অনুবাদকের সংযুক্তি

অনুবাদকের সংযুক্তি

ইহুদিবাদ থেকে জায়নবাদ : অনিঃশেষ বিদ্বেষের বাস্তবতা

ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মাতৃভূমির প্রতি সহজাত অদম্য আকর্ষণের কারণে ইহুদিদের মধ্যে পবিত্র ভূমিতে তথা ইসরায়েলে ফেরার আকাঙ্ক্ষা সবসময়ই ছিল। প্রাচীনকাল থেকে নিগ্রহের কারণে সে আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়েছে। নবী ইব্রাহিমের (আব্রাহাম) পুত্র ইসহাকের (আইজ্যাক) ছেলে নবী ইয়াকুবের (জ্যাকবের) নাম ইসরায়েল। ইহুদিরা মনে করে তিনিই আসলে ইসরায়েলে ফেরার এবং প্রত্যাবাসনের প্রথম নায়ক। একেশ্বরবাদী তিন ধর্মের মান্য পিতা ইব্রাহিমকেও চরম দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে জেরুজালেম ছেড়ে যেতে হয়েছে। ইব্রাহিম পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্ম খরা, দুর্ভিক্ষ এবং পারিবারিক কোন্দলের কারণে এই যাওয়া-আসার মধ্যে ছিল। ইব্রাহিমি তিনটি ধর্মের (ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম) বর্ণনায় দেখা যায়— ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ (জোসেফ), মুসা (মুজেস)- প্রত্যেকের কারো নিজেদের, কারো বা তাদের অনুসারী ও বংশধরদের মিসরে গিয়ে দাসত্ব করতে হয়েছে। এই দাসত্বের কারণে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে এবং মুসা এসে এই নিগ্রহের হাত থেকে তাদের রক্ষা করলেন। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর আলোচনায়ও দাসত্ব থেকে মুক্তি, নাগরিক অধিকার এবং আইনের শাসনের প্রাচীন প্রতীক হিসেবে মুসাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায় মুসাকে তাদের প্রথম সিলমোহরে স্থান দেয়।

খ্রিস্ট জন্মের তিনশ বছর আগে গ্রিক হেলেনিস্টিক রাজাদের সময় থেকে মিসরে ইহুদি নিগ্রহ, দাঙ্গা ও নিধনের ইতিহাস পাওয়া যায়। ওই সময়ের নিগ্রহের প্রতিক্রিয়ায় জুডিয়ায় ম্যাকাবিয়ানরা বিদ্রোহ করে (১৭০- ১৬৭ খ্রিস্টপূর্ব)। প্রাচীন ইহুদি দার্শনিক ফিলো অব আলেকজান্দ্ৰিয়া লিখেছেন খ্রিস্ট পরবর্তী ৩৮ সালে ইহুদিদের ওপর হামলার কথা। ওই হামলায় কয়েক হাজার ইহুদি মারা যায়। খ্রিস্ট-পরবর্তী ১৬০ সালের দিকে রোমান রাজাদের সময়ে ইহুদিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হলেও খ্রিস্টধর্ম কাঠামোগত রূপ লাভের পর সে সম্পর্ক আবার খারাপ হয়ে যায়। খ্রিস্ট- পরবর্তী ৬০০ শতক থেকে হিস্পানিয়ায় ভিসিগথিক রাজা এবং চার্চের পক্ষ থেকে ইহুদিদের ওপর আক্রমণ চলে। ইহুদিদের খতনা এবং বিভিন্ন দিবস পালনের ওপর আদেশ-নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ইহুদিদের সঙ্গে বিয়েশাদিও নিষিদ্ধ করা হয়। তখন জোর করে ধর্মান্তর, দাস বানানো, নির্বাসন ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো বিধানের পাশাপাশি সামাজিক আগ্রাসনও বহাল থাকে। নবম শতক থেকে মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বে বরং ইহুদিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। তাদের জিম্মি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ইসলামি শাসকদের পক্ষ থেকে ধর্ম পালন ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এই সময়ে খ্রিস্টান ইউরোপের চেয়ে তারা বরং মুসলিম শাসকদের অধীন অঞ্চলগুলোতে শান্তিতে ছিল। অবশ্য সেই শান্তিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আইবেরীয় উপদ্বীপের করডোবা ও গ্রানাডা এবং মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, মরক্কো ও বাগদাদ— এসব অঞ্চলে পরবর্তী কয়েকশ’ বছর ধরে দাঙ্গা, ধর্মান্তর, হত্যার শিকার হতে হয় তাদের।

ইহুদি নিগ্রহ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলোর মধ্যে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে জার্মানি ও ফ্রান্সের রাইনল্যান্ড গণহত্যা (১০৯৬ সাল), ইংল্যান্ডের বহিষ্কার আদেশ (১২৯০), কালো মৃত্যুর (ব্ল্যাক ডেথ, মানে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু) সময়ের নির্যাতন (১৩৪৮-১৩৫১), স্প্যানিশ ইহুদি হত্যাযজ্ঞ (১৩৯১), স্প্যানিশ ইনকুইজিশন (১৪৭৮), স্পেন থেকে বহিষ্কার (১৪৯২), ইউক্রেনে কশাক হত্যাযজ্ঞ (১৬৪৮-১৬৫৭), রাশিয়ান সম্রাটদের ইহুদিবিদ্বেষী পগরম (১৮২১-১৯০৬), ফ্রান্সে দ্রেফিউস কেলেঙ্কারি (১৮৯৪-১৯০৬), রুশ বিপ্লব (১৯১৭) পরবর্তী সময়ে ইহুদিবিরোধী নীতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) জার্মান নিয়ন্ত্রিত ইউরোপে ইহুদি হত্যাযজ্ঞ। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইহুদিবিদ্বেষের বড় সব ঘটনা ঘটেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশ শতকের পরে ইহুদিবিদ্বেষ বেড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। হাজার বছরের বিদ্বেষের যে ইতিহাস, তা প্রধানত ইউরোপের খ্রিস্টানদের সঙ্গে। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মুসলিমদের সঙ্গে এই বিদ্বেষ নতুন মাত্ৰা পায়।

প্রাচীনকালে যেমন ইহুদিবিদ্বেষের প্রধান কারণগুলো ছিল ধৰ্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। এখনো তা তেমনই আছে। ইহুদিদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান পালন করতে না দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, রোগ বালাইয়ের জন্য তাদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা (মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথের সময় তা করা হয়েছে), নানাভাবে তাদের নিগ্রহ ও ঘৃণা, জনতাকে উসকে দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালানো, পরদেশি বা বিদেশি হিসেবে তাদের প্রতি ভয়-বিদ্বেষ- এসব ধরনে শুরু থেকে বিশ শতক পর্যন্ত চলে এসেছে ইহুদি নিগ্রহ। এই শতকের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইহুদি নিগ্রহের ধরন ও ধারণা পাল্টেছে, পাল্টেছে ইহুদিবিদ্বেষের ধরনও। ইহুদিরা নিপীড়িত জাতি থেকে আবির্ভূত হয়েছে নিপীড়কের ভূমিকায়। বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলা বহু বছর ধরেই একটি প্রায় নিয়মিত ঘটনা। যুক্তরাজ্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেট বাতিল করার পর ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আগ্রাসী শক্তি হিসেবে তার সক্ষমতা জানান দেয়। বিশ্বের সংখ্যালঘু একটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর এই ধরনের আগ্রাসী ভূমিকার নেপথ্য রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক অর্জন এবং গোপন নানা তৎপরতার মধ্যে। সেই অর্জন ও তৎপরতাগুলো বোঝার জন্য ইহুদিদের প্রভাবশালী রাজনৈতিক আদর্শ জায়োনিজম বা জায়নবাদ এবং থিওডর হার্ৎজেলের মতো আদর্শবাদীদের বোঝার প্রয়োজন খুবই বেশি।

আমাদের সবার মোটের ওপর একটা ধারণা আছে যে ইহুদি মানেই জায়নবাদী। ইহুদি ধর্ম এবং জায়নিজম বা জায়নবাদ কিছুটা আলাদা। একজন ইহুদি জায়নবাদী না-ও হতে পারে এবং একজন অ-ইহুদিও জায়নবাদী হতে পারে। জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতবাদ বা আদর্শ। নবী ইয়াকুবকে (জ্যাকব) ইসরায়েল এবং জেরুজালেমকে ‘জায়ন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শুরু হয় জায়নবাদের রাজনীতি। উনিশ শতকের শেষ দশক এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে জায়নবাদের উত্থান। এরপর তা বেশ কয়েকটি ধারায় অগ্রসর হয়েছে। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জায়নবাদই প্রধান। জায়নবাদ এখন নানা বিবেচনা ও ধারণায় বিস্তৃত। যেমন: লেবার জায়নবাদ, লিবারাল জায়নবাদ, সংশোধনবাদী জায়নবাদ, সবুজ জায়নবাদ, হিন্দু জায়নবাদ, খ্রিস্টান জায়নবাদ ও মুসলিম জায়নবাদ। সর্বশেষ যোগ হয়েছে পোস্ট- জায়োনিজম (উত্তর-জায়নবাদ) এবং নিও-জায়নিজম।

ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্র থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার সমস্যার একটি নতুন সমাধানের প্রস্তাব উঠছে বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই। ইসরায়েলের ভেতরকার যে ধ্রুপদী জাতীয়তাবাদ সে ব্যাপারে আগ্রহ কমছে নাগরিকদের। উত্তর-জায়নবাদীর পরামর্শ হচ্ছে— ইসরায়েলের উচিত ‘ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র’ এই ধারণা পরিহার করা এবং সব নাগরিকের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা নেওয়া। উত্তর- জায়নবাদ উভয় জাতির একটি রাষ্ট্রের প্রস্তাবনাও রাখছে, যেখানে আরব ও ইহুদিরা নিজেদের নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে একত্রে বসবাস করবে।

রাজনৈতিক জায়নবাদের প্রবক্তা থিওডর হার্ৎজেল যখন ১৮৯৬ সালের পর থেকে ইহুদিদের জেরুজালেমে ফেরানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন, তখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা সেখানে ফেরার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল, তা বলা যায় না। তাদের মধ্যে নানা পিছুটান ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। নানা দেশে ইহুদিদের যে সম্পদ, সম্পত্তি ও বাসস্থানগত প্রতিষ্ঠা তা ছেড়ে তারা আসতে চায়নি। যতই ধর্মীয় বোধ প্রবল হোক না কেন, বস্তুগত সুবিধা ও অভ্যাসের জায়গাটি স্বভাবতই মানুষ ছাড়তে চায় না। যখন ছাড়ে তখন তারা অপারগ হয়েই ছাড়ে। প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধের নিধন ও নিগ্রহের পর কিন্তু তাদের জেরুজালেমে ফেরার আগ্রহ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে তাদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চলে, তাতে সেখানে বসবাসের ব্যাপারে তাদের নাভিশ্বাস উঠে যায় এবং তারা জেরুজালেমে ফেরার ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপের পরিস্থিতি ইহুদি জাতীয়বাদী রাজনৈতিক তৎপরতা তথা জায়োনিজমের মতো মতাদর্শকেও শক্তিশালী করেছে। ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের সামাজিক শান্তির প্রশ্নে হয়তো ইহুদিদের সরাতেও চেয়েছে। ইহুদিরা কয়েক হাজার বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন জাতি এবং খ্রিস্টান ধর্মের দিক থেকে যে নিগ্রহ ও নিধনের শিকার হয়েছে, তারই চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় বিশ শতকের প্রথমার্ধের ইউরোপে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে ইউরোপের দেশগুলোতে ইহুদিবিদ্বেষ ও নির্যাতন যে ভয়াবহতা পায়, নাৎসিবাহিনী যেভাবে ইহুদি নির্যাতন ও নিধন চালায়, তাতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইহুদিদের একটি দেশ দিয়ে গোটা ইউরোপ যেন একটা ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং গ্লানিমুক্ত হওয়ার পথে হেঁটেছে।

থিওডর হার্ৎজেল, আহাদ হামস, হাইম ওয়াইজম্যান এবং বেন গুরিয়নদের মতো জায়নবাদীদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষা এবং ইউরোপের আকাঙ্ক্ষা একযোগে কাজ করেছে ইহুদিদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের বীভৎস পরিস্থিতি তৈরি না হলে আজকের ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি হতো কি না তাই সন্দেহ।

ব্রিটিশ শাসন ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিয়েছে। রুশ বংশোদ্ভূত ইহুদি জৈব-রসায়নবিদ হাইম ওয়াইজমানের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেক বেশি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মেন্টেশনের জনক হাইম ওয়াইজম্যান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির জন্য অ্যাসিটোন উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে কোরডাইট বিস্ফোরক তৈরিতে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা ব্রিটিশদের কৃতজ্ঞই করেছিল। বিশ শতকের প্রথমার্ধজুড়ে ব্রিটিশ সরকারের নানা পদে থাকা উইনস্টন চার্চিলের মতো রাজনীতিবিদের সঙ্গে হাইমের সখ্য এক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছে। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা এবং এর অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, সবই সম্ভব হয়েছিল এই কৃতজ্ঞতার সুবাদে।

থিওডর হার্ৎজেলের এই গ্রন্থেও আমরা দেখব যে তিনি খ্রিস্টান এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতির সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক তৈরির শুধু আকাঙ্ক্ষা নয়, বিভিন্ন প্রস্তাবও রেখেছেন; কিন্তু ইউরোপের হাজার বছরের বিরোধের জায়গা থেকে ইহুদিদের অপসারণ করে তাদের জন্য নতুন দেশের ব্যবস্থা দিয়ে ঐতিহাসিক সমস্যা সমাধানের পথ করতে গিয়ে আরেক ঐতিহাসিক সমস্যার জন্ম হলো। নতুন বিরোধের ক্ষেত্র তৈরি হলো মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে। সেই সমস্যা যে হতে পারে, তা কতটা আঁচ করতে পেরেছিলেন হার্ৎজেল সেটি অবশ্য তার বই ‘ইহুদি রাষ্ট্রে’ উল্লেখ নেই। তবে তার লেখা উপন্যাস ‘আল্টনয়ল্যান্ডে’ সে ইঙ্গিত আছে। তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে কোনো বিরোধ হবে না। তিনি যা ভাবেননি তাই হয়েছে। কী কী হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা ১৯৪৮ থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যকার অব্যাহত যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ববাসী। ইসরায়েল নিপীড়িত ছিল, নিজেদের আবাস ও দেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিপীড়ক হয়ে উঠেছে কি না, তা বলে দেয় গত ৭৫ বছরের বাস্তবতাই।

‘ইহুদি রাষ্ট্র’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রসঙ্গে

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক উত্থান-পতনে কিছু বই আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যেমন থমাস পেইনের ‘কমন সেন্স’ (১৭৭৬), সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেমন ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস এবং কার্ল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ (১৮৪৮), তেমনই ইহুদিদের ক্ষেত্রে থিওডর হার্ৎজেলের ‘দেয়ার য়ুদেনস্টাট’[১] কিংবা ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ (১৮৯৬)। আয়তনের দিক থেকে এই তিনটিই ছোট পুস্তিকা; কিন্তু এই পুস্তিকাগুলোর শক্তি ভীষণ। তিনটি বইকে একসঙ্গে মেলালে হয়তো অনেকে নাখোশ ও দ্বিমত হবেন যে, এই তিনটি বই এক রকম নয়। দুটিকে ভালো বই বললেও ইহুদি রাষ্ট্রকে’ অনেকে হয়তো ‘কালো বই’ বলবেন। অ-ইহুদি ও অন্যান্য তাত্ত্বিক বিবেচনায় তা হতেই পারে; কিন্তু থিওডর হার্ৎজেলের ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইহুদিদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকেই বদলে দিয়েছিল। হার্ৎজেলের এই বইকে আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচক— যেভাবেই নিই না কেন, কী জাদু ছিল তার এই বইয়ে, যা ইহুদিদের মধ্যে একটি রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাকে সুদৃঢ় ও সংহত করে তুলেছিল, তা বোঝার প্রয়োজন আছে। এ ধরনের একটি বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই ১৯৪৬ সালে (বইটি প্রকাশের ৫০ বছরে) এই বই সম্পর্কে প্রখ্যাত দার্শনিক হানা আরেন্ট- যিনি নিজেও ইহুদি ছিলেন এবং এক সময় জায়নবাদী ছিলেন- বলেছিলেন, ‘আজকের বাস্তবতায় হার্ৎজেলের ইহুদি রাষ্ট্র পাঠ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।’ এই ২০২৩ সালে, বইটি প্রকাশের ১১৯ বছর পর এসে এই বই পড়া, আমরা বলব, খুব স্বাভাবিকভাবেই আরও অনেক বেশি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

[১ দেয়ার য়ুদেনস্টাট: মূল জার্মান ভাষায় এর অর্থ ‘ইহুদিরাষ্ট্র। বাংলাভাষার পাঠকের অভ্যস্ততার বিবেচনায় আমরা এই বইয়ের বাংলা শিরোনাম এবং ভেতরে সব জায়গায় ‘ইহুদি রাষ্ট্র লিখেছি। থিওডর হার্ৎজেলের নামের মূল জার্মান উচ্চারণ ‘থিওডর হের্ৎসেল’হওয়াই সঙ্গত। বাংলায় প্রচলিত বিবেচনায় আমরা এই বইয়ের সবখানে ‘থিওডর হাজেল’ লিখেছি।]

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম হওয়ার কারণে আরবের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহধর্মীয় অনুভূতি আছে। ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের অনেকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধও করতে গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের পরও বাংলাদেশ থেকে অনেকে ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতার জায়গা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়তে কিংবা ফিলিস্তিনিদের মানবিক সহযোগিতা দিতে লেবাননে গিয়েছিলেন। ১৯৪৮ কিংবা ১৯৮২ সাল ছাড়া অন্য কোনো সময় এই ধরনের সরাসরি সক্রিয়তা না থাকলেও সহমর্মিতার বোধ রয়েছে সবসময়ই।

ধর্মের উৎসের দিক থেকে ‘আহলে কিতাব’ হিসেবে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান ভাই ভাই হলেও ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ঘিরে মুসলমান ও ইহুদিদের যে সংঘাতময় বৈরিতা তার প্রভাব বাঙালি মুসলমানের মনেও আছে। যে কারণে আছে ইহুদিবিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ যতটা না বাংলাদেশের ওপর ইসরায়েলের সরাসরি বিরোধ ও বৈরিতার কারণে, তারচেয়ে বেশি তাদের না জানার কারণে এবং ধর্মীয় অনুভূতির কারণে। বিদ্বেষের এই বাস্তবতার দিক থেকেও প্রতিপক্ষকে গভীরভাবে জানা ও বোঝার প্রয়োজন আছে। সেই জানাবোঝার জায়গাকে প্রসারিত করার জন্য ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপট ও রূপকল্প জানা জরুরি। যে কারণে থিওডর হার্ৎজেলের ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ গ্রন্থটিকে একটি ঐতিহাসিক ও প্রভাবশালী দলিল হিসেবে বাংলায় অনুবাদের প্রয়োজন বোধ করেছি।

বাংলাদেশে বাংলাভাষায় ইসরায়েল সংক্রান্ত কোনো লেখার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় পক্ষপাত থাকে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও সচরাচর তেমন বইপত্রই বেছে নেওয়া হয় যেগুলো ইহুদিবিদ্বেষকে সন্তুষ্ট করবে, ইহুদিদের বিপক্ষে যাবে এবং এখানকার মুসলমানদের মানসিকভাবে তৃপ্ত করবে। এই গ্রন্থের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। কারো প্রতি কারো ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা উদ্বেগের জন্য এই ভূমিকা লেখা হয়নি, এই বইও অনুবাদ করা হয়নি। ইসরায়েলের ইতিহাস ও বাস্তবতাকে বোঝার জন্য, হার্ৎজেলের চিন্তাকে বোঝার জন্য, তার চিন্তাকে ইহুদিবাদের বাইরে প্রতিস্থাপন করলে তাতে যে দেশ ও জাতি-নিরপেক্ষ সারবত্তা থাকে, তা অনুধাবনের জন্য এই গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়েছে।

থিওডর হার্ৎজেলের মূল গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় ‘দেয়ার য়ুদেনস্টার্ট’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। সিলভি ড্যাভিগডর এটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ১৯৪৬ সালে তা প্রকাশ করে আমেরিকান জায়োনিস্ট ইমারজেন্সি কাউন্সিল। যিউয়িশ ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে থাকা এই ইংরেজি অনুবাদটিকে প্রামাণ্য ধরে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।

পরিভাষাগত কিছু সমস্যার কারণে বাংলা অনুবাদের বেশকিছু জায়গায় ইংরেজি পরিভাষা রেখে পাশে বাংলায় প্রচলিত পরিভাষা কিংবা শব্দ দিয়ে তা বোঝানো হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় টীকা দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তারপরও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। যেগুলো আমরা পরের সংস্করণে সংশোধন ও পরিমার্জনের আশা রাখছি।

বইটির অনুবাদ ও সম্পাদনায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন অনুবাদক ছন্দা মাহবুব। বাংলা অনুবাদের কপিতে চোখ বুলিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন কবি ও প্রাবন্ধিক সরোজ মোস্তফা এবং জার্মান ভাষা জানা কবি অহ নওরোজ। তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

থিওডর হার্ৎজেল ও তার বিষাদ-পর্বত

থিওডর হার্ৎজেল এবং তার বংশধরদের জীবনের দিকে তাকালে আমাদের চোখে পড়ে বেশকিছু বিষয়। নিগ্রহ, অপমান, দেশান্তর, বিষণ্ণতা, অবসাদ, আত্মহত্যা এবং অল্প বয়সে মৃত্যুর ঘনঘটা দেখি তাদের জীবনে। হাজেল মারা গেছেন মাত্র ৪৪ বছর বয়সে। তার স্ত্রী জুলি হার্ৎজেল মারা গেছেন ৩৯ বছর বয়সে, স্বামীর মৃত্যুর তিন বছর পর। হিস্টিরিয়ায় ভুগেছেন তিনি, ভিয়েনার এক মানসিক হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার (১৯০৭ সালে)। হার্ৎজেলের বড় সন্তান কন্যা পলিনা মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন, মারা গেছেন অতিমাত্রায় হিরোইন সেবনে, বলা যায়, আত্মহত্যাই করেছেন তিনি (১৯৩০ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে)। পলিনার এক বছরের ছোট হার্ৎজেলের একমাত্র পুত্র হ্যান্স আত্মহত্যা করেছেন নিজের গুলিতে। সবার ছোট কন্যা ট্রুডে মারা গেছেন নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ট্রুডের ছেলে রিচার্ড নরম্যান ওয়াশিংটনের ম্যাসাচুসেটস অ্যাভিনিউ ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

হার্ৎজেলের তিন সন্তান এবং এক নাতি- সবাই ভুগেছেন আত্মবিধ্বংসী বিষণ্ণতা ও অবসাদে। অন্য জাতি ও সম্প্রদায়ের ঘৃণা ও বিদ্বেষ দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। শিকার হয়েছেন বিশ শতকের প্রথমার্ধের বিশ্ব পরিস্থিতির এবং বীভৎস রাজনীতির। একইভাবে তাদের কেউ কেউ হতাশ হয়েছেন নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনের আচরণেও। হার্ৎজেলের পূর্বসূরিদের বিত্ত ছিল; কিন্তু জীবন ছিল অনিকেত। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়ে বসবাস করতে হয়েছে তাদের। পরিস্থিতি তাদেরও তাড়া করেছে। হার্ৎজেলের মৃত্যু হয়েছে অস্ট্রিয়ায়। সন্তানদের কারো মৃত্যু প্যারিসে, কারো মৃত্যু বোহেমিয়ায় (বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র), কারো ওয়াশিংটনে।

মৃত্যুর পর হার্ৎজেল পরিবারের সবাই এক হয়েছেন জেরুজালেমে। ব্যতিক্রম তার স্ত্রী জুলি, কারণ, তার দেহভস্মের সন্ধান মেলেনি। যাদের দেহাবশেষ ও ভস্ম পাওয়া গেছে তাদের পুনরায় সমাধিস্থ করা হয়েছে ইসরায়েলের জাতীয় সমাধি মাউন্ট হার্ৎজেলে[২]। সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে করা হয়েছে হার্ৎজেলের সমাধি। ১৯০৪ সালে অস্ট্রিয়ার রেইশেনাও আন ডের রক্সে মৃত্যুশয্যায় হার্ৎজেল শেষবার শেষ কথায় শেষ আকাঙ্ক্ষা জানান- ‘কোনো আয়োজন নয়, কোনো বক্তব্য নয়, কোনো ফুল নয়। একেবারে নিতান্ত গরিবের মতো বিদায় দিয়ো আমাকে।’ তা হয়নি। তার শেষ বিদায়ের আয়োজনে ভিড় করে আসেন হাজার হাজার মানুষ। পুষ্পস্তবক অর্পণ, তাকে নিয়ে নানা কথা, বক্তৃতা, কাদ্দিশ— সবই করা হয় অন্ত্যেষ্টিতে। মৃত্যুর একদিন আগে রেভারেন্ড উইলিয়াম এইচ. হেকলারকে হার্ৎজেল বলেছিলেন, ‘আমার মহান প্যালেস্টাইন, হৃদয়ের সব রক্ত দিয়ে গেলাম আমার এই জনতাকে।’

[২ মাউন্ট হার্ৎজেল: ইসরায়েলে ইহুদিদের জাতীয় সমাধিসৌধের নাম রাখা হয়েছে মাউন্ট হার্ৎজেলের নামেই।]

দাদা থিওডর হার্ৎজেলের এসব কথা ৪২ বছর পর অনুপ্রাণিত করেছিল নাতি স্টিফেন নরম্যানকে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রয়্যাল আর্টিলারির ক্যাপ্টেন স্টিফেন নরম্যান। বাবা রিচার্ড নিউম্যান আর মা হার্ৎজেলের ছোট কন্যা ট্রুডে। ইসরায়েল তখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট[৩]। সেখানে সফরে গিয়েছিলেন তিনি তখনো তার দাদার কবর ভিয়েনা থেকে মাউন্ট হার্ৎজেলে স্থানান্তর করা হয়নি। সফর শেষে তিনি লিখলেন, ‘ইসরায়েলে আমার সফর শেষ হলো, বলা হয়ে থাকে যে, দূরে যাওয়া মানে একটু মরে যাওয়া। আর আমি জানি যে, পবিত্র ইসরায়েল থেকে যখন চলে যাই তখন আমিও একটু মরে যাই। কিন্তু আমি জানি, তারপর, ফিরে আসা, তা এক রকম পুনর্জন্ম এবং আমি ফিরে আসব।’

[৩ ব্রিটিশ ম্যান্ডেট: ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পর্যন্ত যে ব্যবস্থার আওতায় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল পরিচালিত হয়েছে সেটিকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তিগুলো আরব ও ইহুদিদের মধ্যে বিরোধপূর্ণ ভূমি এই ম্যান্ডেটের আওতায় ব্রিটিশদের হাতে হস্তান্তর করে।]

ইসরায়েলে ফিরতে চেয়েছিলেন হার্ৎজেলের শেষ বংশধর নাতি স্টিফেন নরম্যানও। যেমন ফিরতে চেয়েছিলেন হার্ৎজেল। তারও আগে বেলগ্রেডের জিমুনি থেকে পবিত্র (ইহুদিদের কাছে) এবং ঈশ্বর প্রতিশ্রুত ভূমিতে[৪] ফিরতে চেয়েছিলেন হার্ৎজেলের দাদা সাইমন লুয়েব হাজেল। প্রখ্যাত ইহুদি রাব্বি যুদা আলকালাইয়ের হাতে লেখা পুস্তক ছিল হার্ৎজেলের কাছে। দাদার কাছ থেকে তা পেয়েছিলেন তিনি। যেখানে ‘ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে ফেরা এবং জেরুজালেমের গৌরব নবায়নের’ কথা লেখা ছিল। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন হার্ৎজেল। নিজেই শুধু পবিত্র ভূমিতে ফিরতে চাননি, ফেরাতে চেয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদেরও। সে কাজও নিজ উদ্যোগে শুরু করেছিলেন তিনি।

[৪ ঈশ্বর প্রতিশ্রুত ভূমি: বাইবেলে ক্যানানের যে ভূমির প্রতিশ্রুতি ঈশ্বর আব্রাহাম ও তার বংশধরদের দিয়েছিলেন।]

আইনজীবী, সাংবাদিক, নাট্যকার, রাজনীতিক, লেখক থিওডর হার্ৎজেলের জন্ম হাঙ্গেরিতে ১৮৬০ সালে। বাবার পরিবার হাঙ্গেরির পেস্টে এসেছিল সার্বিয়া থেকে। হার্ৎজেল উপাধিটি জার্মানাইজ করে নেওয়া। মা জিনিটা আর বাবা জেকব হার্ৎজেলের দ্বিতীয় সন্তান থিওডর হার্ৎজেল। বাবা ছিলেন অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী। হার্ৎজেলের এক বছরের বড় বোন পলিনে তারুণ্যে মারা যান টাইফাসে। কৈশোরে হার্ৎজেলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফরাসি কূটনীতিক এবং সুয়েজ খালের উদ্যোক্তা ও উন্নয়নকারী ফার্দিনান্দ দ্য লিসেপস। বিজ্ঞানে ভালো না করায় লিসেপসের মতো হওয়া হয়নি তার। আগ্রহ বদলে যায় কবিতা আর মানবিকবিদ্যায়। শুরু করেন সাংবাদিকতা ও নাটক লেখা। কৈশোর ও তারুণ্যে হার্ৎজেল মনে করতেন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে জার্মানরাই সেরা। ১৮৮৭ সালে বোনের মৃত্যুর পর হার্ৎজেলের পরিবারের আরেক দফা দেশান্তর ঘটে। তারা চলে যান ভিয়েনায়। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনায় আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন। যোগ দেন ছাত্র সংগঠন বুর্শেনশেফটে। সংগঠনে ইহুদিবিদ্বেষ তাকে হতাশ করে। পদত্যাগ করেন তিনি। ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা এবং সাল্সবুর্গে সংক্ষিপ্ত আইনপেশার পর নিজেকে সঁপে দেন সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে। সাংবাদিক হিসেবে তখন তিনি লন্ডন ও ইস্তানবুলে মাঝে মাঝে যাতায়াত করতেন।

ভিয়েনার অভিজাত ধনী ব্যবসায়ীর ২১ বছর বয়সী কন্যা জুলি নাশাওয়ারকে ১৮৮৯ সালে বিয়ে করেন হার্ৎজেল। বিয়ে সুখের হয়নি। তাদের তিন সন্তান পলিনা, হ্যান্স ও মার্গারেথে (ট্রুডে)। হার্ৎজেলের এক জীবনীলেখক অবশ্য লিখেছেন, স্ত্রীকে গনোরিয়ায় আক্রান্ত করেছিলেন হার্ৎজেল। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না হার্ৎজেলের মায়ের। মাকে খুবই ভালোবাসতেন হার্ৎজেল। রাজনীতিতে ব্যস্ত হওয়ার পর স্ত্রীর সাথে আরও দূরত্ব তৈরি হয় হার্ৎজেলের। রাজনীতিতে তার স্ত্রীর কোনোই আগ্রহ ছিল না। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এডা জরিটের ‘হিজ অ্যালিয়েনেটেড ওয়াইফ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হার্ৎজেলের স্ত্রী। এই উপন্যাসের মাধ্যমে পরিবারটিকে কিছুটা বিশদে বোঝা যায়।

একমাত্র ছেলে হ্যান্সকে ধর্মনিরপেক্ষভাবে গড়ে তুলেছিলেন হার্ৎজেল। তাকে খতনা করাতেও দেননি। হার্ৎজেলের মৃত্যুর পরপরই প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ধর্মের দীক্ষা নিয়ে ব্যাপ্টিস্ট হন হ্যান্স। পরে আবার ক্যাথলিক হন। বাবার মতোই ব্যক্তিগত মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে এবং এক সম্প্রদায় থেকে আরেক সম্প্রদায় বেছে নিয়েছেন। তিনিও বাবার মতোই চাইতেন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের এক সার্বজনীন ও চিরন্তন সমাধান। ১৯০৫ সালে নিজে থেকেই খতনা করানোর উদ্যোগ নেন হ্যান্স। অতিরিক্ত হেরোইনে সেবনে মারা যাওয়া বোন পলিনার অন্ত্যেষ্টির মাত্র এক দিন পরই নিজের গুলিতে আত্মহত্যা করেন হ্যান্স। বয়স তখন মাত্র ৩৯।

আত্মহত্যার আগে মর্মস্পর্শী এক সুইসাইড নোট লিখিছিলেন হ্যান্স— ‘নতুন ধর্মের অনুশাসনের কাছে নিজেকে যতই সাগ্রহে নিবেদন করুক না কেন, একজন ইহুদি ইহুদিই থেকে যায়, তার প্রাক্তন সহধর্মীদের চিরন্তন অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সে যত বিনম্রভাবেই তার কাঁধের ওপর মুক্তির ক্রুশ তুলে ধরুক না কেন, একজন ইহুদি ইহুদিই থেকে যায়… আমি আর বেঁচে থাকতে পারি না। আমি ঈশ্বরের ওপর থেকে সবটুকু আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। সারাজীবন আমি সত্যের জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আজকে রাস্তার শেষে এসে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, হতাশা ছাড়া কিছুই নেই। আজ রাতে আমি আমার বাবা-মায়ের জন্য কাদ্দিশ উচ্চারণ করেছি এবং পরিবারের শেষ বংশধর হিসেবে নিজের জন্যও। এমন কেউ নেই যে আমার জন্য কাদ্দিশ বলবে, যে শান্তি খুঁজতে বেরিয়েছিল এবং যে শিগগিরই শান্তি পাবে… আমার স্বাভাবিক যাকিছু সব শেষ পর্যন্ত ভুল এবং আমি সেই অসংশোধনীয় ভুলগুলোর মধ্যে একটি করেছি, যা পুরো জীবনের ওপর ব্যর্থতার ছাপ মেরে দিয়েছে। তাহলে তো এই জীবন বর্জন করাই উত্তম।’ হ্যান্সের এই সুইসাইড নোটে তার অনুশোচনা, যন্ত্রণা এবং রুদ্ধ প্রাণের ক্রন্দন যেমন আছে তেমনই আছে পরিস্থিতি, পরিপার্শ্ব ও রাজনীতি দ্বারা তাড়িত হওয়ার আভাসও।

ছোট বোন মার্গারেথে তথা ট্রুডের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না হার্ৎজেলের অন্য দুই সন্তান পলিনা ও হ্যান্সের। ট্রুডে বিয়ে করেছিলেন তার চেয়ে ১৭ বছরের বড় রিচার্ড নিউম্যানকে। বিশ্ব মহামন্দার (১৯২৯-১৯৩৯) সময়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন নিউম্যান। ট্রুডের চিকিৎসার খরচ জোগানোও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। হতাশা ও বিষণ্ণতা ট্রুডেকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে তাকে প্রায়ই হাসপাতালে রাখতে হতো। নাৎসি বাহিনী ট্রুডে ও রিচার্ড নিউম্যানকে থেরেসিয়েনস্টাড কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই তারা মারা যান। তাদের মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

হার্ৎজেলের নাতি স্তেফান থিওডর নিউম্যানকে (স্টিফেন নরম্যান), শেষ বংশধর, বাবা রিচার্ড পাঠিয়ে দেন ইংল্যান্ডে, ১৯৩৫ সালে। ভিয়েনিজ এক ইহুদি এবং জায়োনিস্ট এক্সিকিউটিভের তত্ত্বাবধানে সেখানে রাখেন ছেলেকে। রিচার্ডের ভয় ছিল অস্ট্রিয়ায় একমাত্র ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রিয়ায় থাকার সময় যার জীবনের অংশ ছিল না জায়নবাদ, ইংল্যান্ডে এসে নিজের নানার সম্পর্কে জেনে এবং পরিস্থিতির কাছে মার খেয়ে পুরোপুরি জায়নবাদী হয়ে ওঠেন নরম্যান। নিজের নামের ইংরেজীকরণ করেন স্টিফেন নরম্যান হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নরম্যান। পদোন্নতি পেয়ে রয়াল আর্টিলারির ক্যাপ্টেন হন। ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালের কোনো এক সময়ে তিনি প্যালেস্টাইনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট সফরের সুযোগ পান।

হার্ৎজেলের ধারার রাজনীতির সঙ্গে বিরোধ ছিল ইহুদি জৈবরসায়নবিদ হাইম আজরিয়েল ওয়াইজম্যানের (ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট)। ১৯৪৫ সালের দিকে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে স্টিফেন নরম্যানের উপস্থিতিকে তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি। লন্ডনে জায়োনিস্ট কনফারেন্সে নরম্যান কথা বলতে গেলে বক্তৃতার পুরো সময়টুকু ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অরগানাইজেশনের চেয়ারম্যান হাইম ওয়াইজম্যান বক্তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিলেন। পরে তিনি নরম্যানকে ধমকাধমকিও করেন। অহং, ঈর্ষা আর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণেই তা হয়েছিল। খুবই আহত হয়েছিলেন স্টিফেন নরম্যান। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ‘অপারেশন আগাথা’র পর (১৯৪৬) স্টিফেন নরম্যানকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়। হাইম ওয়াইজম্যান তাকে ওয়াশিংটনে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক মিশনে ছোট একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে নরম্যানের দেখা হয় তাদের পরিবারের আয়া উথের সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার বাবা-মায়ের এবং পরিবারের অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা উথের কাছে জানতে পেরে ভেঙে পড়েন তিনি। ইহুদিদের এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু না করতে পারার গ্লানি তাকে পেয়ে বসে। ১৯৪৬ সালের ২৬ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন তিনি। রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা না হলে এতটা হয়তো ভেঙে পড়তেন না স্টিফেন নরম্যান।

আধুনিক রাজনৈতিক জায়োনিজমের জনক বলা হয় থিওডর হাজেলকে। তিনি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে জায়োনিস্ট অরগানাইজেশন গড়ে তুলে ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে স্থানান্তরের চেষ্টা চালান। হিব্রু ভাষায় তিনি ‘চোজা হামেদিনাহ’ (রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা)। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে গৃহীত ইসরায়েলি স্বাধীনতার ঘোষণায় তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ইহুদি রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার আগেও রাব্বি এহুদা বিবাস, জিউয়ি হির্শ কালিশার, যুদা আলকালাইয়ের মতো অনেকে ইহুদি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন; কিন্তু সক্রিয় প্রচেষ্টায় তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে।

হার্ৎজেল প্রথম দিকে ইহুদিবাদী[৫] কিংবা জায়নবাদী ছিলেন না। তার প্রথম দিকের লেখায় ইহুদিদের ওপর বিশেষ আলোকপাত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ইহুদিরা যে দেশ, শহর বা সমাজে আছে সেখানেই তাদের স্বাধিকার দেওয়া হোক এবং তারা সেখান বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে মিলেমিলে থাকুক। পরে তিনি সামাজিক আত্মীকরণের এই ধারণা থেকে সরে আসেন। কীভাবে ইহুদিবাদী হয়ে উঠলেন হার্ৎজেল, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মত আছে। তবে তারা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়কে সামনে এনেছেন। এর একটি হচ্ছে ফ্রান্সের ট্রেফিউস অ্যাফেয়ার এবং ভিয়েনায় বাগ্মী জননেতা কার্ল লুগানের মেয়র হওয়ার ঘটনা।

[৫ এই বইয়ে ‘যুদাইজম’কে ইহুদিবাদ লেখা হয়েছে। কেউ চাইলে ইহুদিবাদের পরিবর্তে ইহুদি ধর্মও পড়তে পারেন।]

দ্রেফিউস অ্যাফেয়ার (১৮৯৪-১৯০৬) নামের রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি তৃতীয় ফ্রেঞ্চ রিপাবলিককে বিভক্ত করে ফেলে। ওই ঘটনা বিচারের নামে অবিচার এবং ইহুদিবিদ্বেষের জন্য ইতিহাস হয়ে আছে। ফরাসি ইহুদি সেনা আলফ্রেড ট্রেফিউসের বিরুদ্ধে জার্মানির কাছে তথ্য পাচারের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা হয়। তখন ফ্রান্সের রাস্তায় যে মিছিল হয় তাতে ইহুদিবিদ্বেষী স্লোগান ওঠে। সাংবাদিক হিসেবে ওই ঘটনা কভার করছিলেন হার্ৎজেল। হার্ৎজেল গবেষকদের অনেকের ধারণা, পুরো ঘটনা তার মধ্যে যে অভিঘাত সৃষ্টি করে তাতে তিনি জায়োনিজমের পক্ষে অবস্থান নেন। হার্ৎজেল নিজেও তার লেখায় এই অভিঘাতের কথা স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, ভিয়েনায় ইহুদিবিদ্বেষী কার্ল লুগানের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়া এবং পরে তার মেয়র হওয়ার (১৮৯৭ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত তিনি ভিয়েনার মেয়র) কারণে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তারই প্রতিক্রিয়ায় জায়নবাদী হয়ে ওঠেন হাজেল। পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে তখন হার্ৎজেল তার ‘দ্য নিউ ঘেট্টো’ নাটকও রচনা করেন।

এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে ১৮৯৫ সালের শুরুতে ‘দেয়ার য়ুদেনস্টার্ট’ (ইহুদি রাষ্ট্র) গ্রন্থ রচনা শুরু করেন তিনি। পরের বছর তা প্রকাশিত হলে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। ইহুদিদের এক পক্ষ তার প্রস্তাবের সমর্থন জানায় এবং অন্য পক্ষ এর বিরোধিতা করতে থাকে।

হার্ৎজেল তার প্রস্তাব ও পরিকল্পনার পক্ষে ইহুদি ও অ-ইহুদিদের সমর্থন আদায়ে উদ্যোগী হন। কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের জোর চেষ্টা চালাতে থাকেন। ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য, ইহুদিদের জন্য আত্মত্যাগের পথে হাঁটতে থাকেন তিনি। তুর্কি শাসক দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ আর্মেনীয় গণহত্যার কারণে তখন ইউরোপে ভীষণ নিন্দার্হ হয়ে ওঠেন। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান হার্ৎজেল। তিনি হামিদের কাছে প্রস্তাব রাখেন, জেরুজালেমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন জানালে ইউরোপে হামিদের সুনাম জোরদারে কাজ করবে ইহুদিরা এবং তুরস্কের বিদেশি ঋণ পরিশোধে ইহুদিরা আর্থিক সহযোগিতাও দেবে। ১৮৯৬ সালে হার্ৎজেল আব্দুল হামিদের সাথে দেখা করতে ব্যর্থ হন, কিন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ পারিষদদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবে রাজি না হলেও তুর্কি সম্রাট হাজেলকে যথার্থ সম্মান জানান। সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে অর্ডার মেদজিদিয়ে পদক প্রদান করা হয়। ১৯০১ সালে তিনি সম্রাট আব্দুল হামিদের সাথে সরাসরি বৈঠকের সুযোগ পান এবং সম্রাট তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

[৬ আর্মেনীয় গণহত্যা: ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত এই গণহত্যা চলে। এক থেকে তিন লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয় এবং অর্ধলক্ষ শিশু এতিম হয়ে যায়।]

১৮৯৫-৯৬ সালে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরুর পর লন্ডন সফরে তিনি অ্যাংলো-জিউইশ সোসাইটি ‘অর্ডার অব অ্যানসিয়েন্ট ম্যাকাবিয়ান দের প্রধান আলবার্ট গোল্ডস্মিডের সমর্থন লাভ করেন। ভিয়েনায় ব্রিটিশ দূতাবাসের অ্যাংলিকান মন্ত্রী উইলিয়াম এইচ. হ্যাকলারের সঙ্গে তার সখ্য হয়। হ্যাকলার বাডেনের গ্র্যান্ড ডিউক ফ্রিডারিক ওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। প্রথম ফ্রিডারিক ছিলেন জার্মান সম্রাট প্রথম ভিলহ্যামের একমাত্র মেয়ের জামাতা। প্রথম ফ্রিডারিক ১৮৯৮ সালে হার্ৎজেলকে সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহ্যামের সঙ্গে বৈঠকে বসার ব্যবস্থা করে দেন। জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহ্যামের কাছ থেকে সমর্থন পান হাজেল।

ইংল্যান্ডের ম্যাকাবিয়ানদের সমর্থনেই তিনি ইহুদিবাদীদের নেতৃত্বে চলে আসেন। ১৮৯৭ সালে তিনি ভিয়েনা থেকে নিজ খরচে ইহুদিবাদী সাপ্তাহিক ‘ডি ওয়েল্ট’ প্রকাশ শুরু করেন। এই বছরই সুইজারল্যান্ডের বাসেলে ‘ফার্স্ট জায়োনিস্ট কংগ্রেসের’ আয়োজন করেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। এই কংগ্রেসের মাধ্যমেই ১৮৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অরগ্যানাইজেশন’ (ডব্লিউজেডও)।

হার্ৎজেল প্রথম জেরুজালেমে যান ১৮৯৮ সালের অক্টোবরে। জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহ্যামের সফরের সঙ্গে মিলিয়ে তার এই সফর সাজানো হয়েছিল। জেরুজালেমে কয়েক দিনের মধ্যে দ্বিতীয় ভিলহ্যামের সঙ্গে তার দুটি বৈঠক বা সাক্ষাৎ হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শাসক, প্রভাবশালী বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর এই সাক্ষাতের প্রভাব পড়ে। এমনকি ইহুদিদের মধ্যেও হার্ৎজেলের প্রতি সমর্থন বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে ডব্লিউজেডও’র অঙ্গ সংগঠন ইংলিশ জায়োনিস্ট ফেডারেশন।

১৯০২-০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের রয়্যাল কমিশন ইহুদিদের অভিবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য হার্ৎজেলকে আমন্ত্রণ জানায়। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিবিড় হয়। উপনিবেশবিষয়ক মন্ত্রী জোশেফ চ্যাম্বারলেইনের মাধ্যমে সিনাই উপদ্বীপে ইহুদিদের বসতি গড়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়। ব্রিটিশ সরকারের মিসরবিষয়ক কনসাল জেনারেল লর্ড ক্রমার এই প্রস্তাবকে বাস্তবসম্মত নয় বলে খারিজ করে দেন। জোশেফ চ্যাম্বারলেইন উগান্ডা প্রকল্পের আওতায় বর্তমান কেনিয়ায় ইহুদিদের বসতি স্থাপনের প্রস্তাবও দেন। জায়োনিস্ট কংগ্রেসে তা নিয়ে আলোচনায় অধিকাংশ সদস্য রাজিও হন। জায়গাটি সরেজমিন দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চান তারা। পরে সরেজমিন রিপোর্টের ভিত্তিতে জায়োনিস্ট কংগ্রেস এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তারা ইহুদিদের বাসভূমি জেরুজালেমে গড়ে তোলার ব্যাপারে সুদৃঢ় অবস্থান নেয়।

১৯০৩ সালে হার্ৎজেল ইহুদির নিজস্ব ভূমির ব্যাপারে পোপ দশম পায়াসের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যিশুকে স্বীকার না করলে তারা এ ব্যাপারে কোনো সমর্থন দিতে পারেন না।

১৯০৪ সালের ৩ জুলাই কার্ডিয়াক স্কেলেরোসিসে মারা যান হার্ৎজেল। বছরের শুরুর দিকে চিকিৎসকরা তার হৃদপিণ্ডের সমস্যার কথা বলেছিলেন। হিব্রু অষ্টম মাসের (আইয়ায়ের) দশম দিনটি হার্ৎজেল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে ইসরায়েলে সরকারি ছুটি থাকে।

হাজেল নাটকই লিখেছেন বেশি। তার রচিত নাটকের সংখ্যা ১৫টির বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশই কমেডি। এ ছাড়া তার দার্শনিক রচনা নিয়ে আছে ‘ফিলোসপিক্যাল স্টোরিজ’। মৃত্যুর পর ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তার দিনলিপি। হার্ৎজেলের রাজনৈতিক লেখাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘দেয়ার য়ুদেনস্টার্ট’ (ইহুদি রাষ্ট্র), ১৮৯৬; আল্টনয়ল্যান্ড’ (পুরনো নতুন ভূমি), ১৯০২; এবং ‘হাগেনাও’, ১৮৮১। এই তিনটি রচনার শেষ দুটি উপন্যাস।

‘ইহুদি রাষ্ট্র’ লেখাটিতে তিনি তো ইহুদি রাষ্ট্রের বিস্তারিত তুলে ধরেছেনই, তার বাইরে ইউটোপিয়ান উপন্যাস ‘পুরনো নতুন জমি’তে এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন আরও বিস্তারিত। প্রবন্ধে যে স্বপ্ন বোনা যায় না সেই স্বপ্নই রচনা করেছেন তিনি এই উপন্যাসে। এই উপন্যাস জায়োনিজমের প্রতি নিবেদিত। তিন বছর ধরে অবসর সময়ে তিনি তা লিখেন। ইহুদি রাষ্ট্রের প্রথম প্রজন্ম কী করবে না করবে তারই বিশদ বিবরণ ও কল্পনা আছে এই উপন্যাসে। ইহুদি রাষ্ট্রকে তিনি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করেননি। সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা ও শান্তির স্থান হিসেবেই তিনি সেটিকে এই উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। এই রাষ্ট্রে হিব্রু প্রধান ভাষা হলেও সব ভাষাই চলবে। ইহুদি ও আরবদের মধ্যে এই ভূমি নিয়ে কোনো সংঘাত থাকবে না, এ রকম স্বপ্নই তিনি উপস্থাপন করেছেন এই উপন্যাসে। রাষ্ট্রটিকে পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখেননি তিনি, দেখেছেন এই দুয়ের সমন্বয়ে তৃতীয় পন্থার একটি রাষ্ট্র হিসেবে। রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কাঠামোটিও তিনি সেভাবেই সাজিয়েছেন। যদিও এটি ইউটোপিয়া; কিন্তু ইসরায়েলে তার এই উপন্যাসের একটি লাইন স্লোগান হিসেবে খুব প্রচলিত, ‘ইফ ইউ উইল ইট, ইট ইজ নো ড্রিম’। ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ লেখায় যেমন এই উপন্যাসেও তেমনই তিনি আর্জেন্টিনাকে ইহুদিদের বিকল্প বাসস্থান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এখনকার ইসরায়েলে তেল আবিব নামে যে দ্বিতীয় প্রধান শহরটি আছে সেটির নামও কিন্তু এসেছে এই উপন্যাস থেকেই।

হার্ৎজেল স্বপ্ন বুনেছিলেন ইহুদি রাষ্ট্রের। রচনা করেছিলেন সেই রাষ্ট্রের রূপকল্প। সুইজারল্যান্ডের বাসেলে ১৮৯৭ সালে ফার্স্ট জায়োনিস্ট কংগ্রেসে তিনি বলেছিলেন, ৫০ বছর পর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে অর্থাৎ ৫০ বছর পর তাই হয়েছে। তিনি ইহুদিদের শান্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইহুদিবিদ্বেষের অবসান চেয়েছিলেন। ইহুদি রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ হলেও শান্তি আসেনি, ইহুদিবিদ্বেষও কমেনি, বরং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পার্শ্ববর্তী ফিলিস্তিন এবং অন্য আরব দেশগুলোর সঙ্গে বিবাদের সূত্রে এসেছে অন্তত ১৫টি ছোট-বড় যুদ্ধ, তৈরি হয়েছে সংঘাতের প্রাত্যহিক বাস্তবতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *