1 of 2

অনীশের জন্মদিন

অনীশের জন্মদিন

গতরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল।

বনের মধ্যের এই পর্ণকুটিরের টালির ছাদ ভেদ করে অনেক জায়গায় জল গড়িয়ে পড়েছিল। বাথরুমের বালতি, প্লাস্টিকের মগ, রান্নাঘরের ডেকচি সব বিভিন্ন জায়গায় পাততে হয়েছিল মেঝেতে মাঝরাতে উঠে।

শুধু ওর চৌপাই এবং বিছানাটা শুকনো ছিল। তবে সেজন্যে চৌপাইটাকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে ঘরের মধ্যে চারপাশে ঘুরপাক খেতে হয়েছিল।

এতসব ঝামেলা-ঝক্কি পুইয়ে ও যখন বাইরের গাছগাছালি, বাথরুমের টিনের চাল এবং টালির ছাদে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন রাত প্রায় দুটো।

চতুর্দিক থেকে পুলকভরা পাখির ডাক শুনতে শুনতে বর্ষাভোরের ঠাণ্ডা মিষ্টি আমেজে চাদর গায়ে-দিয়ে-শোওয়া অনীশ যখন চোখ মেলল, তখন ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, আজ ওর জন্মদিন।

বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে বাইরে চাদর-গায়ে দিয়ে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল অনীশ। হাওয়া নেই কোনো। কিন্তু নানারকম গাছগাছালি, লতাপাতা, পাখপাখালির নরম গা থেকে একটা সোঁদা সোঁদা বৃষ্টিভেজা বর্ষার গন্ধ উঠছিল। নানারকম পাতা, ফুল, ঘুঘুর বুকের খসে-পড়া পালক সব ঝরেছিল জঙ্গলের মধ্যে এদিকে ওদিকে।

চাদরটাকে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে নিজের মনে বলল, আজ আমার জন্মদিন! হঠাৎই, সম্পূর্ণ বিনা কারণে নির্জনবাসের একাকী—অনীশের, এই সকালে, এই প্রাকৃতিক পরিবেশে বড়ো ভালো লাগতে লাগল।

জন্মদিন ব্যাপারটা চিরদিনই ওর কাছে একান্ত নিরুত্তাপের ছিল। মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণত কোনো সমারোহ হয় না। অন্তত ওদের বাড়িতে হত না। বরাবর জন্মদিনের ভোরে ও একা নিজের ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াত। নিজের মুখ সেদিন সকালের আলোয় নতুন করে দেখত। কিন্তু প্রতিজন্মদিনে ওর ভীষণ খারাপ লাগত। মনে হত, একটা পাতা ঝরে গেল, একটা ফুল ঝরে গেল সাজানো তোড়া থেকে।

প্রতিজন্মদিনে বেলা বাড়লে ও বইয়ের দোকানে গিয়ে একটা বই কিনে তাতে লিখত, ‘আমার জন্মদিনে আমাকে দিলাম। ইতি—অনীশ।’

যৌবনে পা দিয়ে প্রথম ও জানতে পেরেছিল যে জন্মদিনটি, যে-জন্মায় তার কাছে ততটা না হলেও, যারা তাকে ভালোবাসে তাদের কাছে তা দারুণ একটা দিন। ও ওর জীবনে জন্মদিনের প্রথম উপহার পেয়েছিল মুনমুনের কাছ থেকে। এক শ্রাবণের বিকেলে বৃষ্টিভেজা গড়ের মাঠে মুনমুন ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। একটা হালকা গোলাপি এবং খুব হালকা নীলের কাজ করা টাই এবং ওই কাজের একজোড়া মোজা নিয়ে। উপহারের ওপর মুনমুনের হাতের ভালোবাসার গন্ধ লেগেছিল, ওর বুকের সমস্ত তরুণ নিষ্কলুষ আন্তরিক উত্তাপ সে উপহারকে উষ্ণ করে রেখেছিল।

এ পর্যন্ত আর কোনোদিন, আর কোনো উপহারে এত খুশি হয়নি ও।

ও তার আদরের মুনমুনের সঙ্গে একদিন ঘর বেঁধেছিল। সেই বাঁধা-ঘর অনেক বছরের জলে-রোদে কালবোশেখির ঝড়ে বড়ো একঘেয়ে, বিবর্ণ, বৈচিত্র্যহীন হয়ে গেছিল। আজ মুনমুন ইচ্ছে করলেও আর তেমন করে অনীশকে কোনো উপহার দিতে পারবে না। তা ছাড়া, বোধ হয় মুনমুনের সেই ইচ্ছেটাও আজ মরে গেছে।

ওর জীবনের খুশির, ভালো লাগার গ্রাফগুলো চুড়োতে পৌঁছেছিল যৌবনের প্রথমে, সেই প্রথম প্রদোষে, কিন্তু তার পর থেকেই সব উষ্ণতা, সব সুখ, সব আনন্দ নিম্নমুখী ঢাল বেয়ে ক্রমান্বয়ে জোরে নামতে থেকেছে।

আজ ও মধ্য যৌবনের সমতল উপত্যকায় একা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আর কেউ নেই। এই পাখিরা ছাড়া, এই ভোরের আশ্চর্য আবেশ ছাড়া, চতুর্দিকের ঘন গহন বন ছাড়া ওকে আনন্দিত করে, বা ওকে নিয়ে আনন্দিত হয় এমন কেউই আর অবশিষ্ট নেই।

তার প্রতি অনেকেরই ব্যবহার দেখে অনীশের মনে মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগত যে, ও আদপে জন্মেছিল কি না। ওর মনে হত ও বোধ হয় ভেসে এসেছিল। যে ভেসে আসে, তার কাছে পৃথিবীর কোনো সম্পর্কেরই কোনো শিকড় থাকে না। জন্মসূত্রে যেসব আত্মীয়তা ও পেয়েছিল সেসব সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও, ব্যবহারের গুণে যেসব সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠা করেছিল তাতেও বুঝি কোনো শিকড় ছিল না। তার মনকে সে সর্বতোভাবে অন্য অনেক মনে ওতপ্রোতভাবে, অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াতে চাইলেও কোনো মনেই তার সত্তা প্রোথিত থাকেনি। জোরে হাওয়া উঠলেই, স্বার্থের ঢেউ লাগলেই, তাদের নিজেদের সুখ, নিজেদের সাধ, নিজেদের ঘরের সঙ্গে কোনোরকম সংঘাত উপস্থিত হলেই তারা সজোরে তার কাছ থেকে সরে গেছে। ফলে, অনীশের কেবলই মনে হয়েছে যে, ও সত্যিই কোনো ভাসমান অনাদরের উদ্ভিদ। এ পৃথিবীতে ওর সত্যিই কোনো শিকড় নেই—নেই অপত্য স্নেহের উষ্ণ আশ্রয়ে, নেই প্রেমেরও পরমপেলব মাটিতে।

তাই, একা থাকলেই আজকাল বড়ো আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে ওর। ওর নিজের জন্যে একা একা স্বার্থপরের মতো ও কখনো কোনোদিন বাঁচতে চায়নি। কেউই হয়তো চায় না। কিংবা কে জানে, হয়তো একদল লোক থাকে, সব সময়ই ছিল; যারা শুধু নিজেদের জন্যেই নিজেদের সুখ ও স্বার্থর চরিতার্থতার জন্যেই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, বাঁচতে চায়। অনীশ যেহেতু তেমনভাবে বাঁচতে চায়নি এবং যেহেতু আজ অনীশের জীবন সম্বন্ধে কারোরই বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই—যেহেতু তার শুধুমাত্র নিজের জন্যেই তাকে এ পৃথিবীতে একজন লোকও চায়নি, অনীশের কেবলই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।

অনীশ এমন কোনো বিরাট প্রতিভাবান কেউ নয় যে, সে মরে গেলে ময়দানে তার স্ট্যাচু হবে। অনীশের এমন কোনো জাগতিক বা অজাগতিক বিরাট কর্ম ও কর্তব্য নেই করার যে, তাকে যেকোনোভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হবেই। তার মতো একজন, নির্গুণ,সাধারণ, সস্তা লোকের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াতে কারোরই কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। সে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় তার জন্যে চোখের জল ফেলার মতো একজনও লোক যে নেই, তাও অনীশ জানে। জানে যে, তাকে কেউই মিস করবে না তার নিজের জন্যে। অন্য অনেকের স্বার্থপূরণ করা ছাড়া, নিজের জন্যে কিছুই না পেয়ে, শুধু অন্য অনেক স্বার্থপর লোকদের স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্র হিসেবে বেঁচে থাকবার কোনো মানে যে নেই, একথা অনীশের বার বার মনে হয়।

অনীশ জানে না কেন আজকাল অনীশের কেবলই মরে যেতে ইচ্ছা করে। কতবার সে কুয়োর সামনে একা একা নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে স্থির হয়ে দাঁড়ায়—কতবার বন্দুকের নল কপালে ঠেকিয়ে কীভাবে ঘোড়া টানবে তা ভাবে।

এই সকালে অনীশ এক প্রাপ্তিহীন জীবন ও বিফল; ব্যর্থ শীতল মৃত্যুর মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে আজ ও কী করবে? কী ওর করা উচিত।

কিন্তু জীবন, জীবনের নিরন্তর প্রবহমান স্রোত কারো জন্যেই থেমে থাকে না। অনীশের জন্যে তো নয়ই। তাই অনীশকেও উদ্দেশ্যহীনভাবে সে স্রোতে ভাসতে হয়, যতদিন না নিজের চেষ্টায় নিজেকে ও অকালে থামায়।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল অনীশ। আজ ওদের যেতে হবে টোড়িতে। চান্দোয়া-টোড়ি। সেখানে বড়ো হাট বসবে শনিবারে। ধানের বীজ কিনতে যাবে ও। বর্ষা নেমে গেছে। এখন না লাগালে আর ধান লাগানো যাবে না। সকলেই বলছে, এবার দেরি করে এলেও ভালোই বর্ষা হবে।

চা-জলখাবার খেয়ে চান-টান করে তৈরি হয়ে নিয়ে পাকদন্ডীর পথ দিয়ে মানি এবং মানির শাকরেদকে নিয়ে স্টেশনের দিকে চলল ও।

পথ গেছে উঁচু-নীচু টাঁড় পেরিয়ে। এখানে ওখানে মহুয়া গাছ, কুঁচ ফলের গাছ, পিটিসের ঝোপঝাড়; বুনো নিম। মাথার ওপর মেঘলা বিষণ্ণ আকাশ।

ওদের পায়ের শব্দে চমকে উঠে তিতির উড়ে গেল ঝোপ থেকে ডানা ফরফরিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে অনীশের আবার খুব ইচ্ছা হল মরে যেতে। কেবলই মনে হতে লাগল যে জীবনে বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট কারণ না থাকলে শুধু শুধু বেঁচে লাভ কী? তেমন করে তো লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোকই বেঁচে থাকে, শুধু বাঁচবার জন্যে। কিন্তু তা কি বেঁচে থাকা?

ও সবসময় খুব ভাবে, একা থাকলে বেশি ভাবে। ওই ওরাঁওদের সঙ্গে জংলি টাঁড় পেরোতে পেরোতে ওর মনটা হঠাৎ এক বিধুর বিষাদে ভরে যায়।

ওর জন্মদিনে ওর ভীষণ মরবার ইচ্ছা করতে থাকে।

ট্রেনটা এসে গেল। বাঁশের সঙ্গে বাঁধা দড়ি এবং ঝুড়ি নিয়ে মানিরাও ওর সঙ্গে উঠল। ওদের নিয়ে জনাকীর্ণ একটা থার্ডক্লাস কামরায় উঠে জানলার ধারে বসল।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। পাহাড়ে, জঙ্গলে, উঠতি-যৌবনের পাহাড়ি নদীর শরীরে নি:শব্দে ভরাট বৃষ্টি পড়ছিল।—ট্রেনটা সেই বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে চলল হু-হু করে—‘মহুয়া-মিলন’ পেরিয়ে।

দেখতে দেখতে এসে গেল টোড়ি। ট্রেন থেকে নেমে সব যাত্রীরা শোভাযাত্রা করে হাটে গিয়ে পৌঁছোল।

অনেকখানি জায়গাজুড়ে স্টেশান থেকে কিছু দূরেই হাট লেগেছে। মুরগি, ছাগল, টায়ার-সোলের জুতো, কাচের চুড়ি, তাজা সবজি, ছাতু-ভুজিয়া, নাপিত ভায়ার ব্রিক-সেলুন সবই আছে, নেই শুধু ধানের বীজ, যার জন্যে অনীশের আসা।

ওদের সঙ্গে নিয়ে সারাহাট তন্ন তন্ন করে খুঁজল অনীশ; কিন্তু কোথাও বীজ পাওয়া গেল না। ভুল খবর নিয়ে এসেছে সে। ভুল জীবনের মতো। এখানে।

এদিকে দুপুর প্রখর হয়েছে। মেঘের আড়ালে-থাকা সূর্যের যে তেজ তা আড়ালহীন সূর্যের তেজের চেয়েও অনেক বেশি। প্রখর খিদেও পেয়েছে। আজ যাইহোক ওর জন্মদিন, কিছু একটা ভালোমন্দ খেতে হয় তা সেলিব্রেট করার জন্যে। সকলেই তা করে, সেজন্যেই।

মানি আর কিনুকে অনীশ ছিটের জামা আর টায়ার সোলের চটি কিনে দিল। ওরা মহা খুশি। তার পর ছাতু খাওয়াল ওদের পেট পুরে।

এর পর ওরাই বলল, তুই কিছু খেলি না বাবু? ছাতু খাবি?

ও হাসল, বলল, ছাতু খেয়ে অভ্যেস নেই।

ওরা দূরের একটা হলুদ ফুল ফুল চাদরের শামিয়ানা-টাঙানো দোকান দেখিয়ে বলল, বাবু, ওখানে যা। গোস্তরুটি পাবি।

দোকানের সামনে ভিড় ছিল। মাটিতে একটা চাটাই পাতা। তাতে মিয়াভাইরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে খাচ্ছেন। ওর ভিড় ভালো লাগে না। একটু দূরে গাছতলায় বসে ও খাওয়ার ফরমাশ করল।

দূরে একটা অশ্বত্থগাছে অনেক কবুতর ওড়াউড়ি করছিল। একবার উড়ছিল, আর একবার বসছিল। সামনে সারি-বাঁধা খাপরার চালের ঘরগুলি। পেছনের স্টেশনে মালগাড়ি শান্টিং হচ্ছে। তার গদাম গদাম শব্দ ভেসে আসছিল। কাছেই একটা লাল-রঙা ঘোড়া, চরে চরে নতুন-গজিয়ে ওঠা ঘাস খাচ্ছিল। ঘোড়াটার নাকের সামনে একটা ঘাসফড়িং ঘুরে ঘুরে উড়ছিল।

ও গাছতলায় হেলান দিয়ে বসে দূরের কোনো নির্দিষ্ট বস্তু নয়; দূরের দিগন্তের বাড়িঘর, গাছপালা, আকাশ, সবকিছুর দিকেই চেয়েছিল। ওর চোখের লেন্স দুটোকে কোনো অদৃশ্য ক্যামেরাম্যান ‘ইনফিনিটি’তে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। দেখছিল, আবার দেখছিলও না। ও জেগেছিল, আবার ঘুমিয়েও ছিল। ওর সমস্ত সত্তার অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বও একইসঙ্গে এক অলস অঙ্গে বিরাজ করছিল।

এমন সময় একটা লুঙ্গি-পরা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, বাবু।

দেখল, লাল গোলাপফুল আঁকা কলাইকরা রেকাবিতে লাল দগদগে গোস্ত—এবং সঙ্গে মোটা রুটি—অন্য রেকাবিতে।

ছেলেটি বলল, খানা লায়া।

রেকাবিটা হাতে নিল, দগদগে গোস্তের দিকে একবার চাইল, ঠিক এমন সময় একটা সাদা দুধেল গোরু পেছন থেকে চরতে চরতে এসে ওর পাশে দাঁড়াল। গোরুটার বড়ো বড়ো কালো চোখ, গায়ে গোরুসুলভ মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। গোরুটা দু-বার কান নাড়ল পট পট করে। তার পর চরতে চরতে আবার চলে গেল।

ছেলেটাকে ডাকল। বলল, হো গায়া।

রেকাবিতে একটু আমড়ার চাটনি ছিল। চাটনিটুকু রুটির ওপর ঢেলে দিয়ে অনীশ একটি রুটি রেখে দিল। আর সব নিয়ে যেতে বলল।

রুটিটা খেতে খেতে ভাবতে লাগল, সে জন্মে থেকে এপর্যন্ত দারুণ কিছু ভালোভাবে না কাটলেও এত খারাপভাবেও আর কখনো ওর জন্মদিন কাটেনি। তাকে আজ সবাই ত্যাগ করেছে। তার জন্যে পৃথিবীর কারোরই আর কিছুমাত্র নরম অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।

রুটিটা গলায় আটকে গেল, তার পর জল দিয়ে দিয়ে কোনোক্রমে খেল সেটাকে ও। ওর ভেতরের অবুঝ ইমোশনাল লোকটার চোখ দুটো জলে ভরে এল।

রুমাল দিয়ে মুখটা মুছছিল। এমন সময় দেখতে পেল একজন ভদ্রলোক হাটের ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেন দ্রুতপায়ে ওরই দিকে আসছেন।

ভদ্রলোকের পরনে একটা সবুজ লুঙ্গি, মাথায় তালিমারা একটা ছাতা, হাতে হাট-করার লাল-রঙা কাপড়ের থলে।

ভদ্রলোক কাছে এসেই ছাতাধরা হাতের সঙ্গে অন্য হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন।তার পর অবাক-গলায় বললেন, আপনি? এখানে?

অনীশ চিনতে পারল না ভদ্রলোককে। বলল, আপনাকে…।

ভদ্রলোক হাসলেন, বললেন, ইন্দিরা গান্ধি কি সকলকে চেনেন?

অনীশ বলল, মানে?

ভদ্রলোক বললেন, আপনারা বিখ্যাত লোক, আপনাদের অনেকে চেনে, তা বলে কি আপনারা আপনাদের সব অ্যাডমায়ারাদের চিনতে পারেন? তা কি সম্ভব? আমাকে আপনি চেনেন না। একবার কলকাতায় একটা ঘরোয়া সাহিত্য-সভায় আপনাকে দেখেছিলাম।

পরক্ষণেই ভদ্রলোক আঁতকে উঠে বললেন, ওকী? আপনি এখানে খেলেন নাকি? উঠেছেন কোথায়? কবে এসেছেন?

অনীশ বলল, আমি খিলারিতে আছি। এখানে এসেছিলাম ধানের বীজ কিনতে। কিন্তু পেলাম না। এ ছাড়া তো খাওয়ার কোনো জায়গা নেই দেখলাম।

ভদ্রলোক একদৃষ্টে অনীশের মুখের দিকে চাইলেন।

বললেন, ফিরবেন তো বিকেলের গাড়িতে? গাড়ি সাড়ে তিন ঘণ্টা লেট। বীজ যখন পেলেনই না, তো চলুন আমার সঙ্গে, আমার কোয়ার্টারে।

ও অবাক হল। বলল, কেন বলুন তো?

ভদ্রলোক রাগ রাগ গলায় বললেন, কেন আর? খাবেন, বিশ্রাম করবেন; আর কেন? আমরা থাকতে এই রোদের মধ্যে মাঠে বসে গোস্ত-রুটি খাচ্ছিলেন আপনি? ছি: ছি:।

খাইনি। মানে কখনো খাইনি যে তা নয়। তবে এখানে বিশেষ করে আজ এ পরিবেশে খেতে পারলাম না।

ভদ্রলোক পাশে পাশে হাঁটছিলেন। ওর মাথায় ছাতা ধরে। অনীশ যেন সত্যিই ভীষণ কোনো দামি লোক।

হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, আজ মানে? আজ কি কোনো বিশেষ দিন?

ভদ্রলোকের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল, বলল, বিশেষ দিন কিছু নয়। তার পর অনিচ্ছার সঙ্গে বলে ফেলল, আজ আমার জন্মদিন।

ভদ্রলোক উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন কী দারুণ খবর শোনালেন আপনি। মা শুনে খুব খুশি হবেন।

ও কোনো কথা বলল না।

মানিদের বলে দিয়েছিল স্টেশনে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে যেন ওর জন্যে অপেক্ষা করে। ট্রেন যখন এত লেট তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে যেতে ওর কোনো আপত্তির কারণ ছিল না।

রেললাইন পেরিয়ে ওপাশে ভদ্রলোকের বাড়ি। বাড়ি মানে কোয়ার্টার। দুটি ঘর, মধ্যে একফালি উঠোন, বাইরে একটু বারান্দা। বাড়ির সামনে বেড়ামতো দিয়ে লাউ কুমড়ো লাগানো হয়েছে।

ভদ্রলোক বলেছিলেন, আমার নাম অনিমেষ। অনিমেষ রায়।

অনিমেষ দরজার কড়া নাড়লেন।

একটি বাচ্চা ছেলে এসে দরজা খুলল।

অনিমেষ ডাকলেন, মা, ও মা, দেখো কাকে এনেছি। এক্ষুনি পায়েস রাঁধো। আজ অনীশবাবুর জন্মদিন।

অনিমেষ অনীশকে নিয়ে একেবারে মহিলার ঘরে ঢুকে পড়লেন।

ভদ্রমহিলার বয়েস পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি হবে। উনি জানলার পাশের ইজিচেয়ারে শুয়ে কী একটা বই পড়ছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে অনীশের গায়ে মাথায় হাত বোলালেন।

বললেন, ওমা! এ যে দেখছি ছেলেমানুষ। তুমি বাবা এমন এমন বই লেখো কী করে?

অনিমেষ বলল, মা, উনি কিন্তু খাবেন।

ভদ্রমহিলা বললেন, খাবেন বই কী। আমাদের কী সৌভাগ্য বল দেখি। তুই এঁকে পেলি কোথায়?

অনিমেষ বলল, সেসব বলব মা, তুমি আগে পায়েসটা রেঁধে ফেলো।

বলেই অনিমেষ অনীশকে নিয়ে ওর ঘরে এলেন। বললেন, দেখুন। দেখেছেন?

ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দেখল, এই গন্ডগ্রামে বিহারের এই জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা ছোটো জায়গাতে অনিমেষের ঘরের দেওয়ালের তাকে অনীশের লেখা সমস্ত ক-টি বই-ই পর পর পাশাপাশি সাজানো আছে।

ও অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। মুখ নীচু করে চুপ করে রইল।

অনিমেষ একটা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল—বসুন।

জানলা দিয়ে অনিমেষের মুখে আলো এসে পড়েছিল। ক্লান্ত ক্লিষ্ট মুখ, কিন্তু মুখের মধ্যে ভারি একটা শান্ত নির্লিপ্ত ভাব। এ-ধরনের মুখে কখনো বিরক্তি দেখা দেয় না। এঁরা বোধ হয় বিরক্তি কাকে বলে জানেনই না।

অনিমেষ নিজেই কথা বলল। বলল, সামান্য একটা চাকরি করি কাঠের বড়ো ঠিকাদারের কাছে। মা ও ছেলের চলে যায় কোনোরকমে।

বিয়ে করেননি?

অনিমেষ লজ্জা পেল। বলল, মা চাপ দেন খুব, কিন্তু যা মাইনে পাই তাতে দুজনেরই চলে না ভালো করে। কিছু মনে করবেন না, আমার ভাবতেই খারাপ লাগে যে, একজন জলজ্যান্ত সুশ্রী যুবতী মেয়ে আমার জন্যে, আমারই কারণে কোনো দুঃখ পাবে। সত্যি ভাবলে খারাপ লাগে, বিশ্বাস করুন। কাউকে আদর করে রাখতে না পারলে এই ব্যাপারটা আমার কাছে স্বার্থপরতা বলেই মনে হয়।

তার পর অনিমেষ আবার বলল, আপনার লেখাগুলো পড়লে বড়ো কষ্ট হয়। কিন্তু জমজমাট মিলনান্তক লেখা লেখেন না কেন?

ও হাসল।

বলল, হয়তো লেখকের নিজের জীবনটা মিলনান্তক নয় বলে।

অনিমেষ উজ্জ্বল চোখ তুলে বলল, আপনার কি কোনো গভীর দুঃখ আছে?

কথাটা এড়িয়ে গেল। বলল, এমন মানুষ কি আছে, যার কোনো-না-কোনো দুঃখ নেই? যার নেই, বলতে হবে তার দুঃখবোধই নেই।

জানি না, তবে জানেন, আমার না মাঝে মাঝেই খুব মরে যেতে ইচ্ছা করে। যতদিন মা আছেন, ততদিন অবশ্য উপায় নেই। মা না থাকলে কিছু একটা করেও ফেলতে পারি। বলা যায় না। আমি খুব ইমোশনাল, সেন্টিমেন্টাল। আপনার লেখা তাই-ই বোধ হয় পড়তে এত ভালো লাগে। আপনার লেখা পড়লেই কিন্তু আমার খুব বাঁচতে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, জানেন? বিশ্বাস করুন, আপনার লেখা পড়লে মনে হয় দুঃখেরও একটা মহানুভবতা আছে, ঔদার্য আছে। মনে হয় দুঃখ, বোধ হয় শুধু ভয় করারই নয়, সমস্ত দুঃখ ছাপিয়েই বোধ হয় কোনো গভীর আনন্দ শেষপর্যন্ত হৃদয়ের ঘরে জমা হয়। জানি না কেন, সত্যি বলছি, আমার ভীষণভাবে একথা মনে হয়। মনে হয় দুঃখী লোকদের সুখটা কেবল দুঃখী লোকরাই বোঝে।

পরক্ষণেই অনিমেষ ছেলেমানুষের মতো অনীশের হাঁটু ছুঁয়ে বলল, দেখুন, আপনার কিন্তু অনেক দিন বাঁচতে হবে, আপনার ওপরে আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। বিশ্বাস করুন, বানিয়ে বলছি না। আপনার জন্মদিনে আমাকে কথা দিতে হবে।

অনীশ হাসল। বলল, আপনি বড়ো ছেলেমানুষ।

তা যা বলেছেন। আপনার চেয়ে মোটে দু-বছরের বড়ো।

এত বেশি ইমোশনাল হলে শুধু কষ্টই পাবেন। ইমোশনাল হওয়া বা ইমোশনাল লেখা, কোনো গুণের কথা নয়।

অনিমেষ হঠাৎ চুপ করে গেল। বলল, দোষ গুণ জানি না। বড়ো ভালো লাগে। যতদিন বাঁচব এমনি করে বাঁচতেই ভালো লাগে।

যাকগে এসব কথা। আপনি যে এসেছেন, আমার ঘরে বসে আছেন—একথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। জন্মদিনে, সকলে কী যেন বলে, কী যেন বলতে হয়—ওই যে, কী একটা বলে না ইংরিজিতে, ওঃ মনে পড়েছে। বলেই বলল, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে।

অনীশ জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েছিল।

ও মনে মনে বলছিল, এমন সার্থক জন্মদিন ওর জীবনে আর বুঝি কখনো আসেনি।

অনিমেষের শীর্ণ, অভাবগ্রস্ত, যুদ্ধরত সুন্দর সুপুরুষ মুখের দিকে তাকিয়ে অনীশ স্বগতোক্তি করল, বেঁচে থাকবেন অনিমেষ, আপনি আপনারা; আমার মতো কোনো হতভাগ্য স্বল্পখ্যাত লেখকের জন্যে। বদলে আমরা বেঁচে থাকব আপনাদের জন্যে। একজন সিনসিয়ার পাঠকের দেখা পাওয়ার চেয়ে বড়ো সার্থকতা, বড়ো পরিপূরণ, একজন স্বল্পখ্যাত লেখকের জীবনে আর কী থাকতে পারে?

ও বলল, মনে মনে, আপনি জানেন না, কখনো জানবেন না অনিমেষ, আজকে আপনি কী এক আশ্চর্য উপহার দিলেন। আমার সবচেয়ে বেশি মন খারাপের, একা একা জন্মদিনের সমস্ত মেঘলা আকাশের আদিগন্ত দ্বিধাকে আপনি কী দারুণভাবে দ্বিখন্ডিত করলেন।

ও আবারও মনে মনে বলল, এমন উপহার আমাকে আর কখনো কেউই দেয়নি, হয়তো দেবেও না কেউ, কোনো জন্মদিনে।

অনিমেষ একদৃষ্টে অনীশের মুখের দিকে চেয়ে বসেছিলেন। কথা বলছিলেন না কোনো। এমনভাবে চেয়ে যেন অনীশ মানুষ নয়, কোনো দেবতা-টেবতা।

ওই ঘরে বসে, হঠাৎ এক ক্বচিৎ কৃতজ্ঞতায় ওর সমস্ত মন নুয়ে এল। ও ভাবল, ও মনে মনে বলল, ওর কী সৌভাগ্য! ও একটু লিখতে পারে, ওর মনের জমানো কথাকে ও সত্যর কাঠামোতে বসিয়ে কল্পনার তুলি বুলিয়ে কত অচেনা লোকের মনে ছড়িয়ে দিতে পারে।

মনে হল, আজ থেকে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণকেই ও ওর জন্মদিন বলে মনে করবে।

নিজের জন্যে না হলেও, অন্যের জন্যে, অনিমেষদের জন্যে ওর বাঁচতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *