায় চাকরি নিয়ে বাংলা শেখার জন্য গুরুর সন্ধান করেন, তখন দীনেন্দ্রকুমারকে সেখানে পাঠানো হয়। পরবর্তী যুগে যখন তিনি তাঁর অতুলনীয় মধুর বাংলায় পাঠকের কৌতূহল সদাজাগ্রত রেখে তাঁর জীবনস্মৃতি বিশেষ করে বরোদার ইতিহাস ও শ্রীঅরবিন্দের সাহচর্য সম্বন্ধে লেখেন, তখন তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে দু-একটি বিতর্কমূলক তথ্য বলে ফেলেন। আমার ব্যক্তিগত মতে তিনি সম্পূর্ণ সত্যভাষণই করেছিলেন। ও আমার অগ্রজ, কাঙাল হরিনাথ, দীনেন্দ্রকুমার, মীর মুশররফ হুসেন কুষ্টিয়ায় সরেজমিন গবেষণা করে ওই সিদ্ধান্তেই পৌঁছন। ফলে তখনকার দিনের মাসিক-সাহিত্য মহলের এক বলবান ক্লিক্ দীনেন্দ্রকুমারকে, জাস্ট হাউন্ডেড় হিম আউট অব বেঙ্গলি লিটারেচার। সেই অনুপম জীবনস্মৃতি শেষ করার সুযোগও তখন তিনি পাননি। অথচ আমি যখন তাঁর লিখিত শ্রীঅরবিন্দের সহকর্মী খাসেরাও যাদব অংশ বরোদার যাদব গোষ্ঠী ও অন্যান্য মারাঠাদের অনুবাদ করে শোনাই তখন তাঁরা অশ্রুবিসর্জন করে বলেন, ‘বাংলা দেশই শুধু সে যুগের মারাঠী বিপ্লবীদের স্মরণে রেখেছে। বাঙালি প্রাদেশিক এ কুসংস্কার আমাদের ভাঙল।’ এরপর হঠাৎ যখন দীনেন্দ্রকুমারের ধারাবাহিক বন্ধ হয়ে গেল, তখনও তারা উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইলেন পরের পর্বের কথা। আমি কোন লজ্জায় স্বীকার করি কেন তার লেখা বন্ধ হয়ে গেল।)
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম! কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আমার বহুদিনের মনস্তাপ— আজ বেমোকায় বেরিয়ে গেল, পাঠক ক্ষমা করবেন।
আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে। প্রাচীন যুগের সব অনুবাদই যে উত্তম ছিল, একথা ঠিক নয়। কিন্তু এঁদের বেশিরভাগই উত্তম সংস্কৃত ও তকালীন প্রচলিত বাংলা ভাষার সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। এবং পণ্ডিতজন যত বাঁকা বাংলাতেই অনুবাদ করুন-না কেন, তাঁদের শব্দভাণ্ডারের দৈন্য ছিল না বলে অনুবাদ মূল থেকে দূরে চলে যেত না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত পিয়ের লোতির ‘ইংরেজবর্জিত ভারত’-এর অনুবাদ পড়লেই পাঠক আমার বক্তব্য বুঝতে পারবেন। লোতির শব্দভাণ্ডার ছিল অফুরন্ত (উত্তর-মেরু-সমুদ্রের আলো-বাতাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি পর পর তিনটি শব্দ দিয়েছেন, ডায়াফনাস, এফিমেরাল, কাইমেরিক– এর অনুবাদ তো দীন শব্দভাণ্ডার নিয়ে হয় না!)। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানতেন অত্যুত্তম সংস্কৃত ভাসের নাটক তখনও ছাপায় প্রকাশিত হয়নি বা তাঁর হাতে পৌঁছয়নি– ভাসকে বাদ দিলে তিনি সংস্কৃতের প্রায় সব নাট্যলেখকের অনুবাদ করেছেন– তাই সে ভাষা থেকে তিনি অনায়াসে শব্দচয়ন করে মূলের বৈচিত্র্যের মর্যাদা রক্ষা করতে পারতেন। অক্ষম অনুবাদকের হস্তে সেস্থলে অনুবাদ হয়ে যায় একঘেয়ে পড়তে গিয়ে পাঠকের ক্লান্তি এসে যায়।
অধুনা একাধিক যোগ্য ব্যক্তি অনুবাদ-কর্মে লিপ্ত হয়েছেন। এঁদের কেউ কেউ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ। এঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, ইংরেজি সাহিত্য বহু ভাষা থেকে বহু বস্তু অনুবাদ করে কীভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে, নব নব অনুপ্রেরণা পেয়েছে, নব নব অভিযানে বেরিয়েছে সেই আদিযুগের শুভক্ষণ থেকে।
আমি অনুবাদ করতে গিয়ে পদে পদে নিজের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছি। এই লেখাটি তারই অভিজ্ঞতাপ্রসূত।
———-
(১) এই সুবাদে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। গুরুদেব আমাকে কয়েক পাতা প্রুফ মেরামত করতে দেন। সেটা তৈরি হলে তার কাছে নিয়ে যেতে গিয়ে দেখি তিনি ক্ষিতিমোহন ও বিধুশেখরের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি থামের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে শুনি, তিনি বলছেন, বনমালী (কিংবা সাধুও হতে পারে, কিন্তু সে গুরুদেবের সঙ্গে ছিল অল্প দিন) তো গেল আমার সঙ্গে এলাহাবাদ। আমি বললুম, “ওরে বনমালী, প্রয়াগে এসেছিস; স্নান করে নিস্।” কিন্তু মশাই কী বলব, সে ও-পাশই মাড়াল না। বোধ হয় আমার সঙ্গে থেকে থেকে দেবদ্বিজে আর ভক্তি নেই। কিংবা ওই ধরনেরই। মাইকেলের কথা তা হলে সব সময়ে ফলে না।