অনুবাদকের নিবেদন : সাধনা প্রসঙ্গে

অনুবাদকের নিবেদন : সাধনা প্রসঙ্গে

(১)

১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতি ও তাঁর গীতাঞ্জলি দেশে দেশে পৌঁছে গিয়েছিল। সারা বিশ্বের, বিশেষ ক’রে পাশ্চাত্যের মানুষ তাঁকে চিনেছিলেন মূলত গীতাঞ্জলির কবি রূপে। আমেরিকাবাসী কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার ঘোষণার বেশ আগে। যদিও সুদূর ভারতের এক অজানা অতীন্দ্রিয়বাদী কবি রূপে আমেরিকার সাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ, তবুও আশ্চর্যের বিষয় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুরু থেকেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিতার আসরে নয়, সাহিত্যের আলোচনা সভাতেও নয়, ভারতীয় দর্শন বিশেষতঃ উপনিষদের উপর বক্তৃতা করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় মহলে তাঁকে বলা হ’তো প্রাচ্যের এক বিদগ্ধ দার্শনিক-কবি (philosopher-poet)।

সে ছিল ১৯১২ সাল। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠের এক আসরে আমেরিকার খ্যাতনামা কবি এজরা পাউন্ড (Ezra Pound) উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা শুনে মুগ্ধ পাউন্ড রবীন্দ্র-কবিতা আমেরিকাতে প্রকাশ করার জন্য শিকাগো (Chicago) থেকে প্রকাশিত পত্রিকা “পোয়েট্রি”র (Poetry) সম্পাদিকা হ্যারিয়েট মনরোকে (Harriet Monroe) তখনই লিখে পাঠান, “Reserve space in next number for Tagore… He has sung Bengal into a nation” (Stephen Hay, American Quarterly, 442)। এজরা পাউন্ড মনরোর কাছে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতার পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন। কবিতাগুলি Poetry, vol.1, No. 3, December 1912-এ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটি কবিতাতেই আধ্যাত্মিকতার সুর। আমেরিকাতে রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম পরিচিতি।

১৯১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভ্রমণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পদার্পণ করেন। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। রথীন্দ্রনাথ ইলিনয় (Illinois) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন। জোড়া শহর শ্যামপেন-আর্বানাতে (Champaign-Urbana) ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল আর্বানায় নিরিবিলিতে কিছুদিন কর্মক্লান্ত অবসর কাটাবেন। কিন্তু দৈনিক কাগজ The Daily Illini তাঁর আগমনের সম্ভাবনার কথা বহু আগেই প্রচার ক’রে দিয়েছিল। ১ অক্টোবর ১৯১২-র কাগজে বড় হরফে লেখা হয়েছিল, “Poet to visit University: Famous Indian Writer Coming Soon”। খবরে ছিল, “Rabindranath Tagore, who is recognized as the foremost poet of India is soon to pay the University a visit. The date for his visit has not been definitely learned.” (Hurwitz,23)

৩০ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ আর্বানাতে পৌঁছালে তাঁকে স্বাগত জানাতে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মরগান ব্রুক্‌স (Morgan Brooks) এবং অধ্যাপক আর্থার সেমুর (Arthur Seymour)। আর্বানাতে প্রথম কিছুদিন রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক ব্রুক্‌সের বাড়িতে এবং সস্ত্রীক রথীন্দ্রনাথ অধ্যাপক সেমুরের বাড়িতে অতিথি ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের “সাধনা”র প্রবন্ধগুলি লেখার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি পাঠ ও সেই বিষয়ে আলোচনা সভার, এবং পরে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতার ব্যবস্থাপনায় এই দুই অধ্যাপকের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা স্মরণীয়।

রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি বাড়ি নেওয়া হলো। কিন্তু তাঁর নির্জনবাস দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সঙ্গে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনা করতে ও তাঁর কবিতা শুনতে আসতে শুরু করলেন। অধ্যাপক সেমুর তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের জন্য আলোচনা সভা ও তাঁর কবিতা পাঠের আসরের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই আসরে ফাদার এলবার্ট ভেইল (father Albert R. Vail) নামে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটারিয়ান চার্চের একজন ফাদার বার-বার আসতেন। এই চার্চ সম্বন্ধে অধ্যাপক সেমুরের স্ত্রী, কবি মেয়েস সেমুর (Mayce Seymour) তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উদারপন্থী অধ্যাপকদের একটি ছোট দল আমেরিকার রক্ষণশীল মধ্যপশ্চিম সমাজের ভ্রুকুটি ও কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা ক’রে ১৯১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধির মধ্যে ইউনিটারিয়ান চার্চের প্রতিষ্ঠা করেন। এই চার্চের ভক্তদের চিন্তাধারার সঙ্গে ভারতবর্ষের ব্রাহ্ম-সমাজের চিন্তাধারার মিল পাওয়া যায়। (Mayce F. Seymour, “That Golden Time”, The Visva-Bharati Quarterly, 2)। ফাদার ভেইল সম্বন্ধে রথীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, “পাদরি মহাশয় ছিলেন খাস হার্ভার্ডের গ্র্যাজুয়েট, সুতরাং তাঁর মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্থানীয় রক্ষণশীল খ্রীষ্টানদের তুলনায় অনেক উদার। তিনি প্রায়ই তাঁর চার্চের বাছা বাছা কয়েকজনকে ডেকে বাবাকে বলতেন তাঁর লেখা থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনাতে।” (১৬০-৬১)

ফাদার ভেইল রবীন্দ্রনাথকে ইউনিটি ক্লাবের (Unity Club) পক্ষ থেকে উপনিষদের উপর একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। অনুরোধটি কিছু আশ্চর্যজনক ছিল না। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আর্বানা থেকে অজিত চক্রবর্তী মহাশয়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,

Unity Club বলে এঁদের একটি club আছে, সেখানে প্রতি রবিবারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মসম্প্রদায় ও ধর্ম্মগুরুদের সম্বন্ধে বক্তৃতা ও আলোচনা হয়ে থাকে। উপনিষদের সম্বন্ধে কিছু বলবার জন্য ইনি আমাকে ধরেছিলেন। আমি প্রথম রাজি হইনি। তার পরেই দেখলুম শর্ম্মা উপাধিধারী একজন বাঙালী ছেলে বলবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অথচ ও সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার তার কোনো অধিকার নেই। তাই উপনিষদের ঋষিদের প্রতি আমার কর্তব্য পালনের জন্য শেষ মুহূর্তে আমাকে রাজি হতে হল। এ সম্বন্ধে আমি যে পণ্ডিত তা বলতে পারিনে, কিন্তু এখানকার “নিরস্ত পাদপে দেশে” আমি যে এরণ্ড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। (১৫ই নভেম্বর ১৯১২. বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবন অভিলেখাগারের সৌজন্যে)

রবীন্দ্রনাথের কৌতুকপূর্ণ আত্মসমীক্ষা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আত্মপ্রচার-বিমুখতার পরিচায়ক। ভারতীয় দর্শন, বিশেষ ক’রে উপনিষদ সম্বন্ধে তাঁর সুগভীর জ্ঞান এবং উপনিষদ প্রদর্শিত পথে তাঁর নিজের জীবনসাধনা সর্বজন বিদিত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, “সাধনা” গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে লেখার সময় একই রচনাশৈলী ব্যবহার করেছেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ইংরেজি ভাষায় সাধনার প্রবন্ধগুলি রচনা সম্বন্ধে রবীন্দ্রজীবনীকার ও সমালোচকদের একাংশের মধ্যে এই রচনাশৈলী বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

ইউনিটারিয়ান চার্চে রবীন্দ্রনাথের প্রথম বক্তৃতা হয়েছিল ১০ নভেম্বর ১৯১২-তে। বক্তৃতাটি বহুল প্রশংসিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে আরও তিনটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত Imperfect Encounter: Letters of William Rothenstein and Rabindranath Tagore গ্রন্থের সম্পাদিকা মেরি লাগোর (Mary M. Lago) দেওয়া তথ্যে আর্বানার চার্চে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটি পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়ঃ

November 10 “World Realisation”

November 17 “Self Realisation”

November 24 “Realisation of Brahma”

December 1 “The Way of Action”

All were included in Sadhana (Lago, 70)

“সাধনা” গ্রন্থের প্রবন্ধগুলির সূত্রপাত এখানেই। প্রথম বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পরে ১৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ অজিত চক্রবর্তী মহাশয়কে এই বক্তৃতা সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “এখানকার অধ্যাপকরা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। আমার ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভাল লেগে গেল। তার ফল হল এই যে আগামী রবিবারের জন্য তাঁরা আমাকে বলতে অনুরোধ করেছেন। এবারে আত্মবোধের বিষয়টা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছি। ইংরেজিতে লিখতে আমার বিলম্ব হয় কষ্ট হয়— তবু প্রতিদিন অল্প অল্প করে লিখে ফেলেছি।” ২৩ নভেম্বর ১৯১২ (৮ই অগ্রহায়ণ ১৩১৯) অজিত চক্রবর্তী মহাশয়কে আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন, “দ্বিতীয়বারে সমস্তটাই আমাকে লিখতে হয়েছিল। তাতে ভালই হয়েছে। তার বিষয়টা ছিল আত্মবোধ। যেটা বাঙলায় আছে তারই তর্জ্জমা নয়… এই বিষয়টাই নতুন ক’রে লিখেছি। এখানকার অধ্যাপক মণ্ডলীর সেটা খুব ভাল লেগেছে।… এই হপ্তাটা আর একটা লিখেছি, তার বিষয়টা ব্রহ্মসাধন, সেটা কাল প়়ড়ব… এবং পর সপ্তাহের জন্যও আর একটা লেখার সূত্রপাত করেছি।… মনে হচ্চে এই আর একটা আবর্ত্তের সৃষ্টি হল, আমেরিকায় এইটের ঘূর্ণিই ঘুরপাক খাওয়াবে… আর আমার ছুটি নেই।”

ইউনিটেরিয়ান চার্চে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রথম বক্তৃতাটি সম্বন্ধে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ ‘বিশ্ববোধ’ নামে তাঁহার বাঙলা প্রবন্ধের একটি ইংরেজি অনুবাদ (সতীশ রায় কৃত) তাঁহার কাছে ছিল, সেই লেখাটাই পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধন করিয়া unity club-এর গির্জায় পাঠ করিলেন” (রবীন্দ্রজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, ২১)। রবীন্দ্রনাথের “বিশ্ববোধ” প্রবন্ধটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের অশীতিতম সাম্বৎসরিক উৎসবে আদি ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা গৃহে প্রদত্ত ভাষণ। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ভক্তদের কাছে দেওয়া উপাসনার ভাষণ এবং আর্বানা শহরে আমেরিকান বুদ্ধিজীবী শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে উপনিষদের উপর দার্শনিক আলোচনার ভাষণ এক ছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। এই বক্তৃতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রজীবনীকারের দেওয়া তথ্য সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের নিজের একটি চিঠির উপর ভিত্তি করে লেখা। রবীন্দ্রনাথ আর্বানা থেকে লিখেছিলেন, “আমার বিশ্ববোধের একটা তর্জমা সতীশবাবু করেছিলেন,… সেইটাকে আমি সংশোধন ও পরিবর্তন করে টাইপ করিয়ে রাখিয়েছিলেম… তাড়াতাড়ি সেইটের সঙ্গে একটা ভূমিকা জুড়ে দিয়ে গির্জ্জাঘরে সন্ধ্যাবেলা পড়েছিলুম।” (অজিত চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ১৫ নভেম্বর, Urbana)। বোঝা যায় আগের চিঠিতে যে ভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে “এরণ্ড” বলেছেন, এই চিঠিতেও সেই ভাবে নিজের লেখা সম্বন্ধে বলেছেন। ইউনিটি ক্লাবে বলবার জন্য ইংরেজি ভাষায় যে প্রবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন, তা’তে তাঁর বাঙলা “বিশ্ববোধ” প্রবন্ধের এবং সতীশচন্দ্রের করা অনুবাদের কতটুকু ছিল সে গবেষণার বিষয়। কারণ এর কয়েক সপ্তাহ পরেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে “Man’s Relation to the Universe” শিরোনামে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। “The Relation of the Individual to the Universe” নামে সেটি “সাধনা” গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বক্তৃতা কোনোভাবেই “বিশ্ববোধ” বাঙলা প্রবন্ধের অনুবাদ, সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ বা অনুসৃজন (transcreation) ছিল না, কোনো পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত রূপও ছিল না। একই বিষয়ের উপরে এ ছিল এক নতুন রচনা, আমেরিকায় বসে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ইংরেজি ভাষায় লেখা। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় পঠিত “বিশ্ববোধ” প্রবন্ধটি প্রার্থনারই অন্য এক রূপ। প্রথম থেকেই লেখার মধ্যে প্রার্থনার সুর। প্রবন্ধ শেষ হয়েছে পুরোপুরি প্রার্থনায়: “হে প্রভু… আমার সমস্তই নাও, সমস্তই ঘুচিয়ে দাও, তাহলেই তোমার সমস্তই পাব— মানব জীবনে সকলের এই শেষ কথাটি ততক্ষণ বলবার সাহস হবে না, যতক্ষণ অন্তরের ভিতর থেকে বলতে না পারব: রসো বৈ সঃ, রসং হ্যেবায়ং লব‌্ধ্বানন্দী ভবতি: তিনিই রস, যা কিছু আনন্দ তা এই রসকে পেয়েই।”

আলোচনা ভিত্তিক প্রবন্ধ “ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের সম্বন্ধ” (The Relation of the Individual to the Universe) শুরু থেকেই অন্য সুরে বাঁধা। প্রথম সতেরো অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় এবং প্রাচীন গ্রীক ও ইয়োরোপীয় সভ্যতার তুলনামূলক যে আলোচনা করেছেন, “বিশ্ববোধ” প্রবন্ধে তা কোথাও নেই। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে যেখানে যেখানে দুইটি প্রবন্ধে মিল আছে মনে হয়, মনোযোগ সহকারে পড়লে বোঝা যায় “সাধনা”র প্রবন্ধটির প্রতিটি বাক্য রবীন্দ্রনাথ নতুন ক’রে লিখেছেন। অনেকসময় দর্শনের পরিভাষা বদলে দিয়েছেন। যেমন বাঙলা প্রবন্ধে বার-বার যেখানে “চিত্ত” শব্দটি ব্যবহার করেছেন ইংরেজি প্রবন্ধে সেখানে লিখেছেন soul (আত্মা)। চিত্ত (mind) এর তর্জমা soul নয়। কাজেই বাঙলা প্রবন্ধে যেখানে চিত্তবৃত্তির উপর আলোচনা করেছেন, ইংরেজি প্রবন্ধে সেখানে আলোচনা করেছেন আত্মার উপলব্ধির উপরে। দুইটি প্রবন্ধের দৃষ্টিকোণ আলাদা।

একই কথা “সাধনা”র অন্তর্ভুক্ত “Realisation in Action” প্রবন্ধ সম্বন্ধেও বলা যায়। রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “এই প্রবন্ধটি তাঁহার কর্মযোগ প্রবন্ধের অনুবাদ: সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বিলাতে ছিলেন— তিনি সেটি অনুবাদ করে দেন” (২য় খণ্ড, ৩৪)। রবীন্দ্রনাথ নিজেই “সাধনা” গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন, “The last paper of this series, ‘Realisation in Action’ has been translated from my Bengali discourse on ‘Karma Yoga’ by my nephew Surendra Nath Tagore।“ “সাধনা” গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা যায় আলোচ্য প্রবন্ধটি গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ নয়। “কর্মযোগ” এবং “Realisation in Action” আদৌ এক প্রবন্ধ নয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, কর্মযোগ প্রবন্ধে বলছেন, “আসল কথা যিনি সত্যস্বরূপ সেই ব্রহ্মকে ত্যাগ করতে গেলে আমরা বাঁচি না।” Realisation in Action প্রবন্ধে লিখছেন, “The real truth is, we cannot live if we devide him who is truth itself in two parts।” দুইটি বাক্যের অর্থ ভিন্ন। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃত “কর্মযোগ” অনুবাদের স্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ উৎসাহ দানের নিদর্শন বলা যায়।

“সাধনা” গ্রন্থে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত চিন্তা এবং উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে, সে সব তাঁর লেখা কবিতায়, গানে, নাটকে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, উপাসনার ভাষণে নানা ভাবে নানা সময়ে পাওয়া যায়। “সাধনা”র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে দেওয়া তাঁর ভাষণের উল্লেখ করেছেন। “সাধনা”র প্রবন্ধগুলি অবশ্যই ছোটদের কাছে দেওয়া তাঁর বাঙলা ভাষণের ইংরেজি রূপান্তর মাত্র নয়। ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ সতীশচন্দ্র রায় ও অজিতকুমার চক্রবর্তীর করা অনুবাদের উল্লেখ ক’রে বলেছেন, “I have used here and there translations of passages from these done by my friends, Babu Satish Chandra Roy and Babu Ajit Kumar Chakravarti.” কিন্তু প্রবন্ধগুলির পূর্ণাঙ্গ রূপের মধ্যে অন্যের করা অনুবাদের, বিশেষ করে অন্যের ভাষার কোনো সন্ধান মেলে না।

এই প্রসঙ্গে অজিত চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি স্মরণ করা যায়। নিজের বাঙলা লেখার নিজের করা তর্জমা সম্বন্ধে ১২মে ১৯১৩ লন্ডন থেকে তিনি লিখছেন, “আমি আজকাল যে ভাবে তর্জমা করি তা’তে তর্জমার মধ্যে মূলের চেহারা খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার এ গুলো প্রতিভাতি: প্রতিমূর্তি নয়। কেননা বাঙলার বাঁশি যে রন্ধ্রে বাজে, ইংরেজির বাঁশি সে রন্ধ্রে বাজে না এই জন্যে সুরের সঙ্গে সুর মেলাবার চেষ্টাই আমি ছেড়ে দিয়েছি।…. আমি ইংরেজি লিখি আমার ‘স্বপ্ন চৈতন্যে’র তলায় বসে,… এই জন্যে কোমর বেঁধে লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব, একেবারে হাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে লিখতে হয়। তারপরে যখন কূলে এসে পৌঁছই তখন নিজেই স্পষ্ট করে বুঝতে পারিনে ঘটনাটা কেমন করে ঘটল।” আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, “ইংরেজির একটি স্বতন্ত্র সৌন্দর্য এবং গৌরব আছে, সেইটেকে অধিকার করে নবজন্ম লাভ করতে পারলে তবেই এ লেখাগুলি সার্থক হতে পারবে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে লিখি বলেই আমি এই রচনায় আনন্দ পাই” (২৯ ফাল্গুন ১৩১৯, Urbana, অজিত চক্রবর্তীকে লেখা পত্র)। যদিও চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, তাঁর গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর এই কথা সমভাবে প্রযোজ্য।

“সাধনা”র প্রবন্ধগুলির রচনা প্রসঙ্গে এই আলোচনা বিস্তারিত ভাবে করার তাৎপর্য আছে। ১৯১৩ সালে “সাধনা” প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর একশো বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। গ্রন্থটি নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো নির্ভরযোগ্য বাঙলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। তার মূল কারণ কিছু রবীন্দ্র-সমালোচকের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অনেক বাঙালী পাঠকের মনে এই ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে “সাধনা”র প্রবন্ধগুলি শান্তিনিকেতনের “মন্দিরে” এবং ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের ভাষণের ইংরেজি তর্জমা মাত্র। সেও প্রধানত অন্যের করা তর্জমা, যার কিছু কিছু পরিবর্তন ও পরির্দ্ধন ক’রে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন। এঁদের মতে রবীন্দ্রনাথের নিজের ইংরেজি ভাষার উপরে তেমন দখল ছিল না।

বিরুদ্ধ প্রচার যাই হোক না কেন, প্রকৃত তথ্য এই যে “সাধনা” গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথের নতুন সৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে “পিতৃস্মৃতি”তে রথীন্দ্রনাথ লিখছেন, “বাবা তখন Sadhana নামে ইংরেজি বইয়ের প্রবন্ধগুলো লিখছেন। এক একটা লেখা শেষ হয়, আর আমি তা টাইপ করতে দিই। কিন্তু ঘনঘন সংশোধন-সংযোজনের ফলে দেখা গেল, লোক রেখে টাইপ করানো বেশ খরচ-সাপেক্ষ হচ্ছে। আমি তখন একটা ছোটো-খাটো মেশিন কিনে নিজেই টাইপ করতে লাগলাম”(১৬০)।

এক একটি প্রবন্ধ শেষ হ’লে অধ্যাপক সেমুরের (Seymour) বাড়ির আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী ও ইউনিটারিয়ান চার্চের (Unitarian Church) ফাদারদের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ সেটি পাঠ করতেন। রথীন্দ্রনাথ লিখছেন, “এঁদের আগ্রহ দেখে বাবা একে একে Sadhana র সব কটি প্রবন্ধই পড়ে শুনিয়েছিলেন। এক একটি প্রবন্ধ যেন এক-এক দিনের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াত” (পিতৃস্মৃতি, ১৬১)। শ্রোতাদের প্রশ্ন, উত্তর, আলোচনার ফলে সংশোধন ও সংযোজনে প্রতিটি প্রবন্ধ যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তা সহজেই অনুমেয়।

এই ঘরোয়া আলোচনা সভার নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন শ্রীমতী মেয়েস সেমুর (Mrs. Mayce Seymour)। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও আলোচনার কথা স্মরণ ক’রে তিনি “That Golden Time” প্রবন্ধে লিখেছেন,

It was our good fortune that as soon as he had finished an essay, he permitted us to invite to our home any of our friends who we thought would be interested in hearing the essay read. He wished to try out what he had written on an American audience…. After the reading of the essay and the discussion which naturally followed there was also a request for a reading of verse…. (The) world and its confusions and strivings forgotten and the prairie shut out, we listened…. the quiet group of listeners, most of us still young, open-minded and sensitive to the outpouring of great ideas and to the poetical expression (9-10).

ইউনিটারিয়ান চার্চে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতাগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক হ্যারোল্ড হারউইট‌্জ (Harold Hurwitz) তাঁর “Tagore in Urbana Illinois” প্রবন্ধে লিখেছেন, “Tagore’s listeners in Urbana, like those who heard him lecture in England, were deeply impressed by his dignity and beauty, as well as by the lucidity of his presentation.” (Indian Literature, 29)। আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিদ্বজ্জনসভায় রবীন্দ্রনাথ যখন ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিক জীবন-সাধনার উপর প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা করেছিলেন তখন বহু শ্রোতারই এই রকম উপলব্ধি হয়েছিল। এঁদের কিছু কিছু স্মৃতিকথা এবং চিঠিপত্র তার সাক্ষ্য বহন করে। এই লেখাগুলি ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ রবীন্দ্র-সমালোচকদের একাংশ বছরের পর বছর ধরে প্রচার করেছেন যে আমেরিকাবাসী রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলির কোনো সমাদর করেননি।

ইউনিটারিয়ান চার্চের বক্তৃতাগুলি শেষ হতে না হতে ইলিনয় (Illinois) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ এলো ভারতীয় দর্শনের উপর দশটি বক্তৃতার একটি বক্তৃতামালা দেওয়ার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের উদ্যোগে সকলের জন্য দুইটি পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি বক্তৃতার আয়োজন করা হলো। আমন্ত্রণ এলো শিকাগো (Chicago), উইসকনসিন (Wisconsin), আয়োয়া (lowa), মিশিগান (Michigan), পারডুয়ে (Purdue) বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও।

আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় দর্শন, বিশেষ ক’রে উপনিষদের উপর বক্তৃতা দেওয়ার এই আহ্বান অভাবনীয় ছিল না। আমেরিকার বিদ্বৎসমাজে ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ বহুদিন থেকেই ছিল। ১৮৪২ সালে আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি (American Oriental Society) স্থাপিত হয়। ১৮৫৬ সালে সাহিত্যিক এমারসন (Emerson) গীতার উপর ভিত্তি করে “Brahma” কবিতাটি এবং “The Oversoul” নামক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ লেখেন। এর পরেই প্রকাশিত হয় এডউইন আরনল্ডের (Edwin Arnold) “Light of Asia”। ১৮৭০ এর দশক থেকে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা ভারতের ধর্ম ও দর্শনের উপর নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতেন। এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের প্রবক্তা শ্রীপ্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বক্তৃতাগুলি স্মরণীয়।

১৮৯৩ সালে শিকাগোর Parliament of Religion এ প্রদত্ত স্বামী বিবেকানন্দের যুগান্তকারী ভাষণ এবং তার পরবর্তীকালে আমেরিকার নানা জায়গায় দেওয়া তাঁর বক্তৃতা ও আলোচনাসভা ভারতীয় দর্শনের প্রতি আমেরিকাবাসীর আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল। ১৮৯৪ সালে বস্টনে শ্রীমতী সারা বুল (Sara Bull) এর বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিদিন যখন উপনিষদ, ভগবদ‌্গীতা ও শঙ্করাচার্যের দর্শনের উপর ক্লাস নিতেন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে আমেরিকার খ্যাতনামা দার্শনিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপকেরা থাকতেন। দার্শনিক হেনরি জেমস (Henry James), সাহিত্যিক উইলিয়াম জেমস (William James), অধ্যাপক আরভিন ব্যাবিট (Irvin Babbit), আর্থার রাইডার (Arthur W. Ryder) নিয়মিত থাকতেন। অধ্যাপক রাইডারের করা ভগবদ‌্গীতার এবং মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলমের বহু প্রশংসিত অনুবাদ ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যকে আমেরিকার সর্বত্র এবং মহাসাগর পার হয়ে নানা দেশের ইংরেজি জানা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। অধ্যাপক ব্যাবিট “ধম্মপদ”-এর অনুবাদ করেন। অধ্যাপক ল্যানম্যানের (Lanman) লেখা “Sanskrit Reader” আমেরিকায় সংস্কৃত ভাষা চর্চার ভিত গড়ে তোলে।

শ্রীমতী বুল বিভিন্ন সময়ে Cambridge Conference on Comparative Philosophy র যে আয়োজন করতেন তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে বেদান্ত দর্শনের আলোচনা। এই প্রসঙ্গে হার্ভার্ডের পত্রিকা আউটলুকে (Outlook) প্রকাশিত অধ্যাপক ল্যানম্যানের একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায়। তিনি লিখেছেন,

Modern philosophical critics may admit or deny the Value of Upanishads and the systems (Darshanas) as speculations, but the loftiness and honesty of purpose of these ancient teachers cannot be denied. They have never lost sight of the one great practical end of all their teachings, the liberation of the soul. As for the Upanishads the practice we little realise in the occident how holi and saintly have been the lives of the thousands of the ancient Vedantins. (“Vedanta”, Prabrajika Prabuddhaprana, 110)

রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় পদার্পণ করার বহু আগেই সেখানকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় দর্শনের উপর পঠন পাঠন ও গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল। এই সমস্ত তথ্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের “সাধনা” বক্তৃতামালা বুঝবার এবং সাদরে গ্রহণ করবার ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল।

আর্বানাতে একটানা থাকবার দিন শেষ হয়ে গেল। ১৯১৩ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার বিষয় ছিল “Ideals of the Acient Civilisation of India”। আমেরিকায় এই পর্বে দেওয়া তাঁর প্রতিটি বক্তৃতার এই ছিল মূল সুর। “সাধনা” গ্রন্থেরও এটিই মূল বিষয়। রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় বসে লেখা পিতার প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে লিখেছেন, “প্রবন্ধগুলি লেখা শেষ হয়ে গেছে। প্রবন্ধের বিষয় হল ভারতের অধ্যাত্মজগতের গভীর সব মর্মবাণী। পশ্চিম জগতে ভারতের এই মর্মবাণী পৌঁছে দেবার জন্য বাবার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল।” (পিতৃস্মৃতি, ১৬১)।

২৯ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ রোচেস্টার, নিউ হ্যাম্পসায়ারে (Rochester, New Hampshire) পৌঁছান। সেখানে The Federation of Religious Liberals Congress এ বক্তৃতার জন্য তাঁর আমন্ত্রণ ছিল। বক্তৃতার বিষয় ছিল Race Conflict, বক্তৃতাটি খুবই সমাদৃত হয়। এই মহাসভায় দেশবিদেশের নানা মনীষী উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা সম্বন্ধে খ্রীস্টান রেজিস্টার (Christian Register) কাগজে লেখা হয়েছিল, “রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় মহাসভার সমস্ত সুর এক উচ্চ গ্রামে উঠিয়া পড়িয়াছিল। কংগ্রেস মঞ্চে তাঁহার অপেক্ষা… অধিকতর উচ্চ ভাবপূর্ণ কথা বলিতে সক্ষম ব্যক্তি আর কেহ ছিল না” (প্রভাত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, ২৭)। “সাধনা” গ্রন্থের প্রতিটি বক্তৃতাও এই রকমই উচ্চগ্রামে বাঁধা।

শিকাগোর পরেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতামালা। সেখানকার বিষয় ছিল, Indian Philosophy in its Application to Life। প্রত্যেকটি বক্তৃতা ছিল এই বিষয়ের এক একটি দিকের উপরে। বিষয়বস্তুর শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় ভারতীয় দর্শনের দুরূহ তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার এই বক্তৃতামালার আলোচনার ক্ষেত্র ছিল না। বক্তৃতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবার সময় তাৎপর্যপূর্ণভাবেই গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয়েছিল, Sadhana the Realisation of Life। ভারতীয় দর্শনের লক্ষ্য নিঃশ্রেয়স সিদ্ধি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ছাড়া হয় না। এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করার বিশেষ কারণ আছে। রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা অধ্যায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু সমালোচক অভিমত প্রকাশ করেন এবং বহুল প্রচার করেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ আয়োজন করলেও রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ভারতীয় দর্শনের উপরে ছিল না। ভারতীয় দর্শনের দুরূহ তত্ত্বের কোনো বিশ্লেষণই এখানে নেই।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতামালা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৩ থেকে। কোনো অনিবার্য কারণে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বক্তৃতাটি দিতে পারেননি। দ্বিতীয় বক্তৃতা হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমারসন হল এফ (Emerson Hall F) এ। বিষয় ছিল The Problem of Evil (অশুভের সমস্যা)। বক্তৃতাটি সম্বন্ধে হার্ভার্ড ক্রিমসন (Harvard Crimson) পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছিল,

“Lecture by Indian Philosopher”

Mr. Rabindranath Tagore of Calcutta, India will lecture in Emerson F today at 4.30 o’clock on “The Problem of Evil’. The lecture will be open to members of the university. It will be followed by the lecture on Monday afternoon at the same time and place on “Man’s relations to the Universe”.

Evil এর উপর বক্তৃতাটি রবীন্দ্রনাথ আর্বানাতে বসে লিখেছিলেন। ইউনিটারিয়ান চার্চে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা শুনতে শুনতে “দুই একজন শ্রোতা প্রশ্ন তুলেছিলেন Evil সম্বন্ধে আমার কি বক্তব্য আছে? আমি বলেছিলুম প্রশ্নটি অত্যন্ত কঠিন এবং মুখে মুখে তার মীমাংসা হওয়া শক্ত অতএব আমি লিখে বলব। সেইটে লিখতে বসেছি।” (অজিত চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ৮ ডিসেম্বর ১৯১২/ ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৩১৯)

হার্ভার্ডে দেওয়া Evil-এর উপর বক্তৃতাটির প্রশংসা ছড়িয়ে যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারির হার্ভার্ড ক্রিমসন পত্রিকার প্রতিবেদনে এই সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল,

In the East Mr. Tagore holds an unparalleled position, and the reputation has risen to the considerable height in the West also. Since coming to America he has been received with enthusiasm in various cities and universities.

The subject of yesterday’s lecture was “The Problem of Evil”. Mr. Tagore said in part: life is essentially in motion and evil helps to draw it forward. But too often we exaggerate its importance by regarding it as static. True movement of life is towards the enlargement of itself; selfishness may be regarded as the basic cause of evil, and society having thus gotten out of gear, we are obliged to the coercion to maintain order. Evil proves the dignity of life in that it is the right of man to suffer, but it is the duty of man to turn evil to good. As the opposite of joy for work well done we must pay for evil in the hard coin of pain.

সেদিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রোতারা যে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছিলেন প্রতিবেদনটি থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। “সাধনা”র কোন্ বক্তৃতা হার্ভার্ডে কখন দেওয়া হয়েছিল, এবং শ্রোতারা সুদূর প্রাচ্যের এই দার্শনিক-কবিকে কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়ে রবীন্দ্রজীবনীকারেরা স্পষ্ট ছবি দিতে না পারায় নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর এমন কি নেতিবাচক সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে।

হার্ভার্ডে পরের বক্তৃতার বিষয় ছিল, “Man’s Relation to the Universe”। ১৮ ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ড ক্রিমসনে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছিল,

Mr. Rabindranath Tagore of Calcutta, Bengal will lecture in Emerson F this afternoon at 4.30 o’clock on “Man’s Relation to the Universe”. It will be followed by a lecture tomorrow evening in Emerson A at 8 o’clock on “Brahma.” Mr. Tagore is the foremost philosopher-poet of the East at the present day. The lectures which are open to the university will be delivered in English.

হার্ভার্ডের বক্তৃতামালার পরবর্তী পর্যায় ছিল এপ্রিল মাসে। রবীন্দ্রনাথ আর্বানায় ফিরে এলেন। আসবার আগে বস্টনের ফিলসফিকাল ক্লাব (Philosophical Club) এ, এন্ডোভার ডিভিনিটি ক্লাব (Andover Divinity Club) এ এবং উইস‌্কনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে এলেন। আর্বানায় ফিরে হার্ভার্ডের পরবর্তী বক্তৃতাগুলি তৈরি করার পালা। এই বিষয়ে ৪ মার্চ ১৯১৩ (২০ ফাল্গুন ১৩১৯) আর্বানা থেকে অজিত চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এখানকার দিন সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে বলে এই অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে অনেক কাজ সেরে ফেলতে হবে। তিনটে বক্তৃতা লিখতে প্রতিশ্রুত আছি— একটা বিদ্যালয় সম্বন্ধে, একটা The Problem of Self সম্বন্ধে এবং আর একটা সৌন্দর্যবোধ সম্বন্ধে। হার্ভার্ডে এই তিনটে পড়েই একেবারে জাহাজে পা দেব।” আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমার গদ্য প্রবন্ধের বিষয় হচ্চে The Problem of Self— বস্টনে যখন বক্তৃতা করছিলুম তখন আমার শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছিলেন— ‘কিন্তু তোমরা Self কে একেবারে লোপ করে দিয়ে মুক্তি সাধনা করতে চাও— সে সম্বন্ধে তোমার মত কি জানতে চাই।’ আমি বলেছিলুম, ‘এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য মুখে মুখে বলে নষ্ট করতে চাইনে আমি লিখে বলব।’ সুতরাং লিখতে হচ্চে এবং এ দেশ থেকে বিদায় হবার আগে বস্টনে সেটা পাঠ করে যেতে হবে। বিষয়টি বেশ পরিষ্কার করে লিখে ফেলতে পারলে এদের নতুন লাগবে বলে বোধ হচ্ছে।” (১৩ মার্চ ১৯১৩, ২৯ ফাল্গুন ১৩১৯)।

৭ এপ্রিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্যায়ের বক্তৃতা শুরু হলো। সে দিনের বিষয় ছিল “The Problem of Self”। বিশ্ববিদ্যালয়ের সে দিনের অনুষ্ঠানসূচী “What is going on today” তে লেখা হয়েছিল:

4.30— Lecture on “Indian Philosophy in its Application to life,

V. “The Problem of Self” by Rabindranath Tagore, Esq,

In Emerson D.”

হার্ভার্ড ক্রিমসন পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ছিল,

Additional Lectures by Mr. Tagore

The division of Philosophy has invited Mr. Rabindranath Tagore, the famous philosopher—poet of India, who has been travelling in this country to give two additional lectures beside those which he gave during the first part of March on “Indian Philosophy in its Application to Life.” The first lecture will be on “The Problem of Self” in Emerson D on Monday at 4.30 o’clock, and the other will be on “Realisation through Love” in Emerson D on Wednesday at 8 o’clock.

“The Problem of Self”-এর উপরে বক্তৃতাটি হয়ে যাওয়ার পরে হার্ভার্ড ক্রিমসন পত্রিকায় অধ্যাপক রবার্ট র‌্যাট‌‌‌‌‌‌‌‌্রের (Robert F. Rattray) লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয়,

Mr. Tagore recently lectured here with marked appreciation. May I through you, call attention to the significance of Mr. Tagore? In the Times Literary Supplement for March 20. 1913, leading article is the following,

‘A new star, perhaps the first magnitude, has lately appeared in the Indian poet, Rabindranath Tagore, whose exquisite art and keen vision of the eternal through the temporal stamp him as a religious genious of rare power.

রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় ভারতীয় দর্শনের মূল তত্ত্বের আলোচনা আমেরিকার শ্রোতাদের কাছে যে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল অধ্যাপক র‌্যাটরের চিঠি থেকে তা সহজে বোঝা যায়। বক্তৃতামালার শেষ বক্তৃতা “Realisation through Love” হয়েছিল ৯ এপ্রিল রাতে।

একদিকে যেমন বক্তৃতাগুলির প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো, অন্যদিকে তেমন রক্ষণশীল খ্রীষ্টান সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগলো। আমেরিকার রক্ষণশীল খ্রীষ্টান সমাজ চিরদিনই ভারতীয় দর্শনের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিরুদ্ধ সমালোচনা উপেক্ষা ক’রে হার্ভার্ডের উদারপন্থী অধ্যাপকেরা প্রবন্ধগুলি তখনই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বার-বার অনুরোধ জানালেন। শিকাগো থেকে শ্রীমতী মুডিও একই অনুরোধ করলেন। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অজিত চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে লিখছেন, “Dr. Woods এগুলি গ্রন্থাকারে ছাপাবার ভার নিতে চেয়েছেন— তাহলে আমেরিকাতেই এগুলি প্রকাশ করা হবে। ম্যাডিসনে (Wisconsin University) The Relation of the Individual to the Universe প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলাম। শ্রোতারা বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেছেন। সকলেই এই কথা বলচেন যে এই বাণী আমাদের অত্যন্ত দরকার— এবারে বস্টনে গিয়ে আমার এই প্রবন্ধগুলি ছাপাবার ব্যবস্থা করব। Mrs. Moody আমাকে বারবার বলচেন এই বই আমেরিকায় খুব আদর ও প্রচার লাভ করবে।” (৫ এপ্রিল ১৯১৩, শিকাগো)

হার্ভার্ডের অধ্যাপক র‌্যট্‌রেকে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধগুলি পড়তে দিয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে অজিত চক্রবর্তীকে লিখছেন, “তাঁকে আমার প্রবন্ধগুলি পড়তে দিয়েছিলুম। তিনি ত খুবই উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। The Problem of Evil বলে যে প্রবন্ধ লিখেছি, সেটা পড়ে তিনি বল্লেন Evil সম্বন্ধে যত আলোচনা তিনি যেখানে পড়েছেন এটা তাঁর কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে। হার্ভার্ডে প্রবন্ধপাঠ সম্বন্ধে আমার মনে একটু দ্বিধা ছিল— বিশেষতঃ আমার ভাষা সম্বন্ধে— সেটা এখন আমার কেটে গিয়েছে।” (শিকাগো, তারিখ নেই)

প্রবন্ধগুলি রবীন্দ্রনাথ রোটনস্টাইনকেও (Rothenstein) পড়তে দিয়েছিলেন। সেগুলি পড়ে রোটনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে যে চিঠি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেই চিঠির থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখছেন,

“আমেরিকায় যে বক্তৃতাগুলো লিখেছিলাম— সম্প্রতিমাত্র সেগুলো তাঁকে (রোটনস্টাইন) দেখতে দিয়েছিলুম পড়ে তিনি লিখছেন,

I am deeply moved by your lectures which I have just read…. Published they must be, for nothing so clear, so direct, so inspired by experience has, to my knowledge at least, been written about the unity of man with God, a subject so often delt with, either by abstruse metaphysicians or by vague and not very convincing amateurs of religion. Of course, it is your poetry over again, the same power of sending a line to bring up active personal experience and inspiration without which no writing can possess a spark of true life…. reading such work makes me feel the absolute necessity of art and poetry as a step to the sense of immense value of life, a sense few men can get without a leader.

এরকম চিঠি পেলে আমার নিজের মনে অত্যন্ত একটা বিস্ময় উদ্রেক করে। তার প্রধান কারণ হচ্চে আমার কোনো ভাল লেখা আমার জাগ্রৎ শক্তির দ্বারা ঘটেনি। এ কথা মনে না করে আমি থাকতে পারিনে যে আমি উপলক্ষ্য।” (অজিত চক্রবর্তীকে লেখা পত্র, ২৯ বৈশাখ ১৩২০, দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭৭, ২৮)

বলা হয় রবীন্দ্রনাথের “সাধনা” তাঁর নিজেরই সাধনার ফসল। নিজের লেখা সম্বন্ধে তিনি চিঠিতে যা লিখেছেন, সে এক সাধকের উপলব্ধির প্রকাশ।

বক্তৃতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হলো। বিদেশী অধ্যাপকদের অনুরোধে গ্রন্থটির নামকরণে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা হলো, Sadhana, the Realisation of Life। ম্যাকমিলান কম্পানী (Macmillan Company) প্রকাশনার দায়িত্ব নিলেন। শ্রীআরনেস্ট রাইস (Mr. Ernest Rhys) নিলেন প্রতিলিপি (proof) সংশোধনের ভার। ১৯১৩ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডন থেকে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হলো। সেই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেই সেটি দুই বার পুনর্মুদ্রিত হলো। এরপর ১৯১৪ থেকে ১৯২১ প্রতি বছর কখনো একবার কখনো দুই বার গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল। গীতাঞ্জলির মতোই “সাধনা” দেশে দেশে বিদ্বজ্জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

(২)

গ্রন্থটির “সাধনা” নামের একটি তাৎপর্য আছে। ব্যাপক অর্থে কোনো বিষয়ে সিদ্ধি লাভের জন্য ঐকান্তিক প্রযত্নকে বলা হয় সাধনা। আধ্যাত্মিক প্রকৃতির মানুষ পারমার্থিক সিদ্ধি চান, মোক্ষলাভ করতে চান, মুক্তি চান। তাঁদের সাধনার লক্ষ্যও তাই হয়। অনেকে জাগতিক ও পারমার্থিক উভয়প্রকার সিদ্ধি কামনা করেন। ভারতের সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্রে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গকে সাধনার লক্ষ্য বা পুরুষার্থ বলা হয়েছে।

সব মানুষই স্থায়ী সুখ চান। যথার্থ স্থায়ী সুখ কি এবং কেমন করে পেতে হয় জানার জন্য সাধনা প্রয়োজন। স্থায়ী সুখ সম্বন্ধে ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেন, “নাল্পে সুখমস্তি। ভূমৈব সুখম্।” অল্পে সুখ নেই, ভূমাতে সুখ। ভূমা ব্রহ্ম, ভূমা আত্মা। স্থায়ী সুখ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি, অপরোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান, আত্মজ্ঞান। সাধনার চরম লক্ষ্য এই পারমার্থিক সুখ বা আনন্দ। নিরন্তর সাধনা ছাড়া ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার হয় না। ভারতের সব দর্শনেই এই মত স্বীকৃত।

ভারতীয় দর্শনে সাধনার নানা পর্যায়ের কথা বলা হয়। শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ও সাক্ষাৎকার এই চারটি মূল পর্যায়। দর্শনের ভাষায় কেবলমাত্র শোনাকে “শ্রবণ” বলা হয় না। শ্রবণের অর্থ সমস্ত শাস্ত্র গুরুমুখে শুনে এবং স্বয়ং অধ্যয়ন ক’রে গ্রন্থের ও গুরুবাক্যের তাৎপর্য নিশ্চয় করা। শাস্ত্রের তাৎপর্য অবধারণ করার পরে সেই বিষয়ে অবিরত চিন্তা করা এবং অনুকূল যুক্তি দিয়ে শাস্ত্রতত্ত্ব দৃঢ়নিশ্চয় করার নাম “মনন”। বিরুদ্ধ যুক্তিতে শুষ্ক বিচার করা হয়, তাতে কেবল সংশয়ই বাড়ে মনন হয় না। “নিদিধ্যাসনে”র অর্থ নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা বা ধ্যান। শ্রবণ ও মননের দ্বারা বিচার ক’রে, যে স্বরূপে মন স্থির হয়ে যায়, তাতে ধ্যান করা বা চিত্ত স্থির করাকে বলা হয় “নিদিধ্যাসন”। সাধনার শেষ পর্যায়ে “সাক্ষাৎকার”। চিত্তের একাগ্রতায় সাধক তখন অদ্বিতীয় ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান লাভ করেন। আমি চৈতন্য স্বরূপ, আমার বন্ধন নেই, মুক্তি নেই, “ন মে অস্তি বন্ধঃ ন চ বিমোক্ষঃ” এই উপলব্ধি হয়। নিজের আত্মা অখণ্ড ব্রহ্মস্বরূপ এই জ্ঞানের উন্মেষে ব্রহ্মবিষয়ক সমস্ত অজ্ঞান দূর হয়ে যায়। বুদ্ধির বিচার ব্রহ্মোপলব্ধিতে বিলীন হয়ে যায়।

ভারতীয় দর্শন অধিকার ভেদে পৃথক পৃথক সাধনার উপদেশ দিয়েছেন। মানুষের মনোবৃত্তি, রুচি, ধারণাশক্তি যেমন ভিন্ন ভিন্ন সাধনমার্গও তেমন ভিন্ন ভিন্ন। সাধনার কয়েকটি মার্গ যেমন জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, কর্মমার্গ। মার্গ পৃথক হলেও লক্ষ্য এক। সমস্ত সাধনমার্গের পরিসমাপ্তি আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারে। “সাধনা” গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি সাধনার চারটি মূল পর্যায় অনুযায়ী বিন্যস্ত। প্রথম প্রবন্ধ The Relation of the Individual to the Universe (ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের সম্বন্ধ)। আমেরিকায় প্রদত্ত এই ভাষণের শিরোনাম ছিল “Man’s Relation to the Universe”. Man এর বদলে Individual শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। Man শব্দটির মধ্যে মানবজাতির এক সমষ্টিগত অর্থ নিহিত রয়েছে। সাধনা মানুষের সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি নয়। প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব ভাবে সাধনা করতে হয়। সাধনা ব্যক্তিমানুষের বিরামহীন প্রচেষ্টা ও উপলব্ধি।

প্রাচীন ভারতের ঋষিদের আদর্শ ছিল চেতনাকে উন্নত ক’রে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে এবং পারিপার্শ্বিকের মধ্যে থেকে সর্বব্যাপী সত্য উপলব্ধি করা। ঋষিরা বহু সাধনায় উপলব্ধি করেছিলেন একই শক্তি যা জগতের আন্তররূপের মধ্যে স্পন্দিত ও অনুস্যূত হচ্ছে তাই চেতনারূপে আমাদের অন্তরাত্মায় নিজেকে প্রকাশ করছে। এই ঐক্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই। যুগ যুগ ধরে ঋষিরাই ভারতবর্ষের আদর্শ। ভারতীয় জীবনের লক্ষ্য অনুভবে ও কর্মে সৃষ্টির এই মূলগত ঐক্য উপলব্ধি করা। ভারতের মানুষের বিশ্বাস, যে ব্যক্তি সমস্ত কিছুর মধ্যে শাশ্বত আত্মার সাক্ষাৎ পান, তিনি বন্ধন মুক্ত হন। তিনি নিজেকে পূর্ণ সত্যের মধ্যে দর্শন করেন। উপনিষদের বাণীর ব্যাখ্যা ক’রে রবীন্দ্রনাথ বলছেন সেই ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সেই হেতু তিনি সর্বজ্ঞ ও মঙ্গলস্বরূপ। জ্ঞানে, প্রেমে ও কর্মে সব জীবের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং এইভাবে সর্বব্যাপী ঈশ্বরের মধ্যে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করা মঙ্গলের মূল তাৎপর্য।

দ্বিতীয় প্রবন্ধ Soul Consciousness (আত্মচেতনা) থেকে সাধনার আলোচনা অন্তর্জগতে সমাহিত। এই প্রবন্ধ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া কোনো বিশেষ ভাষণ নয়, যদিও আত্মচেতনার আলোচনা রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার নানা ভাষণের মধ্যে বারবার এসেছে। উপনিষদের বাণী “আত্মানং বিদ্ধি”র উপর ভিত্তি ক’রে এই প্রবন্ধের আলোচনা। উপনিষদের দৃষ্টিতে মানুষের সমস্ত স্বার্থকেন্দ্রিক আবেগ, স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা আত্মা সম্বন্ধে তার যথার্থ দৃষ্টি অস্পষ্ট ক’রে দেয়। অবিদ্যা বা অজ্ঞান মানুষের চেতনাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে, মানুষকে নিজের সত্তার মধ্যে আবদ্ধ ক’রে রাখে। কিন্তু যখন মানুষ পারিপার্শ্বিকের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করে, অন্যের সঙ্গে নিজেকে এক ক’রে আনন্দ লাভ করে, সমস্ত রকম স্বার্থ ত্যাগ ক’রে গর্ব, লোভ ও ভয়ের ঊর্দ্ধে উঠে নিজের আত্মাকে দর্শন করে তখন তার আধ্যাত্মিক জীবনের দ্বার খুলে যায়। তার জীবনে সমস্ত বিরোধ ও বিরুদ্ধতার সমন্বয় সাধিত হয়। জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মিলন ঘটে। সমস্ত বিচ্ছিন্ন ধারণা প্রজ্ঞায় ঘনীভূত হয়। মানুষের পূর্ণ প্রকাশ হয়। উপনিষদ বলেন মানবাত্মার এই প্রকাশ তার মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ।

১৯১৩ সালে আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ।

শিকাগোতে শ্রীমতী মুডির সঙ্গে সপরিবারে রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩ সাল। ছবির পিছনে রথীন্দ্রনাথের লেখা, “At the front Pratima of Moody’s. 1913.”

আর্বানা শহরের সেই বাড়ি যেখানে রবীন্দ্রনাথ “সাধনা”র সমস্ত প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছবির পিছনে রথীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা, “The house in which we lived with father and Pratima at Urbana in 1913.”

১৯১৩, আর্বানায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার শ্রোতাদের এক অংশ। বসে আছেন, ডানদিক থেকে শ্রীমতী গালি (Mrs. Gulley), শ্রীমতী কুন্‌জ (Mrs. Kunz), কুমারী কার্টিস্ (Miss Kartis), রবীন্দ্রনাথ, শ্রীমতি মেয়েস্‌ সেমুর (Mrs. Mayce Seymourr), কুমারী ফ্যাপ্‌ (Miss Fapp), জোসেফাইন (Josephine), বারনেস্‌ গ্লাস্‌কো (Barness Glassco), বেসি এবং লুই স্মিথ (Bassie and Louie Smith). দাঁড়িয়ে আছেন— বাঁদিক থেকে নাম অজানা, ডঃ কুন্‌জ (Dr. Kunz), শ্রী রায় [বসন্তকুমার রায় ?] (Mr. Ray), ডঃ সেমুর (Dr. Seymour), নাম অজানা, শ্ৰী সিং (Mr. Singh), পরবর্তী দুইজনের নাম অজানা, ডঃ গ্লাসকো (Dr. Glassco), পরবর্তীদের নাম অজানা।

মার্চ ১৯১৩, ইলিনয়ে রবীন্দ্রনাথ।

তৃতীয় প্রবন্ধ The Problem of Evil (অশুভের সমস্যা)। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন অশুভ মানুষের অন্তরে বা বাইরে বা উভয়ত্র রয়েছে, কিন্তু অশুভ জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। মৃত্যু জীবনের চরম তত্ত্ব নয়। অশুভ অস্থায়ী ও অসম্পূর্ণ; জীবন গতিশীল। মানুষের সামনে সে পূর্ণতার আদর্শ তুলে ধরে। অশুভ কখনো জীবনের গতি রুদ্ধ করতে পারে না। জীবনের পূর্ণতা অর্জনের জন্য মানুষকে ক্রমাগত অশুভকে অতিক্রম করতে হয়। অশুভ থেকে শুভ, অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতা মানুষের অন্তরের লক্ষ্য। উপনিষদের ব্যাখ্যা ক’রে রবীন্দ্রনাথ বলছেন সুখ কেবল নিজের জন্য, কিন্তু মঙ্গল সর্বকালের, সকল মানবজাতির আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। যিনি মঙ্গলের আদর্শে জীবন যাপন করেন, তাঁর কাছে জীবনের এক ব্যাপক অর্থ থাকে। যথার্থ মঙ্গলের মধ্যে থাকার অর্থ অসীমের মধ্যে নিজের জীবনকে উপলব্ধি করা। যিনি তা করেন তিনি সুখ দুঃখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান।

পরবর্তী প্রবন্ধ Problem of Self (ব্যক্তিসত্তার সমস্যা) সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখছেন এক শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে তাঁর এই আলোচনার সূত্রপাত। প্রশ্ন ছিল, “ভারতবর্ষে কি সত্তার বিলোপকে মনুষ্যত্বের চরম লক্ষ্য বলে ধরা হয়নি?” আলোচনার প্রারম্ভেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সর্বাধিক মূল্যবান। ব্যক্তিসত্তাকে দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। একটি সত্তা নিজেকে প্রদর্শন করে, আরেকটি সত্তা নিজেকে অতিক্রম করে। মানুষের অবিদ্যা তাকে চিন্তা করতে শেখায় যে তার স্বতন্ত্র সত্তা স্বতন্ত্র রূপেই সত্য— তার জীবনের এইটি চরম লক্ষ্য। এই সত্তা আত্মকেন্দ্রিক, নিজের সুখ, নিজের স্বাধীনতা, নিজের আবেগ নিয়েই সে উদ্বিগ্ন। সে বিদ্রোহী, সংহারক, অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী। সে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে বন্ধনে পরিণত করে।

মানুষের নিজের মধ্যেই নিজের সীমাকে অতিক্রম ক’রে যাওয়ার ধারণা আছে, অসীমের উপলব্ধির আকাঙ্ক্ষা আছে। মানুষের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি সবসময় এমন কিছুর অনুসন্ধান করে যা তাকে অতিক্রম ক’রে থাকে, তা সত্ত্বেও যা নিগূঢ় সত্য। মানুষ যখন উপলব্ধি করে তার সত্তার অর্থ ঈশ্বর ও অন্য সকলের থেকে বিচ্ছেদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না, যায় ঐক্যের নিরবচ্ছিন্ন উপলব্ধিতে, যখন সে অনুধাবন করে তার নিজের মধ্যেই শাশ্বত আমি রয়েছেন, ব্যক্তি আমি পরিপূর্ণতা লাভ করে শাশ্বত আমির মধ্যে, তখনই অবিদ্যা বা মায়ার দাসত্ব বন্ধন থেকে তার পরিত্রাণ, আপাতঃ প্রতীয়মানতার থেকে তার মুক্তি, মঙ্গলে, প্রেমে, মিলনে তার পূর্ণতা।

পরবর্তী দুইটি প্রবন্ধ, Realisation in Love (‌প্রেমে উপলব্ধি) ও Realisation in Action (কর্মে উপলব্ধি) সাধনার দুইটি মার্গের উপর রচিত। “প্রেমে উপলব্ধি”র আলোচনার শুরুতেই রয়েছে উপনিষদের বাণী, “আনন্দের থেকে এই ভূত সকল জাত, আনন্দের মধ্যে জীবিত, আনন্দের দিকে তারা অগ্রসর হয় ও আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করে।” সৃষ্টিকর্তার পরিপূর্ণ আনন্দের থেকে এই জগৎ সৃষ্ট। এই আনন্দের আরেক নাম প্রেম। প্রেমস্বরূপ ঈশ্বরের মধ্যে সসীম ও অসীম এক হয়ে থাকে; দ্বৈত ও অদ্বৈত, বন্ধন ও মুক্তি বিরুদ্ধ নয়। বৈষ্ণব মতে, ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন। সেখানেই মানব অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠ মহিমা। মানবাত্মার যাত্রা চলেছে নিয়ম থেকে প্রেমে, নৈতিক স্তর থেকে আধ্যাত্মিকতায়। বৌদ্ধ মতে যিনি আধ্যাত্মিকতার স্তরে পৌঁছান, সর্বজীবে তাঁর অপরিসীম প্রেম থাকে, এবং এই প্রেম হয় সমস্ত ক্রুরতা, সমস্ত বিরুদ্ধতা মুক্ত। সাধক ঐক্যের সত্য উপলব্ধি করেন, পরম প্রেমিকের সঙ্গে বিশ্বাত্মার ঐক্য উপলব্ধি করেন।

Realisation in Action (কর্মে উপলব্ধি) প্রবন্ধে কর্ম ও মুক্তি সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার উল্লেখ ক’রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আমাদের দেশে অনেকে কর্মকে মুক্তির বিরুদ্ধ মনে করেন। তাঁদের মতে কর্ম ব্যবহারিক স্তরে রয়েছে বলে আত্মার নির্মল প্রাণ-চাঞ্চল্যে বাধা দেয়। রবীন্দ্রনাথ এই মত খণ্ডন ক’রে বলছেন, আনন্দ যেমন নিয়মের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে আত্মা সেইরকম কর্মে নিজের মুক্তি খুঁজে পান। উপনিষদ বলেন, “বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ” তিনি বিশ্বের আদিতে ও অন্তে রয়েছেন। তাঁর আনন্দ সর্বদা নিজেকে উৎসর্গ করে, এই উৎসর্গই তাঁর সৃষ্টি। যিনি সর্বত্র বিচ্ছুরিত, তাঁর বহুধা শক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি উৎস, তিনি প্রেরণা, তিনি পরিণাম।

মানুষ যখন তার সমস্ত কর্ম ব্রহ্মকে সমর্পণ করে, যখন কর্মের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ব্রহ্মের কাছে উৎসর্গ করে, তখন সেখানে পরিপূর্ণতা থাকে, মুক্তি থাকে, তখন বিশ্বজগতে ঈশ্বরের রাজত্ব আসে, ব্রহ্মের আনন্দ মূর্ত হয়। যে সাধক ব্রহ্মানন্দ লাভ করেন, তাঁর আনন্দ সমস্ত দৈনিক কর্মের মধ্যে, সৌন্দর্যের মধ্যে, শৃঙ্খলার মধ্যে, মঙ্গল সাধনের মধ্যে অভিব্যক্ত হয়।

The Realisation of Beauty (সৌন্দর্যের উপলব্ধি) প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ আর্বানায় বসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পর্যায়ের বক্তৃতার জন্য লিখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বক্তৃতাটি সেখানে দেননি। এই প্রবন্ধে তিনি সৌন্দর্যের উপলব্ধির আলোচনা করেছেন শুধুমাত্র শিল্পীর উপলব্ধি ও শিল্প অনুরাগীর উপলব্ধি রূপে নয়, সমগ্র জীবনের উপলব্ধি রূপে, ব্রহ্মোপলব্ধি রূপে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যে মানুষ সকল বস্তুকে ব্যক্তিস্বার্থ ও ইন্দ্রিয় লালসার অহরহ দাবি থেকে আলাদা ক’রে দেখার ক্ষমতা অর্জন করেন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান সুন্দরকে দেখার দৃষ্টি লাভ করেন। তখন তিনি উপলব্ধি করেন, যা সাধারণ দৃষ্টিতে অপ্রীতিকর তা অপরিহার্য ভাবে অসুন্দর নয়। সত্যের মধ্যেই তার সৌন্দর্য রয়েছে। সত্যের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে আমরা সৃষ্টির রীতি উপলব্ধি করি— আর সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য উপলব্ধি করি। আমাদের অস্তিত্বের পরম উপলব্ধি, ‘সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর’।

মানুষ তার আত্মিক সামঞ্জস্য সম্বন্ধে যত সচেতন হয় তত জগতের পরম আনন্দময় ভাব সম্বন্ধে তার ধারণা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। মানবজীবনে মঙ্গল ও প্রেমের মধ্যে দিয়ে সুন্দরের অভিব্যক্তি অসীমের দিকে এগিয়ে যায়। সৌন্দর্যের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে সত্য-দ্রষ্টারা নিঃস্বার্থ আনন্দের পরিপূর্ণ আস্বাদ পান। এই আনন্দ একমাত্র ব্রহ্মেই রয়েছে। পরমানন্দের প্রকাশ হয় শিল্পে, কাব্যে, সঙ্গীতে। শিল্প সৃষ্টির সীমিত বিন্যাসে অসীমের নীরব ও প্রত্যক্ষ প্রকাশ।

গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ The Realisation of the Infinite (অসীমের উপলব্ধি)। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন এই প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন তখন শিরোনাম ছিল Realisation of Brahma। সম্ভবতঃ অভারতীয়, বিশেষতঃ পশ্চিমের পাঠক পাঠিকারা ব্রহ্ম শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নাও হতে পারেন ভেবে ব্রহ্ম শব্দ পরিবর্তন ক’রে the Infinite (অসীম) শব্দটি “সাধনা” পুস্তকাকারে প্রকাশ করার সময় ব্যবহৃত হয়। প্রবন্ধের মধ্যে অবশ্য ব্রহ্ম শব্দের বার-বার ব্যবহার হয়েছে।

সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্রহ্মোপলব্ধি। রবীন্দ্রনাথ আলোচনার সূত্রপাত করেছেন মানুষের মনের চিরন্তন জিজ্ঞাসা দিয়ে, “ঈশ্বরলাভের স্বরূপ কী?” উপনিষদ বলেন, আত্মা যখন ঈশ্বরকে খোঁজে তখন সে যা খোঁজে তা হলো ‘নিত্যোহনিত্যানাম্,” সমস্ত অনিত্য বা অনৈক্যের মধ্যে নিত্য বা ঐক্য, “রসানাং রসতমঃ”, সমস্ত আনন্দরস একীভূত করা পরমানন্দ। ঈশ্বর বা ব্রহ্ম পরিপূর্ণতার আদর্শ। তিনি সর্বত্র বিরাজিত। সাধক যখন উপলব্ধি করেন যা কিছু রয়েছে সবই ব্রহ্ম-পরিব্যাপ্ত এবং মানুষের নিজস্ব যা কিছু আছে সবই তাঁর দান, তখন তিনি সীমার মধ্যে অসীমকে, দানের মধ্যে দাতাকে উপলব্ধি করেন। জ্ঞানের প্রক্রিয়া দিয়ে পরমাত্মাকে জানা যায় না। বুদ্ধিগত জ্ঞান আংশিক। আর আংশিক জ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে না। উপনিষদে বলা হয় মন কখনো ব্রহ্মকে জানতে পারে না, শব্দ কখনো তাঁকে বর্ণনা করতে পারে না; একমাত্র আত্মা তার আনন্দ দিয়ে, তার প্রেম দিয়ে তাঁকে জানতে পারে। আনন্দ পরিপূর্ণ জ্ঞান। প্রেমের জ্ঞান অপরোক্ষ জ্ঞান। মানুষের অন্তরাত্মায় পরমাত্মার উপলব্ধি এক পরিপূর্ণ সমাহিত অবস্থা। উপনিষদ বলেন যিনি আত্মার গভীরে নিহিত সত্যস্বরূপ অনন্তস্বরূপ ব্রহ্মকে জানেন, তিনি চেতনার অন্তরাকাশে সর্বজ্ঞ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি উপলব্ধি করেন ব্রহ্ম তাঁর মধ্যে বিরাজিত আর তিনি ব্রহ্মের মধ্যে। এখানেই সাধকের আধ্যাত্মিক সিদ্ধি বা মোক্ষলাভ।

যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের ভাষায় আধ্যাত্মিক উপলব্ধি প্রকাশ করা যায় না। সাধকের উপলব্ধির কিছু আভাস কাব্যের ভাষায় দেওয়া যায় মাত্র। “সাধনা” গ্রন্থে অনেক সময় দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গদ্যে গদ্য-কবিতার সুর, কখনো কখনো আলোচনা হয়ে ওঠে প্রার্থনা। দার্শনিকের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, কবির সংবেদনশীলতা ও সাধকের উপলব্ধি— এই তিন ধারার সঙ্গমে সাধনার গদ্যশৈলী অনবদ্য হয়ে ওঠে।

গ্রন্থটি একটু মনোযোগ সহকারে পড়লেই বোঝা যায় প্রবন্ধগুলির প্রতিটি বাক্য রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে রচনা করেছেন, প্রতিটি শব্দ সযত্নে চয়ন করেছেন। তাঁর শব্দচয়ন বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রীমতী সেমুর (Mrs. Saymour) লিখেছেন, “So sensitive was the poet to the spirit of the spoken word” (That Golden Time, 14)। এই সংবেদনশীলতা “সাধনা”র প্রতিটি শব্দকে মনোগ্রাহী ক’রে তুলেছে।

এই প্রবন্ধগুলির শ্রোতাদের অধিকাংশই যে বিদেশী এ’কথা সবসময় লেখকের মনে ছিল। বার-বার তিনি এমন শব্দ (term) ব্যবহার করেছেন যা পশ্চিমের ধর্মীয় আলোচনায় বা দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনায় সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমেরিকার শ্রোতারা তাঁদের পরিচিত শব্দে অপরিচিত ভারতীয় দর্শন সহজে যাতে বুঝতে পারেন এই ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। তবে এই সব শব্দ ব্যবহারের আরও একটি তাৎপর্য আছে। প্রবন্ধগুলির প্রায় প্রতি পদক্ষেপে ভারতীয় দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে পশ্চিমের দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তাভাবনার তুলনামূলক আলোচনা রয়েছে, কখনো বিস্তারিত ভাবে, কখনো প্রচ্ছন্নরূপে। শব্দগুলির ব্যবহারের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন তুলনা শ্রোতা বা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রবন্ধগুলিতে যতিচিহ্ন ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে উল্লেখ করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে যতিচিহ্ন ব্যবহার করেছেন তা’তে তাঁর চিন্তাধারার (chain of thought) এক বিশেষ ধরণ লক্ষ্য করা যায়। যতিচিহ্নের ব্যাকরণ-শাস্ত্রীয় বেড়া ভেঙে নিজের গতিতে লেখকের চিন্তাধারা পাঠককে অতি সহজে তত্ত্বের বিচার বিশ্লেষণ থেকে ভাবের জগতে উন্নীত করে। জীবনের উপলব্ধি এক নতুন মাত্রায় প্রকাশিত হয়।

ইংরেজি ভাষার রচনাশৈলী ও বাঙলা রচনাশৈলী এক নয়, বাক্য গঠনও একরকম ভাবে হয় না। তবুও “সাধনা”র এই অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের বাক্য গঠন ও যতিচিহ্নের ব্যবহার যথাসম্ভব রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষার নিজস্ব মাধুর্যের মধ্যে দিয়ে Sadhana, the Realisation of Life পড়ে পাঠকের যে অনুভূতি ও উপলব্ধি হয়, বাঙলা রূপান্তরে এই অমূল্য গ্রন্থটি যাঁরা পড়বেন তাঁদেরও যাতে সেই অনুভূতি ও উপলব্ধি কিছু মাত্রাতেও হয়, এই ভাবনা থেকে “সাধনা” অনুবাদের এই প্রয়াস।

(৩)

“সাধনা” অনুবাদের দুরূহ কাজে প্রতি পদক্ষেপে আমাকে সাহায্য করেছেন বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগের অধ্যাপিকা ড. মায়া দাস। ভারতীয় দর্শনের উপর তাঁর নিজের গবেষণা এবং দীর্ঘ দিন ভারতীয় দর্শন পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার অনুবাদকে সমৃদ্ধ করেছে। আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে “সাধনা”র কিছু প্রবন্ধ পড়াতাম। এখনকার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের “সাধনা” পড়বার উৎসাহ আমাকে বিস্মিত করতো। আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য অধ্যাপক দিলীপকুমার মহান্ত আমাকে “সাধনা” গ্রন্থটি বাঙলায় অনুবাদ ক’রে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। পরেও অনুবাদের অগ্রগতি বারংবার জানতে চেয়ে তিনি আমাকে এই কাজে ব্রতী ক’রে রেখেছিলেন। বিশ্বভারতীর বাঙলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ শ্রদ্ধেয় প্রফেসর সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ও নির্দেশনা আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছে। বিশ্বভারতীর বাঙলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক-প্রধান প্রফেসর আলপনা রায় নানাভাবে আমাকে বাঙলা অনুবাদে নির্দেশনা দিয়েছেন। “সাধনা” অনুবাদের প্রারম্ভিক পর্যায়ে বিশ্বভারতীর বাঙলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক-প্রধান প্রফেসর যূথিকা বসু এই গ্রন্থ বাঙলায় ভাষান্তরিত করার রীতি সম্বন্ধে নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত যত্ন সহকারে আলোচনা ক’রে আমাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগার ও অভিলেখাগারের কর্মকর্তারা আমাকে নানা অজানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁদের আন্তরিক অকুণ্ঠ সহযোগিতা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি। রবীন্দ্রনাথের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণ সংক্রান্ত কিছু মূল্যবান তথ্য প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরতা ড. আলপনা মুখার্জী আমাকে জানিয়েছেন। তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সোৎসাহ সহায়তা আমার গবেষণায় প্রামাণিক তথ্য সংযোজন করেছে। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কম্পিউটারের কাজে সাহায্য করেছেন সৈয়দ খাইরুল আলম। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ইংরেজি ভাষায় “সাধনা” প্রকাশনার একশো ছয় বছর পরে সকলের সহযোগিতায় এর বাঙলা অনুবাদ করা সম্ভব হলো।

আশৈশব আমার সমস্ত শিক্ষা বিশ্বভারতীতে। “সাধনা”র এই অনুবাদ আমার গুরুপ্রণাম। শুভমস্তু।

টীকা

১. এজরা পাউন্ড ইংল্যাণ্ড থেকে যে ছয়টি কবিতা “পোয়েট্রি” পত্রিকার জন্য পাঠিয়েছিলেন সবগুলিই ইংরেজি গীতাঞ্জলির (Song Offering) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাউন্ড যখন কবিতাগুলি পেয়েছিলেন Song Offering তখনো প্রকাশিত হয়নি।

তথ্যসূত্র

অজিত চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অধিকাংশই বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবন অভিলেখাগারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৭৭, ৩৭ বর্ষ, সংখ্যা ২৮, পৃ. ১৫০, অজিত চক্রবর্তীকে লন্ডন থেকে ২৯ বৈশাখ, ১৩২০ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি।

Harvard Crimson পত্রিকা থেকে দেওয়া সমস্ত উদ্ধৃতি ড. আলপনা মুখার্জীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।

Imperfect Encounter: Letters of William Rothenstein and Rabindranath Tagore 1911-1941. Edited. with Introduction and Notes Mary M. Lago. Harvard University Press: Cambridge, Massachusetts, 1972.

পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা: কলিকাতা, ১৯৬৬

রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল, ষষ্ঠ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড: কলকাতা, ১৯৯৩

রবীন্দ্র-জীবনী ও রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রবেশক, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন, ১৩৪৩.

“বিশ্ববোধ,” শান্তিনিকেতন ১০, রবীন্দ্র-রচনাবলী, সুলভ সংস্করণ, সপ্তম খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৯৫: ১৯১০ শক, পৃ. ৭২১-৭২৮

“কর্মযোগ,” শান্তিনিকেতন ১৩, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ষোড়শ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৬৫, পৃ. ৩৪৩-৩৫৬

Sadhana the Realisation of Life, Rabindranath Tagore, Macmillan and Co. Ltd., St. Martin’s Street: London, 1930

Saint Sara: The Life of Sara Chapman Bull, Prabrajika Prabuddhaprana, Sri Sarada Math: Calcutta, 2002

“Tagore in America,” Stephen N. Hay, American Quarterly, vol. 14, No. 3, Fall 1962

“Tagore in Urbana: Illinois”, Harold M. Hurwitz, Indian Literature, vol.4, Tagore Number, 1961, Sahitya Akademi: New Delhi

“That Golden Time”, Mayce F. Seymour, The Visva-Bharati Quarterly, (Ed.) Kshitis Roy, vol. 25, No. 1, Summer 1959, 1-15

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *