৪
ডাক্তার সাহেবের কথা সত্যি।
অপারেশন শেষ হবার পরপরই খবর ছড়িয়ে পড়ল রূপা চৌধুরী এই হাসপাতালে আছেন। হাজার-হাজার লোক আসতে থাকল। সে এক দর্শনীয় ব্যাপার!
মিসির আলি খবর পেলেন অপারেশন ঠিকঠাকমতো হয়েছে। মেয়েটি ভালো আছে। এটিও আনন্দিত হবার মতো ব্যাপার। তার দিয়ে যাওয়া খাতাটা পড়া শুরু করা যায়। পড়তে ইচ্ছা করছে না। অসুস্থ অবস্থায় কোনোকিছুতেই মন বসে না।
ক্যাট স্ক্যান করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায় নি। তার চেয়েও বড় কথা লিভারের সমস্যা বলে যা ভাবা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সমস্যা সেখানে নয়। মেডিক্যাল কলেজের যে-অধ্যাপক চিকিৎসা করছিলেন, তিনি গতকাল বলেছেন, ‘আপনার শরীরে তো কোনো অসুখ পাচ্ছি না। অসুখটা আপনার মনে নয় তো?’
মিসির আলি হেসে ফেললেন।
প্রফেসর সাহেব বললেন, ‘হাসছেন কেন? আপনি মনোবিদ্যার একজন ওস্তাদ মানুষ তা জানি—কিন্তু মনোবিদ্যার ওস্তাদ মানুষদের মনের রোগ হবে না, এমন তো কোনো কথা নেই। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ক্যান্সার হয়। হয় না?’
‘অবশ্যই হয়। তবে মনের রোগ এবং জীবাণু বা ভাইরাসঘটিত রোগকে এক লাইনে ফেলা ঠিক হবে না।’
‘আচ্ছা, ফেলছি না। আপনাকে আমার যা বলার তা বললাম, আপনার অসুস্থতার কোনো কারণ ধরা যাচ্ছে না।’
‘আপনি কি আমাকে হাসপাতাল ছেড়ে দিতে বলছেন?’
‘শুধু-শুধু কেবিনের ভাড়া গোনার তো আমি কোনো অর্থ দেখি না। অবশ্যি একটা উপকার হচ্ছে। বিশ্রাম হচ্ছে। যে-কোনো রোগের জন্যেই বিশ্রাম একটা ভালো অষুধ। সেই বিশ্রাম আপনি বাড়িতে গিয়েও করতে পারেন।
‘তা পারি।’
‘আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিই মিসির আলি সাহেব?’
‘দিন।’
‘ময়মনসিংহের গ্রামে আমার সুন্দর একটা বাড়ি আছে। পৈত্রিক বাড়ি— যা সারা বছর খালি পড়ে থাকে। আপনি আমার ঐ বাড়িতে কিছুদিন থেকে আসুন না।’
‘আপনার পৈত্রিক বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই বিশেষ ফেভার আপনি কেন করতে চাচ্ছেন? আমি আপনার একজন সাধারণ রুগী। এর বেশি কিছু না। আপনি নিশ্চয়ই আপনার সব রুগীদের হাওয়া বদলের জন্যে আপনার পৈত্রিক বাড়িতে পাঠান না।’
‘তা পাঠাই না……….।’
‘আমাকে পাঠাতে চাচ্ছেন কেন?’
‘আমি যদি বলি মানুষ হিসেবে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, তাহলে কি আপনার বিশ্বাস হবে?’
‘বিশ্বাস হবে না। যে-সব গুণাবলী একজন মানুষকে সবার কাছে প্রিয় করে তার কিছুই আমার নেই। আমি শুকনো ধরনের মানুষ। গল্প করতে পারি না। গল্প শুনতেও ভালো লাগে না।’
ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, ‘আমার বড় মেয়েটি আপনার ছাত্রী। তার ধারণা, আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। সে চাচ্ছে যেন আপনার জন্যে বিশেষ কিছু করা হয়।’
মিসির আলি হেসে ফেললেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখে—এটা তিনি লক্ষ করেছেন। যদিও তার কোনো কারণ বের করতে পারেন নি। অন্য দশ জন শিক্ষক যেভাবে ক্লাস নেন তিনিও সেভাবেই নেন। এর বেশি তো কিছু করেন না। তার পরেও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা এ-রকম ভাবে কেন? রহস্যটা কী?
‘মিসির আলি সাহেব!’
‘জ্বি।’
‘আমার বড় মেয়ের স্বামী ধনবান ব্যক্তি। আমার বড় মেয়ে চাচ্ছে তার খরচে আপনাকে বাইরে পাঠাতে, যাতে সর্বাধুনিক চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। আপনি রেগে যাবেন কি না এই ভেবেই এ-প্রস্তাব এতক্ষণ দিই নি।’
‘আপনার বড় মেয়ের নাম কি?’
‘আমার মেয়ে বলেছে আপনি তার নাম জানতে চাইলে নাম যেন আমি না বলি। সে তার নাম জানাতে চাচ্ছে না। আপনি কি আমার মেয়ের প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন?’
‘না, তবে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করব। আপনার পৈত্রিক বাড়িতে কিছুদিন থাকব। বাড়ি নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?’
‘হ্যাঁ—খুবই সুন্দর। সামনে নদী আছে। আপনার জন্যে নৌকার ব্যবস্থা থাকবে। ইচ্ছা করলে নৌকায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। পাকা বাড়ি। দোতলায় বারান্দা বেশ বড়। বারান্দায় এসে দাঁড়ালে ঘরে যেতে ইচ্ছা করে না—এমন।’
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না।’
‘গিয়ে দেখুন, এখন হয়তো করবে। অসুস্থ মানুষকে প্রকৃতি খুব প্রভাবিত করে। পরিবেশেরও রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে। আমি কি ব্যবস্থা করব?’
‘করুন।’
‘দিন পাঁচেক সময় লাগবে। আমি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থাও করব। আমার ছাত্র গৌরীপুর শহরে প্র্যাকটিস করে। তাকে চিঠি লিখে দেব, যাতে তিন-চার দিন পরপর সে আপনাকে দেখে আসে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। বজলু আছে। সে হচ্ছে একের ভেতর তিন। কেয়ার টেকার, কুক এবং দারোয়ান। এই তিন কাজেই সে দক্ষ। বিশেষ করে রান্না সে খুব ভালো করে। মাঝে-মাঝে তার রান্নার প্রশংসা করবেন। দেখবেন সে কত খুশি হয়।’
.
ডাক্তার সাহেবের পৈত্রিক বাড়ি বারোকাদায়।
ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ লাইনের অতিথপুর স্টেশনে নেমে ছ’ মাইল যেতে হয় রিকশায়, দু’ মাইল হেঁটে, এবং বাকি দু’-তিন মাইল নৌকায়।
মিসির আলির খুবই কষ্ট হল। অতিথপুর থেকে রওনা হয়ে বেশ কয়েকবার মনে হল, না-গেলে কেমন হয়? শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন একটামাত্র কারণে—ডাক্তার সাহেব নানান জোগাড়—যন্তর করে রেখেছেন। লোকজনকে খবর দেওয়া হয়েছে। এরপরে না—যাওয়াটা অন্যায়।
ডাক্তার সাহেবের পৈত্রিক বাড়ি খুবই সুন্দর। সম্প্রতি চুনকাম করা হয়েছে বলেই বোধহয়—–সবুজের ভেতর ধবধবে সাদা বাড়ি ঝকঝক করছে। বাড়ি দেখে খুশি হবার বদলে মিসির আলির মন খারাপ হয়ে গেল। এত বড় বাড়ি খালি পড়ে আছে। খাঁ-খাঁ করছে। কোনো মানে হয়? বাড়ির জন্যে তো মানুষ নয়, মানুষের জন্যেই বাড়ি।
বাড়ির সামনে নদী না—খালের মতো আছে। অল্প পানি। সেই পানিতেই পানসিজাতীয় বিরাট এক নৌকা। বজলু হাসিমুখে বলল—’স্যার, নৌকা আপনার জন্যে। বড় আপা চিঠি দিয়েছে—যেন প্রত্যেক বিকালে নৌকার মধ্যে আপনার চা দিই।’
‘ঠিক আছে, নৌকাতে চা দিও।’
‘আগামীকাল কী খাবেন, স্যার যদি বলেন। মফস্বল জায়গা। আগে-আগে না—বললে জোগাড়—যন্তর করা যায় না। রাতের ব্যবস্থা আছে কই মাছ, শিং মাছ। মাংসের মধ্যে আছে কবুতরের মাংস। মাছের মাথা দিয়া মাষকালাইয়ের ডাল রানধা করছি।’
‘যথেষ্ট হয়েছে। দেখ বজলু খাওয়াদাওয়া নিয়ে তুমি বেশি ব্যস্ত হয়ো না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ খুব কম। দুই পদের বেশি কখনো রান্না করবে না।’
বজলু সব ক’টা দাঁত বের করে হেসে ফেলল—
‘আপনি বললে তো স্যার হবে না। বড় আপা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন—লিখেছেন, স্যারের যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়। সবসময় খুব কম করে হলেও যেন প্রতি বেলা পাঁচ পদের আয়োজন হয়। আমি স্যার অনেক কষ্টে পাঁচ পদের ব্যবস্থা করেছি—কই মাছের ভাজি, শিং মাছের ঝোল, কবুতরের মাংস, বেগুন ভর্তা আর ডাল। আগামীকাল কী করি, এই চিন্তায় আমি অস্থির।’
‘অস্থির হবার কোনো প্রয়োজন নেই বজলু। আপাতত চা খাওয়াও।’
‘তাহলে স্যার নৌকায় গিয়া বসেন। বিছানা পাতা আছে। আপা বলে দিয়েছেন নৌকায় চা দেওয়ার জন্যে।’
মিসির আলি সাহেব নৌকাতেই বসলেন। তাঁর মন বলছে, বজলু তাঁকে বিরক্ত করে মারবে। ভালবাসার অত্যাচার, কঠিন অত্যাচার। একে গ্রহণও করা যায় না, বর্জনও করা যায় না।
নৌকায় বসে মিসির আলি একটা মজার জিনিস লক্ষ করলেন। খাল বরাবর আমগাছগুলি টিয়া পাখিতে ভর্তি। দশ-পনেরটি নয়, শত-শত। এরা যখন ওড়ে তখন আর এদের সবুজ দেখায় না। কালো দেখায়। এর মানে কী? টিয়া কালো দেখাবে কেন? চলমান সবুজ রঙ যদি কালো দেখায়, তাহলে তো চলন্ত ট্রেনের সবুজ কামরাগুলিও কালো দেখানোর কথা। তা কি দেখায়? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। বজলুকে একবার পাঠাতে হবে চলন্ত ট্রেন দেখে আসার জন্যে। সে দেখে এসে বলুক।
প্রথম রাতে মিসির আলির ভালো ঘুম হল না। প্রকাণ্ড বড় খাট—তাঁর মনে হতে লাগল তিনি মাঠের মাঝখানে শুয়ে আছেন। বাতাসও খুব সমস্যা করতে লাগল। জানালা দিয়ে এক-একবার দমকা হাওয়া আসে, আর তাঁর মনে হয় তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মাঝরাতে দরজা-জানালা বন্ধ করে তিনি বুড়ির খাতা নিয়ে বসলেন।