অনীশ – ০৭

মাথার যন্ত্রণা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মিসির আলি তাঁর নোটবই লিখে ভরিয়ে ফেলছেন। রূপার লেখা বারবার করে পড়ছেন। স্বামীর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েটির এই ভয়াবহ সমস্যায় স্বামীর অংশ কতটুকু তা বের করা দরকার।

রূপার পুরো লেখাটা স্বামীর প্রতি ঘৃণা নিয়ে লেখা; তার পরেও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি তার স্ত্রীকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো আলাদা বাসা ভাড়া করেছে।

মিসির আলি তাঁর নোটবইতে লিখলেন—আমাকে ধরে নিতে হবে মেয়েটি মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ নয়। সে পৃথিবীকে তার অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে দেখছে এবং বিচার করছে। স্বামীকেও সে একইভাবে দেখছে। সে তার স্বামীর ছবি যে-ভাবে এঁকেছে তাতে তাকে ঘৃণ্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে, অথচ এই মেয়ে তার মা’র ছবি এঁকেছে গভীর মমতায়। মা’র ছবি এত মমতায় আঁকা সত্ত্বেও মা’র ভয়াবহ রূপ বের হয়ে এসেছে। আমার কাছে জয়নাল ছেলেটিকে হৃদয়বান ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। এই ছেলে দু’ জন নিঃসঙ্গ মহিলাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে হাসির গল্প করে। তাদের হাসাতে চেষ্টা করে। ছেলেটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে—তার স্ত্রীর সন্তানটি তার নয়। তার পরেও সে স্ত্রীকে গ্রহণ করেছে। ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। এবং বলছে মেয়েটা ভালো।

রূপা শিশুর কান্না শুনছে। এটা কেন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। মিসির আলি নোটবইতে কবে-কবে কান্না শোনা গেল তা লিখে রাখতে শুরু করলেন। এর থেকে যদি কিছু বের হয়ে আসে।

‘স্যার, টেইন দেইখ্যা আসছি।’

মিসির আলি লেখা থামিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কি দেখে এসেছ?’

‘ট্রেইন। রেলগাড়ি। আপনে বললেন রেলগাড়ি দেখতে। চলন্ত রেলগাড়ি কী রঙে দেখা যায় দেখতে কইলেন। দেখলাম।’

‘কি দেখলে? কালো দেখা যায়?’

‘জ্বি—না, সবুজ দেখা যায়। সবুজ জিনিস, চলন্ত অবস্থায় যেমন সবুজ, থামন্ত অবস্থায়ও সবুজ। এইটা হইল আপনার সাধারণ কথা।’

মিসির আলি চিন্তিত মুখে বললেন, ‘সাধারণ ব্যাপারেও মাঝে-মাঝে কিছু অসাধারণ জিনিস থাকে বজলু। সেই অসাধারণ জিনিস খুঁজে বের করতে আমার ভালো লাগে। সারা জীবন তাই খুঁজেছি। কখনো পেয়েছি কখনো পাইনি। চলন্ত ট্রেন তোমাকে দেখতে বললাম কেন জান?’

‘জ্বি না।’

‘আমি লক্ষ করেছি উড়ন্ত টিয়া পাখি কালো দেখা যায়। সবুজ রঙ গতির কারণে কালো হয়ে যায় কি না, সেটাই আমার দেখার ইচ্ছা ছিল।

‘উড়ন্ত টিয়া পাখি কালো দেখা যায়, জানতাম না স্যার।’

‘আমিও জানতাম না। দেখে অবাক হয়েছি। আচ্ছা বজলু তুমি যাও, আমি এখন জরুরি একটা কাজ করছি। একটি মেয়ের সমস্যা নিয়ে ভাবছি।’

বজলু বলল, ‘গৌরীপুর থাইক্যা ডাক্তার সাহেব আসছেন। আপনেরে দেখতে চান।’

‘এখন দেখা হবে না।’

‘আপনার মাথাধরার বিষয়ে কথা বলতে চান।’

‘এখন কথাও বলতে পারব না। আমি ব্যস্ত। অসম্ভব ব্যস্ত।’

বজলু মানুষটার মধ্যে ব্যস্ততার কিছু দেখল না। কাত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। হাতে একটা খাতা। এর নাম ব্যস্ততা? বজলু মাথা চুলকে বলল, ‘রাতে কী খাবেন স্যার?’

‘চা খাব।’

‘ভাত-তরকারির কথা বলতে ছিলাম। হাঁস খাইবেন স্যার? অবশ্য বর্ষাকালে হাঁসের মাংসে কোনো টেস্ট থাকে না। হাঁস খেতে হয় শীতকালে। নতুন ধান উঠার পরে। নতুন ধান খাওয়ার কারণে হাঁসের শরীরে হয় চর্বি—

‘তুমি এখন যাও বজলু।

মিসির আলি খাতা খুললেন।

.

আমার স্বামী এম. এস. ডিগ্রী করার জন্যে আজ সকালে টেক্সাস চলে গেলেন। টীচিং অ্যাসিস্টেন্টশিপ নিয়ে গেলেন। যাবার টিকিট আমি করে দিলাম। তিনি বললেন, ‘আমি ছ’ মাসের মধ্যে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি পাসপোর্ট করে রাখ।’

আমি বললাম, ‘আমাকে নিতে হবে না। আমি ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাব না।’

‘ঢাকা ছেড়ে যাওয়াই তোমার উচিত।’

‘কোনটা আমার উচিত, কোনটা উচিত নয় তা আমি বুঝব।’

তোমার হাজব্যান্ড হিসেবে আমারও বোঝা উচিত।’

‘অনেক বুঝেছ, আর না।’

‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ স্পষ্ট করে বল।’

‘যা বলতে চেয়েছি স্পষ্ট করেই বলেছি।’

‘তুমি কি আমার সঙ্গে বাস করতে চাও না?’

আমি একটু সময় নিলাম। খুব বেশি না, কয়েক সেকেন্ড। এই কয়েক সেকেন্ডকেই মনে হল অনন্তকাল। তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম, ‘না।’

‘কি বললে?’

‘বললাম, না।’

‘ও, আচ্ছা।’

আমার স্বামী-ভদ্রলোক অনেকক্ষণ তাঁর মুখে বিস্ময়ের ভাব ধরে রাখলো। তারপর আবার বললো, ‘ও আচ্ছা।’

আমি বললাম, ‘আমি যে তোমার সঙ্গে বাস করতে চাচ্ছি না, তা কি তুমি বুঝতে পার নি?’

‘না, পারি নি।’

আমি হাসলাম। তিনি বললো, ‘তোমার টাকাটা আমি পৌছেই পাঠিয়ে দেব। দেরি করব না।’

‘দেরি করলেও অসুবিধা নেই। না-পাঠালেও ক্ষতি নেই। আমার যা আছে তা আমার জন্যে যথেষ্ট।’

‘তুমি কি আবার বিয়ে করবে?’

‘জানি না, করতেও পারি। করার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘যদি বিয়ে করবে বলে ঠিক কর—তাহলে অবশ্যই সেই ভদ্রলোককে আগেভাগে জানিয়ে দিও যে তোমার মাথার ঠিক নেই। তুমি অসুস্থ একজন মানুষ।’

‘আমি জানাব।’

.

ঊনি চলে যাবার পর আমি পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। নিজেকে ব্যস্ত রাখার অনেক চেষ্টা করলাম। পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করে আড্ডা দিই। মহিলা সমিতিতে নাটক দেখি, বই পড়ি, রাতে কড়া ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে যাই।

এক রাতের কথা, বিশ মিলিগ্রাম ‘ইউনেকট্রিন’ খেয়ে ঘুমিয়েছি। ঘুমের মধ্যেই মনে হল আমার ছেলেটা আমার পাশে শুয়ে আছে। তার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। সেই অদ্ভুত গন্ধ, যা শুধু শিশুদের গায়েই থাকে। একেকজনের গায়ে একক রকম গন্ধ, যা শুধু মায়েরাই আলাদা করতে পারেন। আমি ছেলের মাথায় হাত রাখলাম। মাথাভর্তি চুল। রেশমের মতো নরম কোঁকড়ানো চুল।

ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কোথাও কেউ নেই, থাকার কথাও নয়। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। কিন্তু সেই স্বপ্ন এত স্পষ্ট! সত্যের এত কাছাকাছি? তৃষ্ণা পেয়েছিল। ঠাণ্ডা পানির জন্যে খাবার ঘরে গিয়েছি, ফ্রীজের দরজায় হাত রেখেছি—আর ঠিক তখন শুনলাম আমার ছেলে আমাকে ডাকছে—’মা, মা।’

এতদিন শুধু কান্নার শব্দ শুনেছি। আজ প্রথম তাকে কিছু বলতে শুনলাম। আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে গেল। মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় ডাকলাম, ‘ও খোকা। খোকা! তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?’

কী আশ্চর্য কাণ্ড, আমার ছেলে জবাব দিল! স্পষ্ট বলল, ‘হু’।

‘তুই কোথায় খোকা?’

‘উঁ।’

‘খোকা তুই কোথায়?’

‘উঁ।’

‘তুই কোথায়? আরেক বার আমাকে ডাক তো! আর মাত্র একবার।’

আমার ছেলে আমাকে ডাকল-‘মা, মা।’

আমি সহ্য করতে পারলাম না। অচেতন হয়ে পড়ে গেলাম।

আমি জানি এর সবটাই মায়া। একধরনের বিভ্রম। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। দুঃখে-কষ্টে-যন্ত্রণায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে পাগলা গারদে ঢুকিয়ে দেবে। একটা নির্জন ঘরে আটকা থাকব। নিজের মনে হাসব, কাঁদব। গায়ের কাপড়ের কোনো ঠিক থাকবে না। অ্যাটেনডেন্টদের কেউ-কেউ আমার গায়ে হাত দিয়ে আনন্দ পাবে। আমার কিছুই করার থাকবে না।

এই সময় আমার এক বান্ধবী রেনুকা বলল, ‘বুড়ি, তুই ছবি করবি? আমার মামা ছবি বানাচ্ছেন। অল্পবয়সী সুন্দরী নায়িকা খুঁজছেন। তোকে দেখলে হাতে আকাশের চাঁদ পাবেন। তুই এত সুন্দর!’

আমি বললাম, ‘তোর ধারণা আমি সুন্দর?’

সে বলল, ‘পৃথিবীর চারজন রূপবতীর মধ্যে তুই একজন। সেই চারজনের নাম শুনবি? তুই, তারপর হেলেন অব ট্রয়, কুইন অব সেবা, ক্লিওপেট্রা। তুই রাজি থাকলে মামাকে বলে দেখি।’

‘আমি তো অভিনয় জানি না।’

‘বাংলাদেশি ছবিতে অভিনয় করার প্রথম এবং একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে অভিনয় না-জানা। তুই অভিনয় জানিস না শুনলে মামা আনন্দে লাফাতে থাকবে। করবি অভিনয়?’

‘করব।’

‘চল, এখনই তোকে মামার কাছে নিয়ে যাই।’

প্রথম ছবি হিট করল। দ্বিতীয় ছবি হিট করল। তৃতীয়টা হল সুপার হিট। ছবি করা তো কিছু না—নিজেকে ব্যস্ত রাখা। ডাবল শিফট কাজ করি, অমানুষিক পরিশ্রম। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়ে মড়ার মতো ঘুমাই। অনেক দিন ছেলের কান্না শুনি না। কথা শুনি না, মনে হল আমার মনের অসুখটা কেটে গেছে। এতে আনন্দিত হবার কথা। তা হই না। আমার ছেলের গলা শোনার জন্যে ভূষিত হয়ে থাকি। তারপর একদিন তার কথা শুনলাম।

‘জায়া জননী’ ছবির ডাবিং হচ্ছে। পর্দায় ঠোঁট নাড়া দেখে ভয়েস দেওয়া। একটা বাক্য কিছুতেই মেলাতে পারছি না। ক্লোজআপে ধরা আছে বলে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। ঠোঁট মেলানোর চেষ্টা করতে-করতে মহা বিরক্ত বোধ করছি। ডিরেক্টর বললেন, ‘কিছুক্ষণ রেস্ট নাও রূপা, চা খাও। দশ মিনিট টী ব্রেক।

আমি আমার ঘরে চলে এলাম। নায়িকাদের জন্যে আলাদা একটা ঘর থাকে। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। আমি একা-একা চা খাচ্ছি। হঠাৎ আমার ছেলের গলা শুনলাম। প্রায় দু’ বছর পর শুনছি, কিন্তু এত স্পষ্ট! এত তীব্র! আমার শরীর ঝনঝন করে উঠল।

‘মা, ও মা।’

‘কি খোকা?’

‘তুমি কী কর? ‘চা খাচ্ছি।’

‘তুমি কোথায়?’

‘তুই কোথায় খোকা? তুই কোথায়?’

‘এই খানে।’

‘কী করছিস?’

‘খেলছি।’

‘ও খোকা। খোকা।’

‘কি?’

খোকা। খোকা।’

‘উঁ।’

‘কাছে আয়।’

আমার ছেলে কাঁদতে শুরু করল। তারপর সব আবার চুপচাপ হয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ডিরেক্টরকে বললাম, ‘আজ আর কাজ করব না। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন, আমার ভয়ংকর খারাপ লাগছে।’

সেই রাতে আমি একগাদা ঘুমের অষুধ খেলাম। মরবার জন্যেই খেলাম। ডাক্তাররা আমাকে বাঁচিয়ে তুললেন।

.

মিসির আলি খাতা বন্ধ করে ডাকলেন, ‘বজলু।’

বজলু ছুটে এল। মিসির আলি বললেন, ‘আমার ঢাকা যাওয়া দরকার। এখন যদি রওনা দিই তাহলে কতক্ষণে ঢাকা পৌঁছব!’

বজলু হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এখন কী যাইবেন? রাত দশটা বাজে।’

গৌরীপুর থেকে ঢাকা যাবার কোনো ট্রেন কি নেই? যে-ট্রেন শেষরাতে ছাড়ে? চল, রওনা দিয়ে দিই।’

‘স্যার, আপনের মাথাটা খারাপ।’

‘কিছুটা খারাপ তো বটেই। জ্যোৎস্না রাত আছে। জ্যোৎস্না দেখতে-দেখতে যাব।’

‘সত্যি যাইবেন?’

‘হ্যাঁ, সত্যি যাব। একটি দুঃখী মেয়ের সঙ্গে দেখা করা দরকার। খুব দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *